- বইয়ের নামঃ সাবরমতী
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. গল্পের নায়িকা রাজনন্দিনী
সাবরমতী – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
০১.
লিখতে বসে এক সে বিদেশী বিদেশী মনে পড়ে গেল। সেই গল্পের নায়িকা কোনো রাজনন্দিনী। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত, সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে রাতে ফিরে আবার ঘুমনো পর্যন্ত, তার প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত নিয়মের সাড়ম্বর শৃঙ্খলায় বাঁধা।
কিন্তু রাজকুমারীর মাঝে মাঝে মনে হয়, শিকলে বাঁধা।
সোনার শিকল। জলুস আছে, ছটা আছে। তবু শক্তপোক্ত শিকলই বটে। ভাঙে না, ছেঁড়ে না। এ শিকল দেখে লোকের চোখ ঠিকরয়, বেদনার দিকটা কারো চোখে পড়ে না। রাজনন্দিনীর চলা-ফেরা ওঠা-বসা, তার বেশ-বাস সাজ-সজ্জা আহার-বিহার আরাম-বিরাম তার হাসি-আনন্দ শোক-তাপ–এক কথায় তার গোটা অস্তিত্ব এক সুমহান রাজকীয় ঐতিহ্যের ধারায় সুনির্দিষ্ট। কোনো ফাঁক নেই, কোনো ব্যতিক্রম নেই। ফাঁক কেউ খোঁজে না, ব্যতিক্রম কেউ চায় না। এমন কি অনেক-অনেকদিন পর্যন্ত রাজকুমারীও খোঁজেনি, চায়নি। চেতনার শুরু থেকে সে-যেন একটানা ঘুমিয়ে ছিল। সেই ঘুমের ফাঁকে তার চেতনা কখনো সুদূরপ্রসারী হতে চায়নি। কোনো নিভৃতের রহস্যতলে মাথা খোড়েনি। সেই নিয়মের ঘোরে কোনো বেদনা গুমরে উঠতে চায়নি।
কিন্তু রাজকুমারীর ঘুম হঠাৎ একদিন ভেঙে গেল। তলায় তলায় এই ঘুম ভাঙার প্রস্তুতি চলেছিল কবে থেকে তা জানে না।
সেটা রাজকুমারীর যৌবনকাল।…আশ্চর্য, নিয়মের ছকে বাঁধা সেই শান্ত যৌবনে সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ লাগে কেমন করে। শান্ত যৌবন দুলে ওঠে ফুলে ওঠে কেঁপে ওঠে গর্জে ওঠে। হঠাৎ এ কি হল রাজকুমারীর! এ কি দারুণ যাতনা আর দারুন আনন্দ। ঐতিহ্যের বাঁধগুলো সব ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। সেই যৌবন মুক্ত হতে চায়, বন্য হতে চায়, সমুদ্র হতে চায়।
কিন্তু শুধু চায়। পারে না। পাল ছেঁড়ে না। হাল ঘোরে না।
শত শতাব্দীর নিয়মের বনিয়াদে ফাটল ধরে না। সত্তার আর এক দিক অটুট আভিজাত্যের নিশ্চিত বন্দরে বাঁধা। নিয়মের বন্দরে। অভ্যস্ততার বন্দরে। দিশেহারা দিকহারা হবার ঘোর কাটে একসময়। তাড়না সরে যায়। বহুদিনের বন্দী পাখি খাঁচা খোল পেলে যেমন তার ডানা উসখুস করে ওঠে, বাইরে বেরিয়ে আসে–অথচ খাঁচার অলক্ষ্য বন্ধন আবার তাকে ভিতরে টেনে নিয়ে যায়। ঠিক তেমনি করে নতুন অনুভূতির উত্তেজনা কাটিয়ে বিনা প্রতিবাদে আবার সে নিশ্চিন্ত শান্তির নৌকায় উঠে বসে। এ নৌকোর নোঙর ছেঁড়ে না।
রাজকুমারীর ভোগের উত্তেজনা আর ভোগের ক্লান্তি সম্বল।
কিন্তু একদিন….
রাজকীয় আভিজাত্যের সুতোয় গাঁথা মালা থেকে খসে-পড়া একটি দিন। সমস্ত হিসেবের বাইরের মুক্ত দিন একটা।
মাত্র একদিনের জন্য মুক্তি পেয়েছিল রাজকুমারী। রাজনীতির ছক-কাটা গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। অফুরন্ত মুক্তির বাতাসে ভাসতে পেরেছিল, হৃৎপিণ্ড ভরে নিতে পেরেছিল। সেই একদিনের জন্য রাজকুমারী ঐতিহ্যের শৃঙ্খলমুক্ত, রাজটিকার ছাপমুক্ত, পরিচয়শূন্য সাধারণ রমণী একটি। বৈশাখের মেঘের মত মাত্র একদিনের জন্য সেই রমণী নিরুদ্দিষ্ট হতে পেরেছিল। সহস্র সাধারণের জীবনের স্রোতের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পেরেছিল, সেই এক মুক্ত দিনের প্রতিটি পল প্রতিটি মুহূর্ত যেন আস্বাদনের বস্তু। শুধু তাই নয়, ওই একটি দিনের মুক্তির মধ্যেই সেই তৃষাতুর রমণীর যৌবন নামশূন্য রাজটিকাশূন্য আর এক অতি-সাধারণ পুরুষ-যৌবনের সন্ধান পেয়েছিল, স্পর্শ পেয়েছিল। তাদের হৃদয়ের বিনিময় ঘটেছিল–যে বিনিময়ের জন্য নারী আর পুরুষের শাশ্বত প্রতীক্ষা।
দুটি হৃদয় দুটি হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছিল।
কিন্তু একটা দিনের পরমায়ু কতটুকু আর?
দিন ফুরিয়েছে। রাজকুমারীর মুক্তির মিয়াদও। পরদিনই আবার তাকে রাজসম্মানের সেই পুরনো জগতে ফিরে আসতে হয়েছে। আগের দিনটা যেন স্বপ্ন। স্বপ্ন, কিন্তু সত্যি। যে পুরুষ-হৃদয়ের সঙ্গে তার অন্তরতম বিনিময় ঘটেছিল, এই সাড়ম্বর রাজকীয় বেষ্টনীর মধ্যে সে অনেক দূরের মানুষ। দূরেই থেকেছে। দূরে সরে গেছে। হৃদয় আকাশের দুটি ভাসমান মেঘ কাছাকাছি এসেছিল কেমন করে। মিলনমুখি হয়েছিল। কিন্তু মেলেনি। মিলতে পারলে ফলপ্রসূ হত, মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তার আগেই তারা থমকেছে। পরস্পরকে দেখেছে। চিনেছে। তারপর আবার যে যার দুদিকে ভেসে গেছে।
আর দেখা হয়নি। হবেও না।
রাজকুমারীর জীবনে আবার সেই প্রাণশূন্য পারম্পর্যশূন্য রাজ-আভিজাত্যে মোড়া একটানা দিনের মালা গাঁথা হতে থাকে। কিন্তু সেই মালার মাঝখানে দুলছে একটি মাত্র কক্ষচ্যুত দিনের স্মৃতি। হৃদয়ের সমস্ত অর্ঘ্য নিটোল শুচিশুভ্র একফোঁটা অশ্রু হয়ে মধ্যমণির মত দুলছে সেখানে।
.
কাহিনীটা মনে পড়তে লেখনী দ্বিধান্বিত হয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। আমার চোখের সামনে দুটি নারী-পুরুষের জীবন যে ছাঁদে যে ছন্দে ভিড় করে আসছে, দেশ-কাল-পাত্র হিসেবে ওপরের ওই কাহিনীর রমণীর সঙ্গে তাদের সহস্র যোজন তফাত। তবু কোথায় যেন মিল।
সাবরমতীর ধারে বসে সেই মিলের হিসেব মেলাতে গিয়ে বিস্ময়ের অন্ত নেই আমার। সেই বিস্ময়ের ঢেউয়ে দ্বিধা সরে গেছে। মানুষের নিভৃততম হৃদয়ের খবরে খুব বেশি রকমফের হয় না বোধহয়। হৃদয়ের তন্ত্রীতে আর এক হৃদয়ের স্পর্শ মুখর হয়ে উঠলে একই সুর বাজে বুঝি, একই ঝঙ্কার ওঠে। বিশ্ববেদনার একই সুর, বিশ্ব-হৃদয়ের একই রূপ। এই সত্যের নতুন পুরনো বলে কিছু নেই। যে সূর্য রোজ উঠছে, তার প্রথম আবির্ভাবের রূপটা চির-পুরাতন, কিন্তু চির নতুন। রাতের রজনীগন্ধা যে বারতা পাঠায় সেটা প্রত্যহের বারতা হলেও পুরনো বলে কে কবে তার প্রতি উদাসীন হতে পেরেছে?