- বইয়ের নামঃ রাধার চোখে আগুন
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
১. দোতলার বাসিন্দা
রাধার চোখে আগুন – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
পাশের বাড়ির দোতলার বাসিন্দাটির জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। এ-দিনের বাড়িঅলা এমন চট করে ভাড়াটে তুলতে পারে এ বড় দেখা যায় না। আজ সাত আট বছর পাশাপাশি আছি। খুব একটা হৃদ্যতা না থাক মোটামুটি সদ্ভাব ছিল। বাড়ির মেয়েদের সঙ্গেই ভাবসাব বেশি ছিল, পাশাপাশি বারান্দায় বা রাস্তায় আমার সঙ্গে দেখা হলে সবিনয়ে কুশল প্রশ্ন করতেন। তেমন দরকার হলে বয়োজ্যষ্ঠ হিসেবে পরামর্শ নিতে আসতেন।
কোর্ট-কাচারি নয়, তিন মাসের মৌখিক নোটিসে এমন দোতলা খানা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন শুনে অবাকই হয়েছিলাম। সামাজিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ওই দোতলার ফ্ল্যাটে এক-আধবার গেছি। মস্ত বড় দুখানা শোবার ঘর, অ্যাটাচড বাথ, সামনে বড়সড় ডাইনিং কাম সিটিং স্পেস। সংসার একটু বড় হবার দরুন হোক বা কিছুটা রুচির অভাবের কারণে হোক শেষেরটার মালপত্র বোঝাই গুদামঘরের হাল। সুন্দর বড়সড় কিচেন কাম স্টোর রুমেরও একই দৃশ্য। এক কথায় ভদ্রলোকের প্রয়োজন অনুযায়ী দোতলার এই পরিসরটুকু আদৌ যথেষ্ট ছিল না।
তবু ভদ্রলোক বেশ সুখেই বসবাস করছিলেন। নিজেই আফসোস করে বলেছিলেন, জলের দরের ভাড়ায় এখানে ছিলেন, তিন মাইল দূরে এর চারগুণ ভাড়ায় যে ফ্ল্যাটে যাচ্ছেন সেটা জানো ছোট তো বটেই, এই ফ্ল্যাটের সঙ্গে তার কোনো তুলনাই হয় না।
আমার স্বাভাবিক প্রশ্ন তাহলে তিনি এত সহজে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে যেতে রাজি হলেন কেন?
কারণ যা শুনলাম সেটুকু একেবারে পাশের পড়শী হিসেবে আমারও খুব ৰাঞ্ছিত মনে হল না। এ বাড়ি যার তিনি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার র্যাঙ্কের লোক। জাঁদরেল অফিসার এবং রাশভারী মানুষ। সদ্য রিটায়ার করেছেন। তিন মাসের মধ্যে সরকারি ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে। অতএব রিটায়ারমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও তাঁর ভাড়াটেকে নোটিশ দিয়েছেন তিন মাসের মধ্যে দোতলার এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে। ভদ্রলোক ওই পুলিশ অফিসারের বোনের দেওর, সেই সুবাদেই এত সস্তায় এই ফ্ল্যাটখানা সহজে পেয়ে গেছলেন তিনি। এত বছর ধরে আছেন, এক পয়সা ভাড়া বাড়ানোর তাগিদও কখনো আসেনি। একেবারে এই বাড়ি ছাড়ার নোটিস। ভদ্রলোকের বউদি অর্থাৎ পুলিশ অফিসারের সেই বোনও আর বেঁচে নেই যে তাঁর শরণাপন্ন হবেন। অতএব বাড়ির মালিকের কাছেই ছুটে গেছিলেন। একটাই আরজি, দু’বছর আগে একতলায় যে মাদ্রাজী ভাড়াটে এসেছেন তাকে তোলা হোক, একতলার এখন যা ভাড়া তিনি তাই দেবেন এবং একতলার ফ্ল্যাটে নেমে যাবেন।
বাড়ির পুলিশ অফিসার মালিক এটুকু শুনেই নাকি বিরক্ত, বলেছেন, সেটা করতে হলে কেসের ব্যাপারে দাঁড়াবে, তাছাড়া এক তলার ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাত্র ফ্যামিলি, তিনি নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চান–ওই ফ্যামিলি চলে গেলে একতলাও আর ভাড়া দেবেন না। অনুনয়ের জবাবে তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, আমার দরকারে ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবে এই কড়ারে তুমি ঢুকেছিলে, এখন সেই মতো ব্যবস্থা করো।
একে আত্মীয়, আর এই রকম কথাই হয়েছিল বটে। অনেকে ফ্ল্যাট আঁকড়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে, কিন্তু ভদ্রলোক আর ঝামেলার মধ্যে যেতে চান না। সদ্য রিটায়ারড, জাঁদরেল পুলিশ অফিসার, তাঁর প্রতিপত্তি কম হবার কথা নয়। ফ্ল্যাট ছেড়েই দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর ক্ষোভটুকু স্পষ্ট। বলেছেন তাঁর দোতলার দখল চাই, আর আমাকে একতলাটা দেবেন না, এটাই কথা–তাঁর তো দোতলায় ওঠার সিঁড়িও আলাদা, আমার বড় ফ্যামিলিতে তাঁর কি অসুবিধে হত বলুন তো? তাছাড়া নিজের বউ নেই, এক ছেলে তার বউ নিয়ে কোম্পানির দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকে, আর এক মেয়ে, তার বড় ঘরে বিয়ে হয়ে গেছে, দুজনেই তারা বাপকে মাথায় করে রাখার জন্য তৈরি তবু আমাকে উচ্ছেদ করে তার এখানেই এসে ওঠা চাই–থাকার মধ্যে সঙ্গে থাকবে পুরনো একজন কমবাইনড হ্যান্ড আর বড়জোর একটা চাকর।
ভদ্রলোকের এই ক্ষোভ আমার মনে অবশ্য দাগ কাটেনি। রাশ ভারী মানুষ, নিজের সঙ্গতি থাকলে অবসর নিয়েই ছেলে বা মেয়ের আশ্রিত হতে যাবেন কেন? ঘরে স্ত্রী না থাকার অভাবটা কত বড় এ-ও তাঁরই সমস্যা। কি লোক কেমন লোক কিছুই জানি না, পাশাপাশি বাড়ির দোতলার দুই সামনের বারান্দার মধ্যে বড়জোর সাত গজ ফারাক। দুবাড়ির মহিলারা তো যে যার বারান্দায় দাঁড়িয়েই কথাবার্তা চালান। সকালে বিকেলে এই সামনের বারান্দায় আমার অনেকক্ষণ পায়চারি করা অভ্যেস। লাগোয়া বারান্দায় চলতে ফিতে একজন দাপটের রিটায়ারড পুলিশ অফিসারের মুখ দেখতে হবে এটা পছন্দ না হওয়া নিজেরই মনের প্রসারতার অভাব হয়তো। আমাদের দেশের পুলিশদের আপনার জন ভাবাটা নীতির কথা আর কেতাবি কথা। কিন্তু কতজনে তা ভাবেন সে প্রসঙ্গ থাক।
একজন বড় ফ্যামিলি নিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেলেন দেখলাম। আর একজনের আসার তোড়জোড়ও দেখছি। দোতলার ফ্ল্যাটের সংস্কারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মনে হল ভাড়াটে কনট্রাক্টর আর মিস্ত্রীই যা করার করছে। মাঝে মাঝে গাড়ি হাঁকিয়ে দু’জোড়া অল্প বয়সী দম্পতীকে তদারকে আসতে দেখি। মনে হয় তারা রিটায়ার পুলিশ অফিসারের ছেলে-ছেলের বউ আর মেয়ে-জামাই হবে। আর একটি মাঝবয়সী লোককেও দেখি মাঝে মাঝে। সে ঠিক চাকর পর্যায়ের না, আবার ঠিক বাবুমানুষও না। দুইয়ের মাঝামাঝি গোছের একজন।