গত এক মাসের মধ্যে ননিমাধব অসাধ্যসাধনই করেছে প্রায়। তার সমস্ত আশা কেন্দ্রীভূত একখানা মোটর গাড়ি কেনা আর ব্যবসায়ে টাকা ঢালার মধ্যে। নিজের মাকে ধরে বাবার সঙ্গে পাপষ্টি একটা ফয়সালা করে নিয়েছে সে। বাপের টাকা যত, ছেলের প্রতি আস্থা তত নয়। তবে বিশ্বাস কিছু বিজনের ওপরে আছে, তার হাতে টাকাটা একেবারে নষ্ট হবে না। কিন্তু আপাতত নিদিষ্ট অঙ্কের বাইরেও তাকে চেক কাটতে হয়েছে ছেলের মতিগতির ব্যতিক্রম দেখেই।
গাড়ি হয়তো এতে শিগগির সত্যিই কেনার ইচ্ছে ছিল না বিজনের। কিন্তু গাড়ির খাতে পটনার আলাদা টাকা বার করে এনেছে, গাড়ি না কিনেই বা কর কি! না কেনা পর্যন্ত ননিমাধবের তাগিদেরও বিরাম ছিল না।
অতএব ফ্যাক্টরি বাড়ানোর জন্য আশাপ্রদ মূলধনই শুধু জোটেনি, নতুন গাড়িও একটা হয়েছে।
গাড়ি কেনার পর ননিমাধবের সর্বাগ্রগণ্য ডিউটি মাসিমা অর্থাৎ অর্চনার মাকে সেই গাড়িতে চড়ানো। তাতেও কিছুমাত্র বেগ পেতে হয়নি, কারণ ছেলেদের যে ব্যবসাটা মহিলা অবহেলার চোখে দেখে এসেছেন এতদিন, গাড়ি কেনার পরেই আর সেটা হেলাফেলার বলে মনে হয়নি। অতএব খুব খুশী হয়েই গাড়িতে চড়েছেন তিনি, আর চড়ার পরে ননিমাধবকেও একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন। প্রসন্ন মুখে গাড়ির প্রশংসা করেছেন, চমৎকার গাড়ি হয়েছে, এতটা পথ ঘুরে এলাম একটুও ঝাঁকুনি নেই
ননিমাধব বিগলিত। সাফল্যটা নাগালের কাছাকাছি এসে গেছে যেন। বলেছে, আর কটা দিন অপেক্ষা করুন না মাসিমা, আমি নিজেই ড্রাইভিংটা শিখে নিচ্ছি-ও ব্যাটার থেকে অনেক ভাল চালাব।
অর্থাৎ ড্রাইভারের থেকেও সে অনেক ভাল চালাবে।
এর পর মায়ের কাছে আর একটা প্রসঙ্গ উত্থাপনে বিলম্ব করাটা একটুও সমীচীন বোধ করেনি বিজন। অবশ্য দুপুরে খেতে বসে সেই উত্থাপনের সুযোগ মা-ই দিয়েছেন। অর্চনা-বরুণ। কলেজে, কাজেই আলোচনায় ব্যাঘাতও ঘটেনি। সকালে নতুন গাড়ি চড়ে আসার আনন্দটা মায়ের মনে লেগেছিল। তিনি বলেছেন, হা রে, এরই মধ্যে তোদের গাড়ি হয়ে গেল, ব্যবসা বেশ ভাল চলছে বল?
বিজন জবাব দিয়েছে, সবে তো শুরু, আর একটা বছর সবুর কর না, দেখ কি হয়–
আলোচনার সাক্ষী শুধু দাশু। অদূরে বসে কি একটা নাড়াচাড়া করছিল। দাদাবাবুর পরের কথাগুলো কানে যেতে গম্ভীর কৌতুকে মুখখানা তার আরো গম্ভীর। ওই এক প্রসঙ্গ থেকেই বিজন পার্টনারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।-ননিমাধবকে তো আর জান না, ওই রকম থাকে বলে। ওর মত ছেলে ক’টা হয়, ব্যবসায়ও তেমনি মাথা—
যেন সমস্ত ব্যবসাটা ওর মাথার জোরেই চলেছে। পাছে নজরে পড়ে যায় সেই ভয়ে দাশু একেবারে ঘুরে বসে নিঃশব্দ মুখভঙ্গি করেছে একটা। মা ওদিকে ছেলের প্রশংসাটা মেনেই নিয়েছেন, কারণ এরই মধ্যে একখানা গাড়ি করে ফেলা তো কম কথা নয়।
বিজন জানিয়েছে, একখানা কেন, আরো হবে। তার পরেই একেবারে আসল বক্তব্যে এসে পৌঁছেছে।-দেখ মা, ব্যবসা ছাড়া কোনদিন কেউ কিছু করতে পারে না, বুঝলে? একটা কলেজের মাস্টারকে এভাবে মাথায় তুলছ কেন তোমরা–অর্চনার বিয়ের ভাবনা তো? সব ঠিক আছে, সে-ভার তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও।
মিসেস বাসু অকুলে কুল পেয়েছেন। অতঃপর গৃহকর্তার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা ফলাও করে বিস্তার করেছেন তিনি। ছেলে গম্ভীর মুখে পরামর্শ দিয়েছে, বাবার কথায় কান দিও না, অর্চনাকেও একটু বুঝিয়ে-সুজিয়ে বলে।
অর্চনাকে বুঝিয়ে বলার আগেই বিকেলে দাশু ছোট দিদিমণির খাবার দিতে গিয়ে তার কাছে বিপদের পূর্বাভাস জ্ঞাপন করে রেখেছে একটু। দাদাবাবুরা তকতকে গাড়ি কিনেছেন, সকালে মাকে চড়ালেন, দাদাবাবু মায়ের কাছে খেতে বসে খুব সুখ্যাতি করছিল ননিবাবুর, বড় দিদিমণির আর ভাবনা নেই, বিয়ের পর গাড়ি চেপে খুব হাওয়া খাবে, ইত্যাদি।
দাশুর বচন নিয়েই মনের আনন্দে বরুণা দিদির পিছনে লেগেছিল। ভদ্রলোকের আর কোন আশাই নেই, আমি না হয় পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিয়ে আসি, মশাই গাড়িটাড়ি কিনতে পারেন তো এগোন, নয় তো কেটে পডুন! দাশ বলছিল, তোর আর একটুও ভাবনা নেই, ননিদা তোকে দিনরাত হাওয়া খাওয়াবে–
অর্চনার তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে দোরগোড়ায় মায়ের সঙ্গে বরুণার ধাক্কা লাগার উপক্রম। তিনি মেয়েকে বোঝাতে এসেছিলেন। বরুণা পাশ কাটিয়ে পালালো। মিসেস বাসু বিরক্তি প্রকাশ করলেন, মেয়ের চলাফেরা দেখ না!
মায়ের সাড়া পেয়েই অর্চনা পড়ার টেবিলে বসে বই টেনে গম্ভীর হতে চেষ্টা করল। ঘরে এসে মিসেস বাসু দুই-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন, তার পর হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, খবর শুনেছিস?
অর্চনা খবর শোনার জন্য ঘুরে বসল।
খাটের বিছানায় উপবেশন করে প্রসন্ন মুখে মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি, বিজু আর ননি চমৎকার নতুন গাড়ি কিনেছে–
তাই নাকি! অর্চনার বিস্ময়ে ভেজাল নেই।
হ্যাঁ, সুন্দর গাড়ি–কাল তোদের চড়াবে’খন। ওদের ব্যবসায়ও দিন-কে দিন উন্নতি হচ্ছে, আর ননিমাধবের কত প্রশংসা করছিল বিজু
ছদ্মত্রাসে অর্চনার চোখ বড় বড়।–তুমি যেন করে বোসো না মা প্রশংসা, তাহলে এক ডজন রুমাল প্রেজেন্ট করতে হবে ভদ্রলোককে!
ঠাট্টাটা আজ মায়ের একটুও ভাল লাগল না। বললেন, তোর সবেতে বাড়াবাড়ি, ঠাস ঠাস কথা বলতে পারলেই ভাবিস কি নাকি–