প্রিয় বাবা-মাঃ বাবার সঙ্গে আমার পছন্দের মিলটা খুব বেশি। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয় আমার। বাবার কথা বলার ঢঙ আমার খুব ভালো লাগে। খুব চমৎকার করে কথা বলতে পারেন তিনি। আর মায়ের সঙ্গে হচ্ছে আমার অন্যরকম সম্পর্ক। মায়ের সঙ্গে আমি সবসময় থেকে এসেছি। একজনের সঙ্গে সারাজীবন থাকলে যে রকম একটা টান হয়ে যায় ওরকম। আর বাবার মধ্যে অনেক জিনিস আছে, যেটা ভাল লাগার মতো, যা স্বাভাবিকভাবেই ভাল লাগে। আমি যদি বাবাকে নাও চিনতাম তাহলেও আমি হয়ত তাকে এত ভালোবাসতাম। বাবার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, কথা বলার আগে তিনি চিন্তা করে কথা বলেন, চিন্তা না করে একটা শব্দও বলেন না। তার বইয়ের রুচি, তার সিনেমার রুচি সব আমার খুব ভালো লাগে। আমার সঙ্গে খুব মেলে। কখনো লিখলে বাবাকে নিয়েই লিখব। আমার বাবা খুবই চালাক। তিনি খুব জটিল ভাষায় নিজের মতো করে কথা বলতে পারেন; তার কথা শুনে মনে হবে তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ! আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় এটা তার সবচেয়ে ভালো দিক। মাঝে মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে খারাপ দিক।
মা’র চোখেঃ ইকুয়েশন ফিহা বইটি আমি এখনো পড়িনি। আমার মনে হয়, নূহাশ এবং আমার সম্পর্কটা ওর সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্কের তুলনায় অনেক বেশি কাছের। আমি কখনো কাউকে তুই বলি না কিন্তু নূহাশকে আমি তুই বলি। ও বিখ্যাত না হলে কিছু যায়-আসে না বরং বিখ্যাত না হলেই আমি খুশি হবো। কারণ বিখ্যাত হওয়ার পর আমাদের পরিবারে একটা অঘটন ঘটে গেছে। আমি চাই ও তার বড় চাচার মতো, ইকবাল ভাইয়ের (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) মতো হোক। আমাদের ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নূহাশ এবং শিলা। নোভা, শিলা, বিপাশা যখন ছোট ছিল তখন তারা একটা সুখী পরিবার দেখেছে। ওই রকম পারিবারিক আনন্দস্মৃতি নূহাশের নেই। ওরা তিন বোন দেখেছে ওদের বাবা কি করেছে, যার জন্য ওরা বাবার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না। কিন্তু নূহাশ নিজ চোখে দেখেনি। ওর সবই আমাদের কাছ থেকে শোনা। তাই ওর ওপর প্রভাবটা পড়ে না। এ কারণে বাবার সঙ্গে ওর যোগাযোগটা আছে।
বাবার চোখেঃ নূহাশ একদিন এসে একটা মেয়ের ছবি আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা এই মেয়েটিকে আমার খুবই পছন্দ হয়, এই যে তার ছবি। আমার জায়গায় আমার বাবা হলে তো একটা ধাক্কার মতো খেতেন। আমি ধাক্কা খেলাম না বরং আগ্রহ নিয়ে ছবিটি দেখলাম। দেখে বললাম, ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে দেখতে তো খারাপ না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। নূহাশের খুব বই পড়ার নেশা। আমি বিদেশ থেকে প্রচুর বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস এবং ইংরেজি সাহিত্যের ইংরেজিতে লেখা বই কিনি। বইগুলো এনেই প্রথমে ভাগাভাগি করি। অর্ধেক আমার কাছে থাকে আর অর্ধেক নূহাশের কাছে। আমি যেহেতু খুব ব্যস্ত থাকি তাই নূহাশেরগুলো আগেই পড়া শেষ হয়ে যায়। এরপর সে আমারগুলোও নিয়ে যায়। নূহাশের অনুবাদ করা ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’ বইটি আমি পড়েছি। ও বেশ ভালই অনুবাদ করেছে। বইটির কিছু অংশ অনুবাদ করার পর প্রকাশক তার ইংরেজি অনুবাদ কেমন হচ্ছে জানতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক শফি আহমেদের কাছে মান যাচাইয়ের জন্য পাঠায়। তিনি তার ইংরেজি ভাষায় দখল দেখে বিস্মিত হন। আমি আশা করি নূহাশ ভবিষ্যতে অনুবাদ অব্যাহত রাখবে।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন
ইমদাদুল হক মিলন একবার হুমায়ূন আহমেদ এর সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন।
ইমদাদুল হক মিলন: আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন ‘৮৪-এর দিকে বোধহয় ? তার আগে, মাত্র চারটা বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন৷ এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা৷ আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হবার কথা ভাবলেন কী করে?
হুমায়ূন আহমেদ: হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সবসময়৷ যদি ভেতরে থাকে তাহলে ‘লেখালেখি’ বিষয়টা মাথার গভীরে একধরনের চাপ দিতেই থাকে৷ এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে৷ দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি৷ আবার আমি যে একজন লেখকও, ঐটাও তো মাথায় ছিল৷
মিলন: লেখালেখির ক্ষেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়৷ আপনার সে অস্বস্তিটা কি তৈরি হয়েছিল যে, এতদিন পরে আমি আবার শুরু করলাম!
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে মনে করতে পারছি না৷ মনে হয় না ছিল৷ কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা লেখালেখি করে, তারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না৷ অনেকদিন লিখিনি তাতে কি হয়েছে? আবার লিখব৷ ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব৷
মিলন: কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল নাকি আস্তে আস্তে?
হুমায়ূন আহমেদ: না, আমার মনে হয় এটা শুরু থেকেই ছিল৷ মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো৷ কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে খুবই চিন্তা-ভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে৷ একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে৷ দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না৷ এই অবস্থা৷
মিলন: এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পরে একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন৷ তারপর ‘৮৫-তে আপনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শুরু করেছিলেন৷ একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, এর পেছনে রহস্যটা কি বলে আপনার মনে হয়?