- বইয়ের নামঃ হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, আত্মজীবনী, জীবনী
গ্রন্থের ভূমিকায় নিজের কথা
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বেশকিছু গ্রন্থের ভূমিকা অংশে অকপটে নিজের কথা জানিয়েছেন।
উপন্যাস : বাদশাহ নামদার ফেব্রুয়ারি ২০১১-এর ফ্ল্যাপ
১৩ নভেম্বর মধ্যরাতে আমার জন্ম। সন ১৯৪৮। হ্যাঁ, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। লেখালেখি করে ত্রিশ বছর পার করলাম। আমি আনন্দিত, ক্লান্তি এখনো আমাকে স্পর্শ করেনি।
ধানমণ্ডির ১৮শ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে কাটছে আমার দিবস রজনী।
আমি কোথাও যাই না বলেই মাঝে মাঝে আমার ফ্ল্যাটে জম্পেশ আড্ডা হয়। যে রাতে আড্ডা থাকে না, আমি শাওনকে নিয়ে ছবি দেখি।
জোছনা আমার অতি প্রিয় বিষয়। প্রতি পূর্ণিমাতেই নুহাশ পল্লীতে যাই জোছনা দেখতে, সঙ্গে পুত্র নিষাদ, নিনিত এবং তাদের মমতাময়ী মা। প্রবল জোছনা আমার মধ্যে এক ধরনের হাহাকার তৈরি করে। সেই হাহাকারের উৎস অনুসন্ধান করেই জীবন পার করে দিলাম।
উপন্যাস সমগ্র—১ম খণ্ড
কুড়ি বছর আগের কথা।
বর্ষার রাত। বাইরে ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। আমি বইপত্র মেলে বসে আছি। থার্মোডিনামিক্সের একটি জটিল অংশ যে করেই হোক পড়ে শেষ করতে হবে।
হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল। কেমিস্ট্রির বইখাতা ঠেলে সরিয়ে দিলাম, লিখতে শুরু করলাম—
“রাবেয়া ঘুরে ঘুরে সেই কথা কটিই বারবার বলছিল।
রুনুর মাথা নিচু হতে হতে থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল।…”
আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস—নন্দিত নরকে। ঐ রাতে কেন হঠাৎ উপন্যাস লেখায় হাত দিলাম, কেনই বা এরকম গল্প মাথায় এল তা বলতে পারব না।
লেখকরা যখন লেখেন তখন তারা অনেক কিছুই বলতে চান। সমাজের কথা বলেন, কালের কথা বলেন, জীবনের রহস্যময়তার কথা বলেন। লেখার ভেতর আদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন—আমরা কোত্থেকে এসেছি? আমরা কারা ? আমরা কেনই বা এলাম ? আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
নন্দিত নরকে লেখার সময় আমার বয়স উনিশ-কুড়ির বেশি নয়। এই বয়সের একজন তরুণ কি এত ভেবে-চিন্তে কিছু লেখে ? আমার জানা নেই—আমি শুধু জানি, ঐ রাতে একটি গল্প আমার মাথায় ভর করেছিল। গল্পের চরিত্রগুলো স্পষ্ট চোখের সামনে দেখছিলাম, ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। ভেতরে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছিলাম—যেভাবে ওদের দেখছি হুবহু সেইভাবে ওদের কথা বলতে হবে এবং আজ রাতেই বলতে হবে। এই মানসিক চাপের উৎস কী আমি জানি না।
এক রাতে লেখা ষাট পৃষ্ঠার এই লেখাটির কাছে আমি নানানভাবে ঋণী। এই লেখাই আমাকে ঔপন্যাসিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছিল। এই একটি লেখা প্রকাশিত হবার পর অন্য লেখা প্রকাশে আমার কোনো রকম বেগ পেতে হয়নি।
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, নন্দিত নরকে আমার প্রথম উপন্যাস নয়। আমার প্রথম লেখা ‘শঙ্খনীল কারাগার’, প্রকাশিত হয় নন্দিত নরকের পরে।
শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটির সঙ্গে আনন্দ-বেদনার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমার বাবা আমার কোনো লেখাই পড়ে যেতে পারেননি—এই পাণ্ডুলিপিটি পড়েছিলেন। বাবা যাতে উপন্যাসটি পড়েন সেই আশায় আমি ভয়ে ভয়ে পাণ্ডুলিপিটি তার অফিসে অসংখ্য ফাইলের এক ফাঁকে লুকিয়ে রেখে এসেছিলাম। উপন্যাস পড়ে তিনি কী বলেছিলেন, তা এই রচনায় লিখতে চাচ্ছি না। পৃথিবীর সব বাবাই তাদের পুত্রকন্যাদের প্রতিভায় মুগ্ধ থাকেন। সন্তানের অতি অক্ষম রচনাকেও তারা ভাবেন চিরকালের চিরদিনের লেখা।
‘শঙ্খনীল কারাগার’ উৎসর্গ করি আহমদ ছফা এবং আনিস সাবেতকে। আহমদ ছফা আমার প্রথম উপন্যাস প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অসাধারণ একজন মানুষ। আনিস সাবেত—আরেকজন অদ্ভুত মানুষ! রোগা লম্বা বৈশিষ্ট্যহীন এই মানুষটি হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করেছিলেন। মানুষ ফেরেশতা নয়। তার মধ্যে অন্ধকার কিছু দিক থেকেই যায়। আনিস সাবেতের ভেতরে অন্ধকার বলে কিছু ছিল না। সচেতন পাঠক হয়তো লক্ষ্য করেছেন, আমার অনেক উপন্যাস ও নাটকে আনিস নামটি ঘুরেফিরে এসেছে। যখনই কোনো অসাধারণ চরিত্র আঁকতে চেয়েছি, আমি নাম দিয়েছি আনিস।
তখন দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। আমি, আহমদ ছফা এবং আনিস ভাই তিন জন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকি। আমাদের চোখে কত না স্বপ্ন! সাহিত্যের সাধনায় জীবন উৎসর্গ করব, চিরকুমার থাকব; জীবনকে দেখার ও জানার জন্যে যা করণীয় সবই করব। তারা দু’জন তাদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন। আমি পরাজিত হলাম জীবনের মোহের কাছে।
শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটি আরও একটি কারণে আমার বড় প্রিয়। এই লেখা পড়ে অষ্টম শ্রেণীর একটি বালিকা আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। তার নাকি বইটি বড় ভালো লেগেছে। তার ধারণা, বইটির লেখকও বইটির একটি চরিত্রের (খোকা) মতো খুব ভালোমানুষ। সে এই ভালোমানুষটির সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকতে চায়।
অষ্টম শ্রেণীর সেই বালিকা এখনো ভালোমানুষটির ( ?) সঙ্গেই আছে। তাকে নিয়ে সুখে-দুঃখে জীবনটা পার করেই ফেললাম। যখন পেছনের দিতে তাকাই, বড়ো অবাক লাগে।
শুধুমাত্র এই বালিকাটিকে অভিভূত করবার জন্যই আমি একটি উপন্যাস লিখি। নাম—নির্বাসন। সেই উপন্যাসটি তার নামে উৎসর্গ করা হয়। বালিকা আনন্দে অভিভূত হবার বদলে ভয়ে অস্থির হয়ে যায়। তার ধারণা হয়, তার বাবা-মা যখন উৎসর্গপত্রটি দেখবেন, তখনি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তার আশঙ্কা খুব অমূলক ছিল না।
‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ এবং ‘অচিনপুর’ এই দুটি রচনা ময়মনসিংহ শহরে লেখা। তখন ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। কাউকেই চিনি না। কথা বলার লোক নেই, গল্প করার কেউ নেই। কিচ্ছু ভালো লাগে না। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করি। একসঙ্গে অনেক গল্প মাথায় আসে। ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দিনরাত লিখি। শুধুই লিখি। কত কথা আমার বুকে জমা হয়ে আছে। সব কথা সবাইকে জানিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কারো সঙ্গে দেখা হলেই মনে হয়— এই মানুষটার জীবনটা কেমন ? কী গল্প লুকিয়ে আছে তার ভেতরে ? কিন্তু আগ বাড়িয়ে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। সব সময় নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাই। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যখন ঘরের একটি নিরিবিলি কোণ পেয়ে যাই, যেখান থেকে সামান্য একটু আকাশ দেখা যায়। এক চিলতে রোদপোষা বেড়ালের মতো পায়ের কাছে পড়ে থাকে। আমি বসে যাই কাগজ-কলম নিয়ে—‘আমি বলি এই হৃদয়েরে। সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।’
লিখে যাচ্ছি ক্রমাগত। কুড়ি বছর হয়ে গেল লেখালেখির বয়স। খুব দীর্ঘ সময় না হলেও খুব কমও তো নয়। অনেক লেখকই ক্রমাগত কুড়ি বছর লিখতে পারেন না। মৃত্যু এসে কলম থামিয়ে দেয়। কেউ কেউ আপনাতেই থেমে যান। তাদের লেখার ইচ্ছা ফুরিয়ে যায়। আমার অসীম সৌভাগ্য, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লেখার ইচ্ছা বেড়েই চলছে। আজকাল প্রায়ই বলতে ইচ্ছা করে— ‘জীবন এত ছোট কেন ?’
উপন্যাস সমগ্র-১ম খণ্ড, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯০
এই যে এত লিখছি, কী বলতে চাচ্ছি এসব লেখায় ? ‘চারপাশের দুঃসময়, গ্গ্নানিময় এবং রহস্যময় জগৎকে একজন লেখক গভীর মমতায় ভালোবাসেন’—এই কি আমার লেখার সার কথা ? নাকি এর বাইরেও কিছু আছে ? আমি জানি না—আমার জানতে ইচ্ছাও করে না। আমার ইচ্ছা করে—থাক। সব কথা বলে ফেলা ঠিক হবে না। কিছু রহস্য থাকুক।
হুমায়ূন আহমেদ
শহীদুল্লাহ হল।
মিসির আলী অমনিবাস, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৩
‘মিসির আলির কথা’ শিরোনামে নিজের কথা বলে নিই আমি। তখন থাকি নর্থ ডেকোটার ফার্গো শহরে। এক রাতে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি মন্টানায়। গাড়ি চালাচ্ছে আমার স্ত্রী গুলতেকিন। পেছনের সিটে আমি আমার বড় মেয়েকে নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। গুলতেকিন তখন নতুন ড্রাইভিং শিখেছে। হাইওয়েতে এই প্রথম বের হওয়া। কাজেই কথাবার্তা বলে তাকে বিরক্ত করছি না। চুপ করে বসে আছি এবং খানিকটা আতঙ্কিত বোধ করছি। শুধু মনে হচ্ছে, অ্যাকসিডেন্ট হবে না তো ? গাড়ির রেডিও অন করা। কান্ট্রি মিউজিক হচ্ছে। ইংরেজি গানের কথা মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে না। কিছু শুনছি, কিছু শুনছি না এই অবস্থা। হঠাৎ গানের একটা কলি শুনে চমকে উঠলাম—
বাঃ, মজার কথা তো! আমি নিশ্চিত, মিসির আলি চরিত্রের ধারণা সেই রাতেই আমি পেয়ে যাই। মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা।
আরো অনেক দিন পর ‘দেবী’ লিখি। মিসির আলি নামের অতি সাধারণ মোড়কে একজন অসাধারণ মানুষ তৈরির চেষ্টা ‘দেবী’তে করা হয়—একজন মানুষ, যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগৎ যিনি স্বীকার করেন না। সাধারণত যুক্তিবাদী মানুষরা আবেগবর্জিত হন। যুক্তি এবং আবেগ পাশাপাশি চলতে পারে না। মিসির আলির ব্যাপারে একটু ব্যতিক্রমের চেষ্টা করলাম। যুক্তি ও আবেগকে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দিলাম। দেখা যাক কী হয়।
যা হল তা অভাবনীয়! পাঠকরা মিসির আলিকে গ্রহণ করলেন গভীর ভালবাসায়। তাঁদের কাছে মিসির আলি শুধু গল্পের চরিত্র হয়ে থাকল না, হয়ে গেল রক্তমাংসের একজন—বিপদে যার কাছে ছুটে যাওয়া যায়।
আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয়, মিসির আলি বলে কি আসলেই কেউ আছে ? এই চরিত্রটি কি আমি কাউকে দেখে তৈরি করেছি ? তাঁদের অবগতির জন্যে বিনীতভাবে জানাই—না, মিসির আলিকে আমি দেখিনি। অনেকে মনে করেন, লেখক নিজেই হয়তো মিসির আলি। তাঁদেরকেও বিনীতভাবে জানাচ্ছি—আমি মিসির আলি নই। আমি যুক্তির প্রাসাদ তৈরি করতে পারি না এবং আমি কখনো মিসির আলির মতো মনে করি না—প্রকৃতিতে কোনো রহস্য নেই। আমার কাছে সব সময় প্রকৃতিকে অসীম রহস্যময় বলে মনে হয়।
মিসির আলিকে নিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখেছি। কিছু ভুলভ্রান্তিও করেছি। যেমন ‘অন্য ভুবনে’ মিসির আলিকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি বড় ধরনের ভুল। এই চরিত্রটি বিবাহিত পুরুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। মিসির আলিকে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবেই মানায়, যিনি ভালবাসার গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করেন; কিন্তু সেই ভালবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনো কাছে পান না।
ভুলত্রুটি সত্ত্বেও আমার প্রিয় চরিত্রের একটি হচ্ছে মিসির আলি। মিসির আলিকে নিয়ে লিখতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে। এই নিঃসঙ্গ, হৃদয়বান, তীক্ষষ্ট ধীশক্তির মানুষটি আমাকে সব সময় অভিভূত করেন। যতক্ষণ লিখি ততক্ষণ তাঁর সঙ্গ পাই, বড় ভালো লাগে।
হুমায়ূন আহমেদ
এলিফ্যান্ট পার্ক, ফেব্রুয়ারি-‘৯৩
সাইন্স ফিকশান সমগ্র, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯০
উনিশ শ’ পঁয়ষট্টি সালের কথা। ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি। বাবা-মা, ভাই-বোন ছেড়ে প্রথম থাকতে এসেছি হোস্টেলে। কিছুই ভালো লাগে না। কোনো কিছুতেই মন বসে না। দিন পনেরো অনেক কষ্টে থাকলাম। তারপর—‘দূর! আর পড়াশোনা করব না’—এই ভেবে রাতের ট্রেনে রওনা হয়ে গেলাম বগুড়ায়। হাতে চটি একটা রাশিয়ান বইয়ের বাংলা অনুবাদ। বইটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর। রাতের ট্রেনে গাদাগাদি ভিড়, আলোও কম, তার ওপর এক ঘুমকাতুরে যাত্রী বারবার ঘুমের ঘোরে আমার গায়ে পড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই পড়তে শুরু করলাম—‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ গল্পটি। কার লেখা এখন আর মনে পড়ছে না—শুধু মনে পড়ছে গল্প পড়ে আমি বিস্মিত, রোমাঞ্চিত ও মুগ্ধ। এ ধরনের গল্প তো আগে পড়িনি! এগুলি যদি সায়েন্স ফিকশান হয়, তাহলে এত দিন এইসব পড়িনি কেন ? একই গল্প ময়মনসিংহ পৌঁছবার আগে আগে তিন বার পড়ে ফেললাম। আমার নেশা ধরে গেল। সেই নেশা এখনো কাটেনি। এখনো আমার প্রিয় পাঠ্যতালিকার শুরুতেই আছে সায়েন্স ফিকশান। তারাশঙ্করের ‘কবি’ পড়ে আমি যে আনন্দ পাই, ঠিক সেই রকম আনন্দ পাই এসিমভের ‘এন্ড অব ইটারনিটি’ পড়ে। সম্ভবত আমার মধ্যে কোনো গণ্ডগোল আছে।
সায়েন্স ফিকশানের প্রতি গাঢ় ভালোবাসার কারণেই হয়তো আমার তৃতীয় প্রকাশিত বইটি একটি সায়েন্স ফিকশান—‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’, প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’তে। আমার ধারণা ছিল, কেউ এই লেখা পড়বে না। পড়লেও বিরক্ত হয়ে বলবে—এসব কি ছাইপাঁশ শুরু হল ? সাহিত্য কোন পথে যাচ্ছে ? আশ্চর্যের ব্যাপার—সে রকম কিছু হল না, বরং অনেকেই আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে লেখা পড়তে শুরু করলেন। খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি বইটি প্রকাশ করলেন। বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তারা সন্দিহান ছিলেন বলেই হয়তো একটা বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের ভাষা এরকম—
‘ছোটদের জন্যে লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
তবে বড়রাও পড়িলে মজা পাইবেন।’
‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ ভালোবাসার সঙ্গে পাঠকরা গ্রহণ করলেও আমি কিন্তু দ্বিতীয় সায়েন্স ফিকশান লেখার ব্যাপারে অনেক দেরি করলাম। প্রায় দশ বছর। কারণ খুব সহজ। আইডিয়া পাচ্ছিলাম না। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আইডিয়া ‘হুট’ করে মাথায় আসে না। আমার দ্বিতীয় সায়েন্স ফিকশানের ‘আইডিয়া’ মাথায় এল ঢাকা থেকে বরিশাল যাবার পথে—লঞ্চের কেবিনে। শীতের রাত। চাদর মুড়ি দিয়ে লঞ্চের কেবিনে বসে আছি, হাতে ঢাকা থেকে কেনা একগাদা ম্যাগাজিন। হঠাৎ কেবিনের দেয়ালে দৃষ্টি আটকে গেল— কুৎসিত একটা মাকড়সা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। এই প্রাণীটিকে কোনো এক বিচিত্র কারণে আমি অসম্ভব ভয় পাই। …একটি প্রকাণ্ড গ্রহে তিনটি মাত্র প্রাণী, দেখতে মাকড়সার মতো। তাদের বুদ্ধি অসাধারণ, কল্পনাশক্তিও সীমাহীন। তারা নির্জন, নিষ্প্রাণ গ্রহে ঘুরে বেড়ায় এবং সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কল্পনা করে। একসময় তাদের পরিচয় হল মানুষ নামের আরেক দল বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে। এই হচ্ছে ‘তারা তিন জন’-এর গল্প। ‘অন্য ভুবন’ গ্রন্থটির চিন্তা মাথায় আসে ছোট একটি মেয়েকে দেখে। মেয়েটির নাম তিনি্ন। সে গাছের সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে। তার গল্প বলার ধরন দেখে মনে হয়, সে গাছের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে; মাঝে মাঝে গাছের সঙ্গে রাগ করছে। মেয়েটির কাণ্ড-কারখানা দেখে আমার মনে হ’ত গাছের সঙ্গে আমাদের প্রাণের যোগ আছে। সেই যোগসূত্রটি এখন ছিন্ন। হয়তো বা এক সময় আমাদের ছেঁড়া সুতা জোড়া লাগবে, আমরা গাছের সঙ্গে কথা বলা শুরু করব।
‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি’তে আমি একটি চক্রের কথা বলতে চেষ্টা করেছি। চক্র এমন একটি ব্যাপার, যার শুরু নেই, আবার শেষও নেই। যে বস্তুর শুরু এবং শেষ নেই, তা হল অসীম। অথচ চক্র অসীম নয়, চক্র সসীম। ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি’ লেখার সময় আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। নতুন ‘আইডিয়া’ ব্যবহার করার গাঢ় আনন্দ।
‘ইরিনা’ লেখার পেছনে তেমন কোনো গল্প নেই। শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে যে, ইরিনা খুব ভেবেচিন্তে লেখা। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ছবি আঁকতে চেয়েছি। সমাজ ব্যবস্থাটা তখন কী রকম হবে ? শোষক এবং শোষিতের প্রাচীন সম্পর্ক তখনো কি থাকবে ? কারা হবে শোষিত ? ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষ কি অমর হবে ? অমরত্বের কোনো অভিশাপ কি তাকে স্পর্শ করবে ?
হুমায়ূন আহমেদ
শহীদুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
ছুটিরদিনে মুখোমুখি
জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ প্রথম বার চিকিত্সার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পথে রওনা হওয়ার দুই দিন আগে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর মুখোমুখি হয়েছিলেন ছুটির দিনের।
ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটবাড়ির দরজাটা হাট করে খোলা। আমরা আসব বলে নয়, গৃহকর্তা ঘরের দরজা সব সময় উন্মুক্ত রাখতে চান বলে। বসার ঘরে বসি। দেয়ালে ঝোলানো পূর্ণেন্দু পত্রী আর এস এম সুলতানের চিত্রকর্মে চোখ বোলাতে বোলাতেই গৃহকর্তা হুমায়ূন আহমেদ চলে আসেন আমাদের মাঝে। গায়ে সবুজরঙা বাটিকের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।
আমরা ঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় গিয়ে বসি। এক পাশে বুকশেলফ। সেটা এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা আর নানাবিধ জার্নালে ঠাসা। অন্য পাশে একটা অ্যাপল কম্পিউটার। একটা স্ট্যান্ডওয়ালা ফ্যান ঘুরছে। মাঝখানে একচিলতে বারান্দা।
হুমায়ূন আহমেদ গদিতে আয়েশ করে বসতে বসতে বলেন, শুরু করো। এরপর আমাদের কথোপকথন শুরু হয়।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় আপনার মেঘের ওপর বাড়ি উপন্যাসটি পড়েছি। ভালো লেগেছে। আপনার অন্য উপন্যাসের তুলনায় অন্য রকম।
হুমায়ূন আহমেদ: বইটা আরেকটু বিশদভাবে লেখার দরকার ছিল।
এ ধরনের আরেকটা বই আমি লিখেছিলাম। বইটার নাম যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ। এক লোক তাঁর বউকে খুন করে। মৃত বউয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে।
মেঘের ওপর বাড়ি বইটা লিখতে গিয়ে প্রধান যে সমস্যা হয়েছে, সেটা ধর্মীয়। মৃত্যুর পরবর্তী জগত্ নিয়ে যদি আমি এমন কিছু লিখি, যেটা ধর্মের সঙ্গে মেলে না, তাহলে ধর্মবিশ্বাসী লোকজন তো রাগ করবে। তবে এই বিষয় নিয়ে আগেও বই লেখা হয়েছে। আমাদের এখানে প্রথম এই বিষয় নিয়ে যিনি লেখেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বইটার নাম দেবযান। এই বইয়ে তিনি মৃত্যুর পরের জগতের অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই ভাবি। মৃত্যুর পরের জগত্ নিয়েও অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছি। সম্ভবত এটা থেকেই মেঘের উপর বাড়ি বইটার ভাবনা মাথায় এসে থাকবে।
ট্রেতে করে চা আসে। তিন কাপ। এই ফাঁকে সঙ্গী আলীম আজিজ প্রসঙ্গ পাল্টান
আলীম আজিজ: দীর্ঘদিন ধরে আপনি লেখালেখি করছেন, এখন পেছনে তাকালে কী মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ: মনে হয়, কিছু পরিশ্রম করেছি (হাসি)। কিছু অর্জন হয়তো আমার আছে। আমার স্ত্রী শাওন আমাকে বলে, ‘আমি খুব সৌভাগ্যবান একটা মেয়ে। কারণ, আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার স্বামী লিখছে। এর চেয়ে পবিত্র দৃশ্য আর কী হতে পারে!’ এই কথাটা আমাকে ভীষণ আনন্দিত করে। আমি ভালো বোধ করি। এটাই লেখক জীবনের বড় পাওয়া মনে হয়।
আলীম আজিজ: অতীতের অনেক তুমুল জনপ্রিয় লেখক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। লেখক হিসেবে আমার আজ প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, এত দিনে আসলে আর কোনো লেখক তৈরি হয়নি।
আমি নিজেকে মনে করি নতুন লেখকদের জন্য একটা বিভীষিকা। কথাটা বুঝিয়ে বলি। বিভীষিকা এই অর্থে যে, পাঠক বই কেনে লাইব্রেরি থেকে। বইয়ের বিক্রেতারা যেসব বই বিক্রি হবে, সেগুলো সাজিয়ে রাখে। যেগুলো বিক্রি হয় না, সেগুলো রাখে না। তারা তো সাহিত্যসেবা করতে আসেনি। তারা চায় বই বিক্রি করতে। আমার নতুন বই বের হবে, আমি জায়গা দখল করব। দখলকৃত জায়গার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। অন্যদের বই প্রদর্শন করারই সুযোগ নেই। এই অর্থে আমি একটা বিভীষিকা।
আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি। পাঠক বাড়ালে তো সবার বই-ই বেশি বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু আমার নিজের পাঠক বাড়িয়েছি। পাঠক যদি বাড়াতাম, তাহলে তো সব বইয়ের বিক্রি বাড়ত।
পড়ার ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত একটা বিষয়। যে বইটা তুমি পড়তে চাও না, সেটা তোমাকে বিনা পয়সায় উপহার দিয়ে সঙ্গে ২০০ টাকা দেওয়া হলেও তুমি বইটা পড়বে না। জোর করে আর যা-ই হোক, কখনো বই পড়া হয় না।
আলীম আজিজ: কলম্বিয়ার বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একটা বয়সে এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার। আপনার কি সে রকম কিছু মনে হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: আমারও প্রায়ই মনে হয়, একটা ঘোষণা দিয়ে লেখালেখি ছেড়ে দিই। ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম করি। কিন্তু এটা হবে একটা লোক দেখানো ব্যাপার। কারণ, আমি জানি, লেখালেখি ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার জন্য অসম্ভব। এই যে শরীরটরীর খারাপ, তাও কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। যেহেতু লেখালেখি ছাড়া থাকতে পারব না, আলতু-ফালতু ঘোষণা দিয়ে তো লাভ নাই। সাধারণত, আমি যে কথা বলি, সেটা রাখার চেষ্টা করি। যেমন, আমি বলতে চাই, ঘেটুপুত্র কমলা আমার পরিচালিত শেষ ছায়াছবি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ছবিটির কাজ কি শেষ?
হুমায়ূন আহমেদ: ছবির সব কাজ শেষ। শুধু প্রিন্টটা করা হয়নি। প্রিন্ট হচ্ছে ব্যাংককে। প্রিন্টিংয়ে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। টাকার অঙ্কটা মোটামুটি আঁতকে ওঠার মতো।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার সাম্প্রতিক কিছু লেখা পড়ে মনে হয়েছে, অমরত্ব বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে। ২০৪৫ সালের মধ্যে অমরত্বপ্রাপ্তির উপায় আবিষ্কৃত হবে—আপনি লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আমার কথা না। এটা বিজ্ঞানীদের কথা। আমিও বিশ্বাস করি। আমরা ক্রমশ সিঙ্গুলারিটির দিকে যাচ্ছি। কলম দাও, বুঝিয়ে বলি।
তাঁর হাতে বলপয়েন্ট কলম তুলে দিই। তিনি দারুণ আগ্রহের সঙ্গে কাগজে গ্রাফ এঁকে বোঝাতে শুরু করেন।
এই দেখো। ধরো, এই রেখাটা হচ্ছে টাইম। আর এই দিকে আছে বড় আবিষ্কার। সব ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান বাড়ছে। আমরা এখন কাছাকাছি চলে এসেছি। ২০২১ সাল নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বিস্ফোরণ হবে। এই বিস্ফোরণটাই হচ্ছে সিঙ্গুলারিটি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অমরত্ব যদি আমাদের নাগালে চলে আসে, ব্যাপারটা কেমন হবে?
হুমায়ূন আহমেদ: ইরিনা নামে একটা উপন্যাস আমি লিখেছি। সেখানে সবাই অমর। যেহেতু মানুষ অমর, তাই মানুষের উত্পাদন বন্ধ হয়ে যাবে। আরও অনেক কিছু ঘটবে। এটার বড় ধরনের একটা সাইড এফেক্ট অবশ্যই থাকবে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অথবা এমন কি হতে পারে যে মানুষ একসময় সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল? যেহেতু তার আর মৃত্যুঝুঁকি, অনিশ্চয়তা—এসব কিছুই থাকছে না।
হুমায়ূন আহমেদ: এ রকম কিছুও হতে পারে। পুরো বিষয়টাই আসলে খুব বিচিত্র। আজকেই পত্রিকায় পড়লাম। আমরা আসলে বর্তমানের চেয়ে সব সময় ৪০ মিলিসেকেন্ড পেছনে আছি। ৪০ মিলিসেকেন্ড লাগছে শরীরের সমস্ত বিষয়টা প্রসেস করতে। সব মিলিয়ে এত অদ্ভুত! আরেকটা কথা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। স্টিফেন হকিং বলছেন, বাইরের জগতের উন্নত প্রাণীর বিষয়ে চিন্তা না করাটাই ভালো। তারা যেন এখানে না আসে। আমরা চিন্তা করছি, তারা এখানে এলে ভালো হয়। আসলে সেটা হবে না। ওরা তো অভাবনীয় উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। আমরা উন্নত প্রাণী। গরু-ছাগল আমরা কেটে খাই, আমাদের প্রয়োজনে। অন্য বিশ্ব থেকে যারা আসবে, তাদের কাছে আমরা হব গরু-ছাগল। তখন সংঘাত অনিবার্য।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি কি মনে করেন, অন্য গ্রহে উন্নত প্রাণী আছে?
হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই আছে। না থাকার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে না কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: SETI (সার্চ ফর এক্সট্রা-টেরিস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স) নামের একটা সংগঠন আছে। ওরা ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করে। ওরা কিন্তু এখনো সে রকম কিছু পায়নি।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি জানি। কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণীদের যদি অন্য কোনো সিস্টেম থাকে, তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না। ওদের কার্বন-বেসড লাইফ কেন হবে? ওদের সিলিকন-বেসড লাইফ হতে পারে। ওদের যদি ঠিক চোখ-কান না, অন্য কোনো সিস্টেম থাকে? তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ঘেটুপুত্র কমলা ছবির বিষয়টা একটু ভিন্ন ধাঁচের। এই নামে একটি গল্প আপনি লিখেছিলেন। ছবিটি কি কোনো বিতর্ক তৈরি করতে পারে?
হুমায়ূন আহমেদ: মূলত, গল্পটা থেকেই এই ছবি। এখন তো এই কালচার নেই। গল্পে বিষয়টা আন্ডার কারেন্ট ছিল। ছবিতেও তা-ই। ছেলেটাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে, ওই পর্যন্তই। তবে পুরো বিষয়টা পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে। আমার শুধু একটা অনুরোধ, বাচ্চারা যেন এই ছবিটা না দেখে। আমার ছেলে আমাকে প্রশ্ন করেছে, ঘেটুপুত্র ছেলে, না মেয়ে? আমি চাইছি না বাচ্চারা এই ছবিটা দেখুক। ছবিটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: কোনো ঘেটুপুত্রের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে। ২০-২৫ বছর আগে তো হবেই। গল্পটা লিখেছি তারও পরে। জিনিসটা মাথায় ছিল। ঘেটুগান ছিল মূলত হাওরভিত্তিক। ওখানকার লোকদের তিন মাস কিছুই করার থাকে না। কর্ম ছাড়া একদল লোক কীভাবে বাঁচবে। তারা গানবাজনা করে। গানগুলোর সুর ক্লাসিক্যাল। একদম ক্লাসিক্যাল সুর। দাঁড়াও, তোমাদের শোনাই।
প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা এসে অ্যাপল কম্পিউটারের পর্দায় ঘেটুপুত্র কমলার গান বাজিয়ে দেন—‘পাখি উড়ি লো…উড়ি লো’।
আমরা শুনি।
গান শেষে আবার আলাপে ফিরি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আমি দেশের অনেক নামি জাদুশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আপনাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন পামিং (হাত সাফাই) শিল্পী হিসেবে স্বীকার করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ: পামিং। এটা শেখার জন্য বছরের পর বছর সাধনা করতে হয়। এখন আর কেউ সেটা করতে চায় না। আমার শুরুই হয়েছে পামিং দিয়ে। বছরের পর বছর আমি এর পেছনে সময় দিয়েছি। হাতের তালুতে পয়সা লুকানোর চেষ্টা করেছি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার প্রিয় জাদুশিল্পী কে?
হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই জুয়েল আইচ। ম্যাজিকের প্রতি তাঁর যে আগ্রহ, ডেডিকেশন, সেটার কোনো তুলনা হয় না। আচ্ছা, বলে রাখি, আমার জাপানি ভাষায় একটা বই প্রকাশিত হচ্ছে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: এর আগে জাপানি টেলিভিশনে আপনার ওপর একটা তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ। সেটা বহুদিন আগে। এই বইটার নাম বনের রাজা। বাচ্চাদের বই। আমাদের এখানে অলংকরণ করেছিল ধ্রুব এষ। যেসব প্রাণীর কথা বলা হয়েছে, ওরা সেগুলো তৈরি করেছে। তারপর সেগুলোর ছবি তুলেছে। খুব যত্ন নিয়ে করেছে বইটা।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: হিমু প্রসঙ্গে আসি। হিমুর এবারের বইয়ে দেখা যাচ্ছে, মাজারের হুজুরের কাছে হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই, মানে একজন বড় বিজ্ঞানী, গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। মাজারে আসার পর তাঁর মাথার জট খুলে যাচ্ছে। আপনার অবচেতন মনে, এটা ছিল যে বিজ্ঞান সবকিছুর উত্তর দিতে পারে না?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, পারে না। বল্টু ভাইয়ের মতো বই পড়েই আমরা সবকিছু জানতে পারব না। যেমন, ওই হুজুর বলেছেন, যে চিনি খায়নি সে কি বই পড়ে বুঝতে পারবে চিনির কী স্বাদ?
ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটোই রহস্যময়।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার লেখার মধ্যে এমনিতে মোটা দাগে কোনো ফর্মুলা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনেক সময় আপনাকে পাঠক ধরে রাখার কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করতে দেখি। ধরা যাক, সাধারণ একটা লোকজ ধাঁধা আপনি বইয়ের শুরুতে ব্যবহার করছেন। যার উত্তর মেলে বইয়ের শেষের দিকে। এটা কি সচেতনভাবে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য করি। একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর পাঠক যাতে পরের পৃষ্ঠাটা পড়ে। কৌশলটা যে খুব ভালো, তা বলব না। তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস। প্রথম দেড় শ পৃষ্ঠা আমার কাছে খুবই একঘেয়ে মনে হয়েছে। পাতার পর পাতা শুধুই একটা পার্টির বর্ণনা। কিন্তু যখন তুমি গল্পটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছো, তখন তুমি বারুদের গন্ধ পাবে। যুদ্ধটাকে অনুভব করতে পারবে। আমি প্রথম পৃষ্ঠায় আটকে ফেলতে পেরেছি, তার মানে আমি বিরাট লেখক এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একটা বই পড়ছি। পড়ে মুগ্ধ হলাম। তার গল্প বলার ধরন অসাধারণ। খুব সহজ কথা বলছে, কিন্তু একই সঙ্গে এত গভীর কথা বলে যাচ্ছে।
আলীম আজিজ: আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: , ঈশ্বরবিশ্বাস আমার আছে। ধরা যাক, তুমি একটা গ্রহে গেছ। গ্রহটা দেখে তোমার মনে হতে পারে, চিরকাল ধরে গ্রহটা একই রকম আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি যদি একটা নাইকন ক্যামেরা দেখ, তোমাকে সেটা হাতে নিয়ে বলতেই হবে, এটার একজন কারিগর বা মেকার আছে।
সামান্য একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা দেখে তুমি বলছো এর একটা মেকার আছে। ক্যামেরার কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তোমার পেছনে একটা মানুষ আছে। ক্যামেরায় পেছনের মানুষটাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি হয়ে যাবে আউট অব ফোকাস। আবার তোমাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জন হবে আউট অব ফোকাস।
মানুষের চোখের কিন্তু এই অসুবিধে নেই। চোখ ক্যামেরার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। আমাদের শরীরে একটা যন্ত্র আছে, যার কাজ শরীরের সুগার-লেভেল ঠিক রাখা। মানুষের পুরো শরীর এমন বিচিত্র আর জটিল যন্ত্রপাতিতে ভরপুর। এসব জটিল ব্যাপার এক দিনে এমনি এমনি হয়ে গেছে, এটা আমার মনে হয় না। ‘ডারউইন থিওরি’ কী বলে? বলে, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। বলে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মানুষের সামনে নানা রকম বিপত্তি আসবে, সেগুলো জয় করতে গিয়ে আমরা এ রকম হয়ে গেছি। পশুর চোখ কিন্তু হলুদ। আর আমাদের চোখ সাদা। এটা হয়েছে, যাতে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে নিজেরা নিজেদের চিনতে পারে। আমাদের টিকে থাকার জন্য এইটুকু জ্ঞানই তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানুষের মাথায় এই জ্ঞান কীভাবে এল যে সে রীতিমতো ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ আবিষ্কার করে ফেলল? এই এক্সট্রা-অর্ডিনারি জ্ঞানটা মানুষকে কে দিল? খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষ সবার আগে যে বাড়িটা বানায়, সেটা একটা প্রার্থনাকক্ষ। সব জাতির মানুষের ক্ষেত্রেই তা-ই। তার মানে, সেই একদম শুরু থেকেই মানুষ আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত—হু ইজ গাইডিং মি?
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মৃত্যুর পরবর্তী জগত্ নিয়ে আপনার নিজের চিন্তাভাবনা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়ে আমার প্রবল একটা আগ্রহ সব সময় ছিল। একবার আমি চেষ্টা করলাম প্রার্থনা করব। প্রতিদিন একটা সময়ে বসি। পৃথিবী থেকে বিদায়মুহূর্তটা কেমন হবে, এটা জানা যায় কি না চেষ্টা করি। দিনের পর দিন এটা চলল। তখন আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন আমাকে দেখানো হলো। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, দিনের পর দিন একটা ব্যাপার চিন্তা করার ফলে আমার মস্তিষ্ক সেটা তৈরি করল। অনেক বড় বিজ্ঞানীর বেলায়ও এটা হয়েছে।
আমি কী স্বপ্নে দেখেছি সেটা বলি—
বিশাল একটা হাওর। হাওরের মধ্যে পানি, পানি আর পানি। কলাগাছের মতো একটা জিনিস ধরে আমি ভাসছি। পানি অল্প ঠান্ডা। কলাগাছের মতো জিনিসটা মনে হচ্ছে একটা যান। সেটা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে মনে হলো—মাই গড! এ তো আনন্দের পৃথিবী ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি! সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা বন্ধ হলো। আবার ফিরে এলাম। আমার এই বাড়িঘর—সব আগের মতো। আমি দেখলাম। তখন আমার মনে হলো—আর কী? এবার যাই। আমার যাত্রা আবার শুরু হলো। অনেক দূর গিয়ে আবার মনে হলো—ও মাই গড! সব ফেলে আমি কোথায় যাচ্ছি! আবার ফিরে এলাম। তারপর আবার মনে হলো—এই তো সব। আর কী? এরপর যানটা একটা অকল্পনীয় গতিতে ছুটতে শুরু করল। কোন দিকে যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। দূরে ছোট্ট একটা আলো।
এটাই হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা। হতে পারে, আমার মস্তিষ্ক এটা তৈরি করেছে। আবার না-ও হতে পারে।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মেঘের ওপর বাড়ি বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আমরা দেখি, নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য একজন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমরা তো সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ কী বলে গেছেন? বলে গেছেন, আমি তো লিখি না, জীবনদেবতা আমাকে দিয়ে লেখান। আবার, এমনও হতে পারে, আমরা খুব অসহায় বোধ করি বলেই একজন বড় পথনির্দেশকের কথা চিন্তা করি।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। দেশটা আপনার কেমন লাগে?
হুমায়ূন আহমেদ: ওখানে যাওয়াটা আমার জন্য ভয়ের ব্যাপার। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ খুবই ক্লান্তিকর। আর বিমান ভ্রমণ আমার জন্য এমনিতেই আতঙ্কজনক। কারণ আমার উচ্চতাভীতি আছে। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে—এই বুঝি সব ভেঙেচুরে নিচে পড়ে যাব।
এই সাক্ষাতকারের ঘণ্টা চল্লিশেক পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
বাংলানিউজ-এর খবর
আটমাস পর দেশে ফিরে নন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান নুহাশ পল্লী। দিনের প্রথমভাগে বিশ্রাম নেওয়ার পর বিকেলে দিকে তিনি নুহাশ পল্লীর গাছপালার সান্নিধ্যে সময় কাটান। নিজের হাতে লাগানো বিরল প্রজাতির গাছপালার পরিচর্যার জন্য নুহাশপল্লীর কর্মীদের নির্দেশ দেন এবং নতুন কিছু চারাগাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন।
নিউইয়র্কে আটমাস ক্যান্সার চিকিৎসাধীন থাকার পর শুক্রবার ভোরে হুমায়ূন আহমেদ তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে দেশে ফেরেন। কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসাধীন এই লেখক তিন সপ্তাহ দেশে থাকবেন। নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটরিং হাসপাতালের কয়েক দফা কেমোথেরাপি নেওয়ার পর আগামী ১২ জুন বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের অস্ত্রোপচারের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। এই অস্ত্রোপচারটা করা হবে নিউইয়র্কের বেইলি হাসপাতালে। তার আগে দেশের জন্য খানিকটা অস্থীর হয়ে উঠায় চিকিৎসকরা তাকে শর্ত সাপেক্ষে ২০দিনের জন্য দেশ থেকে ঘুরে আসার অনুমতি দেন বলে জানান লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
চিকিৎসকরা হুমায়ূন আহমেদকে লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আর কথাবার্তা না-বলার শর্ত দিয়েছিলেন কিন্তু দেশে ফেরার প্রথম দিন তিনি চিকিৎসকদের সেই শর্ত পুরোপুরি পালন করতে পারেন নি। গাজীপুরে নুহাশ পল্লীতে তাকে দেখতে আসা মা-শাশুড়ি, ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। পাশাপাশি তাকে দেখতে আসা সাংবাদিক ও শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গেও সৌজন্য বিনিময় ও মৃদু কথাবার্তা বলেছেন তিনি।
নুহাশ পল্লীতে বাংলানিউজ কথা বলে লেখকের মা আয়েশা ফয়েজের সঙ্গে। তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদ এখন কেবল আমার একার সন্তান না। সারাদেশের মানুষের সম্পদ সে। তাকে মানুষ কতোটা ভালোবাসে, সেটি আমি বুঝেছি তার অসুস্থতার সময়। কতোদিন পরে ছেলেকে আমি কাছে পেলাম। সামনে তার বড় একটা অপারেশন। সেই অপারেশন শেষে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে হুমায়ূন যেন আমার কাছে, দেশের মানুষের কাছে ফিরে আসতে পারে, সেজন্য আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।
বিকেলের দিকে রোদ পড়ে এলে হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীতে তার গড়ে তোলা বিরল প্রজাতি গাছপালার বাগানে খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ান। এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিক ও শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, নুহাশ পল্লীর গাছপালাই বোধহয় আমার সবচেয়ে আপনজন। কারণ নিউইয়ার্কে এদেরই আমি সবচেয়ে বেশি মিস করেছি। তাই বলে যে মা আর আত্মীয়-স্বজনকে মিস করিনি, তা কিন্তু নয়। তাদের মিস করা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু গাছপালাকে মিস করাটা স্বাভাবিক নয়। কারণ দেশে ঢাকায় থাকার সময় তো এদের মিস করতাম না।
নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের নিজের হাতে লাগানো আপেল গাছটি এখন বেশ বড় হয়েছে। সেই গাছের নিচে বসে শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, দীর্ঘদিন পর আমার প্রিয় গাছপালার সান্নিধ্য পেয়ে আমি আনন্দিত। গাছপালা আমাকে তাদের মাঝে ফিরে পেয়ে আনন্দ পেয়েছে কিনা তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নাই।
তিনি বলেন, আমার নুহাশপল্লীতে কয়েকটি বিরল প্রজাতির গাছ আছে। যা বাংলাদেশের আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এখানে এমন কিছু গাছ আছে যেগুলোর নাম আমি নিজেও জানি না। প্রতি বছরই নতুন কিছু চারাগাছ নুহাশ পল্লীতে লাগানো হয়। আসছে বর্ষা হলো গাছ লাগানোর সিজন। কিন্তু এই সময়টায় আমি দেশে থাকছি না। গাছ লাগানো যাতে থেমে না থাকে সেজন্য কোথায় কোন গাছ লাগানো হবে, এতক্ষণ ঘুরে আমার লোকদের তা দেখিয়ে দিলাম।
নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে একপ্রশ্নের উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, দেশে আসার পরপর বেশ কয়েকটি চ্যানেলের লোকজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। চ্যানেল আই থেকে এসেছে ইবনে হাসান। বাংলাভিশন থেকে এসেছে শামীম শাহেদ। তাদের ইচ্ছা, দেশে থাকার এই সময়টায় তাদের চ্যানেলে ঈদে প্রচারের জন্য দু’চারটা নাটক তৈরি করি। আমি তাদের কাউকে কোনো কথা দিতে পারি নি। আমার তৈরি ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ ছবিটির সব কাজই শেষ। সেন্সরও হয়ে গেছে। এটি কবে মুক্তি পাবে, সেটা ছবি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস ভালো বলতে পারবে।
নিজের লেখালেখি প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ডাক্তার শুরুতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন লেখালেখি করা যাবে না। একান্তই যদি না পারেন, তাহলে আপনি বলবেন আপনার স্ত্রী লিখবে। ডাক্তারদের সব পরামর্শ তো মেনে চলা যায় না। তাই আমি টুকটাক করে নিজেই লেখালেখিটা চালিয়েছি। এখনও পর্যন্ত আমার কোন সমস্যা হয় নি। এখনও নিজেই লিখতে পারছি। এর মধ্যে একটি নাটক লিখবো। আর কি লিখবো তা এখনও বলতে পারছি না।
হুমায়ূন আহমেদ তার চিকিৎসা প্রসঙ্গে বলেন, ক্যান্সার অসুখটা সত্যিই খুব ভয়াবহ। আমাকে যিনি চিকিৎসা করছেন তার নাম ডাক্তার ভিচ। তিনি এমন এক ঘোষণা দিলেন যে, শুরুতেই ঘাবড়ে গেলাম। আমার চেকআপ করানো সময় একদিন তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, কেমো থেরাপি দিলেও তুমি বেশি দিন বাঁচবে না। তোমার আয়ু বড়জোর দুই বছর। আমি মনে মনে গোছাতে শুরু করলাম দুই বছরে আমার কী কী কাজ করা উচিত? কয়েকবার কেমো নেওয়ার পর অবস্থার পরিবর্তন হলে তিনিই আবার আমাকে আশ্বস্ত করলেন, মনে হচ্ছে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি তার সবকথা স্বাভাবিক আর সহজভাবেই নিয়েছি। আসলে বিশ্বাসটা তো একান্ত নিজের ব্যাপার। তাই কোন কিছুর সামনেই আত্মবিশ্বাস হারানোর কোন কারণ আমি খুঁজে পাই না। যদি আর একদিনও বাঁচি, আমি আনন্দের সঙ্গে বাঁচতে চাই। আমি লিখতে পারছি, এটাই বড় আনন্দের কথা। আমি আনন্দ নিয়ে আছি।
হুমায়ূন আহমেদ আরও বলেন, যে হাসপাতালে আমি প্রথম ভর্তি হই তার ব্যয় বহন করা ছিল আমার জন্য ছিল দুঃসাধ্য। কেমো নেওয়ার পর এবার তাই একটি সরকারি হাসপাতালে আমি ভর্তি হয়েছি। এর নাম বেইলি হাসপাতাল। আমার যে অপারেশনটা তা এই বেইলি হাসপাতালেই হবে। তিনি বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা খরচ সাংঘাতিক ব্যয়বহুল। এই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আমাকে ঋণ করতে হয়েছে। চ্যানেল আইয়ের কাছ থেকে আমি ৫০ লাখ টাকা ধার নিয়েছি। আমি ঋণগ্রস্ত থাকতে অভ্যস্ত নই। পরেরবার অপারেশন শেষে দেশে ফিরে সেই টাকা পরিশোধ করে দেব।
অনেকটা আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, আমার মায়ের বয়স এখন ৮০ বছর। তিনি আমেরিকায় আমার চিকিৎসার জন্য তার আজীবনের সঞ্চয় ৫৫০০ ডলার পাঠিয়েছেন। একেই বলে মা। পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কে এরকম করবে!
মা আয়েশা ফয়েজসহ পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ দুই দিন নুহাশপল্লীতে কাটানোর পর ১৩ মে তার ঢাকার ধানমন্ডির বাসভবন ‘দখিন হাওয়া’-তে যান।
এই লেখাটি বাংলানিউজ থেকে নেওয়া।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
বাংলানিউজের প্রতিনিধি শিহাব উদ্দিন কিসলুর সঙ্গে
নিউইয়র্ক এ চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হুমায়ুন আহমেদ বাংলানিউজের প্রতিনিধি শিহাব উদ্দিন কিসলুর কাছে এই সাক্ষাৎকার দেন।
“মা অপেক্ষা করছেন। ছেলেকে দেখতে। ছেলেও উদগ্রীব। তাই দেশে যাচ্ছি। ডাক্তারকে সেটাই বলেছি। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিল, “দেশে যাওয়া কেন?”
নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা এলাকার ভাড়া বাসা থেকে স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় দেশের উদ্দেশে রওনা করার আগে এভাবেই নন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদ বাংলানিউজের সঙ্গে তার একান্ত সাক্ষাৎকারটির সূচনা করেন।
অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই গুণী মানুষটির সঙ্গে যেন সাক্ষাৎকার নয়, গল্প জমে উঠেছিল। আলাপচারিতায় জানালেন, দেশের খাওয়া-দাওয়া খুব মিস করছেন।
এ প্রসঙ্গটি উঠতেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলেলেন, “ঢাকায় খবর হয়ে গেছে। বুঝেছ, খবর দিয়ে দিয়েছি। প্লেন সকালে নামবে। আমি বড় কই মাছ আলু দিয়ে, পেটে ডিম ভর্তি বড় বড় শিংমাছের ঝোল, আর বড় সাইজের কাতলের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট খাবো। বাংলাদেশি খাবারটা খুব মিস করছি।”
মানুষ হিসেবে অতি সজ্জন হুমায়ূন আহমেদের কথাবার্তায় মোটেও মনে হয়নি তিনি আসলেই চরম বেরসিক এক শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। শুধু বাইরের অবয়বে খানিকটা আঁচ করা যায়।
“দেশে গিয়ে কি কি করবেন, কোথায় কোথায় যাবেন স্যার?“ সোজা প্রশ্ন করলাম।
কোথাও যাবো না,” বললেন হুমায়ূন আহমেদ।
শুধু নূহাশ পল্লীতে যাবো। ওখানেই থাকবো কিছুদিন। ওখানে আমার বাবুর্চি আছে, দারুণ রান্না করে। ওর মত মুড়িঘণ্ট আর কেউ করতে পারে না। সেই মুড়িঘণ্ট খাবো।”
মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, “মা তো মা-ই, সবার উপরে। এই মা আমার চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা ডলার করে সাড়ে ৫ হাজার ডলার আমেরিকা পাঠিয়েছেন। জমানো টাকাগুলো কিন্তু আমারই দেওয়া। সেই টাকাই আমাকে পাঠিয়েছেন। এই আমার মা।”
হুমায়ূন আহমেদ চোখের অশ্রু লুকিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কণ্ঠের আবেগ আর চেহারার রক্তিম আভা জানিয়ে দিয়েছে মা তার কত প্রিয়। শরতের মেঘে সূর্যের লুকোচুরির মতই হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে গেছে সাংবাদিকের কলমে।
“স্যার আপনার দেশে ফেরার অনুভূতি…“
বললেন, “দেশে ফেরা তো হচ্ছে না। আগে তো দেশে ফিরেছি স্থায়ীভাবে। কিন্তু এবার আগে থেকেই জানছি আবার ফিরে আসতে হবে। তাই দেশে ফেরার যে সত্যিকারের অনুভূতি, যে ভালো লাগা সেটা ততটা নেই। দেশ যে আমার কাছে অনেক আপন, সেখানে কি ক’দিনের জন্য যাওয়া ভালো লাগে!”
কথোপকথনের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য ঘরে ঢুকেছিলেন মামুন ভাই। স্বনামখ্যাত ফটো সাংবাদিক নাসির আলী মামুন। তিনি সুযোগ পেয়ে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়ূন আহমেদের পারিবারিক বন্ধু গাজী কাশেমকে আমার অ্যানড্রয়েড ফোনের ক্যামেরায় আমাদের কয়েকটি ছবি তুলতে অনুরোধ করলাম। এ সময় হুমায়ূন আহমেদ সেল ফোনটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “মামুন, গুগলের লেটেস্ট এই ফোনটা দেখেছো?”
মামুন ভাই জবাব দিলেন, “জ্বি, খুবই ভালো।”
হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী শাওন ছেলে নিষাদকে সামলানো আর মালপত্র গোছানোতো ব্যস্ত। এরই মাঝে বাইরে গিয়ে ছবি তোলার জন্য গাজী কাশেমের অনুরোধ। ছবি তুললাম। ছবিটা হুমায়ূন আহমেদকে দেখিয়ে বললাম, “স্যার, মামুন ভাইয়ের চেয়ে ভালো হয়েছে না? উনার ব্যবসা তো এবার শেষ!”
বললেন, “হ্যাঁ, ওর ব্যবসা আসলেই শেষ।”
মামুন ভাই খানিকটা সরল হাসিতে সেই `সত্য` যখন স্বীকার করে নিলেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বললেন, “শোনো, এতে তোমার কোনো কৃতিত্ব নেই। তোমরা কি জানো বাংলাদেশে ফটোগ্রাফারের সংখ্যা কত?“
আমি আর মামুন ভাই দু’জনই ভাবছিলাম সংখ্যাটা কত হতে পারে।
ওদিকে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, “সংখ্যাটা এক কোটির বেশি। কিভাবে? শোনো। ঢাকায় আমি একদিন পাবলিক টয়লেটে গেছি। অমনি পাশ থেকে কয়েকজন বলে উঠলো, “স্যার একটা ছবি তুলি?”
বলেই সেলফোনে ছবি তোলা শুরু করলো।
বললাম, “বাবারা, আমি তো পাবলিক টয়লেটে দাঁড়িয়ে!”
হাসির জোয়ারে ভেসে গেলাম সবাই। শেষে বললেন, “দেশে সবার হাতেই সেলফোন।
সবাই ক্যামেরাম্যান।”
ওদিকে বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কথোপকথন এখানেই শেষ।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
বাদশাহ নামদার হুমায়ূন
হুমায়ূন আহমেদ কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস বাদশাহ নামদার। মোগল সাম্রাজ্যের রংদার চরিত্র সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে লিখেছেন লেখক হুমায়ূন। একেবারে ভিন্ন ধরনের এই বই নিয়ে লেখকের কৌতূহলোদ্দীপক সাক্ষাৎ কার নিয়েছেন আলীম আজিজ ও তৈমুর রেজা।
প্রশ্ন: সরাসরি বইয়ের প্রসঙ্গে চলে আসি। বাদশাহ নামদার উপন্যাসের কাহিনির সঙ্গে অনেক বেশি মিল আছে গুলবদন বেগম প্রণীত হুমায়ুন-নামা গ্রন্থের।
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, সেই বইটা আমার কাজে এসেছে। তবে আমি অনেক কিছু নিয়েছি জওহর আফতাবচির কাছ থেকে, বাদশাহ হুমায়ুনকে যিনি পানি পান করাতেন।
এই লোকটি সব সময় বাদশাহ হুমায়ুনের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। তিনি যখন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তখনো তিনি তাঁকে ছেড়ে যাননি। এমন কি আকবরের যখন জন্ম হয়েছে তখনো জওহর আফতাবচি সঙ্গে ছিলেন।
প্রশ্ন: আপনি সাধারণত সমকাল নিয়েই লেখালেখি করেন। হঠাৎ বাদশাহ হুমায়ুনকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন?
হুমায়ূন: বাদশাহ নামদার বইটি লেখার কারণ আমি বইয়ের ভূমিকাতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। ছোটবেলায় আমি যখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ি, তখন আমাকে বেশ ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়েছে। ছাত্ররা আমাকে ডাকত ‘হারু হুমায়ূন’। কারণ শেরশাহর সঙ্গে প্রতিটি যুদ্ধে আমি হেরেছি। পালিয়ে বেড়িয়েছি। আমি বলতাম, আমি হারছি নাকি? সবাই বলত, ‘হারু হুমায়ূন, হারু হুমায়ূন’। এটা একটা কারণ। আরেকটা হতে পারে, চিতোরের রানি যখন সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছে রাখিবন্ধন পাঠালেন, তিনি যে সঙ্গে সঙ্গে সব ফেলে রেখে ছুটলেন—এই পাগলামিগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
প্রশ্ন: হারু হুমায়ূন আপনার লেখায় আগে বোধহয় কখনো আসেনি। হঠাৎ করে আপনার সঙ্গে এর যোগসূত্র হলো কীভাবে? হঠাৎ করে কেন মনে এল হুমায়ূনকে নিয়ে লিখতে হবে?
হুমায়ূন: আসলে আমার আকর্ষণ তাঁর খ্যাপা ধরনের জন্য। এই রকম একটা পাগল লোক। ভিস্তিওয়ালা তাঁর জীবন রক্ষা করেছে বলে আধাবেলার জন্য তাকে দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। এটা পাগলামি ছাড়া আর কী! তুমি তাকে টাকা-পয়সা দাও। একেবারে দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া—এটা কোনো কাজ হলো? তার মানে তুমি এত হেলাফেলা করে ভাবো? এইটা আমাকে খুবই সারপ্রাইজ করল। চিতোরের রানিকে সাহায্য করতে তিনি সব ফেলেফুলে ছুটলেন। এটাও সারপ্রাইজিং। তারপরে রক্তবর্ণ কাপড় পরে তিনি যে মানুষ হত্যা শুরু করলেন—এটা কিন্তু ইতিহাস থেকে নেওয়া। সেখানে একটা ছেলে এসে গান গাইল। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। মোগল চিত্রকলার শুরুটা কিন্তু হুমায়ুনের হাতে। তাঁর আগে মোগল চিত্রকলা ছিল না। তিনি পারস্য থেকে চিত্রকর নিয়ে এলেন। ভারতে তিনিই প্রথম মানমন্দির তৈরি করেছেন। কেন? কারণ তিনি পারস্যে মানমন্দির দেখে আসছেন। তাঁর মৃত্যুও হয়েছে কিন্তু ওই মানমন্দিরের কারণে। সকালে ফজরের আজান হয়েছে। তিনি জানেন সকালে ফজরের আজানের সময় শুক্রগ্রহ মানে সন্ধ্যাতারাটা ওঠে। ওটা দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। পরনের কাপড়ে আটকে তিনি পড়ে যান। এ সব ঘটনা, একটা ক্যারেক্টার এত বিচিত্র হতে পারে? এত খেয়ালি হতে পারে। বৈরাম খাঁর কথা পড়েছ না?
প্রশ্ন: অনেকে মনে করেন, দুই ধরনের সাহিত্যিক থাকে। পপুলার লেখক আর সিরিয়াস লেখক। সিরিয়াস সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা যায়, তাঁরা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন। এই বই দিয়ে আপনি ইতিহাসের দিকে ঝুঁকছেন। জনপ্রিয় সাহিত্যিকের খাতা থেকে নিজের নাম কি কাটাতে চাচ্ছেন?
হুমায়ূন: না, না। আমি আমার আগের যে খাতা সেটাতেই বহাল আছি। আমার খাতা একটাই। আমি এমনিতে ইতিহাসের খুব মনোযোগী পাঠক। ইতিহাসে আমার আগ্রহ আছে। এখানে বাসায় যে বইগুলো দেখছেন, সেটা কিন্তু আমার মূল লাইব্রেরি না। আমার অনেক বই স্কুলে আছে। তারপর নুহাশ পল্লিতে আছে। লেখার থেকে আমি পড়ার পেছনে বেশি সময় দিই। এত জানার জিনিস আছে পৃথিবীতে। কিন্তু বাংলা বইয়ে ইতিহাস খুবই কাঠখোট্টাভাবে লেখা। এই লেখাগুলো তো কেউ পড়ে না। আমার ইচ্ছে করে এসব গল্প পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে। গল্পগুলোই আসলে আমাকে ইনস্পায়ার করে। আমার বাসায় গুলবদনের বই সাত বছর ধরে আছে। শাওন কখনো পড়ার আগ্রহ পায়নি। কিন্তু বাদশাহ নামদার যখন ও পড়ে শেষ করল, তখন গুলবদনের বই তাকে টানতে শুরু করল। এখন সে গুলবদন পড়ছে, বাবরনামা পড়ছে।
প্রশ্ন: বাদশাহ নামদার লিখতে গিয়ে আপনি নিজেই হুমায়ুন চরিত্রটির মধ্যে ঢুকে পড়েছেন এমন কি কখনো মনে হয়েছে?
হুমায়ূন: না, আমি নিজেকে কখনো তাঁর জায়গায় কল্পনা করিনি। কারণ যে নির্দয়তা তিনি দেখিয়েছেন, সেগুলো ভয়াবহ। আমি কখনো এসব ভাবতে পারি না। একটা মানুষের মধ্যে তো ভালো-মন্দ দুইটাই থাকবে, ওনার মধ্যেও পুরোপুরি ছিল।
প্রশ্ন: আপনার টিপিক্যাল চরিত্রগুলো এই বইয়ে প্রায় অনুপস্থিত। দুজন মাত্র চরিত্রকে আপনার চেনা ধরনের সঙ্গে মেলানো যায়। হরিশঙ্কর আচার্য আর হামিদা বানু। যেমন হামিদা বানু জোৎ স্না দেখতে ভালোবাসে।
হুমায়ূন: হামিদা বানু চরিত্রটা ঐতিহাসিকভাবেই এমন। জোৎ স্না দেখতে ভালোবাসে। একটু চঞ্চল, একটু ছটফটে। হুমায়ুনের সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হবে তখন হামিদা বানুর বয়স মাত্র পনেরো। হুমায়ুনের চারটা বউ আছে। হুমায়ুন মায়ের সঙ্গে রদখা করতে গিয়ে দেখলেন পনেরো বছরের একটি মেয়ে তাঁকে কুর্নিশ করছে। তিনি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করছেন, মেয়েটা কে? জানা গেল, একজন শিক্ষকের মেয়ে। হুমায়ুন বললেন, আমি একে বিবাহ করতে চাই। হামিদা বানু বিয়ের কথা শুনে বললেন, এটা অসম্ভব ব্যাপার। আমি এমন কাউকে বিয়ে করব, যাঁর হাত আমি যখন ইচ্ছে ধরতে পারি, যাঁকে দেখলে আমার কুর্নিশ করতে হবে না। আর ইনি তো রাজ্যহারা লোক। একে আমি বিয়ে করতে যাব কেন? এসব আমার বইয়ের মধ্যে আছে।
প্রশ্ন: তো স্যার, এই বইয়ের মধ্যে আপনি যেমন আলাদা হয়ে উঠেছেন, এটা কি আপনি সচেতনভাবেই চেষ্টা করেছিলেন?
হুমায়ূন: না, না। দেখো পৃথিবীতে দুই ধরনের লেখক আছে। একটা হলো স্পনটিনিয়াস রাইটার। আরেকটা ধরন হলো, চিন্তাভাবনা করে বইপত্র পড়ে ধীরেসুস্থে লিখবে। অল থ্রু মাই লাইফ আই ওয়াজ এ স্পনটিনিয়াস রাইটার। এর মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। তবে এই স্পনটিনিয়াস রাইটিংয়ের জন্য আমাকে ইতিহাস পড়তে হয়েছে। তথ্যগুলো ব্রেইনের একটা অংশে ছিল। কিন্তু আমি লিখেছি স্পনটিনিয়াসলি। চিন্তাভাবনা করে, এটা করব ওটা করব—এসবের মধ্যেই আমি নেই।
প্রশ্ন: এই বইয়ে আপনার লেখার স্টাইলে পরিবর্তন স্পষ্ট, যেমন আপনার লেখায় হিউমার খুব পরিচিত ব্যাপার, কিন্তু এই বইতে কোথাও কোথাও ঝিলিক থাকলেও হিউমার প্রায় নেই।
হুমায়ূন: হ্যাঁ। এই বইয়ে আমার স্টাইলগত পরিবর্তন অবশ্যই আমার ইচ্ছাকৃত। এখানে আমি প্রচুর তৎ সম শব্দ ব্যবহার করেছি। পুরোনো বানানগুলো অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করেছি। পুরোনো আবহটা আনার জন্য। যেসব দীর্ঘ-ঈ কার আজকাল হ্রস্ব-ইতে লেখা হচ্ছে সেগুলোতে আমি দীর্ঘ-ঈকার ব্যবহার করেছি। পাণ্ডুলিপি হায়াৎ মামুদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে আমি বলেছি, আমি দীর্ঘ-ঈকারগুলো রাখছি, যাতে ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাটার্নে একটা পুরোনো দিনের ফ্লেভার তৈরি হয়। এটা সচেতনভাবে করা।
একটা গল্প তোমাদের বলি, এটা আমাকে বোঝার জন্য কাজে লাগতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো একটা উপলক্ষে আমাকে চট্টগ্রামে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আমি আগ্রহ করে গেলাম। গিয়ে দেখি হলভর্তি লোকজন বসে আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক কায়সার বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠলেন। হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্ত নিয়ে লেখালেখি করেন। এর বাইরে তিনি যেতে পারেন না। মধ্যবিত্ত হলো আমাদের সমাজের টু পার্সেন্ট মাত্র। বাকি আটানব্বই লোক অন্য শ্রেণীর। কৃষিজীবী আছে, মৎ স্যজীবী আছে। অল থ্রু অব হিজ লাইফ তিনি এদের নিয়ে কিছু লেখেননি। মাত্র টু পার্সেন্ট লোক নিয়েই লিখেছেন। তাঁকে লেখক বলে স্বীকৃতি দেওয়ার তো কিছু নেই। যাঁরা দুর্বল মনের মানুষ, তাঁরা এসব শুনলে চিন্তায় পড়ে যান। আরে এভাবে তো কখনো ভাবিনি। মাত্র টু পার্সেন্ট লোককে নিয়ে লিখছেন। দেখলাম কিছু কিছু ছেলেপেলের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তারা এটা নিতে পারছে না। তাঁর কথা শেষ হওয়ার পর আমি বললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লেখক যাঁকে বলা হয়, তিনি সারা জীবন শুধু রাজা-বাদশাহ আর রাজকন্যাদের নিয়ে লিখেছেন। তাঁর নাম শেকসপিয়ার। আমার শেকসপিয়ারের মতো ক্ষমতা নেই বলে আমি এগুলো লিখছি। কিন্তু মধ্যবিত্ত নিয়ে লিখলেই যে সব স্পর্শ করা যাবে না, এটা কে বলেছে আপনাকে? এরপর তিনি খুবই লজ্জিত হয়ে আমাকে সরি বলেছেন।
আরেকটা ঘটনা বলি। বিচিত্রার শাহাদাত চৌধুরী আমাকে বললেন, আপনি তো লেখালেখি করছেন, এক কাজ করি। আপনাকে ট্যাগ করে দিই সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। দুজনের মুখোমুখি একটা আলোচনা আমরা ছাপব। আমি রাজি হয়ে গেলাম। সৈয়দ হকের সঙ্গে বসলাম মুখোমুখি। তিনি প্রশ্ন শুরু করলেন এইভাবে, হুমায়ূন আহমেদ সাহেব। আপনার সব উপন্যাসই দেখি, হয় চার ফর্মায় শেষ হয়, নয় পাঁচ ফর্মায় কিংবা ছয় ফর্মায়। এভাবে ফর্মা হিসেবে কি উপন্যাস আসে আপনার মাথায়? আমি সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম, তাঁর ইনটেনশন খুব খারাপ। আমি তো পুরোপুরি ধরা খেয়ে গেছি। তখন বললাম, ‘হক ভাই, আপনি যে সনেটগুলো লেখেন, এগুলো তো ১৪ লাইনে লেখেন। আপনার ভাব যদি ১৪ লাইন মেনে আসতে পারে, আমার উপন্যাস ফর্মা হিসেবে এলে অসুবিধা কী?’
প্রশ্ন: আপনি এর আগে ঐতিহাসিক যেসব উপন্যাস লিখেছেন, সেখানে ন্যারেটর হিসেবে আপনার সাধারণ মানুষকে পাই। এখনকার সাব-অল্টার্ন স্টাডিস বা তলা থেকে দেখা ইতিহাসের সঙ্গে এই ব্যাপারটা খুব খাপ খায়। কিন্তু বাদশাহ নামদার উপন্যাসের প্রায় পুরো গল্পটাই অভিজাতদের পাটাতন থেকে বলা। ন্যারেটর হিসেবে নিম্নবর্গ বা তলার মানুষ নেই। এটা কেন হলো? আপনার কি কোনো লিমিটেশন ছিল?
হুমায়ূন: লিমিটেশন তো ছিলই। আমি যাঁদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছি, এঁদের
একজন হচ্ছেন আবুল ফজল। একজন হচ্ছেন হুমায়ুনের বোন। একজন তাঁর পানি সরবরাহকারী আফতাবচি। আমাকে তো এঁদের কাছ থেকে তথ্যগুলো নিতে হয়েছে। আর সেই সময় হুমায়ুনের রাজসভায় যাঁরা গেছেন, তাঁদের কারও কারও ভাষ্যের সাহায্য আমি নিয়েছি। কাজেই নিচু তলার কারও ভাষ্য পাওয়ার সুযোগ ছিল না। এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার কেউ নেই। এটা করতে গেলে আমাকে করতে হতো পুরোপুরি কল্পনার সাহায্য নিয়ে। সে ক্ষেত্রে আমি ইতিহাস থেকে আরও দূরে সরে যেতে পারতাম। এই উপন্যাসের একটা চরিত্র হচ্ছে ভিস্তিওয়ালা। সে যদি একটা বই বা উপন্যাস লিখে যেতে পারত, তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গিটা আমরা জানতে পারতাম।
প্রশ্ন: এই উপন্যাসে আমরা দেখি, হুমায়ুন যখনই যুদ্ধ জয় করতেন, তখনই তিনি বিরাট উৎ সবে মেতে উঠতেন। হেরেমের ব্যাপারেও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তিনি আফিম খেতেন, এটা আপনার উপন্যাসেই আছে। কিন্তু বাদশাহ নামদার-এ হেরেমটাকে আপনি কিছুটা এড়িয়ে গেছেন।
হুমায়ূন: হ্যাঁ, এটা আমি কিছুটা বাদ দিয়েছি। এই জিনিসটাকে আমার কাছে একটু অরুচিকর মনে হয়। পতিতালয় থাকবে একজন সম্রাটের, এটা কেমন কথা।
প্রশ্ন: সেক্স বা সেক্সুয়ালিটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী—সাহিত্য বা ফিকশনের ক্ষেত্রে?
হুমায়ূন: এটা নিয়ে আসাটাকে খুব মডার্নিস্ট মনে করা হয়। যিনি যত ভালোভাবে নিয়ে আসতে পারেন, তিনি তত মডার্ন লেখক, এটা ভাবা হয়। আমাদের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় লেখক যিনি, তাঁর নাম হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনার গল্প-উপন্যাসে কোথাও সেক্সুয়ালিটি পেয়েছ? এক জায়গায় শুধু আছে, ‘তখন তাহার শরীর জাগিয়া উঠিল।’ এর বেশি তিনি আর আনেননি। শুধু ‘জাগিয়া ওঠা’ পর্যন্ত। পাঠকের কল্পনার ওপর তিনি ছেড়ে দিয়েছেন।
প্রশ্ন: বাদশাহ নামদার-এ ওই সময়ের জিওগ্রাফি, এনভায়রনমেন্ট, ওই সময়ের সোসাইটি, সাধারণ মানুষ—এর প্রায় কিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এটা আপনার উপন্যাসে একটা ব্যত্যয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা একটা খামতিও। এ ব্যাপারে আপনার নিজের কী মনে হয়?
হুমায়ূন: তোমরা তো আমাকে কনফিউজ করে দিলে। ওই যে কালটা ধরা যাচ্ছে না বলছ, সেটা আমার মনে হয় না। আমাদের সেলিনা হোসেন গালিবকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন। সেই উপন্যাসে গালিব বলছেন, একজন স্ত্রী ভাত রাঁধতে পারলেই হলো। গালিবের স্ত্রী তো ভাত রাঁধতে পারেন না। বড়জোর রুটি বানাতে পারেন। এই ত্রুটিগুলো কিন্তু আমি করিনি। আর সাহিত্যিক তো ঐতিহাসিক না। ভারবাটিম তার সবকিছু ধরার দরকার নেই। তোমাদের কল্পনার জন্য জায়গা রাখতে হবে না, বলো? সময় ধরার জন্য আর কী করতে পারতাম, বলো।
প্রশ্ন: যেমন ধরেন, ওই সময়ের পথঘাট। আমরা অনেক যাত্রার বিবরণ পেয়েছি যে সৈন্য দল যাচ্ছে।
হুমায়ূন: পথঘাট ছিল না, ফর ইয়োর ইনফরমেশন। পথঘাট শুরু করলেন শেরশাহ। গ্র্যান্ডটাংক রোড বানালেন উনি। পথঘাট ছিল না তো, যে পথের বর্ণনা দেব। পালকি-টালকি ছিল…আরেকটা কারণ হলো, আগে আমি ঐতিহাসিক যেসব উপন্যাস লিখেছি, যেমন—জোছনা ও জননীর গল্প, সেই সময়টা আমি নিজ চোখে দেখেছি বা মধ্যাহ্ন কিছুটা হলেও দেখেছি, বাবা-চাচাদের কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু এই উপন্যাসের সময়টা চাক্ষুস দেখেছে, এমন কারও সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ নেই। বই যেগুলো হাতে আছে, এর বাইরে আমরা কিন্তু কিছু জানতে পারছি না। যে বইগুলো আমি পড়েছি, সেখানে প্রায় কোনো ডিটেইলই নেই। গুলবদন বেগমের বইয়ে যেমন—শুধু এভাবে লেখা যে আম্মা এটা বললেন বা আব্বা এটা করলেন। অমুক এটা করলেন, তমুক এটা করলেন। শুধু সারমর্মটা আছে। বর্ণনা সেভাবে নেই।
আর একটা সমস্যা হলো, হুমায়ুনের সময়ের কোনো স্থাপত্যকলাও নেই। সবই ধ্বংস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হয়েছে এইটিন ফিফটি সেভেনে। সিপাহি বিদ্রোহের কারণে ইংরেজরা খুবই খেপে গেল, মোগলের কিছুই থাকবে না এখানে, ইনক্লুডিং তাজমহল। সব ডেমোলিশ করতে হবে। তখন এটা রক্ষা করলেন একজন ইংরেজ সাহেব। তাঁর নামটা এই মুহূর্তে আমি ভুলে গেছি। তিনি এগিয়ে এসে বহু কষ্টে এটা রক্ষা করলেন। লালকেল্লা আর তাজমহল। ওরা ঠিক করেছিল, মোগলের কোনো চিহ্নই রাখবে না।
আর শোনো। আমার লেখার ধরন নিয়ে একটা ছোট্ট কথা তোমাদের বলি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঔপন্যাসিক বলতে হবে তলস্তয়কে। আরেকজন দস্তইয়েভস্কি। এঁরা করেন কী, একটা চরিত্রকে বর্ণনা করা শুরু করেন। ধরো, তোমাকে তারা বর্ণনা করছেন। অনেক লাইন কিন্তু খরচ করছেন তোমার পেছনে। তার চোখ এমন ছিল, তার অল্প কিছু গোঁফ ছিল, নাকটা খাড়া ছিল—টোটাল বর্ণনা দিয়ে তোমার চেহারাটা ফুটিয়ে তুলবেন। আমি কিন্তু ওই লাইনে যাই না। সাধারণত আমি চেহারার বর্ণনা দিই না। আমি এই ব্যবস্থাটা করি। ডায়ালগের ভেতর দিয়েই যেন পাঠক চরিত্রগুলোকে কল্পনা করতে পারে। এটার সুবিধাটা দেখো। আমরা পথের পাঁচালী উপন্যাসটা যখন পড়ি, তখন প্রত্যেকেই একজন করে দুর্গাকে কল্পনা করি। একটা অপু কল্পনা করি। সত্যজিৎ রায় যখন ছবি বানালেন, তখন সবার কল্পনাটা সীমিত হয়ে গেল। যে কারণে আমি এত কিছু লিখি, আমি কিন্তু হিমু নিয়ে কোনো সিনেমা বা নাটক করিনি। কারণ, সবার কল্পনায় নিজের মতো একটা হিমু আছে। আমি ওইটায় হাত দিতে চাইনি। মিসির আলিও আমি বানাইনি। অন্যরা দুয়েকজন বানিয়েছে। আমি এর থেকে দূরে থাকছি। শুভ্রও আমি বানাইনি। বানাতে চাচ্ছিও না। যার মনে যা আছে, সেটাই থাকুক।
প্রশ্ন: এখানে দেখা যায়, বাদশাহ হুমায়ুনের জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল।
হুমায়ূন: অত্যন্ত ঝোঁক ছিল। উনি তাঁর ছেলে আকবরের জন্মের পর নিজের হাতে ৪০ না ৪৫ পৃষ্ঠার একটা কোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। আকবরের জন্মতারিখটা ভুল লেখা আছে। কারণ, সত্যিকারের জন্মতারিখ সবাই জেনে ফেললে জাদুটোনা করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে। আকবরের জন্মের সময় আফতাবচি সেখানে উপস্থিত। আবুল ফজল এটা জানলেন অনেক পরে। আমরা তো নেব জওহর আফতাবচির মতো।
প্রশ্ন: আপনার উপন্যাসে হুমায়ুন প্রবলভাবে ভাগ্যবিশ্বাসী একজন মানুষ, গ্রহ-নক্ষত্রের বিচার ছাড়া তিনি কিছু করেন না, কিন্তু তাঁর আশপাশে এমন কোনো চরিত্র নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী কারও দেখা কিন্তু আমরা পাই না।
হুমায়ূন: ঠিকই বলেছ। আমার উপন্যাসে এ রকম কোনো চরিত্র নেই। কিন্তু বাদশাহ হুমায়ুনের লোক ছিল, যে এই গ্রহ-নক্ষত্রের ব্যাপারগুলো দেখত বা তিনি নিজেই দেখতেন বেশির ভাগ সময়। বাবর কিন্তু এসবের ব্যাপারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি তলোয়ারের ওপর নির্ভর করতেন, রণক্ষেত্রের ওপর বিশ্বাস রাখতেন। হুমায়ুন দূর্বল মনের মানুষ। এ জন্য গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর নির্ভর করতেন।
প্রশ্ন: আপনি যখন ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন, তখন এমন অনেক চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হয় যাদের আপনি দেখেননি, বইপত্র ছাড়া যাদের কথা জানার উপায় নেই। এ রকম চরিত্রগুলো আপনি কীভাবে ভিজুয়ালাইজ করেন? কোনো পদ্ধতি কি থাকে আপনার?
হুমায়ূন: পদ্ধতি থাকলে তো আমি লেখক বানানোর একটা স্কুল দিয়ে ফেলতে পারতাম। আর বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে বড় লেখক হতেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের ছেলে। কারণ, তাঁরই সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিল বাপের কাছ থেকে লেখালেখির কলাকৌশল শিখে নেওয়ার। সে তো মোটামুটি গাধা ছাড়া কিছু হয়নি।
এটা আসলে বলা যাচ্ছে না। ব্রেইনের কোন অংশে কীভাবে আসলে প্রসেস হয়, আমি জানি না। তুমি কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালো ছুতার হতে পারবে। কিন্তু লেখকের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ভালো লেখক হতে পারবে—এটা আমি মনে করি না। এর প্রেরণাটা অন্যখান থেকে আসে। এটা রহস্যময়।
প্রশ্ন: স্যার, বাদশাহ নামদার-এর সূত্র ধরে এ রকম আরও ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার ইচ্ছা কি আছে আপনার?
হুমায়ূন: না, এই মুহূর্তে আমি আর ভাবছি না। অনেক সময় নষ্ট হয় আমার। দুনিয়ার বই পড়তে হয়। আর ব্যাপারটা খুব কনফিউজিং। একেকজন ঐতিহাসিক একেক রকম কথা বলে যাচ্ছেন। ভেরি ভেরি কনফিউজিং। এক ধরনের ইতিহাস পড়লে তোমার মনে হবে, আওরঙ্গজেবের মতো নিষ্ঠুর মানুষ পৃথিবীতে নেই। আরেক ধরনের ইতিহাস পড়লে মনে হবে, ও মাই গড, আওরঙ্গজেবের মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে নেই। একটা উদাহরণ দিই। রাজপুতানার এক রাজার দুজন রানি ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে গর্ভবতী হলেন। তখন রাজা মারা গেলেন। এই দুজনের এক রানি খবর পাঠালেন আওরঙ্গজেবের কাছে, ‘আপনি যদি আমার সন্তানকে স্বীকৃতি দেন রাজা হিসেবে, তাহলে আমি আমার লোকজন নিয়ে মুসলমান হয়ে যাব।’ আওরঙ্গজেব দুই রানির কোনো ছেলেকেই রাজত্ব দিলেন না। যে রাজা মারা গেছেন, তাঁর ছোট ভাইকে রাজত্ব দিলেন। সভাসদরা বললেন, ‘কী আশ্চর্য! আমরা এত বড় একটা সুযোগ পেলাম। আপনি সেটা নিলেন না কেন?’ আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আমি রাজ্য শাসন করতে এসেছি। ধর্মপ্রচার করতে আসিনি। নাবালক পুত্রকে বসিয়ে আমার চলবে না।’ আওরঙ্গজেব নিজে খুবই ধার্মিক লোক। তিনি বলছেন এই কথা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০১০
বিবিসি সাক্ষাৎকার — আগস্ট, ২০১১
হুমায়ুন আহমেদ ২০১১ সালের আগস্ট মাসে বিবিসি- বাংলায় একটি সাক্ষাতকার দেন। বিবিসি-র পক্ষে হুমায়ুন আহমেদের সাথে কথা বলেছেন অর্চি অতন্দ্রিলা। সাক্ষাতকারটি বিবিসি-র ওয়েব সাইট থেকে নেওয়া।
বিবিসিঃ আপনি গত চার দশক ধরে লেখালেখি করছেন। এ লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হলো?
হুমায়ূন আহমেদঃ বাংলাদেশে আর ১০ টা মানুষ যে ভাবে লেখালেখি শুরু করে আমি একই ভাবেই শুরু করেছি। আলাদা কিছু নয়। তারা কি ভাবে শুরু করে? প্রথমে তারপরে স্কুল ম্যাগাজিনে লেখে, তারপর কবিতা লেখে তারপর পত্রপত্রিকায় পাঠাবার চেষ্টা করে। তারা যে ভাবে শুরু করেছে আমিও সেই ভাবেই শুরু করেছি। আলাদা কিছু নয়।
বিবিসিঃ আচ্ছা, মিঃ আহমেদ, আপনার পড়াশোনার বিষয় ছিল রসায়ন। সাধারণত মনে করা হয় এটা সাহিত্যের বিপরীতে। কিন্তু অধ্যাপনা ছেড়ে লেখার আগ্রহটা কি ভাবে তৈরী হলো?
হুমায়ূন আহমেদঃ সাধারণত মনে করা হয় এটা সাহিত্যের বিপরীতে। আসলেই কি তাই? যদি সাহিত্যের পক্ষে বা সাহিত্যের স্রোতে যে সাবজেক্টগুলো আছে সেগুলো কী? তাহলে বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্য? যদি সেটা হয়ে থাকে তাহলে আমার প্রশ্ন থাকবে প্রতি বছর যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বাংলা বা ইংরেজিতে পাস করে বের হচ্ছে তাদের মধ্যে কয় জন লেখালেখি করছে? কে কি পড়ছে সেটার সাথে লেখালেখির কোন সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না।
বিবিসিঃ সাহিত্যের সাথে সাথে নাটক এবং সিনেমা পরিচালনায় আপনি কি ভাবে আসলেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ হঠাৎ করেই আসি বলা যেতে পারে। আমি দেখলাম, আমার কিছু গল্প নিয়ে ওরা বাংলাদেশ টেলিভিশন নাটক তৈরী করেছে। নাটকগুলি দেখে আমি ভাবলাম, আমি নিজেই যদি নাটক তৈরী করতে পারতাম তাহলে কি ওদের চেয়ে ভাল হত না মন্দ হত? আমি নতুন কিছু কি করতে পারতাম? ঐ আগ্রহ থেকেই আমি নাটক তৈরী শুরু করি। আর সিনেমা তৈরীর পেছনে মূল কারণটা হচ্ছে – এতো বড় একটা মুক্তি যুদ্ধ হয়ে গেছে আমাদের দেশে । কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোন ভাল ছবি তৈরী হয়নি। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে একটা ভাল ছবি হওয়া দরকার। এই থেকেই আগুণের পরশমণি ছবিটা বানিয়েছি। নট নেসেস্যারি যে বিশাল কিছু হয়ে গেছে। কিন্তু চেষ্টাটা ছিল আর কি।
বিবিসিঃ আপনার লেখা অনেক চরিত্র মানুষকে কাদিয়েছে, হাসিয়েছে। আপনি নিজে কেঁদেছেন কোন চরিত্রের জন্য?
হুমায়ূন আহমেদঃ আমি যখন লেখালেখি করি তখন কোন একটা চরিত্র খুব ভয়াববহ কষ্ট আর দুঃখের মধ্যে পড়ে যায় তখন নিজের অজান্তেই দেখি আমার চোখে পানি আসে। কাজেই কোন বিশেষ চরিত্র নয় সব চরিত্রের জন্যই আমার চোখে পানি আসে। আর আমি তো অনেক হিউমার পছন্দ করি। যখন আমি হিউমারগুলো লিখি আমি শিওর যে তখন আমার আশেপাশে কেউ থাকলে তারা দেখবে যে আমার ঠোটের কোণায় মুচকি হাসি দেখতে পাবে তারা। —
বিবিসিঃ আপনার নাটক কোথাও কেউ নেই –তে বাকের ভাইয়ের মৃত্যু ঠেকাতে মানুষ যখন প্রতিবাদ শুরু করল মানুষের আবেগের দিকে তাকিয়ে একবারও কি বাকের ভাইকে বাচিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদঃ এই নাটকের ২টি ভার্সন ছিল শেষে। একটি হচ্ছে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছি আরেকটি হচ্ছে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়নি। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়নি আমার খুব প্রিয় ভার্সন ছিল। কিন্তু বিটিভি শেষ পর্যন্ত ঠিক করে যেটায় ফাঁসি হয়েছে ঐটাই প্রচার করার ।
বিবিসিঃ কাল্পনিক চরিত্র বাকের ভাইয়ের সাথে মানুষের এমন একাত্ততা এনিয়ে আপনি কি ভাবছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ আমি খুবই অবাক হচ্ছিলাম । কত রকম মানুষের ফাসি হয়ে যায়, মানুষ মারা যায় রাস্তার পাশে, নির্দোষ মানুষকে ফাসিতে ঝুলিয়ে দেয়। এটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। এটা একটা চরিত্র, একটা কাল্পনিক চরিত্র। তার ফাসি হচ্ছে এটা নিয়ে যে এতো মাতামাতি এটা আমাকে খুব বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছিল এই টুকু বলতে পারি । শুধু তাই নয়। মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায়নি। তারপর শুরু হল কুলখানি। আজ অমুক জায়গায় বাকের ভাইয়ের কুলখানি। কাল অমুক জায়গায় বাকের ভাইয়ের কুলখানি। পরশুদিন বাকের ভাইয়ের জন্য মিলাদ মাহফিল। আমি এই রকম বিস্ময়কর ঘটনা ভবিষ্যতে দেখব তা মনে হয় না।
বিবিসিঃ আচ্ছা মিঃ আহমেদ, আপনার কোন কালল্পনিক চরিত্র নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে বহুব্রীহি নাটকের কাজের ছেলে সৈয়দ বংশ হওয়া বা একজন ডাক্তারের চরিত্র বোকা ধরণের হওয়া নিয়ে আপনার পাঠকের রসবোধ নিয়ে কি বিশেষ কিছু মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদঃ তখন মনে হয় জাতি হিসাবে আমরা খুব সিরিয়াস। প্রতি দিনের ঘটনায় যে একটা ফানি পাঠ আছে এটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আমরা সিরিয়াস পাঠের দিকে তাকাই। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের মানুষ তো খুবই রসিক বলে আমি জানি। ওরা এই রসটা ধরতে পারে না কেন এটা নিযে আমি খুব আপসেট হই বলা যেতে পারে। তবে বেশী পাত্তা দিই না।
বিবিসিঃ আচ্ছা , আপনার উপন্যাসের একটা জনপ্রিয় চরিত্র হিমু। এটা কি নিছক কাল্পনিক না এর ভেতর আপনি আপনার পরিচিত কাউকে তুলে ধরেছেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ না, হিমুতে আমি আসলে পরিচিত কাউকে তুলে ধরিনাই। যে হিমু আমি লিখি ঐ হিমু হওয়া খুবই জটিল ব্যাপার তো বটেই। আমি মানুষের অনেক আশা –ইচ্ছা পূরণের ব্যাপার আছে মানুষ অনেক কিছু করতে চায় কিন্তু করতে পারে না। মানুষের যে ইচ্ছাপূরণের যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো আমি হিমুর মাধ্যমে ঐ ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারগুলো ঘটাই। যে কারণেই আমার ধারণা পাঠক এটাকে এতো পছন্দ করে। এরা হতে চায়। এরা করতে চায়। এরা চায় প্রত্যেকেই যে আমার একটা আধ্যাত্বিক ক্ষমতা থাকবে। মানুষের ভুত-ভবিষ্যত বলে দিতে পারব। সবার ভেতরে এটা একটা গোপণ বাসনা। ওদের গোপন বাসনা আমি পথে ঘাটে হেটে বেড়াবো- কেউ আমাকে কিছু বলবে না। আমাকে চাকরি করতে হবে না। কোন কিছুই করতে হবে না। আমার জীবন চলবে জীবনের মতো। কোন বাড়ির সামনে গিয়ে যদি দাড়াই ওরা আমাকে খাবার দিবে। এই যে গোপন ইচ্ছেগুলো যেগুলো থাকে সেই ইচ্ছেগুলি আমি পূরণ করি হিমু উপন্যাসে। কাজেই কারো সাথে যে মিল আছে এটা মনে হয় না।
বিবিসিঃ আচ্ছা মিঃ আহমেদ, এই হিমু তো পাঠকদের কাছে প্রায় অনুকরণীয় একটা চরিত্র হয়ে দাড়িয়েছে। এই হিমুকে নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস সম্পর্কে কোন বিশেষ কোন ঘটনা আছে কি যা আপনাকে নাড়া দিয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদঃ হ্যাঁ, একটা বলা যেতে পারে। আমি হঠাৎ করে ইয়ে থেকে একটা ম্যাগাজিন পেলাম রাশিয়া এম্বাসী থেকে। ও ই ম্যাগাজিনে দেখি কি ওদের রাশিয়াতে একটা হিমু ক্লাব আছে। ওই হিমু ক্লাবের সদস্যরা সবাই কিন্তু রাশিয়ান; বাংলাদেশী ছেলে-পেলে না। ওরা একটা অনুষ্ঠান করেছে সেই অনুষ্ঠানে সব এম্বাসেডরদের ডেকেছে। এম্বাসেডরদের হলুদ পোশাক পরতে হবে। তারা জানে এম্বাসেডররা হলুদ পোশাক পরবেন না। কাজেই ঐ ক্লাবের তরফ থেকে প্রতিটি এম্বাসেডরকে একটি করে হলুদ নেকটাই দেয়া হয়েছে। তারা এই হলুদ নেকটাই পরে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এটা শুনে বা বইয়ের লেখাতে পড়ে আমি খুবই একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।
আরেক বার ধাক্কা খেয়েছি জার্মানীতে। জার্মানীতে গিয়েছিলাম আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলায়। সেখানে একটা বাসায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। এক ছেলে এসে আমাকে বলল যে, স্যার, আমি কিন্তু হিমু। হলুদ একটা কোট গায়ে দিয়ে আসছে। আমি বললাম, তুমি হিমু। হিমুর তো খালি পায়ে থাকার কথা। এই প্রচন্ড ঠান্ডা জার্মানীতে। তোমার কি খালি পা? বলল, স্যার, দেখেন। তাকিয়ে দেখি তার খালি পা। ওই দিনও আমি ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।
বিবিসিঃ বাংলাদেশে সাধারণত দেখা যায়, যারা নতুন লেখালেখি শুরু করে নতুন বই প্রকাশ করতে তাদেরকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়। আপনি যখন প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন তখন সেটা প্রকাশ করতে কি আপনার কি রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদঃ খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমাকে তেমন কোন প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমার প্রথম উপন্যাসের নাম “নন্দিত নরকে”। এটি প্রকাশ করতে খুব একটা সমস্যা হয়েছে আমি মনে করি না। কারণ, আহমদ ছফা বলে এক জন ছিলেন আমাদের দেশের খুবই স্পিরিটেড এক জন মানুষ। তিনি উপন্যাসটি পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। এই উপন্যাসটি যে কোন কারণেই তার খুব মনে ধরেগিয়েছিল। তিনি জান দিয়ে ফেললেন এটি প্রকাশ করার জন্য। এই উপন্যাসের পান্ডুলিপি বগলে নিয়ে তিনি প্রায় প্রতিটি প্রকাশকের ঘরে ঘরে গেলেন। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তো। আমি ব্যাপারটি জানিই না। শুধু ছফা ভাইয়ের সাথে দেখা হয় । ছফা ভাই খবর দেন – আজকে অমুকের কাছে গেছি, কালকে অমুকের কাছে গেছি। এভাবে বলে বলে তিনি এক জন প্রকাশককে মোটামুটি কনভিনসড করে য়েললেন যে উপন্যাসটি প্রকাশ করতে হবে।কাজেই উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে গেল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার আগে প্রকাশকের সাথে আমার পরিচয়ও হয়নি । আমি লাজুক টাইপের তো । যাইনি। লজ্জা লাগত খুব। যে দিন প্রকাশিত হল সে দিন গেলাম। গিয়ে কিছু বইপত্র নিয়ে আসলাম ওনার কাছ থেকে।
বিবিসিঃ মিঃ হুমায়ূন আহমেদ, সাহিত্যিক হিসাবে গত কয়েক দশক ধরে আপনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তুমুল জনপ্রিয়তা অনেক সময় বিড়ম্বনার কারণ হয় বলে শোনা যায়। আপনার ক্ষেত্রেও কি তাই হয়?
হুমায়ূন আহমেদঃ যে অর্থে বিড়ম্বনার কথা বলা হচ্ছে সে অর্থে আমি বিশেষ বিড়ম্বনার ভিতর যে পড়ি তা নয়। যদি বই মেলাতে যাই তখন পাঠকদের হুড়াহুড়িটা দেখে একটু ইয়ে লাগে- সামান্য ভয় ভয় লাগে। এছাড়া তো আমি নরমালি ঘোরাফেরা করি। আমি দোকানে যাই । বাজারে যাই। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরি। কোন সমস্যা তো দেখি না আমি। যেটা হয় সাধারণত বই মেলাতেই হয়। বই মেলার বাইরে ধর, এগোরাতে গেলাম বাজার করতে। সেখানে দুই এক জনকে পাওয়া যায় তারা আমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চায় । এটা তো খুবই স্বাভাবিক। এটা তো বিড়ম্বনা ধরার কিছুই না । তাই না?
বিবিসিঃ আচ্ছা আপনি লেখালেখি থেকে অবসর নেবার কথা কি কখনো ভেবেছেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ যখন খুব লেখালেখির চাপ যায় যেমন ধর, বই মেলার সামনে বা ঈদ সংখ্যার সামনে খুবই যখন চাপের ভিতর থাকি তখন দেখা গেল শেষ হয় যে দিন সে দিন মনে হয় এখন থেকে আমি অবসরে । আর লেখালেখির ভিতরে নাই। বাকি সময়টা আরামে থাকব, সিনেমা দেখব, গল্পের বই পড়ব। সে দিন মনে হয় । তারপরের দিন মনে হয় । কিন্তু ২য় দিন থেকে আবার মনে হয় আমার যেন কিছুই করার নেই । আমি মারা যাচ্ছি। এক্ষুনি বই/ কিছু একটা লেখা শুরু করতে হবে। লেখা শুরু করি । সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বস্তি ফিরে আসে। হ্যা, আমি অবসর নিব। আমি ঠিক করেছি অবসর নিব। মৃত্যূর ঘন্টা খানেক আগে অবসর নিব। তার আগে নিব না। আমি চাই মৃত্যুর ১ ঘন্টা বা ২ ঘন্টা আগে আমি যেন এক লাইন বাংলা গদ্য লিখে যেতে পারি।
বিবিসিঃ এটা কি মৃত্যুর সময়? আপনি কি ভাবে বুঝতে পারবেন?
হুমায়ূন আহমেদঃ বোঝা যাবে। বোঝা যায় না? অনেকেই তো বলে টের পায় যে আমি মারা যাচ্ছি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওই যে কি শেষ নিঃশ্বাস ফেলার জন্য শারীরিক প্রস্তুতি। মৃত্যু তো শুধু হার্ট বন্ধ হয়ে যায় তা না। মৃত্যু তো প্রতিটি জীবকোষ – প্রতিটি কোষ মারা যায়। প্রতিটি কোষের মৃত্যু তো একটি ভয়াবহ ব্যাপার। বুঝতে পারার তো কথা।
বিবিসিঃ তো আপনি শেষ পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান?
হুমায়ূন আহমেদঃ আমি পারব কিনা আমি জানি না । আমার গোপন ইচ্ছা এবং প্রগাঢ় ইচ্ছা হচ্ছে যে মৃত্যুর এক/দেড় ঘন্টা আগে যেন আমি এক লাইন বাংলা গদ্য লিখতে পারি। যেন হা হুতাশ করে না মরি। এই মইরা গেলাম রে, বাঁচাও রে। এই আল্লাহ-খোদাকে ডাকাডাকি করতেছে। এটা না করে আমি প্লেন এন্ড সিম্পল লাস্ট একটা ওয়ান লাইন আমি লিখতে চাই। এখন তুমি যদি বল কি সেটা – সেটা আমার মাথায় আছে; তোমাকে আমি বলব না।
বিবিসিঃ অনেক ধন্যবাদ। আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য ।
হুমায়ূন আহমেদঃ অর্চি , তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ। তুমি অনেক ভাল থাক এবং মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে ব্যস্ত থাক। যাও।”
[অনুলিখন : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
সাক্ষাৎকার – জুলাই, ২০০৮ (দৈনিক সমকাল)
১৮ জুলাই ২০০৮ সালে সুইডেনে হুমায়ুন আহমেদ দৈনিক সমকালের সাংবাদিক সাব্বির রহমান খান কে একটা সাক্ষাৎকার দেন।
সাব্বির খানঃ আপনাকে স্যার বলছি, ঠিক আছে?
হুমায়ুন আহমেদঃ ২২ বছর মাস্টারী করেছি, স্যার বলবে নাতো কি বলবে। ২ বছর আমেরিকায়, আর বাকী সময় বাংলাদেশে। সারা বাংলাদেশে সবাই-ই আমাকে স্যার ডাকে। এখন বলো, আমার কোন ইন্টারভিউ তো না?
সাব্বির খানঃ আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। কিছু কথা জানার আগ্রহ নিয়েই আমার আসা।
হুমায়ুন আহমেদঃ আমিতো ইন্টারভিউ দেশেও দেইনা, তাই বাইরে এসে যদি ইন্টারভিউ দেয়া শুরু করি, তাহলে দেশের সাংবাদিকদের জন্য সেটা হবে অস্বস্তিকর ব্যাপার। তারা খুব ভালো ভাবে জানে যে, আমি ইন্টারভিউ দেইনা। এই হলো প্রব্লেম।
সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনার ছবির শুটিং সম্বন্ধে একটু জানতে এসেছি। সুইডেনকে শুটিংয়ের জন্য কেন বেছে নিলেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি সুইডেনে যে ব্যাপারে এসেছি, তার মেইন ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলি। আমরা বাংলাদেশে ছবি বানাই ৩৫ মিমি ক্যামেরায়। ওই ছবিগুলোতে প্রয়োজন হয় ফিল্মের। ফিল্মে ছবিগুলো এক্সপোজড হয়। যেহেতু পৃথিবী বহুদুর এগিয়ে গিয়েছে, এখন শুরু হয়েছে ফটোগ্রাফি ডিজিট্যালি নেয়া। যদি ডিজিটেলি ফটোগ্রাফি করা হয়, তাহলে অনেক কিছু করা যায়। ফিল্মে ফটোগ্রাফিতে বেশি কিছু করা যায়না। ডিজিটেল ফটোগ্রাফিতে একটাই সমস্যা হয়, তাহলো Depth of field এর সমস্যা। ধরুন আমরা যদি ৩৫ মি.মি.-এ দুজনকে ধরি, তাহলে দুজনের পিছনে যা থাকবে, তা থাকবে খুবই ক্লিয়ার এবং এটা খুবই ইন্টারেস্টিং। কিন্তু ডিজিটেলি এটা করতে পারে না। তবে নতুন একটা টেকনোলজি এসেছে। সেটা হচ্ছে কি, একটা হাই ডেফিনিশন ভিডিও ক্যামেরা ব্যাবহার করে, তার সাথে একটা এডাপ্টার লাগায়। তার পরে যে সমস্ত লেন্সগুলো আছে, সেগুলো বসায়। এই প্রক্রিয়ায় যে রেজাল্ট হয়, তা ৩৫ মিমি ক্যামেরার খুব কাছাকাছি। হলিউডে যে সব ছবি করা হয়, তারা তাতে এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে, যা দুএকটা উদাহার আমি দেখেছি। তাতে কোন রকম পার্থক্য আমি পেলাম না ৩৫ মি.মি. ক্যামেরার ফিল্মের সাথে। কিন্তু বোম্বেতে কিছু ছবি তারা করেছে, তাতে বোঝা যায় যে, ওগুলো ভিডিওতে করা। হলিউডের ছবিগুলোতে তা বোঝা যায়না। যেহেতু নতুন জিনিসের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ আছে বলে আমরা ঠিক করলাম যে আমরা চেষ্টা করবো এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে। প্রথম কারন হচ্ছে নূতন একটা টেকনোলজির কাছে যাওয়া, আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে, এটা এতো এক্সপেন্সিভ না। আর তৃতীয় কারন হচ্ছে, কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা যে চেঞ্জগুলো করতে পারবো, ৩৫ মি.মি. তা সম্ভব না। এই তিনটি কারনে উৎসাহীত হলাম। তারপরে মাসুদ আখন্দ (সহকারী পরিচালক) এই এডাপ্টারটা যোগার করেছে এবং লেন্সগুলো তাতে সেট করা যাচ্ছে, তাই ঠিক করলাম যে ছবির প্রথম পর্বটা সুইডেনে করবো এবং দ্বিতীয় পর্বটা বাংলাদেশে করবো। যেহেতু এই টেকনিকে আমি অভ্যস্ত না, তাই এটা দিয়েই শুরু করলাম।
সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনি শুটিং করতে গিয়ে কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ নানাবিধ সমস্যা আছে এখানে। প্রথমতঃ লোকবলের সমস্যা, দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, এখানে প্রতিটা জিনিসই খুব এক্সপেন্সিভ। যেমন আমি যে একটা ক্রেন ভাড়া করবো, যেটা উপর থেকে নীচে যাবে বা নীচ থেকে উপরে যাবে, সেটা ভাড়া করতে পারছিনা। তাতে আমাদের বাজেটে কুলোবে না। কিন্তু দেখা যাক কি হয়। কাজতো শুরু করলাম। আগামি শীতে আবার যখন আসবো, তখন এখনকার শুটিংয়ে যে ত্রুটিগুলো ধরা পড়বে, সেগুলোর আবার নতুন করে শট নেবো। যেহেতু আমাদের ছবিতে গ্রীস্মের এবং শীতের দুটি পর্ব আছে, সেহেতু আমাদের এখানে দুবারই আসতে হবে। গ্রীস্মেরটা এখন হয়ে গেলো, শীতেরটা পরে হবে। আমার পরিকল্পনা ছিল স্কটল্যান্ডে এই ছবিটা করতে। কিন্তু এখানে যেহেতু মাসুদ আছে, সে ফিল্ম লাইনে পড়াশুনা করেছে। তার মেধা এবং অভিজ্ঞতাকে ব্যাবহার করা যাবে এবং তার কম্পিউটারের জ্ঞ্যান ভালো, সেটাকে পুরোপুরিভাবে ব্যাবহার করা যাবে। সর্বোপরি, এখানকার ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে কাজ করবে। এই সব বিষয় বিবেচনা করে ভাবলাম যে, এই জায়গাটা ঠিক আছে। এইভাবেই আমরা ছবিটা তৈরিতে অগ্রসর হয়েছি। পূর্বে দেশীয় ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করেছি। এবার ইউরোপে একজন ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করছি। দেশের অংশটা দেশীয় ক্যামেরাম্যান নিয়ে করবো।
সাব্বির খানঃ দেশীয় এবং ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যানের মধ্যে পার্থক্য কি?
হুমায়ুন আহমেদঃ এই দুই ক্যামেরাম্যানের মধ্যে প্রথমতঃ শিক্ষাগত পার্থক্য। ইউরোপীয়ানরা ক্যামেরা বিষয়ক সমস্ত থিওরী জানে। আর আমাদের দেশের ক্যামেরাম্যানরা হচ্ছে গুরুর কাছ থেকে শেখা, অর্থাৎ গুরুমুখী বিদ্যায় শিক্ষিত। তারা গুরুর কাছ থেকে আস্তে আস্তে সবকিছু শিখে নেয়। আমাদের ক্যামেরাম্যানদেরকে ছোট করার কোনই কারন নাই। এদের অভিজ্ঞতা খুব বেশি। এরা ২০-২৫ বছর ধরে কাজ করছে। আমি নিজে দেখেছি, এরা ক্যামেরার আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারে যে, ক্যামেরাটা রান করছে, না স্লো হয়ে যাচ্ছে। এটা শুধুই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারনে সম্ভব।
সাব্বির খানঃ কেন দেশী এবং বিদেশী দুই ধরনেরই ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করবেন? তাতে অসুবিধা হবেনা?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমাদের দেশটা হচ্ছে খুব স্লো, এশিয়ার সব দেশই বলা যায় স্লো এবং এই স্লো ব্যাপারটা ছবিতেও চলে আসে। একটা উদাহারন না দিলে বোঝা যাবে না, ধর তুমি একটা কাগজে কিছু একটা লিখছো। ক্যামেরাটা তোমার মুখের উপরে ধরা। সেখান থেকে ক্যামেরাটা কাগজের উপর নামবে। আমাদের দেশের ক্যামেরাম্যানরা খুব স্লোলী ক্যামেরাটা মুখ থেকে কাগজের উপর নামাবে, অথবা মুখ থেকে কাট করে দ্বিতীয় শটে কাগজটা দেখাবে। ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যানরা ধাম করে নীচে নামাবে। এরা খুব দ্রুত। আমাদের দেশে সে স্পিডটা নাই। আমরা জাতীগতভাবে স্লো, দেশটা স্লো, কথাবার্তায় স্লো। আমরা সবকিছুতেই খুব স্লো। আমি চাই, ফিল্মের ইউরোপীয়ান পর্ব যেটা হবে, সেটা হবে ইউরোপীয়ান স্টাইলে, খুব ফাস্ট। আর বাংলাদেশী পর্ব যেটা হবে, সেটা হবে আমাদের দেশীয় স্টাইলে, খুব স্লো। তাতে স্পস্ট একটা পার্থক্য তৈরি হবে।
সাব্বির খানঃ ছবিটার নাম কি হবে?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমার “নক্ষত্রের রাত” নামের উপন্যাস অবলম্বনে হবে এই ছবিটা। উপন্যাসের নামে অবশ্য ছবির নাম হবে না। ছবির নাম এখনো ঠিক করা হয়নি। তবে প্রথমিকভাবে “ চোখে আমার তৃষ্ণা ” নামটি ঠিক করেছি ছবির জন্য। এটা রবীন্দ্র নাথের গানের একটা লাইন। তবে নামটা বদলানো হতে পারে।
সাব্বির খানঃসুইডিশ কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকছেন কি এই ছবিতে?
হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যা থাকছে। অনেকেই অভিনয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
সাব্বির খানঃ সুইডিশদের সাথে কাজ করতে কেমন লাগছে?
হুমায়ুন আহমেদঃ ভালোই লাগছে। তবে ওরা খুব রোবোটিক । ওরা হুকুমের বাইরে এক পা-ও নড়বেনা। ওদের যা বলে দেয়া হচ্ছে, ওরা ঠিক ততটুকুই করছে। তার বাইরে না। ওদের বলেছি মাঝে মাঝে একটু ইম্প্রোভাইস করতে, কিন্তু তারা তা করছে না। শুধু আমি যতটুকু বলছি, ততটুকুই করছে। তবে তারচেয়েও বেশি অসুবিধা হচ্ছে লাইটিংয়ের ব্যাপারে। ডিজিটেলেতো লাইটের খুব একটা বেশি প্রয়োজন পড়ে না, আর আমি প্রচুর লাইট নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত। তাতে আমার বেশ একটু অসুবিধা হচ্ছে। তবে দেখা যাক, কাজতো এগিয়ে চলছে!
সাব্বির খানঃ এই ছবিটা তৈরিতে খরচ কেমন হবে বলে মনে করছেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমার সব ছবিতে সাধারনত এক কোটি টাকার মতো খরচ হয়। আমার মনে হয়, এটাতেও তাই হবে। ইউরোপে টাকার এই অংকটা খুবই কম হলেও, আমাদের দেশে অনেক বেশি।
সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনি এখন শুটিং করছেন এবং আগেও এসেছেন। সুইডেন এবং বাংলাদেশের মধ্যে আপনি কোন ব্যাপারগুলোর মিল বা অমিল খুঁজে পান?
হুমায়ুন আহমেদঃ মিল তেমন কিছু নাই। বাংলাদেশের মানুষরা খুব সুখী মানুষ। ধরুন, বন্যায় ঘর ডুবে গেছে, ঘরের চালের উপর আশ্রয় নিয়েছে মানুষ, ঠিক তখন সেখান দিয়ে দেশী বা বিদেশী কোন টিভি টিম যাচ্ছে, তখন তারা কি করবে? হাসবে অথবা হাত নাড়বে। এই ঘটনা সুইডেনে কখনোই সম্ভব না। এটা শুধুই আমাদের দেশে সম্ভব। আবার পেটে ভাত নাই, নৌকায় কোথাও যাচ্ছে। নৌকায় চড়েও দেখবেন একটা গান ধরছে। এটা আমাদের দেশেই সম্ভব। সুইডিশরা তা পারবেনা।
সাব্বির খানঃ আপনি বলতে চান যে বাংলাদেশের মানুষ আসলেই খুব সুখী?
হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই। কিছুদিন আগে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষদের দেশের একটা তালিকা বের করেছিল। সেখানে বাংলাদেশ ছিলো পাচ নাম্বারে। দুর্নীতির তালিকায় এক নাম্বারে থাকলেও সুখীর তালিকায় কিন্তু পাঁচ নাম্বারে।
সাব্বির খানঃ আপনিতো মুলতঃ একজন লেখক। কিন্তু আপনি একই সাথে নাট্যকার ও চলচিত্র পরিচালক। আপনি নিজেকে কি হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি আসলেই একজন লেখক। আমি নিজেকে বলি ফিকশন রাইটার। কখনোই আমি নিজেকে ফিল্মমেকার বলিনা। ছবি দেখার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার খুব আগ্রহ ছিল। আমি কত সুন্দর সুন্দর ছবি দেখি, কিন্তু আমাদের দেশে সেরকম বানাতে পারছেনা। এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হলো, অথচ মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ছবি নাই। এই আফসোস থেকেই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ছবি বানালাম “আগুনের পরশমনি”। এই ছবি করতে সমস্ত খরচ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তারপর থেকে চালিয়ে যাচ্ছি ছবি বানানো। আসলে ছবির লাইনটা হচ্ছে একটা নেশার মতো। সিগারেটের যেমন নেশা, গাঁজার যেমন নেশা, সিনেমা বানানোর নেশা তারচেয়েও বেশি।
সাব্বির খানঃ আপনি থামবেন কোথায়? লেখালেখিতে, সিনেমায় না অন্য কিছুতে? নাকি সবকিছু একসাথে নিয়ে চলবেন, কোথাও থামবেন না? শিক্ষকতায় ফিরে যাবেন কি?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি লিখে যাবো। অন্য কিছুর কি হবে জানিনা, তবে লেখালেখি থামবেনা। আর আমরাতো ভবিষ্যতের ব্যাপারে খুব একটা ভাবিনা। তাই জানিনা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে। আমরা হচ্ছি, “প্রডাক্ট অব দ্য প্রেজেন্ট”! প্রেজেন্ট নিয়েই আমাদের সমস্যা বেশি।
সাব্বির খানঃ আপনি কিছুক্ষন আগে বলেছেন যে, আমরা খুব স্লো-জাতী। এটা যদি আমাদের জন্য একটা নেতিবাচক দিক হয়, তাহলে আমাদের ঠিক হওয়ার জন্য কি করা উচিত?
হুমায়ুন আহমেদঃ এটাকে ঠিক করার কিছু নাই। এটা যেমন সেরকমই থাকবে। এর মাঝখান থেকে নতুন নতুন ছেলেপেলে বেরোচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। তারা খুবই স্মার্ট, খুবই আধুনীক। বাংলাদেশকে পরিবর্তন করার দায়িত্ব এদের। এরা করবে।
সাব্বির খানঃ আপনিতো বাংলাদেশ প্রচন্ড জনপ্রিয়। আপনার এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধানের লক্ষে কিছু একটা করা যায়না?
হুমায়ুন আহমেদঃ একজন লেখক কিন্তু সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করতে পারেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান তিনি দেবেন না বা এটা তার দায়িত্ব না।
সাব্বির খানঃ এটা কার দায়িত্ব?
হুমায়ুন আহমেদঃ এ দায়িত্বটা রাজনীতিবিদদের। সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব। একজন লেখক রাজনীতিবিদ না, বা সমাজ সংস্কারক না। এটা তার দায়িত্বও না।
সাব্বির খানঃইঙ্গিত থাকবে কিন্তু প্রস্তাবনা থাকবেনা, এটা কি ঠিক?
হুমায়ুন আহমেদঃ ইঙ্গিতের ভিতরেইতো প্রস্তাবনা থাকে। কিন্তু সেগুলোকে গুরুত্ত্বের সংগে বিবেচনা করার কিছু নাই।
সাব্বির খানঃ আমাদের রাজনীতিবিদ বা প্রশাসনগুলো কি এই ইঙ্গিত বা প্রস্তাবনাগুলো যাচাই করে থাকেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ না না না। এই সমস্ত ইঙ্গিত বা প্রস্তাবকে গুরুত্ত্বের সংগে নেয়ার কিছু নাই। আমাদের মুসলমানদের কথাই যদি ধরি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট পবিত্র গ্রন্থ কোরান যদি আমাদের চেঞ্জ করতে না পারে, একজন ঔপোন্যাসিক কি একটা উপন্যাস লিখে তাদের চেঞ্জ করতে পারবেন? সেটা কিভাবে সম্ভব?
সাব্বির খানঃ লেখক হুমায়ুন আহমেদের সমাজের প্রতি অঙ্গিকার বা দায়বদ্ধতা কি?
হুমায়ুন আহমেদঃ লেখক হিসেবে আমার অঙ্গিকার একটাই, যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের জন্ম, সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা সবাইকে জানিয়ে রাখা। কারন আমি যখন একজন যুবক, তখন সেই যুবকের দৃষ্টি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধটি দেখেছি।
সাব্বির খানঃ আপনিতো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। আপনার দৃষ্টিতে একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদী এবং বর্তমানের মৌলাবাদ ও মৌলবাদীর মধ্যে তফাৎ কোথায়?
হুমায়ুন আহমেদঃ একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদীরা ছিল একটা বিদেশী শক্তির অর্থাৎ পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে যে মৌলবাদ ও মোলবাদীরা কোন বিদেশী শক্তির অংশ না। এটাই পার্থক্য। তবে আমাদের এতো মৌলবাদ-মৌলবাদী বলে চিৎকার করে লাভ নেই কিছু, কারন বিশ্বের সব দেশেই এখন এসব আছে। ইন্ডিয়াতে আছে বিজেপি, আমেরিকাতে আছে ক্লু ক্লাক্স ক্লান, সারা পৃথিবীতেই আছে মৌলবাদী।
সাব্বির খানঃ বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা কি সমস্যা না? বিএনপি-জামাত সরকারের সময়ে বাংলা ভাই, শায়খুল, ৬৩টা জেলায় এক সাথে বোমাবাজী এসব কি সমস্যার আওতায় পড়ে না?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি মনে করি না। বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা এতো বড়ো কোন সমস্যা এখনো হয়নি। জনগন যদি ভোট দিয়ে মৌলবাদিদের নির্বাচন করে, গনতান্ত্রিকভাবে কি তাদের বাদ দেয়া যায়? হোক না তারা মৌলবাদী।
সাব্বির খানঃ এই দুর্মূল্যের বাজারে বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালীরা এখন কেমন আছে?
হুমায়ুন আহমেদঃ সবাই খুবই ভালো আছে। বিশ্বের সব জায়গায়ই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। এখনো বাংলাদেশে চালের দাম বিশ্বের যে কোন জায়গার চেয়ে কম।
সাব্বির খানঃবাংলাদেশের বর্তমান সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি তাদের খুব ভালো দৃষ্টিতে দেখি। তারা খুব ভালো কাজ করছে।
সাব্বির খানঃ একটা স্বাধীন দেশে এতদিন জরুরী অবস্থা জারী করে রাখা কি উচিত?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা এতদিন দেশটাকে যে অবস্থা করে রেখেছিল, আগামী আরো দুবছরও যদি জরুরী অবস্থা জারী থাকে, আমি তার বিরূদ্ধে একটি কথাও বলবো না। কারোর পক্ষে কখনোই কি সম্ভব ছিল তারেক জিয়া, কোকো এদেরকে জেলে ঢোকানো? এর পরে যদি আওয়ামী লীগ সরকারও আসতো, পারতো কি এদের ধরে ধরে জেলে ঢোকাতে? কখনোই পারতো না। কারন একাজ করতে গেলে সবার থলেরই বিড়াল বেরিয়ে পড়তো। প্রত্যেকেইতো যার যার থলেতে একটা করে বিড়াল নিয়ে ঘুরছে।
আমাদের যে জেনারেল মইন ঊ আহমেদ, খুব নরম মনের মানুষ, কিন্তু খুব শক্ত। যেই ইন্ডিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করলো, আমাদের জেনারেল ভারতে গেলেন, সেখানে যারা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, তাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসলেন, সম্মান দিলেন। এই কাজটা কি আওয়ামী লীগ সরকার করতে পারতো না? আমাদের জাতী হিসাবে একটা কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবেনা? এতোগুলো ভারতীয় সৈন্য আমাদের জন্য আত্নত্যাগ করলো, আমরা কি পারতাম না তাদের স্মরনে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে? আমরা করিনি কিন্তু! একটা অন্য দেশের সন্তানরা আমাদের দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, এটা আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল।
সাব্বির খানঃ বাংলাদেশ থেকে জামাতের মৌলবাদী রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। আপনি কি বলেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি কোন রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষপাতি না। “সারভাইভ্যাল ফর দ্য ফিটেস্ট”। যে ফিটেস্ট, সে সারভাইভ করবে। যে আন-ফিট সে সারভাইভ করবে না। রাজনীতি বন্ধ করে কিন্তু একটা জিনিস বন্ধ করতে পারবে না।
সাব্বির খানঃ বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদ বিতাড়নের উপায় কি বলে আপনি মনে করেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ বাঙ্গালীদের শিক্ষিত হতে হবে। এখানে মাদ্রাসা শিক্ষা নয়, আমি সাধারন বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলছি। যদি সাধারন শিক্ষায় বাংলাদেশীরা শিক্ষিত হয়, তাহলে বাংলার মাটিতে মৌলবাদীদের চিহ্ন থাকবে না। অশিক্ষিতকেই একজন মৌলবাদীর পক্ষে ভুল বোঝানো সম্ভব। ধর্মীয় শিক্ষার জন্যতো আমার ঘরই যথেষ্ঠ। মাদ্রাসায় গিয়ে পড়তে হবে কেন। আমাদের যদি যেতে হয়, তাহলে সাধারন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেয়েই আমাদের শিক্ষা গ্রহন করতে হবে।
সাব্বির খানঃআপনার কি মনে হয় ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে?
হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই হবে।
সাব্বির খানঃ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে কথিত মাইনাস-টুর যে ফর্মূলা, এব্যাপারে আপনার অভিমত কি?
হুমায়ুন আহমেদঃ এই সরকারের আগে দেশের যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে দেশের সাধারন মানুষই বলতো দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে দেশ পরিচালনার কথা। এটা এই সরকারের কোন কথা নয়। এটা বাংলাদেশের মানুষেরই কথা। আমাদের দেশে অসংখ্য জোকস (কৌতুক) আছে এই দুই নেত্রীকে বাদ দেয়ার ব্যাপারে। আর আমরা হচ্ছি কি… আমরা এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট। যখনই এই সরকারের এক বছর পূর্তি হল এবং তারা কিছুটা এস্টাবলিশ হলো, তখনই আমরা এন্টি- এস্টাবলিশমেন্টের ধাঁচে কথা বলা শুরু করলাম। অথচ এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার কি ছিল? নাথিং!
সাব্বির খানঃ বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ?
হুমায়ুন আহমেদঃ তারা যথা সম্ভব সংবিধান মেনে চলছেন বলে আমার বিশ্বাস।
সাব্বির খানঃ বর্তমানে দুই নেত্রীর একজন জেলে, আর অন্যজন চিকিৎসার জন্য বাইরে। এব্যাপারে আপনার অভিমত কি?
হুমায়ুন আহমেদঃ তারা যদি দোষী হয়, তাহলে তাদের সাজা হওয়া উচিত। আর যদি দোষী না হয়, তাহলে তাদের বিচারের মাধ্যমে জেল থেকে বের হয়ে আসা উচিত।
সাব্বির খানঃ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারকে দেখা গেছে মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করে। কেন তারা মৌলবাদের সংগে আঁতাত করে?
হুমায়ুন আহমেদঃ আঁতাতটা হয় মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দেখেছেন না, আওয়ামী লীগ কিভাবে খেলাফত আন্দোলনের সাথে পাঁচ দফার চুক্তি করেছিল। কেন করেছিল? মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে। বিএনপিতো মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করবেই। কারন তারা সেই ধরনেরই রাজনীতি করে। কিন্তু যেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নেতৃ্ত্ব দিয়েছে, জনগন কি অন্তত তাদের কাছ থেকে এই রাজনীতি আশা করে?
সাব্বির খানঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে এই সরকার কেন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
হুমায়ুন আহমেদঃ এই সরকারই প্রথম যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কথা বলেছে। এর আগে আর কোন সরকার এই ব্যাপারে কথা বলেনি। এমন কি আওয়ামী লীগ সরকারও না। তবে আমার ধারনা, বর্তমান সরকার বিদায়ের আগে এব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদায় নেবে।
সাব্বির খানঃ আপনার কি চান যে এই সরকার নিজ উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্র্যাইবুনাল গঠন করুক?
হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই চাই। কারন এটা সরকারেরই দায়িত্ব এদের বিচার করা। এরকম অন্যান্য দেশেও হয়েছে এবং হচ্ছে।
সাব্বির খানঃ আপনি এখন সুইডেনে। বাংলাদেশের তসলিমা নাসরিনের সাথে কি আপনার যোগাযোগ হয়েছে?
হুমায়ুন আহমেদঃ না হয়নি।
সাব্বির খানঃ কিছুদিন আগে আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে পশ্চিম বঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তসলিমাকে একজন বিতর্কিত লেখিকা বলেছেন। আপনি কি এই ব্যাপারে একমত?
হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, আমার মনে হয় উঁনি একজন বিতর্কিত লেখিকা। কারন ওঁনার লেখা দিয়ে উনি নিজেই নিজেকে বিতর্কিত করেছেন। তবে তসলিমা নাসরিন যে নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আছেন, সেজন্য আমি খারাপ বোধ করি। কারন একজন লেখক তার মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকার রাখে। তসলিমাকে দেশে ফিরতে দেয়া উচিত।
সাব্বির খানঃ আপনি কি কোন রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতবাদের প্রতি অনুগত?
হুমায়ুন আহমেদঃ যে কোন লেখকে জন্য রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতবাদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা ক্ষতিকর। কারন তার লেখা কোন সাহিত্য হবেনা, সেটা হবে একটা মূখপত্র। আনুগত্য স্বীকার করার মত কোন সমস্যার মধ্যে আমি পড়িনি। কারন যে সব দর্শনের কথা বলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগইতো আমার নিজের। আর আমি লেখালেখি করি প্রথমত আমার নিজের আনন্দের জন্য। সে আনন্দের ভাগ যদি পাঠকরা পায়, তাহলেতো গুড এনাফ। লেখক হিসেবে মতবাদ প্রচার করার দায়-দায়িত্ব আমার না।
সাব্বির খানঃ বাংলাদেশের লেখকরা কি স্বাধীন?
হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন।
সাব্বির খানঃ তাহলে ডঃ হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ কারন যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিৎ যে, যে-কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয়না।
সাব্বির খানঃ ঠিক একই কারনে কি তাসলিমা নাসরিন দেশ থেকে বিতাড়িত?
হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, হয়তোবা।
সাব্বির খানঃ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশ-দ্রোহীর মামলার মাথায় নিয়ে মৃত্যু বরন করেছেন। ওঁনার অপরাধ কি ছিলো? আপনি কেমন বোধ করেন এব্যাপারে?
হুমায়ুন আহমেদঃ ওনাকে তো কেউ খুন করেনি। উনিতো ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। ওঁনাকে দেশদ্রোহী কখনোই বলা হয়নি। দেশদ্রোহীর কথাটা ভুল ইনফরমেশন। তার বিরুদ্ধে কখনোই দেশদ্রোহীর মামলা করা হয়নি। তাছাড়া সমস্ত ব্যাপারটাই ছিল এত তুচ্ছ, আমরা জানি যে, সমস্তটাই ছিল একটা সাজানো খেলা। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নাই। মৌলবাদীরাতো কতবার আমাকে মুরতাদ বলেছে, তাতে কি আমি মাথা ঘামিয়েছি কখনো? কখনোই না।
সাব্বির খানঃ আপনি কি সমাধীকারে বিশ্বাস এবং নিজের জীবনে চর্চা করেন?
হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই। এটা বাংলাদেশে সবাই করে। বিশেষ করে আজকালকার অফিস আদালতের দিকে তাকালে প্রচুর মেয়েদের দেখা যায়, যা পূর্বে ছিলনা। আমি নিজেওতো আমার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ না করে কিছু করিনা। তার মতামতের যথেষ্ঠ গুরুত্ব আমি দেই।
সাব্বির খানঃ আপনার নিজের ব্যাপারে কি শুনতে আপনার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমার ব্যাপারেতো আমি খারাপ কিছু শুনিনা। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি বলে যে, আপনার এই বইটা খুব একটা সুবিধার হয় নাই, তাহলে খারাপ লাগে। পরচর্চাও খারাপ লাগে। আমি নিজেই তার শিকার হয়েছিলাম যখন একটা ফ্যামিলি ছেড়ে দিয়ে, নতুন একটা ফ্যামিলি শুরু করলাম, তখন এরকম হয়েছিল।
সাব্বির খানঃ আপনি কেমন আছেন স্যার?
হুমায়ুন আহমেদঃ আমি ভালো, আমি খুব ভালো আছি।
সাব্বির খানঃ আপনি কি সুখী? আপনার সংসার কেমন চলছে?
হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, আমি ১০০% সুখী। আমার সংসার ভালো চলছে। আমার সংসার ভালো না চললে কি আমি আমার স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে আসতাম! আমার বড় ছেলেটিও আমার সাথে এসেছে।
সাব্বির খানঃ স্যার, আপনি অনেক সময় দিয়েছেন আমাকে আজ। আমার এবং দৈনিক সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই এবং আপনার সুখী-সমৃদ্ধ জীবন কামনা করি। ভালো থাকবেন।
হুমায়ুন আহমেদঃ তোমাকে এবং তোমার মাধ্যমে আমার পাঠকদের জানাই অনেক ধন্যবাদ।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
সাক্ষাৎকার – মার্চ, ২০০৭ – দৈনিক সমকাল
২০০৭ সালের ৩ মার্চে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় নূহাশ হুমায়ুন, গুলতেকিন ও হূমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হল। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও অনুলিখন করেছিলেন আরিফুর রহমান।
মা গুলতেকিনের সঙ্গে নূহাশ হূমায়ূন
চশমা পরা হ্যাংলা ফরসা ছেলেটাই নূহাশ, নূহাশ হূমায়ূন। পড়ে সানবিম স্কুলে নবম শ্রেণীতে। ওর বয়স এখন ১৫ বছর। অবসরে ছবি আঁকে, অ্যানিমেশন করে, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, ছবি তোলে, গল্প লেখে, গান লেখে। এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে নূহাশের প্রথম বই ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’। ,বইটি সে ইংরেজিতে আনুবাদ করেছে যা বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ওর বাবা হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন। নূহাশ এবং তার বন্ধুরা বেশকিছু ত্রিমাত্রিক ছবিও নির্মাণ করেছে। সে খেলাধুলা করতে খুব একটা পছন্দ করে না। তার পড়তেও ভাল লাগে না। তবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে ও খুব পছন্দ করে। নূহাশ ছবি আঁকছে দু’তিন বছর হলো। সে মূলত পেন্সিল স্কেচ করে। ওর ছবির বিষয় মানব শরীর।
আমার বইঃ ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’ বইটা লেখা হয়েছিল ১৯৮১ অথবা ’৮২ সালে। কিন্তু পড়ে মনে হয় অনেক আধুনিক। আমি যখন বইটা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলাম, তখন আমার প্রধান ভয়টা ছিল, বাংলাটা পড়ে যেমন চোখে পানি চলে আসে, ইংরেজিটা পড়েও কি চোখে পানি আসবে! তাই কয়েক পৃষ্ঠা লিখেই আমি বাবার কাছে লেখাগুলো নিয়ে যাচ্ছিলাম প্রায় প্রতিদিন। বাবা দেখে তার মতামত জানাচ্ছিলেন। পড়তে পড়তে বাবা এক সময় বললেন, ‘এখন তো আমি আর তোমার প্রুফ রিডার না। আমি পড়ে তো আর ভুল ধরতে পারছি না। আমি গল্পের ভেতর পুরো ঢুকে গেছি।’ এটা শুনে আমার খুব ভাল লাগল। মনে হলো, আমি সফল হয়েছি ।
আমার আছেঃ আমার অনেক ধরণের সংগ্রহ আছে। আমার সংগ্রহে আছে অনেক বড় বড় রোদ চশমা, যা কেউ পরে না। আছে মজার কিছু মুখোশ । এর কিছু বাবা দিয়েছেন, কিছু আমি কিনেছি। একটি কঙ্কাল আছে, আমার খুব প্রিয়। আমরা বন্ধুরা মিউজিক নিয়ে এক সঙ্গে অনেক কাজ করি। আমাদের সিনেমায় ব্যবহার করার জন্য আমরা কিছু গান লিখেছি। আমি সব ধরনের গানই শুনি। তবে প্রোগ্রেসিভ রক বেশি শুনি। মাঝে মাঝে পপ অথবা হেভি মেটালও শুনি। বাংলা গান তেমন শোনা হয় না। নতুন একটা সিনেমা করছি ‘কোকিল’। আর বাবার লেখা বই গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা একটা বই আমার এত ভাল লাগবে, আমি কখনো ভাবিনি। অন্যগুলোর মধ্যে ময়ুরাক্ষী আমার অনেক মজা লেগেছে। মিসির আলীর বইগুলো ভাল লাগে। কারণ এগুলো পড়লে বোঝা যায়, অনেক চিন্তা-ভাবনা করে লেখা। মন খারাপ থাকলে হিমু পড়তে ভাল লাগে।
প্রিয় বাবা-মাঃ বাবার সঙ্গে আমার পছন্দের মিলটা খুব বেশি। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয় আমার। বাবার কথা বলার ঢঙ আমার খুব ভালো লাগে। খুব চমৎকার করে কথা বলতে পারেন তিনি। আর মায়ের সঙ্গে হচ্ছে আমার অন্যরকম সম্পর্ক। মায়ের সঙ্গে আমি সবসময় থেকে এসেছি। একজনের সঙ্গে সারাজীবন থাকলে যে রকম একটা টান হয়ে যায় ওরকম। আর বাবার মধ্যে অনেক জিনিস আছে, যেটা ভাল লাগার মতো, যা স্বাভাবিকভাবেই ভাল লাগে। আমি যদি বাবাকে নাও চিনতাম তাহলেও আমি হয়ত তাকে এত ভালোবাসতাম। বাবার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, কথা বলার আগে তিনি চিন্তা করে কথা বলেন, চিন্তা না করে একটা শব্দও বলেন না। তার বইয়ের রুচি, তার সিনেমার রুচি সব আমার খুব ভালো লাগে। আমার সঙ্গে খুব মেলে। কখনো লিখলে বাবাকে নিয়েই লিখব। আমার বাবা খুবই চালাক। তিনি খুব জটিল ভাষায় নিজের মতো করে কথা বলতে পারেন; তার কথা শুনে মনে হবে তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ! আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় এটা তার সবচেয়ে ভালো দিক। মাঝে মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে খারাপ দিক।
মা’র চোখেঃ ইকুয়েশন ফিহা বইটি আমি এখনো পড়িনি। আমার মনে হয়, নূহাশ এবং আমার সম্পর্কটা ওর সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্কের তুলনায় অনেক বেশি কাছের। আমি কখনো কাউকে তুই বলি না কিন্তু নূহাশকে আমি তুই বলি। ও বিখ্যাত না হলে কিছু যায়-আসে না বরং বিখ্যাত না হলেই আমি খুশি হবো। কারণ বিখ্যাত হওয়ার পর আমাদের পরিবারে একটা অঘটন ঘটে গেছে। আমি চাই ও তার বড় চাচার মতো, ইকবাল ভাইয়ের (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) মতো হোক। আমাদের ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নূহাশ এবং শিলা। নোভা, শিলা, বিপাশা যখন ছোট ছিল তখন তারা একটা সুখী পরিবার দেখেছে। ওই রকম পারিবারিক আনন্দস্মৃতি নূহাশের নেই। ওরা তিন বোন দেখেছে ওদের বাবা কি করেছে, যার জন্য ওরা বাবার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না। কিন্তু নূহাশ নিজ চোখে দেখেনি। ওর সবই আমাদের কাছ থেকে শোনা। তাই ওর ওপর প্রভাবটা পড়ে না। এ কারণে বাবার সঙ্গে ওর যোগাযোগটা আছে।
বাবার চোখেঃ নূহাশ একদিন এসে একটা মেয়ের ছবি আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা এই মেয়েটিকে আমার খুবই পছন্দ হয়, এই যে তার ছবি। আমার জায়গায় আমার বাবা হলে তো একটা ধাক্কার মতো খেতেন। আমি ধাক্কা খেলাম না বরং আগ্রহ নিয়ে ছবিটি দেখলাম। দেখে বললাম, ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে দেখতে তো খারাপ না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। নূহাশের খুব বই পড়ার নেশা। আমি বিদেশ থেকে প্রচুর বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস এবং ইংরেজি সাহিত্যের ইংরেজিতে লেখা বই কিনি। বইগুলো এনেই প্রথমে ভাগাভাগি করি। অর্ধেক আমার কাছে থাকে আর অর্ধেক নূহাশের কাছে। আমি যেহেতু খুব ব্যস্ত থাকি তাই নূহাশেরগুলো আগেই পড়া শেষ হয়ে যায়। এরপর সে আমারগুলোও নিয়ে যায়। নূহাশের অনুবাদ করা ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’ বইটি আমি পড়েছি। ও বেশ ভালই অনুবাদ করেছে। বইটির কিছু অংশ অনুবাদ করার পর প্রকাশক তার ইংরেজি অনুবাদ কেমন হচ্ছে জানতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক শফি আহমেদের কাছে মান যাচাইয়ের জন্য পাঠায়। তিনি তার ইংরেজি ভাষায় দখল দেখে বিস্মিত হন। আমি আশা করি নূহাশ ভবিষ্যতে অনুবাদ অব্যাহত রাখবে।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন
ইমদাদুল হক মিলন একবার হুমায়ূন আহমেদ এর সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন।
ইমদাদুল হক মিলন: আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন ‘৮৪-এর দিকে বোধহয় ? তার আগে, মাত্র চারটা বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন৷ এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা৷ আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হবার কথা ভাবলেন কী করে?
হুমায়ূন আহমেদ: হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সবসময়৷ যদি ভেতরে থাকে তাহলে ‘লেখালেখি’ বিষয়টা মাথার গভীরে একধরনের চাপ দিতেই থাকে৷ এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে৷ দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি৷ আবার আমি যে একজন লেখকও, ঐটাও তো মাথায় ছিল৷
মিলন: লেখালেখির ক্ষেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়৷ আপনার সে অস্বস্তিটা কি তৈরি হয়েছিল যে, এতদিন পরে আমি আবার শুরু করলাম!
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে মনে করতে পারছি না৷ মনে হয় না ছিল৷ কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা লেখালেখি করে, তারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না৷ অনেকদিন লিখিনি তাতে কি হয়েছে? আবার লিখব৷ ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব৷
মিলন: কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল নাকি আস্তে আস্তে?
হুমায়ূন আহমেদ: না, আমার মনে হয় এটা শুরু থেকেই ছিল৷ মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো৷ কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে খুবই চিন্তা-ভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে৷ একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে৷ দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না৷ এই অবস্থা৷
মিলন: এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পরে একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন৷ তারপর ‘৮৫-তে আপনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শুরু করেছিলেন৷ একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, এর পেছনে রহস্যটা কি বলে আপনার মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ: এই অবস্থা যে তৈরি হয়েছিল, এই বিষয়টার একটা নরমাল আর একটা আধিভৌতিক ব্যাখ্যা আছে৷
মিলন: আপনি বলেন- আমরা দুটোই শুনি৷
হুমায়ূন আহমেদ: নরমাল ব্যাখ্যা হলো- আমি নাটক লেখা শুরু করলাম৷ আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি৷ ‘এইসব দিনরাত্রি’ বহু লোক দেখা শুরু করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরু করল৷ পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হবার পেছনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা৷ একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে- এটা তো হবার কথা না৷ আমার ধারণা আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে- এটা হতে পারে৷ আর আধিভৌতিক ব্যাখ্যা যেটা হলো- শহীদুল্লাহ হলে যখন থাকি, তখন একসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকে আমি হঠাত্ কিছু বড় অংকের টাকা পেয়ে গেলাম৷ ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ সেই সময় ২৫-৩০ হাজার টাকা অনেক টাকা৷ বই বিক্রির টাকা৷ তখনো বই লেখা বাবদ অ্যাডভান্স দেয়া শুরু হয়নি৷ যেহেতু টাকা পেয়েছি, আমার খুব হাত উশখুশ করছিল টাকাটা খরচ করার জন্য৷ কাজেই করলাম কী গুলতেকিন এবং বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়াতে৷ এই টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশ ভ্রমণ হবে এই হলো পরিকল্পনা৷ প্রথমে গেলাম নেপালে, নেপাল থেকে দিল্লী৷ ভাবলাম এত কাছে যখন এলাম মরুভূমি দেখে যাই৷ জয়সলমীরের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম৷ জয়সলমীরের পথে পড়লো আজমীর শরীফ৷ এত নাম শুনেছি- পথে যখন পড়লই তখন ভাবলাম যে, আজমীর শরীফ দেখে যাই৷ আজমীর শরীফ গেলাম৷ আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি, বিপাশা, সে খুবই বিরক্ত হয়ে গেল; বলল- কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির৷ ফকিরে ভর্তি জায়গাটি৷ বিপাশার বয়স তখন তিন সাড়ে তিন; আমি তাকে বোঝালাম যে, এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে৷ এখানে এলে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়৷ দেখা গেল যে, এই কথা শুনে মানসিকভাবে সে স্বস্তি বোধ করলো৷ তখন তাকে নিয়ে গেলাম কবর জিয়ারত করতে, জিয়ারত শেষ করে চলে আসবো, দেখি বিপাশা দাঁড়িয়ে৷ ব্যাপার কী? বিপাশা বলল, আমি যেটা চেয়েছি সেটা তো পাইনি৷ না পেলে যাব না৷ আমি বললাম, মা, তুমি কী চেয়েছ? বিপাশা বলল, আল্লাহর কাছে আমি এক হাজার বস্তা টাকা চেয়েছি৷ এই টাকা না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে আমি যাব না৷ করবস্থানের পাশে রেলিংটা ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ আমি ও তার মা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম৷ না, সে এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না৷ এদিকে বাংলাভাষাভাষী কিছু লোক ছিল, তারা খুবই মজা পেয়ে গেল৷ একটি মেয়ে এক হাজার বস্তা টাকা আল্লাহর কাছে চাইছে, না পাওয়া পর্যন্ত সে যাবে না- এটা তো মজার বিষয়ই৷ তখন বিপাশাকে বোঝালাম যে, এখন টাকাটা পেলে বরং সমস্যা হবে৷ এতগুলো টাকা দেশে নিয়ে যেতে হবে৷ কান্নাকাটি না করে চলো দেশে যাই৷ দেশে গেলে টাকাটা পেয়ে যাবে৷ অবশ্যই পাবে৷ আমরা দেশে ফিরে এলাম৷ আসার পর পরই জলের মতো হুহু করে টাকা আসতে লাগল৷ কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে লেখালেখি করে বিপুল অর্থ উপার্জন আপনি কীভাবে করলেন? আমি বলি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশার কারণে করেছি- এখানে আমার কোনো হাত নেই৷
মিলন: … কবিতার ছন্দ, শব্দের ব্যবহার এসব নিয়েও আপনি অনেক ভেবেছেন৷ এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: না, আমি কোনো ব্যাখ্যায় যেতে চাচ্ছি না৷ আমি নিজেকে একজন গল্পকার মনে করি এবং গল্পকার পরিচয়েই আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি৷ কবিতাকে বলা হয় সাহিত্যের ফাইনেস্ট ফর্ম৷ এই ফাইনেস্ট ফর্মে কাজ করার ক্ষমতা আমার নেই৷ গদ্যটা হয়তো খানিকটা লিখতে পারি৷ কবিতা নিয়ে মাঝে মাঝে একটু চেষ্টা চলতে পারে, তাই বলে নিজেকে কখনোই আমি কবি বলি না৷ সেই প্রতিভাও আমার নেই৷
মিলন: স্বাধীনতাউত্তর সময়ে এদেশের সাহিত্যের দুটি শাখা খুবই ডেভেলপড্- কবিতা ও মঞ্চনাটক৷ এদেশের কবিদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
হুমায়ূন আহমেদ: বাংলাদেশের সাহিত্যে যারা কবিতা লিখছেন- আগে যারা লিখেছেন, এখন যারা লিখছেন- তাদের কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই৷ বাংলাদেশ কবির দেশ৷
মিলন: একটি ভিন্ন বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই৷ বিষয়টি হলো ‘মৃত্যু-চিন্তা’৷ আমি জানি যে, আপনি মৃত্যু নিয়ে ভাবেন৷ জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃত্যু-পরবর্তী জগত্ নিয়েও আপনি ভাবেন৷ আপনার মৃত্যু-চিন্তাটা কী রকম?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে৷ বর্ষা আসবে, জোছনা হবে৷ কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না৷ আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতই ঐদিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই আর পারছি না৷
মিলন: বড় লেখকদের ক্ষেত্রে কালজয়ী শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে৷ যারা সময়কে জয় করে নেন নিজের লেখার মধ্য দিয়ে৷ আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন, এই ফিলিংসটা আপনার কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়টা একেবারেই আমার মাথায় আসে না৷ আমিই নেই আর আমার লেখা লোকজন পাঠ করছে, এতে আমার কী যায় আসে?
মিলন: কিন্তু এরকম কি কখনো মনে হয় না, আমার যে লেখাগুলো আমি রেখে যাচ্ছি, তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, লোকজন আমাকে স্মরণ করবে?
হুমায়ূন আহমেদ: না, সেরকম মনে হয় না৷ মিলন, আমি তোমাকে সিরিয়াসলি বলছি, আই অ্যাম টেলিং ইউ ফ্রম মাই হার্ট – এই চিন্তাটা কখনো আমার হয় না যে, ৫০ বছর পর লোকে আমার লেখা পড়বে, আমি কত ভাগ্যবান! আমি সারাজীবন লেখালেখি করেছি নিজের আনন্দের জন্যে।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা – বাংলানিউজ, অক্টোবর ২০১০
২০১০ এর ২৭ অক্টোবর বাংলানিউজে সাক্ষাৎকারভিত্তিক এই লেখাটি প্রকাশিত হয়।
সে এক বিশাল আয়োজন, ব্যয়বহুল প্রস্তুতি। স্বঘোষিত শেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র সেটকে আকর্ষণীয় ও সময়োপযোগী করে তোলার জন্য দীর্ঘ চার মাস ব্যয় করেছেন জনপ্রিয় কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ। নূহাশপল্লীর স্টুডিওতে সেই সেট এখন শুটিংয়ের জন্য প্রস্তুত। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়াতে চলছে ছবিটির আউটডোরের শুটিং। ২ নভেম্বর থেকে নূহাশপল্লীতে শুরু হবে ইনডোর শুটিং।
প্রায় দেড়শ বছর আগে হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘেটুগান নামে নতুন সঙ্গীতধারা সৃষ্টি হয়েছিল। মেয়ের পোশাক পরে কিছু সুদর্শন কিশোর নাচগান করত। এদের নামই ঘেটু। গান হতো প্রচলিত সুরে, কিন্তু সেখানে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রভাব ছিল স্পষ্ট। অতি জনপ্রিয় এই সঙ্গীতধারায় নারী বেশধারী কিশোরদের উপস্থিতির কারণেই এর মধ্যে অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে। বিত্তবানরা এইসব কিশোরকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাবার জন্যে লালায়িত হতে শুরু করেন। একসময় সামাজিকভাবে বিষয়টা স্বীকৃতি পেয়ে যায়। হাওর অঞ্চলের বিত্তবান শৌখিন মানুষরা জলবন্দি সময়টায় কিছুদিনের জন্যে হলেও ঘেটুপুত্র নিজের কাছে রাখবেন এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে বিবেচিত হতে থাকে। আর তাদের স্ত্রীরা ঘেটুপুত্রদের দেখতেন সতীন হিসেবে। এমন এক ঘেটুপুত্রের গল্প নিয়েই হুমায়ুন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।
গল্পের প্রধান পটভূমি ভাটি-অঞ্চলের এক বিত্তবান জমিদার বাড়ি। ১৫০ বছর আগে ওই অঞ্চলের জমিদারবাড়ির আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। সেই বৈশিষ্ট্যগুলো ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র ইনডোর সেটে তুলে ধরতে চেষ্টার কোনও কমতি রাখেননি হুমায়ূন আহমেদ। ২৬ অক্টোবর মঙ্গলবার দুপুরে নূহাশপল্লীতে গিয়ে দেখা গেল এই চিত্র। দ্বিতল প্রাসাদের অবকাঠামো, সিংহমূর্তিবিশিষ্ট প্রবেশ দরোজা, নকশাখচিত দেয়াল ও কার্নিশ, অন্দরমহল, বৈঠকখানা, রঙমহল ইত্যাদি সবকিছুতে রয়েছে পরিকল্পনার ছোঁয়া। আসবাবপত্র এবং উপকরণ-সামগ্রী সংগ্রহেও নির্মাতা দিয়েছেন যথেষ্ট গুরুত্ব। প্রাচীন আমলের তিনটি খাট তৈরিতেই ব্যয় করা হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। কারুকাজ করা এ ধরনের খাট আজকাল শুধু জাদুঘরেই দেখা যায়। রেলিং দেওয়া একটি কাঠের সিন্দুক বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা। পুরনো দিনের আরাম কেদারা, আলমিরা, জলচৌকি, ক্যাশবাক্স, বজরা ইত্যাদি সংগ্রহ ও তৈরির পেছনেও খরচের কথা নির্মাতা মাথায় রাখেন নি। উপকরণাদির মধ্যে আগের আমলের দুরবিন, হাতপাখা, বাঘের চামড়া, হরিণের মাথা, পিতলের হুকো, বল্লম, চাবুক, ঝাড়বাতি, গালিচা, বালিশ, বিছানাপত্র, বাসনকোসন, পানপাত্র, গয়নাগাটি, শো-পিস সবমিলিয়ে নূহাশপল্লীর স্টুডিওটাকে যেন মিনি জাদুঘরে রূপান্তর করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রডাকশন সূত্রে জানা যায়, পনের লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়ে গেছে ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য সেট নির্মাণ ও উপকরণাদি সংগ্রহের পেছনে।
ছবির সেট ডিজাইন ও সামগ্রী সংগ্রহের কথা জানতে চাইলে বাংলানিউজকে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ভাটি অঞ্চলের বিত্তবান জমিদারদের গল্প আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। তাদের বিলাসিতার নমুনা পাওয়া যায় হাওড় এলাকার প্রাচীন কিছু জমিদারবাড়িতে। আমি তাদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন সম্পর্কে যতোটা পারি তথ্য সংগ্রহ করেছি। নূহাশ চলচ্চিত্রের একটি টিম এজন্য সুনামগঞ্জ আর হবিগঞ্জে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মতভাবে দেড়শ বছর আগের বিলাসিতা ও শৌখিনতার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা আমাদের আছে। সেট নির্মাণ ও উপকরণাদি সংগ্রহ করতে চার মাসেরও বেশি সময় লেগে গেছে। খরচের কথা নাইবা বললাম। তারপরও আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। মনে হয়েছে ফাঁক-ফোকর রয়েই গেছে। আমার কাছে যদি একটা টাইমমেশিন থাকতো তাহলে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে আমি ওই সময়ের কোনো জমিদার বাড়িতে চলে যেতাম। বলতাম, ভাই আমি আপনাদের নিয়ে একটা ছবি বানাতে চাই। দয়া করে আমাকে অনুমতি দিন। কিন্তু আমার কাছে তো কোনো টাইমমেশিন নেই। তাই দেড়শ বছর আগের সময়টা ধরার জন্য আমাদের যতো চেষ্টা।
ঘেটুপুত্র কমলা’র সেট নির্মাণ ও সামগ্রী সংগ্রহে নির্মাতার পাশে ছিলেন শিল্প-নির্দেশক মাসুম রহমান। হুমায়ূন আহমেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট সময় ও শ্রম তিনি ব্যয় করেছেন বলে জানা গেছে।
ঘেটুপুত্র কমলা’-এর মহরতের দিন হঠাৎ করেই হুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা দেন, এটিই তার শেষ ছবি। মহরতে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাৎক্ষণিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
হিমুকে নিয়ে হ্যালো-টুডেতে
হুমায়ুন আহমেদ উপন্যাস ও নাটকের জন্যে কয়েকটি চরিত্র তৈরি করে তিনি ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন। চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হিমু । নন্দিত এই কথা শিল্পী হিমু চরিত্র নিয়ে কি ভাবেন? হিমু কে নিয়ে হ্যালো-টুডেতে দেয়া হুমায়ুন আহমেদের সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল ।
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়,’আপনার উপন্যাসের জনপ্রিয় চরিত্র হিমু।এটা কি নিছক কাল্পনিক?না আপনি এর মধ্য দিয়ে আপনার পরিচিত কাউকে তুলে ধরেছেন?’
হুমায়ুন আহমেদের উত্তর,’না হিমুতে আমি আসলে পরিচিত কাউকে তুলে ধরি নাই,যে হিমু আমি লিখি আসলে সে হিমু হওয়া একটা জটিল ব্যাপার।মানুষের অনেক ইচ্ছা পূরনের ব্যাপার আছে,মানুষ করতে চায় কিন্তু করতে পারে না।এই যে ইচ্ছাগুলি আছে,আমি হিমুর মাধ্যমে এই ইচ্ছাপূরন গুলি ঘটাই।
পাঠকদের কাছে হিমুর এত জনপ্রিয়তার কারন কি বলে আপনার ধারনা?
-যে কারনে আমার ধারনা পাঠকরা এত পছন্দ করে,এরা হতে চায়,করতে চায়।এরা চায় যে আমার আধ্যাত্বিক ক্ষমতা থাকবে,আমি মানুষের ভূত ভবিষ্যত বলে দিতে পারবো।সবার মনের একটা গোপন বাসনা পথে ঘাটে আমি হেটে বেঁড়াবো,কেউ আমাকে কিছু বলবে না।আমাকে কোনো চাকরি করতে হবে না।কোনো কিছুই করতে হবে না,আমার জীবন চলবে জীবনের মত।এই যে গোপন ইচ্ছাগুলি থাকে এইগুলি আমি পূরন করি হিমু উপন্যাসে।’
আচ্ছা মি.আহমেদ,হিমু তো আপনার পাঠকদের কাছে অনুকরনীয় চরিত্র হয়ে দাড়িয়েছে।এই হিমুকে নিয়ে বিশেষ কোন ঘটনা আছে কি যা আপনাকে নাড়া দিয়েছে?
-হ্যা,একটা বলা যেতে পারে।আমি একবার একটা ম্যাগাজিন পেলাম রাশিয়া থেকে,ঐ ম্যাগাজিনে দেখি ওদের রাশিয়াতে একটা হিমু ক্লাব আছে।হিমু ক্লাবের ছেলেমেয়েরা কিন্তু সব রাশিয়ান,বাংলাদেশি না।এরা একটি অনুষ্ঠান করেছিল যাতে সব অ্যাম্বাসেডরদের ডেকেছে,সেখানে সব অ্যাম্বাসেডরদের হলুদ কাপড় পড়ে আসতে হবে। এর পর যারা যারা হলুদ কাপড় পড়ে আসেনি তাদের সবাইকে একটা করে হলুদ টাই দেয়া হয়েছে।এটা পড়ে আমি ধাক্কার মত খেয়েছিলাম।
হিমুকে নিয়ে আর কোনো স্মরনীয় ঘটনা কি আছে?
– আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে।জার্মানীতে আমি একবার গিয়েছিলাম ফ্রাংক ফুড বইমেলায়।অনেক ঠান্ডা তখন সেখানে।বরফ পড়ছে এমন অবস্থা।সেখানে হলুদ একটা কোট পড়ে এসে একজন আমাকে বললো,’স্যার আমি হিমু।’আমি বললাম,’হিমু?হিমুর তো পা খালি থাকে।’ছেলেটা বললো যে,’স্যার দেখেন’।আমি তখন একটা ধাক্কার মত খেলাম যে এই ঠান্ডায়ও তার পা খালি।’
স্যার কখনো অবসর নেবেন?
-হ্যা অবসর নেব। মৃত্যুর এক ঘন্টা বা দুই ঘন্টা আগে নেব,আমি চাই মৃত্যুর এক ঘন্টা আগেও যেন আমি এক লাইন হলেও বাংলা গদ্য লিখে যেতে পারি।’
হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগ পর্যন্ত তার লিখে যাওয়ার ইচ্ছা। তিনি জানিয়েছিলেন, তার লেখার শেষ লাইনটি কী হবে সেটাও তিনি ঠিক করে রেখেছেন।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন
হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে ইমদাদুল হক মিলনের একটি লেখা আছে, নাম – হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ। লেখাটিতে হুমায়ুন আহমেদ এর সাক্ষাৎকার এর সাথে সাথে বেশ কিছু মজাদার হাসি তামাশাও চলে এসেছে যাতে হুমায়ুন আহমেদের চির হাস্যমুখর প্রানবন্ত অনুভুতিও ফুটে উঠেছে। লেখাটি অনেক বড়….
এই লেখাটুকু হুমায়ূন আহমেদের
কিছুদিন হলো আমার জীবনচর্যায় নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। সন্ধ্যা মিলাবার আগেই সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে তিন-চারজন আমার বাসায় উপস্থিত হচ্ছে। আমার মায়ের শোবার ঘরটিতে ঢুকে যাচ্ছে। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এসি ছেড়ে দিচ্ছে। গলা উঁচিয়ে চা-নাশতার কথা বলছে। এই ফাঁকে একজন ক্যাসেট রেকর্ডার রেডি করছে। অন্য একজন ক্যামেরায় ফিল্ম ভরছে। তৃতীয়জন কাগজ-কলম নিয়ে প্রস্তুত। চতুর্থজন ব্যস্ত হয়ে মোবাইলে টেলিফোন করছে ইমদাদুল হক মিলনকে। ঔপন্যাসিক চলে এলেই কর্মকাণ্ড শুরু হবে। ঔপন্যাসিক আমার ইন্টারভিউ নেবেন।
ইমদাদুল হক মিলনের সমস্যা কী আমি জানি না। ইদানীং সে সবার ইন্টারভিউ নিয়ে বেড়াচ্ছে। টিভি খুললেই দেখা যায় সে কারোর না কারো ইন্টারভিউ নিচ্ছে। পত্রিকার পাতাতেও দেখছি অনেকেই তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁরাও রক্ষা পাননি। তিন দিন ধরে ক্রমাগত তাঁদের ইন্টারভিউ হলো। আমার দখিন হাওয়ার বাসাতেই হলো।
মিলন জানেও না ইন্টারভিউ নিতে নিতে তার গলার স্বরেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। চোখের দৃষ্টিও অন্য রকম। এখন তার চোখে শুধু প্রশ্ন খেলা করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন এই ফাঁদে পা দিলাম? সন্ধ্যাটা আগে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভালোই কাটত। এখন ক্যাসেট প্লেয়ার মুখের সামনে ধরে মিলন বসে থাকে। সামান্য ঝুঁকে এসে প্রশ্ন করে_
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘লীলাবতী’ দিয়েই শুরু করছি। এটা পড়ে মনে হয়েছে, প্রধান চরিত্র হচ্ছে সিদ্দিকুর রহমান। এই উপন্যাসটির নাম ‘সিদ্দিকুর রহমান’ বা ‘সিদ্দিকুর রহমানের জীবন’ এ রকম হতে পারত। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ নামে আপনার একটা বই আছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নামেই যদি নামকরণ করেন, তাহলে উপন্যাসটির নাম ‘লীলাবতী’ কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো মনে করি যে, ‘লীলাবতী’ উপন্যাসে যে কটি চরিত্র এসেছে, প্রতিটিই প্রধান চরিত্র।
[ভুল উত্তর। উপন্যাসের সব চরিত্রই প্রধান হতে পারে না। ঔপন্যাসিক মিলন অবশ্যই এটা জানে। কিন্তু সে এমন ভাব করল যেন সে আমার উত্তর গ্রহণ করেছে। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল_]
ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে ‘লীলাবতী’ নামটি কেন রাখলেন?
[প্রবল ইচ্ছা হলো বলি_আমার ইচ্ছা। তোমার কী?
এই জাতীয় উত্তর দেওয়া যায় না। অনেক পাঠক পড়বে। জ্ঞানগর্ভ কিছু বলা দরকার। জ্ঞানগর্ভ কিছু মাথায় আসছে না। কী করি? উপন্যাসের নাম নিয়ে মিলনের মাথাব্যথার কারণটাও ধরতে পারছি না। আমি বললাম_]
হুমায়ূন আহমেদ : উপন্যাসের নাম হিসেবে ‘লীলাবতী’ নামে যে মাধুর্য আছে ‘সিদ্দিকুর রহমান’ নামে কি সে মাধুর্য আছে?
ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই এটা একটা সুন্দর নাম।
[মিলন মুখে বলল, এটা একটা সুন্দর নাম; কিন্তু তার চেহারা দেখে মনে হলো সে আমার কথাবার্তায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। তার চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তখন আমার মনে হলো_আচ্ছা, মিলন কি ভাবছে আমি ‘লীলাবতী’ নামটি বাণিজ্যিক কারণে রেখেছি? তাই যদি হয় তাহলে তো নামকরণের ব্যাপারটি ভালোমতো ব্যাখ্যা করা দরকার। বইয়ের ফ্ল্যাপে এই ব্যাখ্যা আছে। আমি পরিষ্কার বলেছি_ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের কন্যার নাম ‘লীলাবতী’। এই নামটির প্রতি আমার অস্বাভাবিক দুর্বলতা আছে। তবে আমি এত ব্যাখ্যায় গেলাম না, সরাসরি মূল বিষয়ে চলে গেলাম_]
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি যদি মনে করো আমি ‘লীলাবতী’ নামটি দিয়েছি বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনায়, তাহলে ভুল করবে। আমার ভালো লেগেছে, তাই এই নাম দিয়েছি। বইয়ের নামের কারণে কিছু বই বেশি বিক্রি হবে_এটা নিয়ে আমার প্রকাশক মাথা ঘামাতে পারে। আমি ঘামাই না।
[আমার কঠিন কথায় মিলন একটু থমকে গেল এবং অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল_]
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার উপন্যাসের ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। আপনি ‘মন্দ্রসপ্তক’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই শব্দটির অর্থও অনেকে জানেন না। আপনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি নাটক লিখেছিলেন_’অয়োময়’। এই শব্দের সঙ্গে বেশির ভাগ বাঙালি পরিচিত নন। আপনার লেখার ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। ওইভাবে আমি ভাবিনি।
হুমায়ূন আহমেদ : তার পরও কিন্তু ফ্যাক্টর থাকে, মিলন। আমি দেখেছি। অন্যপ্রকাশ আমার দুটি বই ‘বাসর’ ও ‘সৌরভ’ প্রকাশ করেছে। তুমি দেখবে, ‘বাসর’-এর বিক্রি হয়েছে অনেক বেশি। ‘বাসর’ নামটি হয়তো মানুষকে আকর্ষণ করেছে অনেক বেশি, দেখি তো কী আছে বইটিতে। ‘সৌরভ’ কিন্তু ততটা আকর্ষণ করেনি। ‘সৌরভ’ উপন্যাসটির নাম যদি ‘বাসর’ দিতাম এবং ‘বাসর’ উপন্যাসটির নাম ‘সৌরভ’ দিতাম তাহলেও একই ঘটনা ঘটত।
ইমদাদুল হক মিলন : (বিজয়ীর ভঙ্গিতে) তাহলে তো আপনি স্বীকারই করলেন যে, নামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে।
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ স্বীকার করলাম। তবে বইয়ের নাম দেওয়ার সময় বাণিজ্যিক ব্যাপারটা আমার মাথায় কখনো থাকে না। যদি থাকত তাহলে ‘সৌরভ’ উপন্যাসটির নাম দিতাম ‘গোপন বাসর’। হা হা হা।
[বুদ্ধিমান পাঠক সম্প্রদায়, আপনারা কি লক্ষ করছেন_মিলন আমাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিল যে নামের একটা বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে। এখন আমার কি উচিত না আরো সাবধানে তার প্রশ্নের জবাব দেওয়া? কে জানে সে হয়তো এমন অনেক কিছু আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেবে, যা আমার মনের কথা না। কাজেই Attention, সাবধান। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে সাবধান। মিলন গভীর জলের পাঙ্গাশ মাছ। আমার মতো অল্প পানির ‘তেলাপিয়া’ না।]
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি প্রচুর ভূতের গল্প লিখেছেন। অবিস্মরণীয় কিছু ভূতের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। বৃহন্নলা, দেবী, নিশিথিনী, অন্যভুবন_এই যে লেখাগুলো, এগুলোর মধ্যে আপনি আধিভৌতিক এবং রহস্যময়তার ব্যাপারগুলো সব সময়ই এনেছেন। পাশাপাশি আপনি আবার বললেন যে, বিজ্ঞানের ছাত্রদের এই বিষয়ে বিশ্বাস থাকা ঠিক না। আপনি যখন এই লেখাগুলো লেখেন, তখন কি বিজ্ঞানের ব্যাপারটি মাথায় রেখে লিখেছিলেন?
[মিলন কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছি। সে আবারও আমাকে দিয়ে স্বীকার করাবে যে আমি নিজেকে ‘কনট্রাডিক্ট’ করছি। একই সঙ্গে বিজ্ঞানের কথা বলছি আবার ভূত-প্রেতের কথা বলছি। অতি সাবধানে এখন উত্তর দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রশ্নগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া।]
হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞান তো থাকবেই। কিন্তু সব ব্যাখ্যা কি বিজ্ঞান দিতে পারছে? মহাবিশ্বের শুরু হলো বিগ ব্যাং (Big Bang) থেকে। তার আগে কী ছিল?
[মিলন ভুলবার মানুষ না। সে এই বিষয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল। আমাকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলতে চাচ্ছে…]
ইমদাদুল হক মিলন : বিভিন্ন সময়ে অনেক আড্ডায় আপনি প্রচুর ভৌতিক গল্প বলেন। আপনাকে আমরা যত দূর জানি, আপনি একজন যুক্তিবাদী মানুষ, অযৌক্তিক কোনো কিছুকে আপনার প্রশ্রয় দেওয়ার কথা না। তাহলে…?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার চরিত্রের একটি অংশ হিমু, আরেক অংশ মিসির আলী। হিমু তো যুক্তিহীন জগতের মানুষ।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার কথা শুনে মনে হয়, আপনার মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষ বসবাস করে।
হুমায়ূন আহমেদ : শুধু আমার মধ্যে কেন, সবার মধ্যেই বাস করে। মিলন! তোমার মধ্যে কি বাস করে না? ‘A man has many faces’. শুধু জন্তুর একটাই ‘Face’ থাকে। মানুষ জন্তু না।
[মোটামুটি ‘জ্ঞানগর্ভ’ উত্তর দেওয়া হলো। আমি খুশি। মিলনকে তেমন খুশি মনে হচ্ছে না।]
ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে আপনাকে একটি প্রশ্ন করি, মানুষ হিসেবে আপনি নিজেকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন এবং নিজেকে কোন স্তরের মনে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ : মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি খুবই উঁচু স্তরের। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি খুবই নিম্নস্তরের একজন মানুষ।
ইমদাদুল হক মিলন : কী কী কারণে এমন মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : কখনো কখনো আমি এমন সব কাজ করি যে মনটা খুবই খারাপ হয়, তখন মনে হয় এই কাজটা কিভাবে করলাম? কেন করলাম?
ইমদাদুল হক মিলন : এটা কি রিসেন্ট কোনো ঘটনায় আপনার মনে হয়েছে! আপনার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনায় বা…
[ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় যদি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবস্থা থাকত তাহলে এ পর্যায়ে ব্যং করে একটা শব্দ হতো এবং টেনশন মিউজিক শুরু হতো।]
ইমদাদুল হক মিলন : প্রশ্নের জবাব দিতে না চাইলে দিতে হবে না।
হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছি, তখন তোমার সব প্রশ্নেরই উত্তর দেব। মানুষ হিসেবে আমি কখনো নিজেকে অতি উচ্চস্তরের ভাবি আবার কখনো নিম্নস্তরের ভাবি অনেক আগে থেকেই। দ্বিতীয় বিয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বহু দিন ধরে টিভিতে, পত্র-পত্রিকায়, এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও যান না, এর কারণ কী? আপনি কি এগুলো অ্যাভয়েড করতে চান? আপনি বলছেন সব কিছু পরিষ্কার বলতে চান, কিন্তু আপনি তো বলেন না।
হুমায়ূন আহমেদ : শোনো, এ ধরনের প্রোগ্রামে যাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক দিন হলো। একটা সময় ছিল, লেখালেখি জীবনের শুরুর কথা বলছি, যখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতাম। পত্রিকার অফিসে বসে থাকতাম। বাংলাবাজারের প্রকাশকদের শোরুমে সময় কাটাতাম। ওই সময়টা পার হয়ে এসেছি। আমার বয়সও হয়েছে। এসব ভালো লাগে না। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে বেশির ভাগ সময়। তা ছাড়া হয়েছে কী, মানুষ তো গাছের মতো। গাছ কী করে? শিকড় বসায়। প্রতিটি মানুষেরই শিকড় আছে। আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত যে শিকড় আছে, সেগুলো ছিঁড়ে গেছে। আমি ফর ফাইভ ইয়ারস বাইরে বাইরে ঘুরেছি। কখনো মায়ের কাছে থেকেছি, কখনো হোটেলে থেকেছি, কখনো উত্তরায় একটি বাসা ভাড়া করে থেকেছি, কখনো বন্ধুর বাসায় থেকেছি, দখিন হাওয়ায় থেকেছি। যখন দখিন হাওয়ায় থাকতে শুরু করলাম তখনো সমস্যা। সপ্তাহের তিন দিন থাকি দখিন হাওয়ায়, চার দিন থাকি গাজীপুরে। প্রায়ই রাতে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, আমি এখন কোথায়? ঢাকায় না গাজীপুরে? একজন মানুষের শিকড় যখন ছিঁড়ে যায়, তখন তাকে অস্থিরতা পেয়ে বসে। এই অস্থিরতার জন্যই বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, নিজের মতো থাকি। ঘরে বসে থাকি, ছবি দেখি, গান শুনি। আমি এই বয়সে এসে এ রকম একটা সময় পার করছি। গর্তজীবী হওয়ার পেছনে এটাও হয়তো কারণ।
এখন নতুন শিকড় গজাচ্ছে। অস্থিরতা কমে আসছে। গর্ত থেকে বেরোতে শুরু করেছি। তোমাকে দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিতে যে রাজি হলাম এটা কি তা প্রমাণ করে না?
ইমদাদুল হক মিলন : আপনাকে অনেকে রুক্ষ মানুষ মনে করে, ভয় পায়। কিন্তু আপনার লেখা যারা পড়েছে তারা জানে যে, আপনি অসম্ভব মমতাবান একজন মানুষ। মানুষকে আপনি পছন্দ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ : লেখা পড়ে তো একজন মানুষকে বিচার করা যায় না।
ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই করা যায়। কেন যাবে না? একজনের লেখা পড়ে আমরা কি বুঝতে পারব না, সে কোন ধরনের মানুষ এবং এটা আপনার তো বিশ্বাস করার কথা। একজন লেখক জীবনের নানা রকম কথা তাঁর লেখার বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে বলেন।
হুমায়ূন আহমেদ : হেমিংওয়ের লেখা পড়ে আমরা কখনোই বুঝতে পারি না যে, হেমিংওয়ে নিজেকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারেন। তিনি অসম্ভব জীবনবাদী একজন লেখক। তাঁর লেখা পড়ে যদি তাঁকে আমরা বিচার করতে যাই, তাহলে কিন্তু আমরা একটা ধাক্কা খাব। মায়কোভস্কি পড়ে কখনোই বুঝতে পারব না যে, মায়কোভস্কি আত্মহত্যা করার মানুষ। আমরা কাওয়াবাতা পড়ে কখনো বুঝতে পারব না যে, কাওয়াবাতা হারিকিরি করে নিজেকে মেরে ফেলবেন। এঁরা প্রত্যেকেই জীবনবাদী লেখক। জীবনবাদী লেখকদের পরিণতি দেখা গেল ভয়ংকর। তার মানে কী? তার মানে কী দাঁড়ায়? লেখকরা কি সত্যি সত্যি তাঁদের লেখায় নিজেকে প্রতিফলিত করেন? নাকি তাঁদের শুদ্ধ কল্পনাকে প্রতিফলিত করেন?
ইমদাদুল হক মিলন : ঘুরে ফিরে ‘লীলাবতী’র প্রসঙ্গটায় আবার আসি। আপনার এ লেখাটা এমন আচ্ছন্ন করেছে আমাকে, এর আগে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ পড়ে এমন আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। লীলাবতীতে মাসুদ নামের একটি ছেলে গোপনে এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে, পরীবানু যার নাম, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। সে চরিত্রটা আবার আত্মহত্যা করল। আপনি মানুষকে এত নির্মমভাবে মেরে ফেলেন কেন আপনার লেখায়?
হুমায়ূন আহমেদ : আমাদের জগৎটা কিন্তু খুব নির্মম। এ জগতে মানুষ যখন মরে যায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে মরে যায়। সৃষ্টিকর্তাও কিন্তু নির্মম। এই যে সুনামিতে দেড় লক্ষ দুই লক্ষ লোক মারা গেল, তিনি নির্মম বলেই তো এত লোক মারা গেল। এই নির্মমতাটা কিন্তু আমাদের মধ্যেও আছে। কথা নেই বার্তা নেই একজন গলায় দড়ি দিচ্ছে, হঠাৎ করে একজন ঘুমের বড়ি খেয়ে নিচ্ছে। যে ঘুমের বড়িটা খাচ্ছে, সে কিন্তু খুব আয়োজন করে খাচ্ছে তা না। মনে হলো খেয়ে নিল। জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে/ কাল রাতে_ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হলো তার সাধ/…বধূ শুয়ে ছিল পাশে_শিশুটিও ছিল/প্রেম ছিল, আশা ছিল/ জ্যোৎস্নায়,_তবু সে দেখিল কোন ভূত/ ঘুম ভেঙে গেল তার? অথবা হয়নি তো ঘুম বহুকাল/ লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার/ এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি/ রক্তফেনা-মাখা মুখে/ মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি/ আঁধার গুজির বুকে ঘুমায় এবার;/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ জাগিবার গাঢ় বেদনার/ অবিরাম_অবিরাম ভার/ সহিবে না আর।’ [এই পর্যায়ে আমি জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ কবিতার প্রায় সবটাই চোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করলাম। কারণ? আশপাশে সবাইকে জানান দেওয়া যে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবিতা মুখস্থ বলতে পারি। মিলনকে সামান্য ভড়কে দেওয়ার ইচ্ছাও যে ছিল না, তা না।]
ইমদাদুল হক মিলন : এই ‘লীলাবতী’ উপন্যাসটা আপনি জীবনানন্দকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গের ভাষাটা হচ্ছে এ রকম_তিনি জীবিত, আপনি কবির উদ্দেশে বলছেন_কবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাইনি। আমি আপনার মতো একজন হতে চেয়েছি। হায়, এত প্রতিভা আমাকে দেওয়া হয়নি।
হুমায়ূন আহমেদ : জীবনানন্দ দাশের কবিতা যখন পড়ি, তখন মনে হয় কবি যেন পাশেই আছেন। আমি যখন গভীর আগ্রহ নিয়ে তাঁর কবিতাটি পাঠ করছি তিনি সেটা শুনতে পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও আমার এই ব্যাপারটি ঘটে। যখন রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ি, তখন মনে হয়, তিনি বুঝি আশপাশেই আছেন। অল্প কিছুদিন আগে বিভূতিভূষণের ‘কিন্নরদল’ গল্পটি পড়ছিলাম…
ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, এটা আপনার খুব প্রিয় একটা গল্প…
হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন গল্পটি পড়ছি, তখন আমার মনে হলো, তিনি আমার পাশেই আছেন। গল্পটি পড়ে আমি আনন্দ পাচ্ছি এবং সেই আনন্দটা তিনি বুঝতে পারছেন। এটা আমার ছেলেমানুষি হতে পারে। কিন্তু এই অনুভূতিটা আমার প্রায়ই হয়। যেকোনো ভালো লেখা পড়ার সময়ই আমার মনে হয় লেখক আমার পাশে আছেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, ধরেন আপনি লিখছেন, কিন্তু এর পরে কোন লাইনটা লিখবেন আপনি জানেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : কিছু কিছু লেখক আছেন, যাঁরা প্রতিটি লাইন খুবই চিন্তাভাবনা করে লেখেন। আবার একধরনের লেখক আছেন, স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। মাথায় যেটা আসবে সেটা লিখবে। আমার লেখার ওপর খুব একটা কন্ট্রোল আছে_তা না, কন্ট্রোল আছে হালকা, আমার মনে হয় যে আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখাটা বেশি কাজ করে। কিন্তু আমি যখন ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লিখেছি তখন কোন লাইনের পর কোন লাইন লিখব আমি জানি। আমি যখন মিসির আলী লিখি তখন কিন্তু আমি জানি এই লাইনটার পরে আমি কোন লাইন লিখব। সায়েন্স ফিকশন লেখার সময় আমি জানি কোন লাইনটা লিখব। ওই বাকি লেখাগুলোর সময় আমার আর কন্ট্রোল থাকে না।
ইমদাদুল হক মিলন : ‘লীলাবতী’ লেখার সময় জানতেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না।
ইমদাদুল হক মিলন : ‘লীলাবতী’র একটা ছোট চরিত্রের কথা বলি, চঞ্চলী, সে রমিলার বোন। রমিলা মাঝে মাঝে বলে আমি পানিতে ডুবে গেলাম। আমার বোন আমার জন্য ঝাঁপ দিল, আমি উঠে গেলাম কিন্তু সে আর উঠল না। সে এখন সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। মাগো, এই জন্য আমি তোমার সঙ্গে ঢাকায় যাব না। এই যে চরিত্রটা, আপনি জেনেই লিখেছেন নাকি হঠাৎ?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ হঠাৎ…হঠাৎ করেই মাথায় এসেছে, আবার হঠাৎ করেই চলে গেছে। চলে গেছে যখন এটা নিয়ে পরে আর মাথা ঘামাইনি। যেমন দীঘির জলে একটা মাছের লেজ ভেসে উঠল। জলে ঘাই দিয়ে তলিয়ে গেল।
ইমদাদুল হক মিলন : এটি ১৩৫৭ সালের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস, এখানে আনিস চরিত্রটা কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে?
[বুঝতে পারছি মিলন এখন প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে, আনিস চরিত্রটি যৌক্তিক না। আমাকে এই মুহূর্তে কঠিন অবস্থানে যেতে হবে। দেরি করা যাবে না।]
হুমায়ূন আহমেদ : (কঠিন গলা) মিলন যথেষ্ট হয়েছে। রেকর্ডার বন্ধ কর। চা খাও। আজকের মতো এখানেই ইতি।
[মিলন রেকর্ডার বন্ধ করল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত বাড়িয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরল। অনেক দিন আগের একটি স্মৃতি আমার মনে পড়ল। তখন শ্যামলীর এক ভাড়া বাড়িতে থাকি। আমার হয়েছে ভয়াবহ জন্ডিস। মিলন প্রচুর ফলমূল নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছে। তার মাথাটা পরিষ্কার করে কামানো। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে আমার বিছানার পাশে বসল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। মুখে কিছুই বলল না। এভাবে সে বসে থাকল দীর্ঘ সময়। ভাব প্রকাশের ব্যাপারটা লেখকদের চেয়ে ভালো কেউ জানেন না। কিন্তু গভীর আবেগের সময় যে তারা কিছুই বলেন না_এই তথ্য কি সবাই জানে?
অনেক বছর আগে আমার হাত চেপে ধরে মিলন যে আবেগ প্রকাশ করেছিল, আজও সে তাই করল। হাত সে ধরে আছে ধরেই আছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। আমি এত ভাগ্যবান কেন? মানুষের এত ভালোবাসা কেন আমার জন্য? আমার ঘরভর্তি চাঁদের আলো। এই আলো আমি কোথায় রাখব?]
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যেদিন পরিচয় হলো সেদিন আমার মাথা ন্যাড়া। জীবনে দুবার ন্যাড়া হওয়ার কথা আমার মনে আছে। একবার একাত্তরের মাঝামাঝি, আরেকবার তিরাশির শুরুর দিকে। দুবারই মন ভালো ছিল না। একাত্তরে আমি এসএসসি ক্যান্ডিডেট। আমাদের বয়সী ছেলেরাও মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। এ কারণে বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করে দিলেন। দুঃখে আমি ন্যাড়া হয়ে গেলাম। ন্যাড়া মাথা নিয়ে রাস্তায় বেরোতে লজ্জা করবে, ফলে বাড়ি থেকে বেরোনো হবে না।
সত্যি তা-ই হয়েছিল। ন্যাড়া মাথার কারণে একাত্তরের সময় অনেক দিন আমি বাড়ি থেকেই বেরোইনি। তিরাশি সালে সেই স্মৃতি মনে করেই ন্যাড়া হয়েছিলাম। আমার তখন রুজি-রোজগার নেই। একাশির অক্টোবরে জার্মানি থেকে ফিরে ‘রোববার’ পত্রিকায় জয়েন করেছি। ইত্তেফাকের সামনে দিন-দুপুরে ট্রাকের তলায় এক পথচারীকে থেঁতলে যেতে দেখে রোববারে একটা রিপোর্ট লিখলাম, সেই রিপোর্টে বিশেষ একটি মন্তব্য করায় চাকরি চলে গেল। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে ‘দোয়েল’ নামে একটা অ্যাডফার্ম করলাম। এক-দেড় বছরের মাথায় সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তত দিনে বিয়ে করে ফেলেছি। কিন্তু পকেটে দশটি টাকাও নেই। এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলাম, সমরেশ বসু হয়ে যাব। লিখে জীবন ধারণ করব। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে সে যে কী কঠিন কাজ, আজকের কোনো তরুণ লেখক ভাবতেই পারবেন না। তখন একটা গল্প লিখে পঞ্চাশ-এক শ টাকা পাই। ঈদ সংখ্যার উপন্যাসের জন্য পাঁচ শ-এক হাজার। তাও পেতে সময় লাগে তিন-চার মাস। লেখার জায়গায়ও কম। এত পত্রপত্রিকা তখন ছিল না। দৈনিক পত্রিকায় উপন্যাস ছাপার নিয়ম ছিল না। কঠিন সময়। দু-চারটা বই তত দিনে বেরিয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও ভালো না। পাবলিশাররা টাকাই দিতে চায় না। একটা বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা তো অভাবী লেখক দেখে ষোলো শ টাকায় আমার দুটি বইয়ের গ্রন্থস্বত্বই কিনে নিয়েছিল। প্রথম প্রকাশিত বইয়ের জন্য আমি কোনো টাকাই পাইনি। এ অবস্থায় লিখে জীবন ধারণ! সত্যি, সাহস ছিল আমার! সেই সব দিনের কথা ভাবলে এখনো বুক কাঁপে।
যা হোক, লিখে জীবন ধারণ মানে প্রতিদিন দিস্তা দিস্তা লেখা। লেখার জন্য সময় দেওয়া এবং ঘরে থাকা। কিন্তু সারা দিন ঘরে আমার মন বসবে কেমন করে! যখন-তখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না দিলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না। তখনই একাত্তরের ন্যাড়া হওয়ার স্মৃতি মনে এসেছিল। ন্যাড়া হয়ে গেলাম। ন্যাড়া মাথা নিয়ে সারা দিন ঘরে বসে উন্মাদের মতো লিখি। লেখার কষ্ট দেখে জ্যোৎস্না একদিন আমার ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, সাধ্য থাকলে তোমার লেখাগুলো আমি লিখে দিতাম।
সেবারের বাংলা একাডেমী বইমেলায় তিন-চারটা বই বেরোল। ‘কালোঘোড়া’, ‘তাহারা’ ইত্যাদি। বইয়ের বিক্রি বাড়াবার জন্য লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ন্যাড়া মাথা নিয়েই মেলায় যাই। আমার অবস্থা যে বেশ ভালো তা বোঝাবার জন্য জার্মানি থেকে আনা জিনস-কেডস আর একেক দিন একেকটা শার্ট পরি। জ্যোৎস্নার মোটা ধরনের একটা সোনার চেইন পরে রাখি গলায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার অবস্থা তখন ‘উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট’। পকেটে সিগ্রেট খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত থাকে না।
বইমেলায় এক বিকেলে নওরোজ কিতাবিস্তানে বসে আছি, প্রতিষ্ঠানটি তখনো ভাগ হয়নি, আমার ‘তাহারা’ বইটি হাতে নিয়ে চশমা পরা, রোগা, দেখলেই মেধাবী এবং তীক্ষ্ন বুদ্ধিসম্পন্ন মনে হয়, এমন একজন মানুষ সামনে এসে দাঁড়ালেন। অটোগ্রাফ। মুখের দিকে তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলাম। নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়ালাম। মুখটি আমার চেনা। ছবি দেখেছি। হুমায়ূন আহমেদ। তখন পর্যন্ত খান ব্রাদার্স থেকে তাঁর তিনটি বই বেরিয়েছে। ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ আর বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’। তিনটি বইয়ের কোনো একটির ব্যাক কাভারে পাসপোর্ট সাইজের ছবিও আছে। আর কে না জানে, স্বাধীনতার পর পর ‘নন্দিত নরকে’ বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস। আহমদ শরীফ, শওকত আলী, আহমদ ছফা_এই সব শ্রদ্ধেয় মানুষ উপন্যাসটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সনাতন পাঠক ছদ্মনামের আড়ালে বসে তখনই বিখ্যাত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘নন্দিত নরকে’র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।
তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালের কথা। আমি জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। লেখার পোকা মাত্র মাথায় ঢুকেছে। আমার বন্ধু কামালের বন্ধু হচ্ছে খান ব্রাদার্সের মালিকের ছেলে ফেরদৌস। তার কাছ থেকে ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ জোগাড় করে আনল কামাল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই বই পড়লাম আমরা। পড়ে মুগ্ধ এবং বিস্মিত! এমন লেখাও হয়! এত সহজ-সরল ভাষায়, এমন ভঙ্গিমায়, মধ্যবিত্ত জীবনের সামান্য ঘটনাকে এমন অসামান্য করে তোলা যায়! সেই প্রথম হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটা ঘোর তৈরি হলো আমার। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ, কত নতুন নতুন লেখক লিখতে শুরু করেছেন, এমনকি আমাদের প্রবীণ লেখকরাও নতুন লেখকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিখছেন কিন্তু বেশির ভাগ লেখকেরই লেখা আমি বুঝতে পারি না। ভাষার কারুকার্যে অযথাই জটিল। গল্পে গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। কায়দা-সর্বস্ব। এ অবস্থায় দু-তিন বছরের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে আরো দু-তিনটি লেখা পড়লাম হুমায়ূন আহমেদের। ‘জনান্তিক’ কিংবা এ ধরনের কোনো একটি লিটল ম্যাগাজিনে পড়লাম ‘নিশিকাব্য’ নামে এক আশ্চর্য সুন্দর গল্প। বাংলাবাজার থেকে ‘জোনাকী’ নামে উল্টোরথ টাইপের একটি সিনেমা পত্রিকা বেরোত, সেই পত্রিকার কোনো এক বিশেষ সংখ্যায় পড়লাম ‘সূর্যের দিন’। এই ‘সূর্যের দিন’ই পড়ে ‘শ্যামল ছায়া’ নামে বই হয়। যদিও ‘সূর্যের দিন’ নামে পরে অন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। যা হোক, ‘বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যায় সে সময় উপন্যাস লিখলেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘নির্বাসন’। বুক হু হু করা এক প্রেমের উপন্যাস। তারও পর লিখলেন ‘অন্যদিন’। এই সব লেখা পড়ে আমি বুঝে গেলাম, লেখা এমনই হওয়া উচিত। সাদামাটা নিজস্ব ভাষায়, নিজের মতো করে জীবনের কথা বলে যাওয়া, যা প্রত্যেক মানুষকে আলোড়িত করবে, দ্রুত পেঁৗছাবে পাঠকের কাছে। বলতে দ্বিধা নেই, লেখায় সরলতার মন্ত্র আমি হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। কিন্তু বইমেলার সেই বিকেলের আগে তাঁকে কখনো চোখে দেখিনি। শুনেছি তিনি ছয় বছর ধরে আমেরিকায়, পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছেন। এদিকে বাজারে সম্ভবত চারটি মাত্র বই_’নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’ আর ‘নির্বাসন’। সেই চারটি বইয়ের কল্যাণেই বিরাশি সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়ে গেছেন। পরে শুনেছি, আমেরিকায় বসে তিনি যখন বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার কথা শুনলেন, শুনে তাঁর শিক্ষককে দিলেন খবরটা, আমেরিকান শিক্ষক হতভম্ব। তুমি কেমিস্ট্রির লোক, লিটারেচারে একাডেমী অ্যাওয়ার্ড পাও কী করে?
সেই শিক্ষক কি জানতেন, কালক্রমে বাংলা সাহিত্যের রসায়ন সম্পূর্ণ চলে আসবে হুমায়ূন আহমেদের হাতে! সাহিত্যের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ তিনি অবলীলায় ছেড়ে আসবেন!
মনে আছে, তিরাশির বইমেলায় খান ব্রাদার্স থেকে বেরিয়েছে তাঁর ‘অন্যদিন’ উপন্যাসটি। মাঝখানে ছয় বছর লেখালেখি করেননি, তবু ‘অন্যদিন’ খুব ভালো বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি এসেছেন আমার অটোগ্রাফ নিতে। একজন স্বপ্নের মানুষ এসে দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। কিসের অটোগ্রাফ, আমি তাঁর পা ধরে সালাম করব কি না ভাবছি। কোনো রকমে শুধু বলেছি, হুমায়ূন ভাই, আপনাকে আমি চিনি। তিনি বললেন, আমি আমেরিকায় বসে খবর পেয়েছি বাংলাদেশে ইমদাদুল হক মিলন নামে একটি ছেলে গল্প-উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় হয়েছে। তুমি কী লেখ আমার একটু বোঝা দরকার।
আমাদের পরিচয় হয়েছিল এইভাবে।
সেদিনই সন্ধ্যার পর আমাকে তিনি তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। শ্যামলীতে এখন যেখানে শামসুর রাহমানের বাড়ি তার পেছন দিকে খোলা মতো মাঠ পেরিয়ে একটা বাড়ি। সেই বাড়ির দোতলা কিংবা তিনতলায় হুমায়ূন ভাইয়ের ফ্ল্যাট। খালাম্মা, শাহিন, মানে আজকের বিখ্যাত সম্পাদক কার্টুনিস্ট এবং লেখক আহসান হাবিব, ছোটবোন, ভাবি, ফুটফুটে নোভা, শিলা, বিপাশা। বিপাশা তখন ভাবির কোলে। আর রফিকের মা নামে একজন বুয়া ছিল। পরবর্তী সময়ে এই বুয়াটির বহু মজার মজার আচরণ হুমায়ূন ভাইয়ের বিভিন্ন নাটকে হাসির উপাদান হয়ে এসেছে।
সেদিন আমার সঙ্গে আরো দুজন মানুষ গিয়েছিলেন হুমায়ূন ভাইয়ের বাসায়। দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী আর বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ। সালেহ চৌধুরীকে হুমায়ূন ভাই ডাকতেন ‘নানাজি’, আর নিয়াজ মোরশেদের দাবার তিনি ভক্ত। নিয়াজের জন্য ভালো রান্নাবান্না হয়েছিল বাসায়। গুলতেকিন ভাবি বেশ বড় সাইজের আস্ত একখানা ইলিশ মাছ ভেজে খুবই লোভনীয় ভঙ্গিতে সাজিয়ে রেখেছেন ট্রেতে। ইলিশটির ওপর ভাজা পেঁয়াজ ছড়ানো, চারপাশে চাক চাক করে কাটা টমেটো, শসা। ভাত-পোলাও দুটোই আছে, মাছ, মুরগি, সবজি, মিষ্টি_সব মিলিয়ে টেবিল ভর্তি খাবার। নানাজি এবং নিয়াজ মোরশেদকে ভাবি চিনতেন। হুমায়ূন ভাই ভাবির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভাবি তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন, একটু বুঝি অবাকও হলেন। ন্যাড়া মাথা, গলায় সোনার চেইন, পরনে জিনস-কেডস, এ কেমন লেখক!
সেই সন্ধ্যায় সেই যে হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের সঙ্গে আমি মিলে গেলাম, আজও সে রকম মিলেমিশেই আছি। আমাদের কোথাও কোনো গ্যাপ হয়নি।
হুমায়ূন ভাই তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। ইউনিভার্সিটির কাজ সেরে শ্যামলীর বাসায় ফিরে যান, বিকেলবেলা আসেন ইউনিভার্সিটি টিচার্স ক্লাবে। সালেহ চৌধুরী আসেন, হুমায়ুন আজাদ আসেন, আমিও যাই। চা, সিগ্রেট, শিঙাড়া আর গল্পগুজব চলে। সালেহ চৌধুরী গল্প শুরু করলে সহজে থামেন না। শুরুর আগেই হুমায়ুন আজাদ বলেন, কাহিনীটা কি খুব দীর্ঘ? দুজনের ছোটখাটো খুনসুটিও লাগে কোনো কোনো দিন। হুমায়ূন ভাই আর আমি চুপচাপ বসে থাকি। হুমায়ূন ভাই চেয়ারে বসেন দুপা তুলে, আসনপিঁড়ি করে। সেই ভঙ্গিতে বসে মাথা নিচু করে চুপচাপ সিগ্রেট টানেন। তখন কথা বলতেন খুব কম। শুনতেন বেশি। আর আমি শুধু তাঁকে খেয়াল করি। পরিচয়ের দিন থেকে ব্যক্তি-মানুষটাকেও তাঁর লেখার মতোই নেশা ধরানো মনে হচ্ছিল আমার। আস্তে-ধীরে হুমায়ূন-নেশায় আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম আমি।
এ সময় হুমায়ূন ভাইয়ের একবার জন্ডিস হলো। পেঁপে নিয়ে আমি তাঁকে দেখতে গেছি। জন্ডিসভরা শরীর নিয়েও এমন মজাদার আড্ডা দিলেন তিনি, আমি হতভম্ব। সেদিন প্রথম টের পেলাম, হুমায়ূন আহমেদ পুরনো হতে জানেন না, তিনি প্রতিদিন নতুন। এমন ঠাট্টাপ্রিয় মানুষ আমি আর দেখিনি। অবলীলাক্রমে নিজেকে নিয়েও ভয়ানক ঠাট্টা করতে পারেন। আর অসম্ভব মেধাবী, তীক্ষ্ন বুদ্ধিসম্পন্ন, আগাগোড়া যুক্তিবাদী, সম্পূর্ণ স্মার্ট এবং ভয়াবহ শিক্ষিত। জানেন না এমন বিষয় পৃথিবীতে কম আছে। অদ্ভুত সব বিষয়ে আসক্তি। হিপনোটিজম শেখার জন্য আমেরিকা থেকে দুবার নোবেল প্রাইজ পাওয়া প্রফেসর ফাইন ম্যানের বই আনলেন। ‘অন্যদিন’ সম্পাদক মাজহারুল ইসলামকে হিপনোটাইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ভূত, বিজ্ঞান, ধর্ম, ম্যাজিক, মানুষ আর মানুষের মনোজগৎ, সাহিত্য, গান, নাটক, সিনেমা, দাবা আর শিশু_এসব একত্রে ককটেল করলে যে জিনিসটা দাঁড়ায়, সেই জিনিসের নাম হুমায়ূন আহমেদ।
তীব্র শীতে নুহাশপল্লীতে শুটিং করতে এসেছে একটি গ্রাম্য মেয়ে। মা গেছে মেয়েটির জন্য শীতবস্ত্র জোগাড় করতে। পাতলা জামা পরা মেয়েটি ঠকঠক শীতে কাঁপছে। আগুন জ্বেলে তার চারপাশে লোকজন নিয়ে বসে আছেন হুমায়ূন ভাই। মেয়েটিকে খেয়াল করছেন। আগুনের পাশে আসতে মেয়েটি একটু লজ্জা পাচ্ছে, কারণ এখানকার কাউকে সে চেনে না। এর পরও শীত সহ্য করতে না পেরে আস্তে-ধীরে আগুনের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই তাপেও তার শীত মানে না। হুমায়ূন ভাই উঠে গিয়ে নিজের কম্বল এনে দেন মেয়েটিকে। তারপর জিজ্ঞেস করেন, তুমি চেন আমাকে? মেয়েটি তাঁর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলে, মনে হয় আপনে হুমায়ূন আহমেদ। আপনেরে আমি চিনছি।
অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম একরাতে।
কোথাও বেশ একটা জনকোলাহল। অনেক সুন্দরী নারী। সম্ভবত কোথাও কোনো সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে পেলাম আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। গান-গল্পে মুখর হয়ে আছে অনুষ্ঠান।
একসময় সুনীল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাকে এক্ষুনি ছুটতে হবে। প্লেন ধরতে হবে।’
তিনি কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গেলেন। তারপর পোশাক বদলে একটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলেন। ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার পেছন পেছন এসো।’
আমি সুনীলের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম।
একটা সময় দেখি কিছুতেই আমি আর তাঁর নাগাল পাচ্ছি না। তিনি আমাকে অনেকটা পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন। হাঁটা বাদ দিয়ে তাঁকে ধরার জন্য আমি ছুটছি। সামনে একটা জলাশয়। সুনীলকে দেখি জলাশয়ের ওপারে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন না, মাঝারি মানের মোটা শরীর নিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি জলাশয় পেরিয়ে তাঁকে ধরার চেষ্টা করছি, পারছিই না।
এটুকুই স্বপ্ন। কী অর্থ ওই স্বপ্নের কে জানে। তবে সুনীলদা আমাকে ফেলে নিউ ইয়র্কের লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে গিয়েছিলেন। সেবার হুমায়ূন ভাইও ছিলেন। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ‘মুক্তধারা’ বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদ আর আমি। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার। হুমায়ূন ভাই দল ছাড়া চলতে পারেন না। অন্যদিন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম আছেন আমাদের সঙ্গে, হুমায়ূন ভাইয়ের অতিপ্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিম আছেন। অন্যদিন গ্রুপের কমলও ছিলেন।
এই ঘটনা বলার আগে একটু পেছন ফিরি। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলি।
হুমায়ূন আহমেদ কোনো কিছু লুকাতে জানেন না, আড়াল করতে জানেন না। তিনি তাস খেলেন মাটিতে ফেলে। সবাই দেখতে পায় তাঁর হাতের তাস। সম্পূর্ণ নিজের মতো একটি জীবন তিনি যাপন করেন। যা ভালো লাগে, বিশ্বাস করেন, তা-ই করেন। কোনো কাজ করার আগে বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করেন, প্রত্যেকের মতামত নেন; কিন্তু করেন সেটাই, নিজে যেটা ভালো মনে করেন। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে ভাবলেন, এ রকম দ্বীপে একটা বাংলোবাড়ি করলে কেমন হয়? জায়গা কিনে বাড়ি করে ফেললেন। তাঁর সেই বাড়ি ইতিহাস হয়ে গেল। দেশের সব মানুষ জানে। বাবা ফয়েজুর রহমান আহমেদ একাত্তরের বীর শহীদ, বাংলাদেশ সরকার তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে আর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পিতার স্মরণে ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করে নিজ গ্রামে একটা স্কুল করেছেন। সেই স্কুলের ডিজাইন ও পরিবেশ স্কটল্যান্ডের মতো। তাঁর নুহাশপল্লী এখন আপন মহিমায় বিখ্যাত। বহু লোক দেখতে যায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে হোতাপাড়ার পশ্চিমে ঢুকে গেছে যে সড়ক, সেই সড়কের নাম ‘নুহাশপল্লী সড়ক’। মোটকথা, হুমায়ূন আহমেদ যা করেছেন, তা-ই ইতিহাস হয়ে গেছে। জীবনে যা চেয়েছেন তিনি, পেয়েছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
শাহাদৎ চৌধুরী সম্পাদিত একসময়কার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ই তাঁকে নিয়ে পাঁচ-ছয়বার কাভার স্টোরি করেছে, ‘রোববার’, ‘পূর্ণিমা’, ‘অন্যদিন’ তো করেছেই, আরো কত পত্রিকা যে করেছে! তাঁর একক বইমেলা হয়েছে বাংলাদেশের বহু জায়গায়, নিউ ইয়র্কে, ফ্রাংকফুর্টে। নিজের তৈরি ছবির ফেস্টিভ্যাল হয়েছে জাপানে। জাপানের বিখ্যাত টেলিভিশন এনএসকে তাঁকে নিয়ে ১৭ মিনিটের ডকুমেন্টারি করেছে_’হু ইজ হু ইন এশিয়া’। শাহরিয়ার কবির, অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইয়ের যাতে ফাঁসি না হয়, সে জন্য মিছিল বেরিয়েছে ঢাকার রাস্তায়, পোস্টারিং হয়েছে। আসাদুজ্জামান নূরের মতো জনপ্রিয় অভিনেতা, এখন আওয়ামী লীগের বিখ্যাত নেতা এবং সংসদ সদস্য চাপা পড়ে গেছেন বাকের ভাইয়ের আড়ালে। এখনো লোকে তাঁকে বাকের ভাই বলেই চেনে। নাটকটির শেষ পর্ব যেদিন প্রচারিত হয়, সেদিন হুমায়ূন ভাই বাড়িতে থাকতে পারেননি। বাকেরের যাতে ফাঁসি না হয়, সে জন্য হাজার হাজার লোক এসে দাঁড়িয়েছিল তাঁর বাড়ির সামনে।
যেখানে হাত দিয়েছেন হুমায়ূন ভাই, সোনা ফলেছে। ব্যর্থতা বলে কোনো জিনিস হুমায়ূন আহমেদের ধারেকাছেও ভিড়তে পারেনি কখনো। টিভি নাটক লিখতে এসে সম্পূর্ণ নতুন এবং নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করে দিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদের নাটক শুধুই হুমায়ূন আহমেদের নাটক, অন্য কারো সঙ্গে মেলে না, অন্য কেউ তাঁর মতো লিখতেও পারেন না। ‘এইসব দিনরাত্রি’ থেকে শুরু হলো। ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’_আরো কত তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় নাটক!
সিনেমা করলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণী আবার হলে ফিরল। প্রথম ছবিতেই আট-দশটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। অসাধারণ কিছু গান লিখলেন, যেমন_’এক যে ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ, ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ’। দুর্দান্ত কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করলেন, যেমন_হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো কুদ্দুস বয়াতির পেছনে ৪০-৫০টি শিশু ছুটছে। প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের বিজ্ঞাপন। তাঁর প্রায় প্রতিটি ধারাবাহিকের জনপ্রিয় চরিত্রদের নিয়ে বিজ্ঞাপন হয়েছে। একটি নাটকে রাধারমণের গান ব্যবহার করলেন, ‘আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম’। গানটি জনপ্রিয়তায় রেকর্ড করল। সিনেমা-নাটকে ব্যবহার করে হাছন রাজার গানকে নতুন করে জনপ্রিয় করালেন তিনি। তাঁর গল্প পড়ে রমাপদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বের যেকোনো ভাষার ভালো গল্পগুলোর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের গল্প তুলনীয়। তিনিই একমাত্র বাঙালি লেখক, যিনি সাত বছর ধরে ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লিখেছেন। এই সৌভাগ্য আর কোনো বাঙালি লেখকের হয়নি।
আর তাঁর বইয়ের বিক্রি?
অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তাঁর কোনো কোনো বই ৮০-৯০ হাজার কপিও বিক্রি হয়েছে। টাকার বস্তা নিয়ে প্রকাশকরা তাঁর বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একসঙ্গে ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন কোনো প্রকাশক। তাঁর বই না পেয়ে হতাশায় ডায়াবেটিস হয়ে যায় প্রকাশকের। গাড়ি, ফ্ল্যাট হয়ে যায় পর পর কয়েক বছর বইমেলায় তাঁর একটি করে বই পাওয়া ভাগ্যবান প্রকাশকের। বইমেলায় যে স্টলে বসেন তিনি, ভিড় ঠেকাতে সেখানে আট-দশজন পুলিশ লাগে। আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর অটোগ্রাফ নিতেও ক্লান্ত হয় না পাঠক। তাঁর সঙ্গে এক দিনের জন্য আড্ডা দিতে নুহাশপল্লীতে কলকাতা থেকে ছুটে আসেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাড়িতে দেখা করতে আসেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নুহাশ পদক দিতে তিনি ডাকেন সমরেশ মজুমদারকে। কিশোর-তরুণ-তরুণী তো আছেই, অনেক শ্রদ্ধেয় ও বয়স্ক ভদ্রলোকও তাঁর ভক্ত, পেছন পেছন ঘুরছেন আর স্যার স্যার করছেন। অভিনেতা-অভিনেত্রী, পাঠক-প্রকাশক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে তিনি স্যার। নিজ গ্রামে তিনি পীর সাহেব। লোকে তাঁকে তেমন করে মানে। ভাবতে বিস্ময় লাগে, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি মাপের রোগা-পটকা একজন মানুষ কোন মন্ত্রবলে এমন আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠেন, কী করে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি!
তাঁকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলে ঘোর লেগে যায়। আমি আমার ঘোর কাটাতে আবার পেছন ফিরে তাকাই। হুমায়ূন ভাইয়ের আরো পেছনে ফেলে আসা জীবনটা দেখি।
শ্যামলীর বাসা ছেড়ে হুমায়ূন ভাই এরপর আজিমপুরে চলে এলেন। নিউ মার্কেটের দক্ষিণ পাশ দিয়ে সোজা পশ্চিমে বিডিআর গেট, সেই গেটের বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে খানিক এগিয়ে হাতের ডান দিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে, রাস্তার একপাশে একটা ডোবা আর কয়েকটা কবর, তার উল্টো পাশের বাড়িটির তিনতলার ফ্ল্যাট। তত দিনে জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে তাঁর। ঈদ সংখ্যাগুলোতে একটার পর একটা উপন্যাস লিখছেন, বইয়ের পর বই বেরোচ্ছে, প্রতিদিনই বিস্ময়করভাবে বাড়ছে বইয়ের বিক্রি। প্রকাশকদের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ূন ভাইও প্রায়ই যাচ্ছেন বাংলাবাজারে। নওরোজ কিতাবিস্তানে ইফতেখার রসুল জর্জের ওখানে আড্ডা হয়। প্রায় নিয়মিত আসেন হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ।
কখনো বিউটি বুক হাউস, কখনো স্টুডেন্ট ওয়েজ। আমি যাই। দু-চার দিন পর পরই হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। কোনো কোনো দিন দুপুরবেলা আমাকে তিনি সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান। দুপুরে তাঁর ওখানে খেয়ে বিকেলবেলা ইউনিভার্সিটি ক্লাবে আড্ডা দিতে যাই। এ সময় টেলিভিশনে শুরু হলো তাঁর দেশমাতানো ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’। নাটকটির পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান। মুস্তাফিজ ভাই তখন আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন। আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই প্রায়ই তাঁর ওখানে যান, স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা হয়। কোনো কোনো দিন টিভি ভবনে রেকর্ডর্িংয়েও যাই আমি। সেই সময় নিজেদের গ্রামে বাবার নামে একটা পাঠাগার করলেন হুমায়ূন ভাই। নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ এবং আমাকে নিয়ে গেলেন উদ্বোধন করাতে। ফেরার দিন রাতে ময়মনসিংহ শহরে নির্মলেন্দু গুণের বাসায় থাকলাম। উহ্, সারাটা রাত নির্মলেন্দু গুণ আর হুমায়ুন আজাদ যে কী ঝগড়া করলেন! ঝগড়ার শ্রোতা আমি আর হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
এই সব বিষয় আপাতত থাক। ধীরে ধীরে আরো অনেক ঘটনা লিখব। এখন তাঁর সাক্ষাৎকারের দিকে যাই। ২০০৬ সালে অসাধারণ একটি উপন্যাস লিখলেন হুমায়ূন ভাই_’লীলাবতী’। সেই উপন্যাস ধরে শুরু করলাম তাঁর সাক্ষাৎকার। ২০০৬ সালের এক সন্ধ্যায়। স্থান দখিন হাওয়া, ধানমণ্ডি।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মনে হয়নি যে ‘লীলাবতী’ উপন্যাসের শেষটা আপনি খুব দ্রুত করেছেন? শেষটা আরেকটু বিস্তৃত হতে পারত?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার বেশির ভাগ উপন্যাসে আমি শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়া করি। কেন করি তোমাকে ব্যাখ্যা করি_তুমি তো লেখক মানুষ, তুমি বুঝবে। লেখক যখন লেখালেখি করেন, লেখার আগে থেকে পুরো উপন্যাসটা তাঁর মাথার ভেতর ঢোকে। আমি একটা ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস লিখলাম, ৫০০টা পৃষ্ঠা কিন্তু আমি তখন মাথার ভেতর নিয়ে বাস করছি। তখন একটা চেষ্টা থাকে, কত তাড়াতাড়ি আমি জিনিসটাকে মাথা থেকে নামিয়ে দেব। আমি প্রবল চাপ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করি, একই সঙ্গে আমার মাথার ভেতর ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস হাঁটাহাঁটি করে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কুটুরকুটুর করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, ব্যাপারটা একই সঙ্গে আনন্দের ও প্রচণ্ড চাপের। আমার মনে হয়, একজন গর্ভবতী মা ৯ মাস গর্ভধারণের পর সন্তানের জন্ম দিয়ে যে আনন্দ-তৃপ্তি-স্বস্তিটা পান, একজন লেখক ঠিক সেই স্বস্তিটা পান। সেই স্বস্তিটার জন্য আমার তাড়াহুড়া। আল্লাহপাক হয়তো এ কারণেই কোরআন শরিফে বলেছেন_’হে মানবসন্তান, তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।’
ইমদাদুল হক মিলন : আবার ‘লীলাবতী’ প্রসঙ্গে আসি। মাসুদের স্ত্রীর যখন বাচ্চা হবে, সে বাড়িতে থাকল, তার বাচ্চা হচ্ছে না। তার শাশুড়ি আগেই বলেছিল, তার যমজ বাচ্চা হবে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। তারপর নৌকা করে সে যাচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে তার যমজ বাচ্চা হলো। এই যে এটুকু রহস্য, তাকে আপনি ঝড়-জলের মধ্যে কেন নিয়ে এলেন? রহস্যটা কী? এই কষ্টটা সে তো বাড়িতেও পেতে পারত?
হুমায়ূন আহমেদ : নৌকায় পরীবানুকে নিয়ে, তাকে ঝড়বৃষ্টির হাতে ছেড়ে দিয়ে যে টেনশন তৈরি হয়েছে, পরীবানুকে বাড়িতে রেখে দিলে তা হতো না।
ইমদাদুল হক মিলন : আমি সাহিত্যের যেটুকু বুঝি, তাতে জানি যে আপনি খুব বড় একজন লেখক। অন্য ভাষায় অন্য দেশে জন্মালে হয়তো আপনি আরো ভাগ্যবান হতেন। দুর্ভাগ্য আপনার, আপনি এই ভাষার, এই দেশে জন্মে গেছেন। আপনার কী মনে হয়, বাংলা ভাষার প্রেক্ষাপটে ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনার অবস্থানটা কোথায়?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার অবস্থান আমাকেই ঠিক করতে হবে? মিলন, শোনো, আমি সাহিত্যের ছাত্র না। আমি কেমিস্ট্রির ছাত্র। সাহিত্যের বিষয়ে আমার যে জ্ঞান, সেটা হচ্ছে বই পড়ে। এক জীবনে প্রচুর বই পড়েছি। আমাদের সময় তো রেডিও, টিভি_এসব ছিল না; আমাদের একমাত্র জিনিস ছিল গল্পের বই। বিশাল বিশাল উপন্যাস, যেটা আমাদের অল্পবয়সীদের পড়তে দেওয়া হতো না। যেমন ধরো, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, খাটের নিচে ঢুকে অন্ধকারে পড়ে শেষ করেছি। আমার সাহিত্য সম্পর্কে যা জ্ঞান আছে, ওই খাটের নিচে ঢুকে বই পড়ে। এমন একজনকে কি সাহিত্যে তার অবস্থান বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক?
ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, আমি জানতে চাইছিলাম যে আপনি এত বড় একজন লেখক, বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে আপনার নিজের অবস্থানটা কোথায়?
হুমায়ূন আহমেদ : প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ছাড়বে? আমার অবস্থান ঠিক হবে আমার মৃত্যুর পর। তোমরা সবাই মিলেই ঠিক করবে। এই সময়ে আমি বর্তমানের একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না।
ইমদাদুল হক মিলন : এখানে একটা কথা বলি, যে অবস্থায় হেমিংওয়ে তাঁর জীবদ্দশায় পপুলার, জীবদ্দশায় মার্কেজ পপুলার, জন স্টাইনবেক পপুলার, তাঁদের মতো লেখক সারা পৃথিবীতে বিরল আর আমাদের সাহিত্যে শরৎচন্দ্র জনপ্রিয়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল_এঁরা জনপ্রিয়। এখন এসব লেখকের জনপ্রিয়তার পার্থক্য আছে। আমি বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তার কথা বললে তারাশঙ্করকে বলব। তাঁর সময়ে তাঁর মতো জনপ্রিয় আর কেউ নেই। জনপ্রিয়তার কথা বললে আপনাকে তো কেউ রোমেনা আফাজের সঙ্গে তুলনা করে না, আপনাকে তুলনা করলে তারাশঙ্করের সঙ্গে তুলনা করে, শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার সঙ্গে করে।
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, শোনো, বাংলাদেশে সাহিত্যের থার্মোমিটার হলেন সাহিত্যের অধ্যাপকরা। এ দেশে পাঠকদের ভালোলাগা-মন্দলাগা গ্রাহ্য হয় না। সাহিত্যের অধ্যাপকদের থার্মোমিটারে কী উঠছে, সেটাই গ্রাহ্য। সাহিত্যের থার্মোমিটার বলছে, আমি একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না। কাজেই এটাই সত্য। আমার মৃত্যুর পর নতুন সত্য আসতে পারে, আবার নাও পারে। না এলে নাই। সাহিত্যের অধ্যাপকরা সাহিত্য মাপার নানা যন্ত্রপাতি_থার্মোমিটার, ল্যাকটোমিটার নিয়ে বসে থাকুক। আমি বসে থাকব বলপয়েন্ট নিয়ে। মিলন, ল্যাকটোমিটার কী জানো তো? ল্যাকটোমিটার দিয়ে দুধের ঘনত্ব মাপা হয়। সাহিত্যের সমালোচকদের হাতেও কিন্তু সাহিত্যের ঘনত্ব মাপার ল্যাকটোমিটার আছে। হা হা হা।
বাংলাদেশের একজন সাহিত্যবোদ্ধা আমার উপন্যাসগুলোর জন্য একটা নাম বের করেছিলেন, সেটা তোমার মনে আছে? ‘অপন্যাস’।
ভাগ্যিস তার পরই কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকা আমার ‘অপন্যাস’ ছাপতে শুরু করল। আমাদের দেশের সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে ওই পত্রিকাটি হিসাবের পত্রিকা।
ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, এটা বাংলা ভাষার কোনো লেখকের ক্ষেত্রে ঘটেনি। প্রতিবছর শারদীয় সংখ্যায় বাংলা ভাষার কোনো লেখকের উপন্যাস ছাপা হওয়া ‘দেশ’-এর ইতিহাসে নেই।
হুমায়ূন আহমেদ : থাকুক ওই প্রসঙ্গ। শারদীয় ‘দেশ’ আমার উপন্যাস ছেপেছে বলে আমি জাতে উঠে গেছি, এটা আমি মনে করি না। আমি লেখালেখি আমার আনন্দের জন্য করি, জাতে ওঠার জন্য করি না। জাতিচ্যুত হওয়ার জন্যও করি না।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি তো প্রচণ্ড আত্ম-অহংকারী লোক!
হুমায়ূন আহমেদ : আমি চোখমুখ শক্ত করে থাকি বলে আমাকে অহংকারী মনে হয়। তবে কিছু অহংকার আছে। সেই অহংকার নিজেকে ভালো মানুষ ভাবার অহংকার। এর বেশি না।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা ভাষার খুব বড় ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটি নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখলেন। ওটা একটা অসাধারণ রচনা। আমার এখনো মনে আছে। আপনার বইয়ের ভূমিকা লিখলেন আহমদ শরীফ এবং বাংলাদেশের যত বুদ্ধিজীবী আছেন, সবাই আপনার প্রশংসা করেছিলেন এই লেখার জন্য। এরপর ড. আনিসুজ্জামান আপনার বইয়ের ভূমিকা লিখে দিলেন। শামসুর রাহমান আপনার লেখার ব্যাপক প্রশংসা করে লিখেছেন এবং বাংলা ভাষার খুব বড় লেখক আমি মনে করি তাঁকে, জানি না আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না_তাঁর নাম রমাপদ চৌধুরী, তিনি আপনার লেখা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত চিঠিপত্র লিখেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে আমার একবার কথাও হয়েছিল কলকাতায়। সব কিছু মিলিয়ে আপনার এ ধারণাটা কেন হলো যে এ দেশের দু-একজন কী বললেন না বললেন তার ওপর আপনাকে নির্ভর করতে হবে বা আপনি খুব আশান্বিত হবেন তাঁদের কথায়?
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, আমি যে সময়ের কথা বলেছি, সে সময়…।
ইমদাদুল হক মিলন : না, তার আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা আহমদ শরীফের মতো লেখকরা আপনাকে নিয়ে লিখেছেন। শওকত আলী আপনাকে নিয়ে লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ : মানুষের মন খারাপ হয় না? কত আগ্রহ, কত আনন্দ নিয়ে লিখি! কত না বিনিদ্র রজনীর লেখাকে অপন্যাস বলা হচ্ছে, একথা মনে লাগবে না? লেখকরা তো আবেগের সমুদ্রেই লালিত-পালিত।
ইমদাদুল হক মিলন : জনপ্রিয় লেখকের কনসেপ্টটা আসলে কী আপনার কাছে? আপনি আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলেন তো…।
হুমায়ূন আহমেদ : তুমি দেখি এক ‘জনপ্রিয়’ নিয়ে ঘটঘট করেই যাচ্ছ? ব্যাপারটা কী? জনপ্রিয় লেখকের কনসেপ্ট একটাই_বহু লোক তাঁর বই পড়ছে।
ইমদাদুল হক মিলন : এখন বহু লোক তো মার্কেজের বইও পড়ছে, তারাশঙ্করের বইও পড়ছে, হুমায়ূন আহমেদের বইও পড়ছে, আবার এদিকে রোমেনা আফাজ বা এজাতীয় লেখকের বইও পড়ছে। সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী রকম দাঁড়ায়?
হুমায়ূন আহমেদ : শোনো মিলন, এত প্যাঁচালের মধ্যে যেতে চাইছি না। এখন আমার কাছে জনপ্রিয় শব্দটা খুব প্রিয়।
ইমদাদুল হক মিলন : প্রিয় শব্দ?
হুমায়ূন আহমেদ : কারণ জনপ্রিয় শব্দটার প্রথম শব্দ হলো ‘জন’, যেখানে জনতা আছে, সেখানে সেই শব্দটাকে আমি ক্ষুদ্র করে দেখব, আমি ওই রকম লোকই না। আমাদের হেমন্তের গান শুনতে ভালো লাগে না?
ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, অবশ্যই।
হুমায়ূন আহমেদ : কত দরদি একজন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! এখন বহু লোক তাঁর গান শোনে বলে কি তিনি ছোট হয়ে গেছেন?
ইমদাদুল হক মিলন : না, এখানে কি হুমায়ূন ভাই আপনার মনে হয় জনপ্রিয়তার দুটি ভাগ আছে? ধরেন যে অর্থে মার্কেজ বা তারাশঙ্কর জনপ্রিয়, যে অর্থে আপনি জনপ্রিয়, সেই অর্থে ফুটপাতের চটিবই লেখা একজন জনপ্রিয় লেখক, এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যাটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আসলে ব্যাপার হলো, জনতার কোন অংশ বইটি পড়ছে।
ইমদাদুল হক মিলন : আমি সেটাই জানতে চাইছি। আমি বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে দিই আপনাকে। ধরেন হেমিংওয়ে বা মার্কেজের জনপ্রিয়তা, তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণের যে জনপ্রিয়তা আর ওদিকে নীহারঞ্জন গুপ্ত। আপনার জায়গাটা কোথায় আসলে?
হুমায়ূন আহমেদ : ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম তো। মিলন, শোনো, একটা সময় ছিল, যখন এই সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম। এখন মাথা ঘামাই না। এখন মনে হয়, তোমাদের যা ইচ্ছা তোমরা বলো, আমার উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ বলো, আমার কিছু যায়-আসে না। আমার প্রধান কাজ হচ্ছে লেখালেখি করে যাওয়া, এ কাজটি আমি যদি আমার মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত করে যেতে পারি, আমি মনে করব, এটা আমার জন্য যথেষ্ট। এবং আমি খুবই ভাগ্যবান লেখক যে আমি আমার বইগুলো অনেককেই পড়াতে পারছি। একটা প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো বাড়িতে ঢুকে যখন দেখি ওই বাড়িতে চার-পাঁচটা বই আছে, এর মধ্যে একটা নিয়ামুল কোরআন আছে, একটা ‘বিষাদসিন্ধু’ আছে আর একটা হুমায়ূন আহমেদের বই_আমার যে কী আনন্দ হয়! চোখে পানি এসে যাওয়ার মতো আনন্দ।
এবার অন্য রকম একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি। তারপর আবার হুমায়ূন আহমেদের পেছনের জীবনের দিকে ফিরব।
হুমায়ূন ভাইয়ের যেকোনো লেখাই গভীর আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে পড়ি। আমার ধারণা, তাঁর এমন কোনো লেখা নেই, যা আমি পড়িনি। বছর তিনেক আগের কথা, তখন অপেক্ষা করে থাকতাম তাঁর ‘বলপয়েন্ট’ লেখাটির জন্য। ‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এ প্রতিসপ্তাহে বেরোচ্ছে ‘বলপয়েন্ট’। এত স্বাদু রচনা, পড়তে শুরু করলে কখন শেষ হয়ে যায় টেরই পাই না। শেষ হওয়ার পর বিরক্ত লাগে। কেন মাত্র দেড়-দুই পৃষ্ঠা করে লিখছেন তিনি? কেন এই লেখা আরো বড় করে লিখছেন না?
এর মধ্যে একটি পর্বে দেখলাম আমাকে নিয়ে দু-তিনটি প্যারা লিখেছেন। পড়ে সন্ধ্যাবেলা তাঁকে ফোন করলাম। তিনি বিক্রমপুর থেকে ফোন ধরলেন। বিক্রমপুরের দীঘিরপার এলাকায় নাটকের শুটিং করতে গেছেন। গ্রামটির নাম কামাড়খাড়া। এই গ্রামের পাশের গ্রাম বাণীখাড়ায় ছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি। এলাকাটি আমার বিশেষ পরিচিত। ওই গ্রামে আমার এক দাদার বাড়ি। অর্থাৎ বাবার ফুফাতো চাচার বাড়ি। কিশোর বয়সে বহুবার সেই বাড়িতে গেছি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম রজতরেখা। হুমায়ূন ভাই ওই এলাকায় শুটিং করছেন আর সেদিনই অনেক দিন পর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে ভেবে ভালো লাগল। আমাকে নিয়ে তিনি লিখেছেন সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ফোন করেছিলাম। কথায় কথায় বললাম, ‘বলপয়েন্ট’ লেখাটিকে মনে হচ্ছে ‘কলম ছেড়ে দেওয়া লেখা’। কোনো পরিকল্পনা নেই, মাথায় এলোমেলোভাবে আছে স্মৃতিগুলো। কোন স্মৃতি আগের, কোনটি পরের_কোনো হিসাব নেই, কলম যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, লেখাও এগোচ্ছে সেইভাবে। বলপয়েন্টের মূল আকর্ষণ এই জায়গায়।
কিন্তু যে কথা বলার জন্য হুমায়ূন ভাইকে ফোন করেছিলাম সেই কথাটাই বলা হলো না। এখন বলি। হুমায়ূন ভাই, আপনি লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এসেছেন। সন্ধ্যাবেলা পার্টি হচ্ছে কোথাও। ঢাকার লেখক-শিল্পীরা অনেকেই আছেন সেখানে। পানাহার হইহল্লা আড্ডা চলছে। সেই আড্ডায় আমি সুনীল-সমরেশকে সমানে তুমি তুমি করে যাচ্ছি।
এখানটায় একটুখানি গণ্ডগোল আছে।
আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কখনো তুমি বলি না। তাঁকে আপনি করেই বলি। সুনীলদা আপনি, বলি।
সমরেশ মজুমদারকে তুমি করে বলি। পেছনে একটা ঘটনা আছে। সতেরো-আঠারো বছর আগে সমরেশ মজুমদার প্রথম ঢাকায় এলেন। ফেব্রুয়ারির বইমেলা চলছে বাংলা একাডেমীতে। সমরেশকে ঢাকায় এনেছেন পার্ল পাবলিকেশন্সের আলতাফ হোসেন। আপনার-আমার দুজনের প্রিয় মিনু ভাই। মিনু ভাই অকালে চলে গেছেন। এই মুহূর্তে তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। মিনু ভাই ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন, হঠাৎ রেগে যেতেন; কিন্তু মনটা খুব ভালো ছিল! একবার তাঁর বিদেশে থাকা এক আত্মীয় খুবই সুন্দর পিংক কালারের বেশ দামি একটা টি-শার্ট গিফট করেছেন মিনু ভাইকে। মিনু ভাই সেটা নিয়ে আমার গেণ্ডারিয়ার বাসায় গিয়ে হাজির। ওই টি-শার্টে নাকি আমাকে খুব মানাবে। বহুদিন মিনু ভাইয়ের দেওয়া সেই টি-শার্ট পরে আমি ঘুরে বেরিয়েছি। ফেব্রুয়ারি বইমেলায় মিনু ভাইকে একটা বই দেব বলে অনেক দিন ঘুরিয়েছিলাম, সে কথা মনে করে আজ অনুতপ্ত হচ্ছি।
তো, সমরেশ ঢাকায় এসে মিনু ভাইয়ের সঙ্গেই আছেন। বাংলা একাডেমীতে মিনু ভাইয়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনো বাংলাদেশের পাঠক সমরেশকে সেভাবে চেনে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে গেছি মিনু ভাইয়ের স্টলের সামনে। মিনু ভাই সমরেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সমরেশের লেখা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ছিল। তাঁর বহু লেখা আমি পড়েছি। বিশেষ করে ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পরিচয়ের মুহূর্তেই সমরেশ যেটা করলেন, আমার কাঁধে একটা হাত দিলেন, দিয়ে বেশ একটা দাদাসুলভ ভঙ্গিতে কলকাতার ভাষায় বললেন, ‘তা, কী লিখছ আজগাল?’ আচরণ এবং প্রশ্নে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কিন্তু আমার মনের ভেতর খুট করে একটা শব্দ হলো। বয়সে ছোট ইত্যাদি ভেবে কি তিনি আমাকে তুমি করে বলছেন? নাকি লেখকসুলভ কোনো ভাব! লেখকদের তো নানা ধরনের ভাবচক্কর থাকে।
আমার মাথায় দুষ্টু একটা পোকা কামড় দিল। তাহলে আমিও সমরেশের সঙ্গে একটু ভাব নিই। আমি ঘাড় বাঁকা করে সমরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে অতিশয় নির্বিকার গলায় বললাম, ‘তা, তুমি কী লিখছ?’
সমরেশ কিন্তু ব্যাপারটা সহজভাবেই নিলেন। ওই বিকেলেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি সমরেশকে তুমি করেই বলতে লাগলাম। সঙ্গে ‘দা’টা লাগিয়ে দিলাম। কিন্তু হুমায়ূন ভাই, আপনি এই তুমি তুমিটা একদমই পছন্দ করছিলেন না। একদিন খুবই বিরক্ত হয়ে কথাটা আমাকে বলেছিলেন। যখন আমি ঘটনাটা বললাম, শুনে আপনি খুব মজা পেয়েছিলেন। তবে তারপর দু-একবার সমরেশদাকে আমি আপনি করে বলার চেষ্টা করেছি, ব্যাপারটা তিনি স্বাভাবিকভাবে নেননি। মাইন্ড করেছেন।
২০০৯-এর এপ্রিলে কলকাতায় গেছি। সমরেশের সঙ্গে দেখা। বললাম, কেমন আছেন, সমরেশদা? সমরেশদা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তুমি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলতে?’
এবার অন্য প্রসঙ্গে। মনে আছে, হুমায়ূন ভাইয়ের আজিমপুরের বাসায়ই মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন তিনি আমেরিকায় থাকেন। ছুটিতে দেশে এসেছেন। আমি মুহম্মদ জাফর ইকবালেরও ভক্ত পাঠক। যত দূর জানি, তখন পর্যন্ত তাঁর দুটি মাত্র বই বেরিয়েছে। মুক্তধারা থেকে ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’, শিশু একাডেমী থেকে ‘দিপু নাম্বার টু’। ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’ গল্পটি বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল এবং আজকের অনেক পাঠকই জানেন না, হুমায়ূন ভাইয়ের ‘নন্দিত নরকে’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন দুজন শিল্পী_মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শামিম সিকদার।
হুমায়ূন আহমেদরা তিন ভাইই বিখ্যাত, তিন ভাইই লেখক। জনপ্রিয়তায় হুমায়ূন ভাইয়ের পরই জাফর ভাই। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো প্রিয় লেখক আর কেউ নেই। শিক্ষক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় তিনি। স্কুল-কলেজের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ, অসম্ভব সাহসী এবং সৎমানুষ। যে কজন মানুষের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে আমাদের সময়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁদের একজন।
আর আহসান হাবিব ‘উন্মাদ’ পত্রিকার সম্পাদক, দুর্দান্ত কার্টুন আঁকেন, রম্য লেখায় তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর জোকসের বইয়ের যে বিক্রি বইমেলায় আমি দেখেছি, বিস্ময়কর! এই পরিবারের আরেকজন মানুষের আমি খুব ভক্ত, হুমায়ূন ভাইয়ের মা। সারা দিন বই পড়েন, সাহিত্য নিয়ে ভাবেন। ‘নূরজাহান’ প্রথম পর্ব পড়ে আমাকে বললেন, দ্বিতীয় পর্ব বেরোলে আমাকে দিয়ো। দ্বিতীয় পর্ব বেরোতে সাত বছর লাগল। এই সাত বছরে যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, বেরোয়নি?
বই বেরোনোর পর প্রথম কপিটি আমি তাঁকে পেঁৗছে দিয়ে এসেছি। শেষ পর্ব হুমায়ূন ভাই মাকে কিনে দিয়েছিলেন, বইটা পেঁৗছে দিতে আমার কয়েকটা দিন দেরি হয়েছিল বলে।
আজিমপুরের সেই বাসা ছেড়ে হুমায়ূন ভাই তারপর এসে উঠলেন শহীদুল্লাহ্ হলের হাউস টিউটরের কোয়ার্টারে। তত দিনে অনিন্দ্য পাবলিশার্স নামের একটি প্রকাশন সংস্থা বেশ জাঁকজমক করে এসেছে প্রকাশনায়। হুমায়ূন ভাইয়ের ‘অমানুষ’, আমার ‘কালাকাল’_এই সব বই নিয়ে শুরু করল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অনিন্দ্যর স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক একদিন একটা মিষ্টির প্যাকেট আর একটা নতুন সাদা ডাইহাটসু গাড়ি নিয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের বাড়িতে এসে হাজির। গাড়িটা আপনার জন্য। রয়ালটি থেকে অ্যাডজাস্ট হবে।
ঘটনাটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা আগে বা পরে আজ পর্যন্ত আর ঘটেনি।
সেই সময় ‘দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য পাতায় ‘মৌনব্রত’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন হুমায়ূন ভাই। ধারাবাহিকভাবে লেখা তাঁর বেশির ভাগ উপন্যাসই শেষ পর্যন্ত শেষ হয় না। ‘মৌনব্রত’ও শেষ হলো না। পরে এই লেখাটি নাম বদলে বই করলেন তিনি। ‘জনম জনম’। উপন্যাসটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা স্বীকার করবেন, ‘জনম জনম’ এক অসাধারণ উপন্যাস। পরে ‘নিরন্তর’ নামে আবু সায়িদ ছবি করেছেন। নায়িকা শাবনূর।
আমি হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব উপন্যাস পড়েছি। বহু ভালো উপন্যাস লিখেছেন তিনি। কতগুলোর নাম বলব! ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’_এ দুটো উপন্যাস তো ইতিহাস! তারপর ‘নির্বাসন’, ‘সূর্যের দিন’, ‘অন্ধকারের গান’, ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’, ‘গৌরিপুর জংসন’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘কবি’, ‘উনিশ শো একাত্তর’, ‘ফেরা’, ‘জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘রুমালি’, ‘শুভ্র’, ‘লীলাবতী’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘বাদশানামদার’_আরো কত উপন্যাস! তাঁর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত ছিলেন বাংলাদেশের খুব বড় একজন শিক্ষিত মানুষ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বেশ কয়েকবার হুমায়ূন ভাই আমাকে রাজ্জাক স্যারের ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে নিয়ে গেছেন। মনে আছে, রাজ্জাক স্যার নিজ হাতে পাঙাস মাছের ডিম রান্না করে আমাদের দুজনকে একদিন খাইয়েছিলেন। তাঁর মুখে কী যে প্রশংসা শুনেছি হুমায়ুন ভাইয়ের একেকটি লেখার!
একবার বইমেলায় আবু হেনা মুস্তাফা কামাল বললেন, হুমায়ূন মধ্যবিত্তের নাড়ি স্পর্শ করেছে। তাঁর ‘চোখ’ গল্পটি পড়ে ‘সংবাদ’-এ দুর্দান্ত একটি লেখা লিখলেন সৈয়দ শামসুল হক। ‘চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক’ উপন্যাসটি পড়ে আহমদ ছফা আমাকে বলেছিলেন, অসাধারণ লেখা! মাত্র কময়কটি আঁচড়ে বাংলাদেশের চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে হুমায়ূন। ফরহাদ মযহার বলেছিলেন, হুমায়ূনের গল্পগুলোর কোনো তুলনা হয় না। নির্মলেন্দু গুণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর ‘জলিল সাহেবের পিটিসন’ গল্পটি পড়ে। কলকাতার ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় হুমায়ূন ভাইয়ের ‘১৯৭১’ গল্পটি ছাপা হলো। আমার সামনে সেই গল্পের এমন প্রশংসা করলেন আল মাহমুদ, হুমায়ূন ভাই লজ্জা পেয়ে গেলেন।
এ রকম কত ঘটনার কথা লিখব!
একই হাতে কত রকমের লেখা যে লিখেছেন হুমায়ূন ভাই। বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনের জনক তিনি। প্রথম সার্থক সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন, সায়েন্স ফিকশনকে জনপ্রিয় করেছেন। এখন তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনও ভীষণ জনপ্রিয়। ভূতের গল্পে হুমায়ূন আহমেদের কোনো জুড়ি নেই। তাঁর মতো এত ভালো ভূতের গল্প বাংলা ভাষার আর কোনো লেখক লেখেননি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘ছায়াসঙ্গী’ গল্পটির কথা। রহস্য, ফ্যান্টাসি, থ্রিলার আর অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়ের লেখা। ‘দেবী’, ‘নিশীথিনী’ লিখে আরেকটা জগৎ তৈরি করলেন। ‘অন্য ভুবন’ লিখে আরেকটি জগৎ তৈরি করলেন। ‘আয়নাঘর’, ‘পোকা’, ‘ভয়’_কত লেখার কথা বলব! আর তাঁর সেই অবিস্মরণীয় চরিত্র মিসির আলী, তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র হিমু! সিলেটের একটি মেয়ে হিমুর সঙ্গেও আমার একবার দেখা হয়েছিল। সব মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ একটি নেশার নাম, হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রতিষ্ঠান। শিশু-কিশোরদের লেখা, রূপকথা_কোথায় তাঁর হাতের পরশ পড়েনি? আর যেখানে পড়েছে, সেখানেই সোনা ফলেছে। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ বলে যেতে পারেন। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক, সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস-গল্প তাঁর প্রিয়। জন স্টাইনবেক, স্টিফান কিং তাঁর প্রিয়। সারাক্ষণ লেখা নিয়ে ভাবছেন। লেখার ব্যাপারে অসম্ভব খুঁতখুঁতে। মনমতো না হলে সেই লেখা কিছুতেই লিখবেন না। মাথা ভর্তি নতুন নতুন আইডিয়া। সবার মধ্যে থেকেও, তুমুল আড্ডার মধ্যে থেকেও কোন ফাঁকে যেন একা হয়ে যান, লেখার জগতে চলে যান। যখন-তখন লিখতে পারেন। লেখেন মেঝেতে বসে, লেখার জন্য চেয়ার-টেবিল দরকার হয় না। লেখার মতোই অসম্ভব আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে গল্প বলতে পারেন, বাস্তবের সঙ্গে কোথায় যে মিশেল দেবেন কল্পনা, তিনি নিজে ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না। কখনো তিনি নিজেই মিসির আলী, কখনো হিমু। সব মিলিয়ে এক বিস্ময়কর মানুষ। কাউকে মা-বাবা ডাকতে পারেন না। নিজের শ্বশুর-শাশুড়িকেও কখনো মা কিংবা বাবা বলে ডাকেন না। কাউকে দুঃখ দিতে চাইলে বেশ ভালোভাবেই তা দিতে পারেন। নিজের নাটকে একবার এক বিশাল নাট্যব্যক্তিত্বের অভিনয় দেখে এত বিরক্ত হলেন, বললেন, ‘এটা কি অভিনয়? আরে, আপনি তো অভিনয়ই জানেন না।’ একবার তাঁর নুহাশপল্লীতে নাটকের রেকর্ডিংয়ে এসে সন্ধ্যার পর কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী অন্য একটি ঘরে বসে হুমায়ূন আহমেদের তুমুল নিন্দামন্দ করছেন। তিনি তো আর তা জানেন না, খুবই উৎফুল্ল ভঙ্গিতে সেই ঘরের দিকে যাচ্ছেন। ঘরের কাছে গিয়েই শোনেন, এই অবস্থা। বাইরে দাঁড়িয়ে খানিক ওসব শুনে মন খারাপ করে ফিরে এলেন। সেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বুঝতে দিলেন না কিছু। আবার পেটে কথাও রাখতে পারেন না। যদি বন্ধুদের কেউ কোনো গোপন কথা বলে বলল, কাউকে বলবেন না, সেটাই সবার আগে বলে ফেলবেন। পাগলের সাঁকো নাড়ানোর মতো।
ইমদাদুল হক মিলন : বাংলা ভাষার খুব জনপ্রিয় লেখক হচ্ছেন শরৎচন্দ্র, তারপর তারাশঙ্কর। কিন্তু যে অর্থে জনপ্রিয়তাকে আমাদের দেশে বিবেচনা করা হয়, এঁরা সেই স্তরের লেখক না এবং আমরা সেই সারিতে আপনাকে অনেক আগেই যুক্ত করেছি। আপনার কি মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার কিছু মনে হয় না, মিলন। আমি এটা আগেও বলেছি। তবে শোনো, আমাদের দেশের লেখকদের ভাগ্য খুবই খারাপ। শুধু লেখালেখি করে আমাদের লেখকরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন না। সেখানে আমার যে অবস্থানটা হয়েছে, মাঝেমধ্যে আমার কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন অধ্যাপনা করি, মাসে ছয় হাজার-সাড়ে ছয় হাজার টাকা পাই, থাকি শহীদুল্লাহ হলে। হঠাৎ করে দেখলাম, লোকজন আমার বই পড়া শুরু করেছে। আমি কী করলাম? মাথা খারাপ থাকলে যা হয় আর কি! সব কিছু বাদ দিয়ে একটা গাড়ি কিনে ফেললাম।
ইমদাদুল হক মিলন : কিনলেন কি, ওটা তো ছিল একটা গিফট। ওটা আপনাকে উপহার দিয়ে গেল এক প্রকাশক। এ ধরনের ঘটনা বাংলা সাহিত্যে কোনো লেখকের ক্ষেত্রে কখনো ঘটেনি।
হুমায়ূন আহমেদ : এটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ছিল। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ঘটনার এখানেই শেষ না। আট মাসের মাথায় আরো বেশি টাকা হয়ে গেল। আমি কিনে ফেললাম মাইক্রোবাস। আমার মাইক্রোবাসের তো তখন দরকার নেই। কেন কিনলাম? এটার কোনো লজিক্যাল কারণ থাকতে পারে? কোনো কারণ নেই, কিন্তু আমার গাড়ি রাখার জায়গা নেই। হলের ভেতরও তো জায়গা নেই। একটা ছোট গাড়ি, আবার একটা মাইক্রোবাস বাসার সামনে পড়ে থাকে। আমার দেখতে খুবই ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে মাইক্রোবাসের দরজা খুলে রাতে মাইক্রোবাসে চুপচাপ গিয়ে বসা। এর চেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে? একজন লেখকের পক্ষেই এ রকম হাস্যকর জিনিস করা সম্ভব। একজন লেখকের চারটি গাড়ি। একটা পর্যায়ে আমার গাড়ি ছিল চারটি। চারটি গাড়ির দরকার নেই আমার। কিন্তু ড্রাইভার আমার একটি। একটি লোক যে চারটি গাড়ি কিনবে তাঁর চারটি ড্রাইভার থাকবে বা তিনটি ড্রাইভার থাকবে। চারটি গাড়ি নিয়ে আমি বসে আছি, আমার ড্রাইভার কিন্তু একজন। চারটি গাড়ি কেন কিনলাম? এগুলো করার সুযোগ করে দিয়েছে আমার বইগুলো। আমার নানা ধরনের পাগলামি পূরণ করতে পারছি কী জন্য? মানুষজন আমার বই পড়ছে বলে। এই যে আমি সেন্ট মার্টিনে একটি বাড়ি কিনে রেখেছি, কেন? নুহাশপল্লী বানিয়ে রেখেছি, কেন?
ইমদাদুল হক মিলন : তার মানে, আপনার মনে হয় আপনার মধ্যে পাগলামি আছে?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার মধ্যে পাগলামি আছে।
ইমদাদুল হক মিলন : এটা কি আপনার বাবার মধ্যেও ছিল? আমি যত দূর জানি, আপনার বাবা, আপনি ‘আমার ছেলেবেলা’ বইয়ে লিখেছিলেন যে তিনি এক মাসের বেতন পেয়ে একটি ঘোড়া কিনে নিয়ে এসেছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ : ঘোড়া কিনে এনেছিলেন, বেহালা কিনে এনেছিলেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার বাবার ঘোড়া কেনার সঙ্গে আপনার মাইক্রো কেনার কোনো যোগসূত্র আছে?
হুমায়ূন আহমেদ : ভালোই তো মিলিয়েছ। শুধু ঘোড়া না, বাবা তাঁর বেতনের টাকায় বেহালাও কিনেছিলেন। সেই সময় উনি বেতন পেতেন আশি টাকা। বেহালাটা কিনেছিলেন পঁচিশ টাকা দিয়ে। ওটা কেনা মানে ওই সময় বেতনের অনেকটাই চলে যাওয়া। খুবই দামি একটি বেহালা। এই বেহালাটা তিনি ওপরে উঠিয়ে রেখে দিলেন। আমাদের নাগালের বাইরে রেখে দিলেন। কী জন্য বেহালাটা কিনলেন? কোনো একসময় তিনি একজন ওস্তাদ পাবেন বেহালার, তখন তিনি শিখবেন। তাই আগে থেকে কিনে বসে আছেন। সেই ওস্তাদও পাওয়া গেল না। হয়তো বা পাওয়া গেল, শেখার পয়সাটা জোগাড় করতে পারলেন না। তাঁর বেহালা শেখা হলো না। একটা পর্যায়ে বেহালাটা তাকের ওপর থেকে নামিয়ে আমরা ভাইবোনরা কিছুক্ষণ পোঁ পোঁ করে বাজাতাম, তারপর উঠিয়ে রাখতাম, বাবা যাতে টের না পান।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখালেখির মধ্যে পাঠকরা একধরনের পাগলামির প্রকাশ দেখতে পায়, এর কারণটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি এখন আমাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছ যে আমি পাগল। পাগল বলেই লেখায় পাগলামি উঠে আসে। আচ্ছা, যাও আমি পাগল। কি, তুমি খুশি তো? আর বকবক করবে না। স্টপ।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বললে স্টপ।
(ইন্টারভিউ বন্ধ হলো। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর তোলা ফটোগ্রাফের স্তূপ নিয়ে বসলেন। একেকটা ছবি হাতে নিচ্ছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন। আমি বললাম, আপনার ছবির চেয়ে ব্যাখ্যা সুন্দর। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, যাও, তোমাকে আর ছবি দেখাব না।)
ইমদাদুল হক মিলন : লেখাপড়ার প্রসঙ্গে আসি। আপনি একবার বলেছিলেন আপনি লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলেন না।
হুমায়ূন আহমেদ : না, ছিলাম না। ছোটবেলায় একেবারেই ছিলাম না। পড়াশোনায় আমার মন বসে অনেক পরে। স্কুলের সব পরীক্ষায় টেনেটুনে পাস করতাম। ক্লাস সিঙ্ ে(চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল) ফেল করি। আমাদের ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার আমার কান্নায় দ্রবীভূত হয়ে বিশেষ বিবেচনায় পাস করিয়ে দেন।
ইমদাদুল হক মিলন : পড়াশোনায় আপনার মন বসল কখন?
হুমায়ূন আহমেদ : তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ভালো ছাত্ররা বৃত্তি পরীক্ষার জন্য সিলেক্ট হয়েছে। তাদের বিশেষ যত্ন। ডাবল টিফিন পায়। যেহেতু বৃত্তি দিচ্ছে, তাদের ফাইনাল পরীক্ষাও দিতে হবে না। আমার খুব… [এখানে মজার একটা ঘটনা আছে, হুমায়ূন ভাইয়ের জবানিতে না, আমার মতো করে আমি ঘটনাটা লিখব]
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার চাকরিজীবনের কথা বলুন। প্রথমেই কি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না। প্রথমে জয়েন করলাম ময়মনসিংহের অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে মাস চার-পাঁচ মাস্টারি করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই।
ইমদাদুল হক মিলন : ময়মনসিংহের সময়টা আপনার কেমন কেটেছে?
হুমায়ূন আহমেদ : খুব খারাপ। যদিও ময়মনসিংহ আমার নিজের জেলা। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতাম। মনে হতো নির্বাসনে এসেছি। সহকর্মীদের কারো সঙ্গই পছন্দ হতো না। তাঁদের চিন্তাভাবনা স্থূল মনে হতো। তাঁদের দেখে মনে হতো তাঁদের জীবন ক্লাস নেওয়া এবং ক্লাস থেকে ফিরে দুপুরে খেয়ে ঘুমানোর মধ্যেই আটকে গেছে।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সময় কাটত কিভাবে?
হুমায়ূন আহমেদ : ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করে। রাতে লিখতাম। ‘অচিনপুর’ নামের উপন্যাসটি ময়মনসিংহে লেখা শুরু করি।
ইমদাদুল হক মিলন : তার আগেই তো আপনার ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রকাশিত হয়ে গেছে।
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ।
ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা, এই যে ‘নন্দিত নরকে’ লেখা হলো একেবারে হঠাৎ করে। তার আগে ‘নন্দিত নরকে’তে একটা ভূমিকা ছিল, সোমেন চন্দরের একটা গল্প ‘ইঁদুর’ আপনাকে প্রভাবিত করেছিল_কিন্তু কথা সেটা না, কথা হলো ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়ার অভ্যাসটা আপনার কিভাবে হলো?
হুমায়ূন আহমেদ : ভূমিকাটা ছিল ‘শঙ্খনীল কারাগারে’। আর বই পড়ার অভ্যাসের কথা বলছ? এই অভ্যাস পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। তাঁর খুব পড়ার শখ ছিল। বাড়ি ভর্তি ছিল বইয়ে। তিনি লেখালেখিও করতেন। তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। নাম ‘দীপ নেভা যার ঘরে’। তাঁর লেখা কলকাতার কিছু পত্রিকা, এ দেশের ‘দৈনিক আজাদ’-এ ছাপা হতো। লেখালেখি করে কলকাতার কোনো এক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ‘সাহিত্য সুধাকর’ উপাধিও পেয়েছেন। সেই সময়ের লেখকরা নানা উপাধি পেতেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার ‘নন্দিত নরকে’ লেখা কি একেবারেই আচমকা? এর আগে আপনি কি কিছু লিখেছেন কখনো?
হুমায়ূন আহমেদ : কবিতা লিখেছি। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। তবে নিজের নামে লিখিনি। কবিতাগুলো আমার ছোট বোন মমতাজ আহমেদ শিখুর নামে পাঠাতাম। তার নামেই ছাপা হতো।
ইমদাদুল হক মিলন : ছোট বোনের নামে পাঠাতেন কেন? নিজের নামে নয় কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : কবিতাগুলো তেমন সুবিধার ছিল না। পুরুষ কবির কবিতা হিসেবে চলে না। মহিলা কবির কবিতা হিসেবে চলতে পারে।
ইমদাদুল হক মিলন : মহিলাদের সৃষ্টিশীলতাকে আপনি কি ছোট করে দেখছেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি বাংলা ভাষার দশজন মহিলা কবির নাম বলো, যাঁরা পুরুষদের পাশে দাঁড়াতে পারেন।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার ছোট বোনের নামে প্রথম যে কবিতাটি ছাপা হয় তার নাম কী?
হুমায়ূন আহমেদ : দিতে পার একশ ফানুস এনে/আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।
ইমদাদুল হক মিলন : এটা তো মুক্তিযুদ্ধের আগে?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের আগে।
ইমদাদুল হক মিলন : তার পরে এভাবে ক’টা কবিতা পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল, আপনার মনে আছে?
হুমায়ূন আহমেদ : পাঁচটি কবিতা।
ইমদাদুল হক মিলন : তারপর আপনি উপন্যাস লিখলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : নাহ্, উপন্যাসটা অনেক পরে…।
ইমদাদুল হক মিলন : উপন্যাসে আসার ঘটনাগুলো বলেন_এই ধরেন_কিভাবে শুরু, কিভাবে আইডিয়াটা এল মাথায়…
হুমায়ূন আহমেদ : প্রথমে তো আমি লিখলাম ‘শঙ্খনীল কারাগার’। যদিও প্রথমে এটা ছাপা হয়নি, কিন্তু উপন্যাস প্রথমে লেখা হয়েছিল ‘শৃঙ্খনীল কারাগার’। কিছুই করার ছিল না সেই সময়। আমার ঠিকমতো মনেও নেই। তবে এই উপন্যাসটা আমার বাবা পড়েছেন_এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের একটা ঘটনা।
হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্পটা বলি।
গল্প না, ঘটনা। গল্পে কল্পনা থাকে, ঘটনায় থাকে সত্যতা। ছেলেবেলায় পড়াশোনায় খুবই খারাপ ছিলেন তিনি। আসলে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না লেখাপড়ায়। স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় টেনেটুনে, কায়ক্লেশে পাসটা করতেন। বাবার বদলির চাকরি। একেকবার একেক জেলায়। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ছেন। সে বছর পাসই করতে পারলেন না। ডাহা ফেল। ফেল করা মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন কী করে! ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার। তাঁর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ছাত্রের কান্না দেখে বড়ুয়া স্যারের হৃদয় দ্রবীভূত হলো। তিনি বিশেষ বিবেচনায় ক্লাস সেভেনে তুলে দিলেন। ওপরের ক্লাসে উঠে যেই কে সেই! অবস্থা আগের মতোই। পড়ায় মন বসে না।
মন বসল ক্লাস এইটে ওঠার পর।
স্কুল থেকে তখন খুবই সুস্বাদু, ভালো টিফিন দেওয়া হতো। সেই টিফিনের জন্য ব্যাপক লোভ ছিল বালক হুমায়ূন আহমেদের। এখানে ব্র্যাকেটে আরেকটা কথা বলে রাখি। হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম ‘বাচ্চু’। কবি শামসুর রাহমানেরও ডাকনাম ছিল ‘বাচ্চু’। পরে দুজনের কেউ এই নাম কখনো ব্যবহার করেননি। কাউকে বলতেনও না।
যা হোক, ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের সিলেক্ট করা হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। যারা সিলেক্ট হয়েছে, স্কুলে তাদের মহাসমাদর। স্যাররা খাতির করছেন, ছাত্ররা খাতির করছে। তাদের যত্ন-আত্তির অভাব নেই। যেহেতু বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে, সেহেতু ফাইনাল পরীক্ষাও তাদের দিতে হবে না। আর যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা সেটা হলো, ভালো ছাত্রদের টিফিন দেওয়া হবে ডাবল। সাধারণ ছাত্ররা যে টিফিন পাবে, ওরা পাবে তার দ্বিগুণ।
এই টিফিনের লোভটা ঢুকল হুমায়ূন আহমেদের মাথায়। যেমন করে হোক বৃত্তি পরীক্ষা তাঁকে দিতেই হবে। বৃত্তি পরীক্ষায় সিলেক্ট হলেই ডাবল টিফিন। তিনি ক্লাস টিচারের কাছে গিয়ে, হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, ‘ঘ্যানরঘ্যানর শুরু করলাম। রোজই স্যারকে ধরি আর করুণ মুখ করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলি, স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।’
প্রথম দিন ক্লাসের খারাপ ছাত্রগুলোর একটি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চাইছে শুনে স্যার আকাশ থেকে পড়লেন। ‘বলিস কী, তুই দিবি বৃত্তি পরীক্ষা!’
_জি স্যার।
_আরে তুই তো ক্লাস সিক্সে ফেল করেছিলি। সেভেন থেকে এইটে উঠেছিস তাও দুটো না তিনটে সাবজেক্টে ফেল।
_তাও আমি স্যার বৃত্তি পরীক্ষা দেব।
_যা যা ভাগ।
স্যার ধমক দিয়ে বিদায় করলেন।
পরদিন আবার সেই ঘ্যানঘ্যানানি, ‘স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।’
আজ স্যার বিরক্ত হলেন আরো বেশি। পারলে মেরে ক্লাস থেকে বের করে দেন। হুমায়ূন আহমেদের করুণ কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে মারলেন না। আগের দিনের মতোই ধমক দিয়ে থামালেন।
কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ থামার জিনিস না। চান্স পেলেই স্যারকে ধরছেন, ‘আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব, স্যার। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।’
একই ঘ্যানঘ্যানানি রোজ শুনতে শুনতে স্যার একদিন মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আয় আমার সঙ্গে।’
নিয়ে গেলেন হেডস্যারের রুমে, ‘স্যার, এই ছেলেটা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চায়।’
হেডস্যার অবাক, ‘বলেন কী!’
_জি স্যার।
_আরে ও তো সব সাবজেক্টে পাসই করতে পারে না, ও কী বৃত্তি পরীক্ষা দেবে? স্কুলের মান-ইজ্জত থাকবে না।
সারা জীবনই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিচিত্র সব মানুষের দেখা হয়েছে। ওই স্যারটিও কিঞ্চিৎ বিচিত্র চরিত্রেরই ছিলেন। হেডস্যারকে বললেন, ‘তার পরও আপনি স্যার ওকে কনসিডার করেন। দেখা যাক কী হয়।’
সেই শিক্ষকের নাম আমার মনে পড়ছে না। হুমায়ূন ভাই বলেছিলেন, ‘ভুলে গেছি। স্মৃতি আজকাল কিছুটা প্রতারণাও করছে।’
তো, ক্লাস টিচারের কথা শুনে হেডস্যার হতভম্ব, ‘এসব আপনি কী বলছেন? এটা কী করে সম্ভব? স্কুলের মান-ইজ্জত সব যাবে।’
শেষ পর্যন্ত ওই স্যারের কারণেই হেডস্যার কনসিডার করলেন। ক্লাস এইটের একটি খারাপ ছাত্রও বৃত্তি পরীক্ষা দেবে_এমন ঘটনা চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে কখনো ঘটেনি।
হুমায়ূন আহমেদ দারুণ খুশি। আরে, কিসের বৃত্তি পরীক্ষা, টিফিন ডাবল পাওয়া যাবে_এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা।
পরদিন থেকে ভালো ছাত্রদের মতো ডাবল টিফিন পেতে লাগলেন। কিন্তু কপাল খারাপ, চার-পাঁচ দিনের মাথায় জলবসন্ত হয়ে গেল। জলবসন্ত নিয়ে স্কুলে যাওয়া যায় না, বাড়িতে শুয়ে থাকতে হয়। রাতের বেলা তো বটেই, দিনের বেলাও মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। মাথার কাছে নিমের একটা ডাল রাখা হয়েছে। ডাল ভর্তি পাতা। নিমপাতা জলবসন্তের মহৌষধ। শরীর অবিরাম চুলকায়। তখন নিমপাতা শরীরে বুলিয়ে দিলে আরাম হয়।
কিন্তু মশারির তলার জীবন লেখকের ভালো লাগে না। ভাইবোনরা কেউ তাঁর সামনে আসেই না। জলবসন্ত ছোঁয়াচে রোগ। কাছে এলেই বা ছুঁলেই হবে। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, মা সংসার নিয়ে। বালক হুমায়ূন আহমেদ মশারির তলায় একা একা ছটফট করেন। সময় আর কাটে না। ওদিকে বৃত্তি পরীক্ষার মাস দেড়-দুয়েক বাকি।
একদিন মনে হলো, আচ্ছা, ক্লাসের বইগুলো একটু পড়ে দেখি তো! কিছু হোক আর না হোক, সময়টা তো কাটবে।
জলবসন্ত ভরা শরীরে মশারির তলায় সময় কাটানোর জন্য ক্লাসের বইগুলো পড়তে শুরু করলেন, অঙ্কগুলো একা একাই করতে লাগলেন। লেখাপড়ার আশ্চর্য এক নেশা ধরে গেল। ধীরে ধীরে জলবসন্ত সারল। বৃত্তি পরীক্ষার দিন এসে গেল। পরীক্ষা দিলেন। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেন। স্কুলের ভালো ছাত্র যারা তাঁর সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিল, তারা কেউ তাঁর ধারেকাছেও নেই। সবাইকে পেছনে ফেলে হুমায়ূন আহমেদ নাম্বার ওয়ান!
শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্রের জীবন। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন, এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন, তুখোড় রেজাল্ট। ডক্টরেট করতে গেলেন আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে। অলথ্রু এ ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট। শিক্ষকতার জীবন শুরু করলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। অধ্যাপক হয়ে ডক্টর হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন। তত দিনে সাহিত্যজগতে তিনি কিংবদন্তি হয়ে গেছেন।
কিন্তু ক্লাসের খারাপ ছাত্রটি বৃত্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করেছে, স্কুলে হৈচৈ পড়ে গেছে। সেই টিচার পারলে হুমায়ূন আহমেদকে কোলে নিয়ে হেডস্যারের রুমে চলে যান। ছাত্রের ভালো রেজাল্টের গৌরবে স্কুলে তাঁর পজিশনও হাই হয়ে গেছে।
ক্লাস নাইনে ঘটল আরেক ঘটনা।
জেনারেল ম্যাথের টিচার হুমায়ূন আহমেদের খাতা দেখতে দেখতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন, ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০ নম্বর দিয়ে দিয়েছেন।
আজব ব্যাপার!
হেডস্যার অঙ্কের টিচারকে ডেকে পাঠালেন। এটা আপনি কী করেছেন? ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০? অঙ্কের টিচার খেপে গেলেন। ছেলেটা অঙ্কে এত ভালো, আমার ইচ্ছা আমি তাকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছি। আপনার কোনো অসুবিধা আছে?
হেডস্যার হতভম্ব। এ দেখি অদ্ভুত চরিত্র!
নিশ্চয় জীবনের এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস-গল্প-নাটকে অদ্ভুত সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটান। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দেখার ভঙ্গি অন্য কারো সঙ্গে মেলে না।
এসব ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আড্ডায় হুমায়ূন ভাই মজা করে বলেছেন। আমি আমার স্মৃতি থেকে লিখছি।
হুমায়ূন ভাইয়ের ভয় পাওয়া নিয়ে এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। বিটিভিতে চলছে হুমায়ূন আহমেদের দেশ-কাঁপানো ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটক নিয়ে চারদিকে চলছে তুমুল আলোচনা। নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনি, তার ব্লাড ক্যান্সার। দর্শক আতঙ্কে আছে টুনির মৃত্যু নিয়ে। ওই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ধারাবাহিক নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়াল পর্যন্ত লেখা হলো। টুনিকে যেন মেরে ফেলা না হয়। কোনো কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছে।
নাটক যখন তুঙ্গে, তখন এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই গেছেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। তিনি তখন নিউ মার্কেটের দক্ষিণ দিককার সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই তাঁর ফ্ল্যাটে যান। খাওয়াদাওয়া, গল্প-আড্ডা আর নাটক নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। আড্ডা শেষ করে হুমায়ূন ভাই ফিরে যান তাঁর আজিমপুরের বাসায়, আমি চলে যাই গেণ্ডারিয়ায়।
ও রকম এক সন্ধ্যার ঘটনা।
সিঁড়ি ভেঙে আমরা দুজন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। সরকারি পুরনো আমলের ফ্ল্যাট। দরজাগুলো পুরনো। দরজার মাথার ওপর পুরনো আমলের কলিংবেলের সুইচ। সিঁড়িতে টিমটিম করে জ্বলছে অল্প পাওয়ারের একটা বাল্ব। হুমায়ূন ভাই আনমনা ভঙ্গিতে কলিংবেলের সুইচে হাত দিতে গিয়েই ‘উরে বাবা রে’ বলে একলাফে সরে এলেন।
আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হলো পুরনো কলিংবেল, তারফারে লিকটিক হয়ে আছে কি না! হুমায়ূন ভাই কি ইলেকট্রিক শক খেলেন!
আমি খুবই নার্ভাস ভঙ্গিতে তাঁর হাত ধরলাম। কী হলো, হুমায়ূন ভাই?
তিনি কোনো রকমে বললেন, ‘মাকড়সা।’
_মাকড়সা?
_হ্যাঁ।
তিনি রীতিমতো কাঁপছেন। তাকিয়ে দেখি, কলিংবেলের সুইচের ওখানে মাঝারি সাইজের একটা মাকড়সা।
মাকড়সাকে এ রকম ভয়?
সত্যি তা-ই। হুমায়ূন ভাই সবচেয়ে ভয় পান মাকড়সা। তাঁর ভাইবোনরাও কেউ কেউ মাকড়সাকে খুবই ভয় পান।
সেদিন মাকড়সার ভয়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তিনি আর স্বাভাবিকই হতে পারলেন না। দ্রুত আড্ডা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম। আমরা তখন প্রায়ই বাংলাবাজারে পাবলিশারদের ওখানে গিয়ে চা-বিস্কুট খাই আর আড্ডা দিই। রয়ালটির টাকা-পয়সার জন্যও যাই কোনো কোনো দিন। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। হুমায়ূন ভাই ইউনিভার্সিটির টিচার। তাঁর একটা বাঁধা রোজগার আছে। আমার নেই কিছুই। হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ-এক শ টাকা ধারও নিই। সেই ধার কোনোদিন শোধ করি না। একদিন দুপুরের দিকে বাংলাবাজার থেকে রিকশায় করে যাচ্ছি তাঁর শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে। বাহাদুর শাহ্ পার্কের ওখানে দেখি এক পাখিওয়ালা খাঁচায় করে মুনিয়া পাখি বিক্রি করছে। আমরা রয়ালটির কিছু টাকা পেয়েছি। খাঁচাসহ হুমায়ূন ভাই তিন জোড়া মুনিয়া পাখি কিনে ফেললেন।
ঢাকায় তখন ট্রাফিক জ্যাম বলতে কিচ্ছু নেই। আমরা রিকশায় করে ইউনিভার্সিটি এলাকার দিকে যাচ্ছি। যেতে যেতে দুজনে মিলে একটা বিজনেসের প্ল্যান করে ফেললাম। আমাদের সেই ব্যবসার প্ল্যান ইত্যাদির কথা পরে বলব। এবার আসুন আমাদের দুজনার কথোপকথন বা আমার নেওয়া হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারের পরের অংশে নিয়ে যাই আপনাদের।
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
ইমদাদুল হক মিলন : মানে, আপনার হাতে লেখা কপিটাই পড়েছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ।
ইমদাদুল হক মিলন : পড়ে কী বললেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমাকে কিছু বললেন না। বাবার সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের দূরত্ব ছিল। বাবা সরাসরি আমাদের কিছু বলতেন না। ভায়া মিডিয়া কথা বলতেন। তাঁর যা বলার তিনি মাকে বলতেন, মা আমাদের বলতেন।
ইমদাদুল হক মিলন : তিনি আপনার মাকে কী বললেন?
হুমায়ূন আহমেদ : পৃথিবীর সব বাবাই সন্তানদের সামান্য প্রতিভায়ই মুগ্ধ হন। তিনিও হয়েছিলেন। তাঁর মুগ্ধতা যে উঁচু পর্যায়ে ছিল, তার প্রমাণ পেলাম কিছুদিন পর। তিনি তখন একটা রেডিও নাটক লিখে শেষ করেছেন। নাম ‘কত তারা আকাশে’। হঠাৎ সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, তুই তোর মতো করে ঠিকঠাক করে দে।
আমি আমার একজীবনে অনেক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি_ওই দিনের সাহিত্য পুরস্কার সব পুরস্কারের ওপরে।
মিলন, আজ আর না। অনেক বকবক করেছি।
ইমদাদুল হক মিলন : ঠিক আছে, আজ এ পর্যন্তই।
সেদিনের মতো আমরা থেমে গেলাম। তারপর একে একে বন্ধুরা এলেন, আলমগির রহমান, আর্কিটেক্ট করিম, অন্যদিন গ্রুপের প্রধান মাজহারুল ইসলাম, মাসুম রহমান, কমল_শুরু হয়ে গেল আমাদের আড্ডা। প্রিয় পাঠক, ঘটনা ২০০৬ সালের, অন্যদিন পত্রিকার জন্য হুমায়ূন ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম আমি। এই সেই সাক্ষাৎকার, যা কয়েক পর্বে ছাপা হয়েছিল অন্যদিনে। এবার আমার নিজের স্মৃতিচারণাসহ সেই সাক্ষাৎকার নতুন আঙ্গিকে শিলালিপিতে ছাপা হচ্ছে। কয়েক দিন পর আরেক সন্ধ্যায় আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে বসলাম।
ইমদাদুল হক মিলন : আমরা কথা বলছিলাম আপনার আমেরিকা যাওয়া প্রসঙ্গে। আপনার চারটি বই বের হলো, আপনি আমেরিকায় চলে গেলেন। আমেরিকায় তো আপনি ছয় বছর ছিলেন একটানা। নোভা, শীলা_দুজনেরই কি জন্ম হয়েছে ওখানে?
হুমায়ূন আহমেদ : নোভা দেশেই হয়েছে। শিলার জন্ম হয়েছে ওখানে।
ইমদাদুল হক মিলন : ছয় বছর আপনি কিছু লেখেননি?
হুমায়ূন আহমেদ : না। ওখানে পড়াশোনার চাপ এত বেশি ছিল, লেখালেখির বিষয়টা মাথায়ই ছিল না। তা ছাড়া তখন বিদেশে আমাদের প্রথম সংসার, জানি না কিছু, নোভার মাও তো খুবই বাচ্চা মেয়ে, সেও তো কিছু জানে না। সংসার চালানো এবং পড়াশোনার বাইরে কিছু করার সুযোগ ছিল না। অবসর কাটত টিভি দেখে।
ইমদাদুল হক মিলন : আর এমনিতে সাহিত্যের পড়াশোনা?
হুমায়ূন আহমেদ : সাহিত্যের পড়াশোনা মানে কি গল্প-উপন্যাস? গল্প-উপন্যাস একটা বয়স পর্যন্ত পাগলের মতো পড়েছি। তারপর সেই পাঠকের মৃত্যু হয়েছে। অন্য সব বিষয় পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিষয় কী তোমাকে বলব না। তুমি আমাকে বুদ্ধিজীবী ভেবে বসতে পারো।
আমার পছন্দের বইপত্র পড়ার সুযোগ আমেরিকায় ছিল। ইউনিভার্সিটির বিশাল লাইব্রেরি। লাইব্রেরি ভর্তি বই। তবে আমার সময় ছিল না। গাদা গাদা বই লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসতাম, এক সপ্তাহ পর না পড়েই ফেরত দিতাম। পড়াশোনাটা করতাম, মাঝেমধ্যে, যখন সামারে ছুটি হতো। এত পয়সা-কড়ি তো ছিল না যে পুরো সামার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘুরব। পছন্দের পড়াশোনা বা গল্পের বই যা পড়ার ওই সময়ই পড়তাম। ওই সময় পাঠ্যবই খুলে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা, আপনি যে আমেরিকায় পড়লেন ‘পলিমার কেমিস্ট্রি’, ওই বিষয়ে কি আপনি লেখালেখি করেননি? বা থিসিসটা কি বের হয়নি বই হয়ে?
হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞানের ওপর বিদেশে যে কাজগুলো হয় ওগুলোর থিসিস পাবলিশড হয় না, থিসিস থেকে পেপার পাবলিশড হয় বিদেশি জার্নালগুলোতে। আমার ২৫টির মতো পেপার ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। থিসিসের কাজ এবং পরে পোস্ট ডক করার সময়ের কাজ নিয়ে।
ইমদাদুল হক মিলন : আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন ‘৮৪-র দিকে বোধ হয়? তার আগে, মাত্র চারটি বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা আমার কাছে। আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবলেন কী করে? তখন তো আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন, আপনার সংসারটা বড় হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ : হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সব সময়। যদি ভেতরে থাকে তাহলে লেখালেখি বিষয়টা মাথার গভীরে এক ধরনের চাপ দিতেই থাকে। এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে। দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি। আবার আমি যে একজন লেখকও, ওটাও তো মাথায় ছিল।
ইমদাদুল হক মিলন : লেখালেখির ক্ষেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। আপনার সে অস্বস্তিটা কি তৈরি হয়েছিল যে এত দিন পর আমি আবার শুরু করলাম!
হুমায়ূন আহমেদ : এটা আসলে মনে করতে পারছি না। মনে হয় না ছিল। কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। অনেক দিন লিখিনি তাতে কী হয়েছে? আবার লিখব। ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব।
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল, নাকি আস্তে আস্তে…?
হুমায়ূন আহমেদ : না। আমার মনে হয় এটা শুরু থেকেই ছিল। মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো। কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে খুবই চিন্তাভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে। একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না_এই অবস্থা।
ইমদাদুল হক মিলন : নাটকের দিকটায় আপনি যে গেলেন, সেই প্রসঙ্গটায় আমি একটু পরে আসছি। এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পর একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন, নাটক তো আরো পরে ‘৮৫-র দিকে। ‘৮৫-তে আপনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শুরু করেছিলেন। আমার মনে আছে। কিন্তু এই যে একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, আপনার কী মনে হয়, এর পেছনে রহস্যটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : এই অবস্থা যে তৈরি হয়েছিল, এই বিষয়টার একটা নরমাল আর একটা আদিভৌতিক ব্যাখ্যা আছে।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বলেন, আমরা দুটোই শুনি।
হুমায়ূন আহমেদ : নরমাল ব্যাখ্যা হলো, আমি নাটক লেখা শুরু করলাম। আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি। ‘এইসব দিনরাত্রি’ বহু লোক দেখা শুরু করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরু করল। পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হওয়ার পেছনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা। একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে_এটা তো হওয়ার কথা না। আমার ধারণা, আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে_এটা হতে পারে।
আর আদিভৌতিক ব্যাখ্যা যেটা হলো_শহীদুল্লাহ হলে যখন থাকি, তখন একসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকে আমি হঠাৎ কিছু বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে গেলাম। ২৫-৩০ হাজার টাকা। সেই সময় ২৫-৩০ হাজার টাকা অনেক টাকা। বই বিক্রির টাকা। তখনো বই লেখা বাবদ অ্যাডভান্স দেওয়া শুরু হয়নি। যেহেতু টাকা পেয়েছি, আমার হাত খুব উশখুশ করছিল টাকাটা খরচ করার জন্য। কাজেই করলাম কি, স্ত্রী এবং বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ায়। এই টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশভ্রমণ হবে_এই হলো পরিকল্পনা। প্রথমে গেলাম নেপালে, নেপাল থেকে দিলি্ল। ভাবলাম, এত কাছে যখন এলাম, মরুভূমি দেখে যাই। জয়সলমীরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। জয়সলমীরের পথে পড়ল আজমীর শরিফ। এত নাম শুনেছি_পথে যখন পড়লই, তখন ভাবলাম যে আজমীর শরিফ দেখে যাই। আজমীর শরিফ গেলাম। আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি, বিপাশা, সে খুবই বিরক্ত হয়ে গেল; বলল_কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির। ফকিরে ভর্তি জায়গাটি। বিপাশার বয়স তখন তিন-সাড়ে তিন; আমি তাকে বোঝালাম যে এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে। এখানে এলে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়। দেখা গেল যে এই কথা শুনে মানসিকভাবে সে স্বস্তি বোধ করল। তখন তাকে নিয়ে গেলাম কবর জিয়ারত করতে, জিয়ারত শেষ করে চলে আসব, দেখি বিপাশা দাঁড়িয়ে। ব্যাপার কী? বিপাশা বলল, ‘আমি যেটা চেয়েছি, সেটা তো পাইনি। না পেলে যাব না।’ আমি বললাম, মা, তুমি কী চেয়েছ? বিপাশা বলল, ‘আল্লাহর কাছে আমি এক হাজার বস্তা টাকা চেয়েছি। এই টাকা না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে আমি যাব না।’ কবরস্থানের পাশে রেলিংটা ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি ও তার মা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম। না, সে এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না। এদিকে বাংলাভাষী কিছু লোক ছিল, তারা খুবই মজা পেয়ে গেল। একটি মেয়ে এক হাজার বস্তা টাকা আল্লাহর কাছে চাইছে, না পাওয়া পর্যন্ত সে যাবে না_এটা তো মজার বিষয়ই। তখন বিপাশাকে বোঝালাম যে এখন টাকাটা পেলে বরং সমস্যা হবে। এত টাকা দেশে নিয়ে যেতে হবে। কান্নাকাটি না করে চলো দেশে যাই। দেশে গেলে টাকাটা পেয়ে যাবে। অবশ্যই পাবে। আমরা দেশে ফিরে এলাম। আসার পরপরই জলের মতো হু হু করে টাকা আসতে লাগল। কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে, লেখালেখি করে বিপুল অর্থ উপার্জন আপনি কিভাবে করলেন? আমি বলি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশার কারণে করেছি_এখানে আমার কোনো হাত নেই।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি যে ঘটনা বললেন, এটি সত্যি মনে রাখার মতোই ঘটনা। আপনি কি অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী?
হুমায়ূন আহমেদ : না। পৃথিবী লজিকে চলে। মিরাকল পৃথিবীর চালিকাশক্তি নয়।
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু আপনি তো প্রায়ই মাজারে যান। সিলেটে গেলেই শাহজালাল সাহেবের মাজার জিয়ারত করেন।
হুমায়ূন আহমেদ : মহাপুরুষদের মাজার জিয়ারত করা মানেই কিন্তু অলৌকিকে বিশ্বাস স্থাপন না। শাহজালাল, শাহ মখদুম, শাহ পরান_এঁরা সবাই উঁচু শ্রেণীর সুফি মানুষ। সব কিছু ছেড়েছুড়ে মানুষের কল্যাণের জন্য এ দেশে এসেছেন। ধর্মীয় কাজকর্মের পরও তাঁরা পুরো জীবন ব্যয় করেছেন সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁরা তো মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। আমরা যদি অন্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কবরস্থানে যাই তাঁকে সম্মান দেখানোর জন্য_আমরা এঁদের কাছে যাব না কেন? একটু চিন্তা করে দেখো, কোথায় কোন দেশ থেকে কত জায়গা ঘুরে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের ত্যাগটা দেখো না! তাঁদের কষ্টটা দেখো না। তা ছাড়া মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, ইসলামী ভাবধারায় বড় হয়েছি, ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে দেখেছি_তাঁরা নামাজ পড়ছেন, সকালবেলা ঘুম ভেঙেছে আমার মায়ের কোরআন তিলাওয়াত শুনে। এটা তো ব্রেনের মধ্যে ঢুকে যায়।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎকার – নিয়েছিলেন শাকুর মজিদ
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শাকুর মজিদ। সেখান থেকে এটি তুলে ধরা হল।
বিশাল কুশনে আধশোয়া শাকুর মজিদ বললেন, ১৯৮৬ সালে ‘দিশা’ হুমায়ূন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। এটিই পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার। এখন কিভাবে লেখাটা পাওয়া যায় সেই এতদিনকার কথা। বললাম, তিনটা জায়গায় খুঁজে দেখতে পারেন। এক. ন্যাশনাল আর্কাইভস, দুই. জাতীয় গণগ্রন্থাগার এবং তিন. বাংলা একাডেমী। দেরি না করে ফোন করলাম মোবারক হোসেনকে; বাংলা একাডেমীর গ্রন্থাগারের ভারপ্রাপ্ত। রাত সাড়ে এগারোটা প্রায়। ভয় ছিল, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। না, ফোনটা ধরল এবং বিষয়টা বললাম। শাকুর এসেছিল আমার উপর তলায় হুমায়ূনের বাসার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের পাশে একদণ্ড থাকতে। ফেরার সময় আমার ঘরে আসা। তো তখনই হুমায়ূন প্রসঙ্গ উঠতে এই তথ্যটা বের হলো। পরদিন মোবারকের ফোন পাই। কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা, হ্যাঁ পাওয়া গেছে। শুধু আমি নই, মোবারকও অবাক, এই পত্রিকা একাডেমীর লাইব্রেরিতে আছে! এমন কোনো বিখ্যাত পত্রিকা নয়, বেশি দিন প্রকাশিতও হয়নি, অনেকটা অগোচরেই এসেছে আবার চলেও গেছে। আর পূর্বসূরি কোনো এক লাইব্রেরিয়ান বাঁধাই করে রেখে দিয়েছেন আলমারির তাকে। তিনি কি জানতেন একদিন খোঁজ পড়বে! সাক্ষাৎকারে অপেক্ষা করছে এ সময়ের পাঠকদের জন্য বিস্ময় এবং কালজয়ী তথ্য। সচিত্র পাক্ষিক দিশার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে। সম্পাদক শামসুন্নাহার জ্যোৎস্না ১৪৯ সি ধানমণ্ডি, ১৩/২ রোড নং ঢাকা। জানা যায়, এই সচিত্র পাক্ষিক দিশার সর্বমোট ২০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। হ্যান্ড কম্পোজে ‘সুশ্রী’ টাইপে পদ্মা প্রিন্টার্সে মুদ্রিত। আর হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারটি মুদ্রিত হয় ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ সালে প্রথমবর্ষ নবম সংখ্যায়। সাক্ষাৎকারের ভেতরে ভেতরে ছাপা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের, তাঁর পরিবারের সদস্যদের আলোকচিত্র। তরতাজা মানুষটি ছবি হয়ে গেল- অথচ সাক্ষাৎকারের বিষয় বক্তব্য এখনো অনেকাংশে অটুট। শাকুর মজিদের এই সাক্ষাৎকারের ভেতর পর্যবেক্ষণযোগ্য কিছু তথ্য রয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে হুমায়ূন খুব একটা বদলাননি। সব কথা অকপট, খোলামেলা। এ সময়ের পাঠকদের জন্য রয়েছে কিছু প্রশ্নের উত্তর। তাঁর রচিত চরিত্রের নামকরণের জটিলতা, বিভিন্ন গ্রন্থের নামকরণ প্রসঙ্গ। আর সাক্ষাৎকারের শেষে শাকুর মজিদ লিখেছেন ‘…বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় (বর্তমানে) ঔপন্যাসিক…।’ শাকুর মজিদ এর ‘বর্তমান’ কখনও বদলায়নি। আজও রয়ে গেছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই ‘বর্তমান’ সব সময়ই বর্তমান থাকবে। এখানেই শেষ নয়। শাকুর মজিদ এরই ফাঁকে হুমায়ূন আহমেদের মায়েরও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এই অংশটি পড়ে পাঠকের হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে হাহাকার করবে। ‘তাঁর বাবা পাণ্ডুলিপিটা তাঁর হাতে দিয়ে বললেন- এটা যত্ন করে রেখে দিস- তুই একদিন খুব নামকরা লেখক হবি।’ আলমগীর রহমান, স্বত্বাধিকারী প্রতীক ও অবসর প্রকাশনা সংস্থা
হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত নাটক ‘নির্বাসন’ দেখতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ নামের একজন লেখকের সাথে যখন আমার প্রথম পরিচয় তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র (১৯৮০)। পরে খোঁজ নিয়ে শুনলাম এ লেখকের আরো তিনটে উপন্যাস বেরিয়েছে লেখকশিবির পুরস্কার প্রাপ্ত ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ আর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। সহজলভ্যতার সুবাদে বই তিনটি সাথে সাথে পড়ে নিতে আমার খুব একটা সময়ের প্রয়োজন হয়নি। এরপর ঈদ সংখ্যা কিংবা আর কোনো কাগজে বেশ কিছুদিন তাঁর কোনো লেখা পড়িনি। বন্ধুরা অনেকে বলত যে হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। নিজেও বিশ্বাস করেছি। এরপর হঠাৎ একদিন টেলিভিশনেই সম্ভবত ‘প্রথম প্রহরে’ শিরোনামে হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটক দেখলাম- কিন্তু তখনও সংশয় কাটেনি। সন্দেহ ছিল নন্দিত নরকেরই সেই হুমায়ূন আহমেদ, নাকি অন্য কেউ? এরপর অবশ্য ঈদ সংখ্যাগুলো খুলতেই চোখে পড়ত আমার অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত সেই ঔপন্যাসিকের নাম- দীর্ঘ সাত বছর পলিমার রসায়নে পিএইচডি নিয়েও যিনি নিজেকে আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যের এক অভিনব আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, যেটা কেবল তাঁর একারই। আর প্রকাশকদের অহর্নিশ চাহিদা আর পাঠক-পাঠিকার নিরঙ্কুশ ভালো লাগাই যদি জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হয় তবে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ।
দিশার পক্ষ থেকে গত ২১ জানুয়ারির পড়ন্ত বিকেলে গিয়েছিলাম আমি আর বাবু তাঁর আজিমপুরের বাসভবনে। ছিমছাম মধ্যবিত্তের সাজানো-গোছানো ড্রইংরুম। মেঝের উপর জল রং করছেন তাঁর ছোট বোন। স্বাগত জানালেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব (হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই)। প্রসন্ন মুখে হুমায়ূন আহমেদ বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন- বলুন ভাই, কী করতে পারি?
বললাম- আপনার ব্যক্তিগত জীবন দিয়েই শুরু করি?
যেহেতু আগেই যোগাযোগ করে আগমনের উদ্দেশ্য নির্ধারিত ছিল।
– আপত্তি নেই।
তিনিই জানালেন, ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে (মামার বাড়ি) তাঁর জন্ম। বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ (স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ), মা আয়েশা আক্তার। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বড়। পুলিশ অফিসার বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে ছোটবেলাতেই অনেক জায়গা ভ্রমণ করেছেন- অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সিলেটের মীরাবাজারের কিশোরীমোহন পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সেরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় যথাক্রমে বগুড়া জিলা স্কুল ও ঢাকা কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হন। [তাঁর ছোট ভাই কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের কাছ থেকে জানলাম, মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বোর্ড থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন- এ কথা অবশ্য না লেখার অনুরোধ করেছিলেন।] উচ্চ মাধ্যমিক সেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন রসায়ন বিভাগে। বিজ্ঞান প্রিয় বিষয় বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসিতে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান (তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে জানা) পাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এরপর আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়নে ডক্টরেট করে এসে (১৯৮২ সালে) এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। জিজ্ঞেস করলাম- বিদেশে থেকে না গিয়ে দেশে ফিরলেন কেন?
– ফিরলাম, যাতে আপনাদের জন্য ‘এই সব দিন রাত্রি’ লিখতে পারি। না ফিরলে কে লিখত?
প্রসঙ্গ পাল্টে লেখালেখি সংক্রান্ত প্রশ্ন শুরু করলাম- লেখালেখির প্রতি অনুরাগ কখন থেকে?
– বানান করে করে প্রথম গল্পটি। যেদিন পড়লাম- মনে হয় সেদিন থেকেই। তবে সুদূরে শৈশবের স্মৃতি মনে নেই। আজকে বলছি।
– প্রথম লেখা কিভাবে ছাপা হলো?
– ‘নন্দিত নরকে’ লেখা খাতাটি বন্ধু আনিস যাবেত ‘মুখপত্র’ পত্রিকার সম্পাদককে দিয়ে এলেন। সেটা ছাপা হলো। প্রথম লেখা ছাপানোর পেছনে কোনো মজার গল্প নেই। এরপর আহমেদ ছফা প্রথম বইটির জন্য প্রকাশক জোগার করলেন। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানী।
– দ্বিতীয়টা (শঙ্খনীল কারাগার)?
– প্রকাশক চেয়ে নেন।
– ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগারে’ পাত্র-পাত্রীদের নাম একই কেন?
– নতুন নাম খুঁজে পাইনি।
– ঐ দুটোর খোকা চরিত্রের সাথে লেখকের ব্যক্তিজীবনের কী সাদৃশ্য আছে?
– আমি বোধ হয় ওতো ভালো নই। তবে আমিও মাঝে মাঝে খোকার মতো হতে চাই। তা ছাড়া লেখকও খোকার মতো খানিকটা বোকা।
– এ দুটোর প্লট কী করে পেয়েছেন?
– মনে নেই। তবে আমি আগে কখনো প্লট ভেবে লিখতে বসি না।
হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, কোনো কিছু লেখার আগে কোনো দিনই তিনি প্লট সাজিয়ে লিখতে বসেন না। লিখতে লিখতেই পাত্র-পাত্রীরা এসে যায়, চরিত্র সৃষ্টি হয়, কাহিনী গড়ায়। লেখার জন্য কোনো রকম পরিবেশ কিংবা ‘মুড’-এর জন্য কোনো ধরনের উপকরণের প্রয়োজন হয় না। চাপের মুখে একটানা সাত-আট ঘণ্টা লেখার অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। তবে সাধারণত অবসর পেলেই লেখেন, আর পড়েন।
– নির্জনে লেখেন না?
– আমার একটা বড় বাড়ি হলে চেষ্টা করে দেখতাম।
– বড় বাড়ির জন্য ইচ্ছা হয় না?
– মাঝে মাঝে হয়।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পের পাত্র-পাত্রীরা মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাঁর মতে, মধ্যবিত্তদেরকেই তো ভালো করে দেখেছি। সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতায়- এর বাইরে লিখব কিভাবে?
– কেন? উচ্চবিত্ত পরিবারের প্লটেও কিছু কিছু তো লিখলেন- যেমন ‘একা একা’?
কিছু উচ্চবিত্তদেরও দেখেছি।
– গল্প, উপন্যাস ছেড়ে নাটক লিখতে এলেন কখন?
– ১৯৭৪ সনে ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটিকে মঞ্চনাটকে রূপ দিই। রেডিওর জন্য ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর বেতার নাট্যরূপ দিই ১৯৭৫-এ। টিভির জন্য প্রথম নাটক লিখি ‘প্রথম প্রহর’ ১৯৮০ সনে।
– কেন এলেন?
– টাকার জন্যে।
এরপর কথা হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘এই সব দিন রাত্রি’ নিয়ে। জানালেন যে মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের আগ্রহে এ সপ্তাহের একটি নাটককে বড় করে দেয়া হলো। সিরিজ নাটকে। দর্শক হিসেবেও তাঁর কাছে নাটকটি উপভোগ্য ছিল। তবে মাঝে মাঝে মনে হতো যে রকম চেয়েছিলেন, সে রকম হচ্ছে না।
– এরপর সিরিজ নাটক লেখার ইচ্ছা আছে?
– আর্থিক ঝামেলায় পড়লে হয়তো লিখব।
– সিনেমার জন্য কাহিনী লেখার ইচ্ছা আছে?
– যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধের উপর ভালো ছবি করতে চায় তাহলে লিখব।
হুমায়ূন আহমেদের একটা বৈশিষ্ট্য (কিংবা দোষ) যে তার বেশির ভাগ কাহিনীতেই বিশেষ কয়েকটি নাম বার বার ঘুরে ঘুরে আসে। অথচ প্রতিটি চরিত্রই স্বতন্ত্র। এটা কেন হয়- জানতে চাইলেই সহজ উত্তর দেন, ‘নতুন নাম খুঁজে পাই না’। আমার বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয় কোনো একটা কিছুকে লুকোনোর জন্যই এগিয়ে যাওয়ার মতো উত্তর। পাশে বসা তাঁর স্ত্রী জানালেন, ‘ও উপন্যাস লিখতে বসে আমাকে নাম জিজ্ঞেস করে। আমি সাথে সাথে বলতে না পারলে বলে- আমি তাহলে আগের নামটিই লিখি? এভাবেই একই নাম বার বার আসে- আসলে অন্য কিছু নয়।’
– আচ্ছা ‘নীলু’কে আপনি চেনেন?
– না।
– এ নামটা কেন বার বার আপনার গল্পে-উপন্যাসে আসে?
– নামটা সুন্দর। [এ জায়গায় তাঁর স্ত্রী জানালেন, তাঁরা যখন আমেরিকায় ছিলেন তখন পাশের বাসায় এক শ্রীলঙ্কান পরিবার থাকত- ঐ বাসায় একটি মেয়ের নাম ছিল নীলু। হুমায়ূন আহমেদ হাত দিয়ে দেখালেন- এতটুকু (চার-পাঁচ বছরের) মেয়ে]।
– নীলগঞ্জই বা কেন আসে?
– সম্ভবত নীল থেকে।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এমন অনেক উপন্যাসও লিখেছেন, যেগুলোর শিরোনামে গল্প বেরিয়েছিল অনেক আগে। অথচ উপন্যাসকেও যে গল্পের পরিবর্ধিত রূপ বলা যাবে, এমনও হয় না। তবে কেন? হুমায়ূন আহমেদের সেই একই জবাব- নতুন নাম খুঁজে পান না। তাঁর মতে, নাম দেয়ার জন্যেই দেয়া। [তাহলে কি নামকরণের সার্থকতার কথা তিনি কখনো ভাবেন না?]
– আচ্ছা, আপনি এত বেশি লেখার সময় কখনও আপনার লেখার মান সম্পর্কে সন্দিহান হন না?
– হ্যাঁ, আমি প্রচুর লিখি। আবার না লিখেও থাকতে পারি। প্রথম চারটি উপন্যাস প্রকাশের পর আমি সাত বছর কিছুই লিখিনি। আবার হয়তো একটা সময় আসবে যখন কিছুই লিখব না।
– একঘেয়ে ঠেকায় এক সময় যদি কেউ আপনার লেখা না পড়ে, তখন আপনি কী করবেন?
– কী আর করব? মন খারাপ করা ছাড়া কিছু করার আছে কি?
– আচ্ছা, আপনি লেখেন কেন?
– বলা মুশকিল, তবে লিখতে ভালো লাগে।
– অমরত্ব পাওয়ার বিন্দুমাত্র আশায়ও কি আপনি লেখেন?
– না। অমরত্ব মহাপুরুষদের জন্য। আমি মহাপুরুষ নই, সাধারণ মানুষ।
– আপনি কি নিজেকে কখনও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বলে মনে করেন?
– যখন জানলাম আমার একই বইয়ের প্রথম মুদ্রণ এক মাসে বিক্রি হয়ে গেছে। [তবে এটা হালকা ধরনের ভৌতিক উপন্যাস, গর্ব করার মতো কোনো রচনা নয়।]
– নিজের কাছে আপনার পরিচয় একজন লেখক, নাকি শিক্ষক?
– লেখক।
– উপন্যাসের শিরোনামে রবীন্দ্র-জীবনানন্দ থেকে ধার করেন কেন?
– এঁদের কাছ থেকে ধার করতে আমার লজ্জা লাগে না বলেই।
– যদি বলা হয় ‘তোমাকে’ প্রেমের উপন্যাস [কভারে লেখা আছে] হিসেবে সার্থক নয়- আপনি কী বলবেন?
– কিছু বলব না।
– আচ্ছা, একটু অন্য ধরনের প্রশ্ন- ‘প্রেম’ ছাড়া ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব হতে পারে?
– পারবে না কেন?
– দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ের মধ্যে যে রকম বন্ধুত্ব হয়- একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যেও কি একই রকম বন্ধুত্ব হতে পারে?
– তা অবশ্য নয়, কারণ এখানে ফ্রয়েডীয় কিছু ব্যাপারস্যাপার আছে।
– তাহলে যে বললেন…
– আসলে ব্যাপারটা একটু জটিল। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।
– আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কোনটা?
– তিনটে উপন্যাস লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়াটা আমার কাছে একটা স্মরণীয় ঘটনা। না, না, এটা লিখবেন না, তাহলে লোকজন মনে করতে পারে আমার গর্ব হচ্ছে- লিখুন গুলতেকিন (স্ত্রী)-এর সঙ্গে পরিচয়।
– দুঃখজনক ঘটনা?
– বাবার মৃত্যু।
এরপর কিছুক্ষণ আপ্যায়ন পর্ব সেরে আবার শুরু হলো। সাহিত্যবিষয়ক কিছু কথাবার্তা শুরু হলো।
– বাংলা সাহিত্যে কার কার লেখা আপনার প্রিয়?
– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর, বিমল কর, সতীনাথ ভাঁদুড়ি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
– শংকরকে কেমন লাগে?
– ভালো। ওঁর প্রথম দিকের কিছু উপন্যাস খুবই ভালো।
– বাংলা সাহিত্য ছাড়া বিদেশি কোনো সাহিত্য পড়েন কি? প্রিয় কে?
– এক সময় প্রচুর পড়েছি। এখনো পড়ি। প্রিয় হচ্ছেন- জন স্টেইন-বেক। রেমাক।
– বড় গল্প আর উপন্যাসের মধ্যে একটু অন্য রকম প্রশ্ন করলাম- আপনার মতে, পার্থক্য কোথায়?
– জানি না।
– ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর মুখবন্ধে ‘নন্দিত নরকে’ ‘গল্প’ বলে উল্লেখ করলেন- অথচ এটা ‘উপন্যাস’ হিসেবে বিবেচিত এবং পুরস্কৃত- তাহলে ‘গল্প’ বলেন কেন?
– আমাকে এসব জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। এ জাতীয় প্রশ্ন করা উচিত সাহিত্যের ছাত্রকে। আমি একবার একটি বইয়ের সমালোচনা লিখেছিলাম ‘রোববার’ পত্রিকায়। পরে সবাই সেটাকে গল্প বলতে লাগল এবং আমিও আমার গল্পগ্রন্থে (আনন্দ বেদনার কাব্য) ঢুকিয়ে দিলাম।
– আপনাকে যদি উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে বলা হয় তাহলে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
– কোনোভাবেই করব না। আমি যদি জানতাম উপন্যাস কী, তাহলে তো নিজেই লিখতাম, যা লিখেছি তার কোনোটিই কি সত্যিকার অর্থে উপন্যাস হয়েছে?
– ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখার কোনো পরিকল্পনা আছে?
– হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের উপর বৃহৎ ক্যানভাসে একটা উপন্যাস লিখব- এবং এ জন্য আমি পড়াশোনাও করছি।
– বঙ্কিম, শরৎ থেকে বর্তমান কালের উপন্যাসগুলোর ধারা অনেকখানি পরিবর্তিত- এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
– সময়ের প্রভাব। উপন্যাস তো সময়েরই ছবি। সময় বদলালে উপন্যাস বদলাবে।
– উপন্যাস সৃষ্টিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা কতটুকু প্রয়োজনীয় বলে আপনি মনে করেন?
– অনেকখানি।
– একটা সার্থক উপন্যাসে কী কী গুণাবলি থাকা আবশ্যক?
– একটা সার্থক উপন্যাসে সমাজ ও কাল উঠে আসবে। লেখক একটি দর্শন দিতে চেষ্টা করবেন। উপন্যাস মানে তো শুধু গল্প নয়। গল্পের বাইরেও কিছু।
– সুন্দর গল্পের জন্য সুন্দর কাহিনীই কি অত্যাবশ্যকীয়?
– না।
– আচ্ছা, সাহিত্য দিয়ে সমাজসংস্কার কিভাবে করা যায়?
– জানি না। আমি নিজে সমাজসংস্কারের কথা ভেবে কিছু লিখি না।
– যখন লেখেন, তখন আপনি কোন শ্রেণীর পাঠকের কথা বিবেচনা করেন?
– সায়েন্স ফিকশনগুলি কম বয়েসী পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে লেখা। অন্যসব যখন লিখি তখন কোন শ্রেণীর পাঠকদের জন্য লিখছি তা মনে থাকে না। যাদের ইচ্ছা হয় পড়বে।
– আপনার লেখায় রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য দেখা যায় না কেন?
– এখন থেকে দেখতে পারবেন।
– তার মানে রাজনীতি আসবে?
– হু।
মাথা নাড়েন হুমায়ূন আহমেদ।
– এটা কী ধরনের হতে পারে?
– আগেভাগে কিছু বলতে চাই না।
– এত দিন না আসার কারণ?
– এত দিন আমার ঝোঁক ছিল গল্প বলার দিকে। যে সমাজ, যে কাল এই গল্প তৈরি করেছে, তাকে অবহেলা করেছি। মনে হয়েছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখই সব।
– আপনি কি মনে করেন যে প্রতিটি মানুষেরই রাজনীতি করা উচিত?
– অফ কোর্স। ইটস এ পার্ট অব আওয়ার লাইফ।
– ব্যক্তিগতভাবে আপনি কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী?
– আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষের অধিকার সমান।
ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বিষয়ক কথাও হলো কিছুটা।
– বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের মধ্যে কে আপনার প্রিয়?
– ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকার।
– প্রিয় ঔপন্যাসিক?
– সৈয়দ হক। শওকত ওসমান। শওকত আলী।
– কবি?
– শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ।
– নাট্যকার?
– হুমায়ূন আহমেদ।
– কবিতা?
– জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগে একদিন’।
– নাটক?
– নৃপতি (নিজের লেখা- ফেব্রুয়ারিতে প্রথম মঞ্চস্থ হবে)।
– ‘বাবা’ আপনার উপন্যাসে আসেনি?
– ‘বাবা’ আমার গল্প-উপন্যাসে অনেকবার, অনেকভাবে এসেছেন (শঙ্খনীল কারাগার)।
– সে হিসাবে মা কিন্তু কম আসেন…
– সম্ভবত আপনার কথা সত্যি নয়।
সব শেষে আহমেদকে প্রশ্ন করেছিলাম, নতুন লেখকদের জন্য আপনি কিছু বলুন।
– নতুন লেখকদের জন্য আমার একটাই কথা- পড়তে হবে, প্রচুর পড়তে হবে- সব লেখকের লেখা পড়তে হবে। তাতে ভাষার ওপর দখল আসবে- কোন লেখক কিভাবে চরিত্রগুলো নিয়ে ‘ট্রিট’ করছেন, সেটাও পরিষ্কার হবে। আবার চোখ-কানও খোলা রাখা দরকার। যেমন কোন পেশার লোক কিভাবে কথা বলে, কিভাবে হাঁটে-চলে এসবও দেখতে হবে। তা ছাড়া কবিতা পড়া থাকলে বোধ হয় ভাষার প্রতি দখলটা তাড়াতাড়ি আসে।
আমরা হুমায়ূন আহমেদকে ছেড়ে তাঁর মার সাথে কথা বলতে চাইলাম। মাকে পাঠিয়ে নিজে ভেতরে গেলেন। বেশ বর্ষিয়সী মহিলা, স্বাস্থ্যবান। সাদা কাপড়ের লাল ডোরার শাড়ি পড়ে আমাদের পাশে এসে বসেন। গল্প শুরু করলাম মিসেস আয়েশা আক্তারের সাথে।
– আপনার ছেলেমেয়েরা কে কী করেন?
– বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ। মেজ ছেলে জাফর ইকবাল- আমেরিকায় পোস্ট ডক্টরেট করছে, সে বাচ্চাদের জন্য লেখে, তিনটা বই বেরিয়েছে। ছোট আহসান হাবীব- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে এমএসসি পাস করেছে এবার। সে আবার ভালো কার্টুন আঁকে- উন্মাদ না কি যে কার্টুন পত্রিকা- এটার সহকারী সম্পাদক সে। বড় মেয়ে সুফিয়া হায়দার- পিরোজপুর মহিলা কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা, ওর হাজব্যান্ড উকিল। মেজ মেয়ে বিএসসি পাস করে ঢাকায় আছে, ওর হাজব্যান্ড মেজর। ছোট মেয়ে- রোকসানা আহমেদও খুব ভালো ছবি আঁকে- শংকর পুরস্কার পেয়েছে। ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে, ডিফ অ্যান্ড ডাম্প স্কুলে- ও আবার বোবা, কথা বলতে পারে না।
– আপনার সব ছেলেমেয়েই প্রতিভাবান এবং সমাজে সুপরিচিত- এ জন্য আপনার কি গর্ব হয়?
– অবশ্যই।
– এঁদের এ সাফল্যের পেছনে আপনার কী অবদান আছে বলে মনে করেন?
– না, আমার কোনো অবদান নেই। ওরাই ওদের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে।
– আচ্ছা, আপনার বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ ছোটবেলায় কেমন ছিলেন?
– ও খুব চালাক ছিল। কথা বলত বুড়ো লোকের মতো এবং সে বুঝতও অনেক বেশি। তা ছাড়া লেখাপড়ায় ও অত্যন্ত ভালো ছিল। ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছিল, ম্যাট্রিকে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছিল। ওর বাবা ওর সব কাগজপত্র জমিয়ে রাখতেন ফাইলের ভেতর। যে কাগজগুলোতে ওর ছবি উঠেছিল, ওর নাম উঠেছিল সে কাগজগুলো আমার কাছে এখনও আছে। ওর বাবা বলতেন, ওগুলো আলমারির মধ্যে যত্ন করে রেখো, তোমার ছেলে একদিন খুব বিখ্যাত হবে, তখন কাগজের লোকরা এসব খুঁজতে আসবে।
– হুমায়ূন আহমেদ যে একদিন লেখকই হবেন- এটা আপনারা বুঝতে পেরেছিলেন?
– ওর বাবা বুঝেছিলেন।
– কিভাবে?
– ও তখন ঢাকায় চলে এসেছে- মহসীন হলের ছাত্র। একবার একটা উপন্যাস লিখে আনল। সম্ভবত ‘শঙ্খনীল কারাগার’। বাসার সবাই আমরা পড়লাম- কিন্তু তার বাবাকে পড়ানোর সাহস তার ছিল না। একদিন আমাকে দিয়ে সে লেখাটি তার বাবার কাছে পাঠাল। তারপর- আমার পাশ দিয়ে শুধু ঘুর ঘুর করে অর্থাৎ জানতে চায় তার বাপ এটা পড়ে কি বললেন। এ রকম দু-এক দিন যাবার পর এক রাতে সবাই যখন শুয়ে গেছে তখন তার বাবা তাকে ডাকলেন। খুব ভয়ে ভয়ে সে গেল। আমিও তখন ছিলাম। তার বাপ পাণ্ডুলিপিটা তার হাতে দিয়ে বললেন- ‘এটা যত্ন করে রেখে দিস। তুই একদিন খুব নামকরা লেখক হবি।’
– তাঁর বাবা কি তাঁর প্রকাশিত কোনো লেখা পড়েছেন?
– না, উনি তো একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হলেন।
– হুমায়ূন আহমেদের লেখা আপনার কেমন লাগে?
– খুব ভালো। মনেই হয় না যে এটা ও লিখেছে। মনে হয় অন্য কেউ সম্ভবত।
– কোনোটা খারাপ লাগেনি?
– না।
– আচ্ছা, তাঁর কোন গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটকের ‘মা’-এর চরিত্রে আপনার চরিত্র কিংবা তার খণ্ডাংশ এসেছে বলে আপনার মনে হয়?
– কি জানি (হেসে)। আমার চরিত্র তো আমি বুঝতে পারি না, তবে ‘এই সব দিন রাত্রি’র সেই মা নাকি আমি- তো এটা অনেকেই বলেন। আমার তো মনে হয় না।
– আপনার চোখে হুমায়ূন আহমেদকে কী মনে হয়- একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নাকি লেখক?
– লেখকটাই বেশি।
– তাঁর চরিত্রে একটা দোষের কথা বলুন।
– সে রাগে খুব বেশি। আবার রাগ থাকেও না বেশি সময়।
– তাঁর ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলুন।
– আমরা তখন সিলেট মীরাবাজারে ছিলাম। আমাদের বাসার পাশেই ছিল গরুর ঘর। একদিন রাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে কি- মা, শুনে যাও, গরুরা কথা বলে। সে কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে বলে যে গরুর কথা সে শোনে- এটা ওর পাগলামি, না অন্য কিছু, কিছুই বোঝা যায় না।
– আপনার সব ছেলেমেয়ের উপর কি আপনি সন্তুষ্ট?
– অবশ্যই।
স্ত্রীর সাথে হুমায়ূন আহমেদই সুযোগ দিলেন কথা বলার। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়ার পর ক্লাস এইটের ছাত্রী গুলতেকিন আহমেদ একটা চিঠি লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ প্রভাষক হুমায়ূন আহমেদের কাছে। এরপর দেখা হয়। যোগাযোগ বাড়ে। ঘনিষ্ঠতার পরিণতিতে গুলতেকিন ১৯৭৬ সালে এসএসসি পাস করার পর হুমায়ূন আহমেদের ঘরণী হয়ে আসেন। তিন মেয়ে নোভা, শিলা আর বিপাশার মা- নিজেই মেয়েদের দায়িত্ব নেন। এদের নিয়ে তাঁর কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। যে যা হতে পারে হবে।
তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম- আচ্ছা, আপনি বিয়ের আগে যখন হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরক’ কিংবা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়লেন তখন কি ও দুটোকে লেখকের আত্মজীবনীমূলক কিছু বলে মনে করতেন?
– কিছুটা মনে হতো।
– নন্দিত নরকের ‘খোশ’ নিভৃতভাবে একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসা সে কোনো দিন মেয়েটিকে জানাবার সাহস পায়নি- তার ভালোবাসা আজীবন নিভৃতেই থেকে গেল। আচ্ছা সেই খোকাটির জন্য কি এখন আমার দুঃখ হতো? (হুমায়ূন আহমেদ তখন মিটমিট করে হাসছেন)
– তা তো হতো।
– বিয়ের পরও যদি কোনো নায়িকার প্রতি লেখকের অতিরিক্ত অনুভূতি দেখা দিত- আপনি কী করতেন?
– ওটা তো গল্পই। আর সত্যি সত্যি সে কিছু করলে তো খারাপ লাগতই।
– আচ্ছা, তাঁর (হুমায়ূন আহমেদের) কোনো এক গল্প-উপন্যাসে আপনার কোনো চরিত্র এসেছিল?
– খণ্ড খণ্ড এসেছে, পুরোপুরিভাবে নয়। [হুমায়ূন আহমেদ জবাব দিলেন, ‘এই সব দিন রাত্রি’তে নীলুর চরিত্রের সাথে ওর অনেক মিল ছিল]
– আচ্ছা, লেখালেখির ব্যাপারে আপনি হুমায়ূন আহমেদকে কিভাবে সহযোগিতা করেন?
– কখনো চা বানিয়ে দিই। তা ছাড়া ও লেখার সময় প্রচুর বানান ভুল করে, সেগুলোও ঠিক করে দিই।
– তাঁকে নিয়ে আপনার গর্ব হয়?
– কিছুটা তো হয়ই।
– আচ্ছা, মনে করুন একদিন এমন হলো যে তাঁর লেখা কেউ আর পড়ছে না- তখন আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হবে?
– তখন যদি ও লেখা ছেড়ে সংসারের দিকে কিছুটা মন দেয়, তাহলে ভালোই হবে।
– একজন পাঠক হিসেবে তাঁর লেখা আপনার কেমন লাগে?
– ওর লেখা আমার সব সময়ই ভালো লাগে।
হুমায়ূন আহমেদ প্রচুর চা খান। দুবার চা খাওয়ালেন আমাদের। বিদায় নিয়ে আসার সময় বাবুকে আর আমাকে তাঁর দুটো সর্বশেষ প্রকাশিত বই (প্রথম প্রহরে) উপহার দিলেন। হাঁটতে হাঁটতেও কথা হলো কিছুটা। বললেন, উপন্যাস লেখার ব্যাপারে তিনি যেসব এঙ্পিরিমেন্ট চালিয়েছেন, এর সবটিই সার্থক। এ টেকনিক আবার সবাই ধরতে পারবেন না। যাঁরা উপন্যাস লেখেন, কেবল তাঁরাই পারবেন।
হুমায়ূন আহমেদ এখন ‘এই সব দিন রাত্রি’ নিয়ে উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত। প্রতিদিন বিশ পৃষ্ঠা লেখেন আর বিশ পৃষ্ঠা প্রেসে দেন।
হাঁটতে হাঁটতে এক সময় একটা রাস্তা দুদিকে চলে গেল। অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিতে বিদায় দিয়ে আমাদের অনিন্দ্য প্রকাশনীর পথ ধরলেন তিনি। আমরাও রিকশা খুঁজতে ব্যস্ত হলাম। চোখের আড়াল হতে হতে হুমায়ূন আহমেদকে ভালো করে আবার দেখে নিলাম। আমার ভেতরে তখন নজরুল ইসলামের গান বাজছে-
– ‘তুমি কেমন করে গান কর হে কবি?’
এতক্ষণে লেখক শিবির পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, অলঞ্চ সাহিত্য পুরস্কার আর ওসমানী স্মৃতি পদক প্রাপ্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় (বর্তমানে) ঔপন্যাসিক অদৃশ্য হয়ে গেছেন।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সময়ের অভাবনীয় এক জনপ্রিয় লেখকের নাম৷ কথাসাহিত্যে তার প্রতিভার বিসত্মার ঘটলেও, তিনি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে৷ তারপর নাটক, ছোটদের জন্য লেখা, সাইন্সফিকশন, চলচ্চিত্র পরিচালনা- শিল্প-সাহিত্যের এমনি নানা বিষয়ে হাত দিয়েছেন এবং প্রতিটি ৰেত্রে ছাপ রেখেছেন অনন্যতার৷ এই অভাবনীয় জনপ্রিয় লেখকের সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতা ঘটে আরেক জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন-এর৷ সেই দীর্ঘ আলাপচারিতার উলেস্নখযোগ্য অংশ ‘ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকী’র পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলো৷ ষাটতম জন্মদিনের প্রাক্কালে প্রকাশিত এই সাক্ষাত্কারটি পাঠকদের আরো আন্তরিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে চিনতে সহায়তা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ইমদাদুল হক মিলন: আপনি লেখক৷ তাই লেখালেখি দিয়েই শুরম্ন করা ভাল৷ আপনার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ লেখা কি একেবারেই আচমকা? এর আগে আপনি কি কিছু লিখেছেন কখনো?
হুমায়ূন আহমেদ: কবিতা লিখেছি৷ দৈনিক পাকিসত্মান পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে৷ তবে নিজের নামে লিখি নি৷ কবিতাগুলি আমার ছোটবোন মমতাজ আহমেদ শিখুর নামে পাঠাতাম৷ তার নামেই ছাপা হতো৷
মিলন: উপন্যাসে আসার ঘটনাগুলো বলেন- এই ধরেন- কীভাবে শুরম্ন, কীভাবে আইডিয়াটা এলো মাথায়ঃ
হুমায়ূন আহমেদ: প্রথমে তো আমি লিখলাম ‘শঙ্খনীল কারাগার’৷ যদিও প্রথমে এটা ছাপা হয়নি, কিন্তু উপন্যাস প্রথমে লেখা হয়েছিল ‘শঙ্খনীল কারাগার’৷ কিছুই করার ছিল না সেই সময়৷ আমার ঠিকমতো মনেও নেই৷ তবে এই উপন্যাসটা আমার বাবা পড়েছেন- এটা আমার জন্যে খুবই আনন্দের একটা ঘটনা৷
মিলন: মানে আপনার হাতে লেখা কপিটাই পড়েছেন ?
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ৷
মিলন: পড়ে কী বললেন ?
হুমায়ূন আহমেদ: আমাকে কিছু বললেন না৷ বাবার সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের দূরত্ব ছিল৷ বাবা সরাসরি আমাদের কিছু বলতেন না৷ ভায়া মিডিয়া কথা বলতেন৷ তাঁর যা বলার তিনি মা’কে বলতেন৷ মা আমাদের বলতেন৷
মিলন: তিনি আপনার মা’কে কী বললেন ?
হুমায়ূন আহমেদ: পৃথিবীর সমসত্ম পিতাই সনত্মানদের সামান্য প্রতিভাতেই মুগ্ধ হন৷ তিনিও হয়েছিলেন৷ তাঁর মুগ্ধতা যে উঁচু পর্যায়ে ছিল তার প্রমাণ পেলাম কিছুদিন পর৷ উনি তখন একটা রেডিও নাটক লিখে শেষ করেছেন৷ নাম ‘কত তারা আকাশে’৷ হঠাত্ সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বললেন- তুই তোর মতো করে ঠিকঠাক করে দে৷ আমি আমার এক জীবনে অনেক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি- ঐ দিনের সাহিত্য পুরস্কার সব পুরস্কারের উপরে৷
ইমদাদুল হক মিলন: আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন ‘৮৪-এর দিকে বোধহয় ? তার আগে, মাত্র চারটা বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন৷ এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা৷ আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হবার কথা ভাবলেন কী করে?
হুমায়ূন আহমেদ: হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সবসময়৷ যদি ভেতরে থাকে তাহলে ‘লেখালেখি’ বিষয়টা মাথার গভীরে একধরনের চাপ দিতেই থাকে৷ এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে৷ দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি৷ আবার আমি যে একজন লেখকও, ঐটাও তো মাথায় ছিল৷
মিলন: লেখালেখির ৰেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বসত্মি তৈরি হয়৷ আপনার সে অস্বসত্মিটা কি তৈরি হয়েছিল যে, এতদিন পরে আমি আবার শুরম্ন করলাম!
হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে মনে করতে পারছি না৷ মনে হয় না ছিল৷ কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা লেখালেখি করে, তারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না৷ অনেকদিন লিখিনি তাতে কি হয়েছে? আবার লিখব৷ ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব৷
মিলন: কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল নাকি আসত্মে আসত্মেঃ?
হুমায়ূন আহমেদ: না, আমার মনে হয় এটা শুরম্ন থেকেই ছিল৷ মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো৷ কিছু কিছু লেখার ৰেত্রে খুবই চিনত্মা-ভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে৷ একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্যে অপেৰা করতে হয়েছে৷ দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না৷ এই অবস্থা৷
মিলন: এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পরে একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন৷ তারপর ‘৮৫-তে আপনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শুরম্ন করেছিলেন৷ একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, এর পেছনে রহস্যটা কি বলে আপনার মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ: এই অবস্থা যে তৈরি হয়েছিল, এই বিষয়টার একটা নরমাল আর একটা আধিভৌতিক ব্যাখ্যা আছে৷
মিলন: আপনি বলেন- আমরা দুটোই শুনি৷
হুমায়ূন আহমেদ: নরমাল ব্যাখ্যা হলো- আমি নাটক লেখা শুরম্ন করলাম৷ আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি৷ ‘এইসব দিনরাত্রি’ বহু লোক দেখা শুরম্ন করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরম্ন করল৷ পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হবার পেছনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা৷ একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে- এটা তো হবার কথা না৷ আমার ধারণা আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে- এটা হতে পারে৷ আর আধিভৌতিক ব্যাখ্যা যেটা হলো- শহীদুলস্নাহ হলে যখন থাকি, তখন একসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকে আমি হঠাত্ কিছু বড় অংকের টাকা পেয়ে গেলাম৷ ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ সেই সময় ২৫-৩০ হাজার টাকা অনেক টাকা৷ বই বিক্রির টাকা৷ তখনো বই লেখা বাবদ অ্যাডভান্স দেয়া শুরম্ন হয়নি৷ যেহেতু টাকা পেয়েছি, আমার খুব হাত উশখুশ করছিল টাকাটা খরচ করার জন্য৷ কাজেই করলাম কী গুলতেকিন এবং বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়াতে৷ এই টাকা শেষ না হওয়া পর্যনত্ম দেশ ভ্রমণ হবে এই হলো পরিকল্পনা৷ প্রথমে গেলাম নেপালে, নেপাল থেকে দিলিস্ন৷ ভাবলাম এত কাছে যখন এলাম মরম্নভূমি দেখে যাই৷ জয়সলমীরের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম৷ জয়সলমীরের পথে পড়লো আজমীর শরীফ৷ এত নাম শুনেছি- পথে যখন পড়লই তখন ভাবলাম যে, আজমীর শরীফ দেখে যাই৷ আজমীর শরীফ গেলাম৷ আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি, বিপাশা, সে খুবই বিরক্ত হয়ে গেল; বলল- কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির৷ ফকিরে ভর্তি জায়গাটি৷ বিপাশার বয়স তখন তিন সাড়ে তিন; আমি তাকে বোঝালাম যে, এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে৷ এখানে এলে আলস্নাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়৷ দেখা গেল যে, এই কথা শুনে মানসিকভাবে সে স্বসত্মি বোধ করলো৷ তখন তাকে নিয়ে গেলাম কবর জিয়ারত করতে, জিয়ারত শেষ করে চলে আসবো, দেখি বিপাশা দাঁড়িয়ে৷ ব্যাপার কী? বিপাশা বলল, আমি যেটা চেয়েছি সেটা তো পাইনি৷ না পেলে যাব না৷ আমি বললাম, মা, তুমি কী চেয়েছ? বিপাশা বলল, আলস্নাহর কাছে আমি এক হাজার বসত্মা টাকা চেয়েছি৷ এই টাকা না পাওয়া পর্যনত্ম এখান থেকে আমি যাব না৷ করবস্থানের পাশে রেলিংটা ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ আমি ও তার মা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম৷ না, সে এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না৷ এদিকে বাংলাভাষাভাষী কিছু লোক ছিল, তারা খুবই মজা পেয়ে গেল৷ একটি মেয়ে এক হাজার বসত্মা টাকা আলস্নাহর কাছে চাইছে, না পাওয়া পর্যনত্ম সে যাবে না- এটা তো মজার বিষয়ই৷ তখন বিপাশাকে বোঝালাম যে, এখন টাকাটা পেলে বরং সমস্যা হবে৷ এতগুলো টাকা দেশে নিয়ে যেতে হবে৷ কান্নাকাটি না করে চলো দেশে যাই৷ দেশে গেলে টাকাটা পেয়ে যাবে৷ অবশ্যই পাবে৷ আমরা দেশে ফিরে এলাম৷ আসার পর পরই জলের মতো হুহু করে টাকা আসতে লাগল৷ কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে লেখালেখি করে বিপুল অর্থ উপার্জন আপনি কীভাবে করলেন? আমি বলি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশার কারণে করেছি- এখানে আমার কোনো হাত নেই৷
মিলন: আপনি তো বহু বিষয়ে ইন্টারেস্টেড৷ এর মধ্যে আপনার একটি খুব প্রিয় বিষয় হচ্ছে ভূত এবং বহু স্মরণীয় ভূতের গল্প লিখেছেন আপনি৷ আপনার ছোট ছোট অনেক অভিজ্ঞতার কথা জানি আমরা৷ এই ভূত ব্যাপারটা নিয়ে আপনার বিশ্বাসটা কি?
হুমায়ূন আহমেদ: বিশ্বাসটা হলো- আমি মনে করি না ভূত বলে কিছু আছে৷ ভূত না থাকলেও ভূতের ভয় আছে৷ ভূতের ভয় আছে বলেই ভূতের গল্প আছে৷
মিলন: তাহলে কী বলব? আপনি বানিয়ে বানিয়ে লিখেন?
হুমায়ূন আহমেদ: গল্প-উপন্যাস মানেই কি বানানো বিষয় না ? গল্প-উপন্যাস তো ইতিহাস না৷ তারপরেও কিছু কিছু ব্যাপার ঘটেও যায়৷
মিলন: আপনি লেখালেখির শুরম্নর দিকে কবিতা লিখেছেন, আপনার বোনের নামে সেগুলো ছাপা হয়েছে এবং হুমায়ূন আহমেদ নামেও একটি কবিতার কার্ড ছাপা হয়েছে৷ তাতে কি আপনার কবিতার প্রতি তীব্র টান প্রকাশিত হয় না?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি একটি উপন্যাস লিখেছি৷ নাম ‘কবি’৷ তারাশঙ্করও এই নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন- বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি একটি৷ সেইখানে আমার মতো একজন লেখকের আরেকজন কবিকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ব্যাপারটি কি দুঃসাহসিক নয়? তারাশঙ্করের কবি ছিলেন সেই সময়ের কবি, আর আমার কবি হচ্ছে আজকের কবি৷ তাদের জীবনবোধ, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে৷ তারাশঙ্করের কবি ছিল অতিদরিদ্র, আমার কবিও অতিদরিদ্র৷ দু’জনের মধ্যেই কাব্য প্রতিভা আছে৷ এই জিনিসটাকে নিয়েই লেখালেখির চেষ্টা করেছিলাম আর কি৷ তো এই উপন্যাসের জন্যেই কবিতার দরকার পড়ল৷ কাকে বলবো? ভাবলাম আমিই লিখি৷ একইভাবে আমার একটি টিভি সিরিয়ালে গ্রাম্য গায়কের কিছু গানের দরকার ছিল৷ নাটকের গান তো, সিকোয়েন্স অনুযায়ী লিখতে হয়, কাকে দিয়ে গান লেখাবো? নিজেই লিখলাম৷ দায়ে পড়ে আর কি! আমি হলাম দায়ে পড়ে কবি, দায়ে পড়ে গীতিকার৷
মিলন: ‘কবি’ উপন্যাসে যে টুকরো টুকরো কবিতার লাইন ব্যবহার করেছেন বা আপনার প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এ যে কবিতার লাইনগুলো রয়েছে- ‘দিতে পারো একশ’ ফানুস এনে/ আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে ফানুস ওড়াই৷’ এটা একজন কবির লেখা কবিতা- তা আপনি যতই ঠাট্টা-তামাশা করম্নন না কেন! কবিতার ছন্দ, শব্দের ব্যবহার এসব নিয়েও আপনি অনেক ভেবেছেন৷ এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: না, আমি কোনো ব্যাখ্যায় যেতে চাচ্ছি না৷ আমি নিজেকে একজন গল্পকার মনে করি এবং গল্পকার পরিচয়েই আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি৷ কবিতাকে বলা হয় সাহিত্যের ফাইনেস্ট ফর্ম৷ এই ফাইনেস্ট ফর্মে কাজ করার ৰমতা আমার নেই৷ গদ্যটা হয়তো খানিকটা লিখতে পারি৷ কবিতা নিয়ে মাঝে মাঝে একটু চেষ্টা চলতে পারে, তাই বলে নিজেকে কখনোই আমি কবি বলি না৷ সেই প্রতিভাও আমার নেই৷
মিলন: স্বাধীনতাউত্তর সময়ে এদেশের সাহিত্যের দুটি শাখা খুবই ডেভেলপড্- কবিতা ও মঞ্চনাটক৷ এদেশের কবিদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
হুমায়ূন আহমেদ: বাংলাদেশের সাহিত্যে যারা কবিতা লিখছেন- আগে যারা লিখেছেন, এখন যারা লিখছেন- তাদের কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই৷ বাংলাদেশ কবির দেশ৷
মিলন: দু’চারজন পছন্দের কবির কথা কি বলবেন?
হুমায়ূন আহমেদ: আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে অনেকেই আছেন- শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ আছেন৷ এছাড়া রয়েছেন আল মাহমুদ- এখন তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস কবিতাকে কতখানি ৰতিগ্রসত্ম করেছে, সেই প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছি না৷
ইমদাদুল হক মিলন: সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
হুমায়ূন আহমেদ: কবিতার চেয়ে তাঁর গদ্য আমার বেশি পছন্দ, তার পরেও তিনি যে কবি সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই৷
মিলন: আপাতদৃষ্টিতে আপনি একজন গম্ভীর মানুষ৷ আপনার সঙ্গে কিছুৰণ মেশার পর বোঝা যায়, আপনি অসম্ভব একজন ঠাট্টা প্রিয় মানুষ৷ আপনি ঠাট্টা করেন, মজা করেন, চমত্কার গল্প বলতে পারেন৷ এই গুণগুলি কি আপনার ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদ: আমাদের ভাই-বোনদের প্রত্যেকেই খুবই গল্পবাজ৷ আমার মাও গল্প করতে খুবই পছন্দ করেন৷ আমার বাবাও গল্প-গুজব করতে পছন্দ করতেন৷ ব্যাপারটা হয়তোবা জিনের মাধ্যমে এসেছে, জেনেটিক্যালি এসেছে৷ আর গম্ভীর টাইপের মানুষ যেটা বলেছো, আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছি, ২০ বা ২১ বছরের মতো, অধ্যাপকদের মুখে তো সবসময় একটা আলাদা ভাব তৈরি করে রাখতে হয়৷ কিছুৰণের মধ্যেই সেই চামড়াটা ফেলে দিয়ে অরিজিন্যাল হুমায়ূন আহমেদ যখন বেরিয়ে আসে, তখন মনে হয় লোকটা খারাপ না৷
মিলন: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন কতদিন? ঐ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? শিৰক হিসেবে আপনি কেমন জনপ্রিয় ছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি অধ্যাপনা করেছি প্রায় কুড়ি বছরের মতো৷ আমি জনপ্রিয় ছিলাম কি না, এটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল৷ আমার কোনো ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া গেলে ওদেরকে জিজ্ঞেস করলে ওরা হয়তো বলতে পারত৷ আসলে হয়েছিল কী, আমি শেষের দিকে এমন একটা সাবজেক্ট পড়াতাম যেটা ছিল খুবই জটিল৷ সাবজেক্টটা হচ্ছে, কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি৷ যে সমসত্ম শিৰক এই সাবজেক্ট পড়ান তারা ছাত্রদের কাছে খুব দ্রম্নত আন-পপুলার হয়ে যান৷ কারণ এ ধরনের সাবজেক্ট খুব অ্যাবস্ট্রাক্ট৷ সাবজেক্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট হওয়ায় কোনো ধরনের মেন্টাল ছবি দাঁড় করানো যায় না৷ অংকের সাহায্যে জিনিসটা বুঝতে হয়৷ আর এমনিতেই তো আমাদের কেমিস্ট্রির ছাত্রদের মেথমেটিক্স জ্ঞানটা একটু কম থাকে অর্থাত্ সেইভাবে জোরালো জ্ঞান মেথমেটিক্সের ওপর থাকে না৷ বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই বুঝতে পারে না, কী পড়ানো হচ্ছে৷ যখন বুঝতে পারে না তখন সাবজেক্টটার ওপর একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়৷ যিনি পড়াচ্ছেন তার প্রতিও বিতৃষ্ণা তৈরি হয়৷ এই জিনিসটা আমার ৰেত্রে ঘটেছে কিনা আমি বলতে পারব না৷ আমি খুবই চেষ্টা করেছি, যতটা সম্ভব সহজভাবে এই অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিসটি বোঝানোর৷ আমার কাছে মনে হয়, হয়তোবা পেরেছি৷ আমার দিক থেকে এই জটিল বিষয় তাদের বুঝানোর চেষ্টায় খাদ ছিল না৷ আমি যখন দেখলাম কোয়ান্টাম মেথড ওরা বুঝতে পারছে না, আমি তখন এই বিষয়ে একটি বই লিখে ফেললাম বাংলায়৷ আমি এই বইয়ে যতটা পারি সহজভাবে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছি৷ মিলন: আমার মনে আছে, এই বই বেরিয়েছিল কাকলী প্রকাশনী থেকে৷ ওরকম বই বাংলা ভাষায় আপনার আগে কেউ লিখে নি, এই তথ্যটা কি আপনি জানেন?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি সেটা জানি না৷ অতি জটিল একটা বিষয় নিয়ে বাংলায় মজা করে লেখার চেষ্টা করেছি৷ অনেকেই সায়েন্সফিকশন মনে করে এই বই কিনে নিয়ে ধরা খেয়েছে৷
মিলন: এই বইটি কি আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সেইভাবে পপুলার হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি যতদিন ক্লাস নিয়েছি ততদিন তারা এই বইটি পড়েছে৷
মিলন: আপনি এমন একটি দুরূহ বিষয়ের টিচার হবার পরও এত জনপ্রিয় একজন লেখক হয়ে গেলেন, এই বিষয়ে আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ বা প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
হুমায়ূন আহমেদ: আমার প্রতি আগ্রহ তাদের বেশ ভালোই ছিল৷ রসায়ন অনার্স ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী কম, হঠাত্ দেখি আমার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী বেশি বেশি লাগছে৷ ছাত্রসংখ্যা বড় জোর ৩০ হলেও, দেখা যেত উপস্থিত আছে ৪২/৪৩ জন৷ দেখা গেল, এরা কেমিস্ট্রির ছাত্র না৷ কেউ জিওগ্রাফির, কেউ সয়েল সায়েন্সের, আবার দেখা গেল কেউ কেউ এসেছে আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে৷ ওরা এসেছে জাস্ট দেখার জন্য, এই লেখক মানুষটি কীভাবে ক্লাস নেয়৷ এটি যখন মোটামুটি জানাজানি হয়ে গেল তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে বলা হলো, আমি যেন আমার ক্লাসে বাইরের কাউকে এলাউ না করি৷ কাজেই পরবর্তীতে ক্লাস নেবার শুরম্নতে দেখে নিতে হতো, ক্লাসের ছাত্র কারা আর ক্লাসের বাইরের ছাত্র কারা৷
মিলন: ছোটদের জন্য লেখালেখি নিয়ে আপনার ভাবনা কী? প্রথম ছোটদের জন্য কবে থেকে লেখা শুরম্ন করেন?
হুমায়ূন আহমেদ: প্রথম লেখাটা বোধহয় ‘নীল হাতি’৷ কবে বের হয়েছিল সেটা ঠিকঠাক বলতে পারব না৷ অবজারভার গ্রম্নপ বাচ্চাদের জন্য একটা পত্রিকা বের করেছিল৷ পত্রিকাটির নাম বোধহয় ‘কিশোর বাংলা’৷ ওটার প্রথম সংখ্যার জন্য লেখাটা দিলাম৷ ভয়ে ভয়ে ছিলাম, বাচ্চাদের জন্য প্রথম লেখা তোঃ কেমন হয় ? ওটাই আমার প্রথম লেখা বাচ্চাদের জন্য৷ তারপর আমার নিজের বাচ্চারা যখন বড় হলো, তখন ওদের পড়ার জন্য ওদের উপযোগী করে বেশ ক’টি লেখা দাঁড় করাই৷ ওগুলোতে বেশিরভাগ চরিত্রগুলোর নাম ওদের নামেই- নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশ৷ একটা সময় বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রচুর বাচ্চাদের বই লিখি৷ বাচ্চারা কিন্তু কঠিন পাঠক৷ বাচ্চাদের মা-বাবা আমাকে ধমক দিতে ভয় পায়৷ কিন্তু বাচ্চারা পায় না৷ তারা ধমক দিয়ে আমাকে বলে, কী ব্যাপার, নতুন বই কই? বই নাই কেন? তখন আমি খুব আনন্দ পাই৷ আমি তখন তাদের বলি, আগামী বইমেলায় তোমাদের জন্য নতুন একটা বই থাকবে৷ ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই আমাকে কথা রাখতে হয়৷
মিলন: আপনারা তিনভাই তিনবোন৷ আপনার এক ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন বড় মাপের লেখক৷ আরেক ভাই আহসান হাবীব কার্টুন এঁকে রম্য লিখে বিখ্যাত হয়েছেন৷ একই পরিবারের তিনজন মানুষ তিনরকমভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন৷ এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ: এরা প্রত্যেকেই নিজ যোগ্যতায় আজকের পর্যায়ে পেঁৗছেছে, নিজস্বভাবেই তারা প্রতিষ্ঠিত৷ এরা প্রত্যেকে আলাদা মানুষ৷ সাধারণভাবে একই পরিবারে দুই-তিনজন লেখক তৈরি হলে একজনের ছাপ অন্যজনের ওপর পড়ে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু আমার ভাইদের মধ্যে ছাপের কোনো ব্যাপার নাই৷ জাফর ইকবাল লিখছে একেবারে তার নিজস্ব স্টাইলে৷ আমার লেখার কোনো ছাপ তার মধ্যে নাই৷ আহসান হাবীব লিখছে সম্পূর্ণ তার মতো করে৷ ছবি-টবি অাঁকছে তার নিজস্ব চিনত্মা থেকে৷ বড় দুই ভাইয়ের কোনো ছাপ তার মধ্যে নাই৷ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আলাদা জায়গায় কাজ শুরম্ন করেছে এবং ভালো কাজ করছে৷ আমরা ভাইবোনেরা ইনক্লডিং মাই সিস্টার্স, যারা লেখালেখির লাইনে আসে নাই- এরা প্রত্যেকেই যে কাজটি করে খুব সিনসিয়ারলি করে৷ এটা আমাদের পারিবারিক গুণ বলা যেতে পারে৷ আমরা ভাইবোনেরা কোনো কাজ হাতে নিলে সেটা ঠিকভাবে করব, এটা স্বতঃসিদ্ধ৷
মিলন: বাংলা ভাষায় আপনার প্রিয় লেখক কারা কারা ? যাদের লেখা আপনি সবই প্রায় পড়েছেন ?
হুমায়ূন আহমেদ: একদম শুরম্ন থেকে বলি৷ বঙ্কিমচন্দ্র৷ কেননা তাঁর গল্প তৈরির ৰমতা অসাধারণ৷ তারপর আমাদের শরত্চন্দ্র৷
মিলন: একটি ভিন্ন বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই৷ বিষয়টি হলো ‘মৃতু্য-চিনত্মা’৷ আমি জানি যে, আপনি মৃতু্য নিয়ে ভাবেন৷ জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃতু্য-পরবর্তী জগত্ নিয়েও আপনি ভাবেন৷ আপনার মৃতু্য-চিনত্মাটা কী রকম?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে৷ বর্ষা আসবে, জোছনা হবে৷ কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না৷ আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতই ঐদিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই আর পারছি না৷
মিলন: বড় লেখকদের ৰেত্রে কালজয়ী শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে৷ যারা সময়কে জয় করে নেন নিজের লেখার মধ্য দিয়ে৷ আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন, এই ফিলিংসটা আপনার কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়টা একেবারেই আমার মাথায় আসে না৷ আমিই নেই আর আমার লেখা লোকজন পাঠ করছে, এতে আমার কী যায় আসে?
মিলন: কিন্তু এরকম কি কখনো মনে হয় না, আমার যে লেখাগুলো আমি রেখে যাচ্ছি, তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, লোকজন আমাকে স্মরণ করবে?
হুমায়ূন আহমেদ: না, সেরকম মনে হয় না৷ মিলন, আমি তোমাকে সিরিয়াসলি বলছি, আই অ্যাম টেলিং ইউ ফ্রম মাই হার্টঃ এই চিনত্মাটা কখনো আমার হয় না যে, ৫০ বছর পর লোকে আমার লেখা পড়বে, আমি কত ভাগ্যবান! আমি সারাজীবন লেখালেখি করেছি নিজের আনন্দের জন্যে৷
মিলন: আপনি বললেন যে, বেশ কয়েকবার মৃতু্য খুব কাছ থেকে দেখেছেন৷ যখন আপনার বাইপাস সার্জারিটা হলো, যখন আপনাকে এনেসথেশিয়া দেয়া হচ্ছে, আপনার সেন্সটা অন্য জগতে চলে যাচ্ছে৷ এই যে ঘুমে তলিয়ে যাবার সময়টা, যতৰণ পর্যনত্ম আপনার চেতনা ছিল, সেই মুহূর্তে আপনি বিশেষ কিছু কি ভেবেছেন? আপনার মনে পড়ে?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি তো মুসলমানের ছেলে৷ ধর্ম-বিশ্বাসটা জন্মের পর থেকেই খুব শক্তভাবে মাথায় ঢোকানো৷ সেই মুহূর্তে আমি যে ক’টা সুরা জানতাম, বারবার সেগুলোই মনে মনে পড়ার চেষ্টা করেছি এবং সুরা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে যাবার প্রার্থনা করছিলাম৷ পুত্র-কন্যা-স্ত্রী-ভাই-বোন এদের কারোর কথাই মনে হয়নি৷
মিলন: আচ্ছা হুমায়ূন ভাই, বাংলাদেশ নিয়ে আপনি কী ধরনের স্বপ্ন দেখেন? এই দেশের স্বাধীনতার জন্য একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, এই মুক্তিযুদ্ধে আপনার বাবা প্রাণ দিয়েছিলেন৷ বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এই দেশের আজকের প্রেৰাপটে আপনি অনেক বড় লেখক৷ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনি বাংলাদেশ নিয়ে কী স্বপ্ন দেখছেন?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি আমার নিজের দেশ নিয়ে অসম্ভব রকম আশাবাদী৷ আমাকে যদি একলৰবার জন্মাবার সুযোগ দেয়া হয় আমি একলৰবার এই দেশেই জন্মাতে চাইব৷ এই দেশের বৃষ্টিতে ভিজতে চাইব৷ এই দেশের বাঁশবাগানে জোছনা দেখতে চাইব৷
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, নভেম্বর ০৭, ২০০৮