যামিনী পিঠের আঁচল সামলে বললেন, “বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা আছে সব তুমিই বোঝ? কত আমার ওজনদার!” বলে অবহেলায় স্বামীকে বাক্যবাণ হেনে বঙ্কুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠাকুরপো বলছিল আপনার নাকি অপদেবতা ধরার ক্ষমতা আছে। সত্যি নাকি?”
ছেলে ভোলানো হাসি হেসে বঙ্কু বলল, “অপদেবতা নয়, আত্মা।”
“ওই হল। ভূত তো?”
“ভূত হল নিচু স্তরের আত্মা। স্কুলে যেমন ওয়ান টু ক্লাস—ভূত হল সেই ক্লাসের। আত্মারা হলেন অনেক উঁচু ক্লাসের।”
জগবন্ধু ঠাট্টা করে বললেন, “হ্যাঁ গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের।”
যামিনী কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, “আত্মারা ক্ষতি করেন না? আপদ বিপদ হয় না?”
“না, না, মোটেই নয়।”
“দেখতে বড় ইচ্ছে করে। ভয়ও হয়।”
“বেশ তো, দেখবেন। দেখাব। ভয়ের কিছু নেই।”
চা নিয়ে আশালতা হাজির হলেন। পেছনে রমেশ।
স্পিরিচুয়ালিস্ট বঙ্কুকে যামিনীর খুব পছন্দ হয়ে গেল। কথায় বার্তায় নম্র, নিজে বেশি কথা বলে না, মুখে হাসিটি লেগে আছে, যখনই এ-বাড়িতে আসে কিছু না কিছু হাতে নিয়ে ঢোকে। যামিনী রাগ করেন, এ তুমি বড় অন্যায় করছ বড় ঠাকুরপো, এমন করলে তোমায় আর বাড়ি ঢুকতে দেব না। বঙ্কু এখন যামিনীর কাছে তুমি হয়ে গিয়েছে। যামিনী রাগ করলে বঙ্কু বলে, নিজের বলতে আমার কেউ কোথাও নেই বউদি ; আপনারা আমার আত্মীয়ের মতন। কদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছেন, সামান্য কিছু হাতে করে আনলে আনন্দ পাই। এতে কেন বাধ সাধবেন।’ এরপর যামিনীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
আশালতা বরাবরই খানিকটা ভিতু গোছের মানুষ। বঙ্কু ভূতভজনা করে শুনে তাঁর রীতিমত ভয় ধরে গিয়েছিল গোড়ায়। বঙ্কুর ব্যবহার দেখে, কথাবার্তা শুনে সে ভয় কেটে গেল বারো আনা। এখন তিনি বঙ্কুর চায়ে চিনি বেশি দেন, সকালে মিষ্টিমাষ্টা এলে কালাকাঁদ, কালোজাম দু চারটে সন্ধের জন্যে রেখে দেন; বঙ্কু এলে সাজিয়ে দেন। ভেজিটেবল চপ করে খাওয়ান। বঙ্কু নিরামিষাশী।
রমেশ বঙ্কুর সঙ্গে বেশ জমিয়ে ফেলেছেন। নিজেদের ছেলেবেলার গল্পগুজব ছাড়াও হরেক রকম আলোচনা হয় ; এখানকার ক্লাইমেট, জমির দাম, বাড়ি করার খরচ থেকে শুরু করে দেশের হালচাল ; ব্ল্যাক মানি, ভেজাল, ইন্দিরা, সাঁইবাবা—মায় মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তারও আলোচনা চলে।
এক জগবন্ধুই বঙ্কুকে একটু তফাতে রাখতেন। তিনি যে মানুষ খারাপ তা অবশ্য নয়, কিন্তু এ-বাড়িতে বঙ্কুর এতটা সমাদর তাঁর পছন্দ হত না। চেনাজানা মানুষ বঙ্কু, ছেলেবেলার পরিচয়, ছোট ভাইয়ের মতনই অনেকটা, তাকে বাড়িতে ডেকে চা মিষ্টি খাওয়াও, গল্পগুজব কর—আপত্তি নেই, তা বলে মাথায় তোলার দরকারটা কী? জগবন্ধু নিজেও কি হাসি তামাশা, গল্পগুজব করেন না বঙ্কুর সঙ্গে, কিন্তু যামিনী বঙ্কুকে দেখলেই যেন আহ্লাদে গলে যায়, কত কথা—সংসারের কোনো কথাই বাদ যায় না। রমেশটাও তাই। এই দুজনে মিলে হাঁড়ির সব খবরই বার করে দিয়েছে বঙ্কুর কাছে। নিজেদের ছেলেমেয়েরা কে কি করছে, কার কোথায় বনিবনা হচ্ছে না, মেয়ে নিজের পছন্দে বিয়ে করল, ছেলের বউ সকালে ঘুম থেকে উঠে লিপস্টিক মাখে—এ-সব কথা বলার কি কোনো দরকার ছিল?
সেদিন বসার ঘরে বসে গল্প হতে হতে রাত হল। জগবন্ধুর ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। আটটায় শুরু করলে ন-টায় শেষ হবে। একটু জিরেন দিয়ে রাত্রের খাওয়াদাওয়া। জগবন্ধু উসখুস করছিলেন। শেষে বঙ্কুকে বললেন, “ওহে প্রেতসিদ্ধ, আমি এবার উঠি। রাতও হচ্ছে।”
যামিনী বললেন, “উঠবে কেন? বসো। কথাটা ঠিক হয়ে যাক।”
“কিসের কথা?”
“এতক্ষণ কি ঘুমোচ্ছিলে? সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মা। জ্বালালে বাপু। বঙ্কু ঠাকুরপোর ওখানে আমরা কবে যাচ্ছি। কাল না পরশু?”
“গেলেই হয়, এ নিয়ে ভাববার কি আছে?”
“যথেষ্ট আছে। ফুরফুরে হাওয়া খেতে তো যাচ্ছি না, যাব ওই আত্মাদের দেখতে। কাল শনিবার। তার ওপর কৃষ্ণপক্ষ। কাল আমার সাহস হয় না।”
“আত্মাদের কোনো বার নেই, কি বলো বঙ্কু?” রমেশ বললেন।
“আত্মা আমাদের অধীন নয়, রমাদা, তাঁরা নিজেদের ইচ্ছায় আসেন যান। অভিরুচি হলে দেখা দেন, না হলে দেন না। শনি সোম বলে কথা নেই।”
“তা হোক। শনিবারে আমি যাব না,” আশালতা বললেন।
“তবে পরশু রবিবার।” যামিনী দিন ঠিক করে ফেললেন। বঙ্কুর আশ্রমে চার জনে আত্মা দেখতে যাবেন। দেখা তো যাবে না, গলা শোনা যাবে, আর যদি গলাও না শোনা যায় পেন্সিলের লেখা ফুটবে। বঙ্কু তাই বলেছে।
আসর ভাঙল। বঙ্কু চলে গেল। জগবন্ধু খেপে গিয়ে বললেন, “ভূতো বঙ্কুর ধাপ্পায় তোমরা ভুললে। বেটা আত্মার আ জানে। তোমরা যাচ্ছ যাও, আমি যাব না।”
যামিনী সরবে বললেন, “যাবে না মানে। নিশ্চয় যাবে।”
রবিবার চার জনে শেষ বিকেলে বঙ্কুর বাড়ি হজির হলেন। আধ মাইলটাক একটানা হেঁটে এসে যামিনীর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে পা দিয়েই যামিনী জল খেতে চাইলেন ; বললেন, “এই তোমার আশ্রম। বড় নিরিবিলি তো?”
বঙ্কু বাইরের বারান্দায় চেয়ার বেঞ্চি সাজিয়ে আসন পেতে রেখেছিল। চার জনকে খাতির করে বসাল। নিজের হাতে জল এনে দিল যামিনীকে। জগবন্ধু বললেন, “তোমার আত্মাদের কখন আসতে বলেছ হে? আটটা নাগাদ আমাদের ফিরতে হবে।”