অনেকের মনে একটা প্রশ্ন ছেড়ে আসা গ্রাম কি ধরনের সাহিত্য? ছেড়ে আসা গ্রাম – দক্ষিণারঞ্জন বসুর একটি জীবনী ও স্মৃতিচারণ সম্পর্কিত বই। ছেড়ে আসা গ্রাম বইটি পারুল প্রকাশনী ২০১৭ সালে প্রথম প্রকাশ করেন। আপনারা বইটি পড়তে চাইলে আর দেরি না করে এখনি শুরু করুণ এবং কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই বইটি পড়ে ফেলুন।
ছেড়ে আসা গ্রাম বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ ছেড়ে আসা গ্রাম
- লেখকের নামঃ দক্ষিণারঞ্জন বসু
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
- প্রকাশনীঃ পারুল প্রকাশনী
- প্রকাশকালঃ ২০১৭
কুষ্টিয়া – শিলাইদহ ভেড়ামারা
প্রমত্তা নদী পদ্মা। জলকল্লোল প্রাণের জোয়ার, প্রাচুর্যের প্লাবন। সে প্লাবনে দু-তীরের গ্রামের মানুষদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তাই গ্রামবাসীরা বড়ো দুঃখে প্রাণ-প্রবাহিনী পদ্মাকে নাম দিয়েছে কীর্তিনাশা। শুধু ধাও, শুধু ধাও, উদ্দাম উধাও। এই উদ্দামতার অত্যাচার সন্তানের আবদারের মতোই যেন সহ্য করে এসেছে আমার জননী, আমার প্রিয় জন্মভূমি শিলাইদহ। জনশ্রুতি আছে শেলি নামে একজন কুঠিয়াল সাহেবের নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ হয়েছে শিলাইদহ। নদীর ধারে তাঁর কবরটি অনেকদিন পর্যন্ত গ্রামবাসীর কৌতূহল মিটিয়ে এসেছে। দুরন্ত পদ্মা এখন তা গ্রাস করে নিয়েছে। এমনি করে মানুষের কীর্তি নাশ করেছে পদ্মা এক দিকে, আবার অন্য দিকে নতুন কীর্তি গড়ে তোলার কাজে অকৃপণ সহায়তাও করেছে। কিন্তু আজ পদ্মাতীরের মানুষ পদ্মাকে ছেড়ে এসেছে যে দুঃখে, পদ্মা নিজেও ততখানি দুঃখ দেয়নি কখনো। এ দুঃখের মূল পদ্মা নয়, মানুষের জাতভাই মানুষ।
হাজার গ্রামের মধ্যে শিলাইদার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল না যার জন্যে বাংলাদেশের মানুষ তাকে মনে রাখতে পারে। কিন্তু সে বৈশিষ্টতা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সোনারতরীর যুগে অনেক কবিতা রচনা করেছেন এই শিলাইদার কোল ছোঁয়া পদ্মার বোটে বসে বসে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িরই জমিদারির অন্তর্গত ছিল এই শিলাইদা।
গ্রামের মাটির স্পর্শ ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না দু-কূল-প্লাবিনী পদ্মকে। বেশ বুঝতে পারছি আজকের এই পরমাশ্চর্য সকালের রোদে নদীর ওপারে ঝাউগাছের দীর্ঘ সারির ফাঁক দিয়ে রোদের ঝলক সারাশিলাইদার গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। নদীর ওপরে গাঙচিলগুলো মাছের লোভে চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। আর জলের বুকে নৌকো বেয়ে চলেছে পদ্মানদীর মাঝিরা। কলকাতার এই মধুবংশীয় গলির প্রায়ান্ধকার কুঠুরিতে কোনোরকমে মাথা গুঁজে আজ অনুভব করছি শরতের প্রাক্কালে পদ্মা-স্নাতা শিলাইদার প্রকৃতি ও পরিবেশ। অকাল বর্ষণে নদী পদ্মার যৌবনমদিরতা হয়তো এখনও শেষ হয়নি। হয়তো জলতরঙ্গ এখনও তেমনই প্রবলতায় আছড়ে পড়ছে শিলাইদার দু-তীরে। সে কূলভাঙা ঢেউয়ের শব্দে কত রাত্রে ঘুম গেছে ভেঙে। কত ঝড়ের রাতে পদ্মানদীর মাঝিদের হাঁকাহাঁকিতে সচকিত হয়ে উঠত আমার কিশোরমন। ভাবতাম এই দুরন্ত, দুর্বার পদ্মার বুকে ভগবান যে-মানুষদের জীবন-সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছেন তারা যেন প্রকৃতির পরিহাসকে অনায়াসে ভ্রুকুটি দেখিয়ে এই দুর্দম ঝড়ের মধ্যেও নদী পারাপার করছে। এ শক্তি মানুষ অর্জন করেছে নিজেদের বাঁচবার অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে। কিন্তু সেই মানুষেরাই আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ভুলে গিয়ে আত্মধ্বংসী সংগ্রামে কী করে মেতে ওঠে?
পুজো এগিয়ে আসছে। প্রতিবছরই এ সময়টাতে শিলাইদা যাওয়ার জন্যে মন উন্মুখ হয়ে উঠত। কুষ্টিয়া স্টেশনে নামলেই মন এক অপরিসীম আনন্দে ভরে যেত। সামনে গড়াই। নৌকো দিয়ে গড়াই নদী পার হয়ে গিয়ে পৌঁছোতাম কয়াতে। আর দূর নয়। আর মাত্র তিন মাইল হাঁটাপথ। দু-পাশে অতিপরিচিত আমবন, বাঁশঝাড় আরও কত বনলতার শ্যামল স্নিগ্ধ
স্পর্শ। ভাঙা রাস্তা। তার ওপর দিয়ে আবার রহিম ভায়ের গোরুর গাড়ির অত্যাচার। তবুও কলকাতার পিচঢালা রাস্তার চেয়ে সে পথকেই আপন বলে জেনেছি, সে-পথ যে আমার গ্রামের ভিটার সন্ধান দিত আমাকে। বর্ষাকালে জল, শীতকালে ধুলো। তবু যেন কী এক প্রশান্তি সারামন জুড়ে থাকত সে পথে চলবার সময়, তা আজ বোঝাই কী করে? পথ-চলতি মানুষদের সুবিধের জন্যে ঠাকুরবাড়ির লোকেরা পথের দু-পাশে অনেক বাবলা গাছ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কয়া থেকে কুঠিবাড়ি, কুঠিবাড়ি থেকে শিলাইদহ কাছারি পর্যন্ত এই বাবলা গাছের সারি। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত সে বাবলা শ্রেণিকে কোনোদিনই তো ভুলতে পারব na। গাছগুলোকে দেখলেই মনে হত যেন আপনার ছত্রছায়ায় আশ্রয় দেওয়ার জন্যে দূরদেশের প্রবাসী সন্তানদের পথ চেয়ে ব্যাকুল আগ্রহে তারা অপেক্ষারত। শুধু গাছ নয়, পথিকদের সুবিধের জন্যে ঠাকুরপরিবারের কর্তারা রাস্তার পাশে একটি বড়ো পুকুর ও টিউবওয়েল খনন করিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি যাওয়ার পথেই কত কুশল প্রশ্ন। কেউ বলে : ‘বাবু কখন আসতিছেন?’ কিছুদূর যেতেই আবার প্রশ্ন : ‘আপনি বাড়ি আসেন না কো? আপনের মা আমার কাছে কত প্যাচাল পাড়েন! বাড়ি গিয়ে হয়তো শুনি ওইলোক অনেকদিন আসেইনি আমাদের বাড়ি। তবু সহজ আন্তরিকতায় কুশল প্রশ্ন করতে কার্পণ্য করে না কেউ। হয়তো বলি : ‘তা তোমাদের দেখবার জন্যেই তো এতদূর থেকে এলাম।’
‘তা কয়েকদিন আছেন তো? কাইল আমার খাজুর গাছ নাগাইছি। আপনার জন্যে এক হাড়ি রস দিবার মন করি।’–কোথা থেকে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে জব্বর। কাছারির গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান জব্বর মুনশি। ওর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখলেই জোর করে নিয়ে যাবে বাড়িতে। কিছু না খাইয়ে কিছুতেই আসতে দেবে না। এমন মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সবার সঙ্গে।
বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে। খোরশেদপুর এম. ই. স্কুল। এই স্কুলেই বিদ্যা শিক্ষার হাতেখড়ি আমার। খোরশেদপুরের স্কুলজীবনে মাত্র তিনদিন স্কুল পালিয়েছিলাম। বড়ো রাস্তা ছাড়া একটা জঙ্গলের পথেও স্কুলে যাওয়া যেত। এই জঙ্গল সম্পর্কে নানারকম জনশ্রুতি রয়েছে। ভূতের জঙ্গল বলে ছিল এর পরিচয়। বলা বাহুল্য কোনোদিন ভূত কিংবা ভূতের বাসস্থানের আমরা সাক্ষাৎ পাইনি। স্কুল পালিয়ে খেত থেকে মটরশুটি চুরি করে এনে বনের ভেতর গাছতলায় বসে বসে খেতাম। একদিন ধরা পড়ে যাওয়ার পর আর স্কুল পালাইনি। মাঝে মাঝে আবার শিকারে বের হতাম। কোনোদিন নদীর ধারে খরগোশ শিকারের আশায়, কোনোদিন দক্ষিণ দিকের জঙ্গলে বাঘের বাচ্চা ধরবার উদ্দেশ্যে মহড়ায় বের হতাম। কিন্তু কোনোদিন একটা ফড়িংও ধরতে পারিনি। এমনই সব অদ্ভুত খেয়ালে পাঠ্যজীবনটা কাটিয়েছি বেশ। একবার দেবুর আর আমার মাথায় খেয়াল চাপল যে ডাকাতি করে গরিবদের দান করতে হবে। যে কথা সেই কাজ। খেলার ছোটো পিস্তলটি নিয়ে রাত দশটার সময় বাইরের ঘর থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম আমি আর লেফটেন্যান্ট দেব। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারিনি। পাশের বাড়িতেই প্রথম মহড়া দিতে গিয়ে কী যে নাকাল হয়েছিলাম সে করুণ কাহিনি প্রকাশ না করাই ভালো। অবশ্যি এমন সব বুদ্ধি হত ডিটেকটিভ বইয়ের নানা আজগুবি গল্প পড়ে।
কিশোরজীবনের এই রূপকথার রাজ্যে মূর্তিমান বাস্তব ছিলেন গফুর মাস্টার। আমার জন্মের পূর্ব থেকেই গফুর মাস্টার আমাদের গৃহশিক্ষক। দাদা-দিদিদের হাতেখড়ি দিয়েছেন তিনিই। কলকাতায় এসে অনেক কৃতবিদ্য শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করে ধন্য হয়েছি, কিন্তু কোনোদিন গফুর মাস্টারকে ভুলতে পারিনি। কলকাতার পথে চলতে চলতে রেডিয়োতে একটা গান শুনলাম : নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। গানটা শুনে আমার মন চলে গেল অনেক দূরের স্মৃতির রাজ্যে শিলাইদার এক প্রান্তে, কোন এক মুগ্ধ কিশোরমনের চিত্র সেটি। ঢল নেমেছে পদ্মার দু-তীরে। সারাটা আকাশে কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। পুবদিকের জানলাটা খোলা। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথ এমন দিনেই হয়তো এখানকার পদ্মার বোটে ‘সোনার তরী’ আর ‘খেয়া’র কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন। সেদিনও আকাশ হয়তো এমন মেঘাবৃত ছিল। সেই মেঘমেদুর অম্বরের প্রান্তঘেঁষা তাল-তমাল বন লক্ষ করে একদিন, সে বহুদিন আগে, আরও একজন কবি ‘শতক যুগের গীতিকা’য় সুর সংযোজন করেছিলেন। মন তখন অতীতমুখর। শুনতে পেলাম পদ্মানদীর মাঝি সুর ধরেছে : ‘কুল নাই, কিনারা নাই, নাইকো গাঙের পাড়ি, সাবধানেতে চালাইও মাঝি আমার ভাঙা তরি। সে দিন আর বুঝি ফিরে আসবে না!
রবিবার আর বুধবার এই দু-দিন বাজার বসত গ্রামে। বাকি পাঁচদিন গোপীনাথ দেবের মন্দিরের সামনে বসত বাজার। বাজারের পাশ দিয়েই পদ্মা প্রবাহিতা। চৈত্র-বৈশাখ মাসের পদ্মা আর বর্ষাকালের পদ্মা যেন আকাশপাতাল তফাত। পদ্মার এই দুটো রূপকেই আমি ভালোবাসি। দারুণ গ্রীষ্মের দাবদাহে পদ্মা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আবার বর্ষার কালোমেঘ দেখলেই পদ্মা যেন উন্মাদের ন্যায় উত্তাল তরঙ্গ ভেঙে দুর্বার হয়ে ওঠে।
এই আমার শিলাইদা। আজ তার পরিচয় দিতে গিয়ে কেবলই মনে হচ্ছে শিলাইদহে জন্মগ্রহণ করে আমি ধন্য হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ এই শিলাইদহকে খুব ভালোবাসতেন। এখানকার কুঠিবাড়িটি ছিল তাঁর নিজস্ব। এখানে থাকতেই তিনি ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদে হাত দেন। এখান থেকে কিছু দূরেই স্বৰ্গত সাহিত্যসেবী জলধর সেনের বাড়ি কুমারখালি। সব স্মৃতির বন্ধনই অটুট আছে, কেবল দেশের ব্যবধান গেছে বেড়ে। তবুও আমি শিলাইদহকে ভুলতে পারি না। মনে হয় আবার আমার গ্রামকে ফিরে পাব, ফিরে পাব গফুর মাস্টার, জব্বর মুনশি, সবাইকে।
.
ভেড়ামারা
পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে।।
এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি;
সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে।।
কবিগুরুর গানটি আজ আমাদের মনের কথা ব্যক্ত করছে। পথের ডাককে অগ্রাহ্য করতে না পেরে আজ আমরা মৃত্যুর পথে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছি অন্ধকার নিশিতে। অপটু-চরম ক্লান্তিতে পড়েছে ভেঙে, পথরেখা মুছে গেছে সম্মুখ থেকে, ফলে জীবনযাত্রায় আমরা পড়েছি পিছিয়ে–এ সময় এমন একটি ধ্রুবতারারও সন্ধান পাচ্ছি না যার আলোর নির্দেশে আমরা এগিয়ে গিয়ে নির্বিঘ্নে জীবনে হব সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়েছি দূরে। শস্যশ্যামলা গ্রাম্য পরিবেশ ছেড়ে রুক্ষ শহুরে আবহাওয়ায় যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ললাটে জন্মভূমির কোমল স্পর্শের জয়তিলক নিয়ে জন্মের প্রথম শুভক্ষণে কান্নার সুরে ‘মা-মা’ বলে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলাম একদিন আজ জীবন-মধ্যাহ্নে কাঁদতে কাঁদতে আবার আশ্রয় প্রার্থনা করছি দেশজননীর কাছে। সেদিন পেয়েছিলাম গ্রাম-জননীর কোল, আজ তাঁর কাছ থেকে বিতাড়িত। সেদিন আর এদিনের মধ্যে পার্থক্য অনেক, আজ আমার চলার পথে কাঁটা, শ্বাস প্রশ্বাসে নাগিনির সুতীক্ষ বিষ! দ্বীপান্তরিত লাঞ্ছিত জীবন নিয়ে সর্বদাই বিব্রত। কেবল নিজের চিন্তায় সব সময় বিভোর। তবু মন পড়ে আছে সেই সুদূরে হারানো মায়ের কোলে, পল্লির ছোট্ট কুটিরে, আমার গাঁয়ের শ্যামঘন-নীলাকাশে। সেসব দিনকে আজ দিকচক্রবালে স্বপ্নের মতো মনে হয়। জানি না দেশজননী আবার মা-জননীর মতো কোলে ঠাঁই দেবেন কি না, আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পাব কি না!
জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা এলেই চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে আমার গ্রামখানি। আমার গ্রাম ভেড়ামারা আমার কাছে অতুলনীয়, বার-বার গ্রামের নাম উচ্চারণে শান্তি পাই মনে। মনের কোনো গোপন কোণে সেই ‘ভেড়ামারা” নামটি বোধহয় খোদাই হয়ে আছে, না হলে আজ এই দুঃসময়ের মধ্যেও তাকে এত নিবিড়ভাবে মনে পড়ে কেন? কেন তাহলে এই অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রামটির তুলনা খুঁজে পাই না? কেন সেই শান্তির নীড় স্নিগ্ধ সমীর’-এর কথা চিন্তা করলে চোখ জলে ভরে আসে? আজ ভেবে আশ্চর্য লাগে আমার গ্রাম আমার কাছে কেন বিদেশ হয়ে গেল একরাত্রির মধ্যে? প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা গ্রামখানি কেন হঠাৎ লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেল?
আমার গ্রাম পূর্বে ছিল নদিয়া জেলায়, আজ হয়েছে কুষ্টিয়া জেলার কুক্ষিগত। আগে এই কুষ্টিয়াও ছিল নদিয়া জেলারই একটি মহকুমা। এককালে একটি ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল আমার গ্রাম। কলকাতার পণ্যের বাজারে তাই ভেড়ামারার একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল বাঁধা। একদিন এখান থেকেই পাট আর পান রপ্তানি হত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে রেল ওয়াগন ভরতি হয়ে। ইলিশ মাছও বাদ যেত না সে তালিকা থেকে। মাইল তিন চার উত্তরে পদ্মা নদীর ধারে ‘রাইটা’ থেকে বরফ দিয়ে মাছের সেরা ইলিশ মাছ আসত ভেড়ামারা স্টেশনে বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হওয়ার জন্যে। বৃদ্ধদের মুখে শুনেছি একদা এখানে নাকি বাইশ তেইশটি ইলিশ মাছ মিলত একটাকায়। কুটুম্ববাড়ি যেতে হলে তাঁরা একটাকার ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যেতেন মুটের মাথায় চাপিয়ে! সেই মাছ অবশ্যি শুধু কুটুম্বরাই খেতেন না, আশপাশের আরও অনেকেই রসাস্বাদন করতেন তার। আমরা অতটা না দেখলেও তার খানিকটা আভাস পেয়েছি। খাদ্যদ্রব্য খুব সস্তাই ছিল এখানে, আজ আর অবশ্যি সেদিন নেই। এখন সব কিছুই অগ্নিমূল্য। এখন মাছ থাকলে তেল থাকে না, তেল থাকলে মাছের অভাব ঘটে। সেদিনের রাম যখন নেই, তখন অযোধ্যার অন্বেষণ করা বৃথা। কেন হল এই দৈন্য? গরিব মানুষের কি সুবিধে হয়েছে দেশ-দ্বিখন্ডিত হয়ে? দেশমাতার অঙ্গচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষেরও যে অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে সে-কথা মোটেই আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। আগেকার কথা ভেবে তাই অস্থির হয়ে পড়ি সময় সময়, কিন্তু আমার অস্থিরতার মূল্যই বা কী? চেষ্টা করলে পারি না কি আবার আমরা এক হতে? পারি না কি দেশের বুকের ওপর যে শ্বাসরোধক প্রাচীরটা তোলা হয়েছে তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে পারি নাকি আবার আমরা পরস্পরকে বিশ্বাসভরে আলিঙ্গন করতে? কাকে ছেড়ে কার চলবে? তবে কেন সমস্ত মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সাম্প্রদায়িক দৈত্যের দাসত্ব করব জীবনভোর?
গ্রামে বাস করার কোনো অসুবিধেই ছিল না। সরকারি হাসপাতাল, হাই স্কুল, থানা, স্টেশন, নদী ইত্যাদি কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। আশ্বিন-কার্তিক মাসে গ্রামখানিতে যেন লক্ষ্মীশ্ৰী ফুটে উঠত। সব দিকে ব্যস্ততা। সে সময় এত পাট আমদানি হত যে পাটের কাঁচা গন্ধে বাতাস হয়ে উঠত ভারী। একমাত্র পাটকে কেন্দ্র করেই লক্ষ লক্ষ টাকার আদান-প্রদান চলত প্রতিদিন। কলে পাট চাপানো হত–সেই সময়ে কুলিদের সমস্বরে গাওয়া খুশিভরা বিচিত্র ‘হো-আই-লো’ গানের সব টুকরো টুকরো কলি আজও সময় সময় কানে এসে বাজে যেন। অন্য সময় চাল-ধান, ছোলা-মটর আর পানের ফলাও কারবারে ব্যাবসায়ীরা থাকতেন ব্যতিব্যস্ত। লক্ষ্মীর ধ্যানে সকলেই থাকতেন মশগুল, অন্য দিকে মন দেওয়ার তেমন অবসরই থাকত না কারও। দুঃখ হয় সেদিনের কথা ভেবে, কোথায় গেল সেই মধুর দিনগুলো।
মনে পড়ে পুণ্যাহে’র সময় জমিদারের কাছারিতে সে কী খাওয়া-দাওয়ার ঘটা! আকণ্ঠ চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয়ের পর বাড়ি ফিরতাম শোলার একটা মালা গলায় দিয়ে। এই ‘পুণ্যের আসরে কোনোদিন জাতিভেদ দেখিনি। হিন্দু প্রজা মুসলমান প্রজা সমান উৎসাহের সঙ্গেই জমিদার বাড়িতে খেয়ে এসেছে, গল্পগুজবে মশগুল হয়ে একই সঙ্গে ফিরে এসেছে আপন আপন বাড়িতে। জানি না হঠাৎ সেই মধুর সম্পর্কের মধ্যে কী করে ফাটল ধরল, ‘পুণ্যের মধুর বন্ধনে পাপের প্রবেশ ঘটল কখন কী করে!
আমাদের বাড়ির সামনেই বসত হাট। সপ্তাহে দু-দিন। মনিহারি, জামা-কাপড় থেকে শুরু করে মাটির হাঁড়ি, কলসি, মশলা, প্রায় সব কিছুই পাওয়া যেত হাটে। তরিতরকারি এবং মাছ-মাংস তো বটেই। গ্রামের হাটের সঙ্গে কোথায় যেন একটা বিরাট পার্থক্য আছে শহুরে বাজারের। হাটের সঙ্গে গ্রামের অতিসাধারণ মানুষেরও একটা সুনিবিড় সম্পর্ক আছে। তেমন সম্পর্কের কোনো হদিশ মেলে না শহুরে বাজারে। আমাদের গ্রাম্য হাটটি তাই ছিল একাধারে মিলনক্ষেত্র এবং শিক্ষাক্ষেত্র। সপ্তাহে দু-দিন কেনাকাটা করতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দূরগ্রামের লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও হয়ে যেত হাটে। আমরা জিনিস কেনার জন্যে যত না হাটে। গেছি তার চেয়ে বেশি গেছি বন্ধুজন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চাক্ষুষ আলাপের জন্যে। এই যে আমাদের গ্রামকেন্দ্রিক আত্মীয়তাপূর্ণ মন তা বিনষ্ট হল কেন? সেই সুন্দর পল্লিজীবন, সেই গোচারণ ক্ষেত্র, সেই মর্মরধ্বনি মুখরিত বেণুকুঞ্জ কোন পাপে আমাদের জীবন থেকে নির্বাসিত হল কে জানে! পল্লিজীবনের সুস্নিগ্ধতা, সরলতা আর বনপ্রান্তরের সৌন্দর্য ও পাখির কাকলি দিয়ে যে জীবন ছিল ঘেরা সে জীবন কি আবার ফিরে পেতে পারি না? পল্লিগ্রামগুলো বাঙালির জাতীয়জীবনের মূল আশা এবং আশ্রয়স্থল। সেই পল্লি থেকেই আমরা হলাম বিচ্যুত! কিন্তু আমাদের কী দোষ?
আজ বেশি করে মনে পড়ছে ‘মায়ের বাড়ি’র কথা। গ্রামবাসীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবেই ধরা হত ‘মায়ের বাড়ি’কে। এখনও পর্যন্ত সেই মায়ের কথা চিন্তায় এলেই আপনা আপনি কপালে হাত দুটি উঠে প্রণামের মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। বিনা প্রণামে মায়ের কথা বলা ভেড়ামারার লোকেরা চিন্তাই করতে পারে না। দুর্গাপুজো হত এখানে অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে। মানতের চিনি সন্দেশের যে হাঁড়ি পড়ত তার সংখ্যানির্ণয়ে ফুরিয়ে যেত ধারাপাতে শেখা যত সংখ্যাসমষ্টি! এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত শ্রেণিবদ্ধ হাঁড়ির সারি দেখে শৈশবে বিস্ময়াবিষ্ট হতাম। সারাবছরের মানত শোধ করা হত এই পুজোর সময়। পাছে গোলমাল হয়ে যায় এই ভয়ে প্রতিটি হাঁড়ির গায়ে খড়ি দিয়ে স্পষ্টাক্ষরে নাম লেখা থাকত গৃহস্বামীদের। ছোটো গ্রামখানির বুকে পুজোর কটাদিন ধরে চলত জীবনের জোয়ার। দূর-দূরান্তরের নর-নারীরা আসত মেলা দেখতে, বিগ্রহ দর্শন করতে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। একই সঙ্গে পুজো দেখা, আত্মীয়দর্শন এবং জিনিসপত্র কেনাকাটার সুযোগ পল্লিগ্রামে বড়ো বেশি আসে, তাই-দর্শনার্থীর প্রাচুর্য চোখে লাগার মতোই হত। আজও সেইদিনকার ছবি স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। কী সুন্দর গ্রামবাসীদের হাসিখুশি মাখানো মুখগুলো, তাদের ত্বরিত চরণ ধ্বনি, বিশ্রাম ও ব্যস্ততায় হিল্লোলিত অপূর্ব জীবনছন্দ। মনে হচ্ছে যেন দেখতে পাচ্ছি মা দুর্গার সামনে করজোড়ে অঞ্জলি দেওয়ার দৃশ্য–শুনতে পাচ্ছি বৃদ্ধ পুরোহিতের উদাত্ত কণ্ঠের মন্ত্রপাঠ,
অন্ধ্যং কুষ্ঠংচ দারিদ্রং রোগং শোকংচ দারুণম।
বন্ধুস্বজনবৈরাগ্যং হরমে হরপার্বতি।
দুর্গাপুজো সমগ্র বাংলারই পুজো। সেখানে, জাতিভেদের কথা ওঠে না। পুজোর সময় সারাগ্রামে একটা জাতিই চোখে পড়ত তা হল মনুষ্যজাতি। সেইজন্যেই অঞ্জলির পর প্রসাদ গ্রহণের ব্যস্ততা দেখেছি শুধু হিন্দুদের মধ্যে নয়, মুসলমান ভাইদের মধ্যেও। অস্থিমজ্জায় এই যে একাত্মবোধ সেদিন ছিল তা কোথায় গেল আজ? সেদিন তো দেখেছি হরপার্বতী বা উমাকে নিয়ে যে গান হত তাতে উমার দুঃখে কত মুসলমান ভাই-বোনও অশ্রুবিসর্জন করেছেন।
ভুলতে পারছি না ঝুলনের সময় ঠাকুরবাড়ির যাত্রাগানের কথা। সেদিনটি যেন ছিল সমস্ত গ্রামবাসীর জীবনের একটি পরমলগ্ন। সারাবছরের প্রতীক্ষার পর আসত ওই দিনটি। আমার বয়েস ছিল অল্প, তাই উৎসাহও ছিল অনন্ত। সন্ধে না হতেই খেয়েদেয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাত্রার আসরে চলে যেতাম। জায়গা না পাওয়ার ভয়ে অভিনয়ের বহুপূর্বেই জায়গা সংগ্রহ করে উদগ্র প্রতীক্ষায় বসে থাকতাম সমস্ত ঠাট্টা-বিদ্রূপ অগ্রাহ্য করেই! ভিড় হত অসম্ভবরকম। ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাড়োয়ারিরা। গ্রামের লোক ঠাকুরবাড়িকে খুব শ্রদ্ধা করত। বাড়ির সামনে কালীঘরে কালীপুজো উপলক্ষ্যে গান বাজনার আসর বসত হামেশাই। কালীপুজোর দিন বাড়ির গুরুজনেরা আমাদের টিকিটি দেখতে পেতেন না, আমরা সবাই থাকতাম মহাব্যস্ত। বলির পাঁঠাদের তত্ত্বতল্লাশ করতাম, মহাযত্নে তাদের কাঁঠালপাতা খাওয়াতাম, তাদের কোলে করে আদর করতাম সমস্ত দিন! কিন্তু এত আদরযত্নে যাদের লালন করলাম সমস্তটা দিন ধরে সেই স্নেহের জীবটিকে মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে কোনো ব্যথাই অনুভব করিনি! মনের এই দ্বৈতপরস্পর-বিরোধিতার গুণগত ব্যাখ্যা করার বয়েস তখন না হলেও আজ খুব বিস্ময় লাগে তা ভাবতে। সেই জিনিসই কি গোটা বাংলার বুকে ঘটে গেল না?
‘নরমেধযজ্ঞ’ বা ‘নহুস উদ্ধার’ অভিনয় আমাদের একদিন সকলকেই মোহাবিষ্ট করত আজও বেশ মনে পড়ে। অভিনয়ে সুদখোর রতন দত্তের চাপে পড়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণ সিদ্ধার্থ তার শিশুপুত্র কুশধ্বজকে তুলে দিলেন রাজা যযাতির নরমেধযজ্ঞে বলি দেওয়ার জন্যে। এই দৃশ্য দেখে আমরা সেদিন জাতিধর্ম-নির্বিশেষে ডুকরে কেঁদে উঠেছি। লক্ষ করেছি আসরের আবহাওয়া মুহূর্তে পালটে গেছে শোকের গভীরতায়, কোনো দর্শকের চোখ সেদিন শুকনো ছিল না। অভিনয় সার্থক হয়ে যেন বাস্তবের রূপ পেত। আজ নহুসের কথাই বেশি করে মনে পড়ছে এইজন্যে যে তার প্রেতাত্মা কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছে শুনতে পাচ্ছি। তার উদ্ধারের জন্যে মানুষের রক্ত চাই,–সে রক্তক্ষরণ তো হল এই বিশ শতকের শেষার্ধে! এখনও কি আমার উদ্ধার আশা করা যায় না নহুসের সঙ্গে সঙ্গে? এত রক্ত কি বিফলে যাবে? আমার মনে হয়, এই যে বিচ্ছেদ আজ এসেছে তা মিলনেরই ভূমিকামাত্র। সীতা’ অভিনয়ে আমরাই তো জোরগলায় শ্রোতাদের শুনিয়েছি,
জননি আমার
হেন প্রশ্ন তুমি কর দেবী?
বাল্মীকির রাম-সীতা চির-অবিচ্ছেদ;
অন্তরে অন্তরে চিরন্তন
মিলনের প্রবাহ বহিছে।
মনে হয় এই মিলন-প্রবাহ অধুনা ক্ষীণ হলেও একদা প্রাণগঙ্গায় জোয়ার এসে সমস্ত ক্লেদ নিয়ে যাবে ভাসিয়ে। বাল্মীকি মহাকবি, তাঁর কথা মিথ্যে হতে পারে না। আমরা সে মিলনের জন্যে আগ্রহে প্রতীক্ষা করব। ‘আসিবে সে দিন আসিবে।’
হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, মাড়োয়ারি বলে আমাদের গ্রামে কোনো পার্থক্য দেখিনি। বহু মাড়োয়ারি এসে বাস করতেন ভেড়ামারায়, কিন্তু লক্ষ করেছি সবাই থাকতেন মিলেমিশে এক হয়ে। দেখেছি দু-পাঁচশো টাকা দরকার হলে চেয়ে আনত একজন অন্য আর একজনের কাছ থেকে। লেখাপড়ার কোনো দরকার হত না তার জন্যে। এই যে আত্মবিশ্বাস এর ওপরেই ছিল সেদিনকার প্রাত্যহিক জীবন। পরিশোধের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এই লেনদেনে কোনোদিন কোনো কলহবিবাদ দেখিনি আজকের মতো। এত সুবিধে-সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেউ কাউকে বড়ো একটা ঠকায়নি বা অবিশ্বাসের কোনো কাজ করেনি। পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করত, পরামর্শ দিত, পরামর্শ শুনত, পরামর্শমতো কাজও করত দ্বিধাহীনচিত্তে। সেখানে হিন্দু-মুসলমান বা মাড়োয়ারির গন্ডি টেনে জনজীবনকে কেউই সীমাবদ্ধ করত না। মাড়োয়ারি বন্ধুদের বাড়িতে প্রায়ই জুটত নিমন্ত্রণ। খাওয়াতে তাঁরা ছিলেন মুক্তপ্রাণ। বাড়িতে বেড়াতে গেলেও খাওয়ার ঘটা দেখে চোখ উঠত কপালে! তাঁদের ‘লাড়ু-মন্ডা-টিকরা’র স্বাদ এখনও ভুলতে পারিনি। সেই ঘিয়ে জবজবে খাবার এখনও জিভকে সরস করে তোলে সময় সময়! কোথায় সেদিন? কোথায় সেই মনের আত্মীয়তা? কোথায় সেই ভেড়ামারা?
অনেক সময় বাবাকে গ্রামের বাইরে যেতে হত দীর্ঘদিনের জন্যে। আমরা তখন ছোটো। মা থাকতেন একা অতবড়ড়া বাড়িতে আমাদের ক-জন নাবালককে নিয়ে। ক্ষুদিরামদাদা কিংবা ভবতারণ জ্যাঠার বাড়ি একটু দূরে ছিল বলে সব সময় খোঁজখবর নিতে পারতেন না তবু আমরা অসহায় বোধ করিনি কোনোদিন। সামনের রিয়াজুদ্দিন মন্ডল আর পাশের গৌরীশংকর আগরওয়ালা সর্বদাই খোঁজ নিতেন। আমাদের কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবস্থা করতেন। বাড়িতে পাহারা দিত জমিজমা তদারককারী আলিমুদ্দিন কিংবা কলিমুদ্দিন। তাদের আমি ‘দাদা’ বলে ডাকতাম। কোনোদিন তাই মনে হয়নি তারা মুসলমান বলে দূরের কেউ। তারা আমার অগ্রজতুল্য, যেখানেই থাকুক তারা সুখে থাকুক এই কামনাই করছি।
মনে পড়ছে এই আলিমুদ্দিনদা আর কলিমুদ্দিনদাই আমাদের প্রথম এসে বাধা দিয়ে ছলছল চোখে বলেছিল, ‘জমি-জায়গা বিক্রি করবেন না, বাবু! দেশ ছেড়ে কোথায় যাবেন? কতদিন থেকে আপনাদের খেয়ে আপনাদেরই কাছে পড়ে রয়েছি। এত সহজেই মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারবেন?’ কই তারা তো সম্প্রদায়ের গন্ডি টেনে আমাদের দূরে সরাতে চায়নি, রাজনীতির যূপকাষ্ঠে দেশকে দ্বিখন্ডিত করতে চায়নি, দেশের এবং জনগণের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে উৎসাহ দেখায়নি। তারা গ্রামের নির্বিরোধ নিরীহ প্রজা, তাদের সামনে লোভের মোহ নেই। তাই তারা কেঁদেছিল আমাদের চলে আসার সময়।
যাবার বেলা সকলেই পিছু ডেকেছে, বাধা দিয়েছে পিতৃভিটে বিক্রির বিরুদ্ধে। আত্মীয়-অনাত্মীয়েরা কেঁদেছে, মাড়োয়ারিদের মা-বউরাও স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছে। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখেছি আমার অতিপ্রিয়জনরা প্ল্যাটফর্মে করুণ মুখে, সিক্ত নয়নে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের চোখেই ফিরে আসার মিনতি। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছে–তোমরা তো চলে গেলে, আমরা কী করব? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। কাপুরুষের মতো মুখ লুকিয়ে এড়িয়ে গেছি সে-কথা। আজ ধিক্কার দিই নিজেকে,–জানি না যারা সেদিন এ প্রশ্ন তুলেছিল তারা আর কোথাও সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে কি না। জানি না আজ তারা কোন ক্যাম্পে মাথা গুঁজে মৃত্যুকে এড়িয়ে চলেছে? আমাদের বাড়ির বুড়ি ঝি এখনও কি বেঁচে আছে?
এখনও চোখ বন্ধ করলে, কান ঢাকলে শুনতে পাই রেলগাড়ি চলার শব্দ। সেদিন যে ট্রেন ভেড়ামার থেকে বাঁশি বাজিয়ে ছেড়েছে আজও যেন তার গতিরোধ হয়নি। জানি না নিরবধি কালের কোন পর্যায়ে সে আমাদের নির্বিঘ্নে স্টেশনে পৌঁছে দেবে,–সেই গতিহীন অনন্তযাত্রার সমাপ্তির রেখা কবে দেবে টেনে।
স্বপ্নে হঠাৎ হঠাৎ প্রায়ই যেন কানে আসে–’কোথায় যাবেন বাবু, এত সহজেই কি গাঁয়ের মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারবেন?’–চমকে উঠে বলি–আলিমুদ্দি-কলিমুদ্দি দাদা! তোমাদের কথাই ঠিক, তোমাদের মায়া কাটানো সোজা নয়, তোমরা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাও। আমাদের কথা কি আলিমুদ্দিনদাদাদের কানে কেউ পৌঁছে দেবে? আবার কি আমরা ফিরে পাব পল্লিজীবনের সেই মধুর পরিবেশ?
খুলনা – সেনহাটী শ্রীপুর ডাকাতিয়া
নদীর নাম ভৈরব। নদী নয়, নদ। কিন্তু ভৈরবের সে-রুদ্র প্রকৃতি এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে খুলনা জেলার গ্রামান্তে এই নদ একবার তার রুদ্ররূপ ধারণ করেছিল। দু-তীরের জনবসতি কুক্ষিগত করে নিয়েছিল সে উদ্দাম উত্তাল ভৈরব। তারপর আর নয়। মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতো সে পড়ে আছে পদপ্রান্তে, আমার গ্রাম সেনহাটীর পদপ্রান্তে। পূর্ববাংলার অন্যতম বিখ্যাত গ্রাম এই সেনহাটী। অনেক ইতিহাস বিজড়িত হয়ে আছে এর সঙ্গে। জনশ্রুতি আছে, বল্লাল সেন তার জামাতা হরি সেনকে ‘জামাইভাতিস্বরূপ এই গ্রামখানি দান করেছিলেন। হরি সেনই তার নাম রাখেন ‘সেনহাটী’। কবিরামের দিগ্বিজয়-প্রকাশ গ্রন্থে বলা হয়েছে লক্ষ্মণ সেন সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে যশোহরের কাছে ‘সেনহাটী’ নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে যাই হোক, ইতিহাসে আজ আর প্রয়োজন নেই। সেনহাটী আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।
সে গ্রামেরই ছেলে আমি। সেজন্যে আমি গৌরবান্বিত। গ্রামের দক্ষিণ দিকে ভৈরব নদ। এ গ্রামে প্রবেশের প্রধান পথ দক্ষিণ দিকেই। নদীপথে এলে গ্রাম-প্রবেশের যে প্রথম ঘাট, তার নাম ‘খেয়াঘাট’। স্কুলঘাট দিয়েও গ্রামে প্রবেশ করা যায়। সবচেয়ে বড়ো ও প্রশস্ত ঘাটের নাম ‘জজের ঘাট। এর কিছু দূরেই শ্মশান ও স্টিমারঘাট। জজের ঘাট থেকে শুরু করে একটি প্রশস্ত বাঁধানো রাস্তা গ্রামের হৃৎপিন্ড ভেদ করে যেন অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। গ্রামের মধ্যে এই জজের ঘাটটি সর্বজনপ্রিয়। বহুবছর ধরে গ্রামের তরুণদের বৈকালিক আড্ডার আসর ছিল এটি। ডালহৌসি স্কোয়ারে টেগার্টকে হত্যার চেষ্টায় বিফলকাম যে বিপ্লবী শেষে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছিল, সেই অনুজা সেন ও স্টেটসম্যান সম্পাদক ওয়াটসনকে হত্যার চেষ্টায় বিফল হয়ে যে বিপ্লবী প্রাণ দিয়েছিল–সেই অতুল সেন ও অন্যান কত সাহসী তরুণকে দেখেছি নদীঘাটের এই বৈকালিক আড্ডা থেকে বাজি রেখে হঠাৎ নদীগর্ভে ঝাঁপিয়ে পড়ে তরঙ্গসংকুল সুপ্রশস্ত ভৈরব-নদ পারাপার করছে। সে দুর্বার প্রাণচাঞ্চল্য আজ কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। এও মনে পড়ে নদীর অপর পারে পল্লিতে হঠাৎ একদিন নিজেদের ভেতর যখন দাঙ্গা বাধে তখন ওপার থেকে ভীত শিশু ও নারীর আর্তনাদ এপারে ভেসে আসতেই এপারের ছেলেরা নৌকার জন্যে কিছুমাত্র ইতস্তত না করে নির্বিচারে স্রোতবহুল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওপারে গিয়ে দাঙ্গাকারীদের শান্ত করে এসেছিল। এসব ঘটনা আজ মধুর স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক জীবনে সেনহাটীর নাম উল্লেখযোগ্য। সেই ‘হিন্দু স্বদেশি মেলা’র যুগের বিপ্লবী নেতা স্বর্গত হীরালাল সেন থেকে আরম্ভ করে শহীদ অনুজা ও অতুল পর্যন্ত সকলেই গ্রামে সাধারণ সরল জীবনযাপন করতেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ একবার বিপ্লবী হীরালাল সেনের পক্ষে সাক্ষ্য দেবার জন্যে খুলনার আদালতে হাজির হয়েছিলেন। হীরালালবাবু কিছুদিন রবীন্দ্রনাথের কোনো জমিদারির ম্যানেজার ছিলেন। এই সূত্রে তাঁকে সাক্ষী মানা হয়েছিল। বিশ্বকবি বিনা দ্বিধায় সেই বিপদের দিনে বিপ্লবী হীরালালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই মোকদ্দমায় হীরালালের জেল হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে তার পরিবারের তত্ত্বাবধানের সকল ব্যবস্থা করেছিলেন। সেনহাটীর অনতিদূরবর্তী ‘দৌলতপুর’ গ্রামে বিপ্লবী কিরণ মুখার্জি প্রতিষ্ঠিত সত্যাশ্রম’ আমাদের গ্রামের তরুণদের মনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেখানেই অনেক বিপ্লবীর প্রথম দীক্ষা। আশ্রমটির কার্যকলাপ বাহ্যত সমাজসেবায় পরিস্ফুট থাকলেও এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের গ্রামেও অনুরূপ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। প্রবুদ্ধ সমিতি’ প্রতিষ্ঠানটি এদের অন্যতম। শহীদ অনুজা ও অতুল এই সমিতির সভ্য ছিলেন। আজ মনে জাগছে এঁদের মতো কত নিঃস্বার্থ তরুণ-তরুণীর আত্মদানে এই দেশের স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু তাঁদেরই, ভাই, বোনেরা সব আজ একটু আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা। তাঁদের শত আবেদন-নিবেদনেও রাজমসনদে বাদশাজাদার তন্দ্রা টুটে যায় না।
বিভিন্ন শ্রেণির লোকের বাস সেনহাটী। খ্যাত, অখ্যাত বহু লোকের জন্মভূমি এই গ্রাম। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের তিনটি বিশিষ্ট বাড়ি কবিরাজবাড়ি’, ‘বক্সীবাড়ি ও ডাক্তারবাড়িতে পুজোর তিন রাত্রি যাত্রাগান হত। স্থানে স্থানে শৌখিন সম্প্রদায়ের থিয়েটার হত। ‘ভেনাস ক্লাব’, ‘বান্ধব’, ‘নাট্যসমিতি’ ‘ছাত্র নাট্যসমিতি’ এ তিনটি শৌখিন নাট্য সম্প্রদায় তাদের অভিনয় নৈপুণ্যে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিল। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি এস, আর, দাশগুপ্ত, ব্যারিস্টার নীরদ দাশগুপ্ত প্রভৃতি ‘ভেনাস ক্লাবের’ সভ্য ছিলেন। এঁদের অভিনয় কৃতিত্বের কথা আজ গ্রামবাসীরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। নাট্যকার শচীন সেনগুপ্তও গ্রামের লোক। তিনিও এ গ্রামে কয়েকবার কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
এইসব যাত্রা, থিয়েটারে কত মুসলমান হিন্দুর পাশে বসে গান শুনতেন। কত মুসলমান ‘ধ্রুব’, ‘প্রহ্লাদে’র দুঃখে বিগলিত হতেন, ‘সীতাহরণ’ দেখে ক্রুদ্ধ হতেন। আজ সেইসব সরল প্রাণ গ্রামবাসী মুসলমান প্রতিবেশীরা কোথায়? বিজয়াদশমীর দিন সন্ধ্যায় নদীর তীরে অভূতপূর্ব দৃশ্যের সমাবেশ হত। প্রায় পঞ্চাশখানা প্রতিমা সারি সারি জোড়া নৌকার বুকে বাজনার তালে তালে নেচে বেড়াত। স্টিমারে করেও অনেক দর্শক আসত প্রতিমা বিসর্জন দেখার জন্যে। অসংখ্য নৌকার বাজনাদারদের বাজনার দাপটে ও নৌকা-স্টিমারের ভিড়ে এক মাইলব্যাপী নদী-পথে ‘সামাল সামাল’ রব পড়ে যেত। সমস্ত জায়গা জুড়ে একটা নৌযুদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টি হত। তারপর ‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে’ বিষণ্ণ চিত্তে সবাই ঘরে ফিরতেন। দশমীর প্রীতি আলিঙ্গনে পরিবেশ মধুর হয়ে উঠত।
ব্যাবসায়িক জীবনেও সেনহাটীর নাম ছিল উন্নত। গ্রামটি নদীতীরে অবস্থিত বলে নানাদেশের পণ্য, বিশেষ করে সুন্দরবন থেকে আনীত বহু জিনিস এখানে ক্রয়-বিক্রয় হত। গ্রামের প্রধান বাজারটি নদীতীরেই বসত–এ ছাড়া কয়েকটি হাট সপ্তাহে দু-একদিন গ্রামের অন্যত্র বসত। ক্রেতা-বিক্রেতারা বিভিন্ন শ্রেণির হলেও কিছু সময়ের জন্যে হিন্দু-মুসলমান সকলেই মিলেমিশে এক পরিবার বনে যেতেন—’খুড়ো’, ‘ভাই’ ‘দাদা’ সম্বোধনের পরিবেশে বিভিন্ন শ্রেণিগত লোকের এরূপ আন্তরিক মিলন আর কখনো সম্ভব হবে কি না কে জানে। এই হাট-বাজারেই গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশের সুখ-দুঃখের, আশা-নিরাশার কথা হত। সেসবই আজ স্বপ্ন বলে মনে হয়।
গ্রামের কয়েকটি প্রাচীন কীর্তি উল্লেখযোগ্য। সদ্ভাবশতক-এর অমর কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে বাসুদেব মূর্তি এক অতিপ্রাচীন কীর্তি। মূর্তিটি কষ্টিপাথরের বলে মনে হয় এবং উচ্চতায় হবে দু-ফুট, মূর্তির মাথায় কিরীট, পরিধানে আজানুলম্বিত কটিবাস, গলায় কটিদেশাবলম্বী বক্ষোপবিত ও আজানুলম্বিত বনমালা। দক্ষিণাধঃ-হস্তে পদ্ম, দক্ষিণোর্ধ্বে গদা, বামোর্ধ্বে চক্র ও অপর বামহস্তে শঙ্খ এবং দক্ষিণপার্শ্বে পদ্মহস্তা শ্রী ও বাম-পার্শ্বে বীণাহস্তা পুষ্টি দন্ডায়মানা। মূর্তির পদনিম্নে গরুড় ও গরুড়ের দক্ষিণে দুটি ও বামে একটি অপরিচিত মূর্তি। এই মূর্তি কোন সময়ে, কোথা থেকে, কার দ্বারা কীভাবে আনীত হয়েছিল সে-সম্বন্ধে কিংবদন্তি আছে।
সাড়ে চারশো বছর আগে সেনহাটী গ্রামের নরহরি কবীন্দ্র বিশ্বাস কামাখ্যাধিপতির রাজধানীতে কিছুদিন দ্বারপন্ডিত নিযুক্ত ছিলেন। এই সময় তিনি কামাখ্যা মহাপীঠস্থানে উৎকণ্ঠ তপস্যা করে মহামায়ার কৃপায় লক্ষ্মীদেবীর মূর্তিসহ বাসুদেব মূর্তি লাভ করেন। কিন্তু মায়াতরীযোগে গৃহে ফিরে এসে বাসুদেবের মূর্তি পূর্বে গৃহে নিয়ে যাওয়ায় লক্ষ্মীদেবী নৌকাসহ অন্তৰ্হিতা হয়ে যান এবং কবীন্দ্র আকাশবাণী শুনতে পান–আমাকে উপেক্ষা করে তুমি আগে ঠাকুরকে ঘরে নিয়ে গেছ–আমি তোমার ঘরে আর যাব না। তুমি ঠাকুরকে ভালোবাস, তাঁকেই পূজা করো–তাতেই তোমার মঙ্গল হবে। সেই থেকে বাসুদেবের মূর্তিটি সেনহাটীতে পূজিত হয়ে আসছে।
সেনহাটীর দ্বিতীয় প্রাচীন কীর্তি ইতিহাস-বিখ্যাত মহারাজ রাজবল্লভ নির্মিত একটি শিবমন্দির, একটি রাসমঞ্চ ও তাঁর খনিত একটি দিঘি। সাধারণের চক্ষে এসবের মূল্য অল্প হলেও ঐতিহাসিকের নিকট এর যথেষ্ট আদর আছে। কারণ মোগল স্থাপত্যের আদর্শ অনুকরণে রাজবল্লভ তাঁর বাসভূমি রাজনগরকে যে-সকল কারুকার্যময় বিবিধ সৌধ, সপ্তরত্ন ও শতরত্ন নামক বিশাল বিরাট মঠাদির দ্বারা সজ্জিত করেছিলেন, কীর্তিনাশা পদ্মার বিরাট গ্রাসে পড়ে তা চিরদিনের জন্যে লোকচক্ষুর অগোচর হয়েছে। সুতরাং রাজবল্লভ নির্মিত সৌধাবলির গঠনপ্রণালী ও বাঙালির কলাকুশলতার ও স্থাপত্য নৈপুণ্যের সাদৃশ্য অনুভব করতে হলে এই দুটি থেকে তার কতক পরিচয় পাওয়া যাবে।
সেনহাটীর তৃতীয় প্রাচীন কীর্তি ‘শিবানন্দ’ ও ‘সরকার ঝি’ নামক দুটি প্রাচীন দিঘি। দ্বিতীয় দিঘিটির নামকরণ কাহিনিটি বড়োই করুণ ও মর্মস্পর্শী। এ সম্বন্ধে জনশ্রুতি এই যে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে যশোহর মৃজানগরে নূরউল্লা খাঁ নামক একজন ফৌজদার ছিলেন। তাঁর সৈন্যসামন্তের ভার ছিল তাঁর জামাতা লাল খাঁর হাতে। যুবক লাল খাঁ অত্যন্ত উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির লোক ছিল। লাল খাঁর অত্যাচারে গৃহস্থ বধূগণ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন। অবশেষে তার অত্যাচার চরমে ওঠে। তার পাপদৃষ্টি নূরউল্লার হিসাবনবীশ রাজারাম সরকারের বিধবা কন্যা সুন্দরীর ওপর পড়ে। তাকে লাভ করবার জন্যে লাল খাঁ নূরউল্লার অনুপস্থিতিতে বৃদ্ধ রাজারামকে কারারুদ্ধ করে–তারপরে তাঁর ওপর ভীষণ অত্যাচার করতে শুরু করে।
সুন্দরী অল্পবয়স্কা হলেও বুদ্ধিমতী ছিলেন। পিতার নির্যাতনের সংবাদ জানতে পেরে তিনি লাল খাঁর প্রস্তাবে সম্মতির ভান করে বলে পাঠালেন–”আমার পিতাকে ছেড়ে দিলেই আপনার প্রস্তাবে সম্মত হতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তার পূর্বে আমি আমার পিত্রালয় সেনহাটীতে একটি পুকুর কাটিয়ে সাধারণের কিছু উপকার করতে চাই, আপনি সেই বন্দোবস্ত করে দিন। সুন্দরীর কথা সত্য মনে করে লাল খাঁ আহ্লাদে উৎফুল্ল হয়ে উঠল ও বহুসংখ্যক চেলার দিয়ে সুন্দরীকে সেনহাটীতে পাঠিয়ে দিল। এদিকে মৃজানগর থেকে যাবার সময় সুন্দরী পিতাকে সংবাদ পাঠালেন–’শুধু সময় ক্ষেপ করবার জন্যে এই কৌশল অবলম্বন করেছি। ফৌজদার সাহেব বাড়ি এলেই তাঁকে সব জানিয়ে মুক্ত হবার চেষ্টা করবেন। যদি মুক্ত হন তবে অবিলম্বে বাড়ি চলে যাবেন। আর যদি না পারেন, তবে শিক্ষিত পারাবত ছেড়ে দেবেন। পারাবত দেখলেই আমিও আমার সম্মান রক্ষার জন্যে যথাকৰ্তব্য করব।’
যথাসময়ে লোকজন সেনহাটীতে পৌঁছে দিঘি খনন করতে থাকে। ক্রমে বহুদিন অতিবাহিত হয়ে যায়। সুন্দরী পিতার কোনো সংবাদ না পেয়ে উৎকণ্ঠিতা হয়ে পড়লেন। এদিকে দিঘির খননকার্য শেষ হওয়ায় তা উৎসর্গের আয়োজন করা হল। এই উপলক্ষ্যে সুন্দরী যখনই ওই দিঘির জলে অবতরণ করলেন, এমন সময় পিতার শিক্ষিত পারাবতটি উড়ে এসে তাঁর কাঁধে বসল। পারাবত দেখে তাঁর প্রাণ উড়ে গেল–মুহূর্ত মধ্যেই তিনি আপন কর্তব্য স্থির করে নিলেন। নিজের মর্যাদা রক্ষার জন্যে সন্তরণচ্ছলে তিনি দিঘির গভীর জলে গিয়ে ডুব দিলেন–আর উঠলেন না!
এদিকে কিছুদিন আগেই ফৌজদার সাহেব দেশে ফিরে লাল খাঁর অত্যাচারের কথা শুনে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করে রাজারামকে মুক্তি দিয়েছেন। কারামুক্ত রাজারাম জন্মভূমি সেনহাটীতে ফিরে আসবার অভিপ্রায়ে যখন অশ্বারোহণ করতে যাবেন–ঠিক তখনই তাঁর শিথিল বস্ত্র থেকে শিক্ষিত পারাবতটি উড়ে যায়। বিপদ বুঝে রাজারাম তখনই বেগে অশ্ব ছুটিয়ে দেন। কিন্তু যখন নিজ বাসভূমি দিঘির পাড়ে এসে তিনি উপস্থিত হলেন, তখন দেখেন সব শেষ হয়ে গেছে। কন্যাস্নেহ-কাতর বৃদ্ধ রাজারাম আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে দিঘির জলে ঝাঁপ দিয়ে কন্যার অনুগমন করে সকল জ্বালা থেকে মুক্তিলাভ করলেন।
‘সরকার ঝি’ সুন্দরী বহুকাল এ মরধাম ত্যাগ করে গেছেন। তাঁর বাসভূমির চিহ্ন পর্যন্ত লোপ পেয়েছে। কিন্তু তাঁর খনিত দিঘি ‘সরকার ঝি’ আড়াইশো বছর ধরে গ্রাম্য বালক বালিকা, পল্লির যুবতী ও বয়োবৃদ্ধার হৃদয়ে তাঁর স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছে–তাঁর দুরদৃষ্টের করুণ কাহিনি শুনতে শুনতে এতকাল ধরে তাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু হাল আমলে শত শত সেনহাটীবাসীকে ঘর হারিয়ে যে সর্বহারা হতে হল তাদের জন্যে আজও যারা সেনহাটীতে আছে তাদের কেউ একফোঁটা চোখের জলও কি ফেলছে?
.
শ্রীপুর
বান এসেছে ইছামতীতে। জল নয়, প্রাণের বন্যা। উপনিবেশের সন্ধানে যশোহর থেকে রওনা হয়েছিল একদল লোক রাজা প্রতাপাদিত্যের মৃত্যুর পর। সে দলের নেতা রাজা ভবানী দাস দেশ খুঁজতে এসে থমকে দাঁড়ালেন এখানে ইছামতী আর যমুনার তীরে। এদিকে সাহেবখালির একটু দূরে রায়মঙ্গল। বিস্তীর্ণ বনভূমি ছিল সেদিন। তাঁবু ফেললেন রাজা ভবানী দাস। প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল ইছামতীর তীরভূমি। মানুষের হাতে বনজঙ্গল সাফ হল। গড়ে উঠল সুন্দর এক গ্রাম। শ্রীহীন বনভূমি মানুষের উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়ে নতুন নাম পেল শ্রীপুর। ধীরে ধীরে মধ্যযুগের শাসন শেষ হয়ে এল শ্রীপুরে। এল ইংরেজ। বণিক-সভ্যতার আওতায় প্রকৃতির সন্তানেরা উঠল হাঁপিয়ে। গ্রামে এসে প্রবেশ করল রেলগাড়ি। কাঁচের বিনিময়ে নিয়ে গেল কাঞ্চন। শুধু শ্রীপুর নয়, বাংলাদেশের অনেক বর্ধিষ্ণু, উন্নত গ্রামই এমন করে বণিক সভ্যতার শোষণে পর্যুদস্ত হয়ে গিয়েছে। তবু বাংলাদেশের মানুষ মরেনি। শ্রীপুরও মরেনি। কিন্তু আজ ষড়যন্ত্রের চাপে বাংলাদেশেও লক্ষ গ্রামের মতো শ্রীপুর থেকেও শরণার্থীর বেশে মানুষের দল সীমান্ত অতিক্রম করে আবার আসছে নতুন উপনিবেশের আশায়। কোথায় মিলবে সে আশ্রয় কে জানে?
খেয়াঘাট থেকে কালো মাটির পথটা গ্রামের মধ্যে পাকা রাস্তায় গিয়ে মিশেছে–দু-পাশে সাজানো গাছের সারি, চর শ্রীপুর আর পাটনি পাড়ার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে গোপখালি নদী। ছোট্ট কুলটা দূর থেকে দেখা যায়–আরও, আরও একটু দূরে ঐতিহাসিক মজুমদার বাড়ি চোখে পড়ে। এঁদের দাপটে নাকি একদিন বাঘে-গোরুতে একই ঘাটে জল খেত। মজুমদার বাড়ির কোল বেয়ে এক সড়ক চলে গেছে দাদপুরের মধ্য দিয়ে সোজা। দু-পাশে খেজুর গাছ আর ধানখেত। আর ওই তো, অদূরে পাতনার বিল-যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু বিলই চোখে পড়ে। সন্ধের পর এই বিলের ওপর দিয়ে লোক চলাচল করে না। গা ছমছম করে। রাত্রে কারা যেন ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ায় খটাখট খটাখট। বোসপুকুর আর মুচিপোতা লোকশূন্য। আজও মায়েরা ছেলেদের ভয় দেখিয়ে বলতেন, মুচিপোতার স্কন্ধকাটাকে ডাকব। চল চল বোসপুকুরধারে তোকে দিয়ে আসি। ঝোপেঝাড়ে বনেজঙ্গলে ভরে গেছে এর সবদিক সন্ধের পর যে-কোনো অতিসাহসী ব্যক্তিরও বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
সরকার পাড়ার পাশ কাটিয়ে লাল সড়কের পথ–এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্ত অবধি চলে গেছে। এ পথ চলে গেছে যেন কোনো এক অজানা পথের ডাক দিয়ে। সরকারদের দাপট একদিন ছিল–চৌধুরিরাও বড়ো কম যেতেন না। মিউনিসিপ্যালিটি, ডাকঘর, উচ্চ ইংরাজি ও মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়, মেটারনিটি হোম, বাঁধা থিয়েটার স্টেজ কিছুরই অভাব নেই। কত ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এই আদর্শ গ্রাম।
একটা গ্রামে এমন শিক্ষার ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, বাঁধানো স্টেজ, চিকিৎসালয়, ক্রীড়াব্যবস্থা আর কোথায় দেখতে পাওয়া যায়? আশা ও অনুরাগের স্বচ্ছন্দ গতিপ্রবাহ নিয়ে এগিয়ে চলছিল এই জীবন। স্যর পি. সি. রায় এই গ্রামকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে এসে তিনি বাস করতেন এখানে। তিনি ভালোবেসেছিলেন ইছামতাঁকে, ইছার জলকল্লোল তাঁকে ডাক দিত, আর এর শ্রী তাকে দিত হাতছানি–এ গ্রামেই পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম।
তবু চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে কেন? দূরের রাঙাদির চরটা যেন ঝাপসা বলে মনে হয়। সাহেবখালি আর ইছামতী যমুনার সঙ্গমস্থলে দীর্ঘ মাইল চর বনজঙ্গলে ছেয়ে আছে, কেউ কেউ বলে রানিচর। গভীর রাত্রে কার যেন কান্না শোনা যায়।
অনেক পিছনে দৃষ্টি যায় ফিরে। প্রতাপের সঙ্গে যখন মোগলদের চলছিল লড়াই, জয়লাভের যখন কোনো আশাই ছিল না তখন প্রতাপের নির্দেশে নাকি সেনাপতি রডা পুরনারীদের জাহাজে করে এনে এখানে ডুবিয়ে দেয়। তারপরই এই চরের জন্ম–তাই লোকে বলে রানিচর। এ কাহিনির সত্য-মিথ্যা নিয়ে কেউ তর্ক করে না। কত, কতদিন এই চরে এসেছি, এর বনের মধ্যে পথ করে চলতে আনন্দ পেয়েছি। কত অজানা জীবজন্তুর হাড় পেয়ে অবাক হয়ে বিচিত্র পৃথিবীর কথা ভেবেছি। আরও, আরও কিছু পাওয়ার আশায় যেন অধীর আগ্রহে ছুটে চলেছি সামনের দিকে।
মেঘ জমেছে–কালবৈশাখীর প্রচন্ড দাপট বুঝি সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যাবে। ভয়ে নৌকা করে পালিয়ে এসেছি তরঙ্গবিক্ষুব্ধ নদীর বুক বেয়ে। অজানা আনন্দে মনটা উঠেছে ভরে। ঝড় আসে তার অমিত শক্তিবেগ নিয়ে। নদী গর্জে গর্জে ওঠে–আছড়ে পড়ে তীরের ওপর–তীরের মাটি ধসে পড়ে নদীর বুকে–সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় নৃত্য করে নদী। কত চালা যায় উড়ে, কত জীর্ণ প্রাচীর যায় ধসে, কত বাগানে কত গাছের ডালপালা যায় ভেঙে, দুর্ভাবনার অন্ত থাকে না সাধারণের। ঝড়ের গতিবেগ ক্রমে থেমে আসে। নামে বৃষ্টি। বছরের প্রথম বর্ষা। পড়শির ছেলেরা মনের আনন্দে খেলা করে সেই জলধারার সঙ্গে। জোরে জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘এই বৃষ্টি ধরে যা, লেবুর পাতা করমচা।’ জেলেরা জাল কাঁধে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে। গ্রীষ্মের দাপটে অস্থির চঞ্চল মানুষের চিত্ত শান্ত হয়। ছেলেরা আম কুড়োতে বেরোয়–আমিও তাদের দলে ভিড়ে গেছি কতদিন। গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ পৃথিবী শীতল হয়। তৃষিত মৃত্তিকা জল পায়। গাছের একটা ভাঙা ডালে বসে চাতক তখন ডাকে –’দে ফটিক জল।’ কিষাণ লাঙল ঠিক করে। চাষের সময় হয়ে এসেছে। মেঘভরা আকাশ–সেদিকে চেয়ে তাদের চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সামনে বর্ষা!
মর্নিং স্কুল। খুব ভোরে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ। বোসপুকুরকে পেছনে রেখে, ঘোষের বাড়ির পাশ দিয়ে সদর বিলের ওপর দিয়ে স্কুল যাওয়ার সে আনন্দ কোনোদিন ভুলবার নয়। পথে যেতে যেতে আমরা বকুল ফুলের মালা গাঁথি, কোনো কোনো দিন ছুটির পর মনে হয় : মাস্টারমশাই যেন কী? একটু দেরি হলেই কি মারতে আছে! মালা গাঁথতে যে দেরি হয়ে গেল। সূর্য তখন তালগাছের মাথার ওপর। পাগলা তালের রস পাড়ছে! মাথাভাঙা খেজুর গাছটায় বসে একটা দাঁড়কাক ডাকছে। কী যেন আনন্দ, কী যেন অনুভূতি, হঠাৎ ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আস্তে আস্তে বলেন, গ্রীষ্মের ছুটি ক-দিন দিল রে? একমাস বুঝি? হ্যাঁ, একমাস। কী আনন্দ। কাঁঠাল, আম, জাম, জামরুলের সময়। যাদের গাছ আছে তারা অনেক খাবে। আমাদের তো কোনো গাছ নেই। শিশুমন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দূর-বোসেদের বাগানের আম রাখব নাকি? সব ঢিলিয়ে পেড়ে নেব। তাড়া করলে দে ছুট। একে তো আর চুরি বলে না?
বর্ষা আসে তার কেশপাশ এলিয়ে-দুলিয়ে। মেঘভার আকাশ, মাঝে মাঝে মেঘের ডাক– শিশুমনে ভীতির সঞ্চার করে। মেঘমেদুর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে কী আনন্দ না জাগে! অঢেল বর্ষা। এ বর্ষা বুঝি থামে না। মাঠঘাট ডুবে যায়, জলা-ডাঙা সব এক হয়ে যায়। ছেলেরা মাছ ধরতে যায়। জলে উজান নিয়ে মাছ উঠছে। মাছ ধরার আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। বর্ষাঘন সন্ধ্যা। ঝিল্লির ডাকমুখর সন্ধ্যা। বাগানের কোনো কোণে একটা বিরহী পাখি যেন ডাকছে–বউ কথা কও। রাত্রি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ ফিকে হয়ে আসে–ক্রমে আকাশ পরিষ্কার হয়। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে চারিদিক। নীল নিবিড় আকাশে জ্যোৎস্নার অনন্ত উচ্ছ্বাস। সেদিকে তাকিয়ে কত কী ভাবি। আকাশের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক। নাড়ির সম্পর্কের চাইতেও যেন গভীর। এই সম্পর্ক অনন্ত জীবনের সঙ্গে জীবনের। নদনদী, গাছপালা সবই যেন ধরা দেয়। কবে কোন অতীতে যুগ-মধ্যাহ্নে কোন তাপস কোন বৃক্ষের তলায় তপস্যা করে হয়েছিলেন ঋষি জানি না। আবার কত মানুষ শুধু পথ চলেছে– পথ, পথ আর পথ, তাদের পথ চলার সঞ্চয় রেখে গেছে ভাবীকালের জন্যে। কত ঘুমভাঙা রাত্রি তারা জেগে কাটিয়ে দিয়েছে। মনে হয় তেমন রাত্রি যেন বারবার আসে, আসুক মহাজীবনের আহ্বান জানিয়ে–আসুক, স্বপ্নের বেসাতি নিয়ে। আসুক রঙিন ফানুস হয়ে, তবু আসুক।
চাষিরা চাষ করে। জেলেরা জাল ফেলে। পাটনিরা খেয়া পারাপার করে, কুমোররা তৈরি করে হাঁড়ি-কলসি। মধুসূদনের বাজার বসে, সবাই একহাটে এসে কেনা-বেচা করে। মাঝে মাঝে গ্রামপ্রান্তে মেলা বসে। মেলায় গিয়ে কতদিন নাগরদোলায় চড়েছি। পুতুল খেলা দেখেছি। সীতার দুঃখ দেখে চোখের জল ফেলেছি। লক্ষ্মণ-ইন্দ্রজিতের যুদ্ধ দেখে অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। মেলায় যাত্রাগান হয়। দেশ-দেশান্তর থেকে যাত্রাদল আসে। অভিমন্যুর বীরত্ব দেখে হাততালি দিয়েছি। মনে মনে ভাবি, আমি যদি অভিমন্যু হতাম। দলু দত্তর গান শুনেছি– এম এ বি এ পাস করে সব মরছে কলম পিষে; বলি, বাঙালি বাঁচবে আর কীসে? মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে আসি। কত আনন্দ ছিল সেদিন।
খেলার ধুম পড়ত। কেদার-মাঠে ফুটবল খেলার শেষে সবাই ইছামতীর ধারে বেলতলাঘাটে গিয়ে বসি। জ্ঞানদার দোকানে ভিড় করি। চায়ের দোকানটা ভালোই চলে। গান চলে, গল্প চলে। পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারাটা কেবলই জ্বলে। ওপারের আলো চোখে ভাসতে থাকে। ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বাজে।
পুজোর কটা দিন চলে যায়। বিজয়ার দিন কীসের বিয়োগব্যথায় যেন সকলের চোখে জল নেমে আসে। নদীর বুকে ভাসে হাজার হাজার নৌকা বাইচ খেলা হয়; বাজি ফোটে। কত আনন্দ অথচ কত দুঃখে মানুষের মন ভারী হয়ে ওঠে। বিজয়ার শেষে সবাই আসে–সবাই আলিঙ্গন করে সবাইকে। রাত্রিতে বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়াই। বিপ্লবী দাদাদের কথা মনে পড়ে। আজ তারা কোথায়? যিনি আমাকে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন সেই শচীন সরকারই বা কোথায়?
শীতকালের কথা বেশ মনে পড়ে।
গ্রামবাসীদের শীতের পোশাক বড়ো জোটে না। তাই ভোরবেলা তারা গাছের পাতা বিশেষ করে নোনাপাতা জোগাড় করে আনে, তাই দিয়ে আগুন করে। তারা আগুনের চারপাশে এসে ভিড় করে বসে। আগুন পোহায়।
এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমার পূর্বপুরুষ যারা এই উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল আজ তাকে ছেড়ে যেতে হবে আবার নতুনের সন্ধানে। আবার যে নতুন উপনিবেশ গড়ে উঠবে তাকে এমনই আপনার করে আর পাব কি?
.
ডাকাতিয়া
বাংলার গ্রাম আজ কথা বলেছে; নিজের কথা, লক্ষ লক্ষ সন্তানের কথা। শুনে মনে জাগছে। আমারও জননী-জন্মভূমি ছেড়ে আসা গ্রামে’-র হৃদয় নিঙড়ানো স্মৃতি। বাংলাদেশের লক্ষ গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম। যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি সে-গ্রামকে ভুলতে পারি না। সে-গ্রামের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক, আমার নাড়ির টান। বহুদূরে পশ্চিমবাংলার উপান্তে এই মফসসল শহরে বসে আকাশ আর মাটির নীরব ভাষা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি। এখানেও গ্রামের মানুষকে আপন করে নিয়েছি। এরাও আমাকে আর শরণার্থী ভাবে না। আমি যেন এদেরই একজন। তবু কোনো এক বৃষ্টি ঝরা অলস অপরাহ্নে পশ্চিমবাংলার রৌদ্র-রুক্ষ এই অবারিত প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে মন চলে যায় বহুদূরে সেই সুদূর পূর্ববাংলায় স্নিগ্ধ ছায়ানিবিড় আমার জন্মভূমি ছেড়ে-আসা গ্রামের সেই নদী মাটি আর আকাশের আঙিনায়। মন বলে : যাই, আবার যাই।
ভাবি, আর কি ফিরে যেতে পারব না আমার ছেড়ে আসা মায়ের কোলে মা–আমার মাটির মা–সত্যিই কি পর হয়ে গেল আজ? মন মানতে চায় না। অব্যক্ত ব্যথায় ভাবাতুর হয়ে ওঠে। সহস্র স্মৃতি-সৌরভে জড়ানো মায়ের স্নিগ্ধ শ্যাম-আঁচলের পরশ কি আর এ জীবনে পাব না? লালাটে তাঁর সব ব্যথা-ভোলানো স্নেহ-চুম্বন আর কি সম্ভব নয়?
ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমাতে হল–এ কার অমোঘ বিধান? ঘরছাড়া মানুষ কি আর ফিরবে না ঘরে–তার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে? শরণার্থীর বেশে মানুষ আসছে দলে দলে–দেহ ক্লান্ত-মন বিষণ্ণ–দু-চোখে অশ্রুর প্লাবন। জোলো হাওয়ার দেশের ভিজে মাটির সবুজ তৃণলতা এরা; শেকড় উপড়ে কঠিন মাটির দেশে এদের বাঁচাবার যে চেষ্টা চলছে তা কি সফল হবে? প্রাণরসের অভাবে শুকিয়ে যাবে না কি ভাবী যুগের সোনার ফসল?
দিগন্ত ছোঁয়া বিলের একপাশে ছোটো সেই চাষিপ্রধান গ্রাম। বিলভরা অথৈ জল। সবুজের সমুদ্র-ধানগাছের ওপর বাতাস দিয়ে যায় ঢেউ-এর দোলন। মাঝে মাঝে শাপলা কচুরিপানার ফুল; নল-হোগলা-চেঁচো বন। বিলের ওপরে ওড়ে বক, পানকৌড়ি, গাংশালিক, ক্ষণে ক্ষণে লাফিয়ে চলে গঙ্গাফড়িং।
আশ্বিন-কার্তিকে সোনার রং লাগে মাঠে মাঠে-লক্ষ্মীর অঙ্গের আভা ওঠে ফুটে। অঘ্রানে পৌষে দেবীকে বরণ করে চাষিরা তোলে ঘরে। তাঁর দেহের সৌরভে বাতাস মধুময় হয়ে ওঠে। পথে-ঘাটে-মাঠে ঘরের আঙিনায় নতুন ধানের প্রাণ-মাতানো সুবাস। ঘরে ঘরে আঁকা হল আলপনা, চলল উৎসব–নবান্ন, পৌষ-পার্বণ-নারকেল-নলেন গুড়ের গন্ধে ভুরভুর চতুর্দিক। চাষির ঘরে দারিদ্র্য আছে, কিন্তু অলক্ষ্মী নেই। দিঘল ঘোমটা-টানা ছোটো ছোটো বধূরাও জানে বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীকে মাটির ঘরে বেঁধে রাখবার মন্ত্র। তাদের ডাগর ডাগর কালো চোখের সরল চাউনি–আজও যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
নৌকা-ডোঙা নিয়ে বিলের বুকে আনাগোনা করে ছেলে থেকে বুড়ো সবাই। ধরে মাছ, ধরে পাখি, কাজকর্মের অবসরে। মাছ নইলে ওদেরও মুখে অন্ন রোচে না। এপারে ফুলতলা আর ওপারে দৌলতপুর স্টেশন। রেলগাড়ির যাওয়া-আসা দেখে চাষিরা সময়ের ঠিক করে নেয়। ওরা বলে ৫টার গাড়ি, ৮টার গাড়ি, ১২টার গাড়ি। অসময়ে যায় মালগাড়ি। রেলগাড়ি চলে দেশ হতে দেশান্তরে, চাষিরা মাঠ থেকে, চাষি-বউরা ঘাট থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যন্ত্রদানব ধূম উদগিরণ করতে করতে চলে গেল। কোথায় কোন দেশে গেল কে জানে?
রেললাইন পার হয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা সড়ক মুসলমান পাড়ার মধ্য দিয়ে চলে গেছে। জোলা পাড়ার তাঁতগুলো চলছে ঠকঠকঠক। দু-পাশ থেকে বাঁশঝাড় নুয়ে পড়ে প্রায় সারাপথটাই ঢেকে রেখেছে। বাঁশপাতা পচা একটা সোঁদা গন্ধ নাকে আসে।
‘বাবু, দ্যাশে আলেন নাহি?’–মুসলমান চাষি সহজ সৌজন্যে কুশলপ্রশ্ন করে। সৈয়দ মুনশির বাড়ির কাছে এলে ওষুধের তীব্র কটুগন্ধ নাকে আসে। উনি কবিরাজিও করেন, আবার মাস্টারিও করেন। এঁর কাছেই আমার জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ। সদা হাসিমাখা মুখ–শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। মাস্টারি ও কবিরাজি ওঁর উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া। ওঁর বাবা ছিলেন রহিম মুনশি, তখনকার দিনের জি. টি. পাস। দীর্ঘদেহ রাশভারী লোক ছিলেন। আমাদের গ্রামে ছোটো ছেলেপুলের কিছু হলেই এঁদের ডাক পড়ত। ভিজিটের কোনো দাবি ছিল না দেওয়ার কথা কারুর মনেও হত না। তবে বাড়ির ফলটা তরকারিটা দেওয়া হত প্রায়ই। আজও যেন তাঁদের আত্মার আত্মীয় বলে মনে হয়। হিন্দু-মুসলমান এতদিন আমরা পাশাপাশি বাস করেছি ভাই-ভাইয়ের মতন–চিরকাল সকলের সঙ্গে একটা আত্মীয়তার যোগ অনুভব করেছি। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি জমি চাষ করেছি; এ আলের ওপর একদল খেয়েছে পান্তা –আর একদল করেছে নাশতা। কল্কে চাওয়া-চাওয়ি করে তামাক খেয়েছে। কুস্তি, খেলা, আড়ং-এ সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করত–আবার কবিগান, জারিগান, গাজির গান, রামায়ণ গান–সব কিছুরই রস উপভোগ করত রাত জেগে পাশাপাশি বসে। আর আজ?
মুসলমানপাড়া ছাড়ালেই আম-কাঁঠাল-তাল-খেজুরের ভিটে পড়ে আছে। কোথা থেকে ঘুঘুর একটানা উদাস ডাক কানে ভেসে আসে। কোকিল ডাকে। কখনো-বা শোনা যায়, ‘চোখ গেল, চোখ গেল’, মন উধাও হয়ে যায় যেন কোন স্বপ্নরাজ্যে। সরষে ফুলে, তিল ফুলে মাঠ গিয়েছে ছেয়ে। ফিঙে লাফায় ফুলে ভরা বাবলা গাছে। বনফুলের গন্ধে উতলা মেঠো হাওয়া দেহে বুলোয় মায়ের হাতের পরশ। দূর থেকে দেখা যায় ঠাকরুনতলা। বিশাল এক বটগাছ–অসংখ্য ঝুরি নেমেছে বিরাট বিরাট ডালপালা থেকে। সর্বজনীন দেবস্থান। গ্রামের সাধারণ ক্রিয়াকর্ম যা কিছু এখানেই হয়ে থাকে। গাজন, কালীপুজো আরও কত কী। এই ঠাকরুনতলার এক পাশে ছিল আমাদের সৈয়দ মুনশির পাঠশালা। বটগাছের শীর্ষদেশে বংশানুক্রমিক সন্তান-সন্ততি নিয়ে কয়েকটা চিল বাস করত–অন্যান্য ডালপালায় কোটরে থাকত আর সব নানা জাতের পাখি। শেষরাতে চিলের ডাকে পল্লিবধূরা রাতের শেষপ্রহর জানতে পেরে শয্যাত্যাগ করত। তারপর ছড়া, ঝাঁট, প্রাতঃস্নান প্রভৃতি থেকে দিনের কাজ হত শুরু। আর পুরুষেরা লাঙল-গোরু নিয়ে ছুটত মাঠে।
ছোট্ট গ্রাম ডাকাতিয়া। তাই বলে ডাকাত বাস করে না এখানে-কিংবা নেই তাদের কোনো অনুচর। দিগন্তপ্রসারী ডাকাতিয়ার বিল। সচরাচর এত বড়ো বিল দেখা যায় না। তার পাশের ছোট্ট এই গ্রামটি তারই নাম পেয়েছে। ডাকাতিয়ার বিলের হয়তো কোনো ইতিহাস আছে–কিন্তু আজ আর সে-কথা কেউ জানে না। তবে খালপারের মাঠে লাঙল দিতে দিতে চাষিরা নাকি অনেক সময় কোম্পানির আমলের পয়সা পেয়ে যায়। খালপারের ভিটের কাছেই একটা মজা পুকুর আছে–পূর্বে নাকি এখানেই ছিল মস্ত বড়ো এক দিঘি। পুকুরের পাড়ে একটি বড় আমগাছ আজও আছে। কয়েক পুরুষ আগে নাকি কখনো কখনো চাষিরা দেখতে পেত–দিঘির মধ্যে ছোট্ট একটা রুপোর নৌকা ভেসে উঠত–আর নৌকাটি ওই আমগাছের গুঁড়ির সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা। ওই নৌকায় মোহরভরা সোনার কলসিও নাকি ঝিকমিক করে উঠত। কিছুক্ষণ ভেসে থেকে আবার ইচ্ছামতো সে নৌকা তলিয়ে যেত দিঘির অতল কালো জলে।
বিলের ওপারে দিনের শেষে সূর্য ডোবে সোনার একখানা বড়ো থালার মতো কাঁপতে কাঁপতে। সেই সূর্যের লাল রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে দিগদিগন্তে। ছোটোবেলায় বসে বসে দেখতাম –কত যে ভালো লাগত! সূর্যাস্তের পর যখন গোধূলির স্লানিমা কাঁপতে থাকত–স্বপ্নবিহার থেকে মন নেমে আসত মাটিতে। বাঁশঝাড়ে-তেঁতুল কিংবা আমগাছে বিলে-চরা বকের ঝাঁক সাদা ডানা মেলে এসে কোলাহল করত–অসংখ্য শালিক কিচিরমিচির ডাকে কীর্তন জমিয়ে তুলত। গ্রামের মেয়েরা সাঁঝের পিদিম নিয়ে আলো দেখাত তুলসীতলায়, ধানের গোলায়, ঠাকুরঘরে। অন্ধকার নিবিড় হয়ে আসত। ঝোপেঝাপে, লতাকুঞ্জে জোনাকির ফুলঝুরি ফুটত। কোনো কোনোদিন বাঁশবাগানের মাথার ওপর যেন পথিক চাঁদ পথ ভুলে এসে তাকিয়ে থাকত।
সন্ধ্যাকালে সংকীর্তনের সুর ভেসে আসত কানে। গাঁয়ে এক সাধুর আজ্ঞা ছিল–সেখানে বাউল-কীর্তন বেশ জমে উঠত গোপীযন্ত্রের সঙ্গে। ঠাকরুনতলার স্কুলঘরে চলত গ্রামের যাত্রাদলের মহড়া। চাষি যুবকদের অশুদ্ধ উচ্চারণে বীররস প্রকাশ, স্ত্রীভূমিকায় পুরুষকণ্ঠের বিকৃত চিৎকার আজও স্পষ্ট যেন শুনতে পাই।
মেঠো পথে অন্ধকারে পথ চলছে হাটুরে লোক-হাট থেকে ফিরছে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি ঘরকন্নার কথা বলতে বলতে। অন্যান্য বেসাতির সঙ্গে ছেলে-মেয়ের জন্যে হয়তো নিয়ে চলেছে একপয়সার বাতাসাওরা বলে ‘ফেনি’; বউ-এর জন্যে কাঁচের চুড়ি আর নিজেদের জন্যে তামাক। পরস্পরের আলাপের যোগসূত্র হল এই তামাক।
ছায়াছবির মতো কত স্মৃতির ছবি ভিড় করে আসে মনের পর্দায়। তাল খেজুর নারকেল সুপারি আম কাঁঠালের দেশ, জলকাদায় স্নিগ্ধ যার কোল, জোলো হাওয়ায় আন্দোলিত যার সবুজ আঁচল, মেঘে-রৌদ্রে হাসিকান্নায় মুখর যার গৃহাঙ্গন–সেই জন্মভূমি পল্লিমায়ের মুখখানি আজ বারবার মনে পড়ছে। ঋতু বিবর্তনের বিচিত্রতা, পল্লির সবুজ চোখজুড়ানো স্নিগ্ধতা, আকাশের প্রসারতা, দিগবলয় ঘেঁষা বিলের রহস্যময়তা আজও আমাকে নীরবে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সোনার বাংলার লক্ষ গ্রামের সেই এক গ্রাম–তাকে আজ আমি কেমন করে ভুলি? শিশু কি কখনো মায়ের কোল ভুলতে পারে? মহাকালের নির্মম পরিহাসে মাকে ছেড়ে চলে আসতে হল দূরপ্রবাসে অশ্রুজল সম্বল করে, ওপারের মানুষ এপারে এলাম শরণার্থীর বেশে। সেই বিলের জলের মতো ছলছল করা আমার জননী জন্মভূমির চোখের জল প্রাণের গহনে যে কান্না জাগায়–কেউ কি তা বুঝবে? আমাদের সেই ঠাকরুনতলায় কালীপুজোর জন্যে সংগৃহীত ছাগশিশুদের মতো রাজনৈতিক যূপকাষ্ঠে আজ লক্ষ লক্ষ মানবশিশু বলি হতে চলেছে। কিন্তু সত্যি কি তাই হবে? ঘরের ছেলেরা কি আর ঘরে ফিরবে না?
চট্টগ্রাম – সারোয়ালি ধলঘাট ভাটিকাইন গোমদন্ডী
সুদীর্ঘ আট-দশ হাত চওড়া আরাকান রোডের দু-পাশে দেখা যায় আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের এক বিশিষ্ট রূপ। রাস্তার দু-ধারে সারবন্দি বড়ো বড়ো গাছ–অশ্বথ, বট, আম, সোনালু আর গামার। নব কিশলয়ে ফুলে ফুলে তাদের বসন্তশ্রী মনে জাগায় সৃষ্টিকর্তার রসমাধুর্য। কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি রং ধরায় মানুষের মনে, ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস বকুলফুল কুড়োবার জন্যে ডাকে।
অদূরে ‘করেলডেঙ্গা’ পাহাড়। নিবিড় শ্যামল আস্তরণের ফাঁকে ফাঁকে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। সোনালি রঙের সোনালু ফুল, বেগুনি রঙের গামার, বনকরবী, অজস্র কাঠ-গোলাপ ও কাঠ-মল্লিকা। পাহাড়ের গা-বেয়ে ছোটো ছোটো ঝরনা নেমে এসেছে, তার পাশে কোথাও কোথাও শণখেত। নীচে দিগন্তপ্রসারী মাঠ, বুকে তাদের নানান ফসল। তারপরই আম, জাম, সুপারি, নারকেল আর খেজুর গাছের ঘন অন্তরালে আমার জন্মভূমি কঞ্জুরি মৌজার সারোয়াতলি গ্রাম। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় থেকে বাইরের লোকে জেনেছে ‘সেওড়াতলি’ বলে।
কর্ণফুলির বহু শাখাপ্রশাখা গাঁয়ের ভেতর প্রবেশ করেছে। ছবির মতো তাদের রূপ তাদের প্রায় সবগুলিতেই বারোমাস নৌকা চলে।
আষাঢ়-শ্রাবণের ঘন বর্ষণেও রাস্তাঘাট ডোবে না, চারিদিক অপূর্ব শ্যামশ্রীতে ভরে যায়। পুকুর-দিঘির টলটলে জলের ওপর নানা রঙের শাপলাফুল ও পদ্মের অপরূপ সৌন্দর্যে চোখ জুড়ায়।
ভরা বর্ষায় খালেবিলে ছোটো নেংটি-পরা ছেলে-মেয়েদের মাছ ধরার হিড়িক পড়ে। এক একটি মাছ পলো চাপা পড়ার পর তাদের উচ্ছ্বসিত হাসি ও চিৎকারে প্রকৃতির সজল রূপের মাধুর্য বেড়ে যায়।
শ্রাবণ মাসের আনন্দমা মনসার আগমন। পয়লা শ্রাবণে ঘরে ঘরে মা মনসার ঘট বসে –প্রতিরবিবার ঘটের পল্লব বদলানো হয়। প্রত্যেকদিনই মনসার পুথি পড়া হয়—’বাইশ কবি মনসাপুথি’ অর্থাৎ বাইশজন কবির লেখা মনসামঙ্গল। একজন সুললিত কণ্ঠে পুথি পড়েন –কয়েকজন দোহার ধরেন। মধ্যে মধ্যে চলে গীতবাদ্য। কোনো কোনো বাড়িতে এই উপলক্ষ্যে ভোজ হয়। সংক্রান্তির দিন ঘটা করে মায়ের পুজো। পুজোয় পাঁঠা, হাঁস, কবুতর বলি পড়ে। কেউ কেউ বলি দেন আখ বা চালকুমড়ো৷
আসে শরৎ। শারদলক্ষ্মীর শুভ আগমনে প্রকৃতির সঙ্গে মানবহৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে। ভোরবেলার শান্ত বাতাসে ভেসে আসে শিউলি ফুলের গন্ধ, দারোগাবাড়ির মঙ্গল আরতির ঘণ্টা, কাঁসর-শাঁখের পবিত্র শব্দ আর বড়োপিরের দরগা থেকে আসে সুমধুর আজান ধ্বনি।
দুর্গা পুজোয় নাগ ও মহাজনদের বাড়িতেই ধুমধাম হয় সবচেয়ে বেশি। গ্রামের প্রায় সবাই তাতে যোগ দেয়। তবে বিশেষ করে নাগেদের বাড়ির নবমী পুজোর বলি দেখবার জন্যে সারাগ্রামের লোক ছুটে যায়। বলির মোষের শিং দুটি সিঁদুরে রাঙিয়ে তার গলায় বেলপাতা ও জবা ফুলের মালা পরানো হয়। সাজতে হয় ঘাতককেও। মাথায় জবাফুলের মালার পাগড়ি, হাতে খঙ্গ–সালুপরা, সিঁদুর-রঞ্জিত সেই মূর্তিকে আজও ভুলতে পারিনি! ভুলিনি বলির পর তার ‘ঘাতক নাচ।
মনে পড়ে ছোটোবেলায় একবার বলির আগেই ছুটে পালিয়ে এসেছিলাম। বলির মোষের চোখের কোণে জলের ধারা আমার শিশুমনের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিল–আজও সেই ছবি আমার মন থেকে মিলিয়ে যায়নি।
পুজোর উৎসবের পরই মনে পড়ে ধান কাটার আনন্দের কথা। কোনো কোনো গৃহস্থের ধান কাটার সময় ঢাক-ঢোলের বাদ্য-বাজনা হত। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের আসামি তারকেশ্বরদাদের জমির ধান কাটা দেখতে জড়ো হতাম ছেলেবেলায়। খুব ভোরে বাজনদারেরা এসে সানাইয়ের তান ধরতেই দলে দলে চাষির দল জমায়েত হত। রাঙা গামছা কোমরে বেঁধে, কাঁচির ডগায় সিঁদুর লাগিয়ে সবাই রওনা হত মাঠের দিকে। মাঠজোড়া অনেক জমি, তাতে ধান কাটা চলত দিনরাত। সঙ্গে চলত বাজনা আর চাষিদের খাওয়া।
তারকেশ্বরের মা সবার বড়োমা। তিনি ধান বরণ করতেন দুৰ্বায়, বরণকুলায়, মঙ্গলঘটের জলে আর মঙ্গলপাখার বাতাসে। প্রথম আঁটি ধান এইভাবে ঘরে আনা হত। চাষিরা বিদায় পেত নতুন কাপড় ও গামছা।
চাষিদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সব জাতই থাকত এবং তারা সবাই এইসব অনুষ্ঠান পালন করত।
চৈত্র মাসে হত ‘গৌরীর নাচ’। হিন্দু-মুসলমান সবাই এই উৎসবে যোগ দিতেন। ঢাকি-টুলি চলে মনোজ্ঞ ফুলসাজে সজ্জিত হরগৌরীর পিছু পিছু। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে শোভাযাত্রীরা গেয়ে বেড়ায়,
আজুয়া গৌরীর মালা-চন্দন
কালুয়া গৌরীর বিয়া,
ওরে গৌরীরে নিতে আইল শিব
চুয়া-চন্দন দিয়া।…
মূল গায়েন গায় ‘আজুয়া গৌরীর…’ ইত্যাদি। পিছনে সবাই ধুয়া ধরে। বাজনার তালে তালে হরগৌরী নাচে।
ছোটো একখানা পেতলের সরাই থাকে গৌরীর হাতে। নাচের ফাঁকে ফাঁকে গিন্নিমাদের কাছে তাদের পাওনা আদায় করে।
চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিনকে বলে ‘ফুলবিষু’। এই নামকরণ অর্থহীন নয়। ফুলের মালায়, নিমপাতায় আর কেয়া কাঁঠালের ফালিতে বাড়ির দরজা-জানালা সাজানো হয়। বাড়ির সব কিছুকেই মালা পরানো হয়, এমনকী আসবাবপত্র এবং গৃহপালিত পশু-পক্ষীও বাদ পড়ে না।
চৈত্র সংক্রান্তির কয়েকদিন আগে থেকেই ঘরে ঘরে খই, চিড়া, নারকেল, তিল, চালতা, কুল ও গুড় প্রভৃতির মিশ্রণে নাড় তৈরি হয়। এই নাড়কে আমাদের চাটগাঁয় বলে ‘লাওন। সংক্রান্তি বা বিষ্ণুপর্বের দিন চলে এই ‘লাওন’ খাওয়ার উৎসব। এই উৎসবের মধ্য দিয়েই হত বর্ষাবিদায় এবং হিন্দু-মুসলমানের নববর্ষ বরণের আন্তরিক শুভকামনার বিনিময়।
জ্যৈষ্ঠ মাসে চলত আম-নিমন্ত্রণ। চট্টগ্রামের পল্লির এই এক বৈশিষ্ট্য। একে অপরকে আম খেতে নিমন্ত্রণ করবেন। নিমন্ত্রণ রক্ষা না করলে অসুখী হবেন–অনুযোগ করবেন।
মোটামুটি এই হচ্ছে আমার গ্রাম সারোয়াতলির পুজোপার্বণ।
গ্রামটি একেবারে ছোটো নয়। স্কুল, ডাকঘর ও দাঁতব্য চিকিৎসালয় আছে, আর আছে মাইলখানেকের মধ্যে কানুনগোপাড়ায় একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ।
চট্টগ্রামের স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশ তার পাহাড় ও নদীর গাম্ভীর্যের মধ্যে গড়ে-ওঠা যেসব মানুষ দেখেছি, আজ তাদের মধ্যে প্রথম মনে পড়ছে যোগেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়কে। ধনীর সন্তান, জমিদারের ছেলে, কিন্তু নির্লিপ্ত এই মানুষটি বিষয়বৈভবের কোনো খবরই রাখতেন না।
এল ভাগ্য বিপর্যয়। তিনি আপনা থেকে কেমন করে জানতে পারলেন যে, তাঁর গৃহদেবতা মা কালীর নিত্যভোগ বন্ধ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আহার বন্ধ করলেন। এরপর যে তিন মাসের মতো বেঁচেছিলেন, তার মধ্যে অন্ন আর গ্রহণ করেননি। একটুখানি হাসি দিয়ে সকলের অনুরোধ এড়িয়ে যেতেন।
তাঁকে দাদুমণি বলে ডাকতাম। কথার ফাঁকে বন্দি করে একদিন দাদুমণিকে অনুগ্রহণের অনুরোধ জানালাম। তাঁর করুণ মুখে মলিন হাসি অশ্রুরাশির মধ্যে ডুবে গেল। চুপি চুপি আমায় সব জানালেন, বললেন–ওই অনুরোধ তুই আর আমায় করিসনি ভাই।
আর আজ মনে পড়ে গ্রামের তারকেশ্বরদা ও রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে–’ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান’। মনে পড়ে–শাসকশক্তির অত্যাচারের করাল রূপ। তারকেশ্বর-রামকৃষ্ণের পরিচয় বাঙালি পাঠককে দিতে হবে না জানি, কিন্তু সেদিন গ্রামের উপর দিয়ে অত্যাচারের যে ঝড় বয়ে গেছে–সে-কথা স্মরণ করলে এখনও শিউরে উঠি।
চোখের উপর ভেসে ওঠে একদিনের নির্মম ছবি। ভোরবেলায় গভীর আতঙ্কে গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙল-ভয়ে কারও মুখে কথা সরে না। জ্বলে উঠল তারকেশ্বর, রামকৃষ্ণ ও বিশিষ্ট কংগ্রেসকর্মী প্রসন্ন সেন মহাশয়ের বাড়ি।
পুলিশ সুপার সুটার সাহেবের কতৃত্বাধীনে সারোয়াতলিকে মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়া হল। তারা তারকাঁটা দিয়ে কালাইয়ার হাটের পাশে গ্রামের হাই স্কুলটাকে ঘিরে ফেলল। শুরু হল লাঠি-বৃষ্টি, বেয়নেটের খোঁচা ও বন্দুকের কুঁদোর আঘাত। তৃতীয় শ্রেণির শিশু থেকে দশম শ্রেণির কিশোর কেউই বাদ পড়ল না– এমনকী শিক্ষকরাও প্রহারে জর্জরিত হলেন।
এই অত্যাচার থেকে বোরলা, কানুনগোপাড়া প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিও রেহাই পায়নি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর জালালাবাদে চলে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইংরেজ সরকারের প্রথম সশস্ত্র সম্মুখ সংগ্রাম। এই যুদ্ধের অধিনায়ক ছিলেন লোকনাথ বল। তাঁর ভাই টেগরা এবং আরও কয়েকজন সেখানে শহিদ হয়েছিলেন। তারকেশ্বর, রামকৃষ্ণের বাড়ির মতো লোকনাথদার বাড়িও ভস্মীভূত হয় সেই সময়।
তখন দেখেছি গ্রামের সকলের তাঁদের প্রতি কী সহানুভূতি ও সমবেদনা! বিদেশি শাসকের অত্যাচারে এদের মনেও বেজে উঠত বিদ্রোহের সুর।
অশিক্ষিত চাষাভুষোর দল বিদ্রোহীদের লুকিয়ে রাখতেন–তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান। তাঁদের ঘরের মায়েরাও ‘স্বদেশি ছেলেদের’ কত যত্নই না করতেন। তাঁদের মুখে প্রায়ই শুনতাম—’আহারে দুঃখিনীর পোয়া, তোরা আখেরে রাজা হবি। তোরার দুঃখ খোদার দোয়ায় ঘুচিব।’
শুনছি সেই রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের বাড়ি তাঁদেরই এক প্রজা জোর করে দখল করেছে। তারকেশ্বরদাদের বাড়ি নিয়েও চলেছে সীমাহীন লোভের হানাহানি। আর স্বর্গীয় প্রসন্ন সেন মহাশয়ের পরিবারবর্গ আজ উদবাস্তু, পশ্চিমবঙ্গে সরকারের আশ্রয়প্রার্থী। শুধু ভাবছি নিয়তির এ কী কঠোর পরিহাস!
কিন্তু এমনতর তো ছিল না। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের বন্যায় শহরের বাসা হতে গ্রামে চলেছি মায়ের কাছে। বেঙ্গুরা স্টেশনে পৌঁছে দেখি, চলার পথ অথৈ জলের তলায় আত্মবিলোপ করেছে, চলাচল হচ্ছে ‘সামপানে’। কিছুদূর চলার পর সামপানও আর চলে না। হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই মাইলখানেক পথ। অবর্ণনীয় সেই দুঃখের ইতিহাস। অনভ্যস্ত পায়ে এগিয়ে চলেছি। সঙ্গে চাকর অমূল্য, তার মাথায় ভারী বোঝা। কজেই তার সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা।
কিছুদূর গিয়েই পড়লাম এক চোরা গর্তে। বুক পর্যন্ত ডুবে গেলাম। কাপড়চোপড় ভিজে জলে কাদায় একাকার হয়ে গেল। ঠিক এমন সময় সহাস্য মুখে এগিয়ে এলেন নুর আহম্মদদা। অতিকষ্ট করে আমায় পার করলেন সযত্নে। মাকে এসে সহাস্যে বললেন—’আখুড়ি, তোয়ার মাইয়া দি গেলাম–আঁয়ার লাই মিঠাই আন।’
মায়ের মুখের মিষ্টি হাসি–তাঁর হাতের সামান্য পুরস্কারই অসামান্য ছিল নুরদার কাছে। কিন্তু সেদিন কোথায় গেল?
কে জানে মহাকালের রথচক্রতলের এই নিষ্পেষণ কবে শেষ হবে? জানি শেষ হবে, হবে এই বিচ্ছিন্ন জাতির মিলন। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের ভাষাগত, কৃষ্টিগত ঐক্যের মধ্য দিয়ে সেই শুভদিন আবার আসবে।
.
ধলঘাট
বৈশাখ মাস। গরমের ছুটির দেরি নেই আর। স্কুলে আসার পথে দেখে এসেছি বুড়াকালী বাড়ির ধারে দত্তদের বাগানে পাকা সিঁদুরে আম ঝুলছে। টিফিনের ছুটিতে দল বেঁধে ছুটলাম কিশোর বন্ধুদের নিয়ে। আনন্দে মত্ত হয়ে আম পাড়ছি, এমন সময় আমাদের তেড়ে এল একটি লোক ‘চোর! চোর!’ বলে। যে-যার প্রাণ নিয়ে দৌড়োলাম। কোঁচড়ে বাঁধা আমগুলো রাস্তায়, পুকুরে, ডোবায় পড়ে গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে স্কুলের দরজায় এসে পৌঁছোলাম। দেখলাম–সেই লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, মুখে তার দুষ্টু হাসি। সে আমায় ইশারায় ডাকলে, ভয়ে ভয়ে তার কাছে গেলাম। লোকটি স্কুলের ছেলেদের পরিচিত, নাম ‘তারা পাগলা’, রাতদিন কালীবাড়ির সামনে বসে বিড়বিড় করে কী বলে, পুকুরে একগলা জলে নেমে একটির পর একটি ডুব দেয়, তারপর ভিজে কাপড়ে উঠে এসে আবার ঢোকে কালীমন্দিরের ভেতর। কোনো কাজকর্ম নেই তার, খাওয়া-পরার ঠিক নেই, কথাবার্তায় সুস্থ মনের পরিচয় পাওয়া যায় না। স্কুলের ছেলেরা তাকে খ্যাপায়, সে ছুটে আসে তাদের মারতে।
‘তারা পাগলা’ আমায় ডাকল কেন–দূর থেকে জানতে চাইল আমার সহপাঠীরা।
অদূরে গাছতলায় বসে আমার হাতটি দেখে পাগলা বললে, এবার পরীক্ষায় তুই ‘ফাস্ট হবি, ভালো করে পড়াশুনো করিস, বুঝলি?
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমারই একজন সহপাঠী জিজ্ঞেস করল, আমি?
পাগলা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলে, তুই সপ্তজন্মেও পাশ করতে পারবি না। কারখানার কুলি হবি তুই, তোর পড়ার দরকার কী?
তারা পাগলের কথা সত্যি হয়েছিল, সে-কথা মনে পড়ছে আজ। কিন্তু সেদিন চপল কিশোরচিত্তের হাজার কথার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল এই সাধকের ভবিষ্যদ্বাণী।
এই তারা পাগলাই তারাচরণ পরমহংসদেব হয়েছিলেন উত্তরকালে। তাঁর সাধনার পীঠভূমি বুড়াকালী বাড়ি পরিণত হয়েছিল হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্রে। সত্যের মহিমায়, সাধনার গরিমায় এই সিদ্ধ মহাপুরুষের সাধনার ক্ষেত্র ‘ধলঘাট’ এমন করে ছেড়ে আসতে হবে তা কী জানতাম!
উত্তরে আর দক্ষিণে হারগেজি খাল টেনে দিয়েছে গ্রামখানির সীমারেখা। পশ্চিমে অবারিত মাঠ মিশে গেছে দিগন্তে, পূর্বে অনুচ্চ করেলডেঙ্গা পাহাড় আকাশের দিকে চেয়ে আছে স্থির নেত্রে। চারদিকে মাঠ আর সবুজের প্রাচুর্য।
একধারে নদী বয়ে চলেছে কুলুকুলু নাদে, আর একধারে পড়ে আছে ধু-ধু মাঠ, তার বুকের উপর দিয়ে এঁকে-বেঁকে অগ্রসর হয়েছে গ্রামের বিস্তৃত পথখানি। ছায়াঘন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ছোট্ট কুটির, মধ্যবিত্তের মাটির দোতলা কোঠা, সানবাঁধানো ঘাট, গোয়াল, গোলা, পুকুর-দিঘি-বাগান, বাঁশঝাড়। যেন তুলি দিয়ে আঁকা। কোথাও এতটুকু আবর্জনা নেই, কোলাহল নেই, গ্রামবাসীরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে–মাঠে চাষ করছে চাষি, জেলে পুকুরে মাছ ধরছে, রাখালেরা বটগাছের তলায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছে, কেউ বা খেলছে ডান্ডাগুলি, কেউ বা ব্যাটবল দিয়ে খেলছে ক্রিকেট, স্কুলের ছেলে-মেয়েরা বই বগলে করে ছুটছে স্কুলে, ব্যাঙ্কের প্রাঙ্গণে বসেছে সভা, হাসপাতালে রোগীরা দাঁড়িয়ে আছে ভিড় করে, পোষ্ট আপিসে পিয়ানকে ঘিরে বসেছে গ্রামের লোকগুলো–খোঁজ করছে চিঠির, মনিঅর্ডারের, দোকানগুলিতে জমে উঠেছে আলাপ– রাজনৈতিক, সামাজিক, ঘরোয়া। বর্ষায় যখন চারদিক জলে ভরে যায়, তখন ছবির মতো দেখায় গ্রামখানি। শরতে মাঠে মাঠে যেন সবুজের সীমাহীন রেখা, গ্রীষ্মে চোখে পড়ে ফাঁকা মাঠগুলো, বসন্তে গাছে গাছে ফুটে ওঠে নবযৌবনশ্রী।
নিরুপদ্রব একটানা জীবনযাত্রা চলেছে আবহমান কাল ধরে। বর্ধিষ্ণু আমার গ্রামখানি। কিন্তু চিরকাল তো ছিল না তার এমন উন্নত অবস্থা। আমরা যখন ছোটো ছিলাম–তখন দেখেছি আমাদের সামনের দিঘিটি জঙ্গলে আছে ভরে, রাস্তাঘাট অনুন্নত, স্কুলের গোড়াপত্তন হচ্ছে মাত্র, ব্যাঙ্ক হাসপাতালের জন্ম তখনও হয়নি। আমাদের চোখের সম্মুখে গ্রামখানি গড়ে উঠেছে।
গ্রামকে শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতার উপযুক্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে ক-জন নেতৃস্থানীয় লোক এলেন এগিয়ে। তাঁদের চেষ্টায় পল্লিসংস্কার আরম্ভ হল। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে সৌন্দর্যে, শিক্ষায়, দীক্ষায় সকল বিষয়ে আমাদের গ্রামখানি হল সেরা। অভাব বলতে ছিল না কিছুরই। শহরের সঙ্গে যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত আছে, রেলপথে মাত্র চল্লিশ মিনিটের রাস্তা, জলপথেও ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। গ্রাম, তবু শহরেরই মতো। তার চেয়ে বরং সুন্দর। গ্রামের মধ্যে অহিন্দুর বসতি নেই, কিন্তু চতুম্পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের মুষ্টিমেয় মুসলমান ও অহিন্দুরা গৌরবের সঙ্গে এই গ্রামেরই অধিবাসী হিসাবে আত্মপরিচয় দেয়।
বঙ্গবাণী, বাণীমন্দির, সাবিত্রী, শৈলসংগীত, সিন্ধুসংগীত, স্বর্গে ও মর্ত্যের রচয়িতা কবি শশাঙ্কমোহন সেনের জন্ম এই ধলঘাট গ্রামে। Star of India জগদ্বন্ধু দত্তের জন্মভূমিও ধলঘাট। দানবীর নিমাই দস্তিদার– চট্টগ্রাম শহরের Outdoor হাসপাতাল যাঁর অক্ষয় কীর্তি তিনিও এখানকারই।
ছিপ দিয়ে মাছ ধরা এ গ্রামের বৈশিষ্ট্য। কানুর দিঘিতে মাগনের দিঘিতে, ক্যাম্পের পুকুরে, পেঙ্কারদের দিঘিতে চারকাঠি বসিয়ে টঙের ওপর বসে শিকারিরা মাছ ধরে। এক একটি মাছ যেন এক-একটি জানোয়ার। ওজন দেড়মন-দু-মন। বিকেলে বঁড়শিতে আটকালে তাকে ডাঙায় তুলতে রাত হয়ে যায়। এত বড় রুই-কাতলা যে পুকুরে থাকতে পারে, এ ধারণা না দেখলে কেউ করতে পারে না।
একটা ঘটনা মনে পড়ে। শীতের দিন। কনকনে শীত পড়েছে। টঙের ওপর বসে আছি ছিপ ধরে। হাটবার ছিল সেদিন। ব্যাপারীরা, ক্রেতারা সব চলেছে দলে দলে। যেতে যেতে তারা মন্তব্য করছে, বাবুদের মাথা খারাপ, এমন শীতে কে কোথায় মাছ ধরেছে? পরিচিত লোক। বললাম, ফিরবার সময় এদিকে এসে দেখে যেয়ো কেমন মাছ ধরেছি।
বিকেলের দিকে সত্য সত্যই একটা মাছ লাগল। মন-খানেক হবে তার ওজন। বিরাট রুই। মাছটি তুলে খেজুর গাছের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখলাম। হাট থেকে ফেরবার পথে লোকগুলো অবাক হয়ে দেখে বাড়ি ফিরল।
জমিদার এখানে নেই, আছে মধ্যবিত্ত। তারা বুকের রক্ত দিয়ে তাদের জন্মভূমিকে পুরুষানুক্রমে করেছে উন্নত। এখানে বাস করে কৃষক-যুগি-তাঁতি-মেথর-হাড়ি-ডোম–যারা শুধু নিজেদের ব্যাবসা নিয়ে পড়ে থাকে না, দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করবার সময়টুকু সকলেই করে নেয়। যারা নিরক্ষর তারাও রাজনীতি সম্বন্ধে দু-কথা বলতে পারে, সকলের এ রাজনীতি সম্বন্ধীয় জ্ঞান এ গ্রামের বৈশিষ্ট্য। বারো মাসে তেরো পার্বণ এখানেও অনুষ্ঠিত হয় এ জেলার আর সব জায়গারই মতো।
গ্রামের এমন পরিবেশের মধ্যে কোথাও উদবেগ নেই, অশান্তি নেই, আছে পরস্পর সহযোগিতা, হিন্দু-মুসলমানে প্রীতি ও পল্লি উন্নয়নের সমবেত প্রচেষ্টা।
আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে যখন গ্রামখানি মাথা তুলে দাঁড়াল সকলের ওপরে, তখন হঠাৎ ব্রিটিশের রোষদৃষ্টি পড়ল গ্রামবাসীর ওপর। শহরের কাছাকাছি, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়-প্রধান গ্রামখানি সন্ত্রাসবাদের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠল।
গভীর রাত্রি, সূচীভেদ্য অন্ধকার। রাত্রের অন্ধকারের বুক চিরে ফুটে উঠল একটি অস্পষ্ট আলোর রেখা। তারপর গুলির আওয়াজ। একটি গুলি আমার কানের পাশ দিয়ে বোঁ করে চলে গেল। বুঝতে পারলাম না কিছুই। কিছুক্ষণ সব নীরব। তারপর একসঙ্গে শত শত গুলির শব্দ। বাইরে আসা নিরাপদ নয়, তাই ঘরে রইলাম।
সকাল হবার একটু আগে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। সশস্ত্র গুখা চ্যালেঞ্জ’ করল। দারোগা সাহেব এলেন। বললেন, রাত্রিতে নবীন ঠাকুরের বাড়িতে ঘটনা ঘটেছে, ক্যাপ্টেন ক্যামেরন সাহেব নিহত হয়েছে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের একজন (নির্মল সেন) আত্মহত্যা করেছেন পালাতে না পেরে।
সকালে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর সর্বপ্রথম হানা দিলেন আমাদের বাড়িতে। বললেন, আমাদের পরিবার এসব ফেরারি আসামিদের সঙ্গে জড়িত। খানাতল্লাশি হল পাড়ার পর পাড়ায়–সারাগ্রামখানিতে। তাতেও রেহাই পেল না নিরীহ গ্রামবাসীরা। চতুষ্পর্শ্বস্থ গৃহস্থের ওপর ধার্য হল পাঁচ হাজার টাকা পাইকারি জরিমানা। স্থাপিত হল চিরস্থায়ী ক্যাম্প, নির্যাতিত হল গ্রামবাসী। তবু কিন্তু এ গ্রাম ছাড়বার কল্পনা তারা করেনি কোনোদিন। পূর্বপুরুষদের ভিটের মায়া কেউ কি ছাড়তে পারে?
বাংলা বিভাগ হল। দলে দলে লোক ছেড়ে গেল তাদের জন্মভূমি। রেখে এল তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে-মাটি। প্রথম উত্তেজনা কমে গেলেই ফিরে আসবে তারা। সবাই চলে যাচ্ছে। একা নই আমি, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার আছে। তারা থাকতে চায় না আর। তাই বাধ্য হয়ে তাদের নিরাপত্তারই জন্যে গ্রাম ছেড়ে আসার সংকল্প করলাম। আপত্তি জানাল হিন্দু মুসলমান-বৌদ্ধ সবাই। আমিন সরিফ, আজিজ মল্ল, ফরোক আহমদ–গ্রামের মধ্যে যারা এখন মাতব্বর, একযোগে বললে, সত্যই আমাদের ছেড়ে চললেন? আমাদের এখানে তো কোনো ভয় নেই।
দুঃখ হয়েছিল তাদের কথায়। তারা তো ছিল আমার আত্মীয়েরই মতো চোদ্দোপুরুষ ধরে, পরিবারের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও প্রীতিসূত্রে আবদ্ধ। তাদের আবার ভয় কীসের? চারদিককার অবস্থা তখন শান্ত। কিন্তু ভিড় খুব। তবু অতিকষ্টে রাত বারোটায় এসে পৌঁছোলাম শিয়ালদা স্টেশনে।
সে আজ প্রায় আট বছর আগেকার কথা। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার শেষে যখন অপরাহু হয় তখন মনখানি ছুটে যায় আমার সেই ‘ছেড়ে-আসা গ্রামে। আমি কল্পনার চোখে দেখি আমাদের স্কুলের মাঠে ছেলেরা খেলছে মনের সুখে, বাড়ির সামনে দিঘিতে মাছ ধরতে বসেছে সুরেশ পুরোহিত, কালীবাড়িতে ওঁঙ্কারগিরির আখড়ায় ভিড় জমে আসছে। পুকুরের পোনা মাছগুলো ঘাটে এসে সাঁতার কাটছে, বাগানের মালতীলতায় টুনটুনি পাখিগুলো বসে আছে তাদের নতুন নীড়ে, ঝাউগাছে বাসা বেঁধেছে চিলেরা, গোয়ালের গোরুগুলো উঠানে ছুটোছুটি করছে, পোযা কুকুরটি দরজার সামনে বসে আছে লেজ গুটিয়ে, বিড়ালটি খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে এঘর ওঘর, বাগানের গোলাপ গাছগুলো ভরে আছে মুকুলে, লিচুগাছের ওপর বসে কাক মনের আনন্দে ডাকছে-কা কা। ফল-ভারে অবনত হয়েছে আম গাছের পত্রবহুল শাখা-প্রশাখা, পাকা কালোজাম বাতাসে ঝরে পড়ছে মাটিতে, রাস্তায় লোক নেই, কোথাও কোনো শব্দ নেই, চারদিকে শ্মশানের নীরবতা। সন্ধ্যা হল, কালীবাড়িতে বেজে উঠল কাঁসর-ঘণ্টা, জ্বলে উঠল আচার্যিদের বাড়িতে দু-একটি প্রদীপ, যুগিদের পাড়ায় খোল করতালে হল সন্ধ্যার বন্দনা…।
ফিরে আসতে চাইল না মন এখান থেকে। এখানকার প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে যে আমার পরিচয় নিবিড়, অবিচ্ছেদ্য। এরা আমায় ডাকবে–এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু পারি না তাদের সে ডাকে সাড়া দিতে। বোঝাতে পারি না অবাধ্য মনকে। আশা বলে, তুমি তো ছিলে না গৃহহীন, একটি বিশাল বর্ধিষ্ণু পল্লির সর্বত্রই ছিল তোমার গৃহ, তুমি তো ঘরছাড়া হতে পারো না।
ভাবি, কোনটা সত্য–আমার আশা, না আমার এ নির্মম বর্তমান?
.
ভাটিকাইন
পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনে যে দেশের মাটিকে আপন বলে জেনেছি, যে দেশের আকাশ আর বাতাসের সঙ্গে আমার শৈশবের প্রতিটি দিনের অনুভূতি একাত্ম হয়েছিল একদিন, আজ সেই জন্মভূমির সঙ্গে শেষ যোগটুকু ছিন্ন করে চলে এসেছি। পিতৃপিতামহের ভিটে ছেড়ে দেশান্তরে পাড়ি জমিয়েছিলাম দিনের আলোতে নয়, রাত্রির অন্ধকারে। গোটা দেশটাই যেন রাত্রির তপস্যায় মগ্ন। দেশকে ছেড়েছি, কিন্তু দেশের মাটিকে তো আজও ভুলতে পারিনি। শরণার্থীর বেশে জীবনের প্রতিপদক্ষেপে আজ যে দুর্যোগের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি, এই দুঃসময়ে বড়ো বেশি মনে পড়ছে আমার জননী, আমার জন্মভূমি, আমার ছেড়ে-আসা গ্রামকে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করেছি, দুঃখ বরণকেই জীবনের সহযাত্রী করে নিয়েছি, কিন্তু এই দুঃখের দিনে জন্মদুঃখিনী গ্রামের স্মৃতিকথা লিখতে বসে এখনও আশা জাগে, এখনও মন বলে, ‘সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।
জীবনের এক বিরাট স্থান শূন্য হয়ে গেছে বলে মনে হয়, পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেছে। কোথাও মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই। কাউকে বলবারও কিছু নেই, বললেও কেউ যেন শুনবে না। এতগুলো লোক মরেছে কি মরবে বোঝা যাচ্ছে না। বোধ হয় এরা সকলেই মরবে, আজ না হয় কাল। কেবল কৃশাঙ্গি শাখা কর্ণফুলি বেঁচে থাকবে। বর্ষীয়সীর শব্দহীন হাস্যে নিজের নিস্তরঙ্গ স্বল্প জলে কুন্ডলী পাকাবে।
নবীনচন্দ্র ‘পলাশীর যুদ্ধে’ যাদের জন্যে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন, তারা বেঁচে আছে, তবে তারা নিজহাতে কবি ও তাঁর কাব্যকে হত্যা করেছে।
ইতিহাস ক্ষমা করবে না জানি, কিন্তু ইতিহাসের দীর্ঘ ও বিচিত্রপথে বিচরণ করে সে প্রতিঘাত উপভোগ করবার জন্যে আজকের কেউ বেঁচে থাকবে না। যে হাত আঘাত করে, সে-হাত বরাভয় দেয়, এইরূপ অসংগতি ইতিপূর্বে শোনা যায়নি। পৃথিবীর বয়স হয়েছে, বোধহয় অন্তিম দশা ঘনিয়েছে।
কিন্তু কী বলছিলাম। জীবনের এক বিরাট স্থান শূন্য হয়ে গেছে মনে হয়। যে মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম, সে-মাটি আজ আর আমার নয়, তা স্পর্শ করবার অধিকার আমার আর নেই!
চট্টগ্রাম।
একদিকে ঘন সন্নিবিষ্ট পাহাড়শ্রেণি, অন্যদিকে তরঙ্গায়িত বঙ্গোপসাগর, মধ্যে কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলে ভরা বিস্তৃত উপত্যকা। আজ যেন সব পুড়ে গেছে।
সীতাকুন্ড থেকে চট্টগ্রামের সে-এক অপূর্ব রূপ, যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়, পাহাড়শীর্ষে শুভ্র দেবালয়ে দেবতা ‘চন্দ্রনাথ’, ক্রোড়ে প্রলয়ের প্রতীক্ষায় ত্রিশূলধারী বিরূপাক্ষ, নিম্নে নিস্তেজ স্বয়ম্ভুনাথ মর্তের মানুষের অতিনিকটে বলে রুদ্ররূপ ত্যাগ করেছেন, আরও নীচে পূতসলিলা মন্দাকিনী, অনাদিকাল হতে কলস্বরে বয়ে যাচ্ছে। পুরাণে এই স্থানটিকে চম্পকারণ্য বলা হত। উত্তরে অনাবিষ্কৃত পাহাড়-চূড়া, সহস্রধারায় জল ঝরে পড়ছে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই এই জল পড়ে পড়ে মাটি পাথর হয়ে গিয়েছে। আবার পাহাড়গাত্রে স্থানে স্থানে অগ্নিশিখা, এর গর্জনকে স্থানীয় হিন্দুরা গুরুধ্বনি বলে। দক্ষিণে বাড়বানল। সীতাকুন্ড থেকে পাঁচ মাইল দূরে ঘন অরণ্যের মধ্যে শিববিগ্রহ ও পাতালস্পর্শী জলকুন্ড টগবগ করে ফুটছে, অথচ ডুব দিলে দেহ শীতল হয়।
চন্দ্রনাথের মন্দির থেকে এক সংকীর্ণ সর্পবহুল গিরিপথ দক্ষিণদিকে নেমে গিয়েছে। তীর্থযাত্রী দল ওই রাস্তা দিয়ে নেমে যায়। যক্ষপুরীর মতো অন্ধকার সে-পথ। পথ হাতড়িয়ে চলতে হয়। মাঝে মাঝে শাবকসহ কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাঘ্র দম্পতিকে চলে যেতে দেখা যায়। এর নাম পাতালপুরী। স্মরণাতীতকালে কোন মহাপ্রাণ হিন্দু রাজা এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন জানা যায়নি। মন্দিরের অধীশ্বরী কালী, মাথা নীচে ও পা ওপরে করে পূজারিদের দিকে পিছন ফিরে আছেন। এ এক অপূর্ব মূর্তি। বহুশতাব্দী পূর্বে আবির্ভূত হয়েছেন এ দেবী, অথচ মর্ত্যের মানুষের মুখ দর্শন করেননি।
কুমিড়া, ভাটিয়ারি ও ফৌজদারির হাটছাড়াবার পর পাহাড় যেন দূরে সরে গিয়েছে। এইখানে কৃষ্ণচূড়া ফুল শোভিত ঢালু জমি। নাম পাহাড়তলি। এ. বি. রেলওয়ের কারখানা, লোকো শেড, মালগুদাম, ইঞ্জিন মেরামতের কারখানা, ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের দফতর। তারপর চট্টগ্রাম স্টেশন। গ্র্যাণ্ড ট্রাংক রোড এখানে ঈষৎ উচ্চে, পাহাড়তলি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রাস্তাটা উঁচু হয়ে গেছে। বাটালি পাহাড়পার্শ্বে সংকীর্ণ গিরিপথের নাম টাইগার পাস। এইখান থেকে বড়ো পল্টন, ইউরোপীয় ক্লাব ও লাটসাহেবের কুঠি পর্যন্তও ছোটোখাটো টিলায় অসংখ্য বাংলো। আগে এখানে সরকারি বড়ো সাহেব, মার্চেন্ট অফিস ও রেলওয়ের সব বড় কর্তারা থাকতেন। আজ তাঁরা সাগর পাড়ি দিয়েছেন। যাবার আগে কার সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করে গেছেন, ইতিহাস একদিন তার বিচার করবে।
সেকালে চরচাকতাই থেকে নৌকাযোগে কর্ণফুলি দিয়ে আমাদের গ্রামে যেতে হত। প্রাচীন পল্লি ভাটিকাইন। বড়ো কর্ণফুলি ও তার নিস্তরঙ্গ শাখা ধরে সেনের পোল, সাইরার পোল, চন্দ্রকলা পোল ও ইন্দ্রপোল হয়ে এসে নুরন্নবী মাঝির নৌকা থামত, দুরন্ত বর্ষায় বড়ো কর্ণফুলির জল যখন দলিত-মথিত হত তখনও বৃদ্ধ নুরন্নবীকে অসীম সাহসে দাঁড় টেনে নৌকা নিয়ে যেতে দেখেছি। আমরা শহরেই থাকতাম, মাঝে মাঝে পাল-পার্বণে বাবার সঙ্গে গ্রামে যেতাম। ইন্দ্র পোল ছাড়িয়ে আরও দূরে নৌকা থামত। নৌকা থেকে নেমে বকাউড়া বিলে গিয়ে উঠতাম। জ্যোৎস্না রাত্রে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি ভিড় করত বকাউড়া বিলে। মাঝে মাঝে দেখা যেত হারগেজা ফুলের ঝাড় আর প্রাচীন মগেদের চিতা।
বিল ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তা ধরতাম। প্রথমেই শ্মশানকালীর হাট, দু-ধারে ঘন বাঁশঝাড়, বাঁশপাতা পড়ে রাস্তার কতকাংশ একেবারে ঢাকা পড়ে গেছে। গ্রামের হাই স্কুল ছাড়িয়ে আমাদের বাড়ি। গ্রামবাসী এবং নিকটবর্তী গ্রামের বহু লোক আমাদের বাড়িকে সরীর বাপের বাড়ি বলত।
সরী ওরফে সরলা আমার বড়ো পিসিমার নাম। জনশ্রুতি, সাতটি সন্তানের অকালমৃত্যুর পর পিসিমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে এবং তিনি পিতৃগৃহে চলে আসেন। পিতৃগৃহে তখন কেউ ছিলেন না, কর্মসূত্রে সকলেই তখন চট্টগ্রাম শহরে। পিসিমা নাকি একাকী একটা বাতি জ্বেলে ভেতরের দিকের বারান্দায় অনেক রাত্রি পর্যন্ত সুর করে রামায়ণ, মহাভারত পড়তেন। অন্ধকারে মধ্যরাত্রে সেই গৌরবর্ণ দীর্ঘাঙ্গী সরলাকে চক্রবর্তীদের পোড়ো বাড়িতে একাকী ঘোরাফেরা করতে দেখে পথচারী কেউ চমকে উঠত কি না জানা যায়নি। শনি, মঙ্গলবারের মধ্যরাত্রে সরীর বাপের বাড়ির পানা-পুকুরের অভ্যন্তর থেকে প্রেত পুজার কাঁসর-ঘণ্টাধ্বনি রামায়ণ পাঠরতা সরলাকে আদৌ বিচলিত করত কি না সে সংবাদও জানা যায়নি। সকলই আজ বিস্মৃতির গর্ভে লীন। কেবল তেঁতুল ও দীর্ঘশির ইন্নালুর ডালে ডালে শাখা কর্ণফুলির উদাস বাতাস মৃত চক্রবর্তীদের নাম নিয়ে আজও লুটোপুটি খায়।
ভাটিকাইন অথবা ভট্টিখন্ড, যাই হোক-না-কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আমাদের গ্রামের নাম ভাটিকাইন। ভাটিকাইন থানার একমাইলের মধ্যে বহু বর্ধিষ্ণু হিন্দুর বাস ছিল গ্রামে। আমাদের বাড়ি ব্রাহ্মণপাড়ায়, হরদাসবাবুর বাড়ির পাশে। হরদাসবাবু জ্ঞানী ও ধার্মিক লোক ছিলেন। তাঁর বাড়িতে অষ্টপ্রহর কীর্তন হত। যতদূর মনে পড়ে তাঁর বাড়ির ভেতর ও বাইরের উঠোনে সংবৎসর শামিয়ানা খাটানো থাকত। উঠোন জুড়ে শতরঞ্চি পাতা, বাইরের পুকুরপাড় পর্যন্ত লোক বসত। ঝুড়ি ঝুড়ি ভোগ হত ঠাকুরের। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের গন্ধে সুরভিত হয়ে যেত চারদিক।
শুধু হরদাসবাবুরই যে সচ্ছলতা ছিল তা নয়, গ্রামবাসী প্রায় সকলের ঘরেই যেন লক্ষ্মী বাঁধা থাকতেন। চাল কিনে খেত এরকম লোককে লক্ষ্মীছাড়া বলা হত এবং সেরকম কেউ গ্রামে ছিল বলে জানা যায়নি।
মামার সঙ্গে কর্ণফুলিতে মাছ ধরতে যেতাম। সেজন্যে আমাদের ভাইদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। চন্দ্র অস্ত যাবার পূর্বেই তিনি জাল নিয়ে বের হতেন। আমরা জেগে থাকতাম। মামার সঙ্গে গিয়ে ডুলা ধরব। পেছনের বাড়ির সিরাজুদ্দিন ভুঞার ছেলে বসিরও আমাদের সঙ্গে যেত। নগেন্দ্ৰকাকা, মামা, আমি, দাদা, বসির ও ওয়াজ্জারগোলার নূরমহম্মদ রাত থাকতে বাড়ি থেকে বের হতাম। বাবা বাড়ি থাকলে আমরা যেতে পারতাম না। মা কিছু বলতেন না। কেবল দিদি জেগে থাকলে সঙ্গে যাবার জন্যে বায়না ধরতেন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় উঠে মরা শ্ৰীমতীর পোল পার হয়ে বকাউড়া বিলের রাস্তা ধরতাম। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের চালায় গিয়ে দাঁড়াতাম। তারপর বৃষ্টির ঝাঁপটা কমে গেলে স্কুলঘর থেকে বের হয়ে ওয়াঙ্গেদারদের বাড়ি ছাড়িয়ে যেতাম। নগেনকাকা বলতেন, ওই দেখ দু মুখো ‘খাইনি’ সাপ ঘুরছে। বসির বলত ‘জঠিয়া’ সাপ। মামা বলতেন, বিলের মুখে ‘কালন্দর’ সাপ আছে। তাতেও আমরা নিরস্ত হতাম না। মরা শ্ৰীমতীর পোল পার হয়েই বিলে নামতাম। তারপর বৃষ্টির জলে, ঠাণ্ডায়, বিড়বিড় করতে করতে সকলে মিলে খালে জাল ফেলত। বাটা, হরা, পোপা, লোঠিয়া, ইচা, খোরশুলা, বেলে, গলদা ও বাগদায় নিমেষে ডুলা ভরে যেত। সকালে বাড়ি ফিরে মাছ ঢাললে উঠোনের একাংশ সাদা হয়ে যেত।
প্রতিবৎসর কাকার বাড়িতে ভাটিকাইনে যাত্রাদলের গান হত। বিজয়-বসন্ত পালা হবে। এই উপলক্ষ্যে গ্রামে সাড়া পড়ে গেছে। স্টেজ বাঁধা হয়েছে। আবদুল আজিজ মৌলবির বাড়িতে দুইটি বড়ো দেওয়ালগিরি আছে। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেগুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যা থেকেই তিন গাঁয়ের লোক আসতে আরম্ভ করবেন। উঠোন জুড়ে ত্রিপল ও সতরঞ্চি পাতা হয়েছে। দেখতে দেখতে উঠোন ভরে গেল। সদরের বাইরে সাময়িকভাবে পান সিগারেট ও চায়ের দোকান বসেছে। সুদৃশ্য বালকের দল রংচঙে পোশাক পরে সখী সেজে স্টেজের ওপর গান ধরেছে—’শাখে বসি পাখি করে গান।’
বহুদিনের কথা। শঙ্খ ও হালদা নদীকে তবুও ভুলিনি। কর্ণফুলির পাশে পাশে সেগুলি আজও বয়ে চলেছে। সেই হাটহাজারি, ফটিকছড়ি, রাঙামাটির দেশ, শান্ত সমাহিত পাহাড় ক্রোড়ে নাকচ্যাপটা মগ ও চাকমা শিশুর দল। সেই চন্দ্রনাথ পাহাড়, পাতালকালীর সহস্র ধারা। সেই ভাটিকাইন যাত্রাদলের গান, চকমকে পোশাক পরে গ্রামের বড়ো অভিনেতা চন্দ্রকুমার আসরে উঠেছে। সবই মনে আছে। কিছুই ভুলিনি।…
তবে এই কলিকাতায় আমি আজ বাস্তুহারা! রিলিফ ক্যাম্পে বাস করি। ক্যাম্পে কয়েকজনের কলেরা হয়েছে। সকালে একটি বাস্তুহারা শিশু বসন্তে মারা গেছে। সে-সময়েই একমুঠো মোটা চিড়ে পেয়েছি। রিলিফবাবুর কাছে যেতে সাহস হয় না। কিছু বলতে গেলেই তিনি খেপে ওঠেন।
কেন এমন হল, সে প্রশ্ন আমি করি না। মাটির তলা থেকে মৃতের দুর্গন্ধ ওপরে ভেসে আসে কি না জানি না, জানলে হয়তো বেশি করে মাটি চাপা দিয়ে আসতাম। আসবার সময় নূরন্নবীর নাতির নৌকাখানা চেয়েছিলাম; রাতদুপুরে শ্মশানকালীর হাটের কাছে নৌকা ভিড়াতে বলেছিলাম। সেও যে বিগড়ে গেছে, আগে তা বুঝতে পারিনি। অন্ধকারে পা টিপে টিপে পটিয়া পেরিয়ে চক্রদন্ডী আসি। শেষরাত্রে হরিচরণের দিঘির ধার দিয়ে আসবার সময় কয়েকটি কুলবধূকে মরাকান্না কাঁদতে শুনেছিলাম। অদূরেই দাউ দাউ আগুন জ্বলছিল। সেই আলোয় পথ চিনে চিনেই চলে এসেছি। অনেকে আসতে পারেনি।
.
গোমদন্ডী
সৌন্দর্যের প্রতীক চট্টলা। প্রকৃতির লীলানিকেতন শৈলকিরীটিনি, সাগর-কুন্তলা, সরিক্সালিনী, কবিধাত্রী চট্টগ্রাম ভারতের জাতীয় ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে সাক্ষী হয়ে আছে। মাঝে মাঝে জীবনসংগ্রামের তপ্ত ঝড় চট্টলার বুকে উঠলেও সে-ঝড় শান্ত হয়ে একদিন শান্তির নিবাস হয়েই দেখা দিত। সমুদ্র-ঢেউ মানুষকে ইঙ্গিত জানাত এগিয়ে চলার। স্থাণু হয়ে বসে থাকার অর্থই হল মৃত্যু-চট্টগ্রাম তাই কখনো মৃত্যুর সাধনা করেনি, সাধনা করেছে প্রাণের, সাধনা করেছে শির উন্নত করে বাঁচার মতো বাঁচার। সে মন্ত্রের পূজারি ছিল প্রতিটি মানুষ, তাই চট্টগ্রাম বিপ্লবী সৈন্যের জন্মদাত্রী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। এই চট্টগ্রামেরই বিখ্যাত কবি নবীন সেন তাই বলেছিলেন,
ভারতের তপোবন! পাপ ধরাতলে
স্বরগের প্রতিকৃতি।
সত্যিই জায়গাটি ছিল স্বর্গের মতো। ভারতবর্ষের তপোবন বলতে যদি কোনো জায়গাকে বুঝতে হয় তাহলে এই চট্টগ্রাম! আজ তার কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বিরাট ঐতিহ্য লুপ্ত হয়েছে, বৃহদারণ্যের মৃত্যু হয়েছে। এই চট্টলারই এক নিভৃত পল্লিতে আমার জন্ম। গোমদন্ডী আমার জন্মভূমি। অখ্যাত অজ্ঞাত গন্ডগ্রাম হলেও গোমদন্ডী ঐতিহাসিক চট্টগ্রামেরই অংশ, অমৃতের উৎস। ইতিহাস থেকে যেটুকু জানা যায় তাতে দেখা যায় বর্গিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের পুর্বপুরুষ মাধবচন্দ্র মজুমদার মহাশয় প্রায় দু-শো বছর আগে বর্ধমান থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে শঙ্খনদীর উত্তরে সুচিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পরে সেখানে স্থানাভাব হেতুই হোক বা অন্য কারণেই হোক মাগনদাস চৌধুরি তাঁর খামারবাড়ি গোমদন্ডী গ্রামে চলে আসেন এবং নির্মাণ করেন তাঁর ভদ্রাসন। শিক্ষায় দীক্ষায় উচ্চাঙ্গের না হলেও গ্রামখানি ছিল পল্লিশ্রীর এক অফুরন্ত ভান্ডার, পশ্চিম প্রান্তে কর্ণফুলি নদীর ডাক দক্ষিণে রায়খালি খাল, উত্তরে ছনদন্ডী, খাল গিয়ে মিশেছে সূর্যাস্তের রঙে রাঙা কর্ণফুলিতে। গ্রামখানির চতু:সীমা চারটি প্রকান্ড দিঘি দিয়ে ঘেরা। প্রকৃতিদেবী পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী, দিঘি দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে চট্টগ্রামকে ঘিরে রেখে শত্রুর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে-চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল! ঘরের মধ্যে যে বিভেদ এল, তার আঘাতেই আমরা পড়লাম ছড়িয়ে। কুসুমে কবে কীট প্রবেশ করেছিল তার সংবাদ রাখিনি, ফুলের ঘ্রাণ নিতেই ছিলাম মত্ত! মনে হয় সেই ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়েই বিষাক্ত কীট প্রবেশ করেছে মনে, তারপর কুরে কুরে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে অন্তঃকরণকে, সে-সর্বনাশের খবর পেলাম বহু দেরিতে! এত সতর্কতা সত্ত্বেও শত্রুর হাত থেকে আমরা বাঁচলাম কই? যে দুষ্ট কীট আমাদের নীচে নামিয়েছে সে-কীটের সন্ধান কি আজও আমরা পেয়েছি?
আজ গ্রামছাড়া হয়ে গোমদন্ডীকে ভাবতে ইচ্ছে করছে! মনে পড়ছে সেই ছায়াঢাকা, পাখিডাকা গ্রামখানিকে বারবার। অর্ধশতাব্দীর সুখ-দুঃখের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামখানিকে কোনোদিন এমনভাবে ছেড়ে আসতে হবে কল্পনা করিনি, তাই বোধহয় সেই স্বর্গাদপি গরীয়সী জন্মভূমির স্মৃতি ইচ্ছে করেও ভুলতে পারছি না। দিনরাত মনের এক অজ্ঞাত ক্ষতস্থান থেকে যন্ত্রণা উঠছে বুঝতে পারি, কিন্তু করার কিছুই নেই। তাই মাঝে মাঝে নির্জনে অশ্রুবিসর্জন করে মনের বেদনা ভুলতে চেষ্টা করি মাত্র।
জীবনভরা যাদের ছিল হাসি আজ কান্নাই তাদের সম্বল! দুঃখের পাঁচালি গেয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চলেছি ছুটে, জানি না এ চলার শেষ কোথায়। একবার বর্গিদের হামলায় দেশত্যাগী হয়েছিলেন আমার পূর্বপুরুষ, আজ ভ্রাতৃবিরোধে আমি হলাম যাযাবর। বর্ধমান থেকে চট্টগ্রামে গেছেন পূর্বপুরুষগণ প্রাণ বাঁচাতে, আমি চট্টগ্রাম থেকে আবার বর্ধমানের কোলে এসেছি আশ্রয় এবং খাদ্যের ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে! কপালের লেখা হয়তো একেই বলে! ভাই ভাই-এর ঝগড়া যে এমন সর্বনাশী প্লাবন আনে জানতাম না। মানুষের দুর্ভাগ্য, মানুষে দীর্ঘশ্বাস শুনে ঈশ্বরকে স্বভাবতই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে,
হে বিধাতঃ! কোন পাপ করিল সে জাতি?
কেন তাহাদের হল এত অবনতি?
প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা আমার গোমদন্ডীর চারিদিকে শুধু সবুজের মেলা। ছুটি উপলক্ষ্যে শহরের কৃত্রিম পরিবেশের মায়া কাটিয়ে যখন গিয়ে পল্লিজননীর শ্যামল কোলে প্রথম আশ্রয় নিতাম তখন ভুলে যেতাম নগর-জীবনের সমস্ত দুঃখকষ্ট। জীবনের সমস্ত দৈন্য গ্লানি যেন এক মুহূর্তে ধুয়ে-মুছে যেত, পল্লিমায়ের সোনার কাঠির স্পর্শে পেতাম জীবনের নতুন সাড়া। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে দু-কূল প্লাবিত কর্ণফুলি দিয়ে সাদা পালের নৌকায় চড়ে গ্রামে যাওয়ার সময় দু-পাশের ধানখেতে চোখ পড়লেই প্রবাসীর মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত।
অন্ন-বস্ত্রের জন্যে নগরের যান্ত্রিক সভ্যতার চাপে যখন শরীর মন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখনই মন বিদ্রোহ করে দেশে ফিরে যাবার জন্যে। অস্থির হয়ে পড়ি পল্লিমায়ের স্নেহশীতল ছায়ায় নির্বিঘ্ন জীবনযাপন করতে। তখনই মনে বড়ো হয়ে প্রশ্ন জাগে, আর কি ভাগ্যে জন্মভূমি দেখা ঘটে উঠবে না, আর কি কোনোদিন ফিরে যেতে পারব না আমার সেই নিভৃত কুটিরে? ছোটো ছেলেটা দেশে ফেরার বায়না ধরলে আর অশ্রু চেপে রাখতে পারি না। নিজেকে অভিশপ্ত বলে ধিক্কার দিই বার বার। মাঝে মাঝে কোনো কোনো সময় অতীতের চিন্তায় বিহ্বল হয়ে পড়লে কেবলই যেন পল্লিমায়ের স্নেহব্যাকুল আহ্বান শুনতে পাই—’ওরে আয় রে ছুটে আয় রে ত্বরা—’ কিন্তু ছুটে কোথায় যাব? পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে ছুটে ছুটে প্রাণ তো কষ্ঠাগত হয়ে উঠল, তবুও তো কোনো আশ্রয় মিলল না, আমাদের! শ্রমের পর বিশ্রাম না মিললে প্রাণধারণই হয়ে ওঠে অসম্ভব, কিন্তু আমরা তো শুধু শ্রমই করে চলেছি, বিশ্রামের সময় আসবে কখন?
আজ চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে গ্রামখানি উঠেছে ভেসে। মন আমার আজ বেদনাবিধুর হয়ে শুধু স্মৃতিরই রোমন্থন করে চলেছে। আমার গোমদন্ডীর বিস্তৃতি ছিল দৈর্ঘ্যে সাড়ে চার মাইল আর প্রস্থে আড়াই মাইল। বিদেশ থেকে গ্রামে চিঠিপত্রাদিতে দত্তপাড়া-দক্ষিণপাড়া, সুবৰ্ণবণিক পাড়া, বড়য়াপাড়া, বহদ্দারপাড়া ইত্যাদি বলে চিহ্নিত না করলে অনেক সময় প্রাপকের কাছে চিঠি পৌঁছে দিতে পিয়োনদের হিমসিম খেতে হত। গ্রামটিতে উচ্চ শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, উকিল-মোক্তার, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক, রেলকর্মচারীর সংখ্যা বড়ো কম ছিল না। হিন্দু-মুসলমান খ্রিস্টান প্রভৃতি সমস্ত সম্প্রদায়েরই বাস ছিল। সপ্তপুরুষ যেখানে মানুষ সেই সোনার চেয়ে দামি আমার । গ্রামখানি আজ কোথায় গেল হারিয়ে? কোথায় গোমদন্ডী আর কোথায় আজ আমি?
সবুজধানের খেত, আম-কাঁঠালের ও সুপারিকুঞ্জ-ঘেরা বিরাট গ্রামখানির অনবদ্য শ্যামলশোভা মনকে আজও সরস করে তোলে। চারিদিকে থইথই জলে যখন মাঠ যেত ডুবে, জোয়ারের জল নদীর কানায় কানায় যখন উঠত ভরে, তখন সেই দৃশ্য দেখে আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতাম। পুজোর ছুটিতে যখন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বড়ো দিঘির পাড়ে বসে পূর্বদিকের দূরবর্তী পাহাড় শ্রেণির দিকে তাকাতাম, দিঘির কাকচক্ষু স্ফটিক জলের সুদূরপ্রসারী হাওলা বিলের জলে কুমুদকহ্লার শোভিত সবুজ ধানের দোলন দেখে কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েই যেন বলেছি বহুবার,
এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার? কোথায় এমন ধূমপাহাড়?
কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্ৰ আকাশতলে মেশে?
এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে?
এই স্মৃতির সঙ্গে মিশেছে শৈশবের ভুলে-যাওয়া দুষ্টুমির কথা। মনে পড়ছে ছোটোবেলায় সমবয়সিদের সঙ্গে দল বেঁধে পুকুর থেকে পদ্মফুল তোলা, জেলেদের ভাড়াটে নৌকা করে জলে-ভরা খালবিল অতিক্রম করে বেড়াতে যাওয়ার কথা, বনভোজন, খালের ওপর থেকে কাঠের পুলের রেলিং-এ বসে নানান আজগুবি গল্পগুজব, পুলের নীচে দিয়ে মাঝিদের ছই দেওয়া নৌকায় ছোটো ছোটো ঢিল ছুঁড়ে মারা, পুল থেকে ঝপাং করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়া, এমনি আরও কত কী। ফুটবল খেলার অনুশীলন উপলক্ষ্যে হাতাহাতির কথাগুলি আজও মনের মানচিত্রে জ্বলজ্বল করছে। জানি না কোন অভিশপ্ত জীবন নিয়ে আমরা সুজলা সুফলা পূর্ববঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, জানি না কোন বিধিবিড়ম্বনায় এমন স্বর্ণপ্রসূ জন্মভূমি ত্যাগ করে আমাদের সর্বহারা হয়ে চলে আসতে হল! কিন্তু তবু মনে হয় এ চলে-আসা আবার দেশে ফিরে যাওয়ার ভূমিকা মাত্র–আমাদের এই আশা চিরতরে আসা নয়।
মনে পড়ে বারোয়ারি পুজোর সময় ছেলে-মেয়েদের উদ্দাম আনন্দের কথা। বৃদ্ধরাও সে আনন্দের অংশীদার হতে দ্বিধাগ্রস্ত বা লজ্জাবোধ করতেন না। পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামে থিয়েটার, যাত্রা, কবিগান, গাজীর গান ইত্যাদি শোনার জন্যে গ্রামের ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের অধিবাসীরা উৎসুক হয়ে থাকত। দূরদূরান্তর থেকে পদব্রজে এবং নৌকা করে বহু শ্রোতা আসত গান শুনতে। সে-শ্রোতার জাতিভেদ ছিল না–সেখানে হিন্দুর চেয়ে বেশি উৎসাহী ছিল মুসলমান ভাইয়েরা। সকলে সমান অংশীদার হয়ে তদারক করত আসর–গানের অর্থবোধ করে কাঁদত সকলেই সমানভাবে। সেখানে কে কার দুঃখে কাঁদছে সেটা বড়ো কথা ছিল না, বড়ো ছিল দরদি মন, বড়ো ছিল দুঃখবোধ। আজ সে নিষ্পাপ মন পরিবর্তিত, আজ অন্য সম্প্রদায়ের দুঃখে অশ্রু বিসর্জন করা যেন লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এমনটি হল? কেন মানুষ তার দরদ হারিয়ে অমানুষে পরিণত হয়েছে, কেন গড়ে তোলা হল বিপদের এই বেড়াজাল? এ বিপদের বেড়াজাল কি ছিন্ন করা যায় না সমস্ত দুঃখিত অবহেলিত মানুষের সামগ্রিক চেষ্টায়? মনে পড়ে দক্ষিণপাড়ার সুন্দরবলী, গোলামনকী ওরফে নকীবলী, ফতে আলি, গোপী চৌধুরি, ভৈরব দত্ত, তারিণী দে, কালী সিং, প্যারী সিং, রামগতি সিং ইত্যাদি পালোয়ানদের অদ্ভুত সব গল্পের কথা। সুন্দরবলীর বহু শক্তির কথা আজও লোকের মুখে মুখে শোনা যায়। সে নাকি প্রায় চল্লিশ বছর আগে যৌবনে পথের মধ্যে ঝড়ে নুয়েপড়া দুটি কাঁচা বাঁশ মুচড়িয়ে গ্রন্থি দিয়ে পথের পাশে সরিয়ে রাস্তা চলাচলের বিঘ্ন দূর করে দিয়েছিল। আর একবার বাড়ি থেকে নৌকাযোগে কর্ণফুলি নদী পার হওয়ার সময় মুসলমান মাঝির সঙ্গে দাঁড় টানা নিয়ে বাদানুবাদ হওয়ার পর অগত্যা নিজে দাঁড় টানতে বসে এবং দু-চারটে টান দেবার পরই অমন মজবুত দাঁড় পাটকাঠির মতো ভেঙে দু-টুকরো হয়ে যায়! এর ফল হয় আরও ঘোরালো, মাঝি প্রচন্ড রেগে অকথ্য গালাগালি দিয়ে অন্য দাঁড় টানতে বাধ্য করে তাকে। আস্তে আস্তে সুবোধ বালকের মতো দাঁড় টেনে তীরে পৌঁছে ক্রুদ্ধ সুন্দরবলী মাঝিকে একটু শিক্ষা দেবার অভিপ্রায়ে মাঝিসমেত নৌকাটি দু-হাতে তুলে কূলে উঠে পড়তেই মাঝির অন্তরাত্মা খাঁচা ছাড়ার উপক্রম হয়। ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে সে সুন্দরবলীর হাতে-পায়ে ধরে কোনোক্রমে সে-যাত্রা রক্ষা পায়! আর সব মল্লবীরদেরও অনেককে আমি নিজের চোখে দেখেছি, তাদের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছিল সমান। চেহারা দেখলে চোখ ফেরানো যেত না। হাতের থাবা ছিল বাঘের মতো। বাক্যবলের চেয়ে তারা বাহুবলেরই ছিল পূজারি। গোপী চৌধুরি এত স্বাস্থ্যবান ছিল যে মাইল পঞ্চাশেক সে অনায়াসেই হেঁটে পাড়ি দিত অম্লান বদনে। আজ তারা কোথায় জানি না, কিন্তু সেদিন তারাই ছিল গ্রামের প্রহরী, গ্রামের রক্ষাকর্তা। তারা থাকতেও গ্রামের মধ্যে বিভেদ, বাইরের লোকের চক্রান্ত প্রবেশ করল কী করে? মল্লবীরদের মধ্যে তো কোনোদিন জাতিভেদের কুৎসিত হানাহানি দেখিনি। তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা ছিল এক ওস্তাদের শিষ্য বলে। কোথায় সুন্দরবলী, কোথায় গোপী চৌধুরি? বিপদের দিনে তারা কি ‘গুরুজি কী ফতে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক পশুটার গলা টিপে ধরতে পারত না?
গ্রামের জাগ্রতা দেবী জ্বালাকুমারীর মন্দিরে ভক্তিভরে কতশত ভক্ত হত্যা দিয়েছে প্রাণ নিঙড়ানো অর্ঘ্য দিয়েছে। তিনিও কি জ্বালা নিবারণ করতে পারেন না আজকের মূঢ় মানুষের? কেন সবাই নির্বাক, কেন শান্তির সপক্ষে কারও স্বর উঠছে না আজ?
বছর পঞ্চাশ পূর্বে বহু শ্রমসহকারে ‘সুহৃদ পাঠাগার’ নামে একটি পাঠচক্র স্থাপন করেছিলাম, আজও মন পড়ে আছে সেই পাঠাগারে। এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন বেঁচে, তিনি আজও গ্রামের মাটিতেই আটকে রয়েছেন খবর পেয়েছি। মাটির মায়া তাঁকে অবশ করে রেখেছে, তাঁর মতো দেশপ্রাণের সাক্ষাৎ আজ ক-জনের মধ্যে দেখতে পাই?
রেলস্টেশন থেকে জেলা বোর্ডের রাস্তাটি সোজা চলে গিয়েছে পোপাদিয়া গ্রামের বুক চিরে কালাচাঁদ ঠাকুরবাড়ির কোল ঘেঁষে আশুতোষ কলেজ পর্যন্ত। গ্রামটি দিঘিবেষ্টিত, বড়ো দিঘিতে জেলেরা যখন বড়ো জাল ফেলে মাছ ধরত সে-দৃশ্য দেখতে পুকুরপাড়ে জমত উৎসুক দর্শকের দল। তার ঘাটে সন্ধেবেলায় বসত মজলিশ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার আড়া। কোথাও দেখা না পেলে শেষে পুকুর ঘাটে জমায়েত হলেই নির্দিষ্ট জনের সাক্ষাৎ অবশ্যই মিলত। দু-পাশে ফুলভারে নত কামিনী ফুলগাছের ডাল এসে গায়ে লাগত, ঘাটের ওপর ঝাঁকড়া চাঁপাফুলের গাছটি গন্ধ বিতরণ করত চতুর্দিকে। বড়ো মনোরম ছিল জায়গাটি। পুকুরের পূর্বপাড়ে পিতৃপুরুষের মহাবিশ্রামের স্থান শ্মশানঘাট। শুভকাজ উপলক্ষ্যে বাড়ির বাইরে গেলে ওই শ্মশানের উদ্দেশে পিতৃপিতামহদের প্রণাম জানিয়েছি কত। তাঁদের মৃত্যুর দিনটিতে স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে ফুলগুচ্ছ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে স্মরণ করেছি বছরের পর বছর। আজ শ্মশান বলতে আলাদা কিছু বোঝায় না, সমস্ত দেশটাই শ্মশানে পরিণত হয়েছে। দূর থেকে তাই প্রণাম জানাচ্ছি শ্মশানেশ্বরকে! কোন ভগীরথ প্রাণগঙ্গা এনে অভিশপ্ত মৃত্যুপথযাত্রীদের জীবিত করে তুলবেন আজ?
পাশের বাড়ির পিসিমার প্রিয় বাঁহাস (লাউয়ের খোসার জলপাত্র) থেকে গ্রীষ্মের দুপুরে কখনো চেয়ে কখনো চুরি করে টকজল খেয়ে কতদিন বকুনি সহ্য করেছি ভেবে হাসি পাচ্ছে। পিসিমা আর বকতে আসবেন না, তিনি চিরনিদ্রায় অভিভূত। আমরা তাঁর বাগান থেকে প্রাণভরে গোটা নির্জন দুপুরে কাঁচা আম, পাকা মিষ্টি আম, আমড়া, কাঁঠাল, কামরাঙা, লিচু, কালোজাম, গোলাপজাম, জামরুল, তরমুজ, ফুটি, নোনা, আতা, শসা ইত্যাদি খেতাম ইচ্ছেমতো। অতীতের স্বাদ আজও ভুলিনি, কিন্তু সেসব ফল এখন আর তেমন করে পাব কোথায়? আজ যেন ‘উত্থায় হৃদিলীয়ন্তে দরিদ্রাণাং মনোরথাঃ’র মতো অবস্থা আমাদের, ভালোমন্দ জিনিস খাবার ইচ্ছে থাকলেও উদাসীনতার ভান করে আত্মদমন করতে হয়!
গ্রামের চারণকবি রূপদাস কৈবর্ত বা প্রসিদ্ধ কবিয়াল রমেশ শীলের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। শ্রাবণ মাস থেকে নাগসংক্রান্তি পর্যন্ত তারা মনসামঙ্গল থেকে গাথা গেয়ে সমস্ত গ্রামটিকে মুখরিত করে রাখত। মেয়েদের মধ্যেও কেউ পুজোর সময় চন্ডীমাহাত্ম্য বা জাগরণ পুথিও সুর করে পড়ত বলে মনে পড়ে। সেদিনের সেই উৎসাহ উদ্দীপনা আজ গেল কোথায়? আর কি ফিরে পাব না গ্রামের জীবন? নগরজীবনকেই কেন্দ্র করে যন্ত্রবৎ বেঁচে থাকতে হবে আজীবন? আর কি কোনোদিন শিবের গাজন, চড়কের মেলা, বারুণী স্নান উপলক্ষ্যে গ্রামে হুটোপুটি করতে পাব না? পাব না কি মুখোশ এঁটে মহিষ, বাঘ, ভাল্লুক সেজে মুখোশ অভিনয় করতে গ্রামের মাঠে? বিশ্বাস আছে মা আবার আমাদের কোলে টেনে নেবেন এবং এ নহে কাহিনি, ‘এ নহে স্বপন, আসিবে সেদিন আসিবে।’ আমরা সেইদিনের প্রতীক্ষাই করব।
জলপাইগুড়ি – বোদা
সুখের স্মৃতি বেদনা আনে, তবু যা একদিন নিতান্তই আপন ছিল অথচ রাজনীতির খেলায় যার সঙ্গে সম্পর্ক আজ অতিদূর হয়ে গেল তার কথা না ভেবে পারি কী করে! আমার গ্রামজননী বোদা বাংলাদেশের অসংখ্য গ্রামের একটি। হয়তো খুব করে বড়ো মুখে বলবার মতোও কিছু নেই তার–তবু আমার কাছে জননীর মতোই সে অদ্বিতীয়া।
চোখ মেলেই যার আকাশ দেখেছি, যার ধুলো গায়ে মেখে বড়ো হয়েছি সেই বোদা আজ পরদেশ। জানি না আজও মাঘী পূর্ণিমায় বোদেশ্বরী মন্দিরে মহোৎসব হয় কি না, স্বচ্ছতোয়া করতোয়ার উত্তরবাহী অংশে বারুণি-স্নান উপলক্ষে একমাসব্যাপী মেলা বসে কি না তাও জানি না। অম্বিকাসুন্দরী কারকুন যে শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন সেখানে আজও নিত্য পুজো হয় কি না সে খবরই বা আমায় কে দেবে।
বোদা যেতে হলে ডোমার পর্যন্ত যেতে হত ট্রেনে, সেখান থেকে গোরুর গাড়িতে একুশ মাইল পাড়ি দেবার পর বোদা। আরও একটা পথ ছিল। জলপাইগুড়ি থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ট্রেনে, সেখান থেকেও আবার গোরুর গাড়ির সাহায্য নিয়ে পনেরো মাইল পার হয়ে গেলে বোদার দেখা মিলত। জলপাইগুড়ি থেকে বোদা পর্যন্ত বাস চলা শুরু হয় আজ থেকে বছর পঁচিশ আগে। প্রথম বাসটির নাম মনে আছে, ‘আঁধারে আলো। সত্যি যেন সে বাসটি আলো হয়ে এল বোদার অধিবাসীদের কাছে।
বোদার নামকরণের ইতিহাস বলি। বুদ্ধরাজা এক বিরাট গড় তৈরি করে রাজবাড়ি স্থাপন করলেন। দু-বর্গ মাইল এলাকা। ক্রমে সেই গড়ে স্থাপিত হল দেবী বুধেশ্বরীর মন্দির। শক্তির ভ্রামরী মূর্তি দেবী বুধেশ্বরী। একান্ন পীঠের অন্যতম। ক্রমে লোকের মুখে মুখে দেবী বুধেশ্বরীর নাম হল বোদেশ্বরী। সেই থেকে ‘বোদা।
আগে রংপুর জেলায় তেঁতুলিয়া মহকুমার মধ্যে ছিল বোদা। ১৮৬৯খ্রিস্টাব্দে গঠিত হল নতুন জেলা জলপাইগুড়ি। তখন বোদা এল জলপাইগুড়ির মধ্যে। তারপর এল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট। র্যাডক্লিফের রায়ে বোদা পড়ল গিয়ে পাকিস্তানে। আমাদের ছেড়ে আসতে হল জন্মভূমিকে।…তবু মাকে ছেড়ে আসা কি সহজ কথা?
মনে পড়ছে পোহাতুর মায়ের কথা। সেই নিরক্ষরা কৃষক জননীর ছড়া কাটা,
ছাড় জায়গা নারয় পানি,
ছাড় পুত্র না ধরে বাণী,
ছাড় দেশ নিবন্ধুয়া,
ছাড় ভার্যা দুচারিণী,
পোহাতু গামছা দিয়ে কপালের ঘাম আর চোখের জল মুছলে। বলল, মাকে কি ছাড়া যায়? মা রুদ্ধকণ্ঠে বললে,
ছাড় খেচখেচি মাও,
ছাড় খেচকেটা দাও।
ভাবছি, আমার বোদাও কি আজ নিবন্ধুয়া দেশ হয়ে উঠল? তাকেও কি শেষপর্যন্ত ‘খেচখেচি’ মায়ের মতোই ত্যাগ করতে হল?…ত্যাগ করতেই হল বোদাকে। তবু ভুলতে পারি না বোদার কথা। …কোনোদিন কি পারব ভুলতে? মনে পড়ছে সারারাত ব্যাপী যাত্রার কথা। রাতের পর রাত, পালার পর পালা।
আরও মনে পড়ছে আমন ধান রোপণের আগে গছর পোনা, ধান কাটার আগে লক্ষ্মী পুজো, আর জমিতে ধুলো ছড়িয়ে ছড়া কাটা,
আগ শুয়োর হঠ
পোকা-মাকড় দূর যাউক,
সবার ধান আউল ঝাউল,
আমার ধান শুদ্ধ চাউল।
তারপর নয়া-খাওয়া, বিশুয়া, কইনাগাত, জিতুয়া। সবই মনে পড়ে আজ।…
গ্রামের লোকসংগীতের সুর এখনও কানে বাজে। চোখ বুজে সেই সুর শুনতে শুনতে আবার আমি বোদায় ফিরে যাই। লোকসংগীত সংগ্রহের শখ ছিল খুব। গাঁয়ের মানুষের মুখে গান শুনেই তৃপ্তি হত না, তাদের কাছে বসে সেই গানের কথা লিখে নিতাম। সে কথায় কৃত্রিমতার লেশমাত্র নেই, তার সুরের উৎস হৃদয়ে। আজও ইচ্ছে করে সেই সুর শুনতে, সেই গানের কথা সংগ্রহ করতে। কিন্তু আজ তো সে দুয়ার একরকম বন্ধ।
বিশেষ করে মনে পড়ে রাখালমেয়ের মুখের মইশাল গান,
মইশাল মইশাল করো বন্ধু রে
(ওরে) শুকনা নদীর কূলে হে,
মুখখানি শুকায়ে গেছেচৈত মাইস্যা ঝামালে।
প্রাণ কান্দেম ইশাল বন্ধু রে।
আমার বাড়িতে যাইয়ো বন্ধু রে এই না বরাবর,
খেজুর গাইছা বাড়ি আমার
পুব দুয়ারা ঘর।
প্রাণ কান্দে মইশাল বন্ধু রে।
আমার বাড়িতে যাইয়ো বন্ধু রে,
বসবার দিব মোড়া,
জলপান করিতে দিব ও শালি ধানের চিড়া।
প্রাণ কান্দে মইশাল বন্ধু রে।
শালি ধানের চিড়া দিব রে বিন্দু ধানের খৈও
(আজি) মোটা মোটা সফরী কলা গামছা
পাতা দৈও রে।
প্রাণ কান্দে মইশাল বন্ধু রে।
মইশাল বন্ধুর জন্যে মেয়ের প্রাণ কাঁদছে। চৈত্রমাসের উত্তাপে শুকনো নদীর কূলে মুখখানি শুকিয়ে গেছে একেবারে। মেয়ে বলছে মইশাল বন্ধুকে, তুমি এই পথ ধরে আমার বাড়িতে যেয়ো। আমার পুব দুয়ারি ঘর, বাড়িতে আছে খেজুর গাছ। তোমার বসবার জন্যে মোড়া দেব, জলপান করতে শালি ধানের চিড়া দেব। আর দেব বিন্দু ধানের খৈও, মোটা মোটা সফরী কলা আর ঘন দই।
বোদা হল দিঘির দেশ। কত যে দিঘি! রাজার দিঘি, ময়দান-দিঘি, কইগিলা-দিঘি, ঠাঁটপাড়া-দিঘি। আরও কত দিঘি। সুউচ্চ পাড় আর অশ্বথ ছায়ায় ঘেরা ময়দান দিঘির কাকচক্ষু জলে আজও লাল শাপলার ছায়া কেঁপে কেঁপে ভাসে কি না কে জানে! ঠিক তেমনই আজও কেউ জানে না সেই লোভী ব্রাহ্মণের নাম, যে নাকি দিঘি-ঠাকুরানির ঋণ পরিশোধ করেনি।
মেয়ের বিয়ের ব্যয়বহনে অক্ষম কোনো গরিব লোক ময়দান-দিঘির পাড়ে এসে করজোড়ে প্রার্থনা জানালে জলের বুকে নাকি ভেসে উঠত মোহরে ভরতি থালা আর চালুনি। চালুনির মোহর নিলে ফেরত দিতে হত না। চালুনির মোহর ছিল দিঘি-ঠাকুরানির দান। কিন্তু থালার মোহর ভেসে উঠত ঋণ হিসেবে। এক লোভী ব্রাহ্মণ চালুনি আর-থালা, দু-পাত্রেরই মোহর আত্মসাৎ করল। কিন্তু ঋণের মোহর আর পরিশোধ করতে পারল না। শোনা যায়, সেই থেকে নাকি দিঘি ঠাকুরানি আর কাউকে দয়া করেননি।
লোকে বলে যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় কোচবিহারের মহারাজা দুর্ভিক্ষের হাত থেকে প্রজাদের বাঁচাবার জন্যেই এইসব দিঘি কাটিয়েছিলেন। দিঘি খননের জন্যে লোকে মজুরি পেত মাথাপিছু একসের চাল আর নগদ দু-আনা।
বোদাতে শুধু দেবমন্দির আর দিঘিই ছিল না। এই ছোটো গ্রামটিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব বোধ করেনি কেউ। বোদার ছেলেদের হাই স্কুল অতিপুরোনো। মেয়েদের জন্যেও ছিল আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়। আমগাছের ছায়াস্নিগ্ধ প্রাঙ্গণে বালিকা বিদ্যালয়টি সত্যিই পঠন পাঠনের পক্ষে ছিল আদর্শ স্থান। এ ছাড়া বরিশাল জেলার রাজবন্দি গোপালকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি নৈশ বিদ্যালয়।
বোদার গৌরবের ভূষণ ছিল কোচবিহার-কাছারি। তা ছাড়া দাঁতব্য চিকিৎসালয়, জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র, সাব-রেজিষ্টারি অফিস, থানা, ডাকঘর সবই ছিল বোদা গ্রামে।
আজও হয়তো সবই আছে। নেই শুধু আমরা–বোদার এই হতভাগ্য সন্তানেরা, ভাগ্যের পরিহাসে পশ্চিমবাংলার তথা ভারতের নানা প্রান্তে যারা আজ ‘বাস্তুহারা বলে পরিচিত। বোদাকে আজ স্পর্শ করতে পাই না, তার বাতাসে আর নিশ্বাস নিতে পাই না, তবু তাকে স্মৃতিতে পাই। বোদা আজও আমায় ডাকে। তার প্রাণের কান্না প্রতিমুহূর্তে শুনতে পাই। নাকি আমারই প্রাণের কান্নাকে তার প্রাণের কান্না বলে ভুল করি! কাঁদি, তবু ভাবি, এ কান্না একদিন শেষ হবেই, বোদার কোলে আবার গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
ঢাকা জেলা – বজ্রযোগিনী সাভার ধামরাই খেরুপাড়া ধামগড় আনরাবাদ শুভাঢ্যা নটাখোলা সোনারং
কর্মমুখর নগরজীবনের এক সন্ধ্যায় সম্ভাষণ এল এক বাল্যবন্ধুর কাছ থেকে। বন্ধু শুধু বন্ধুই নয়, যে আমার শিক্ষাজীবনের সহপাঠী, কর্মজীবনের সহযাত্রী। তার ডাকে পরমআগ্রহ নিয়ে গেলাম তার কাছে। সবেমাত্র সে ফিরে এসেছে আমাদের দুজনেরই জন্ম-গ্রামের কোল থেকে। দেখা হতেই প্রশ্ন : তোমার জন্যে দেশ থেকে এনেছি এক পরমসম্পদ, বলো তো সে কী হতে পারে? ভাবতে চেষ্টা করলাম শতাব্দীর সন্ধিকালে এমন কী সম্পদ সে নিয়ে আসতে পারে দূরান্তরের সেই গ্রাম থেকে। শেষপর্যন্ত সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বন্ধুটি তুলে দিল আমার হাতে এককৌটো মাটি। আমার পিতৃ-পিতামহের আশিস-পূত বসতবাটি ‘বসু বাড়ির ভিটে’-র মাটি। এ মাটি আমার মা। এ মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পূর্বপুরুষের পুণ্যস্মৃতি। আমার কাছে এ শুধু মহামূল্যই নয়–অমূল্য। মাথায় ঠেকালাম সে-মাটি। এ মাটি ধুলো নয়। এ মাটি বাংলার হৃদয়-নিংড়ানো রক্তে সিক্ত আজ। তার দহনজ্বালায় সর্বংসহা ধরিত্রীর চোখ থেকেও ঝরছে অশ্রু-বহ্নি। জলে ঝাপসা হয়ে এল দৃষ্টি। কেঁদে উঠল, অসহায় মন।
উত্তরে ধলেশ্বরী, দক্ষিণে প্রমত্তা পদ্মা। মাঝখানে বহুর মধ্যে এক এই গ্রাম। বর্ষার প্লাবনে খরস্রোতা নদীর ঢেউ দোলন লাগিয়ে যায় আমার গ্রামের স্নিগ্ধ মাটির বুকে। বর্ষার বিক্রমপুরের রূপ অপরূপ! জলে জলময় ছল-ছল সব পল্লি। একবারের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। একেবারে ছেলেবেলাকার কথা। ঘরে ঘরে সাঁকো। এবাড়ি-ওবাড়ি যেতে আসতে নৌকো। তার ওপর বর্ষার জলে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের ভাসিয়ে দেওয়া ছোটো-বড়ো কাগজি নৌকো, কলার মোচা ও কলাগাছের বাকলের নৌকোর ছড়াছড়ি। বাড়ির উঠোনে খেলে যায় ছোটো ছোটো মাছ। সে-মাছ ধরার জন্যে ছোটোবেলায় সে কী মত্ততা! সন্ধে হতেই পাটখেতে ধানখেতে বঁড়শি পেতে রেখে আসার হিড়িক। ঘণ্টা দু-ঘণ্টা পর পর লণ্ঠন হাতে জল ঝাঁপিয়ে যেতে অনেক সময় হাসতে হাসতেই বঁড়শিতে সাপও তুলে নিয়ে এসেছে আমাদের মধ্যে অনেকে মাছের সঙ্গে সঙ্গে। সাপের ভয় ভয়ই নয় যেন! পুল থেকে দল বেঁধে লাফিয়ে পড়ে বর্ষার জলস্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার আনন্দও ভুলে যাওয়া চলে না। এমনি কত কী! শারদ বঙ্গের মাধুর্যও যেন ম্লান এখানে এক হিসেবে। মনে হয় বর্ষার বিক্রমপুরকে যারা দেখেনি, বিক্রমপুরের আসল রূপের সঙ্গেই তারা অপরিচিত।
আরও পরের কথা। আকাশে একটি-দুটি করে সবেমাত্র তারা ফুটতে শুরু করেছে। তারই ছায়া পড়েছে গোয়ালিনির কাকচক্ষু দিঘির জলে। কতকাল আগের কোন গোয়ালিনির স্মৃতি বয়ে চলেছে এ দিঘি জানা নেই। তবে সে অজানা গোয়ালিনির আভিজাত্য অস্বীকারেরও উপায় নেই। আমাদের বাড়ির সমুখ দিয়েই চলে গেছে বজ্রযোগিনী-মীরকাদিমের সড়ক। এই সড়কই আমাদের রাজপথ। রাজপথের ধারে অনেক দিঘির মতো গোয়ালিনি দিঘিরও একদিন মর্যাদা ছিল। কিন্তু আজ সে হৃত যৌবনা, তার কচুরিপানাময় জঞ্জাল রূপ আজ আর হয়তো কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আমরা ছোটোবেলায় এ দিঘির ঘাটে বসে কত সময় কাটিয়েছি, কত গল্প করেছি, ছুরিতে কেটে, ঘেঁদা ঝিনুকে চেঁছে দিনের পর দিন খেয়েছি কত কড়া-কাঁচা আম! সে সবই আজ স্মৃতি।
দিঘির পাড়ের শ্মশানের আগুনের শিখাও চোখে ভাসে। কিন্তু আমার বাঙাল দেশজুড়ে আজ যে আগুন জ্বলছে তার লেলিহান শিখার, তার দাহিকা শক্তির প্রচন্ডতার বুঝি তুলনা নেই! সে-আগুনে ছাই হয়েছে মরা মানুষের অস্থি-মজ্জা-মেদ, এ আগুনে পূর্ণাহুতি তাজা তাজা হাজারো জীবন।
আমার গাঁয়ে পথচলতি মানুষ দলে দলে চলে উত্তরে দক্ষিণে–কাজ সেরে কেউ বাড়িমুখো, কেউ বাড়ি ছেড়ে কাজে, আবার কেউ বা হয়তো চলেছে আড্ডায়। রাত পড়তেই পথের এপাশে-ওপাশে কোনো-না-কোনো বাড়িতে নিশিকান্ত বা হরলালের কীর্তন আর না হয় শিশরির ‘ত্রিনাথের মেলা’-র গান শুরু হয়েছে বা হয়নি। এমনি ছিল আমার গাঁয়ের প্রায় প্রতিদিনকার সান্ধ্য পরিবেশ। সুখবাসপুরের সুধাকণ্ঠ গায়ক দুর্গামোহন মুখোপাধ্যায় আমাদের বাড়িতে প্রায় রোজই শ্যামাসংগীতের আসর বসাতেন এবেলা-ওবেলা। আর আমার ভক্তপ্রবর ঠাকুরদা স্বর্গীয় রাজমোহন বসু মজুমদার কেঁদে বুক ভাসাতেন সেসব গান শুনে। ভক্তিরসের বাহুল্য দেখে সেই ছোটোবেলায় আমরা হয়তো অনেক সময়ই হেসেছি। কিন্তু দুর্গামোহনের,
মা আছেন আর আমি আছি,
ভাবনা কি আর আছে আমার?
মায়ের হাতে খাই পরি
মা নিয়েছেন আমার ভার।
এসব সুললিত গানের কথা আজও যে ভুলতে পারিনি! কর্মক্লান্ত দিনের অন্যান্য অবকাশে কলকাতার ফুটপাথে চলতে চলতে কতদিন এসব ছায়াছবির মতো ভেসে উঠেছে মনের পর্দায়।
আজও মনে ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে বিক্রমপুরের সেই গ্রাম, যে গ্রামের নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার নাড়ির যোগ। যখনই চিন্তায় হাতড়াই, কাছে এসে পড়ে বজ্রযোগিনী গ্রামের স্বপ্ন-মাখানো স্নেহভরা সেই স্মৃতি। মায়ের মতো ভালোবেসেছি এই গ্রামকে। আমার প্রায় সব-ভুলে-যাওয়া শৈশব আর সব মনে-থাকা কিশোর-জীবনের কান্না-হাসির দোলায় স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে আমার সেই ছেড়ে আসা গ্রাম।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বজ্রযোগিনীর নাম অবিস্মরণীয় সত্তা। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে ও ঐতিহ্যে এ গ্রাম লক্ষ গ্রামের দেশ বাংলায় যেকোনো একটি নয়, স্বমহিমায় এ সবিশেষ। সুদূর অতীতের অন্ধকার যুগে বাংলার সত্যসন্ধানী যে ছেলে একদিন জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে দূরধিগম্য হিমাচলের দুস্তর গিরিমালা অতিক্রম করে তুষারঘেরা ঘুমের দেশ তিব্বতে উপনীত হয়েছিলেন ভগবান তথাগতের বাণী নিয়ে, সেই জ্ঞান-তাপস দীপংকর শ্রীজ্ঞান অতীশের পুণ্য জন্মভূমি এই গ্রাম। কিন্তু আজ আর পুকুরপাড়ায় সেই দীপংকরের ভিটেয় সন্ধ্যাদীপ জ্বলে না লক্ষ জনের কল্যাণ কামনায়, চলার পথে আজ আর হয়তো কোনো মানুষ সে-মহামানবের অসীম করুণার প্রত্যাশায় মাথাও নোয়ায় না ভক্তিবিনম্রচিত্তে ‘নাস্তিক পন্ডিতের ভিটে’-র সমুখ দিয়ে যেতে যেতে।
পাশের ঐতিহাসিক গ্রাম সেন রাজাদের অধিষ্ঠানভূমি রামপাল আজ শ্রীহীন। তার ভগ্নাবশেষের স্কুপের তলায় আশপাশে অতীত স্মৃতির যেটুকু শুচিতা অবশিষ্ট ছিল তারও সবটাই হয়তো আজ বিনষ্ট। মাইল দীর্ঘ রামপালের সেই বল্লাল দিঘি। প্রজার জলকষ্টে দুঃখপীড়িতা রাজমাতা ছেলের কাছে জানিয়েছিলেন তাঁর মনের বেদনা। পরদিনই দিঘি খননের আদেশ হল। রাজমাতা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যতদূর পথ পায়ে হেঁটে যেতে পারবেন ততদূর দীর্ঘ ও তার অর্ধেক প্রস্থ জলাশয় হবে, বল্লাল রাজার এই হল প্রতিশ্রুতি। প্রজার জলাভাব মোচনে পথ চলায় রাজমাতার বিরাম নেই। রাজ-পারিষদগণের চোখে-মুখে দেখা দেয় উদবেগের ছাপ। শেষটায় কি সারারাজ্য জলময় হয়ে যাবে! পায়ের সামনে অজ্ঞাতে আলতা ঢেলে দিয়ে কৌশলে তখন কে থামিয়ে দেয় রাজমাতাকে পুরো একমাইল পথ হাঁটার পর। রক্তচিহ্ন দেখে ভয়ে থমকে দাঁড়ান মা-রানি। মাইলব্যাপী দিঘির জন্ম হল রাতারাতি। সারারাজ্য মুখর হয়ে উঠল বল্লালরাজ ও রাজমাতার জয়ধ্বনিতে। কিন্তু আজ? আজ আর প্রজার দুঃখে রাজার মন কাঁদে না, এমনকী রাজমাতা, রানি বা রাজ-ভগিনীদেরও নয়। সেখানে আজকের রাজা প্রজারক্ষায় নয়, প্রজাহননে যেন উল্লসিত–রাজপুরুষেরা তারই নানা সাফাই গায় বেতারে, বক্তৃতায়! আজ আর জয়ধ্বনিতে নয়, ক্রন্দন আর্তনাদে সারারাজ্য মুখরিত।
বল্লালদিঘির উত্তর পাড়ের সুদীর্ঘ গজারি গাছ আজও সেন রাজার উদার উন্নত মনের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে কি না জানি না, তবে চার বছর আগেও জীর্ণ সে-গাছের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি প্রায় আটশো বছর আগের গৌরবময় অতীতকে। প্রচলিত ধারণা, রাজার হাতি বাঁধা থাকত এ গাছে। কিন্তু দৈবপ্রভাব ছাড়া শ-শ বছর ধরে কী করে একটা গাছ সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, বিক্রমপুরের মানুষের মনে এ জিজ্ঞাসা অতিপুরাতন। ছেলে-মেয়ের দীর্ঘায়ুর আশায় কত মা এই অমর গাছের শীতল ছায়ায় বসে মানত করেছে, প্রার্থনা জানিয়েছে ভগবানের কাছে। কিন্তু আজকের ভগবানের দরজায় কি মানুষের কোনো প্রার্থনাই পৌঁছোয়? পূর্ববাংলায় আজ যাঁরা ক্ষমতার মালিক তাঁদের দম্ভকে স্বীকার করে আজও কি সেই গজারি গাছ তার অমরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে?
রামপালের হরিশ্চন্দ্রের দিঘির আশ্চর্য কাহিনিও বিস্মৃত হওয়ার নয়। কতবার মাঘী পূর্ণিমার দিনে এ দিঘির অলৌকিক ব্যাপার দেখতে গিয়েছি বড়ো ঠাকুরদার সঙ্গে, আশপাশের গ্রাম থেকে এসেছে দলে দলে নর-নারী আর ছাত্র-শিক্ষকের দল। সারাবছর ধরে যে দিঘির জল থাকে মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে ‘দাম’-বনজংলায় ঢাকা, মাঘী পূর্ণিমায় তার সে কী সজল হাসিমাখানো রূপ! যে দামে’-র ওপর গোরু চরে, ছেলেরা ঘুড়ি ওড়ায়, পাখি ধরে, সাপ তাড়া করে দৌড়োয় দিনের পর দিন, সে ‘দাম’ এই একটি দিনের জন্যে দিঘির জলের কোন অতল তলায় তলিয়ে যায় কে জানে? পূর্ণিমা পেরিয়ে গেলে আবার ভেসে ওঠে যেমনি তেমনি। ব্রিটিশ সরকার এ বিস্ময়ের যবনিকা উত্তোলনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এ প্রাচীন কীর্তির অবমাননাকারীর দন্ড ঘোষণা করে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ে না, এ প্রবাদ হয়তো শুধু প্রবা দই। তা ছাড়া পুববাংলায় আজ হয়তো কোনো হুকুমেই পরোয়া নেই কারুর। মানুষের জীবনেরই কোনো মূল্য নেই যেখানে, সেখানে অজানা অতীতের হিন্দুকীর্তি রেহাই পাবে অমর্যাদার হাত থেকে এ আশা দুরাশা বই কী! তবু আশা হয়, ভেঙে গেছে যে স্বপ্ন, বাংলার বহ্নি-হৃদয়ে আবার উজ্জ্বল হয়ে আলো দেবে সেই স্বপ্ন।
কলকাতার মানুষ হয়ে গেছি আজ। কিন্তু জন্মেছিলাম যার আঁচলজড়ানো কোমল মাটির নরম ধুলোয় তাকে তো ভুলতে পারিনি। দুঃখ আছে মনে, দিন-রাত্রির খাটুনিতে অবসাদ নামে দেহে, আর্থিক দৈন্যও থেকেই যায়। তবু ছুটি পেলেই একছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে প্রায় তিন-শো মাইল দূরের সেই গ্রামে! বিক্রমপুরের স্বপ্ন-ছোঁয়া সেই শ্যামল গাঁয়ের পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে চলতে চলতে ইচ্ছে করে ছেলেবেলার মতো আবার গলা ছেড়ে সুর ধরি : ‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে। এদেশ জন্মদুখিনী, তবু এই আমাদের সাত রাজার ধন, এক-শো হিরে-মানিক জ্বলে তার আকাশে।
কলকাতা থেকে গাড়ি করে গোয়ালন্দ। সেখান থেকে স্টিমারে পদ্মা পেরিয়ে ধলেশ্বরীর কোলে কমলাঘাট স্টেশন। স্টেশনের পর বন্দর। তারই অদূরে মীরকাদিমের হাট পেরিয়েই শুরু আমার গাঁয়ের রাস্তা, যাকে আগে বলেছি ‘রাজপথ’। খানিক এগিয়ে এলেই আমার গ্রামের মুখে সুখবাসপুরের সেই কড়ই গাছ। এখানে এসে বিশ্রাম-সাধ না জেগেছে এমন লোক বড়ো নেই। সেই কড়ই গাছের তলায় তিনসিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কত দুপুর, কত রাতে প্রার্থনারত মুসলমানদের আজানের ডাক ভেসে এসেছে বাতাসে বাতাসে। মনে হয়েছে এ ডাক বন্ধুত্বের, মৈত্রীর, ভালোবাসার।
আর একটু যেতেই নিবারভাঙার পুল। আমাদের কত আড্ডা জমত সেখানে স্কুলপালানো, ঘরপালানো কৈশোরের ক্লান্তিহীন উল্লাসে। কৈশোরের সেই বাঁধন না-মানা উন্মাদনা নিয়ে গ্রামোন্নয়নের কাজে সেবাদল করেছি, ডন-কুস্তির আখড়া করেছি, আর সেইসবেরই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়েছিলাম শান্তিসুধা লাইব্রেরি। সেসব আজ দূর অতীতের গর্ভে। কিন্তু তা হলেও সে-অতীত একথাই প্রমাণ করে, গ্রামের ছেলেরা একজোট হয়ে কত ভালো কাজ করতে পারে। এসব কাজে আমরা পেয়েছিলাম জীবনদার সাহচর্য। সময়ে-অসময়ে কতদিন কতরকমে পালিয়ে পালিয়ে ছুটে গিয়েছি তাঁর কাছে, তাঁর কর্মকেন্দ্র মহকুমা-শহর মুনসিগঞ্জে। অগ্নিসাধক সেই জীবনদার কাছে দীক্ষা পেয়েছিলাম সেবার, দেশপ্রেমের, বিপ্লবের। আজ তাঁর সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে সরে থাকলেও মুক্তিপাগল শঙ্কাহরণ সেই জীবনদার অকপট আদর্শ-নিষ্ঠার কাছে আজও মাথা নোয়াই।
অসহযোগের যুগে কংগ্রেসনেতা সূর্য সোমের বক্তৃতা শুনেছি, বক্তৃতা শুনেছি নামজানা না জানা আরও অনেক দেশভক্তের। তখন আমি কতটুকু! কিন্তু জ্বলন্ত বিদ্রোহের যে আগুন তাঁরা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন মনে, সে-বহ্নিদাহনে জীবনের সব জড়তা, হীনতা-দীনতা পুড়িয়ে ছাই করে খাঁটি মানুষ হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলাম সেদিন। অনেক চ্যুতি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও বড়ো হয়ে স্নেহ পেয়েছি তাঁদের অনেকের, বিশেষ করে সূর্য সোমমশাইয়ের। বছর বারো আগে শেষদেখা হয়েছিল সোম মশাইয়ের সঙ্গে। অবকাশ যাপনে কিংবা কোনো উপলক্ষ্যে গিয়েছিলেন তিনি দেশের বাড়িতে কর্মস্থল ময়মনসিংহ থেকে। আমিও তখন গ্রামে রয়েছি ছুটিতে। আমার কথা শুনেই খবর পাঠালেন। প্রণাম করতেই পিঠ চাপড়ে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘শেষজীবনটা গাঁয়ের মাটিতেই কাটাব ঠিক করেছি। তোরাও আসিস, যখন ফুরসত পাবি ছুটে আসবি। গ্রামগুলোকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারিস তো দেশ আপনি এগিয়ে যাবে। কথাগুলো সবই ঠিক। কিন্তু শেষজীবনটা গাঁয়ে কাটাবার শখ আর তাঁর মেটেনি। অল্পদিন পরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাঁকে প্রকৃতির আহ্বানে। আজ যে পরিবেশ তাতে আমাদেরই কি আর গ্রামসেবার সে-সুযোগ ঘটবে?
বাংলাদেশের অন্যতম জনবহুল এই গ্রাম। উনিশ-কুড়ি হাজার লোকের বসতি। আঠাশটি তার পাড়া। তিন-তিনটে ডাকঘর আর তিনটে বাজারে সদা জমজমাট এই জনপদ। বছর কুড়ি-একুশ আগে বেশ একটা বড়ো হাসপাতালও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিলতৈল-খ্যাত জি. ঘোষের অর্থে। কিন্তু অর্থ যারই হোক, রোগ চিকিৎসায় কোনো পার্থক্যই কখনো দেখিনি হিন্দু-মুসলমানে।
গ্রামের রাজধানী বলতে গুহপাড়া। বড়ো বাজার, বড়ো ডাকঘর, সাত-শো আট-শো পড়ুয়া ছেলের হাই স্কুল, খেলার মাঠ সব কিছুই এখানে। গ্রামের জমিদার গুহবাবুদেরই কীর্তি অধিকাংশ। জমিদারির প্রতাপ নিঃশেষিত হয়েছে রায়বাহাদুর রমেশচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে। পল্লি আভিজাত্যর ঐতিহ্য তাঁর মধ্যেও লক্ষ করেছি, কিন্তু তাঁর পরে আর নয়। দানে-অপচয়ে প্রায়-নিঃশেষ ভান্ডারও দোল-দুর্গোৎসব ও রথযাত্রার সমারোহে কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। চৈত্রসংক্রান্তিতে বাবুর বাড়ির দরজা থেকে বাজার ও খেলার মাঠজুড়ে বসে ‘গলৈয়া’-র মেলা। অফুরান আনন্দের ঝড় বয়ে যায় ক-দিন ধরে এ উপলক্ষ্যে। চৈত্রমাসে নীলোৎসবে চড়কপুজো ও কালীকাছ’-এর নাচের কথা ভুলে যাওয়া বিক্রমপুরের কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। এই কালীকাছ’-এর নাচে ভট্টাচার্যপাড়ার দলই ছিল সবার সেরা। আর সত্যি নাচে-গানে এ পাড়ার নামই ছিল সবচেয়ে বেশি। সোমপাড়া-ভট্টাচার্যপাড়া ‘অ্যামেচার ড্রামাটিক ক্লাব’ও ছিল এ পাড়াতেই এবং এই নাট্যাভিনয় ক্লাবটি ছিল আমার গাঁয়ের একটি গৌরবের বিষয়।
শ্রাবণ মাস পড়তেই ধুম পড়ে যেত মনসার পাঁচালি গানের। মূল গাইয়ে ছিলেন স্বর্গীয় লালমোহন বসু মজুমদারমশাই। মনসার ভাসান গান সম্পর্কে তাঁর ছিল অদম্য উৎসাহ। তিনি নিজেই তিন খন্ডে এক পাঁচালি লিখে ফেলেছিলেন। আর সারা-শ্রাবণ মাস ধরে সে-পাঁচালির গানই গাওয়া হত। লালমোহন, হরিমোহনের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গান ধরতাম আমরা সব ছেলে-মেয়ের দল, পদ্মে গো পুরাও মনের বাসনা বলে। কীই-বা আমাদের এমন বাসনা ছিল? সাপের কামড় থেকে আত্মরক্ষার জন্যেই তো ছিল আমাদের আকুল আবেদন। দেশবিভাগের যে বিষ-যন্ত্রণা আমরা আজ মর্মে মর্মে অনুভব করছি তার তুলনায় সাপের কামড়ও যে নিতান্তই সামান্য!
পড়ার জীবনের অনেক স্মৃতিই আজ সামনে এসে ভিড় করে। মনে পড়ছে নাহাপাড়ায় হরিমোহন বসুর পাঠশালার আটচালার কথা। হাতেখড়ি হরিমোহনের কাছেই, তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। কতদিন পড়া ফাঁকি দিয়ে পাঠশালা পালাতাম দলবেঁধে ঘুড়ি ওড়াতে কি হাডু-ডু খেলার নেশায়। যখন আকাশ বেয়ে নামত বৃষ্টি আমাদেরও মনের দিগন্তে তখন সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে আসত ছুটির আমন্ত্রণ। হাই স্কুলের ছোটোখাটো মানুষ হেডমাস্টার অম্বিকাবাবুর চলন, চেহারা ও চাহনিতে অধ্যয়নার্থী ছাত্রদের জাগাত হৃৎস্পন্দন। তাঁর চলার পথে দু-শো হাতের মধ্যে যেতে সাহস হত না কারুর। আহা, কী ভালোই না বাসতেন তিনি ছাত্রদের। আদিনাথবাবু, তারাপ্রসন্নবাবু, পন্ডিতমশাই, বিরজাবাবু, এঁরা সবাই ছাত্রবন্ধু। স্নেহে ও শাসনে বাপ-মায়ের মতো আপন। অথচ দেশে গিয়ে এঁদের দেখা পাব এমন ভরসা কি আর আছে?
ধীরেনবাবু ইতিহাস পড়াতেন আমাদের। খুব ভালো লাগত তাঁর মুখে বাঙালির অতীত গৌরবের কথা শুনতে এবং বইয়ে পড়তেও। পরীক্ষার আগে ইতিহাসের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তাম। মধ্যরাত্রে দক্ষিণের বিলে নলখাগড়ার বন থেকে ভূতুমের ডাক শুনে জেগে উঠে আবার শুরু করতাম ধীরেনবাবুর ইতিহাসের পড়া। সেই ধীরেনবাবুই ছিলেন গত কয় বছর ধরে আমাদের জয়কালী হাই স্কুলের হেডমাস্টার। কিছুদিন আগেও শুনেছিলাম, সাহস করে তিনি তখনও আমাদের গ্রামেই আছেন। তাঁর সাহসিকতাকে নমস্কার জানিয়েছিলাম সে কথা শুনে। কিন্তু এ কী, তিনিই হঠাৎ একদিন আমার অফিসে এসে হাজির তাঁর দুঃখের কথা জানাবার জন্যে! তাঁর যে ছাত্র তাঁকে সপরিবারে মানে মানে সরে পড়ার পরামর্শ দিল, গ্রাম ছেড়ে চলে আসার পথে তারই সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে আটক পড়তে হল তাঁকে সদলবলে। প্রিয় ছাত্রের মধ্যস্থতায় শ-দুই টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে গুরুমশাই ছাড়া পেয়ে কোনোক্রমে পরিজনসহ পদ্মা পেরিয়ে কলকাতায় এলেন বটে, কিন্তু পাড়াগাঁয়ের সরল-মন শিক্ষকের বিস্ময় কাটল না–এ কী হল, কেমন করে হল, এসব প্রশ্ন ঘিরে রইল তাঁর মনকে। একলব্যের কাল অতলান্ত অতীতের গর্ভে, সে আর ফিরে আসবে না জানা কথা। তা হলেও সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে বাংলারই মাটিতে যে গুরুদক্ষিণা দেয় হবে গুরুমশাইয়ের আর ছাত্র হবে গ্রহীতা, এ ছিল অকল্পনীয়। তবু তাই হল এবং তাই পাকাপাকি নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে কি নতুন শরিয়তি রাজত্বে, কে তা বলতে পারে? কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পা দিয়েছি। কলকাতায় এসে খবর পোঁছোল ভুখা বাংলার পঞ্চাশী মন্বন্তরের হিংস্র আক্রমণে বজ্রযোগিনী মুমূর্ষ। বুদ্বুদা, অমিয়দা প্রভৃতির সাহায্যে কলকাতায় বজ্রযোগিনী সমিতি গড়ে উঠল হীরালাল গাঙ্গুলি মশাইকে সভাপতি করে। অর্থ আর অন্নবস্ত্র সাহায্য সঙ্গে করে গ্রামের পথে পা বাড়ালাম।
তখন প্রায় সন্ধে। দিগন্ত ছোঁয়ানো আকাশে ম্লান মেঘের ছায়া। আকাল। আঠাশপাড়ার গ্রাম বজ্রযোগিনী কন্ঠাগতপ্রাণ। বকুলতলার ঘাটে স্নানার্থী জলার্থী মেয়েদের আর ছেলেদেরও ভিড় যেখানে জমে উঠত, সেখানেও বিরলতর হয়ে আসে সন্ধ্যাগুঞ্জন। সোমপাড়ার পুলে কত অক্লান্ত আড্ডা জমিয়ে পথচারীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছে পাড়ার ছেলের দল। সে-বছর সেখানেও দুরন্তদের ভিড় নেই। সোমপাড়া আমার শৈশবের স্বপ্নভূমি।
মন্বন্তর সর্বভুক সরীসৃপের মতো গ্রাস করে নিচ্ছিল গ্রাম-হৃদয় বাংলার জীবন। মনের টানে আমাদের সামান্য প্রচেষ্টা নিয়ে সেদিন গিয়েছিলাম গ্রামে। খবর শুনে এলেন এক মাস্টারমশাই। বললেন, মনে রেখেছ বাবা গ্রামকে? গ্রাম যে যায়। আমরা শিক্ষক। আমাদের আর কী আছে, তোমরা ছাত্ররাই আমাদের যা-কিছু সম্পদ। আনন্দে যেন উচ্ছল হয়ে উঠলেন তিনি। আমার স্কুলজীবনের উত্তর-তিরিশের আধা-প্রৌঢ় গুরুমশাইয়ের চোখে-মুখে বার্ধক্যের নামাবলি। সবগুলো চুল গেছে পেকে। সময় যে নিঃশব্দ চরণে এগিয়ে চলেছে এ তারই স্বাক্ষর।
তারপর চলে গেল আরও কত বছর। নাড়ির টানে বার বার ছুটে গিয়েছি গ্রামে। তার মায়ের মতো স্নেহস্পর্শে অবুঝ হয়ে উঠেছে মন। দূর গ্রামের মুসলমানদের এক মেয়ে, ডাকতাম তাকে মধুপিসি বলে। কেউ নাকি ছিল না তার। প্রায়ই আসত আমাদের বাড়ি। আমরাই তার সব, একথা যে কতবার সে আমাদের বলেছে তার লেখাজোখা নেই। কোনোদিন মনে হয়নি মধুপিসি মুসলমান। নিজের বাড়ির এটা-ওটা, মাঠের ফল-মূল-শাক প্রায়ই সে নিয়ে আসত আমাদের জন্যে। আগ্রহে পরমানন্দে মধুপিসির দেওয়া সেসব জিনিস গ্রহণ করতাম।
শুধু কি এই? একদল বিহারি দেহাতি মানুষ–প্রতিবছর পুববাংলার পল্লিতে পল্লিতে যারা এসে সাময়িক আস্তানা গাড়ে, তার একটা বড়ো অংশ একরকম পাকাপাকিভাবেই রয়ে গিয়েছিল এই গ্রামে; আমাদের গ্রামের মানুষই হয়ে গিয়েছিল তারা–আমাদের সঙ্গে একাত্মা। তারা ডুলি-পালকি বইত, অনেকে এমনি আর সব কাজকর্মে রুটি জোগাত নিজেদের। অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট রায়বাহাদুরের বাঁধা পালকি ছিল একটা। তাঁর চারজন বেহারাও ছিল নির্দিষ্ট। তারাই ছিল গ্রামের বিহারিদের মোড়ল। আজও কি তারা আমার গ্রামে আছে?
আমার সোনার গ্রাম! সিদ্ধা যোগিনী বরদার নাম-মহিমায় মহিমান্বিত এ গ্রাম। সংস্কৃত শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল এক সময় এ জনপদ। গোবিন্দ বেদাধ্যায়ী, প্রসন্ন তর্করত্ন, শশিভূষণ স্মৃতিরত্ন, শ্রীনাথ শিরোমণি ও দ্বারিকানাথ তর্কভূষণ প্রমুখ ভারত-খ্যাত পন্ডিতেরা এ গ্রামেরই সন্তান। আমার গাঁয়েরই নাহাপাড়ায় জন্মেছিলেন লোককবি আনন্দচন্দ্র মিত্র। আনন্দচন্দ্রের হেলেনাকাব্য, মিত্ৰকাব্য, বিবিধ সংগীত প্রভৃতি রচনা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বড়ো দুঃখেই কবি গেয়েছিলেন–
(এসব) দেখে শুনে এ দুর্দিনে বল মা তারা, যাই কোথা?
মিলে যত ভন্ড ষন্ড দেশটা করলে লন্ডভন্ড;
ধর্মকর্ম থোকার টাটি, (যত) বদমায়েসির ফাঁদ পাতা!
… … … … …
না জানি কি কপাল দোষে হতভাগ্য বঙ্গদেশে
পশুর বেশে অসুর সৃষ্টি কল্লে দারুণ বিধাতা!
দেশ হয়েছে আস্ত নরক! একদিনেতে এসে মড়ক,
গো-বসন্তে উজাড় করলে তবে যায় মনের ব্যথা!!
প্রায় এক-শো বছর আগের বাংলাদেশের অবস্থায় যে কবির কোমল প্রাণে দেখা দিয়েছিল এমনি মর্মপীড়া, আজকের হতভাগ্য বাঙালির অবস্থা দেখতে হলে কী করে তা সহ্য করতেন কবি, তা কি আমরা কল্পনাও করতে পারি?
‘জাতের নামে বজ্জাতি’ যারা করে, তীব্র কশাঘাতে তাদের সংশোধনের কত চেষ্টাই না করেছেন চারণ-সম্রাট মুকুন্দ দাস! তাঁর যাত্রাগানের কথা বাঙালি কি ভুলতে পারে কোনোদিন? ছোটোবেলায় আমাদের গাঁয়েই শুনেছি তাঁর কত পালাগান। বাঙালির অধঃপতনে তাঁরও খেদের অন্ত নেই। তিনিও গেয়েছেন–
মানুষ নাই দেশে
সকল মেকি সকল ফাঁকি, যে যার মজে আপন রসে।
আর তারই প্রতিফল আমরা আজ ভোগ করছি হাতে হাতে। চারণ-সম্রাট আজ আর বেঁচে নেই, তাঁর জন্মগ্রাম বিক্রমপুরের বানারিও কীর্তিনাশা পদ্মার গর্ভে। তার জন্যে দুঃখ করার আর কী আছে! সারা পুববাংলা ছাড়াই তো আমরা। রাজা রাজবল্লভের রাজনগর আর চাঁদ রায়-কেদার রায়ের রাজবাড়ি গ্রাস করেই তো পদ্মা নাম নিয়েছে কীর্তিনাশা পদ্মার কবল থেকে রক্ষা পেলেও পাকিস্তানের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার তো উপায় ছিল না। আজ তাই তো ভাবি, আমার গ্রাম যে থেকেও নেই। সে না-থাকার ব্যথা যে আরও দুঃসহ!।
যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সারাভারতের মুক্তির সাধনায় সর্বত্যাগী, তাঁর পিতৃপুরুষের বাসভূমি আমার গাঁয়ের অদূরবর্তী তেলিরবাগ গ্রাম স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত নয়–সে পুণ্যক্ষেত্র আজ বিদেশে, বিদেশির শাসনাধিকারে, এ ভাবতেও শরীর শিউরে ওঠে। কিন্তু কী হবে ভেবে?
কে জানত এমনি করে ছেড়ে আসতে হবে গ্রামকে। শরণার্থী পরিজন পরিবেশে এই মহানগরীর এক প্রান্তে সংকোচে আজ দিন কাটাই। তবু আশা জাগে, আজ যে দেশ দূর, দুঃশাসনের হাত থেকে সে-দেশকে, সোনার বাংলার হৃৎপিন্ড সে-বিক্রমপুরকে একদিন ফিরে পাব আমার মনের কাছে।
.
সাভার
প্রতি অঙ্গে সে-গাঁয়ের স্পর্শ। বড়ো মিঠে. বড়ো মধুর। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ওখানেই তো চলতে শিখেছি। ওরই হিজলতলায়, পদ্মবিলে, ধলেশ্বরীর উচ্ছল স্রোতে সারাশৈশবটা কেটেছে। বুধু পন্ডিতের পাঠশালা, বুড়ো বটের দিঘল জটা কত স্মৃতির মাধুর্যেই না মধুময়!
ময়ূরপঙ্খির গল্প শুনতে কতদিনই না বসেছি ধলেশ্বরীর ধারে। সন্ধে নেমেছে। চাঁদ উঠেছে কালো গাঁয়ের মাথায়। শত মুক্তোর প্রাচুর্য নিয়ে মাতাল হয়েছে ধলেশ্বরী। এক চাঁদ শত চাঁদ হয়ে আছড়ে পড়েছে ঢেউয়ের দোলায়। চেয়ে রয়েছি, কেবল চেয়ে থেকেছি।
সন্ধের ঝিরঝিরে হাওয়ায় নোঙর খুলে পাল তুলেছে মাঝিমাল্লারা। তাদের কলকন্ঠে খিলখিল করে হেসে উঠেছে যেন জ্যোৎস্নাস্নাত নিবিড় আকাশ। দিগন্ত তুলেছে প্রতিধ্বনি। কিশোর মন সন্ধান করেছে মধুমতীর দেশের, ওই বাঁক পেরিয়ে মাঠ ছাড়িয়ে।
কেষ্ট বৈরাগীকে ভুলতে পারি? কত ভোরেই না ঘুম ভেঙেছে তার সুললিত গানের সুরে। মায়ের আঁচল ধরে কতদিনই না বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। ভোরের হাওয়া আমার সর্বাঙ্গ বুলিয়ে গেছে মায়ের স্নেহের মতো। আমার আঁখির আবেদনে আবার নতুন করে গান ধরেছে কেষ্ট,
সখিগো…ওগো প্রাণসখি! এই করিয়ে তোমরা সকলে, না পুড়াইয়ো রাধা অঙ্গ না ভাসাইয়ো জলে, মরিলে বান্ধিয়া রেইখো তমালেরি ডালে…গো।
বিরহিণীর অশ্রুভেজা এ অন্তিম আবেদনে কৈশোরের অবুঝ মনও কেঁদে উঠেছে। কেষ্ট বৈরাগীর মরমি সুর ধলেশ্বরীর পলিমাটির মতোই নরম।
এমনি কত টুকরো টুকরো স্মৃতি আর স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা আমার গ্রাম সাভার, ঢাকা জেলার একটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। বুকে তার কত শতাব্দীর অক্ষয় ইতিহাস, অতীত সভ্যতার বিলীয়মান কঙ্কাল। এখানে রাজ্য ছিল, রাজা ছিল একদিন, ছিল শিক্ষা আর সংস্কৃতির প্রাণবান প্রবাহ। এ দেশের বাণী সেদিন পৌঁছোত দূরদূরান্তে…হিমালয়ের শিখরচূড়া পেরিয়ে। দীপংকরের জ্ঞানের প্রদীপ এখানেই প্রথম জ্বলেছিল–গুরুগৃহে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়েছিল এখানে। সেদিনের সাভার ছিল সর্বেশ্বর নগরী, রাজা হরিশ্চন্দ্র পালের রাজধানী, সর্ব-ঐশ্বর্যে মন্ডিত। বৌদ্ধধর্মের বন্যা নেমেছিল এর দিকে দিকে। ধর্মরাজিকা কত বিহার মাথা তুলেছিল এ অঞ্চল ঘিরে। কত ভক্তমনের অন্দরমহলে ঠাঁই করে নিয়েছিল সর্বেশ্বর নগরী…আমার সাভার।
সেদিনের স্মৃতি আজও নিঃশেষ হয়নি। বাজাসনে’ আজ রাজার আসন না থাকলেও সে গৌরবময় দিনের কত স্বপ্ন-কথা এর মাটির অঙ্কে অঙ্কিত রয়েছে। সেদিনের কত অস্পষ্ট স্বাক্ষর দিকে দিকে আজও বর্তমান। কর্ণপাড়ার ভগ্নস্তূপ, ‘বাজাসন’ রাজপ্রাসাদের শেষচিহ্ন কোটবাড়ি আজও তো পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আমরাও কি আর কম ঘুরেছি? কতদিন, কত কাঠফাটা রোদ্দুরে বাড়ি থেকে পালিয়েছি দল বেঁধে। একটা নতুন কিছু যেন আবিষ্কারের ইচ্ছে। দুধসাগর, নিরেমিষ, লালদিঘি এমনি কত পুকুরের ধারে ধারেই না সারাটাবেলা কেটেছে। রবীন্দ্রনাথের সেই খ্যাপার মতো আমরা যেন করে ফিরেছি সেই পরশমণির অনুসন্ধান। আমগাছের ছায়ায় বসে বসে ডাক দিয়েছি রমজানকে, আজমত শেখকে। বাজাসনের এখানে-ওখানে আজ ওদেরই উপনিবেশ। দুধে ধোয়া সাদা-বাবরি নেড়ে রমজান বলেছে কত গল্প, কত পুকুরের ইতিবৃত্ত; ‘নিরামিষ্যিতে মাছ থাহে না কর্তা, ওডা রাজার মা’র পুকৈর।–অবাক হয়েছি। বোবার মতো চেয়ে রয়েছি রমজানের দিকে। কোদাল ধোয়ার ইতিহাস বলেছে রমজান, কোটরাগত চোখ দুটো টেনে টেনে। ওটাই নাকি রাজা হরিশের শেষ পুকুর। শত পুকুর শেষ করে ওখানেই নাকি কর্মীরা কোদাল ধুয়ে উঠেছিল–রমজান তার নানার কাছে থেকে শুনেছে সেসব কথা। সেদিন রমজানের কোনো কথাই অবিশ্বাস করিনি। সাভারের এপাশে-ওপাশে ছড়িয়ে থাকা শত শত পুকুর দেখে বুড়ো রমজানের কথা সত্যি বলেই মনে হয়েছে।
আজ আরও কত কথাই না মনে পড়ে। স্মৃতির মণিকোঠায় বিগত দিনের কত ছবিই না। জ্বলজ্বল করে ওঠে। যখন ভাবি, কিশোরবেলার স্বপ্ন-ছাওয়া সে গ্রামখানি থেকে কত দূরে সরে এসেছি, যখন মনে হয় দেশবিভাগের পাপে আত্মার আত্মীয় সে-গাঁখানি আমার আজকে বুঝি পর হয়ে গেল, তখন সজল চোখের আরশি দু-খানি কত বিচিত্রতর ছবিতেই না ভরে ওঠে! গত দিনের কত কথা ও কাহিনি মনের দোরে এসে বারে বারে ঘা মেরে যায়।
মনে পড়ে নববর্ষের কথা। বৈশাখের রুদ্রদূত নতুনের জয়পত্র নিয়ে আসে। সারাগাঁয়ে পড়ে যায় সাড়া। দোকানিদের দোকানগুলো ফুলেপাতায় সেজেগুজে নতুনকে জানায় অভ্যর্থনা। গাঁয়ের মেঠোপথ মুখর হয়ে ওঠে আনন্দপাগল ছেলে-ছোকরাদের কলকন্ঠে। অপূর্ব হয়ে ওঠে সারা গাঁখানি! অপূর্ব মনে হয় জীবনের স্বাদ।
বিকেলের দিকে মেলা বসে। পাঠানবাড়ির বটের ছায়ায়। নমপাড়ার হীরু সর্দার, বক্তারপুরের জনব আলিরা শুরু করে ছড়ি খেলা। আগ্রহাকুল দর্শকেরা ভিড় করে থাকে চারপাশে। প্রতি বছর প্রতি বৈশাখের প্রথম দিনটি এমনি কত সর্দারের ছড়ির প্যাঁচেই না হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত! বিজয়ীর সর্বাঙ্গে কতজনেরই না উৎসুক দৃষ্টি পিছলে পড়ে!
হীরু সর্দারের নাম আছে। ঝাঁকড়া চুলে ঝাঁকুনি মেরে সে যখন ছড়ি নিয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে নতুন মানুষ বলে মনে হয়। দিঘল দুটি চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে আগুনে দৃষ্টি। নিশ্বাসের তালে তালে বুকের পাটাও যেন ফুলে ফুলে ওঠে। হেই…হেই…সামাল..সামাল..শব্দ করে তিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে হীরু সর্দার। পায়ের তলায় মাটি যেন একেবারে কেঁপে ওঠে। উৎসুক জনতার অজস্র করতালির ভেতর খেলা শেষ করে কোমরের গামছা খুলে হীরু বাতাস করতে থাকে। গাঁয়ের মেয়েরা আড়চোখে দেখে যায়।
বর্ষা নেমে আসে। শাওনের ঢল নামে গাঙে। নবযৌবনা ধলেশ্বরী আপন গরবে ফুলে ওঠে। ওপারের কাশবন ডুবে যায়। মজেযাওয়া খালগুলো ছল ছল করে ছোটে; চাষিপাড়ার এক একটি কুটিরকে এক-একটি দ্বীপের মতো দেখায়।
শাওনের অঝোরঝরা রাতের একটি ছবি মনে জেগে ওঠে। গাঙিনীর জলে হেলেদুলে একটি ভেলা ভেসে চলেছে। তালীবন শেষ হল। সমুখে শুধু জল আর জল। বেহুলার অকম্পিত বুক। মা কাঁদছে, ভাই কাঁদছে, কাঁদছে প্রতিবেশীরা। আর বেহুলার সংকল্পে পরিবর্তন নেই!
মনসা পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছে এই বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি। পল্লিকবি জিইয়ে রেখেছেন চাঁদবেনের কথা। ভাসান গানের সুরে সুরে বেহুলার অবাধ অশ্রু আজও উছলে ওঠে। সনকার অশ্রুজলে কত সন্ধ্যায় কত মায়ের বুকও ভিজে যায়।
এ অঞ্চলে বহুল প্রচলিত এই গান। রাতের পর রাত গান চলে। বেহুলা-লখিন্দরের প্রথম পরিচয় থেকে বিদ্রোহী চাঁদের অন্তিম পরাজয় পর্যন্ত। হিন্দু-মুসলমান সমান শরিক সে-গানের। মাখন দাঁ, এমনকী কেদার মুনশিও। বেহুলার অটল সংকল্পে ভাই-এর ব্যথা যখন মূর্ত হয়ে ওঠে এ গানে,
না যাইয়ো না যাইয়ো বইন
শুন লো মোর মানা;
তুমি গেলে বইন লো আমার
মায় যে বাঁচব না।
তখন কতদিন লুঙ্গির কোণে ছাবেদালী ব্যাপারীকে চোখের জল মুছতে দেখেছি। হিদুর ‘কেচ্ছা’ সেদিনও মুসলমানের ‘গুণাহ’ বলে বিবেচিত হয়নি। সনকার অশ্রুর আড়ালে তারা যেন তাদের ব্যক্তিক দুঃখেরই ছবি দেখতে পেয়েছে।
শরতের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। এই সময়টির জন্যে সারাবছর ধরে কী বিপুল প্রতীক্ষা! সে কী আয়োজন! প্রবাসীরা ঘরে ফিরছে। ধলেশ্বরীর কূলে রোজই এসে নতুন নতুন নৌকো লাগছে। আমরা ছেলেরা গিয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়েছি। ক-দিনের জন্যে গাঙখালি লোকে ভরপুর। সবার সঙ্গে আবার নতুন করে পরিচয়।
হিন্দুপ্রধান গ্রাম সাভার। পুজো এখানে বেশ কয়েকখানিই হয়। তার মধ্যে দক্ষিণ ও উত্তর পাড়ার বারোয়ারি দুটি প্রধান। আগে উভয়ের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা হত, প্রতিমা তৈরি থেকে আরম্ভ করে গান-বাজনা নিয়েও। দক্ষিণীরা ঢাকা থেকে কারিগর আনালে, উত্তরেরা বিক্রমপুর পর্যন্ত ছুটত। দক্ষিণীরা তিন রাত গানের ব্যবস্থা করলে, উত্তরেরা নট্ট কোম্পানির যাত্রদলের সঙ্গে পাঁচ রাতের চুক্তি করে বসত। সন্ধে থেকে শুরু করে সারারাত চলত গান। এপাড়া হরিশ্চন্দ্র’ বই নির্বাচন করলে ওপাড়ায় আরম্ভ হয়ে যেত রামচন্দ্র।
ছোটোবেলায় দেখেছি দুর্গা পুজোর মুসলমানের আনন্দ কম নয়। হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের ঘরেও আসত নতুন কাপড়। মুসলমান মেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় প্রতিমা দেখে বেড়াত। রং বেরঙের লুঙ্গি পরে গলায় গামছা ঝুলিয়ে এগাঁয়ের সেগাঁয়ের মুসলমানেরা সকাল সকাল ঠাঁই করে নিত যাত্রার আসরে। রামচন্দ্র’ কিংবা হরিশ্চন্দ্র’ পালায় হিন্দুর সঙ্গে তারা সমান ভাবেই হেসেছে ও কেঁদেছে। পূর্ববাংলায় দুর্গাপুজো ঠিক এমনি করেই হয়ে উঠেছিল সর্বজনীন উৎসব।
কোকিল-ডাকা বসন্তে আর একটি উৎসবে এ অঞ্চল মেতে উঠত। এটা যেন সত্যিকারের গণউৎসব। এতে চাষিদেরই উৎসাহ বেশি। ষাট বছরের বুড়ো পাঁচু মন্ডল হলুদবরণ কাপড় পরে পা দুটিতে ঘুঙুর বেঁধে দুলে দুলে নাচতেও লজ্জা করেনি। সারাবছরের দৈন্যেভরা জীবনকে ভুলে তারা যেন কেবল মুঠো মুঠো আনন্দ কুড়িয়েছে।
শিব পুজো বা শিব খাটনাও সাধারণ মানুষের উৎসব। এ অঞ্চলে এর প্রাধান্য কম নয়। অন্তত দশ-বিশ দল তো প্রতিবছরই আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। শিব ঠাকুরকে মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করেছে এরা। গলায় কয়েকখানি ‘মেডেল’ ঝোলানো ঢাকি হরকেষ্টার ঢাকের তালে তালে বুড়ো-কাঁচায় সমান হয়ে নেচেছে। নাচনার শেষে গান ধরেছে প্রেমানন্দ। উমার গান, নিমাই-সন্ন্যাসের গান। ডান হাতে মাথাটি রেখে প্রেমানন্দ যখন গেয়েছে,
সন্ন্যাসী হইয়ো রে নিমাই
বৈরাগী না হইয়ো,
(ওরে) ঘরে বইসে কৃষ্ণ নামটি
মায়েরে শুনাইয়ো।
তখন মায়ের চোখ দুটি কোন সে ব্যথার অনুভূতিতে যেন টলটল করে উঠেছে।
দিনে ‘খাটনা’, রাতে ‘কাছ’। ‘কাছ’ কথাটি এসময় সম্পূর্ণ এক নতুন অর্থে ব্যবহৃত হয়। নানাপ্রকার রঙ্গরসের ভেতর দিয়ে কাছ’ নাচের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ যেন বাংলার আদিম নৃত্য। জনসাধারণের কাছে অসীম এর আবেদন। ছেলেবেলায় মায়ের বকুনি খেয়ে সারারাত্রি জেগে বাড়ি বাড়ি এ ‘কাছ’ দেখে ফিরেছি। মহাদেবঠাকুর যদি তার দীর্ঘ ত্রিশূলটি হাতে নিয়ে দু-একটি কথা বলেছে, তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। হিংসুটে রাধাবল্লভটা অনুতাপে জ্বলে জ্বলে মরেছে। সে-আনন্দ, সে-অনুভূতি আজও উপলব্ধিতে জাগে। ‘মুখা কাছ’ দুর্লভ শীল আজও মনের নিভৃতে অগোচরে উঁকি দিয়ে যায়। তাদের কি ভুলতে পারি?
কত মধুরই না ছিল সে সন্ধেগুলো। তাল-তমালের ফাঁকে ফাঁকে প্রদীপ জ্বলত, শাঁখ বাজত, কর্মক্লান্ত দিনের শেষে সারা-গাঁ-জুড়ে নেমে আসত একটা নিবিড় প্রশান্তির ছায়া। দোকানি ফিরত হাট থেকে, মাঠ থেকে ফিরত রাখালেরা। সন্ধের আঁধারে তলিয়ে যেত সকল বিচ্ছিন্নতা। নীরব নিথর গ্রামখানি দাঁড়িয়ে থাকত পূজারিনির মতো, একক–একনিষ্ঠ।
যেদিন চাঁদ উঠত আকাশে, সেদিনের আর এক ছবি। ফুলকেয়ারির ফাঁকে ফাঁকে শুরু হত আলো-আঁধারের খেলা। জুই ফুলের গন্ধে বাতাস হত মদির, স্বপ্নময় হয়ে উঠত আমার গাঁখানি।
মেয়েমহলে সেদিন যেন মহোৎসব। সকাল সকাল সান্ধ্য আয়োজন শেষ করে দুর্গাখুড়োর পাকা উঠানে সবাই এসে ভিড় করত। প্রিয়দার বউ আসত কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে, মেরুর মা আসত হাতের চেটোয় ‘সাদা’ গুঁড়ো নিয়ে। এমনকী ফুলী আর সুধী বোন, যারা সূর্যসাক্ষী করে পরস্পরের মুখদর্শন পর্যন্ত বন্ধ করেছিল, তারাও এসে পাশাপাশি মুখ ফিরিয়ে বসে থাকত। হায় রে! সে-নিবিড়তা, সে-মাখামাখি চিরকালের মতোই কি শেষ হল?
মতি সাধুকে ভুলব না। কীর্তনীয়া মতি সাধু। সারাতল্লাটে বিদেশে তার নামডাক। অমন মধুর কণ্ঠ, অমন ভাবানুভূতির তুলনা খুঁজে পাইনে–আজও যেন মনে লেগে আছে। অমন প্রাণ দিয়ে গান গাওয়া আর কি শুনতে পাব?
গোপাল আখড়া, হরি আখড়া, বড় আখড়া। গাঁয়ের এক-একটি কেন্দ্র এ আখড়া গুলোতে কতদিন মতির গান শুনেছি। জলকেলি, মাথুর প্রভৃতি পালা! হাতে চামর নিয়ে হেলেদুলে গান করেছে মতি সাধু। গলায় ঝোলানো গাঁদা ফুলের মালা এদিক-ওদিক গড়িয়ে পড়েছে। মাথুর পালায় গান ধরেছে সে এই বলে,
সর্ব অঙ্গ খেয়ো রে কাক
না রাখিয়ো বাকি,
কৃষ্ণ দরশন লাগি
রেখো দুটি আঁখি।
দোহারিরা সুর ধরেছে, তাল রেখেছে। তন্ময় হয়ে মতি সাধু শুরু করেছে কথকতা: ওরে কাক, ওরে তমাল-ডালে বসে থাকা কাক! তুমি আমার সর্বাঙ্গ নষ্ট করো। কিন্তু যে কৃষ্ণের বিরহ-ব্যথায় আমি জ্বলে জ্বলে পুড়ে পুড়ে মরছি, সেই নিঠুর কৃষ্ণের দর্শন-অভিলাষী আমার এই আঁখিযুগল কেবল তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি। এ দুটো তুমি বাকি রেখো।
কথকতার পর আবার সুর ধরেছে মতি সাধু,
বাকি রাখিয়ো,
কৃষ্ণ দরশন লাগি
বাকি রাখিয়ো।
খোল বেজেছে। মাথা নেচেছে। তালে তালে পড়েছে করতালি। কিন্তু মনের অজান্তে। আঁখিপল্লব দুটি কখন যে একেবারে ভিজে উঠেছে–কেউ হয়তো টেরও পায়নি।
বাংলা লোকসংস্কৃতির এক বিশিষ্ট অবদান এই কীর্তনগান–শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পল্লির গৃহকোণে বেজে চলেছে এর সুর, এর আবেদন। বাংলার সাধারণ মানুষের উপলব্ধিতেও এ গান সাড়া জাগিয়েছে। কেবলমাত্র রাধাকৃষ্ণের কথা নয়, রামমঙ্গল, নিমাই সন্ন্যাস, এমনি আরও কত গানের মাধ্যমেই না পল্লির জনমানস রস সংগ্রহ করেছে। কত দিন, কত সন্ধ্যায় এরই আবেদনে কুসীদজীবী অধর ঘোষকেও কৈবর্তপাড়ার ভোলানাথের সঙ্গে কোলাকুলি, গলাগলি করতে দেখেছি। হিসেবি মানুষ অখিল সাহাও কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে।
সে-গ্রাম আজ কত দূরে! পদ্মা-মেঘনা পেরিয়ে কোথায় সে ধলেশ্বরী! এত স্মৃতি, এত স্বপ্ন-রঙিন সে-মোহন পরিবেশ থেকে আজ আমি নির্বাসিত। দেশবিভাগের পাপে আমার মতো ছিন্নমূল আরও অনেকে দিগবিদিকে ছড়িয়ে গেছে। ভেঙেছে সমাজ, ভেঙেছে ঘর সংসার। শান্ত সুনিবিড় আমার সে-গাঁখানি আজ বুঝি নির্বাক হয়ে গেছে। পুঁটি পিসিরা কোথায়? অমন অনাবিল স্নেহের উৎসটি আজ কত দূরে! কাজ না-থাকা অলস দুপুরবেলা আজ তো আর কেউ তেমন দরদ দিয়ে ডাকে না, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আজ তো আর কেউ কাছে এসে বসে না। আজ আমি যেন আকাশ থেকে ছিটকেপড়া তারা–স্মৃতির জ্বালায় তিল তিল করে পুড়ে মরছি।
নিশ্চয়ই আমাদের তুলসীতলাটি আজ একেবারে নির্জন। আজ আর সেখানে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে না, কাঁসর-ঘণ্টা বাজে না, সদিবোনের রাধাকৃষ্ণের গানে সান্ধ্য হাওয়াও আর তো সজল হয়ে ওঠে না! পূর্ববাংলার নিভৃতে থাকা আমার সে-গাঁখানি রাতের আঁধারে আজ বুঝি কেবল থমথম-ই করতে থাকে!
ধলেশ্বরী তেমন করেই বয়ে যায় কি? কাশফুলগুলো আজও কি তেমন করেই ফোটে? জ্যোৎস্নাস্নাত বালুচরে রাখালিয়া বাঁশি আজও কি তেমন করেই বেজে ওঠে? গভীর রাতে ঘুম ভেঙে এমনি কত প্রশ্নই না মনে জাগে! চোখের সামনে ভিড় করে আসে ছবির পর ছবি। ব্রহ্মচারীর মাঠ, রজনি সা’র মশান–আরও কত কিছুর কথাই না মনে পড়ে যায়! স্মৃতির জ্বালায় আঁখিপল্লব দুটি বারে বারে ভিজে ওঠে। মনে হয় সে যেন হারিয়ে গেছে। যে ছিল প্রিয়, যে ছিল শ্রেয়, সে যেন আর আমার নয়। আমার স্বপ্নে-থাকা মাটির মাকে মা বলে ডাকবার অধিকারও যেন আজ আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তার আহ্বানের তো শেষ নেই! আজও যেন সে আমায় ঠিক আগের মতোই ডাকে। স্বপ্ন-শিয়রে ধলেশ্বরী আজও যেন আছড়ে পড়ে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলে বার বার–আয়, আয়, ওরে আয়!
.
ধামরাই
আবর্তিত হয়ে চলেছে মহাকালের রথচক্র। সেই রথচক্রের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রথিত হয়ে আছে মানুষের জীবন। এমনি এক মহাকালের ত্রিকালবিধৃত বিগ্রহরূপের সঙ্গে শৈশবেই পরিচিত হয়েছিলাম আমাদের গ্রামে। ধামরাই-এর মাধব ঠাকুরের রথের সেই ঘূর্ণমান চক্র দেখে মহাকালের চিরপ্রবহমান গতিস্রোতের যে বিশাল ব্যাপ্তি উপলব্ধি করেছিলাম ছোটোবেলায়, সে-স্মৃতি আজও অবিস্মরণীয়। প্রথম দৃষ্টি মেলেই যে গ্রামের মাটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে শৈশব ও যৌবনের দিনগুলো অতিবাহিত করেছিলাম, এক অভাবনীয় ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সে-জন্মভূমি গ্রাম-জননীর মাটি থেকে ছিন্ন হয়ে দূরান্তরের এই জনারণ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললেও সেদিনের স্মৃতি আজও আমার লক্ষ্যহীন যাযাবর জীবনের ধূলিধূসর মুহূর্তগুলোকে আশার আলোকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। সে-গ্রাম যে আমার জননী।
বংশাই নদীর এক তীরে ধু-ধু করছে প্রান্তর–যতদূর দৃষ্টি যায়, শ্যামল সবুজ। ধান্যশীর্ষগুলো দু-হাত বাড়িয়ে আকাশের দিকে কীসের প্রত্যাশী যেন–মধ্যাহ্ন-সন্ধ্যায় বাতাসে দুলে দুলে শোঁ শোঁ শব্দে কেন যেন বাঁশি বাজায় ওরা। এপারে মল্লিকঘাটের সামনে ঠক-ঠক হাতুড়ি পেটানোর শব্দ-বড়ো বড়ো মালবাহী নৌকো তৈরি চলছে সেখানে। ঘাট থেকে একটি রাস্তা এঁকে-বেঁকে কিছুদূর গিয়ে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে–একটি গিয়ে মিশেছে বাজারে যাওয়ার সড়কে, আর একটি চলে গেছে তাঁতিপাড়ার দিকে। দ্বিতীয় পথটি ধরে কিছুদূর গেলেই পাঁচিল-ঘেরা বাগান, পেছন দিকে মস্তবড়ো পাকা দোতলা বাড়ি। এ রাস্তার ওপরেই বাড়ির খিড়কি-দোর। সদর দোর বড়ো সড়ক থেকে পুবদিকে বেরিয়ে-আসা একটা গলির ওপর। তামাম দুনিয়ায় এইটেই ছিল আমার মাথা গোঁজবার ঠাঁই। জীবনের এতটা বয়েস এখানেই কেটেছে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে। কোনোদিন দু-মুঠো অন্নের জন্যে কপালে চিন্তার রেখা ঘনিয়ে ওঠেনি। অতিথি এসেছে, কখনো সেবার ত্রুটি হয়নি। আজ আমরাই অতিথি হয়ে পরের অনুগ্রহপ্রার্থী। অদৃষ্টের এ নির্মম পরিহাস!
আমাদের গ্রামটি ছিল প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাষি, জেলে, গোয়ালা, কামার, কুমার, ছুতোর, তাঁতি, ডাক্তার, কবরেজ প্রভৃতি নানারকমের লোকের বসবাস ছিল সেখানে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো সামগ্রীর অভাব সেখানে হত না। প্রত্যহ বসত বাজার। সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার হাট। অত বড়ো হাট এদিকটায় ছিল বিরল। নদীপথে ও উন্নত ধরনের গ্রাম্যপথে দূরদূরান্তের পল্লিগুলোর সঙ্গে সংযোগ ছিল তার, তাই ধামরাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল এ অঞ্চলের একটি বড়ো ব্যবসাকেন্দ্র। শিল্পের মধ্যে তাঁত ও কাঁসার জিনিসপত্রই ছিল প্রধান। শিল্পে-ব্যাবসায়ে সমৃদ্ধ এমন গ্রাম এ অঞ্চলে খুব কমই দেখা যেত।
১৯৪৬ সালে বাংলার বুকে যখন সহসা সাম্প্রদায়িক দাবানল জ্বলে উঠল, রাজধানী থেকে সুদূর শান্তিময় পল্লিতেও যখন তার লেলিহান শিখা বিস্তৃত হল এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র বাংলার বক্ষ দীর্ণ খন্ডিত হয়ে গেল-ধামরাই শ্মশানে রূপান্তরিত হতে চলেছে তখন থেকেই। গ্রামের শেষে কয়েকখানি ঘর মুসলমানদের। তাদের সকলেই প্রায় কৃষক। প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে মিলেমিশে চাষ-আবাদ করে এবং হিন্দু জমিদার-মহাজনের সাহায্য নিয়ে বেশ শান্তিতেই কাটছিল তাদের দিন। তাই বাইরের উসকানি তাদের খুব একটা উৎসাহিত করতে পারেনি। তবু দুর্গের মতো এই হিন্দুপ্রধান গ্রামের আকাশেও দেখা দিল অন্ধকারের অনিশ্চিত আশঙ্কা। পথ চলার সময় আপন ছায়াও সচকিত করে তুলতে লাগল আমার গাঁয়ের মানুষকে।
ত্রস্ত জীবন ও লাঞ্ছনা-গ্লানির অন্ধকূপ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়ে সংসার পাতবার সুযোগ ও সংস্থান যাদের ছিল কিংবা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন ভাগ্য রচনা করার দুর্জয় দুঃসাহসিক মনোবল যাদের ছিল–তারা যতটা সম্ভব বিষয় আশয় বেচে দিয়ে বহুপুরুষের বুকের রক্তেগড়া আবাসভূমিকে প্রণাম করে অশ্রুজলে বিদায় নিল। আপন কর্মশক্তি দ্বারা নতুন কর্মক্ষেত্রে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় শ্রমজীবীদের আছে তারাই গেল সর্বপ্রথম। ধনিক ব্যাবসায়ীরাও ব্যাবসা গুটিয়ে স্থানান্তরে যাওয়ার জন্যে উদ্যোগী হলেন। বিত্তবান জমিদারেরা সরিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁদের অস্থাবর সম্পদ। ডাক্তারেরাও চলে গেলেন, শহরের ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি না করে গ্রামের দিকে গেলে কোনোরকমে চলে যাবে, এই ধারণা। পড়ে রইল কৃষক-জেলে ও হতভাগ্য মধ্যবিত্তরা! কৃষক-জেলে জানে, গতর খাটালে কোথাও ভাতের অভাব হয় না। তবু শেষপর্যন্ত দেখে যাবে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা কোথায় যাবে?–কোন ভরসায়? যাদের বাগানের শাকসবজি, পুকুরের মাছ আর কিছু ধানি-জমির ধান ও তার আয়ের ওপর দিন চলে– তাদের কী উপায়? ডিঙি নিয়ে নদীতে বা পুকুরে জাল ফেলতে তারা জানে না, গোরু নিয়ে মাঠে লাঙল ঠেলতে পারে না, মাথায় মোট বয়ে উপার্জনও কল্পনার অতীত। যদি সকল সম্পত্তি উচিত মূল্যে বেচা এবং পশ্চিমবাংলায় উচিত মূল্যে অনুরূপ সম্পত্তি কেনা সম্ভব হত, তবেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু উচিত মূল্যে বেচাও হবে না, কেনাও হবে না। কেনা-বেচার কালোবাজারের দাঁড়িপাল্লার দৌরাত্মে সকল সম্পত্তি উজাড় হয়ে যাবে। মধ্যবিত্ত ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীদের অবস্থা তেমনি। সবচেয়ে মর্মান্তিক অবস্থা শিক্ষক ও বেসরকারি চাকুরেদের। নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় এসে পশ্চিমবাংলার দ্বারে দ্বারে আশ্রয় ও জীবিকার সকরুণ আবেদন জানিয়ে মাথা কুটে মরবে তারা। হতভাগ্যদের নাম পুনর্বসতির দফতরে ও এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের পর্বতপ্রমাণ ফাইলের তলায় চাপা পড়ে পড়ে কখন জঞ্জালের ঝুড়িতে স্থান পাবে। এদের ভরসা সরকারের অনুগ্রহ। কিন্তু অদৃষ্টের দোষে প্রায় সবার অবস্থাই যে আমারই মতো দাঁড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ কাউকেই যে আর বিশ্বাস করা যায় না এ সংসারে, কারও কথার ওপরেই যে নির্ভর করা চলে না!
আমার কথাই বলি! পরকে বিশ্বাস করে নিজেকেই যে বিপন্ন করেছি বারে বারে। যারা না জানে এপারে এসে তারাও তো সেই বিপদের পথেই পা বাড়াবে। বাইরের সহানুভূতি দেখে মানুষের অন্তর চেনা যায় না। এ অভিজ্ঞতা অনেক বাস্তুহারা পরিবারেরই হয়েছে কলকাতার শেয়ালদা স্টেশনে, পশ্চিম বাংলার নানা শরণার্থী শিবিরে। এমনি এক শিবির দেখতে এসে মনে পড়ে সেই কবে ধামরাইয়ে আমাদেরই এক প্রতিবেশীর দক্ষিণের ঘরের দাওয়ায় বসে এক বাউল গেয়েছিল তার একতারা বাজিয়ে,
মনের মানুষ না পেলে সেই মনের কথা কইব না;
মনের মানুষ পাবার আশে
ভ্রমণ করি দেশ বিদেশে
মানুষ মিলে শত শত মন তো মিলে না–
প্রাণ সজনি গো!
সংসারী মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে সংসার-বিবাগি বাউল আরও গেয়েছে,
শিমুল ফুলের রং দেখে ভাই রঙ্গে মেত না;
ও ভাই দেখলে চেয়ে মনের চোখে,
অহরহ পড়বে চোখে
চোরের নায়ে সাউধের নিশানা–
প্রাণ সজনি গো!
কিন্তু কলকাতায় নবাগত আমার গাঁয়ের সর্বহারা সরল-মন মানুষদের কি সে ক্ষমতা সে মনের অবস্থা আছে শিমুল-শিউলি বেছে নেওয়ার! কাজেই পুববাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এ স্বাধীনতার স্বাভাবিক দান–-প্রতারণা থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোনো উপায়ই যে দেখছি না আমি।
কলকাতায় এসেছি আত্মরক্ষার পথের সন্ধানে। এই জনকোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে, আমাদের ধামরাইয়েও তো দূরদূরান্ত থেকে সহস্র সহস্র তীর্থযাত্রী আসত মাধব-দর্শনে। মেলা বসত। মাধবঠাকুরের ঘাট থেকে যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত অসংখ্য বিপণি। কতরকম খেলনা, হাঁড়ি-পাতিল, ধামা-কুলো, বাক্স-ট্রাঙ্ক, বাসনপত্র, ছবি-ফোটো, মাটির ঠাকুর প্রভৃতির বিরাট সমাবেশ। কতরকম খাবারের দোকান ও রেস্টুরেন্ট। ম্যাজিক শো, সার্কাস। যাত্রীদের ভিড়ে গ্রামে তিলধারণের স্থান থাকত না। ঠাকুরমন্ডপে, দালানে, প্রতিটি গৃহের বারান্দায়, গাছের তলায়–সর্বত্র যাত্রীদল। সঙ্গে মেলার সওদা। মুড়ি, মুড়কি, ঢেপের খই, বিনি খই, চিনির মট, তিলা-কদমি, তেলেভাজা, দই-জিলিপি দিয়ে তাদের চলছে ফলার ভোজন। তা ছাড়া নুনবিহীন খিচুড়ি প্রসাদ কেনারও ধুম পড়ে যেত বিকেল বেলা। অসংখ্য বিপণির অপূর্ব শোভায়, আলোকসজ্জায়, ম্যাজিক-সার্কাসের ড্রাম-পেটানোর আওয়াজে, যাত্রীদের কোলাহলে, শিশুদের ভেঁপুর শব্দে সমস্ত গ্রামখানা উৎসবমুখর–সর্বত্র উৎসাহ-উদ্দীপনা, মুক্ত প্রাণের আনন্দ-উচ্ছ্বাস। কিন্তু কলকাতার এই হট্টগোলে আনন্দের পরিচয় কতটুকু?
ধামরাইয়ের মাধবঠাকুরের রথ সুবিখ্যাত। অত বড়ো রথ বোধ করি বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। পাঁচতলা উঁচু। বত্রিশটি লোহার বেড়-দেওয়া চাকা। ওপরে ওঠবার চওড়া সিঁড়ি। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি রথটি। পৌরাণিক চিত্র খোদাই ও সুন্দর ভাস্কর্যশিল্পে অনন্য। রথটি রাখা হত গ্রামের মাঝখানে সুবিস্তৃত সড়কের ওপর। গ্রামের বাইরে থেকেও দেখা যেত তার চূড়া। দূর থেকে মনে হত যেন একটি মন্দির। নবাগতদের কাছে ছিল এক বিস্ময়। লক্ষাধিক লোকের সমাগম হত রথ-টানা উপলক্ষে। মেলাও বসত তিন সপ্তাহ ধরে। অপূর্ব দ্রব্যসম্ভার, অতুলনীয় ছিল তার আয়োজন। রথ চলত বিশ হাজার বলিষ্ঠ হাতের যুক্ত টানে। সে-দৃশ্য সত্যই দর্শনীয়। কিন্তু আজ?
দেশবিভাগের পর পাক-নাথের রক্তচক্ষুর দাপটে জগন্নাথের রথ আর এক পা-ও অগ্রসর হয়নি। মেলা-উৎসব শরিয়তি শাসনের ভয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে আত্মগোপন করেছে। যাত্রীদল সারাগ্রামে ভিড় জমিয়ে তুলে তাদের নিদ্রার ব্যাঘাত করতে আর সাহসী হয়নি।
তীর্থক্ষেত্ৰ ধামরাই। সুপ্রাচীনকালে সংস্কৃত নাম ছিল ‘ধর্মরাজিকা। তারপর পালি নাম ধম্মরাই থেকে আমরা পেয়েছিলাম আমাদের আধুনিক গ্রাম ধামরাইকে। বাস্তবিকই ধর্মপাগল ছিল আমার গাঁয়ের লোকগুলো। কিন্তু এত ধর্ম-সাধনার এ কী সিদ্ধি?–ধামরাইয়ের মানুষ হল ধামছাড়া! রথ, মাঘী পূর্ণিমা, উত্থান একাদশী ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষ্যে চিরকাল সেখানে তীর্থের উল্লাস মূর্ত হয়ে উঠত। আর এখন? এখনও সেসব উৎসবের দিন ঘুরে ঘুরে প্রতিবছরই আসে, কিন্তু তারা যেন একে একে এসে স্তব্ধ রাত্রির অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে অতিসন্তর্পণে পালিয়ে যায়।
অতীতের স্মৃতি-তরঙ্গ ভেসে চলেছে দূরে, আরও দূরে, মহাকালের মহাসমুদ্রে। এপারে পুনর্বাসনের প্রার্থনা নিয়ে আমরা যারা ঘুরে বেড়াই এক-একটা পর্বদিন তাদের হৃদয়দোরে নিয়ে আসে অতীত স্বপ্নের দুঃসহ আঘাত। কিন্তু ধ্বনির যেমন প্রতিধ্বনি আছে, আঘাতেরও তো তেমনি আছে প্রত্যাঘাত। এপারে যে প্রতিনিয়ত আঘাত আসছে আমাদের বুকে, তার প্রত্যাঘাত কবে পৌঁছোবে ওপারে?
সাত সাতটি পুরোনো দেবালয়ের আশিসপূত ধামরাই। সর্বক্ষণ সরগরম থাকত সারাগ্রাম। সকাল-সন্ধ্যায় দেবালয়ে দেবালয়ে শঙ্খ-ঘণ্টার আরতি-বাজনায় ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত সমগ্র পল্লি। পূর্ববাংলার শান্ত পল্লি-সন্ধ্যা আজ কি কাঁসর-ঘণ্টার বাজনায় তেমনি চঞ্চল হয়ে ওঠবার সুযোগ পায়? সেদিনও শুনেছি, আমার গাঁয়ের দেবালয়ে এখনও নাকি পূজারতি চলে, কিন্তু নীরবে! বাজনা নিষিদ্ধ না হলেও ভয়ের কারণ, তাই বাজনা বন্ধ। প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকে, ঝিল্লিরব ওঠে–কিন্তু কীর্তনগান আর শোনা যায় না। অথচ এই কীর্তনগান ছিল মাধব-ক্ষেত্র ধামরাই গ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শ্রীমাধবের কৃপার ওপর ভরসা করে আজও যেসব কীর্তনীয়া পড়ে আছে গ্রাম-মায়ের মাটির বুকে তাদের কণ্ঠ আজ রুদ্ধ। সমস্ত ভয়ভীতি ও নিযেধাজ্ঞার বাঁধ ভেঙে কবে সেই রুদ্ধকণ্ঠ আবার নামকীর্তনে মেতে উঠবে কে জানে?
এখনও বংশাই নদীর তীরে প্রতিদিন প্রভাত আসে, সন্ধ্যা নামে। কিন্তু সে-প্রভাত, সে সন্ধ্যার স্নেহ-পরশ তো আর আমার অনুভব করার অবকাশ নেই। বংশাইয়ের বুকে নৌকো পাড়ি দিয়ে মাটির মাকে ছেড়ে এসেছি, বিদায় দিয়ে এসেছি তাঁকে চোখের জলে–আসতে বাধ্য হয়েছি। আমার মতো আরও অসংখ্য মানুষ শরণার্থীর বেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে এই সীমান্তে। তারা জানে না কী তাদের পাপ, কী তাদের অপরাধ। তারাও তো ভালোবাসত তাদের দেশকে, দেশের মাটিকে আর সবারই মতো। দেশ-জননী কেন তাদের তার কোল থেকে ঠেলে ফেলে দিল? আবার কি মা ডেকে নেবে তার এসব নিরপরাধ সন্তানদের?
বাল্য ও কৈশোর-জীবনের কথা মনে আসে অহরহ আর অন্তরখানি ডুকরে কেঁদে ওঠে। ভোজনবিলাসী বাঙালদেশি মানুষ আমরা। খেতে-খাওয়াতে সমান আনন্দ পেত যারা, তারা আজ দু-মুঠো ভাতের জন্যে ঘুরে বেড়ায় দৈন্যের বিষণ্ণতা নিয়ে। অথচ খাওয়া বাঁচিয়ে বাঁচবার কথা পুর্ববাংলার মানুষ কোনোদিন ভাবতে পারেনি। কবিগুরু আমাদের লক্ষ করেই হয়তো রহস্য করে লিখেছিলেন,
খাওয়া বাঁচায়ে বাঙালিদের বাঁচিতে হলে ঝোঁক
এদেশে তবে ধরিত না তো লোক!
অপরিপাকে মরণ ভয়
গৌরজনে করিছে জয়
তাদের লাগি কোরো না কেহ শোক।
কিন্তু রাজনীতির পাপচক্রে আমাদের না খাইয়ে মারার যে ব্যবস্থা হয়েছে তার জন্যে শোক বা দুঃখ করার লোকও তো আজ বড়ো একটা দেখতে পাই না স্বাধীন দেশ এ ভারতবর্ষে!
আঁচলে ঘেরি কোমর বাঁধে,
ঘণ্ট আর হেঁচকি রাঁধো–
পূর্ববাংলার বাস্তুহারা মা-বোনদের শিবির-জীবনে এ দৃশ্য কি সম্ভব?
মনে পড়ে ছোটোবেলার আরও অনেক কথা। একবার পাঠশালা পালিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম বড়দার হাতে। দুষ্টু ছেলের সঙ্গে মিশতে দেখে তিনি যে আমায় শুধু গালমন্দই করেছিলেন তা নয়, কয়েক ঘা চাবুকও পড়েছিল আমার পিঠে। বুড়ো চাষি কদম আলি পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, বাজার ফিরতি তার নিঃশেষিত সবজির ঝাঁকা মাথায় নিয়ে। বড়দার হাতে আমার লাঞ্ছনা দেখে ব্যথায় যেন ভেঙে পড়ল কদম আলি। মাথার ঝাঁকাটি নামিয়ে রেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল বড়দার দু-হাত আর বলল মিনতি করে—’আর মাইরেন না দাদাবাবু, ছাইড়া দেন। আহা, হা! বেতের মাইরে খোকাবাবুর পিঠ ফাটাইয়া দিছেন এক্কেবারে! আর না, দোহাই আপনের, এইবারের মতন ছাইড়া দেন।’ কদম আলির সকরুণ আবেদনে বড়দা সেদিন সাড়া না দিয়ে পারেননি। সেবারের মতো সত্যি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন আমায়। তবে বড়দার কঠোর শাসনের চেয়ে কদম আলির স্নেহস্পৰ্শই কিন্তু চিরকালের জন্যে গভীর দাগ কেটেছে আমার মনের মণিকোঠায়। সেই কদম আলিরা গেল কোথায়? গাঁয়ের মাটিকে প্রণাম করে আমরা যখন চলে এলাম, কই, কোনো মুসলমান ভাই তো সজল চোখে এগিয়ে এল না ‘যেতে নাহি দিব’ বলে! অসীম দুঃখে কদম আলির আত্মা হয়তো ডুকরে কেঁদে উঠছে– ফেলছে দীর্ঘনিশ্বাস আকাশ থেকে। কিন্তু সে দীর্ঘনিশ্বাসের তীব্র তরঙ্গস্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কি মানুষের সমস্ত অশুভবুদ্ধি সোনার বাংলার বুক থেকে?
বেদে-বেদেনিরা প্রায়ই আসত আমাদের গাঁয়ে সাপের খেলা দেখাতে। বেহুলা-লখিন্দরের পৌরাণিক কাহিনি সুরে সুরে ছড়িয়ে দিয়ে তারা ঘুরে বেড়াত সাপখেলা দেখিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধ হিংস্র সাপের সঙ্গে মানুষের মিত্ৰতা–তার সঙ্গে রহস্য ও রঙ্গরস সেসময় লক্ষ করেছি স্তব্ধ বিস্ময়ে। কিন্তু তখন তো বুঝতে পারিনি যে, মানুষ যদি কখনো সাম্প্রদায়িকতার বিষপানে সাপের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে তার প্রতিবেশীকে আঘাত হানতে, তার জীবন-মান বিপন্ন করে তুলতে, তাহলে কোনো মন্ত্রেই আর তাকে বশীভূত করা সম্ভব হয় না।
শ্রীমাধবের ধাম ধামরাই মগ্ন আজ রাত্রির তপস্যায়। বংশাইয়ের কালো জলে আরও যেন কালি ঢেলে দিয়েছে রাত্রির অন্ধকার। যতদূর চোখ যায় শুধু অন্ধকার। কে জানে, কোথায় তার শেষ? এ প্রশ্ন আজ লক্ষ লোকের মনে। কিন্তু কে দেবে তার উত্তর?
.
খেরুপাড়া
ভারতবর্ষের বিশাল ভূমিখন্ডে বিদেশি বণিক-শাসনের অন্তিম লগ্নে মর্মান্তিক অভিনয় হল– ব্যবচ্ছেদের ছুরির ইঙ্গিতে ওরা হত্যার খঙ্গকে আহ্বান জানিয়ে খুশিমনে সরে পড়ল। মানুষের হৃদয়হীন দুর্বুদ্ধি সাপের ফণার চেয়েও সাংঘাতিক, তারই একটি দংশনে সমগ্র দেশ বিষ-জর্জর!
পদ্মা, মেঘনা, কর্ণফুলির তীরে তীরে সেই খঙ্গেরই বিদ্যুৎ-ঝিলিক দেখতে পাচ্ছি। মাটি রক্তে লাল, আকাশ লাল অন্তরের আক্রোশে, বাতাস-ভেজা চোখের জলের বাষ্পে–আর এই জল ঝরেছে অসহায় শিশু, বিপন্ন নারী, হাত-পা বাঁধা অক্ষম পুরুষের চোখ থেকে। ভাইয়ের মতো একান্ত আপন, একান্ত বিশ্বাসী যে, অন্ধকারে সে শ্বাপদের মতো লুকিয়ে এসে জ্বালিয়ে দিল ওর ঘর–ওর মাঠের ধান, গোয়ালের গোরু, ঘরের ঐশ্বর্য দস্যুর মতো লুঠ করে নিয়ে গেল চোখের সমুখ দিয়ে।
পূর্ববাংলার গ্রাম, গঞ্জ, জনপদ আজ নির্বাক, নিষ্প্রাণ। কল্পান্তের বিভীষিকায় চেতনা লুপ্ত তার। বারোমাসে তেরো পার্বণ যে দেশে, সেখানে সন্ধ্যার অন্ধকারকে চিহ্নিত করে আজ একটিও শঙ্খধ্বনি ওঠে না, বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মী-সন্ধ্যায় গৃহবধূর আড়ষ্ট কণ্ঠ চিরে ফোটে না উলুধ্বনি। বোষ্টমের আখড়ার একতারা স্তব্ধ, গোপী-যন্ত্রের ছেঁড়া তারে হয়তো মরচে ধরেছে, হরিসভার ভক্তদের খোলের চামড়া কেটে দুরে আর আরশোলা তারমধ্যে এতদিনে সংসার ফেঁদে তুলেছে বুঝি বা!
লক্ষ-গ্রামশোভিত বাংলার এক গ্রামে, তার ধুলো-মাটির আদর-ভরা কোলে বিধি-নির্ধারিত একটি দিনে আমি প্রথম চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম। দেশের ইতিহাসে সে-গ্রাম গর্বে-গৌরবে উজ্জ্বল নয়, কিন্তু আমার কাছে চিরস্মরণীয়, চিরবরণীয়–সে যে আমার মা, স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী। সেই মা আজ লাঞ্ছনায় অহল্যাজননীর মতো পাষাণ হয়ে আছে। আমরা পলাতক, তবু জন্মান্তরের প্রতীক্ষায় দিন গণনা চলে তার। পরিত্রাতার আবির্ভাব কি হবে না, তার রাত্রির তপস্যা কি সূর্যালোকের আশীর্বাদে ধন্য হবে না কোনোদিন?
কত গল্প, কাহিনি, স্মৃতি, উপকথায় জড়ানো আমার সেই মাটির মা–তার বুকজুড়ে আজ নির্জন শ্মশানের স্তব্ধতা! ভাবতেও চোখের কোণ জ্বালা করে জল ছুটে আসে। ঘরের কোলে সেই যে একফালি উঠোন, গণিতের মাপে বিশ-পঁচিশ গজের বেশি প্রশস্ত হবে না হয়তো অথচ সাতসমুদ্র তেরো নদীর চেয়েও তা দুস্তর দুরতিক্রম্য মনে হত, পার হতে গেলে পা ওঠে না–প্রাণ আর মানের দায়ে তাও শেষপর্যন্ত ছেড়ে এলাম, চোখের জলে তার শেষ ছবি এঁকে নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে, শাণিত বিদেশি ছুরির দাগের রক্তাক্ত সীমান্তরেখার ওপারে, যে বাড়ি যে ঘর পড়ে রইল, এখানে অদৃষ্টে নগর-লক্ষ্মীর অকুণ্ঠ দাক্ষিণ্য লাভ যদি ঘটেও, তবু কি আমার মন থেকে মুছে যাবে তার স্মৃতি? লাটসাহেবের বাড়ির নেমন্তন্ন কিংবা মোটা মাইনের সরকারি চাকরির গৌরবে কি আমি কোনোদিন ভুলতে পারব আমার জননী জন্মভূমিকে? যত দূরেই থাকি, মাইল-ক্রোশের হিসেব-কষা ব্যবধান যতই দীর্ঘ হোক-না কেন, সারাদিনের ব্যস্ততার পর অনেক রাত্রে আলো-নেবানো ঘরের অন্ধকারে বিছানায় যখন আমি একা, তখন সেই দূরান্তে ফেলে-আসা তাল, তমাল, হিজল, জিউল, নারকেল, খেজুর গাছের ছায়ায় ঘোমটা-টানা সেই স্নেহময়ীর জলভরা বিষণ্ণ দৃষ্টির ছায়া মনের ওপর এসে পড়ে। মধ্যরাত্রের মন্থর বাতাসে জড়িয়ে জড়িয়ে ভেসে আসে তার কান্না-করুণ কান্নার সুরে সে যেন আমায় ডাকতে থাকে, টানতে থাকে। চোখের পাতা থেকে কখন ঘুম ঝরে যায়। শিয়রের কাছের খোলা জানলা-পথে বিনিদ্র চোখে উত্তর আকাশে তাকাতে নজর পড়ে, সপ্তর্ষির দৃষ্টির আগুনে কী একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন রাত্রির অন্ধকারকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে। ও যেন আমার মনেরই প্রশ্ন, ঘোর অন্ধকারে আকাশের পটে গৃহপুঞ্জের জ্যোতিতে লেখা।
কলকাতার নগর-বেষ্টনী ছাড়িয়ে প্রায় দু-শো মাইল দূর। শেয়ালদা থেকে আট-দশ ঘণ্টার ট্রেনযাত্রার পর, গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে পদ্মা পার হয়ে ছোট্ট একটা স্টেশন-কাঞ্চনপুর। শালকাঠের তিনখানা তক্তা-ফেলা সিঁড়ি বেয়ে স্টিমার থেকে নেমে বালুর চরে পা দিতেই কী এক আশ্চর্য আনন্দে মনটা কলরব করে উঠত। দেশের আকাশ-আলো-মাটির স্নেহ সমস্ত শরীরে অনুভব করতাম। শিক্ষিত-নিরক্ষর, ভদ্র-অভদ্র পল্লিবাসীর সহজ সৌজন্যসূচক প্রশ্ন আন্তরিকতায় মাখা। অদ্ভুত ছেলেমানুষি খুশিতে বার বার মনে হত, দেশে এলাম তবে, এবার কিছুদিনের জন্যে শহরের গিলটিকরা নকল জীবনের বাইরে অনাবৃত আরামের ছুটি!
গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে ইছামতী–আমার শৈশবের বিস্ময়, কৈশোরের খেলার সঙ্গী। এর পারে দাঁড়িয়ে দূরের আবছা ধু-ধু বাঁকটায় নজর করতে করতে আমার প্রথম বিপুল পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা, এর ওপর দিয়েই গেন্দু ভাইয়ের নৌকোয় চেপে প্রথম আমার কলকাতার উদ্দেশ্যে কাঞ্চনপুর স্টেশনে যাওয়া। ইছামতীর আঁকা-বাঁকা পথ। ছোটো ছোটো বাঁক। শীর্ণ শান্ত নদী, সংযত উচ্ছ্বাসহীন। বর্ষায় কূলে কূলে ভরে ওঠে জল, অথচ কূল ছাপিয়ে যায় না। জোয়ারের জলে তীব্র স্রোত–স্থানীয় লোকে বলে ‘ধার। কিন্তু পাড় ভেঙে ধারালো জিহ্বা বিস্তার করে সে ফসলের খেতের দিকে অগ্রসর হয়ে যায় না, আক্রমণ করে না নিঃস্ব চাষির জীর্ণ কুটির। সে যে এই গাঁয়েরই মেয়ে–মেয়ের মতোই সুখের চেয়ে দুঃখ বোঝে বেশি। গ্রীষ্মে জল শুকিয়ে খরখরে বালি বেরিয়ে পড়ে, কর্দমাক্ত ডাঙা জেগে ওঠে, এদিক-ওদিক। তার ওপরে পলিমাটির স্বাদে নিবিড় হয়ে গজিয়ে উঠে বনতুলসী, কালকাসুন্দি, শেয়ালকাঁটার ঝাড়-কচুরিপানার বেগুনি ফুলে চারদিক আলো হয়ে থাকে। পঙ্কিল জলের ওপর নৌকোর গলুই গলা উঁচু করে রাখে, তার চুড়োয় বসে কচ্ছপ-শিশু রোদে ঝিমোয়। জলের ধারে ধারে ঘোরে বক, বাবলা গাছের ডালে ধ্যানী মাছরাঙার নিঃশব্দ প্রহরগুলো কেটে যায়, পানকৌড়ি সেই পঙ্কিল জলেই অনবরত ডুব খেয়ে চলে।
লেখাপড়ার তাগিদে শহরে আসতে হয়েছিল। স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছি, স্বাভাবিক নিয়মে বয়স বেড়েছে। কিন্তু সেই যে অভ্যেস ছুটি হলেই পড়িমরি করে বাড়িতে ছোটা, তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রবাস-জীবনের দিনগুলোর যাত্রাপথ বরাবর আমার টেবিলের সামনের দেয়ালে টাঙানো ক্যালেণ্ডারের পাতায় চিহ্নিত হয়ে থাকত–প্রতিদিন রাত্রে পড়াশোনা শেষ করে শুতে যাওয়ার আগে সেদিনের তারিখটা আমি কেটে দিতাম। বিছানায় শুয়ে মনে হত, একটা দিন তো কমল, বাড়ি যাওয়ার সময়টা স্পষ্ট পদক্ষেপে চব্বিশ ঘণ্টা সরে এল কাছে। স্কুলে যখন উঁচু মানের ছাত্র, জনৈক সহপাঠী একদিন শ্লেষ করে বলেছিল, ‘ছুটি হলেই বাড়ি ছুটিস, শহর ছেড়ে ভালো লাগে তোর পাড়াগাঁয়ে? কী আছে সেখানে সেই তো বাঁশবন, মশা, ম্যালেরিয়া, ঘেঁটু ফুল আর কানা কুয়ো।
রাগে ব্ৰহ্মর জ্বলে গিয়েছিল, ক্ষোভে দুঃখে জল এসে পড়েছিল চোখে। সেদিন বোকার মতো চুপ করে চলে এসেছিলাম; এত বড়ো মূর্খ প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। পরে ভেবে দেখেছি, সব জিনিস সকলের বুদ্ধি দিয়ে মাপা চলে না। শান্ত ইছামতাঁকে যারা বোনের মতো ভালোবাসেনি, পুজোর দিনের ভোরবেলা শিউলি ফুলের গন্ধ জানলা দিয়ে ঢুকে যাদের ঘুম ভাঙায়নি, একবারও যারা জীবনে দেখেনি সূর্যোদয়ে সোনার এই পুরোনো পৃথিবী আমার গাঁয়ে বিয়ের কনের মতো কেমন সুন্দর মধুর হয়ে দেখা দেয়, তাদের কী করে বোঝাব কী আছে সেই গাঁয়ে। ওরা সিনেমায় গিয়ে দেখে এসেছে গ্রাম, জানে না–সে-গ্রাম, না গ্রামের প্রেতচ্ছবি। অন্য দশটা ফালতু ঘটনার মধ্যে দেখেছে, সিনেমা-স্টার অমুক দেবী গাঁয়ের বধূ সেজে সস্তা আর্ট দেখিয়ে কলসি কাঁখে জল আনছেন নদীর ঘাট থেকে। হলদে পাখির ডানায় রঙের মাধুর্য ওরা বুঝবে কী করে? শীতের দিনে নদীর চরের কাশবনে চড়ইভাতি করার আনন্দ অজ্ঞাত ওদের কাছে। ফির্পো কিংবা গ্র্যাণ্ড হোটেলের খানার ওপারে ওরা তো জানে না কিছু।
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গ্রীষ্মের রূপ অপরূপ। ঝরাপাতা মরাফুল উড়ে যায় দমকা বাতাসের মুখে–নবীনের আবির্ভাবের আভাস পেয়ে জীর্ণজরা খসে পড়ে যেন আসনশূন্য করে দেয় তাকে। মৌমাছিদের অবিশ্রান্ত গুনগুনানি শুনতে শুনতে আমের মুকুল বড়ো হতে থাকে। সড়কের ধারে ঢিলের মতো উঁচু জায়গায় দারা! অসংখ্য অনামি বন্য গাছ সেখানে। সাদা ফুলের ছড়া ঝুলে থাকে রাস্তার ওপর। কী মিষ্টি গন্ধ তার! অবহেলিত সেই বৈশিষ্ট্যহীন। গাছগুলোও বসন্তকালে এমআকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। প্রতিসন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফুটবল খেলা শেষ করে বাড়ি ফেরবার সময় নীচু ডালের ফুলগুলো আমরা পেড়ে নিয়ে আসতাম লাফিয়ে।
চৈত্রের আগুনে মাটি পুড়ে যেত, জ্বলন্ত আকাশ থেকে নিদারুণ গ্রীষ্ম ঝরে পড়ত মাথার ওপর। এদিক-ওদিক শোনা যেত তৃষ্ণার্ত চাতকের জলপ্রার্থনার করুণ সুর-ফটিক জল, ফটিক জল!
তারপর একদিন কালির দাগ লাগত আকাশের দূরতম কোণায়। তীক্ষ্ণ নীল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠত মহাশূন্যে, কড়কড় শব্দে বজের তরুণ কণ্ঠের হুংকার শোনা যেত। কিছুটা সময় বায়ুলেশহীন স্তব্ধতা। নীড়-প্রত্যাশী পাখিদের শঙ্কিত চিৎকার। চারিদিকে কীরকম একটা থমথমানি–তারপরই মনে হত কারা যেন হাজার হাজার ঘোড়া ছুটিয়ে পদ্মার চরের ধূসর বালিতে চতুর্দিক অন্ধকার করে এই গ্রামের দিকেই আসছে। দক্ষিণ দিকের আকাশ চিরে শোঁ শোঁ শব্দ বেরিয়ে আসত। ঘোড়ার খুরের বাজনা গাছপালার মাথার ওপর দিয়ে দ্রুততালে এগিয়ে আসতে থাকত-কাছে…কাছে…আরও কাছে। অবশেষে এসেই পড়ত তারা–প্রচন্ড ঝড়। আকাশে তখন রোদ থাকত না, অথচ অন্ধকারও নয়–মেঘের গা চুঁইয়ে কী এক অদ্ভুত পিঙ্গল আলো টর্চের ফোকাসের মতো লম্বা রেখায় নেমে আসত এদিক-ওদিক, ঝড়ের প্রহারে আকুল আর্তনাদে কেঁদে উঠত বাঁশবন, মড়মড় শব্দে পথঘাট আটক করে উপড়ে পড়ত গাছ, মত্ত বাতাসের মুখে হালকা তাসের মতো উড়ে যেত চালাঘর, তালগাছের পাতায় ঝলসে উঠত বিদ্যুতের আভা। জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, কেন জানি না, আমার শিশুমনে আশঙ্কা হত, রাস্তার ধারে ওই যে ফাঁকা জায়গায় নিঃসঙ্গ একলা দাঁড়িয়ে নারকেল গাছটা, ওটার মাথায় বজ্রপাত হবে। বড়োমার কাছে গল্প শুনেছি, পদ্মায় যে বছর ঝড়ে কালীগঞ্জের স্টিমার ডুবে গিয়েছিল, সেবার আমাদের পুকুরপাড়ের তেমাথা আমগাছে বাজ পড়ে গাছটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল, আর সেই থেকেই ওর তিন মাথা।
ঝড়ের বেগ শান্ত হয়ে এলে আসত বৃষ্টি-স্নিগ্ধ বড়ো বড়ো ফোঁটায় নামত বছরের প্রথম বর্ষণ। বৃষ্টিধারায় স্নান করতে করতে আমাদের সেই করমচার গানের কোরাস চলত-কচু পাতায় করমচা, যা বৃষ্টি উড়ে যা। ধূলিলিপ্ত গাছপালার প্রসাধন হত সেই জলে। ভেজামাটি থেকে সোঁদা গন্ধ উঠত। চাতকের পিপাসা বুঝি ওতেও মিটত না, কারণ একটু পরেই আবার শোনা যেত-‘ফটিক জল, ফটিক জল’!
প্রতিবছর বৈশাখ মাসে বাংলাদেশের মাঠেমাঠে কে এক রক্তচক্ষু, পিঙ্গলজটা, রুদ্র সন্ন্যাসী বহ্নিমান চিতাপের সম্মুখে বসে শান্তিপাঠ করে যান। তাঁর গম্ভীর উদাত্ত কণ্ঠধ্বনি শুষ্ক দগ্ধ তৃণ-প্রান্তরের ওপর দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে যায়। তখন জনমানুষের সাড়া পাওয়া যায় না কোথাও, কেবল তন্দ্রাতুর কপোতের ক্লান্তস্বর কোথা থেকে ভেসে এসে যেন সেই গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে মিশে যায়। গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে শান্তিনিকেতনের শুষ্ক মাঠে এই শান্তিপাঠরত সন্ন্যাসীকে একজন দেখেছিলেন–সিদ্ধকবির দিব্যদৃষ্টি ছিল তাঁর। কিন্তু আমিও দেখেছি এঁকে, আমাদের বাড়ির সীমান্তবর্তী দিগন্ত-ছোঁয়া বিস্তীর্ণ বাল্লার মাঠে।
তখন আমার বয়স কত বলতে পারব না। তবে এটুকু বলা চলে, ‘পথের পাঁচালী’-র অপুর মতো তখন আমি, আমার নিজের জগতে একজন মস্ত বড়ো কবি, একজন আবিষ্কারক। কাজেই সেই শিশু আমি, যাকে সিদ্ধকবির সঙ্গে বিনাদ্বিধায় এক-আসনে বসানো চলে।…হ্যাঁ, সেই সন্ন্যাসীর অস্পষ্ট স্মৃতি আমার মনে আছে। দুপুর বেলা বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, মায়ের বুকের ওপর থেকে কাশীরাম দাসের মোটা মহাভারতখানা একপাশে কাত হয়ে নেমে এলে, পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। খেজুর গাছের তলায় দাঁড়িয়ে, সভয় দৃষ্টিতে মাঠের দিকে তাকিয়ে মনে হত, ওই দূরে মাঠের ঠিক মধ্যিখানে কীসের যেন ধোঁয়া–আবছা, অস্পষ্ট–শীতের দিনের কুয়াশার ধূসরতা। কী একটা উধ্বমুখী হয়ে কাঁপছে– ছোটো ছোটো ঢেউ–আগুনের শিখা বুঝি! রোদের মধ্যে মিশে গেছে তা, ভালো করে বোঝা যায় না। তার ও-পাশে বসে কে যেন একজন–ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মূর্তি, দেখা যায় না, চেনা যায় না, কিন্তু অনুমান করতে গিয়ে নিঃসংশয়ে মনে আসে, সে-এক উগ্রদর্শন সন্ন্যাসী, দু চোখে আগুন তাঁর, দয়া নেই, মায়া নেই, ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে যেন ওই চিতার আগুন একলাথি মেরে সমস্ত গ্রামের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে নিমেষে তিনি সব ধ্বংস করে ফেলতে পারেন… ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকতাম, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করত, শরীর শিউরে উঠত মাঝে মাঝে, কিন্তু এক পা নড়তে সাহস পেতাম না। মনে হত, নড়বার চেষ্টা করলেই তিনি টের পেয়ে যাবেন, আর একবার টের পেলে–!
একদিন অমনি দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে ঝড় উঠেছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, সন্ন্যাসী বুঝি খেপে গেছেন কোনো কারণে। বাতাসে শুকনো মাঠের রাঙা ধুলো উড়ছিল। আমি দেখছিলাম চিতার আগুন পা দিয়ে তিনি লন্ডভন্ড করে দিচ্ছেন। চিৎকার করে বারমুখো ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে বাঁশের কঞ্চির স্থূপের ওপর পড়ে গিয়েছিলাম জ্ঞান হারিয়ে। গলার বাঁ-পাশে অনেকখানি কেটে গিয়েছিল, ক্ষতচিহ্নটা এখনও আছে।
সেসব দিনের ভয়ের কথা মনে পড়লে চোখ সজল হয়ে আসে কেন? ঝাপসা দৃষ্টির সামনে বিস্তীর্ণ বাল্লার মাঠ জলভরা অথই বিলের মতো ছলছলিয়ে ওঠে। আমার ছোটোবেলায় রোজ সন্ধ্যায় আমার গাঁয়ের পোড়োমাঠে আলেয়া জ্বলেছে, ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটা আগাগোড়া ভয়ের কাঁথা মুড়ি দিয়ে চিরকাল দাঁড়িয়ে থেকেছে, অমাবস্যার রাত্রে কেউ কেউ নাকি নাড়দের পতিত ভিটেয় মেয়েমানুষের হাসি শুনতে পেয়েছে–এসব ভয়-কাহিনি-স্মৃতির দেশে আর একবার যেতে ইচ্ছে করে; মনে হয়, আর একবার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হিজলগাছের মাথায় সন্ধের প্রথম তারাটা দেখি, ঝিঁঝির ডাক শুনি বেতের জঙ্গলে।
বর্ষার মেঘান্ধকার বিষণ্ণ দিন কেটে গেলে এসেছে শরৎ। কাস্পিয়ান সাগরের ঘন নীল জল দিয়ে কে যেন ধুয়ে দিত আকাশ। সকাল-বিকেলের রাঙা রোদ তার ওপরে সোনা ছড়াত। মাঠেমাঠে পাকা ধান, সোনালি রং, বৈকুণ্ঠ-লক্ষ্মীর অঙ্গ-আভা যেন। ফসল ভালো হলে মুসলমানরাও বলত, মা লক্ষ্মী এবার ভালো দেছেন গোয়
আমার গাঁয়ে বিলের জলকে ঢেকে রাখত পদ্ম আর শাপলা। খালের পারে, নদীর চরে উচ্ছ্বসিত কাশের বন–সাদা ফেনার সমুদ্র যেন। আশ্বিনের ছুটির বাঁশি বাজত জলে-স্থলে স্টিমারঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে একটির-পর-একটি নৌকো এসে ভিড়ত ইছামতীর পারে। গ্রামভরা লোকজন, ঘরে-ঘরে প্রবাস প্রত্যাগতের আনন্দ কলরব। বাংলাদেশের গ্রাম যে চিররূপময়ী কাব্যের নায়িকা নয় তা জানি। সবুজ মাঠ, সোনালি রোদ, পাখির ডাক, পূর্ণিমা রাত্রির জ্যোৎস্নার জলে ধোয়া আকাশের আড়ালে তার যে ঈর্ষা-নিন্দা-দলাদলি, ক্ষুধা-দারিদ্র অকালমৃত্যু পীড়িত বিকৃত বিকারগ্রস্ত রূপ রয়েছে, তাও মিথ্যে নয়। কিন্তু তবু এই পুজোর দিনে একান্ত নিঃস্বের দরজার সমুখেও আঁকা হয় আলপনা, উঠোনে দাঁড়ালে প্রাণখোলা হাসির সঙ্গে কেউ-না-কেউ এসে হাতে দিয়ে যায় দুটো নারকেল-নলেনগুড়ের মিষ্টি। বিজয়ার দিনে ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে বুকে জড়িয়ে সবাই সবাইকে করে আলিঙ্গন। প্রাত্যহিকতার অজস্র গ্লানি বিস্মৃত হয়ে, দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের কালো চিহ্নগুলো মন থেকে মুছে ফেলে, সমস্ত পৃথিবীকে
বিজয়ান্তে একবার হৃদয়ভরে গ্রহণ করা ছিল পূর্ববাংলার চিরাচরিত রীতি। আমার গাঁয়ের তেমনি পরিবেশ আর জীবনে কোনোদিন দেখতে পাব, তা যে কল্পনার অতীত।
আমাদের চন্ডীমন্ডপে প্রতিমা তৈরি হত। একমেটে, দো মেটে, মাজাঘষা–তারপরে রং। পুজোর কাছাকাছি তিনজন কুমোরের অনেক রাত অবধি লণ্ঠন জ্বেলে কাজ চলত। ঘুমের ঘোরে অবস্থা কাহিল হয়ে না পড়া পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের ভিড় কমত না। নানারকম বায়না নিয়ে তারা বসে থাকত।
যোগেন দা, এই যে দেখো, আমার পুরোনো পুতুলটায় একটু রং চড়িয়ে দেবে–তোমার ওই দুর্গার চুড়ার সোনালি রংটা?
আর এই যে আমার ঘোড়াটা যোগেনদা, ঠ্যাংটা ভেঙে গেছে, একটু জুড়ে দাও না ওই এঁটেল মাটি দিয়ে।
যোগেনের কোনোদিকে তাকাবার অবসর নেই, মুখে হু-হ্যাঁ চালিয়ে সে তুলি টানতে থাকত।
এই ছাওয়ালপান, কামের সময় প্যানপ্যান কইরো না।–উঠোনের ওধার থেকে ছেলেদের ধমক দিত ইয়াদ আলি। প্রতিমা-সজ্জা দেখার শখ ছেলেদের অপেক্ষা কিছুমাত্র কম নয় তার। মুসলমানপাড়ার দোর্দন্ড প্রতাপশালী সর্দার সে। পঞ্চাশের ওপরে বয়স। মাথায় কাঁচা-পাকা চুলের বাবরি। প্রচুর পান খেয়ে খেয়ে দাঁতগুলো সে করেছে পাকা তরমুজের বিচির মতো কুচকুচে কালো। চাষাবাদ আর দস্যুবৃত্তি তার উপজীবিকা। মানুষ খুনের ঐতিহ্যবাহী বংশের অধস্তন পুরুষ সে। দু-চারটে লাশ সে নিজেও যে মাটির নীচে পুঁতে দেয়নি এমন নয়।
তুমি চ্যাংড়াদের কথায় কান দিয়ো না পালমশায়, মন লাগিয়ে চিত্তির করো,-ই সব ভগমানের কাম।–যোগেনকে পরামর্শ দিত ইয়াদ আলি। কিন্তু গ্রামে থাকতেই দেখে এসেছি, সে ইয়াদ পালটে গেছে। আনসার বাহিনীর নায়ক সে। হিন্দুর দেবতার নাম মুখেও আনে না, ইসলামের চমৎকার ব্যাখ্যা করে।
চলতি রাজনীতির সঙ্গে এ গ্রামের বরাবরই যোগ ছিল। পোড়োভিটের গভীর জঙ্গলে বেশি রাতে গোপনে মিটিং হত। তারপরেই শুনতে পাওয়া যেত, আট-দশ মাইল দূরে সাহাদের পাটের আড়তের ক্যাশ লুঠ হয়েছে। মহকুমা শহর মানিকগঞ্জ অনুশীলন পার্টির নেতা বিপ্লবী পুলিন দাসের অন্যতম কর্মকেন্দ্র, আর ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ভূতপূর্ব ম্যনেজিং ডিরেক্টর রজনী দাস ছিলেন মানিকগঞ্জ শাখার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এ গ্রামের কয়েকটি তরুণ সেখানে নিয়ত যাওয়া-আসা করতেন। সেই সূত্রে আমাদের বাড়ি পুলিশে সার্চ করেছে একাধিক বার; কাকাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। সে-সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যায়াম এবং লাঠিচালনা শিক্ষার সমিতি স্থাপিত হয়েছিল অনুশীলন পার্টির নেতৃত্বে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সারাবাংলার লাঠিয়ালদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ গ্রামের ছেলে সুধীর দত্ত অপরাজিত থেকে চ্যাম্পিয়নের গৌরব অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘকাল পূর্বে তিনি মারা গেছেন। এ জন্যে আক্ষেপ করি না। সেকালের বিপ্লবীকে আজ শরণার্থীদের মধ্যে দেখতে হচ্ছে না–নিঃসন্দেহে এ সৌভাগ্য নয় কি? বিয়াল্লিশ সালের অগাস্ট মাসেও স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ছিল এখানে। নিরুদবিগ্ন পল্লিজীবনের অনাবিল শান্তিতে লেগেছিল প্রচন্ড দোলা। গাঁয়ের কাঁচাসড়ক ধরে ভারী বুটের শব্দ করতে করতে আসতে দেখেছি সঙিনধারী পুলিশ।
গ্রামের লোকের, বিশেষত যুবকদের চেষ্টায় গড়ে উঠেছিল প্রকান্ড পাবলিক লাইব্রেরি, থিয়েটারের ‘এভার গ্রিন’ ক্লাব। ক্লাবের ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব ষ্টেজ। প্রতিবছর পুজোর সময় তিন রাত্রি অভিনয় বাঁধা ছিল, এবং অভিনেতারা প্রায় সকলেই ছিলেন ঢাকা কিংবা কলকাতার কলেজের ছাত্র। ক্লাব-লাইব্রেরি যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরা জীবনের জটিলতা আর জীবিকার ধাঁধায় জড়িয়ে পড়লে এর নায়কতা এসেছিল আমাদের হাতে। ভবিষ্যতে একদিন হয়তো আমাদের কাছ থেকে কনিষ্ঠদের হাতে উত্তীর্ণ হয়ে যেত এই নেতৃত্ব। কিন্তু তার আগেই যে গ্রাম ভেঙেছে, কে কোথায় ভেসে গিয়েছে জোয়ারের মুখে কে জানে!
গ্রীষ্মকালে চারদিক যখন শুকনো খটখটে, ক্লাবের সভ্যদের উৎসাহে প্রতিবছরই একবার করে সে-সময়ে গ্রামের স্বাস্থ্যোদ্ধার করা হত। পুকুর থেকে, নদী থেকে কচুরিপানা টেনে তুলে শুকিয়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতাম আমরা। সমবেত আক্রমণের মুখে অবাঞ্ছিত ঝোঁপজঙ্গল নিঃশেষ হয়ে যেত। দুর্গম রাস্তা সংস্কারের উদ্দেশ্যে চুপড়ি-কোদাল নিয়ে অভিযান চলত–মাটির বোঝা বইতে গিয়ে টনটন করত আমাদের মাথার চাঁদি।
দু-বছর আগে এক অপরাহ্নে ইছামতী পাড়ি দিয়ে আমার জন্মভূমি খেরুপাড়া ছেড়ে চলে এসেছি। নিজের বাড়ি বিদেশ হয়েছে, ঘরে ফেরার পথে গজিয়েছে বিষাক্ত কাঁটা। এ জীবনে খেরুপাড়ার কালো মাটির পথে বুঝি আমার পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। কিন্তু যদি এ অনুমান ব্যর্থ হয়, কখনো যদি গঙ্গা-পদ্মা ফের নতুন রাখিবন্ধনে বাঁধা পড়ে, তা হলে কি আমি আবার তেমনিভাবে ফিরে পাব আমার সেই হারানো খেরুপাড়াকে?
অবিশ্বাস গাঢ় হয়ে আসে, সংশয়ে দুলতে থাকে মনটা। আশার সার্থকতায় ফিরে পাওয়া গ্রামে পৌঁছোল কেউ যদি হঠাৎ এসে খবর দেয়, ও পাড়ার যারা প্রাণের মায়ায় সীমান্তপারের দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল, মাঝপথ থেকে তাদের আর খবর নেই কিংবা যদি কেউ বলে, পাশের গ্রামের এক অসহায় গৃহস্থ পরিবারের নতুন বউ কোনো উপায় না দেখে একগোলা আফিম মুখে পুরে ঠাকুরের পটের সামনে চুপচাপ মুখ বুজে শুয়েছিল, সে আর উঠে বসেনি–অথবা যদি শুনতে পাই, আমাদেরই প্রতিবেশীর এক কুমারী মেয়ে, আমাদের পুকুরধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফাল্গুন মাসে যখন অসংখ্য রক্তমঞ্জরিতে লালে লাল হয়ে ওঠে, তারই ডালে চূড়ান্ত অপমান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছিল, তখন আমার চোখ ফেটে যে জল আসবে, সে কি পুনর্মিলনের আনন্দে? আমি যদি অসহ্য চাঞ্চল্যে পথের ধুলোয় লুটিয়ে পড়ি, তা কি অদৃষ্টের দেবতাকে সকৃতজ্ঞ প্রণাম জানাবার জন্যে? সময়ের গতি দুর্বার, জীবন অস্থির–পদ্মপাতায় জলবিন্দু টলমল। যা হারালাম, যা ফেলে এলাম, অনন্ত-অতীত তাকে গ্রাস করে নিল, কোথাও তার আর সন্ধান মিলবে না।
আকাশে বর্ষার মেঘ, বিচ্ছিন্ন কান্নার সুর। কিন্তু সে-সুরে তো হৃদয় ময়ূরের মতো পেখম বিস্তার করে নাচে না। প্রাসাদের শিখর থেকে কারও কালো চুলের ঢেউ আকাশ ঢেকে ফেলেছে–এ কল্পনাতেও মন তো এগোয় না। আমি দেখতে পাচ্ছি, এই মেঘেরই ছায়া পড়েছে ইছামতীর জলে। তারই তীরে দাঁড়িয়ে জনহীন বিপন্ন খেরুপাড়া গ্রাম। অহল্যার পাষাণ-জীবন তার। মুক্তির অপেক্ষায় চলছে অপমৃত্যুর প্রহর গণনা। তবু কেন জানি না, প্রবল প্রত্যয়ে কবিগুরুর সেই অমৃতময়ী আশার বাণী বার বার মনে আসে,
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
তেমনি স্থান কি পাব না আমরা?
সংগ্রামের নায়ক নিয়তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়েছে। তার রথচক্র গ্রাস করেছে মেদিনী, অন্যায় চক্রান্তে বিপর্যস্ত সে। কিন্তু তার পৌরুষ লুপ্ত হয়নি, বীর্যের বিনাশ নেই, আদর্শ অমর। দিগন্তের নিকষ অন্ধকারে দৃষ্টি চলে, কিন্তু কার যেন পদধ্বনি শোনা যায়! অন্ধকারে যবনিকা থরথর করে কেঁপে ওঠে।
.
ধামগড়
‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী’–গানটি কত উৎসবে কতবার যে গেয়েছি তার ঠিক নেই। কবিগুরুর মহাবাণী শুনে প্রাণে শক্তি পেয়েছি সত্য, কিন্তু আমাদেরও যে সর্বস্বত্যাগী হয়ে ‘জয় মা’ বলে এমনিভাবেই তরি ভাসাতে হবে অনির্দিষ্টতার পথে তা আগে কি কোনোদিন ভাবতে পেরেছিলাম? ভারত স্বাধীন হবে, আমরা সুখীসচ্ছল হব, বাঙালির ঘর ভরে উঠবে আবার ধন-ধান্যে, পুজো-পার্বণে–এই স্বপ্নই তো দেখেছি রাত জেগে জেগে! কিন্তু তার বদলে আমরা হলাম নির্বাসিত, অসহায় পাখির মতো বিপদগ্রস্ত।
মনে পড়ছে প্রায় বারোবছর আগে আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে একমাত্র পুত্র দেবেন মারা গেলে আমার ঠাকুমা দুঃখ করে বলেছিলেন,–‘আহা, সারদার ভিটেয় আর প্রদীপ দেবার কেউ রইল না!’ কিন্তু আজ সমস্ত পূর্ববাংলার প্রতি হিন্দু-পরিবারে ছেলে থাকতেও প্রায় ভিটেতেই প্রদীপ দেওয়ার কেউ নেই।
নারায়ণগঞ্জ থেকে মাইল তিনেক দূরে আমাদের গ্রাম ধামগড়। স্টিমার বা নৌকো যাতে খুশি যাওয়া যায়। তবে নৌকোতে গেলে দেড় ঘণ্টা আর স্টিমারে গেলে লাগে আধঘণ্টা। ছাত্রাবস্থায় এ দুটোর কোনোটাতেই মন সরত না–সামান্য সময় অপচয়ও ছিল তখন প্রবাসীমনের পক্ষে অসহ্য। বাঁধনছেঁড়া মন মুহূর্তে বাড়ি পৌঁছোবার জন্যে পাগল হয়ে উঠত। স্টিমারে গেলে সারং, সুখানী, ড্রাইভার কর্মচারীদের দেওয়া খাবার জুটত প্রচুর। এ-উপহার জুটত বাবার সম্মানে, তিনি তখন সোনাচোরা ডকের ডাক্তার। তাই ছোটোবাবু (আমি) তাদের আপনার জন, তাকে আদর করার অর্থ তার পিতাকে সম্মান দেখানো। নৌকোতে গেলে যেতাম চারার গোপে। আমাকে দেখামাত্রই জনদশেক মাঝি হুমড়ি খেয়ে এসে দাঁড়াত চারপাশে। তারা সবাই প্রায় মুসলমান। কার নৌকোয় উঠব ভেবে ঠিক করতে পারা যেত না। যাকে প্রত্যাখ্যান করব তারি তো হবে অভিমান! তবুও কেউ কেউ আমার শোচনীয় অবস্থাকে আরও সঙিন করার জন্যেই ছোঁ মেরে নিয়ে যেত বাক্স–বিছানা-সুটকেস। তারপর সমস্বরে আহ্বান জানাত—’আইয়েন ছোড ডাক্তারবাবু আমার নায়ে, ছোত কইরা যাইতে পারবেন!’ পিতার খেতাব আমার কপালে যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই জুটেছিল! এরপর কাঁচুমাচু মুখে একজনের নৌকোয় গিয়ে হয়তো উঠতাম–যারা সুটকেস ও বিছানা নিয়ে গিয়েছিল তখন তারা তা হাসিমুখেই ফিরিয়ে দিয়ে যেত সে-নৌকোতে। আমি সাধারণত যার নৌকোয় যেতাম, মনে পড়ে, সে গান গাইত চমৎকার। রসুল মাঝি বলেই সে পরিচিত ছিল। আমাদের কাছে। নৌকো ছেড়ে সে ডান হাতে দাঁড় টানত আর বাঁ-হাতে হুঁকো ধরে টানত কড়া তামাক। তামাক খাওয়া শেষ হলে ছোট্ট একটা কাশির পর উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরত সে,
গুরু আর কতদিন থাকবা ফারাক, পাইনা তোমার দ্যাহা,
কত দুঃখ সইলাম দরায়, নাইকো ল্যাহ জোহা।
গুরুভজা রসুলমাঝি গান গেয়ে চলেছে আনমনে একটানা। অপূর্ব পরিবেশের মধ্যে দূরে দেখা যাচ্ছে শীতলক্ষ্যার পুবপাড়ে ঢাকেশ্বরী মিলের চিমনি, বসু গ্লাস ওয়ার্কসের কারখানা। পশ্চিম দিকে পাটের কল দু-নম্বর ঢাকেশ্বরী মিলের চোঙা, লক্ষ্মীনারায়ণ মিল আর চিত্তরঞ্জন মিলের খাড়া-উঠে-যাওয়া চিমনির শ্রেণি অবিরাম ধোঁয়া উদগিরণ করে চলেছে যেন মানুষের ইতিহাসকে কলঙ্কমলিন করার উদ্দেশ্যেই!
আজ বেশি করে মনে পড়ছে রসুল মাঝির ভারি খোলা গলার ভক্তিমূলক সেসব গান। শীতলক্ষ্যার জলে তার দাঁড়ের ছপছপ শব্দ আমাকে যেন অন্য কোনো জগতে নিয়ে যেত। সেদিনকার গোধূলিবেলায় বৈরাগীমন যেমন নিমেষে চলে যেত অন্য জগতে আজ রূঢ় বাস্তবময় পরিবেশে দেহও স্থানান্তরিত হয়েছে অন্যদেশে। চিরদিনের জন্যেই কি হারিয়েছি শীতলক্ষ্যার শান্ত করুণ মিনতিভরা রূপকে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা জননী জন্মভূমিকে!
মাতৃভূমিকে ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফেলে এসেছি সমস্ত ঐশ্বর্য ও সম্পদকে। অকৃত্রিমভাবে বুঝতে পেরেছি স্বাধীনতা আমাদের দেশে পরাধীনতার অভিশাপ নিয়েই দেখা দিয়েছে। অমাবস্যার ঘোর কালরাত্রির মধ্যে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি বলেই জীবনেও দেখা দিয়েছে অমাবস্যার করাল ভয়াল মূর্তি! রাত্রি প্রভাতের কত দেরি কে বলে দেবে? মহামনীষীরা স্তোক দিয়েছেন wait for the morning owl! কিন্তু শীতলক্ষ্যার তীরে আবার পূর্বাকাশের সূর্যোদয়ের রক্তরাগরেখায় গোধূলির দেখা পাব কি না জীবনে কে জানে।
সন্ধেবেলায় দেখতাম একহাতে প্রদীপ আর অন্যহাতে ধুনুচি নিয়ে প্রাঙ্গণপাশে তুলসীমঞ্চে মা গলায় আঁচল দিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করছেন। দেবতার কাছে তিনি কী প্রার্থনা করতেন জানি না, কিন্তু আজকের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বচ্ছন্দে বলতে পারি, তাঁর ভীরু হৃদয়ের উজাড় করা প্রণাম এবং প্রার্থনা পূর্ণ হয়নি। জীবনকে বিপদমুক্ত করার সব আবেদনই ব্যর্থ হয়েছে আমাদের। একা একা থাকলেই মনে পড়ে যায়, গ্রামের নিস্তব্ধ দুপুরে জামের ডালের ওপর বসা ঘুঘু দম্পতির একটানা সুর, আজও হয়তো শুনতে পাওয়া যায় সে-সুর, কিন্তু সে ডাকে কটা মানুষের মন সাড়া দেয় এখন?
দুরন্ত দুপুরের ছবি যেন ক্রমাগত চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজ। মনে হচ্ছে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সামনে সবুজ মাঠের বিস্তীর্ণ ফসল ফলার ছবি। কোনো জমিতে ধানগাছ বাতাসের সঙ্গে মাথা দুলিয়ে নড়ছে সবুজ যৌবনকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে, আবার কোনো মাঠে অজস্র পাটচারার সমারোহ। সব খেতে উবু হয়ে বসে মাথায় টোকা দিয়ে খেত নিড়িয়ে দিচ্ছে অখন্ড মনোযোগ সহকারে কৃষকের দল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আবার গানও হচ্ছে–কোহিল ডাইক্কো না ডাইক্কো না এই কদম্ব ডালে। জমি থেকে উঠছে কুন্ডলী কেটে ধোঁয়া, খড় পাকিয়ে লম্বা দড়ি করে গোড়ায় আগুন দেওয়া হয়েছে তামাক খাওয়ার জন্যে। সংকীর্ণ আল দিয়ে হেঁটে চলেছে ক্লান্ত ‘বি’ শিফটে ছুটি পাওয়া শ্রমিকদল। কারুর মাথায় ছাতা, কারুর মাথায় বড়ো বড়ো কচুপাতা! কেউ যাবে রানিঝি, কেউ জাঙাল, কেউ বা পুবদিকের নমশূদ্র পাড়ায়। কারুর গন্তব্যস্থল মালিবাগ কারুর বা আরও দূরে লাঙলবন্ধ। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমপাড়ে হিন্দুতীর্থ লাঙলবন্ধ খুব কাছে নয়।
ছোটোবেলায় মায়ের সঙ্গে অষ্টমীস্নান করতে কতবার এই লাঙলবন্ধে গিয়েছি। দূরত্ব ছিল মাইল-দুই পথ। গ্রামের গৃহিণীরা যেতেন পাল্কি চেপে, কিন্তু মাকে কোনোদিন পাল্কিতে যেতে দেখিনি। তিনি বলতেন, “এইটুকু পথ চলতে না পেরে পাল্কিতে চড়ে তীর্থ করতে হয় যদি, তাহলে সে-তীর্থের ফল কী? ওরকম তীর্থ করার চেয়ে না করাই ভালো। তাই মুখ কালো করে আমাকেও হাঁটতে হত তাঁর সঙ্গে। মায়ের হাঁটা বড়ো আস্তে, ভোর চারটের সময় যাত্রা করেও তাই আমরা পৌঁছোতাম রোদ উঠে যাওয়ার পরে। আমাকে হাঁটতে হত না বড়ো একটা, কেননা সঙ্গে থাকত দুজন প্রজা। একজন মামুদ আলি আর একজন কালীচরণ। চলার মাঝখানেই হঠাৎ থেমে বিষণ্ণ মুখে মায়ের আঁচল চেপে কাঁদো কাঁদ স্বরে বলতাম—’মা, পা বড্ড কনকন করছে!’ মা জবাব দেওয়ার পূর্বেই চতুর মামুদ আলি বুঝে ফেলত আমার চালাকি। আকর্ণ হাসিকে বিস্তৃত করে মায়ের হয়ে সে-ই বলত—’আইয়ো আইয়ো, তোমার চালাকি বুঝি বুজি না ছোট্টবাবু!’ এই বলে স্বচ্ছন্দে সে তুলে নিত ঘাড়ে।
মাঠে মাঠে রাস্তা কিছু কম, তাই আমরা আল ধরে এগিয়ে যেতাম। দেখতাম অজস্র ভক্ত তীর্থযাত্রী ভক্তির অর্ঘ্য নিয়ে ছুটে চলেছে তীর্থসলিল স্পর্শ করতে। পুণ্যকামী বাঙালির এই চিত্র সর্বত্রই এক। চলতে চলতে চোখে পড়ত শস্যশ্যামলা মাতৃভূমির লুকোনো সম্পদ। ধান-পাট-মেঠোকুমড়োয় মাঠ পরিপূর্ণ, কোথাও লাল লঙ্কায় লালে লাল। মেলার পথে দোকানদাররা নিয়ে চলেছে ধনে-জিরে-তেজপাতার তৈজসপত্র। আবার কারুর মাথায় খই মুড়কি-ডবল বাতাসার গুরুভার। যাত্রীরা এইসব জিনিস কিনে আনবে বাড়ি ফেরার পথে। মামুদের কাঁধে গদিয়ান হয়ে মনটা বেশ স্ফুর্তি-স্ফুর্তিই ঠেকত।
ভোরের বাতাসে ভেসে আসছে মেলার হট্টগোল, খোলের মিঠে আওয়াজ, কীর্তনের অসমাপ্ত কলি। হঠাৎ শুনতে পেলাম দূর থেকে কে যেন হাঁকছে ‘বিশু বাই’ করে। চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি উজ্জ্বল দাঁত বের করে হাসছে গঙ্গা। বাল্যবন্ধু গঙ্গা, সহপাঠী গঙ্গা অবাঙালি গঙ্গা। জন্মেছে আমাদের গ্রামে, বাড়ি মুঙ্গের জেলার এক পল্লিতে। তার বাবা রঙ্গলাল চৌকিদার। গঙ্গার ভাগ্যে কোনোদিন জন্মভূমি দেখার সুযোগ হয়নি, সে আমার গাঁয়েরই ছেলে, তাকে দেখে কাঁধ থেকে নামতে চাইলাম, কিন্তু মামুদ ধমকে বলে উঠল–না ছোটোবাবু আরাইয়া জাইবা, বিরের মইদ্যে লামতে দিমু না– কী করি উঁচু থেকেই গঙ্গার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললাম। মেলায় পৌঁছে দেখি স্নান সেরে মেয়েরা কাঁখে বা মাথায় নতুন হাঁড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহলী শিশু সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল কাঁধের ওপর থেকে—’মামুদ ভাই, হাঁড়ির মধ্যে কী নিয়ে যাচ্ছে ওরা?’ মামুদ বিজ্ঞের মতো কমকথায় উত্তর দিয়েছিল—‘পুইন্যি!’
কলকাতার পথে চলতে চলতে শুনতে পাই বেতার শিল্পীদের ভাটিয়ালি, রামপ্রসাদি, বাউল, শ্যামাসংগীত এবং আরও কতরকম ভক্তিমূলক গান। এসব শুনলেই মনটা আকুলি বিকুলি করে ওঠে শৈশবে দেখা কিশোরী বাউলের কথা ভেবে। কিশোরী বাউলের সেই টানাটানা চোখ দুটো, আজও আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছে যেন! ভুলতে পারিনি তার সৌম্য-সুন্দর ঢলঢলে মুখখানি। পরনে গেরুয়া, এককাঁধে ঝুলি আর এক কাঁধে সারেঙ্গি। মাসান্তে দেখা পেতাম তার ঠিক দুপুরবেলায়। তার গান শোনার জন্যে উদগ্র হয়ে থাকতাম নির্দিষ্ট দিনে। কিশোরী বাউল তার সারেঙ্গির ওপর ছড় ঘষতে ঘষতে ঢুকত লাল সুরকি-ঢালা পথ বেয়ে। বেরিয়ে বারান্দায় আসার সঙ্গে সঙ্গে কিশোরী প্রণাম করত আমাকে। তারপর একটুখানি বসে গান ধরত—’আলোকের পূর্ণ ছবি আর কতদিন রবে দূরে। আজ কিশোরী কোথায় জানি না, তবে তার সঙ্গে দেখা হতেও পারে একদিন।‘ কারণ কিশোরীই বলেছিল আমাকে—’বাবু, বাংলাদেশের যেখানেই থাকেন না কেন, এই কিশোরীর সঙ্গে আপনাদের দেখা হবেই।‘
কলকাতার বর্ষা দেখে আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের বর্ষার রূপ মনে পড়ে। ডোবা নালা সব জলে টইটম্বুর। পুকুরের পাড় ভেঙে ছুটছে জলের স্রোত–সেই স্রোতের একপাশে বঁড়শি নিয়ে মাছ শিকারে ওত পেতে আমি বসে। শোঁ শোঁ শব্দে জল যাচ্ছে মাঠের ওপর দিয়ে। আজ মনে হয় সেই অশ্রান্ত বাঁধভাঙা জলের কল্লোলধ্বনি আর কিছুই নয়, বিপর্যস্ত মানুষের হাহাকার যেন–জলস্রোতের শিহরন আজকে আমার মনে জনস্রোতের বিহ্বলতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ঘরছাড়া মন জলস্রোতের সঙ্গে জনস্রোতের সাদৃশ্য কী করে খুঁজে পেল জানি না। জল ঝরে পড়ার শব্দে শিশুমন যেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত, আজকে কেন জানি না হৃদয়তন্ত্রীতে সেই শব্দ ব্যথার রেশ লাগায়। হয়তো ব্যথাতুর মন প্রকৃতির মধ্যে বেদনাবিধুর আবেশটিকেই গ্রহণ করে। মেঘের খেয়ায় খেয়ায় মন উদাসী।
বর্ষার জলে মাঠ থই থই করছে, পাটগাছগুলো কাটা হয়ে গেলেও ধানগাছগুলো খাদ্যভারে বাতাসে দোল খাচ্ছে জলস্রাতের মুখে। জলের মধ্যে মাথা তুলে রয়েছে একটা কদম গাছ ফুলসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে। পাতার গা বেয়ে জল ঝরছে টিপ টিপ শব্দে। সামান্য শব্দ সামান্য দৃশ্য যে মনকে এতখানি ভাবিয়ে তুলতে পারে কোনোদিন তা দুঃখ না পেলে বুঝতে পারতাম না। মনকে উৎসুক, উদগ্র করেছে সংকট–আজ বুঝতে পারছি সংকট না এলে ইতিহাস সৃষ্টি হয় না। কিন্তু প্রাণঘাতী এ ইতিহাস আমাদের জীবনকে মূলধন করে না গড়লে কী ক্ষতি হত ভবিষ্যতের?
জীবনকে ঘিরে রয়েছে দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন। রাত্রিকে পাড়ি দেওয়ার শক্তি কোথায় পাব? প্রতি বাস্তুহারার চোখের জল যেন অশান্ত পদ্মার উন্মত্ততার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অহরহ। যাদের ছিল ঘর তারা আজ মুক্ত আচ্ছাদনহীন বিস্তৃত ভূমিতে নিরালম্ব হয়ে রাতের পর রাত কাটাচ্ছে। এক প্রদেশ থেকে এক এক দলকে বিতাড়িত করা হচ্ছে অন্য প্রদেশে। ভয় হয় এ ধরনের বিতাড়নে ক্ষয়িষ্ণু বাঙালি ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের থিসিসের খোরাক হয়ে দাঁড়াবে না তো শেষে? যাযাবর জাতিরা মাটিকে কেন্দ্র করে তবেই সভ্য হয়েছিল একদিন, আর আমরা মাটিকে হারিয়ে হলাম যাযাবর।
.
আনরাবাদ
দেশের কথা নির্জন জীবনে আজ নানাভাবে বেশি করে মনে পড়ছে। মনের ছায়াতলে বিনা ভাষায় বিনা আশায় আমার ছোট্ট নিরালা গ্রামখানি বার বার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পরমুহূর্তে যাচ্ছে মিলিয়ে। দেশজননীর কথা, জন্মভূমির কথার অর্থই হল অজান্তে নিজের কথা। শিশু শুধু নামের নেশাতেই ডাকে, সে যে কথা বলতে শিখেছে এটাই সেখানে বড়ো কথা। সেইরকম আমার গ্রামের কথা বলাও একটা সুখস্মৃতি। আজ প্রাকৃতিক সুষমামন্ডিত আমার সেই ছোটো গ্রামখানিই মনের মণিকোঠায় পূর্ণতা লাভ করেছে।
বসন্তের প্রতীক কচি কিশলয়, ফোঁটা মুকুলের মিষ্টি গন্ধ, লতাগুল্মের ছায়ায় বসা দোয়েল শ্যামার ডাক মনকে কেন জানি না লোভার্ত করে তুলছে এই ইটকাঠ-ঘেরা অকরুণ মহানগরীর কারাগারের মাঝখানে। এখানে রাত্রির কোনো মনোহারিণী রূপ নেই, রাতের কলকাতা ভয়ংকরতারই প্রতীক! কিন্তু আমার সেই ছেড়ে-আসা গ্রামের অন্ধকারের রূপও চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ঝিল্লিমুখরিত অন্ধকার রাত্রে শেয়ালের ডাক এক নিমেষেই চমৎকার একটি গ্রাম্য পরিবেশ সৃষ্টি করে তোলে। একথা বুঝতে পারছি অনেক দূরে এসে এবং চিরতরে গ্রামকে প্রণাম করে আসার পর। নগরজীবন বনাম গ্রামজীবন সম্বন্ধে শৈশবে একবার আমাদের মাস্টারমশাই রচনা লিখতে দিয়েছিলেন। স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিন আমি নগরের রূপটির বাইরের চাকচিক্য দেখে তার দিকেই ভোট দিয়েছিলাম। আজ আক্ষেপ হয় গ্রামকে সেদিন অবহেলা করেছি বলে, গ্রামকে সেদিন চিনিনি বলে! শৈশবের সেই বোকামির জন্যে দূর থেকে পরবাসীর মতই ভক্তিভরে তাকে প্রণাম জানিয়েছি এই বলে—’ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।‘
ঢাকা জেলার কুখ্যাত রায়পুরা থানার অন্তর্গত আনরাবাদ আমার গ্রাম। গ্রাম হিসেবে ইতিহাসবর্জিত, অখ্যাত, অজ্ঞাত হয়তো অন্যের কাছে। কিন্তু তবু সে যে আমার আরাধ্য জন্মভূমি! মাইল তিনেক দূরে মেঘনা, একমাইল দূরে রেল স্টেশন, দু-মাইল দূরে থানা আর ষাট মাইল দূরে কাছারিবাড়ি। আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, বাঁশ, বেত আর বর্ণালি গাছের ছায়াঘেরা আনরাবাদ নিস্তব্ধ। কোলাহলমুখর জীবন থেকে মুক্তি চাইলে আনরাবাদ আজকের বিংশ শতাব্দীর কেজো মানুষদের শান্তিময় পরিবেশের সন্ধান দিতে পারে।
আমাদের গ্রামে বাস করতেন অনেক বড়ো বড়ো পন্ডিত। বিদ্যারত্ন, বিদ্যাভূষণ, বিদ্যালংকার, স্মৃতিতীর্থের তীর্থভূমি বললেও এ গ্রামকে বাড়িয়ে বলা হয় না। দূর-দূরান্তর থেকে লোক আসত এই গ্রামের পন্ডিতসমাজের কাছে বিধান নিতে; তাঁদের মুখের কথাকে। আমরা বেদবাক্য মনে করতাম। টোল ছিল অনেকগুলো, ছোটোবেলায় দেখেছি সেখানে বহু বিদ্যার্থী আসত বিদ্যার্জনে। প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের আশ্রমের কথা শুনেছিলাম ঠাকুরমার মুখে, এগুলো দেখে সেই আশ্রম-স্মৃতি যেন চোখের সামনে উঠত ভেসে।
গ্রামবাসীর প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত অল্প, তা ছাড়া, মালিন্য যারা আনে তেমনি সব বড়ো বড় প্রতিষ্ঠান আমাদের গ্রাম থেকে দূরে থাকায় মিথ্যে গোলমালের হাত থেকে আমরা একরকম মুক্তি পেয়েছিলাম। থানা-পুলিশের দূরত্ব, কোর্ট-কাছারির দূরত্ব একটু বেশি হলেও শান্তিভঙ্গ কোনোদিন হয়নি। সেই শান্তি-শৃঙ্খলার কোনো বালাই আজ আর নেই সেখানে। তবু আজও মরুভূমির মধ্যে আমার গ্রামটি দাঁড়িয়ে আছে ওয়েসিসের মতো।
পাকিস্তান হবার কিছুদিন পরে দেখে এসেছি আমার গ্রামকে–মায়ের আমার সে রূপ গেল কোথায়? অশ্রু রোধ করতে পারিনি তাঁর হতশ্রী দেখে। ঝাড়ের বাঁশ বাড়ি ফেলেছে ঘিরে, যে আঙিনায় বারো মাস থাকত আলপনার ছাপ সে ছাপ কবে মুছে গেছে। আঙিনায় গজিয়েছে মানুষ-সমান বুনোঘাস। ঘরদোর খাড়া রয়েছে বটে, কিন্তু সমস্তই শ্রীহীন– প্রেতপুরীর মতো ভয়াবহ হয়ে উঠছে সমস্ত গ্রামটি! বিষাদবিধুর নিস্তব্ধতা শ্বাসরোধ করে তুলছিল আমার। আমার দেশজননীর এমন রূপ কোনোদিন দেখব তা স্বপ্নেও ভাবি নি। এখন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নিশাচর শ্বাপদ এবং দ্বিপদের অভিযান। কোনো উপায় যাদের নেই তারা সেইসব অত্যাচার সহ্য করে আজও মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে সে গাঁয়ে। প্রকৃতির শ্যামচিক্কণ আঁচল দিয়ে যে গ্রাম ছিল ঢাকা তার এ ধরনের শান্তিভঙ্গ যারা করেছে তাদের কি প্রকৃতিদেবী কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেন?
সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর আমি জননীর অঞ্চলতলে ছিলাম নির্বিঘ্নে নির্ভাবনায়। তাই বুঝিনি গ্রামের শান্তি, জননীর স্নেহ কতখানি নিবিড় হতে পারে। বিগত জীবনে সুখে-দুঃখে বিপদে-সম্পদে মায়ের যে অভয়বাণী অথবা স্নেহ-সুনিবিড় শীতল ছায়ার আস্বাদ পেয়েছি তা আজ একসঙ্গে ভেসে এসে বিষাদখিন্ন মনকে শৈশব-কৈশোর-যৌবনের পরমানন্দ রূপটি মনে করিয়ে দিয়ে অসহ্য ব্যথায় হৃদয়তন্ত্রীকে বিকল করে দিচ্ছে যেন। আজ সেদিনের স্মৃতিকে স্পর্শ করতে যাওয়াকেও আমার পক্ষে দোষাবহ মনে হচ্ছে। যেখানে চল্লিশ বছর কাটিয়েছি, যেখানকার বাতাস আমার জীবন বাঁচিয়েছে, যে গ্রামের রূপ দেখে জ্যোৎস্নারাত্রে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছি এক একদিন, যেখানকার বাসিন্দাদের গলা জড়িয়ে ধরে পরস্পরের সুখে-দুঃখে হেসেছি, অশ্রু বিসর্জন করেছি, লজ্জার কথা, সেখানে আমি অনাত্মীয় আজ–নিজের মায়ের ওপর কোনো স্নেহের দাবিই নেই আমার, আইনের চোখে আমরা আজ বিদেশি! দেশে যেতে গেলেও চাই পাসপোর্ট, চাই ভিসা। এরকম লজ্জা বিশ্বের অন্য কোনো জাতি এত নিবিড় করে অনুভব করেনি বোধ হয়।
আজও নিয়মিতভাবেই আসে দুপুর, কিন্তু দেশের মতো ছুটে আমবাগানে গিয়ে দুপুরটা কাটাতে পারি না। গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহর আমাদের কাছে ছিল অত্যন্ত লোভনীয়–সকাল থেকে নুন-লঙ্কা গুঁড়িয়ে কাগজে জড়িয়ে রাখার ইতিবৃত্ত মনে করলে চোখটা সজল হয়ে ওঠে আজও। মা-বাবার তন্দ্রা আসার সঙ্গে সঙ্গেই সন্তর্পণে খিড়কি খুলে বাগানে পালানো বইপত্র ফেলে, তার তুলনা কোথায়! ছোটো বোনকে পরিবেশ-পরীক্ষক হিসেবে রেখে পালাতাম আমের লোভ দেখিয়ে-বেচারি ঠায় বসে থাকত গুরুজনদের মুখের দিকে তাকিয়ে, তাঁদের কারুর তন্দ্রা ভাঙবার আগেই সে ছুটে গিয়ে খবর দিত চুপিচুপি–আর আমিও ঠিক আগের মতোই আবার শান্তশিষ্ট ছেলের মতো অখন্ড মনোযোগ দিয়ে বিদ্যাভাসে লেগে যেতাম! বই খাতার নীচে থাকত আমের কুচি। নুন-লঙ্কা সহযোগে যথা সময়ে সেগুলোর সদব্যবহারও আমার পক্ষে ছিল একটা কর্তব্যকাজ! এই ধরনের ফাঁকি দেওয়া অবশ্য রোজ সমান চাতুর্যের সঙ্গে সম্ভব হত না। কোনো কোনো দিন বোনটির অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে রেখে যাওয়ার ফলে বিপদে পড়তে হত। সে দুষ্টুমি করে খবরই দিত না আর সেদিন। আমরা তো অকুতোভয়ে বৃক্ষ থেকে বৃক্ষান্তরে ফলাহারে উন্মত্ত হয়ে উঠতাম সময়ের দিকে না তাকিয়েই! অবসাদ এলে বা পেট ভরতি হয়ে গেলে গাছ থেকে নীচে নেমে দেখতাম সন্ধের আর বেশি দেরি নেই! সেদিন কপালে চড়-চাপড় যে পরিমাণ জুটত তার কথা আর নাই বা বললাম।
সন্ধেবেলায় ব্রাহ্মণপাড়ায় কাঁসর ঘণ্টা বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে হাজির হতাম প্রসাদ পাওয়ার লোভে। সেদিনের সে উৎসাহ-উদ্দীপনা আজ যদি কিছুটাও অবশিষ্ট থাকত তাহলে মনে হয় এতখানি মিইয়ে পড়তাম না দুঃখের ভারে। লাঞ্ছনা-অপমান পেয়ে পেয়ে মনের অপমৃত্যু ঘটেছে–সৌন্দর্যের মৃত্যু মানেই মানুষের মৃত্যু। যদি বাঁচতে হয় এগুলোকে আবার জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন, কিন্তু যা প্রয়োজন এবং যা করা কর্তব্য তা সব সময় আমরা করি কোথায়? বাসস্থান, চাকুরিসংস্থান, দৈনন্দিন অনটনের ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে কি আমাদের ভবিষ্যৎ তলিয়ে যাবে?
এ কি জীবন না জীবনের অভিনয়? এ প্রসঙ্গে হঠাৎ মনে পড়ে যায়, গ্রীষ্মকালে আমাদের থিয়েটার হত প্রতিবছর মহা ধুমধামের সঙ্গে। গ্রীষ্মবকাশের দিনগুলোকে স্মরণযোগ্য করার উদ্দেশ্যেই হত অভিনয়ের ব্যবস্থা। সচরাচর আমরা অভিনয় করতাম পৌরাণিক নাটক। নরমেধযজ্ঞ, বিল্বমঙ্গল, বনবীর, সগরযজ্ঞ, চন্দ্রগুপ্ত ইত্যাদির অভিনয় একদা মাতিয়ে তুলত সমগ্র গ্রামখানিকে। সবচেয়ে বড়ো কথা এই যে, এর মূল অভিনেতারা প্রায় সবাই ছিলেন গুরুজনস্থানীয়! বাবা, মামা, মেসো, পিসে, দাদা, ভাই সবাই মিলে পার্ট মুখস্থ করেছি সারা দিনরাত ধরে–একে ওকে হঠাৎ মাঝখান থেকে খানিকটা দরাজ গলায় অভিনয়াংশ শুনিয়ে দেওয়াটা অত্যন্ত মজার ব্যাপার ছিল। এতটুকু আবিলতা ছিল না তার মধ্যে। বাবাকেই হয়তো আমি অভিনয়ের ঘোরে এক ফাঁকে কখন বলে ফেলেছি–দেখো সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ। বাবা শুনে মুচকি হেসেছেন। তাঁর ছেলে রাতারাতি যে আলেকজাণ্ডার বনে গেছে সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি তাঁর। কিন্তু উজ্জ্বল সেই দিনগুলোর ওপর কালবৈশাখীর ঝড় এল কেন? মনের আনন্দে মিলে-মিশে কাজ করতাম, তার বিপক্ষে সুনিপুণ করে জাল পাতল কোন হৃদয়হীন ব্যাধ?
গ্রীষ্মের পরই শুরু হত বর্ষা। কাজলকালো মেঘমেদুর বর্ষা গ্রামটিকে থমথমে করে দিত একনিমেষে। টিপটিপ ইলশে গুঁড়ি থেকে ঝমঝম ধারার মুষলবৃষ্টি সবই লক্ষ করতাম সেই ছোটোবেলায় জানালায় বসে বসে। মাঠ-ঘাট জলে থই থই করত, কৃষকেরা ভিজতে ভিজতে কাজ করে আর গান ধরে মনের খুশিতে। শ্রাবণ দিনে চাষবাস আর রাত্রে মনসার পুথি পড়াই তাদের দৈনদিন কাজ। বানান করে করে অপটু পড়য়ার মতো পুথি পড়লেও তাতে আনন্দ পায় তারা বেশ–সেই সঙ্গে আনন্দ বিতরণও করে পড়শি ভক্তদের মনে। শ্রাবণ মাসের শেষদিনে লখিন্দর উপাখ্যান শেষ করে তারা পদ্মাপুরাণ জড়িয়ে উঠিয়ে রাখে চাঙে।
আজ মনে পড়ে কৃষ্ণকিশোর কীর্তনীয়াকে। বড় ভালো কীর্তন গান করত, সে ছিল গ্রামের প্রাণস্বরূপ। তার পালা-কীর্তনে মুগ্ধ হত না এমন লোক দেখিনি। সুললিত কণ্ঠস্বরে তাল-মান বজায় রেখে অকৃত্রিম ভক্তিভরে চোখ বুজে সে কীর্তন ধরত যখন,
ঘরে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া প্রবোধ দিব কেমনে
বুঝাইলেও বুঝ মানে না নিমাই চান্দ বিনে–
যেমন তৈলবিনে বাতি জ্বলে না,
প্রাণ বাঁচে না জল বিনে।
অথবা
শুয়েছে গো বিষ্ণুপ্রিয়া–
কালঘুমেতে অচেতন
মায়া-নিদ্রা তৈজে নিমাই হল সন্ন্যাসে গমন
আমি বিদায় হলাম, ওগো প্রিয়ে দেখে যাও
জনমের মতন।
তখন অতিবড়ো পাষন্ডেরও চোখে জল দেখেছি। কৃষ্ণকিশোরের গলা আজও মাঝে মাঝে ভেসে আসে বাতাসে, অনেক রাত্রে ধড়মড় করে উঠে বসি মনের ভুলে, কানে বাজে, সেই কৃষ্ণকিশোর যেন সতর্ক করার জন্যে গান ধরেছে—’বিদায় হলাম, ওগো প্রিয়ে দেখে যাও জনমের মতন!’ সত্যি বিদায় হয়েছি জন্মের মতো, কিন্তু সন্ন্যাস নিয়ে নয়, অপরাধীর চরম দন্ড দ্বীপান্তর গ্রহণ করে।
এই বিষাদময় দুঃখের মধ্যেও আনন্দের দিনগুলোকে বাদ দিতে মন সরে না। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত আমাদের গ্রামে। শারদোৎসবই হত সবচেয়ে ধুমধামের সঙ্গে। মেঘমুক্ত আকাশ-বাড়ির প্রাঙ্গণে শিউলি ফুলের বন্যা, স্থলপদ্ম, জলপদ্মের সমারোহে মন থাকত এমনিতেই খুশি। মাঠে মাঠে ধানের শিশিরভেজা সোঁদা সোঁদা গন্ধে অনির্বচনীয় মনে হত আনন্দোচ্ছাসকে। শারদীয়ার আগের আর একটা দুষ্টুমির অনুষ্ঠানের কথাও বাদ দেওয়া চলে না। সেটা হল নষ্টচন্দ্র! ভাদ্রের শুক্লা চতুর্থীর রাত্রে এই নষ্টচন্দ্রের কোপে কত গৃহস্থ যে ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন তার হিসেব নেই। রাত্রে কত যে চুরি গেছে গৃহস্থের মিষ্টি কুমড়ড়া, শসা, জাম্বুরা (বাতাবিলেবু) আর আখ তা ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা মনে মনে হয়তো একটা হিসেব করে নিতে পারবেন! একে চুরি বললে ভুল করা হবে। গাছের জিনিস ভাগ করে রেখে দেওয়া হত সকলের দরজাগোড়ায়। সকালে উঠে এসব দেখে কেউ বড়ো একটা আশ্চর্য হত না, শুধু যাদের বাগান থেকে ফল খোয়া গেছে তারাই পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের উপলক্ষ করে সামান্য গালিগালাজ করত মনের দুঃখে! সে গালাগালও আজকের বাস্তব গালাগালের চেয়ে মিষ্টি ছিল ঢের। তার ভেতর খানিকটা স্নেহের আমেজও মেশানো থাকত, কেননা অনেকক্ষেত্রে বাড়ির দু-একটি ছেলেও যে সে চুরিতে যুক্ত থাকত।
আর একটা ভোজের মওকা জুটত ভাইফোঁটা উৎসবে। সে আর এক বিরাট ব্যাপার! গ্রাম সম্পর্কে বোন হলেও অনেকেই ফোঁটা দেবার অধিকারী। ফোঁটা নিতেই হবে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে। ফোঁটায় ফোঁটায় সেদিন কপালের অবস্থা হত সঙিন,–একইঞ্চি ‘লেয়ার’ পড়ে যেত পুরু কাজলের আর চন্দনের। বাড়ি ফিরতাম চন্দনচর্চিত বনমালীর ‘পোজে’-নড়তে চড়তেও বড়ো কষ্ট হত সারাক্ষণ ভালোমন্দ খেয়ে খেয়ে। বাঙালি ভাই-বোনের প্রীতি-বন্ধনের সে কী মধুময় স্মৃতি। ভাইয়ের দীর্ঘ-জীবন কামনায় বোনেদের কী সে আকুল আন্তরিকতা! ভাইদের কপালে কাজল-চন্দনের ফোঁটা দিতে দিতে বোনেরা ছড়া কেটে বলত,
প্রতিপদে দিয়া ফোঁটা,
দ্বিতীয়ায় দিয়া নিতা;
যমুনা দেয় যমেরে ফোঁটা
আমরা দেই আমাদের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা।
আজ অবধি ভাইয়ের আমার যম দুয়ারে কাঁটা!
ঢাক বাজে ঢোল বাজে আরো বাজে কাড়া,
যাইয়ো না যাইয়ো না ভাইরে যমেরি পাড়া।
আজ অবধি ভাইয়ের আমার যম দুয়ারে কাঁটা!
পূর্ববাংলার ঢাকা জেলার প্রায় সর্বত্রই ভাইফোঁটার উৎসব চলত দু-দিন ধরে। প্রতিপদে দেওয়া হত ফোঁটা, আর দ্বিতীয়ায় বোনের দেওয়া প্রীতিভোজ। ভাইদের যমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে যে বোনেরা আজন্ম এমনি করে প্রার্থনা জানিয়ে এসেছে বছর বছর, তাদের সেই অকৃত্রিম প্রীতির বিনিময়ে কী করেছি আমরা তাদের জন্যে? দুবৃত্তদের হাত থেকে বোনেদের মান-মর্যাদাটুকু পর্যন্ত রক্ষা করতে পারিনি! ভগিনীর সম্মান আমাদের প্রাণের চেয়েও যে অনেক বড়ো, একথা বিস্মৃত হয়েছিল আত্মবিস্মৃত বাঙালি। তাই তো আজকের এই লাঞ্ছনা!
এরপর থেকেই একনাগাড়ে চলল উৎসব। শীতে কড়কড়ে ভাত, সরপড়া ব্যাঞ্জন আর পিঠে-পায়েসের সমারোহ। পৌষ-সংক্রান্তি, মহা-বিষুব সংক্রান্তি। বাস্তু পুজোর ধুম। হাজার বছরের পূজিত বাস্তু আজ যে এমনিভাবে ত্যাগ করে আসতে হবে তা কে জানত? হায় বাস্তুদেব, অদৃষ্টের কী পরিহাস, তুমিও আমাদের রাখতে পারলে না! মাঘের প্রচন্ড শীতে অনূঢ়া মেয়ের দল সূর্যোদয়ের পূর্বে পুকুরে স্নান করে দুর্বাদল মুঠো করে ধরে আবাহন জানাত প্রাণের প্রতীক সূর্যদেবকে,
উঠো, উঠো সূর্যঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া…
উঠিতে না পারি হিমালয়ের লাগিয়া,
হিমালয়ের পঞ্চকন্যা সূর্যে করল বিয়া–
লও লও সূর্যঠাকুর লও ফুল পানি!…ইত্যাদি।
এই যে কৌমার্যব্রত, এই যে কৃচ্ছসাধন, এই কি তার সফল প্রতিদান? এখানেই শেষ নয়। এরপর চলত উদিত সূর্যের আরাধনা। গোময় প্রলেপিত আঙিনায় ইটের গুঁড়ো, বেলপাতার গুঁড়ো, চালের গুঁড়ো, আবির হলুদের গুঁড়ো, তুষের গুঁড়ো দিয়ে কত বিচিত্র চিত্রাঙ্কন হত বাড়ির উঠানে। মাসান্তে ব্ৰত সাঙ্গ হলে কুমারীরা গ্রামের বিশিষ্ট লোকেদের খাওয়াত নিমন্ত্রণ করে। এই মাঘমন্ডল ব্রত পুর্ববাংলার পল্লিজীবনের এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। এমনি ভুলে-যাওয়া ব্ৰত যে কত ছিল আমাদের গাঁয়ে তার ইয়ত্তা নেই।
গোটা চৈত্র মাসটা ঢাকের বাজনায় মুখরিত থাকত। গ্রামের সব যুবকরা আর প্রৌঢ়রা সন্ন্যাসী সেজে নামত গাজনে। কী কঠোর ছিল সেই ব্রহ্মচর্য! এতে কোনো জাতিভেদের বালাই থাকত না। উচ্চনীচ সবাই একসঙ্গে পূতচিত্তে গুরু-সন্ন্যাসীর অনুশাসন মেনে চলত। ঢাক-পাট নিয়ে তারা গান গাইত মহাখুশিতে–অনেক সময় নিজেরাই বাদক, নিজেরাই গায়ক। শেষের দিকে রাত্রে ‘কালীকাছ’ অনুষ্ঠানটি ছিল বড়ো মজার। কেউ একজন অবিকল মা কালীর সাজে সজ্জিত হয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরত বাজনার তালে তালে। সঙ্গে সঙ্গে চলত দলবল। ঘুমন্ত চোখে ছেলে-মেয়েরা জেগে উঠে সময় সময় ভয়ে শিউরে উঠেছে। চিৎকার করে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে মায়ের আঁচলের তলায়। শেষ দিন হরগৌরীর যুগল মূর্তি গৃহস্থের দুয়ারে দুয়ারে কল্যাণ কামনা করত। রাত্রে হত ব্রহ্মচর্যের কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। নিজের চোখে দেখেছি দশ-বারো হাত দীর্ঘ জ্বলন্ত অগ্নিচুল্লির মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসীরা অবলীলাক্রমে পার হয়ে চলে যেত। সুতীক্ষ খাঁড়ার ওপর উঠে নৃত্য করত হাসিমুখে!
পার্লামেন্ট সভ্যদের মধ্যে লজ্জাকর গালাগালি আর কাদা ছিটানো দেখে মনে পড়ে যায় আমাদের গ্রামের সেই বকুল গাছ-তলার কথা। ওইখানে জমত পার্লামেন্ট! আলোচনা, সমালোচনা, বিচার, বিধান প্রভৃতি সব কিছুরই নিষ্পত্তি হত বকুলতলায়। আমাদের গ্রামে কোনোকালেই পুলিশ আসেনি। এখানকার লোককে কোনোদিন আইন-আদালত কেউ দেখেনি করতে। তারা ছিল নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, শাস্ত্রানুশীলনে রত। মেয়েরা ছিল ব্রত-পূজা পার্বণ নিয়ে ব্যস্ত। অশান্তি দেখিনি গ্রামের কোথাও।
আজ আমরা সবাই গ্রামছাড়া। বকুলতলায় বয়োবৃদ্ধদের মুখে শুনেছি, পূর্বে নদী ছিল এ অঞ্চলটায়। কালক্রমে চরা পড়ে পড়ে এবং মুসলমান আমলে ধীরে ধীরে বসতি হতে হতে গড়ে উঠল এই গ্রাম। আনোয়ার খাঁ বলে কে একজন প্রথম এই জায়গাটি আবাদ করে বলে তারই নাম অনুসারে নাকি গ্রামের নাম হয় আনোয়ারাবাদ বা আনরাবাদ। গ্রামের চতুষ্পর্শেই হিন্দু। একসঙ্গে এত হিন্দু খুব কম জায়গাতেই আছে। কিন্তু কালের গতি চিরকালই কুটিল। গ্রামের চারিদিক কানা বিল, ঘাগটিয়া বিল, গজারিয়া বিল, মহিষা বিল, দিলি বিল, রাজুখালি বিল ও ইনাম বিল দিয়ে ঘেরা। মনে হয় এই সপ্তবিল দিয়ে পরিবেষ্টিত করে প্রকৃতিদেবী শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্যেই আনরাবাদ তৈরি করেছিলেন। দুর্গের মতো চারধারে পরিখা অতিক্রম করে শত্রুর আক্রমণ সত্যিই ছিল এক অসাধ্য ব্যাপার। জানি না আবার আমরা পরিখা পেরিয়ে নিজের বাস্তুভিটেয় স্থান পাব কি না। আর কি কোনোদিন দুই বাংলা এক হয়ে আনন্দোৎসবে মাতবে না! কিপলিঙের ‘East is East and West is West কথাগুলোকে মিথ্যে প্রমাণিত করে আমরা কি জাতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ কোনোদিন আর দিতে পারব না? হিন্দু-মুসলমান আবার আগের মতো নির্ভয়ে মনের সুখে পরস্পরের হাত ধরে বেড়াতে পারবে না, সে-কথা আমি বিশ্বাস করতে পারি না!
.
শুভাঢ্যা
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!
দৈন্যের দায়ে বেচে আসিনি, প্রাণের মায়ায় ছেড়ে এসেছি আমরা আমাদের সোনার মাকে। কবিগুরুর লক্ষ্মীছাড়া তিরস্কার আমাদের পক্ষে যথেষ্ট নয় জানি, কিন্তু যে ব্যবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে এমনি লক্ষ্মীছাড়া, গৃহহারা হতে হল সে ব্যবস্থার অধিকারীদের বিচারকর্তা কতকাল ঘুমিয়ে থাকবেন? এতগুলো অসহায় মানুষের আর্ত ক্রন্দনে বিশ্ব বিচারকের আসন কি টলে উঠবে না? যদি না ওঠে তাহলে তাঁর অস্তিত্ব নিয়েই যে প্রশ্ন। উঠবে!
কতটুকুই বা তার আয়তন। দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে মাইলখানেক আর মাইল-দেড়েক মাত্র হবে হয়তো। কিন্তু দশ দশ হাজার লোকের ঘন বসতি ছিল একদা এ গ্রামে। ঢাকা শহরের দক্ষিণ তীরে বাবুর বাজার ও কালীগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে শুরু করে একটা পথ জিঞ্জিরা গ্রামের গোরস্থানের পাশ দিয়ে এবং আর একটি পথ শুভাঢ্যা খাল ঘিরে তার পশ্চিম তীর দিয়ে শ্রীশ্রীগোপীনাথ জিউর আখড়ার নিকট এসে মিলিত হয়েছে। ঢাকা থেকে আসতে হলে এ আখড়া হয়েই আসতে হয় আমাদের গ্রামে। শুভাঢ্যা ছিল হিন্দুপ্রধান গ্রাম।
বাংলার এককালীন বিখ্যাত মল্লবীর স্বর্গত পরেশনাথ ঘোষের (ঢাকার পার্শ্বনাথ) জন্মভূমি, তাঁর শৈশব ও যৌবনের লীলাক্ষেত্র শুভাঢ্যা। এ গ্রাম ক্ষাত্রশক্তির জন্যে চিরকালই ছিল প্রসিদ্ধ। কিন্তু সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার কাছে সে ক্ষাত্রশক্তির পরাক্রম যে অতিসহজেই পরাভব মেনে নিল। এ পরাজয়ের কলঙ্ক আমাদের ভবিষ্যৎ পুরুষ কি মোচন করতে পারবে না কোনোদিন? না তারা শুধু অভিশাপই দেবে তাদের পূর্বপুরুষদের?
নামকরা শিক্ষাবিদ ডা. প্রসন্নকুমার রায় ও কলকাতার এককালের প্রসিদ্ধ ডাক্তার দ্বারকানাথ রায় এ গাঁয়েই হয়েছিলেন ভূমিষ্ঠ। তখনকার দিনে সমগ্র বিক্রমপুর ও নিকটবর্তী অঞ্চলের নৈয়ায়িক পন্ডিত কৃষ্ণচন্দ্র সার্বভৌম এ গাঁয়েরই এক পর্ণকুটিরে বাস করতেন; টোলে সংস্কৃত শাস্ত্র শিক্ষা দিতেন তাঁর ছাত্রদের। তাঁদের স্মৃতিপূত আমার পল্লিজননীকে চোখের জলে বিদায় দিয়ে এসে আমরা আজও বেঁচে আছি। কিন্তু এ বাঁচা যে মরার চেয়েও করুণ, তার চেয়েও বেদনাদায়ক।
কিন্তু চরম আঘাতে ভেঙে পড়লেও, চূড়ান্ত দুঃখের মধ্যে আজও সগৌরবে স্মরণ করি আমার গ্রামের নওজোয়ানদের আর তাদের অভিভাবকদের। বিদেশি চক্রান্তে বার বার ঢাকায় শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর সেই উন্মত্ততা পার্শ্ববর্তী পল্লির শান্ত পরিবেশে করেছে অশান্তি উদগিরণ। আমার গাঁয়ের ওপরও তেমনি হামলা করার উদ্যোগ হয়েছে কয়েকবার। গোপীনাথ জিউর আখড়া অবধি এগিয়ে এসেছে উন্নত্ত জনতা–কিন্তু তার বেশি আর নয়। শুভাঢ্যার শুভবুদ্ধি তার সমগ্র সত্তা ও শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে আর আক্রমণকারী দলের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে গেছে প্রতিবার সেই সম্মিলিত প্রতিরোধের সামনে।
সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে পুড়ে। ‘৪৬ সাল। মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর তান্ডবলীলা চলছে কলকাতায়, ঢাকায়, প্রায় সারাবাংলা জুড়ে। বাইরে থেকে শুভাঢ্যার দিকেও এগিয়ে এল মারমুখো হয়ে একদল হাঙ্গামাকারী-সাম্প্রদায়িক ধ্বনি তাদের সুউচ্চ কণ্ঠে, সশস্ত্র তাদের বাহু। কিন্তু সুবিধা হল না। অল্প সময়ের মধ্যেই টের পেল তারা যে, এ বড়ো কঠিন ঠাঁই। দুর্জয় প্রতিরোধে স্তব্ধ হল সমস্ত কলরব, ব্যর্থ হল দূবৃত্তদলের অশুভ প্রবৃত্তি। শুভাঢ্যার জাগ্রত তারুণ্য সেবার শুধু তাদের আপন গ্রাম-জননীকেই রক্ষা করেনি, তাদের ঐক্যবোধ ও সাহসিকতায় রক্ষা পেয়েছে আশপাশের অন্যান্য পল্লিঅঞ্চলও। তবে তার জন্যে দক্ষিণাও বড়ো কম দিতে হয়নি শুভাঢ্যাকে। লিগ সরকারের পুলিশি গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে আমার গাঁয়ের তিন তিনটি বীর জোয়ানকে। সেই গদাধর, ফুলচাঁদ আর ক্ষুদিরামের স্মৃতিতর্পণই কি করে চলেছি আমরা সব-হারানোর তপ্ত আঁখি-জলে? এ তর্পণের শেষ কি নেই?
আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের লীলাক্ষেত্র, পিতৃপুরুষের ভিটে ও অতিআদরের জন্মভূমি সেই শুভাঢ্যা গ্রামটি ছিল কত বিচিত্র! গোপীনাথ জিউর আখড়া থেকে শুরু করে যে দো-পায়া সড়কটা অনেকটা খাল ও নালা ডিঙিয়ে গাঁয়ের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে, তারই একটি শাখা আবার গাঁয়ের পশ্চিমাঞ্চল বেয়ে আঁকাবাঁকাভাবে পশ্চিমপাড়ার খেলার মাঠে মূল সড়কটার সঙ্গে এসে মিশেছে। উত্তরপাড়া, পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়ায় বিভক্ত ছিল আমাদের গ্রামটি। তার প্রত্যেকটি পাড়া ছিল আবার নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের পেশা অনুসারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে ভাগ করা। যেমন কামারহাটি, মাঝিহাটি, বৈদিকহাটি ইত্যাদি। পুজো-পার্বণ, খেলাধুলো, গান-বাজনা প্রভৃতি প্রত্যেক অনুষ্ঠান নিয়ে এ তিন পাড়ায় কত হইচই প্রতিদ্বন্দ্বিতাই না ছিল! পশ্চিমপাড়ার জনবল ও অর্থবল বরাবরই ছিল বেশি। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাকি দু-পাড়াকে হার মানিয়ে দিত তারা। উত্তরপাড়ার জনবল ছিল কম। তাই ওপাড়ার ছেলের দল খেলাধুলো ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিত পশ্চিমপাড়ার সঙ্গেই।
পদ্মা পার হয়ে চলে আসতে হয়েছে। কিন্তু ছেড়ে আসা গ্রামের সেই পুরোনো স্মৃতি কি বিস্মৃত হওয়া যায়? পুজোর দিন ঘনিয়ে আসতেই আমাদের মতো প্রবাসীদের মধ্যে দেশে যাবার কী ধুমই না পড়ে যেত। কাপড়চোপড়, অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র গোছগাছ করে অনেকদিন আগে থেকেই আফিস ছুটির প্রতীক্ষায় দিন গুনতাম। আর দেশে যাবার দিনটিতে গাঁয়ে ফেরার মহানন্দে ঢাকা মেলে সে কী ভিড়! জোর ঠেলাঠেলি–সবাই উঠতে চায় গাড়িতে একসঙ্গে–তর সয় না কারুর। দাঁড়িয়ে তল্পা নিয়ে সবাই চলেছে দেশের বাড়িতে বাদুড়ঝোলা হয়ে। ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে যে কতবার গোয়ালন্দ পর্যন্ত চলে গেছি, তার ঠিক নেই। মনের আনন্দে কখন যে সুর ভাঁজতে শুরু করে দিয়েছি ট্রেন চলার তালে তালে তা নিজেরই হয়তো খেয়াল নেই। কখনো হয়তো বা জেনেশুনে মতলব করেই গেয়ে ফেলেছি,
ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল
আপন ঘরে।
আমার গানে দোলা লেগেছে আর-সব ঘরমুখো যাত্রীদের মনে। কিন্তু আজ পরমুখো হয়ে যেভাবে ঘুরে মরছি আমরা দোরে দোরে তার অবসান কবে ঘটবে, কবে ফিরে পাব আমরা আমাদের জীবনের সেই হারানো সুরকে! আমাদের মতো প্রকান্ড একটা গ্রামের আট-দশখানা দুর্গা পুজোর মধ্যে কেবলমাত্র দু-খানা ছিল সর্বজনীন। ব্যক্তিগত পুজো অপেক্ষা এ দুটি পুজোই হত খুব ঘটা করে ও হইহুল্লোড়ের মধ্যে। ঢাকিদের ঢাক বাজনায় সারাগ্রাম মুখরিত হয়ে উঠত। দশহরার দিন বড়ো বড়ো পেটওয়ালা পাটের নৌকো ভাড়া করে প্রতিমা ভাসান হত। নৌকোগুলোকে নানাস্থান ঘুরিয়ে রাত্রিবেলা বুড়িগঙ্গার অপর পার–ঢাকা শহরের ‘বাকল্যাণ্ড বাঁধে’ ভিড়ানো হত। বিরাট এক মেলা বসত সেখানে এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই আসত প্রতিমা দর্শন করতে। মিঠাই-মন্ডা খেয়ে সারারাত জেগে প্রতিমা নিরঞ্জনের পর সবাই বাড়ি ফিরত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।
মনে পড়ে আমাদের পশ্চিমপাড়ার খেলার মাঠের কথা। পাঠ্যাবস্থায় গ্রীষ্মের লম্বা ছুটিতে ওইটুকুন চতুর্ভুজ মাঠে ফুটবল খেলার কী বিরাট ধুমই না পড়ে যেত! ওই মাঠেই অনুশীলন করে আমরা আশপাশের–এমনকী বিক্রমপুরস্থ দূর গ্রাম থেকেও কত শিল্ড-কাপ জয় করে নিয়ে এসেছি তার ঠিক নেই।
ছেড়ে-আসা গ্রামের আরও অনেক কিছুই আজ মনে পড়ে। মনে পড়ে, শীতের সময় শিবরাত্রির উৎসবের কথা। রাত্রি জাগরণের নামে সবাই যখন নির্জলা উপবাসে কাতর, আমরা তখন গাঁয়ের গৌর মুদি, আদিত্য ভট্ট আর শরৎ ভট্টদের খেজুর গাছের রস চুরি করে। খেতাম। শীতে ঠকঠক করে কাঁপত সবার শরীর। কিন্তু তাতে কী?
চৈত্র মাসে চড়ক পুজোর কথাও ভুলতে পারা যায় না। গাজন দলের লোকেরা বাড়ি বাড়ি কত সং দেখিয়ে বেড়াত, বেদে-বেদেনির নাচ নাচত। গাঁয়ের কবিয়ালরা চমৎকার নতুন নতুন গান বেঁধে তাদের সহায়তা করতেন। কুমাই মুদি আর ট্যানা সাধু প্রভৃতি সেসব জনপ্রিয় কবিয়ালরা আজ কোথায়?
আমি তখন একেবারেই ছোটো। পাঠশালার নীচের ক্লাসে পড়ি। আমাদের গাঁয়েরই এক বাড়িতে কবিগানের আসর বসেছে। আমিও তার একজন উৎসুক শ্রোতা। ওইটুকু বয়সে সে গানের অর্থ বোঝা দুরূহই ছিল আমার পক্ষে। তবু দু-পক্ষের কবির লড়াই যে খুবই উপভোগ করেছিলাম, সে-কথা আজও বেশ মনে পড়ছে। কী অস্বাভাবিক কবিত্বশক্তি দেখেছি সেকালের কবিয়ালদের। সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় উত্তর-প্রত্যুত্তর চলেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। কখনো চলেছে কেচ্ছা এবং পাল্টা কেচ্ছার তুফান আবার কখনো বা চলেছে ধর্মালোচনা। তার প্রায় সবটাই ছিল আমার উপলব্ধির বাইরে। তবু নেহাত হজুগে মেতে এবং কবিয়ালদের অদ্ভুত কবিত্বশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছি কবিগান শুনে। বড়ো হয়েও কবিগান শুনেছি নতুন নতুন দলের। সেসব গান বুঝেছি, তার অন্তর্নিহিত কথা উপলব্ধি করেছি। সখী-সংবাদের একটি গানের কয়েকটি পদ এখনও ভুলতে পারিনি। শ্যামের আগমন প্রতীক্ষায় সেজেগুজে প্রায় সারারাতই কাটিয়ে দিলেন বিনোদিনী রাধা। কৃষ্ণ যখন এলেন শ্ৰীমতীর কুঞ্জদ্বারে তখনকার পরিবেশ এবং তার প্রতিক্রিয়া কী নিখুঁতভাবেই না বর্ণনা করেছেন পুববাংলার কবিয়াল! দুই দলের বাদ-প্রতিবাদ ও হাস্যপরিহাস চলেছে অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু যখনি আরম্ভ হয়েছে তত্ত্বকথা বা অবতরণ করা হয়েছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের, তখনই সমগ্র জনতা হয়ে গেছে একবারে নীরব নিথর। কবি গেয়েছেন,
শ্যাম আসার আশা পেয়ে, সখিগণ সঙ্গে নিয়ে বিনোদিনী
যেমন চাতকিনী পিপাসায়, তৃষিতা জল আশায়
কুঞ্জ সাজায় তেমনি কমলিনী।।
সাজাল রাই ফুলের বাসর, আসবে বলে রসিক নাগর,
আশাতে হয় যামিনী ভোর, হিতে হল বিপরীত।
ফুলের শয্যা সব বিফল হল, অসময়ে চিকণ কালা এল–
রঙ্গদেবী তায় ধারণ করে দ্বারে গিয়ে।
এর পরেই সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে ধুয়া,
ফিরে যাও হে নাগর, প্যারী বিচ্ছেদে হয়ে কাতর
আছে ঘুমাইয়ে।
ফিরে যাও শ্যাম তোমার সম্মান নিয়ে।
এমনি ভাষায় কৃষ্ণকে সতর্ক করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি কবি। তিনি মুখের ওপর শ্যামকে আরও কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে তরুণী হত্যার দায়ে ফেলারও ভয় দেখিয়েছেন তিনি, বলেছেন শ্যামসুন্দরকে,
ছিলে কাল নিশীথে যার বাসরে।
বঁধু তারে কেন নিরাশ করে, নিশি শেষে এলে রসময়!
বঁধু প্রেমের অমন ধর্ম নয়।
তুমি জানতে পারো সব প্রত্যক্ষে, দুই প্রেমেতে যেজন দীক্ষে
এক নিশিতে প্রেমের পক্ষে, দুই-এর মন কি রক্ষা হয়।
প্যারী ভাগের প্রেম করবে না, রাগেতে প্রাণ রাখবে না,
এখন মরতে চায় যমুনায় প্রবেশিয়ে।
চাঁদোয়ার নীচে গাঁয়ের মাটিতে বসে এমনি সব কবিগান আর হয়তো শোনবার সুযোগ হবে না কোনোদিন!
‘চৈত্র-সংক্রান্তি’র আগের দিন হরগৌরী নৃত্য ও তার সঙ্গে নানাপ্রকার নাচগান হত। যখন ছোটো ছিলাম, স্কুলে পড়তাম–ওদের মতো আমরাও সং সেজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম –পয়সা সংগ্রহ করতাম। আর তার সদ্ব্যবহার করতাম চড়ক-পুজোর মেলায়। এ উপলক্ষে ‘চন্দ্রপিকারা’র মেলা কত নামকরাই না ছিল–দূর দূর গ্রাম থেকে কত লোকই না আসত এ মেলায়!
প্রখর গ্রীষ্মের ভীষণতা অসহ্য মনে হত। কিন্তু বর্ষাকালে আমাদের গাঁয়ের চেহারাই যেত পালটে। সমস্ত মাঠ, ঘাট, খেত-খামার জলে থই থই করতে থাকে বর্ষায়। দূর গাঁয়ের জলে ঘেরা পাড়গুলোকে ছোটো ছোটো দ্বীপ বলে ভুল হত। পায়ে-চলা পথ প্রায় সবটাই হয়ে যেত অদৃশ্য। নৌকোই তখন যাতায়াতের একমাত্র বাহন। ধান আর পাটগাছের সবুজ মাথার ওপর দিয়ে যখন মেঠো হাওয়া হুহু করে বয়ে যেত, সান্ধ্য পরিবেশে কী মনোরমই না লাগত সে দৃশ্য! বিকেলে নৌকো করে রোজ বেড়াতে যেতাম আমরা সে পরিবেশ, সে দৃশ্য উপভোগ করতে।
মনসা ভাসান উপলক্ষে শুভাঢ্যা খালের একপ্রান্তে হরির মঠ-সংলগ্ন বিরাট জলাভূমিতে ‘নৌকোবাইচ’ হত ও মেলা বসত। ছোটো-বড়ো সব ধরনের নৌকোই এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত সুসজ্জিত হয়ে। মাঝি ও দাঁড়িরা তালে তালে বৈঠা ফেলত লোকসংগীতের ঝড় বইত সঙ্গে সঙ্গে। নৌকোয় নৌকোয় ভাসমান মেলাই যেন এক-একটি বসে যেত। তাদের কোনোটাতে থাকত নানা পণ্যসম্ভার, কোনোটাতে ক্রেতা, কোনোটাতে বা দর্শক।
কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের দিকে জলে যখন টান ধরত, তখনকার প্রধান আকর্ষণ ছিল মাছ ধরা। জল কমে আসায় তখন পুকুর, ডোবা, নালায় এসে আশ্রয় নিত মাঠের মাছগুলো। ছিপ, পলুই বা জাল ফেলে মাছ ধরার তখন মহাধুম পড়ে যেত চারদিকে। জীবন্ত পুঁটি ‘খোটে, খোটে উঠত বঁড়শিতে। বড়ো বড়ো শোল আর গজাল মাছ ধরারই বা কী আনন্দ! টোপ গেলার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে গিয়ে ছিপ টেনে মাছ তুলতে সে কী ছুটোছুটি! একটু দেরি হলে শিকার হাতছাড়া হবার খুবই সম্ভাবনা। মৎস্য ধরিব খাইব সুখে’–কথাটা পূর্ববাংলার এই নীচু জলাভূমির ক্ষেত্রেই বুঝি বেশি খাটে!
আমাদের ছেড়ে-আসা গ্রামের এমনি কত কথা–এমনি কত স্মৃতি আজ চোখের সামনে এসে ভিড় করে–মানসপটে দেখা দেয় পল্লিমায়ের এমনি কত স্নেহসিক্ত রূপ। জীবনের এতগুলো বছর যার স্নেহক্রোড়ে কেটে গেছে হাসি-কান্না রং-তামাশার মধ্য দিয়ে, তার কোলে ফিরে যেতে আবার যে সাধ যায়–ইচ্ছে হয় পরমপীঠস্থান আমার জন্মভূমিকে আবার আপনার করে ফিরে পেতে!
.
নটাখোলা
রাজনীতি কীর্তিনাশা পদ্মার ওপরেও টেক্কা দিয়েছে বিংশ শতাব্দীর মাঝখানে এসে! পদ্মা এক পাড় ভেঙে অন্য পাড়ে সমৃদ্ধির প্রাসাদ তোলে, কিন্তু ভেজাল রাজনীতি বড়ো নির্মম! পিতৃভূমি ত্যাগ করে আজ কত নিরাশ্রয় মানুষ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাপাত্র সম্বল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের দুঃখ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তার উপলব্ধি অধিকাংশ মানুষের মনকে স্পর্শও করছে না! সমস্ত জীবন সুখে কাটিয়ে শেষজীবনে যাঁরা দুটি ভাত-কাপড় আর একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে হন্যে হয়ে মানসম্মান হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁদের অবস্থার কথা ক-জন ভাবছেন দরদ দিয়ে? স্বাধীনতার জন্যে জীবন বিপন্ন করেছি আমাদের ভয়ে একদিন বিদেশি শক্তিও ভীত হয়েছিল, কিন্তু ভ্রাতৃবিরোধ সেই ঐতিহ্যটুকু হরণ করে সর্বদিক থেকে যেন সমস্ত বাঙালি জাতিকে হীন করে তুলেছে। বাংলার মানুষ আত্মীয়বোধে জীবন দিতে পারে, কিন্তু আজ হীন স্বার্থ বড়ো হয়ে উঠে মানুষের মানবতাবোধকেও যেন বিপর্যস্ত করতে বসেছে। আমাদের এই যে অপমৃত্যু এর জন্যে দায়ী কে? জাতীয় ঐতিহ্য বিসর্জন দেওয়া আর আত্মহত্যা করা দুই-ই যে সমান কথা।
পদ্মার কুলুকুলু ধ্বনি একদিন মনে যে আমেজ আনত আজ আর গঙ্গার কূলে বসে সে অনুভূতি যেন পাই নে। আমাদের অবস্থা যেন সেই ছড়া-বর্ণিত এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর’ গোছের। দুঃখ-লাঞ্ছনা ভোগ করে করে অবস্থা হয়েছে স্যাণ্ডউইচের মতো নিষ্পিষ্ট। গ্রামের মানুষ আমরা, শহরজীবনে অভ্যস্ত নই। তাই পদে পদে কলকাতায় পায়রা খুপি অস্বাস্থ্যকর ঘর নামধেয় বস্তিজীবন আমাদের শ্বাসরোধ করে তুলছে দিন দিন। এই দ্বীপান্তর থেকে কবে মুক্তি পাব তা ঈশ্বরই জানেন। ছেড়ে-আসা গ্রামকে আজ তাই বেশি করে মনে পড়ছে। খুঁটিনাটি জীবনকথা চোখের সামনে ভেসে উঠে মনকে উদাস করে তুলছে। বার বার। মুক্ত জীবন, মুক্ত বাতাস একে উপড়ে নিয়ে এই যে ইটকাঠ-ঘেরা কারাগারে আমাদের জোর করে বন্দি করে রাখা হয়েছে একে কি স্বাধীনতা আখ্যা দিয়ে সম্মানিত করা মৃতপ্রায় মানুষের পক্ষে সম্ভব?
পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ কূল ছাপিয়ে তীরবর্তীদের ভিজিয়ে দিত, আর সেই ঢেউয়ের বুকে দুলে দুলে চলত গাঁয়ের কতরকমের নৌকো। কোনো কোনোটার বুকে আঁকা থাকত ছোটো ছোটো লাল তারকা। গাঁয়ের ছেলেরা ঝাঁকে ঝাঁকে বাঁকে বাঁকে, ডিঙি নৌকোয় মাছ ধরত; কৈবৰ্তরা ঘাটে ঘাটে তাদের ডিঙি ভিড়িয়ে সেই মাছ কিনে নিত। গ্রাম ছেড়ে সে মাছ চলে যেত দূরে–কত দূরে–কলকাতায়। সকাল থেকে সন্ধে নাগাদ পদ্মার বুকে চলত হাজার হাজার নৌকোর আনাগোনা–দেশি, বিদেশি ছোটো ছোটো ডিঙির মাঝখান দিয়ে পাল তুলে চলত বড়ো বড়ো হাজারমনি পাঁচ-শোমনি চালানি নৌকো–দূর থেকে মনে হত ছোটো ছোটো পাতিহাঁসের দলে চলেছে যেন এক-একটা বড়ো বড়ো রাজহংস।
নারায়ণগঞ্জ লাইনের স্টিমারগুলো গোয়ালন্দ বন্দর থেকে ছেড়ে এসে মাঝখানটায় কাঞ্চনপুরে ভিড়ত; সেখান থেকে স্টিমার ছাড়বার ভোঁ পদ্মার বাতাসে ভেসে ভেসে এসে পড়ত আমাদের স্টেশনঘাটে। সে ধ্বনি ইলামোরার মাঠ পেরিয়ে আইড়মাড়া বিলের ওপারেও শোনা যেত ভিন গাঁয়ে। পাটগ্রাম, পাঠানকান্দি, হেমরাজপুর, বাহাদুরপুর–এ পরগনার প্রায় সমস্ত লোকই জানত–শহর কলকাতা থেকে তাদের প্রবাসী কুটুম্ব ওই স্টিমারে আসছে। ভোরের সেই স্টিমারের ভোঁ, আর সন্ধ্যার গোয়ালন্দগামী স্টিমারের বাঁশি এ গাঁয়ের এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের নর-নারীর মনে জাগিয়ে তুলত মিলনের আনন্দ, বিচ্ছেদের বেদনা। আজও সকাল-সন্ধ্যায় শোনা যায় সেই স্টিমারের ভোঁ। কিন্তু স্টিমারঘাটে নেই সে ভিড়–নেই আর সেই দোকানপাট। ছেলেরা পালিয়েছে, নয়তো মরেছে না খেয়ে–কৈবৰ্তরা পালিয়ে এসেছে রাণাঘাটে, নয়তো নবদ্বীপে। এখন কি সেই বিরাট চালানি নৌকো তেমনি পাল তুলে চলে? বড়ো বড়ো পানসিগুলো নদীপারের যাত্রী নিয়ে আজ কি পদ্মার বুকে পাড়ি জমায়? ঘাটে ঘাটে গাঁয়ের মেয়েদের কচকচানি, ছেলে-মেয়েদের জলে দাপাদাপি হয়তো ফুরিয়ে গেছে, শাঁখ বাজিয়ে ঘণ্টা পিটিয়ে গঙ্গাপুজোরও হয়ে গেছে হয়তো অবসান!
ছত্রিশ জাতের গ্রাম ছিল আমাদের নটাখোলা। ব্রাহ্মণপাড়ার ভট্টাচার্যদের বাড়িতে বাড়িতে ন্যায়ালংকার, বিদ্যালংকার, তর্কতীর্থ, তর্কতীর্থ, কাব্যতীর্থদের টোলে ঢুকে ঢুকে দেখেছি, টোলের প্রবাসী ছাত্ররা সুর করে পড়ত বেদ-বেদান্ত, স্মৃতি, তর্কশাস্ত্র, কাব্য, দর্শন। গোঁসাইপাড়ার গোস্বামীগণ শোনাতেন চৈতন্যচরিতামৃত। আধুনিক গাঁয়ের একমাত্র মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছেলেরা ইংরেজির দুরূহ উচ্চারণ অভ্যাস করত চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে। তাদের বিজাতীয় বিকৃত উচ্চারণে চমকে চেয়ে থাকত কলসি কাঁখে পদ্মার ঘাটে গমনরতা গাঁয়ের কুললক্ষ্মীরা। গাঁয়ের হাঁটা-পথে ধাবমান বলদজোড়াকে আপন মনে যেতে দিয়ে লাঙল কাঁধে করিমচাচা অথবা মহেন্দ্র বিশ্বাস সেই পড়য়াদের ইংরেজি বুলিতে হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত–ওরা হয়তো মনে করত গুহ, বসু ও মজুমদার বাবুদের ছেলেরা তাদের গালাগাল দিচ্ছে। সেই ব্রাহ্মণপাড়ার কোল ঘেঁষেই মস্তবড়ো দাসপাড়া। এ পাড়ায় থাকত গাবর দাসেরা। এদের কাজ ছিল সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ির কাজ করা–ভিটেয় মাটি তোলা, বাগান তৈরি করা, ধান মাড়াই করা ও ফাইফরমাশ খাটা। এতেই সুখে-দুঃখে পঞ্চাশ-ষাট ঘর দাসেদের চলত অনাবিল জীবনপ্রবাহ।
দাসেদের পাড়া পেরিয়ে গেলেই সাহাদের বাড়িঘর। এরা সবাই ছিল সম্পন্ন, যেমন শ্রী ছিল ঘরদোরের তেমনি ফুটফুটে আঙিনা। তাঁদের অনেকেই করত চালানি কারবার। সেই চালানির পেঁয়াজ, রসুন, তিল, সরষে, খেজুর গুড়, কলাই ছাঁদি-নৌকোয় ভরে গাঁয়ের মাঝিমাল্লারা ‘গাজি পাঁচপীর বদর বদর’ বলে পদ্মার বুকে ভাসিয়ে দিত সপ্তডিঙা মধুকর। এমন পাকা মাঝি ছিল তারা যে, কোনোদিন নৌকো ডুবে যায়নি তাদের, যদিও তারা সুন্দরবন পেরিয়ে এসেছে কলকাতায়, উজান ঠেলে গিয়েছে আসামের ধুবড়ি, তেজপুরে। কলকাতার পর ওরা গিয়েছে পাটনায়, কানপুরে-ফিরে এসেছে সরষের তেল নিয়ে, বিহারি আখিগুড়ে নৌকো ভরতি করে। আর আসাম থেকে ওরা এনেছে ধান আর ধান-কত ধান! এই গাঁয়ের ঘাট থেকেই রপ্তানি হত ঝিটকা বন্দরের প্রসিদ্ধ হাজারি গুড়, কিন্তু পরিমাণ ছিল বড়ো অল্প। আজকালকার ফিটকারি মেশানো নকল হাজারি গুড় সে নয়। আসল হাজারি গুড় বেশি সাদা হয় না–তাতে পায়েস রান্না করলে দুধও জমে যায় না। কাঁচা রসের সুমিষ্ট গন্ধে পদ্মার ঘাট মিষ্টি হয়ে যেত মাত্র দু-এক মন হাজারি গুড়ের সুগন্ধে। কোথায় লাগে তার কাছে। ভীম নাগের সন্দেশ-কলকাতার নলেন গুড়! যা খেয়েছি আজও যে তার আস্বাদ ভুলে যেতে পারছি না। হাজারি শেখ জন্মেছিল ক-পুরুষ আগে জানি না, হাজারি নিজে কিন্তু ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমায় অমর হয়ে রয়েছে–থাকবেও।
সাহাপাড়ার ডান পাশেই পুবের দিকে আইড়মারার মাঠের কোল ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে ছিল তাঁতিপাড়া-মুসলমান কারিগর। মাঝখানটায় একটা মাত্র গেঁয়োপথের ব্যবধান–হিন্দু মুসলমানের সীমান্তরেখা। দিবারাত্র শুনতাম খটাখট শব্দ। তাদের মাকু চালানোর আওয়াজ আইড়মারার বিল পেরিয়ে, পাঠানকান্দির গ্রাম ছাড়িয়ে শোনা যেত ইছামতী নদীর কোলের বন্দরে–লেছড়াগঞ্জে। বন্দরের ব্যাবসায়ীরা সেই তাঁতিদের কাপড়, শাড়ি, চাদর, গামছা বিকিয়ে দিত ঘরে ঘরে। পঞ্চাশের মন্বন্তর এল–সেই তাঁতিকুল সুতোর অভাবে বেকার হয়ে গেল, না খেয়ে শুকিয়ে মরল অনেকে। দুর্ভিক্ষের পরে এল মহামারি! গ্রাম উজাড় হয়ে যায়! আমি নিজে ধরনা দিলুম তৎকালীন চিকিৎসামন্ত্রীর কাছে–ফল হল না কিছু। সামান্য কজন কর্মী যতটা পারি করলাম। স্বাভাবিকভাবেই মরে মরে ফুরিয়ে এল সেই মহামারি। তাঁতিপাড়ার আওয়াজ তখনও বন্ধ হয়নি। দেশ ভাগ হবার পূর্ব পর্যন্ত চলেছে কোনোক্রমে। তারপরে ধীরে ধীরে থেমে গেছে–সাতাশ ঘরের সাতঘর হয়তো টিকে আছে। তাঁত বেচে ফেলেছে–খেতখামারে নিড়ানি দিয়েছে তারা–নিড়ানো ফুরিয়ে গেছে, এখন তারা নিকটের শহরের পথে পথে হেঁটে বেড়ায়,–পাকিস্তানি কোঁদল শোনে–আর ভাবে, এ জীবনের আর কত বাকি!
চাষিরা ছিল দু-জাতের। হিন্দুও ছিল, তবে মুসলমানই বেশি। তারা নির্দিষ্ট কোনো পাড়ায় থাকত না। যেকোনো দিকে হিন্দু-মুসলমানের ঘর পাশাপাশিই ছিল। ব্রাহ্মণ হলেও, আমাদের বাড়িটার ঠিক গা ঘেঁষে তিনদিকেই ছিল মুসলমান প্রতিবেশী–সবাই চাষি। জহিরুদ্দিন শেখের স্ত্রী আমাদের ছিলেন বড়োচাচি, বুধাই শেখের সুন্দরী স্ত্রীকে বলতাম ‘ধলা-ভাবি’ গোপাল শেখের স্ত্রীকে তো ভাবি বলেই ডাকতাম–কারণ গোপাল আমার বাবাকে ‘বাবা’ই বলত। আমার বাবা ডা. হৃদয় ভট্টাচার্যকে সারাপরগনার লোকেই চিনত। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলের প্রথম পর্যায়ের পাশ করা ছাত্র ছিলেন তিনি, পাশ করা হৃদয় ডাক্তার। গোপাল একবার কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর চিকিৎসায় বেঁচে উঠে পিতৃদেবকে বাবা বলে ডেকে চিকিৎসার দক্ষিণা দেয়–সেই থেকে চিরদিনই ছিল সে আমাদের বড়ো ভাই। আমাদের সুখের দিনে বাবরি চুল ঝুলিয়ে লাঠি নিয়ে নাচত আর দুঃখের দিনে–শোকে-সন্তাপে আমাদের উঠোনে গড়াগড়ি দিয়ে সবার সঙ্গে সমানে কাঁদত। ধমক খেয়ে বাগানের আমগাছ কেটে শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থাও করে দিত। মোল্লাপাড়ার মাজুদিদিকে আজও পারি না ভুলতে। আমার মাকে তিনিও মা বলেই ডাকতেন। রাত্রির আঁধারে বোরখা পরে, চাকরের হাতে লণ্ঠন দিয়ে চটিজুতো পায়ে তিনি সপ্তাহে প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়ি-তখনকার দিনে মেয়েদের জুতো পরার রেওয়াজ হয়নি। কাজেই মাজুদিদির ওই অপরূপ মূর্তিটা চোখে বেশি করেই বাজত। দিদির কাজ ছিল ভারি মজার। যত রাজ্যের ভালো ভালো জিনিস চাকরকে দিয়ে বয়ে নিয়ে এসে আমাদের সকল ভাইবোনকে, মা, দিদিকে সামনে বসে খাইয়ে তবে তিনি যেতেন। কোনো নতুন জিনিস তাঁর আগে আমাদের কেউ এনে দিতে পারত না। দিদি ছিলেন নিঃসন্তান–আমাদের কোলে না নিতে পারলে তাঁর ভালো লাগত না। কতদিন পন্ডিত মশাইয়ের মার খাবার ভয়ে পালিয়ে গেছি মাজুদিদির বাড়িতে সেই পতিত জমির ওপারে। মাজুদিদির কোলে বসে কতদিন মজা করে দুধ-ভাত খেয়েছি। মর্তমান কলা দিয়ে আর পুরোনো খেজুরগুড় মিশিয়ে। আমার ব্রাহ্মণত্ব তাতে ঘোচেনি। মা জানতেন, বাবা তো ছিলেন সাহেব। নিষেধের প্রাচীর সেই পুরোনো দিনে আমাদের ভ্রাতা-ভগ্নীর সম্বন্ধটাকে ঘিরে ফেলতে পারেনি। এর সঙ্গেই মনে পড়ে সেই ছোটোবেলার শীতের দিনের কথা। গাছের তলায় সকালের রোদ্দুরটা আগে এসে পড়ত আমাদের বাড়িতে। সেইখানটায় ছেঁড়া চট বিছিয়ে ইস্কুলের পড়া তৈরি করতুম। এক এক ফাঁকে ক্ষেপু শেখের স্ত্রী ‘চাচি’ হাতছানি দিয়ে ডাকতেন। ছুটে গিয়ে কাঁটাল পাতায় করে সদ্য তৈরি নতুন গুড়ের ‘চাঁচি’ নিয়ে মহাআনন্দে রোজ চাখতুম। পঞ্চাশের ধাক্কায়ও বেঁচে ছিলেন চাচি, যদিও তাঁর তিনকুলে কেউ ছিল না। কিন্তু যেই আমরা দেশ ছেড়েছি চাচি আর বেঁচে থাকতে চাইলেন না। শুনেছি তাঁকে পদ্মার ভাঙাপারের ফাটলে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দিয়েছে গাঁয়ের দয়ালু মুসলমানেরা, ছাফন কাফনের খরচা জোটেনি। এই কলকাতায় বসে যতদিন ভেবেছি ছুটে গিয়ে চাচির সেই কবরখানা দেখে আসি, আর ফেলে আসি সেখানে তাঁর দেশছাড়া এক জিম্মি-ছেলের কয়েক ফোঁটা অশ্রু। রাক্ষুসি পদ্মা কি সে কবর এখনও রেখেছে?
গ্রামের একটাই ছিল প্রধান রাস্তা–প্রথমে লোকাল বোর্ডের, পরে উন্নীত হল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়কে। পদ্মাপার হতে মহকুমার সদর মানিকগঞ্জ পর্যন্ত ষোলো মাইল রাস্তা। সেই পথের পাশ ধরেই থাকত কৈবৰ্তরা। তারা ছিল প্রায় দু-শো ঘর। মাছের চালানি কারবার করত তারা। স্টিমারঘাটে বরফ দিয়ে কলকাতায় এত মাছ তারা পাঠাত যে স্টিমারকে কোনো কোনো দিন তারা দু-ঘণ্টাও আটকে রাখত। এখন তারা আর বেশি কেউ নেই, দু-এক ঘর হয়তো আছে। জেলেরা রাস্তার পারে মেলে দিত কতরকমের জাল-ইলিশধরা, চিংড়িমারা, নদীবেড় দেওয়া। তারা সব দেশ ছেড়ে এসে নবদ্বীপের আশপাশে ‘হা গৌরাঙ্গ’, ‘হা গৌরাঙ্গ’ করছে এখন। কুমোরদের সংখ্যা খুব ছিল না বটে, তবে দুটো বাড়িতে হাঁড়ি-কলসি যা হত তাতে গ্রামের তৈজসপত্রের অভাব মিটে তো যেতই, তারপর তারা নৌকো করে বাড়তি হাঁড়ি-কলসি সুন্দরবনে বিকিয়ে দিয়ে নৌকোভরতি ধান নিয়ে ফিরে আসত ফি-বছর। তারা পাট উঠিয়ে কোথায় গেছে জানি না। এ ছাড়া ছুতোরপাড়া, কামারপাড়া নিয়ে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম আর কোথাও গিয়ে পাব কি না সন্দেহ। অভাব হয়তো ছিল, তবে অভাবের বোধ ছিল না বলেই জিনিসের অপ্রতুলতার কথা শোনা যায়নি সে গাঁয়ে।
বারোমাসে তেরো পার্বণ, আর তার ঘটাও ছিল তেমনি। দেখতে দেখতে কার্তিক মাস পড়ে যেত। ধান ঘরে উঠেছে, পথঘাট কিছু শুকিয়েছে, লেগে গেল বরোয়ারি কালীপুজোর ঘটা এ উপলক্ষে। ভদ্র পাড়ায় হত কালীর আসরে যাত্রাগান, শখের থিয়েটার, কবিগান, জারিগান। হিন্দু-মুসলমান চাঁদা দিয়ে, পান তামাক খেয়ে একত্রে গলাগলি করে রাতের পর রাত গান শুনত–কবিদের গানের লড়াই, ছড়ার কসরত শুনে তারিফ করত। মদন কবিওয়ালা, ছমির বয়াতি উভয়েরই ছিল গ্রামের মহলে মহলে সম্রাটের সম্মান। চৈত্রসংক্রান্তি, রথ ও দোলের মেলায় গ্রামে চলত সস্তা বিপণির বিকিকিনি, কত ভিন গাঁয়ের কত জিনিসের হত আমদানি! চার পয়সা, আট পয়সার পুতুল থেকে এক পয়সার বাঁশি পর্যন্ত কিনে আমরা কত যে সুখী হয়েছি, সে সুখ আর কি ফিরে পাব? দশহরাতে নিজেদের দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে জেলেদের বড়ো বড়ো ছাদি-নৌকোয় বের হতুম আমরা। সাতখানি প্রতিমার সঙ্গে চৌদ্দজন ঢাকি বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে মরাগাঙের স্থির জলে বেদনার মূৰ্ছনা বইয়ে দিত। দু-পারের হিন্দু-মুসলমান গৃহবধূরা সজল চোখে বিদায় দিত দেবী জগন্মাতাকে। বাইরের নৌকোতে ঘুরে ঘুরে খঞ্জনিতে তাল ঠুকে গাইত মুসলমান বয়াতি বিদায়ের বিসর্জন গান। দশহরার পরের দিন সকল বাড়িতেই লেগে যেত তাড়াহুড়ো। মাইলখানেক দূরে বাহাদুরপুরের ঘাটে যেতে হবে ইছামতী নদীর কিনারায়। ওইখানেই হত নৌকোবাইচ–এক-শো হাতের, আশি হাতের লম্বা নৌকোয় পাল্লা দিয়ে বেয়ে আসত কত শত শত নৌকো নীল, লাল, সবুজ নিশান উড়িয়ে। সব নৌকোই মুসলমান মাঝিদের–গলুইয়ের ওপর কালো বাবরি উড়িয়ে, পিতলে বাঁধানো বৈঠা ঘুরিয়ে পঞ্চাশ-ষাট জন বাইচ-খেলোয়াড়কে সমান তালে, সমান জোরে জল টেনে চলতে তারা সংকেত করত। এ যেন মহাযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির ইঙ্গিতে যুদ্ধ করে চলেছে সৈন্যদল–সেনাপতি অলক্ষ্যে নন, পুরোভাগে। প্রতিযোগিতা চলত দেশবিদেশের নৌকোয়, পাল্লা দিত গ্রামে গ্রামে, মহকুমা মানিকগঞ্জের পরগনায় পরগনায়। যে বছরে পাটের দাম যত বেশি মিলত, সেই বছরে তত জোর পাল্লা। হারজিতের সমাধান কোনোদিন দেখতে পেতুম না, কারণ কোথায় যে ওই পাল্লা শেষ হত, কত মাইল দূরে, তা শুধু ইচ্ছামতী নদীই বলতে পারত। আমরা দেখতুম শুধু উল্কাবেগে ছুটে চলেছে এক এক জোড়া নৌকা। নয় তো দেখেছি, ধীরে ধীরে বেয়ে চলেছে একখানি বাইচের নৌকো–চার-পাঁচজন বয়াতি গায়ক ঘুঙুর পরে নেচে নেচে খঞ্জনি বাজিয়ে গেয়ে চলেছে বয়াতি গান–নিজেদের রচনা, বর্তমান যুগধারা ও অতীতের সুখ-দুঃখের ব্যঙ্গ প্রকাশ। দেশ ভাগ হবার পরে শেষ গান শুনেছি বয়াতির কণ্ঠে বিষাদের সুরে,
কলি যুগে জান বুঝি আর বাঁচে না–
কোথায় থেকে তুফান আইল,
ঘর বাড়ি সব উড়াইয়্যা নিল,
মানুষজনে খাইত্যাছে আইজ কুত্তা শিয়ালে।
সেই বয়াতি সুরের বিদায়ক্রন্দন আজও কানে বাজে–কলকাতার সুর-লয় সংযোগে আভিজাত্যমন্ডিত যেসব ভাটিয়ালি গান আজ শুনছি, তার চাইতেও গভীর করে যে সেই বৈঠার তাল, খঞ্জনির মূৰ্ছনা মনেপ্রাণে দাগ কেটে রেখেছে। তেমনটি কি আর শুনব? ছন্দহীন পঙক্তিবিহীন সেই গেঁয়ো কবির মর্মভরা কবিতা, ইচ্ছামতীর জলেই কী চিরকালের মতো বিসর্জন দিয়ে এলাম?
পৌষ মাস এসে পড়ল। এর সময়েই হত আলিজান ফকিরানির দরগায় বছরের উৎসব। সারামুলুকের হিন্দু-মুসলমান ছুটে যেত ফকিরানীর আশীর্বাদ, দোয়া নেবার জন্যে। তার দরগা দুধে দুধে ধুয়ে দিত, তার সর্বজনীন সিন্নির খিচুড়ি মাথায় করে নিয়ে যেত হিন্দু-মুসলমান সবাই। পঙ্গু ফকিরানী তাঁর রুক্ষ জটাজালপূর্ণ মাথাটি নাচিয়ে নাচিয়ে একবার এর আর ওর গলা জড়িয়ে ধরে ‘আল্লার জান, বাঁচো’ বলে ছুটতেন এধার-ওধার। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে এই গেঁয়ো তাপসী রাবেয়া’র আশীর্বাণী মাথায় করে কৃতার্থ হত সবাই। মকিম শেখের কোলে চড়ে কতবার গেছি সেই প্রসাদী সিন্নি খেতে। সেই ফকিরানীও আজ নেই–সিন্নিও ফুরিয়ে গেছে। দরগা নাকি পদ্মার জলে অতলে তলিয়ে গেছে। ভোর হলেই এখনও কানদুটো শুনছে শেষরাতের আজানধ্বনি, উদ্ধব বৈরাগীর উদাসিয়া গান। চৈত্র মাসের কালীকাঁচ আর বুড়ো মোল্লার বহুরূপ এখনও যে চোখের সমুখে নেচে বেড়ায়! ঘোষালের যাত্রার আসরে ভীমের গদা এখনও যে বনবন করে মনের চোখের সামনে ঘুরছে!
কলকাতায় পথে-ঘাটে কতরকমের পাগলই না দেখছি–তবু দিনু পাগলাকে ভুলতে পারি না। সেই দিনু শেখের মেয়েটাও মরে গেল–আগের বছর বউ মরেছে কলেরায়, দিনু পাগল হয়ে গেল। ঘন কালো সুঠাম দেহে, একমাথা ঝাঁকড়া কালো চুলে সে পরত বেছে বেছে ধুতরো ফুল। সুদে ও তস্য সুদে তার ভিটেমাটি আগেই গ্রাস করেছিল মহাজনরা–তাই ছিল না তার কিছুই। কালীতলায় পড়ে থাকত রাতের বেলায়, দিনভর বসে থাকত সে পদ্মার ঘাটে। বউ-ঝিরা তার রক্তচক্ষু দেখে একটুও ভীত হত না–আর দিনুর কড়া পাহারায় একটি বাচ্চাও জলে ডুবতে পারত না। একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে তো–দিনু ডাঙা থেকে লাফিয়ে পড়েছে–জল থেকে তুলেছে ডুবন্তকে। খিদের বেলায় একটা কলাপাতা নিয়ে যেমন খুশি ঢুকে পড়েছে যেকোনো বাড়িতে–পেয়েছে পেটভরা ভাত। স্ফুর্তি করে খেয়ে ‘আল্লাকালী’, ‘আল্লাকালী’ বলে লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেছে বাইরে, দু-চোখের বাইরে। কিছুক্ষণ বাদেই দেখা যেত তাকে, চাষির হাতের লাঙল কেড়ে নিয়ে সে চালাচ্ছে বলদ—’হেঁইও–হট’–ততক্ষণে আইলের ওপর বসে চাষি ভাই একটু তামাক খেয়ে নিচ্ছে। সে আর কতক্ষণ! একটু পরেই দিনু ছুটেছে পদ্মার তীরে।
সেই শান্ত পাগল দিনুই একবার ভীষণ কান্ড করে বসল। শীতের মধ্য রাত্রি, হরি পোদ্দারের খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে সে জোর চেঁচাতে শুরু করল-”ও পোদ্দার মোশাই–দ্যাহেন কত্তা, কী নাল ঘোড়া দাবাড় দিছি। যত লোকজন হই-হুঁল্লোড় করে আগুন নেভায়, দিনু ততই নাচে বগল বাজিয়ে, কী সুকর্মই না সে করেছে। অগ্নি নির্বাপিত হল। তারপরে গাঁয়ের মাতব্বর ব্যক্তিরা বসে গেলেন বিচার করতে। পঞ্চায়েতি বিচার করতে। পঞ্চায়েতি বিচারসভায় হিন্দু-মুসলমান দাস-কৈবর্ত সকলেই থাকতেন। দিনুকে জিজ্ঞাসা করা হল, কেন সে এমন কাজ করল। সাফ উত্তর দেয় দিনুজারা, বড়ো কড়া জারা (শীত)। সেই বছর থেকে যেবারই বেশি শীত পড়েছে, গাঁয়ের লোকে চাঁদা করে দিনুর জন্যে শীতের কম্বল কিনে দিয়েছে, নয় তো জোগাড় করে দিয়েছে। দিনু আর শীতেও কাঁপেনি–লাল ঘোড়াও আর ছুটোয়নি। দিনু আর নেই। কিন্তু কলকাতায় এসে দেখি সেই দিনু পাগলার মৃত্যু হয়নি। সারাদুনিয়ার ঘরে ঘরে দিনু পাগলার জন্ম হয়েছে–তারা ছুটিয়ে আসছে লাল ঘোড়া। এবার হরি পোদ্দারের দলের যে কী দশা হবে ভেবে পাইনে কিছু, তাদের রুখতে হলে যে কম্বলের দরকার, তা দেবে কে?
চৈত্র মাসের খরার দিনে দেখতুম গাঁয়ের চাষি-ছেলেরা মাঙনে বের হত। ঝকঝকে একটা ঘটি হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে, গোরুর দড়ি দিয়ে আম্রপল্লব-বাঁধা পাঁচন বাড়ি কাঁধে নিয়ে ঘরে ঘরে সিন্নির চাল মেগে নিত। বলত একদিলের সিন্নির চাল দেন। কোন আল্লাদেবতা যে এই ‘একদিল’ জানতুম না। এখন বুঝি একদিল মানে একপ্রাণ। এত বড়ো দেবতার কৃপা কুড়োতে হিন্দু ও মুসলমান চাষিদের মধ্যে বিভেদ হত না। সেই ভিক্ষালব্ধ চাল দিয়ে সম্মিলিত যে সিন্নি পতিত ভিটেয় হত–তাতে হিন্দু-মুসলমান সবাই যোগ দিয়ে বৃষ্টির কামনা করত। মন্ত্রতন্ত্র কিছু ছিল না। একপ্রাণের কামনার ফল ফলত বই কী–হয় শীঘ্র, নয় বিলম্বে।
সেই ছেড়ে-আসা অবিখ্যাত আমার গ্রাম! কলকাতার মিলের চিমনি ভোরের বেলাতে ভোঁ করে ওঠে-ঘুম ভাঙতেই শুনি! মনটা রোজই ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ওই গোয়ালন্দের স্টিমার কাঞ্চনপুরঘাট ছেড়ে এসেছে–যাবে নারায়ণগঞ্জে, বাঁশি বাজাচ্ছে–ভোঁ-ভোঁ।
.
সোনারং
খাওয়া পরা দেখছি হল ভার,
মায়ের মুখ কেবল মনে পড়ে;
তাদের কথা বলছ কিবা আর,
দূর থেকেও সঙ্গ নাহি ছাড়ে।
খাওয়াপরা সকল দিছি ছেড়ে,
ছেলেগুলোই সব নিল রে কেড়ে!
কতকাল আগে কোন কবি এ গান গেয়ে গেছেন তা সঠিক না জানলেও তাঁর দুঃখের সঙ্গে আমাদের দুঃখের মিল দেখে আশ্চর্য বোধ করছি। আজ আমরা জন্মভূমি ছাড়া হয়ে নাওয়া খাওয়া ত্যাগ করেছি, আমরা মাকে ভুলতে চাইলেও তিনি চোখের সামনে উঠছেন ভেসে বার বার। স্মৃতিসঙ্গ কিছুতেই মুক্তি দিচ্ছে না,–তাঁর দুরন্ত ছেলেগুলো তাঁকে কেড়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে! মাকে ছেড়ে প্রবাসী হয়েছি, প্রবাসযাত্রার শেষ কবে হবে জানি না।
বার বার মনে পড়ছে আমার গ্রাম সোনারং-এর কথা। আশা-নিরাশার স্মৃতি মনের মণিকোঠায় ভিড় করে রয়েছে জট বেঁধে, মন হাঁপিয়ে উঠছে চারপাশের দেওয়াল-ঘেরা শহুরে আবহাওয়ায়। এখানে মুক্তি নেই, উদারতা নেই, ছুটি নেই, ফাঁক নেই। আমার গাঁয়ের উন্মুক্ত প্রান্তরের উদার হাতছানি কোথায় পাব শান-বাঁধানো কলকাতার বুকে? হৃদয়বীণার তারে মরচে ধরেছে–তাকে হয়তো আর সুরে বাঁধতে পারব না! সুর কেটে যাচ্ছে তাই বার বার।
আমার গ্রামটির ইতিহাস শান্তির ইতিহাস। ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে সে গ্রাম মহান। আজও সেখানে বৌদ্ধযুগের শান্তির ধ্বজা উড়তে দেখা যায়। সেখানে রয়েছে বৌদ্ধযুগের ধ্বংসাবশেষ। গ্রামের কবি হরিপ্রসন্ন দাশগুপ্ত মশায়ের কাছে শুনেছি সেই আলো-ঝলমল তথাগতের শান্তির ললিত বাণীর মনোরম গল্প। আজও বর্ষার দিনে যেখানে বাঁকাজল খেলা করে তার তলায় বিশ্রাম করে তথাগতের সারিবদ্ধ সোনার দেউল। জন্মভূমি পক্ষবিস্তার করে রক্ষা করছেন বিস্মৃত ইতিহাসকে। ভারতবর্ষের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্যেই চিন-জাপান পর্যন্ত ভারতকে গুরু বলে স্বীকার করে নিয়েছে। তাঁর শান্তির বাণীকে বর্বর মানুষ আর ব্যর্থ পরিহাস করতে পারবে না–সলিলসমাধি সৌধরেখা আজ জলরেখায় গেছে মিশে! মনে পড়ে প্রথম যেবার ঢাকা শহরে ক্ষুদ্র মিউজিয়ামটি দেখতে যাই, সেবার প্রথমেই দেখতে পাই সুউচ্চ স্কুপের ওপর ভগবান বুদ্ধের স্তব্ধ মূর্তিটি। আপনা আপনিই সেদিন তাঁর পায়ে আমার মাথা পড়েছিল লুটিয়ে। সেখানে দাঁড়াতেই কানে বেজে উঠেছিল কবিরাজ গোস্বামীর গানটি,
উপজিল প্রেমবন্যা, চৌদিকে বাঢ়য়।
জীবজন্তু কীট আদি সকলে ডুবায়।
বুদ্ধের অনন্ত মাধুরীপূর্ণ প্রেম ও দয়ার অমৃত মন্ত্র পুণ্যবতী বাংলা মাকে তো বাঁচাতে পারল না? বর্ষার স্ফীতবক্ষা পূতসলিলা জাহ্নবীধারার মতো হিংসা-দ্বেষকে তো প্রেমবন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারল না মানুষ! হৃদয়-আত্মা বাসনাহীন নির্লোভ হয়ে চিদাকাশে বেলুনের মতো অদৃশ্য হতে পারে না কি? কেন আজ আমাদের পদে পদে পরাজয়ের গ্লানি। সংসারী মানুষ ইন্দ্রিয়সুখের জন্যে আর কত নীচে নামবে? শাক্যসিংহের মতো আজ আমাদের কে বলবেন, ‘সকলই জ্বালাময়। কীসের অগ্নিতে জ্বলিতেছ? আমি তোমাদিগকে বলিতেছি,-ক্রোধের জ্বালায় দগ্ধ হইতেছ,–মোহের শিখায় দগ্ধ হইতেছ!’
সেদিন বুদ্ধমূর্তির সামনে একটি ফলক দেখে চমকে উঠেছিলাম,–মূর্তিটি আমার গ্রামের একটি পুষ্করিণী খননকালে পাওয়া গেছে। জানি না সেই সদাহাস্যময় বুদ্ধদেবের প্রতিমূর্তি আজও ঢাকার জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে কি না! যাঁর চরণতলে একদিন কোটি কোটি মানুষ নিয়েছিল শান্তির পাঠ, আজ তিনিই শান্তিতে আছেন কি না ভাবতে হচ্ছে। সর্বদেশে সর্বকালেই দেশের বুকে জগাই মাধাই মাথা নাড়া দিয়েছে, কিন্তু এরা কি শেষ পর্যন্ত ভুল বুঝতে পারবে? পারবে তো আবার সবাইকে বুকে টেনে নিতে? আমাদের আশা ব্যর্থ হবে কি না জানি না, কিন্তু সেই সুদিনের প্রতীক্ষাই করছি সব সময়।
স্টিমারঘাটে নামতে নামতেই শরীরে জাগত কেমন অনির্বচনীয় একটা রোমাঞ্চ, সোনালি স্বপ্নের আবেশে মন হয়ে উঠত আবেশময়, সেখান থেকেই পেতাম সোনারং-এর পরশ। মাঝিদের আহ্বানে চমক ভাঙত হঠাৎ। কানে এসে বাজত–’আহেন কর্তা, আমার নায়ে আহেন, যাইবেন কৈ?’ দরদস্তুর বা কথাবার্তার মধ্যে না গিয়ে শুভ্র-শ্মশ্রু বৃদ্ধ মাঝির নৌকোয় গিয়ে উঠে পড়তাম বাক্স-বিছানা নিয়ে। আমার নির্লিপ্ত ভাব দেখে মাঝি কী বুঝত জানি না, তবে আশ্বাস দিয়ে বলত, “আমিই যামু কর্তা, ভারা যা অয় দিয়েন অনে!’ নৌকোয় আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসার পর প্রশ্ন করতাম, “সোনারং চিনো?’ হাসতে হাসতে সে জবাব দিত, ‘হোনারং চিনি না? কন কী কর্তা, হেই দিনও আইলাম আপনেগ গেরাম থিঙ্কে। সুতরাং আর চিন্তা কী? পাটাতনে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ি নিশ্চিন্ত আরামে! নৌকো ছাড়া অন্য যান কিছু নেই গ্রামে যাওয়ার। গ্রাম পত্তন যিনি করেছিলেন তিনিও এসেছিলেন এই নৌকো করেই মনের খুশিতে গান গাইতে গাইতে। বেতবন আর হিজলের বুক চিরে নৌকো ঠিকই পথ চিনে বার বার এসেছে গেছে যাত্রী বুকে নিয়ে। আজ ভাবি সে জঙ্গলে যে শয়তান লুকিয়ে ছিল তা কারও নজরেই পড়েনি।
নৌকো ভ্রমণ চুপচাপে হয় না,–পেঁচার মতো মুখ করে আর যাই করা যাক নৌকোতে বেড়ানো যায় না। তাই মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে মাঝির সঙ্গে আলাপে রত হতাম। আলাপ জমাতে মাঝিদের কেউ বলে চাচা, কেউ বলে মামু। আমি মামু বলেই গল্প আরম্ভ করতাম। পেটে তখন পদ্মার বাতাস ক্ষুধার উদ্রেক করেছে, তাই আমার প্রথম কথা ছিল সেদিন, ‘মামু, খুদা তো বড়ো লাগছে, বাজার-টাজার আছে নাকি সামনে?’ আন্তরিকতায় মাঝির মুখও দেখেছি সেদিন ব্যথাতুর হয়ে উঠেছে। আমার খিদে তার বুকেও এনেছে ব্যথার পরশ-ম্লান হয়ে সে জবাব দিয়েছে, আগে কইলেন না ক্যান, এই তো দিগির পারের আটটা ছারাইয়া আইলাম। আইচ্ছা, সামনে পুরার বাজার আছে, চিড়া-মুড়ি কিন্না দিমু অনে!’ কী সহানুভূতি, কত দরদ পেয়েছি সেদিন। মাঝিকে নিজের পরিবারের লোক বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু আজ? কোথায় গেল সে সরল সহজ মামু! প্রাণভরা, দরদভরা সহানুভূতি দিয়ে যারা মানুষকে বুঝত তারা কি চিরবিদায় হয়েছে এই কলুষ-পঙ্কিল পৃথিবী থেকে? না চক্রান্তকারীদের ভয়ে মুখ তারা খুলতে দ্বিধাবোধ করছে? সৌন্দর্যের মৃত্যু হওয়া দেশের পক্ষে চরম লোকসানের কথা–সেই অশুভ দিন কেন নেমে এল কালো পাখা মেলে এই বাংলার ওপর?
সেদিন মাঝির সঙ্গে ভাগ করে চিড়ে-মুড়ির পর খালের জল খেয়ে যে কত আনন্দ পেয়েছি তা ভাষায় বলা যায় না। পদ্মার বাতাস, পদ্মার জল সেদিন কাছে টেনে নিয়ে ভাই-ভাইয়ের একপ্রাণতা একতার সূত্রে বেঁধে দিয়েছিল,–আজও সেই পদ্মা আছে, কিন্তু সে তো আজ চুপচাপ সাক্ষীর মতো ভ্রাতৃবিরোধ দেখে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলে পারে কি সে আমাদের সকলের হাত এক করে দিতে! পদ্মার জলের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের চোখের জল। কীর্তিনাশা বলে তার বদনাম আছে, কিন্তু তার কীর্তিকথার খোঁজ আমরা ক-জন রাখি? মানুষ কি তার চেয়েও বেশি কীর্তিনাশ করেনি? মানবতাবাদের সংহার কে করেছে? মানুষ, না পদ্মা? আজ ঘুমের মধ্যে পদ্মার ঢেউ বুকের ভিতর আছাড় খেয়ে পড়ে সমস্ত অভিমান নিয়ে। সে ঢেউ কি আর কারও বুকে লাগে না?
এক-একটি ভাব মানুষের মনে এক একরকম প্রেরণা জোগায়। তা না হলে যে পদ্মা রবীন্দ্রনাথের মনে কাব্যের প্লাবন এনেছিল সে পদ্মাই কী করে মারণমন্ত্রের প্রেরণা দিল? কবিতার প্রেরণা ও লুণ্ঠনের প্রেরণা কী একই উৎসকেন্দ্র থেকেই উঠছে না? পরস্পরবিরোধী এ ভাব কেন জাগে হৃদয়তন্ত্রীতে? সুকুমার বৃত্তির চিরউচ্ছেদ হতে পারে না মানুষের মন থেকে। এই সাময়িক ক্ষিপ্ততার শেষ হবেই হবে।
শহুরে সন্ধ্যায় চিমনির ধোঁয়া দেখলে আমার সেই মাঝির তামাক খাওয়ার কথা মনে পড়ে। হুঁকো কল্কে সাজিয়ে ধূম্রকুন্ডলীর যে আবর্ত সেদিন তারা সৃষ্টি করেছিল তা থেকেই বোধ হয় আরব্য উপন্যাসের দৈত্যটা প্রবেশ করেছে তাদের মনে! এ দৈত্যের সংহারমন্ত্র কী? তাকে আবার কি বোতলে ঢোকাতে পারা যাবে না?
দু-হাতে বৈঠা মারতে মারতে নৌকো যেত এগিয়ে। ছোটো খালের দু-ধারে কত রকমের গাছ। যোগীর জটাজালের মতো মাটির ওপর দিয়ে শিকড়গুলো এসে নেমেছে খালের জল ঘেঁষে। সেই বিরাট গাছের ধ্যানরত স্তব্ধতা, অনন্ত নীলিমার দিকে চেয়ে থাকার ছবি আজ ভুলতে পারছি না। তাদের ধ্যান বোধহয় আজও ভাঙেনি,তারা শান্তিতে থাকুক, মনে গৈরিক ধূসর বৈষ্ণবতা এনে মানুষকে আবার সুখীসচ্ছল করুক এই প্রার্থনাই করি দূরে বসে।
মাঝে মাঝে বেতের ঝোঁপ। বিক্রমপুর আছে অথচ বেতবন নেই এটা কল্পনাই করা যায় না! ঘন জঙ্গল সৃষ্টি করে কত রকমারি পশু-পাখিকে আশ্রয় দিয়েছে এই বেত। এই খালের ধারের বেত ঝোঁপের বুক থেকেই ভোরের কাকলি ওঠে প্রথম। নির্জন দুপুরে ঘুঘুর ডাক ওঠে এখান থেকেই, এখান থেকেই নিশুতি রাত্রে ককিয়ে ওঠে বক-শিশুরা! জঙ্গলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কচুরিপানার বংশ। বিক্রমপুরের শ্বাসরোধ করার চক্রান্ত এরা কোথা থেকে পেল? বিক্রমপুরের সঙ্গে সমস্ত পুববাংলার লোকের শ্বাসরোধ কি এই রক্তবীজের বংশধরেরাই করেছে?
খালের ঘাটে গৃহস্থ বধূরা জল নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কটাক্ষে দেখে নিত হাট-ফিরতি নৌকোর আরোহীদের। তাদের মুখে খুঁজে পেতাম যেন রাঙা বৌদি, মণিদি, মনোপিসির মুখের আদল! প্রবাসী মন থেকে উৎপাটিত হয়ে তারা নানান দিকে পড়েছে ছড়িয়ে, জানি না তারা আজকে কোথায়। জানি না তাদের ক-জনই বা নির্বিঘ্নে চলে আসতে পেরেছে সম্মান বজায় রেখে। দিকে দিকে মেয়েদের অসম্মান–তাদের আতাঁরবে মা বসুন্ধরার কি ঘুম ভাঙবে? নারীর লজ্জা কি নারী চোখ মেলে দেখেই যাবে শুধু? দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে, সংকুচিত হয়ে আর কতদিন ভারতবর্ষ থাকবে? নারীর সম্মানের জন্যে আগে মানুষ কেমন উত্তেজিত হত, নারীরা আসন পেত সবার ঊর্ধ্বে। নারীর অসম্মান তখন সমগ্র দেশের অসম্মান বলে বিবেচিত হত, সেদিনের সে মনোভাব গেল কোথায়? হিন্দু-মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান চিরদিনই নারীকে সম্মান দেখিয়েছে, অথচ আজ এ কী হল? জাতি-বিচারই কি নারী-বিচারের মাপকাঠি হয়ে মনুষ্যত্ববোধের অধঃপতন ঘটাবে বাংলায়?
রাজ্যের ভাবনা ভাবতে ভাবতে কখন যেন একটু তন্দ্রা এসে যেত। সে তন্দ্রা টুটত বৃদ্ধ মাঝির সস্নেহ ডাকে, ‘উঠেন কর্তা, টংগীবাড়ি আইয়া পড়ছি। টংগীবাড়ি এসে পড়েছি? তাহলে তো এসেই পড়েছি। মনে পড়ে যায় কতদিন এখানে এসেছি হাট করতে; হাট সেরে অকারণ দাঁড়িয়ে থাকতাম ওই পুলের ওপর। গ্রাম-সম্পর্কে মতিকাকার মাল কাঁধে বয়ে পৌঁছে দিয়েছি তাঁর বাড়িতে কতদিন। বাড়ি হাজির হয়ে মতিকাকা বাতাসা দিয়ে জল দিতেন আদর করে। তারপর হেসে বলতেন : “আরে আদা শুকাইলেও ঝাল থাকেরে, তগ মতন বয়সে আমরা দুই মুনি আড়াই মুনি বোঝা লইয়া আইছি টংগীবাড়ির থন। সেদিনের গল্পগুজবের মধ্যে মতিকাকা, মতিকাকিমার সহৃদয়তা আমাদের মুগ্ধ করত। মুড়ি, বাতাসা, নারকেল নাড় আমাদের বারবার টেনে নিয়ে যেত মতিকাকার বাড়ি! জানি না, ঝড় তাঁদের কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে আজ। যেখানেই হোক, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন! বেঁচে থাকলে দেখা হবেই একদিন-না-একদিন। দুঃখ লাগে ভেবে, যারা মুড়ি নাড় বিলি করেছে বেহিসেবিভাবে আজ তারাই করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে খাবার জিনিসের দিকে! কপালের পরিহাস আর কাকে বলে জানি না, কিন্তু নিজেদের দৃষ্টান্ত থেকে তার পরিচয় পাচ্ছি। সামান্য ডালভাতের জন্যে আজ আমাদের স্বার্থপরতা দেখে স্তম্ভিত হচ্ছি।
টংগীবাড়ির পর মনে পড়ছে মুনশিবাড়ির কথা। নবাবি আমলে এই গ্রাম আটকে গিয়েছিল বিলাসের ফাঁসে। চরম মুনশিয়ানা করে গেছে গ্রামবাসীরা। চিহ্নস্বরূপ আজও মঠ-মসজিদ দেখা যায় প্রচুর। মঠে শ্মশানেশ্বর শিব ও মা কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে সেই নবাবি আমল থেকে। মা কালী ছিলেন এ অঞ্চলের জাগ্রত দেবতা। কত দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসত পুজো দিতে ধন্না দিয়ে অভীষ্টসিদ্ধির জন্যে! দেখেছি মুসলমান ভাইয়েরাও হাতজোড় করে মানত করে যেত। কিছুদিন বাদে রোগমুক্তির পর জোড়া জোড়া পাঁঠা নিয়ে আসত দিকে দিকে আনন্দধ্বনি ছড়াতে ছড়াতে। জাতিধর্মনির্বিশেষে এমনি কালীপূজো আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, কিন্তু মা কালীও কেন বিরূপ হলেন আমাদের ওপর? কেন ভিটে ছেড়ে নির্বাসিত হলাম, অজানা ভবিষ্যতের অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে হল কোন পাপে! ছোটোবেলায় এই মঠবাড়িই ছিল আমাদের আড্ডাখানা। কত দৌরাত্মই না করেছি আম-কাঁঠালের সময়। গভীর রাত্রে খেজুরের রস চুরি করে জলভরতি কলসিটি টাঙিয়ে রাখতাম ভালো মানুষের মতো।
বিজয়া দশমীর দিন কী মাতামাতিই না করতাম এই মঠের ঘাটে। ঢাক-ঢোলের বোলের সঙ্গে চার ধূপতির আরতি দেখে মাঝরাত্রি পর্যন্ত হইহুল্লোড় করে কাটাতাম। দুর্গাপুজো উপলক্ষ করে কোনো বছর ছুটিতে বাড়ি যেতে না পারলে অস্থির হয়ে পড়তাম আগে। এখনও বছরে বছরে যথারীতি পুজো আসে, কিন্তু আমি বাড়ি যেতে পাই না। এ দুঃখের তুলনা দেব কীসের সঙ্গে? অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে চোখ দুটি পূর্ব সুখস্মৃতির কথা ভেবে। আজও সে মঠ আছে, তাকে নিশানা করে লোকেরা হয়তো চলাফেরাও করে ভক্তিনম্রভাবে মা কালীকে প্রণামও হয়তো করে কেউ কেউ, কিন্তু সেদিনের সেই সুখী উজ্জ্বল আবহাওয়া কি আর আছে মুনশিবাড়িতে? একতা, সংঘবদ্ধতাকে নির্বাসন দিয়ে মানুষ আজ যে ভুল করল তার উপলব্ধি কবে হবে কে জানে!
মঠের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না আজ। বহু স্মরণিকা ভিড় করে আসছে–এই মঠই ছিল এ অঞ্চলে অগ্নিযুগের প্রেরণাকেন্দ্র। অনুশীলন পার্টির অন্যতম প্রধান কার্যালয়। পুলিশের অত্যাচার এ কেন্দ্রে ঘূর্ণিবায়ুর মতো নিষ্ঠুর গতিতে বয়ে গেছে এক সময়। সে বর্বরতার কথা মনে করলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। গ্রামের দেশকর্মী ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে কতরকম মর্মান্তিক অত্যাচারই না করেছে অমানুষ অশিক্ষিত মূঢ় সেদিনকার ইংরেজ ভৃত্যরা। তাদের ভয়ে তরুণ যুবকদের গ্রামে থাকাই হয়ে উঠেছিল অসম্ভব। সেই সময় থেকেই নীরব ফন্তুর মতো কাজ হত মঠে–মা কালী তার সাক্ষী। সেদিন বিদেশি শক্তির বিপক্ষে মায়ের খঙ্গ উঠেছিল ঝলসে, মায়ের আশীর্বাণী পেয়েছে সব ভক্ত ছেলের দল। কিন্তু ভ্রাতৃবিরোধের দিনে মা রইলেন নীরবে দাঁড়িয়ে, অথচ তাঁর আশীর্বাদের প্রয়োজন তখনি ছিল বেশি!
মনে পড়ছে এ গ্রামের কৃতী নারী-পুরুষের কথা। এখানকার কেউ হয়েছেন নামকরা অধ্যাপক, কেউ আই. সি. এস., কেউ স্বাধীন ভারতের প্রতিনিধি হয়ে ইয়োরোপ গেছেন। এই গাঁয়ের একটি মেয়ে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি পেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন সর্বপ্রথম। তবুও বলব এঁরা গ্রামের মাটি থেকে বহুদিন থেকেই উৎপাটিত–প্রাণের যোগ তাঁদের নেই গ্রামের সঙ্গে। তাঁরা মহীরুহ, সামান্য ক্ষণের জন্যে বসা যায় তাঁদের ছায়ায়, কিন্তু আড্ডা জমাতে হলে যেতে হয় জেলেপাড়ার মহানন্দের বাড়ি, কিংবা প্রসন্ন মুদির দোকানে, না হয় বিশ্বম্ভর পালের হাঁড়ি গড়বার চাকের ধারে! তাদের সুখ-দুঃখই সারাগ্রামের সুখ-দুঃখ। তাদের প্রাণচাঞ্চল্য, তাদের আন্তরিকতা আজও নির্জন জীবনে রোমাঞ্চ জাগায়। মনে পড়ছে, সেবার অনাবৃষ্টি সম্বন্ধে আলাপ করতে করতে আমি বলেছিলাম যে, এবছর শীত যেমন দেরিতে এসেছে, বর্ষাও আসবে তেমনি দেরি করে। আমার কথা শুনে কালী ভুইমালী কারণস্বরূপ বলেছিল, ‘পাঁচ রবি মাসে পায়, ঝরায় কিংবা খরায় যায় সেদিন সত্যিই লজ্জা পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, কতকাল আগের গাণিতিক গবেষণার ওপর প্রতিষ্ঠিত খনার বচনকে যারা প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় অনুসরণ করছে তাদের ওপর পান্ডিত্য ফলাতে গিয়েছিলাম আমি। বাংলার লোকসংস্কৃতি তো এদের ভেতরেই ক্ষীণ হয়ে বেঁচে আছে আজ পর্যন্ত।
যে গ্রামে প্রতিমাসেই উৎসব থাকত লেগে, সেখানে আজ মানুষ খুঁজে বের করতে হয় শুনলাম। বাড়িঘর হয়তো দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঘন জঙ্গল গজিয়েছে উঠোনে, আগাছা জন্মেছে দেওয়ালে দেওয়ালে। সেই তেঁতুলগাছটাও কি আছে? ঝাঁকড়া ওই গাছের নীচে বসত আমাদের আড্ডা। মনে পড়লে হুহু করে প্রাণ, আপনাআপনিই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত অশ্রু। নির্বিঘ্ন জীবন কি আর আমরা ফিরে পাব না, সেইদিনের মতো কি আর আমরা বরুণ পুজোতে মেতে উঠতে পারব না ছেলে-বুড়ো মিলে? চৈত্র মাসে জলের জন্যে প্রার্থনা জানাতাম বরুণদেবের কাছে। চৈত্রের খর রৌদ্রের অবসানের জন্যে জলকাদা মেখে গ্রাম প্রদক্ষিণ করতাম দল বেঁধে। মেঘের দেবতাকে খুশি করবার মন্ত্র আওড়াতাম,
দেওয়ার মাললা মেঘারানি।
খাড়া ধুইয়া ফালা পানি।।
মেঘের উপর পুন্নিমার চান।
ঝপঝপাইয়া বিসটি লাম।।
সেদিনের এই মন্ত্র ছিল যেন অব্যর্থ। পাগলা হাতির মাতন নিয়ে ছুটে আসত মেঘ-বৃষ্টি ঝড়। জীবন হত শান্তিময়, নির্বিঘ্ন। আজকের মানুষের তাপিত প্রাণ কি ঠাণ্ডা হতে পারে না এই মন্ত্রে? আমাদের জীবনে কী নেমে আসতে পারে না আবার সেই আকাঙ্ক্ষিত শান্তিবারি? শান্তিময়, সুখীসচ্ছল দিন কি চিরতরে ছেড়ে গেল আমাদের? আজ বর্ষা নামলে বেলেমাছ ধরার কোনো উৎসাহই পাই না আর, অথচ একদিন রাতদুপুরে ছুটেছি ছিপ হাতে মৎস্য শিকারে! পদ্মা প্রমত্তা নদীর বুকে ডিঙি ভাসিয়ে গেছি মঠবাড়ির বড়োখালে। খালে খালে জেগেছে জীবনের ছোঁয়াচ, মাঠে মাঠে বাধাহীন জলধারা যাচ্ছে ছুটে, সে-ছবি আজও আমায় উতলা করছে! শ্মশানে প্রাণবসন্ত দেখা দিক আবার, আবার ছুটিয়ে নিয়ে যাক আনন্দ নিজের গ্রামে, শান্তিবারি ঝরে পড়ুক প্রতিটি মানুষের মাথায়। ভয় থেকে অভয়ের মধ্যে নতুন করে জন্মলাভ করুক দেশবাসী। জড়তা থেকে নবীন জীবনে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করুক ঈশ্বর! আর শুধু দিনযাপনের প্রাণধারণের গ্লানি সহ্য হয় না–নিশিদিন রুদ্ধঘরে ক্ষুদ্রশিখা স্তিমিত দীপের ধূমাঙ্কিত কালি জীবনের গায়ে কালি লেপন করছে, জীবন খন্ড খন্ড হচ্ছে দন্ডে পলে ভাগ হয়ে! রবীন্দ্রনাথের মতো আজ আমি শুধু প্রার্থনা করি,
শ্যেনসম অকস্মাৎ ছিন্ন করে ঊর্ধ্বে লয়ে যাও
পঙ্ককুন্ড হতে,
মহান মৃত্যুর সাথে মুখোমুখি করে দাও মোরে
ত্রিপুরা – বায়নগর চান্দিসকরা বালিয়া কালীকচ্ছ
কালের খেলনার মতো আমার সেই ছোট্ট গ্রামটির কথা আজ মনে পড়ে। মনে পড়ে কাঞ্চনফুল আর সোনালতায় মাটির পৃথিবীর সে অপরূপ হাসি– সোনালু গাছের ফলে (আঞ্চলিক ভাষায় বানরের লাঠি) ঘুঙুরের বোলের মতো মিঠে আওয়াজ আজও যেন স্পষ্ট শুনতে পাই। শ্রাবণের থমথমে আকাশের দিগন্তে মেঘের তম্বুরা যেন কোন খেয়ালি দেবতার বিদ্যুৎ-আঙুলের ছোঁয়ায় গুরু গুরু মন্ত্রে কাঁপছে–টিনের চালায় চালায় বৃষ্টির নূপুর বাজছে ঝমঝম করে; ধ্বনিবর্ণময় বর্ষার সে কী অপরূপ ঘনঘটা! আবছা আলো-আঁধারে চূর্ণবৃষ্টির ধূসর চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্বচরাচর যেন মনের কাছে আসত ঘন হয়ে। মনে পড়ে ক্ষান্তবর্ষণ শ্যামলী মৃত্তিকার বর্ণাঢ্য রূপশৃঙ্গার : কচি পাতার ফাঁকে-ফাঁকে সোনালি রোদের খিলখিল হাসি, বৃষ্টি-ধোয়া কনক চাঁপার উজ্জ্বল হরিৎ আভা। দুপুরের তীক্ষ্ণ রোদে উদার উন্মুক্ত আকাশ যেন গুণীর কণ্ঠের গভীর-গম্ভীর কোনো উদাত্ত রাগিণীর মতো দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত টানা। বৈরাগীর একতারার মতো মেঠো পথ চলে গিয়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তে ব্যাকুল বাউল-উতলা বাতাসে ফসলের গান; তৃণশীর্ষে সূর্যের গুঞ্জন।
আরতির ধূপছায়ার মধ্য দিয়ে দেখা ঝাপসা দেবী প্রতিমার মতো আজও চোখে ভাসছে আমার সেই ছোট্ট গ্রামটি–তার মধ্যে দেখেছি রূপকথার খুঁটেকুড়নি মায়ের নির্বাক বেদনার প্রতিমূর্তি। কালের একতারায় তাঁর অশ্রুর অশ্রুত রাগিণী যেন ডানা-ভাঙা পাখির মতো আজ কেঁদে কেঁদে ফিরছে।
গ্রামের নাম বায়নগর। ত্রিপুরা জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম। শোনা যায়, আসলে এর নাম ছিল নাকি ‘রায়নগর’। এ গাঁয়ের জমিদার ছিলেন রায়েরা। রায়বংশের শেষপুরুষ অঘোর রায়ের প্রতাপ ছিল দোর্দন্ড। পাকা সবরি কলার মত গায়ের রং, উন্নত ঋজু নাসা আর ভোজালির মতো একজোড়া তীক্ষ্ণ গোঁফ ছিল রায়ের। অঘোর রায় যেমন ছিলেন বাঘের মতো ভয়ানক তেমন তাঁর রাগও ছিল প্রচন্ড। আকস্মিক উত্তেজনার বশে একদিন তিনি এমন একটি কান্ড করে বসেন যার ফলে তাঁকে শেষপর্যন্ত এ গ্রাম ছেড়ে যেতে হয়।
ঘটনাটি সম্পর্কে জনশ্রুতি এরকম। বাড়ির লাগোয়া একফালি জমিতে তিনি নানা দূরদেশ থেকে প্রচুর অর্থব্যয় করে নানারকম বাহারি ফুলের চারা এনে লাগিয়েছিলেন। ফুল আর ফুলকপির চাষে ছিল তাঁর সমান আগ্রহ, সমান অধ্যবসায়। একদিন ভিন গাঁয়ের এক জমিদারনন্দনের সদ্য ক্রীত টাট্ট ঘোড়াটি মালির সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে বাগানে ঢুকে পড়ে। খবর শুনেই তো অঘোর রায়ের ব্রহ্মরন্ধ্রে বারুদ জ্বলে উঠল–দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দুর্গাপুজোর সময় যে খঙ্গ দিয়ে মহিষ বলি দেওয়া হত তাই নিয়ে ঝড়ের মতো ছুটলেন তিনি বাগানের দিকে। পেছনে পেছন ছুটল তাঁর স্ত্রী, পাইক, বরকন্দাজ আর সব। খঙ্গের শানিত চোখ দুটি রক্তের তৃষ্ণায় ধকধক করে জ্বলছে, আর জ্বলছে অঘোর রায়ের ভাঁটার মতো দুটি চোখ। বাগানে ঢুকেই তিনি একলাফে গিয়ে ঘোড়াটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অশ্বদেহ দ্বিখন্ডিত করে সেই প্রচন্ড খড়ের কিয়দংশ মাটিতে ঢুকে গেল। রাজগন্ধার উজ্জ্বল লাল রক্তের ছোপ–সবুজ ফুল শাখায় বীভৎস ক্ষতের মতো রক্তের চাপ–অন্তঃপুরিকাদের অস্ফুট আর্তনাদ আর পাইক বরকন্দাজের শোরগোল সে এক বিকট দৃশ্য। কাঁপতে কাঁপতে অঘোর রায় হলেন ধরাশায়ী। তার পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। জমিদারে জমিদারে এ নিয়ে শুরু হলে প্রচন্ড বৈরিতা। মামলা-মোকদ্দমা আর ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে বিপর্যস্ত হয়ে অঘোর রায় হলেন দেশত্যাগী। তারপর কালক্রমে রায়নগর রূপান্তরিত হল বায়নঘরে।
গ্রামটি মুসলমানপ্রধান–দু-দিকে মালীগাঁ আর থৈরকোলাতে হিন্দু প্রায় একজনও নেই। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে জীবনযাত্রার আদান-প্রদানের তাগিদে এমন একটি সহজ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল যে, কেউ কাউকে পর মনে করত না। গ্রামসুবাদে বয়ঃকনিষ্ঠরা পরস্পর পরস্পরকে দাদা, পুতি (কাকা), ঠাকুরভাই প্রভৃতি বলে ডাকত। এর আসল কারণটা প্রধানত অর্থনৈতিক। জীবিকার ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ ছিল যে, জীবনেও তার প্রভাব আসতে বাধ্য। গ্রামের হিন্দুদের মধ্যে যারা কৃতী পুরুষ তাঁরা প্রায় সবাই থাকতেন বিদেশে। এঁদের জোতজমি চাষবাসের ভার ছিল মুসলমান প্রধানিয়াদের হাতে। তাঁরা হাল-লাঙল দিয়ে জমি চষতেন, ফসল তুলতেন। যাঁরা বাড়িতে থাকতেন তাঁদের অর্ধেক ফসল দিয়ে দিতেন। এমনও হয়েছে যে, জমির মালিক হয়তো চিঠি লিখেছেন–তাঁর প্রাপ্য ফসলের মূল্য মনিঅর্ডার করে পাঠাতে। মুসলমান বর্গাদার প্রধানিয়ারা কড়াক্রান্তি হিসেব করে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন–কোথাও একবিন্দু ফাঁকি বা কারচুপি ছিল না। যেন মনে হত অলক্ষ্যে কোনো অদৃশ্য চক্ষু তাঁদের কারবার সব দেখছে–এমনি ধর্মভীরু আর নিরীহ ছিলেন তাঁরা। একটা নিশ্চিত বিশ্বাসের শক্ত জমিতে ছিল তাঁদের জীবনের ভিত, সদাসন্তুষ্ট কঠোর পরিশ্রমী আর নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেখেছি হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে কী অমায়িক আর প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করতে। আমার কাকা ছিলেন ডাক্তার। বাড়িতেই প্র্যাকটিস করতেন। সন্ধ্যাবেলায় তাঁর বৈঠকখানায় এসে জুটতেন একে একে হাজি বাড়ির বড়ো হাজি, উত্তরপাড়ার আকবর আলি, পাঞ্জৎ আলি, মুনশি গ্রামের প্রধানিয়ারা। গাছপিঁড়িতে বসে যেতেন এঁরা–মাটির মালসাতে (দেশে বলে ‘আইল্যা’) তুষের আগুন জিইয়ে রাখা হত টিকে ধরাবার জন্যে। গভীর রাত্রি পর্যন্ত চলত বৈঠক, আর চলত ছিলিমের পর ছিলিম তামাক। যুদ্ধের সময়টা এখানে ভিড় হত বেশি। সবাই যেন শুনতে চায় আশার বাণী, আশ্বাসের বাণী- সবাই যেন প্রাণপণে বিশ্বাস করতে চায় এ দুর্দিনের অন্ত আছে। ডাক্তার কাকার কাছে তাই অনেকে ছুটে আসত, তাঁর কাছ থেকে সমর্থনের বাণী শুনবার জন্যে। কেউ খেতে পাচ্ছে না–রোগে ওষুধ নেই, পথ্য নেই, ডাক্তারকাকা তাঁকে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বলিষ্ঠদেহ মুসলমান চাষিদের দেহে বুভুক্ষা আর অনাহারের ছাপ ব্যাণ্ডেজ খোলা পোড়া ঘায়ের মতো মুখে শুকনো হাসি–যেমন করুণ তেমনি বীভৎস। রাজনৈতিক আধি আর ঝোড়ো হাওয়ার অন্তরালে একটি সহজ সরল জীবনের সমতল ভূমিতে সবাই হাতে হাত মিলিয়ে চলত এখানে। আমাদের বাড়ির কিছুদূরেই ছিল হাজিবাড়ি। এ বংশের কোন পুরুষ কবে একবার মক্কা গিয়ে ‘হজ’ করে এসেছিলেন, তাই থেকে এরা সবাই হাজি’। বড়ো হাজির কথা আজ মনে পড়ে। মেহেদি রঙের দাড়ি আর চোখদুটিতে ছিল একটা সরল বিশ্বাসের ছাপ, চোখ এমন করে হাসতে জানে–একথা এর আগে আমার জানা ছিল না। শেষরাত্রে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের ‘আজান আমাদের পাতলা ঘুমের আস্তরণ ভেদ করে কানে এসে বাজত। আমাদের ভালো কোনো খবর পেলে এই মুসলমান বৃদ্ধটি সত্যি সত্যি খুশি হতেন–প্রাণখোলা হাসির ছটায় মেহেদি রঙের দাড়িতে একটা আলোর ঝিলিক ঠিকরে পড়ত যেন।
টুকরো-টুকরো কত ছবি আজ মনে পড়ে! মনে পড়ে স্বরূপদাস সাধুর কথা। একটা জীর্ণ আলখাল্লা গায়ে-হাতে খঞ্জনি আর কাঁধে শতচ্ছিন্ন ভিক্ষার ঝুলি। কিন্তু মুখে নিশ্চিত প্রত্যয়ের কী অপূর্ব প্রশান্তি এক পা ঊর্ধ্বে খঞ্জনি বাজিয়ে সে গাইত, ।
এতদিন পরে ঘরে এলি রে রামধন,
মা বলে ডাকে না ভরত,
মুখ দেখে না শত্রুঘন-ন-ন।
তখন অনুতপ্তা কৈকেয়ীর মর্মজ্বালা যেন যুগযুগান্ত পেরিয়ে আমাদের মনের ভেতর ছুঁয়ে যেত। বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে উঠোনে, স্বরূপদাস খঞ্জনি বাজিয়ে নেচে-নেচে গান গাইছে। বাড়ির কুকুরটা পর্যন্ত অবাক হয়ে দেখছে–মাঝে-মাঝে কান খাড়া করে বোধহয় গানও শুনছে। সকলে ফরমাশ করে যাচ্ছেন–স্বরূপদাস অক্লান্তভাবে গান গেয়ে চলেছে কখনো-বা দেহতত্ত্ব, কখনো-বা শ্যামাসংগীত, কখনো-বা কৃষ্ণ-রাধিকার বিরহ-মিলন-কথা। যাওয়ার সময় কয়েক মুঠো চাল, কারও দেওয়া কিছুটা ডাল এবং আনাজ ঝুলিতে পুরে গুনগুন করে চলে যেত স্বরূপদাস।
আমাদের গ্রামে সংকীর্তনের রেওয়াজ ছিল খুব বেশি। প্রতিসন্ধ্যাতেই কীর্তন হত। রমণী পালের হাত ছিল মৃদঙ্গের বোল ফোঁটাতে ওস্তাদ। সরু লিকলিকে চোহারা–চুলগুলি বড়ো বড়ো। কীর্তনের সময় মৃদঙ্গটি কাঁধে ঝুলিয়ে সে যেভাবে লাফাতে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাতে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। বড়ো-বড়ো চুলগুলি একবার এপাশে আর একবার ওপাশে কাত হয়ে পড়ছে, এক একবার এক-একটি প্রচন্ড লাফ দিয়ে সে যাচ্ছে ডান দিক। থেকে বাঁ-দিকে আর মৃদঙ্গের বোলে আওয়াজ উঠছে যেন গম্ভীর ওঙ্কারধ্বনির মতো। একবার জ্বরগায়ে অষ্টপ্রহর সংকীর্তনে মৃদঙ্গ বাজাতে গিয়ে রমণী পাল মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল অস্নাত, অভুক্ত অবস্থায়। কিন্তু তবু সে মৃদঙ্গ ছাড়েনি। কিন্তু আজ–আজ সে রমণী পালের। কাঁধে আর মৃদঙ্গ নেই-শান-বাঁধানো শহর কলকাতার পথে-পথে সে আজ ফিরি করে ফিরছে।
এক সময় আমাদের গ্রামে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালাকীর্তনের ঢেউ আসে। প্রথম পালাকীর্তনের অনুষ্ঠান হয় আমাদের বাড়িতে। উত্তরপাড়ার বংশী, খগেশ, নীরু, আবু–এসব ছেলেরা এতে অংশগ্রহণ করে। বলা বাহুল্য, সেদিন উত্তেজনা ছিল প্রচুর–আয়োজন ছিল না। সাজপোশাকের কোনো বালাই ছিল না। খগেশ নিমাই সন্ন্যাসের পালায় শ্রীরাধার ভূমিকায় অভিনয় করে। শুক-শারি এসে গাইছে,
ওঠ-ওঠ রাইশ
শীভোর হল অমানিশি
ও হরি! শ্রীমতী রাধিকা প্যান্ট পরেই সলজ্জ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে শুক-শারির প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্ত দর্শকসমাজ এমনি অভিভূত হয়ে ছিল যে, এতে তাদের বিন্দুমাত্র রসবোধের ব্যাঘাত ঘটেনি।
শচীমাতার বিলাপে হিন্দু-মুসলমান সকলের চোখ সজল হয়ে ওঠে। ভোর হতেই পালা শেষ হয়ে বের হল প্রভাতফেরি। কাঁপা-কাঁপা, টানা-টানা সুরে সে কী গান–আমাদের বাড়ির দ্বাররক্ষী ছিল দুটো বড়ো তেঁতুল গাছও তল্লাটে এত প্রকান্ড গাছ আর ছিল না। তার চিকনচিকন পাতার ঝালর ছিঁড়ে সূর্যের আঁকাবাঁকা আলো এসে পড়ছে; আলো আর সুরে কী নেশাই না সেদিন লেগেছিল।
আমাদের গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণে সাঁচার। সেখানকার রথযাত্রা’ আমাদের অঞ্চলে বিখ্যাত। প্রতিবছরই আমাদের বাড়ির নৌকা করে আমরা সবাই রথযাত্রায় যেতাম। সকাল সকাল খেয়ে-দেয়ে আমরা রওনা দিতাম। আশপাশে আরও কত নৌকা–কত দূরদেশ থেকে, কত ভিন গাঁ থেকে এরা আসছে। নৌকার ছইয়ের ওপর কারও কারও দেখছি জ্বালানি কাঠ বাঁধা–অর্থাৎ ২। ৩ দিন আগে থেকেই তারা রওনা দিয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় বাজার বা গঞ্জে নৌকা ভিড়িয়ে তারা আহারপর্ব সমাধা করে।
জগন্নাথদেব দর্শন ও রথের রশি ছোঁয়া নিয়ে ধর্মভীরু যাত্রীদের সে কী উন্মত্ত উন্মাদনা! কারও জামা ছিঁড়ে গেছে, রথের রশির কাদায় সর্বাঙ্গ চিত্রবিচিত্র হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেদিকে কারও লক্ষ নেই–মুখে শুধু ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি। অদূরে অপেক্ষমান মেয়েরা হুলুধ্বনি দিচ্ছেন, ক্রমাগত শঙ্খ-কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজ, নারীকন্ঠের হুলুধ্বনি জনতার জয়ধ্বনি মিলে মিশে একটি বিরাট শব্দস্তম্ভ রচনা করেছে যেন–চারিদিকে মানুষের কেবল মাথার সমুদ্র তার মধ্য দিয়ে চলেছে জগন্নাথের রথ। বিকেলের সূর্য তার ওপর আবির ছড়িয়ে দিচ্ছে মুঠোমুঠো। সে-দৃশ্য কি কখনো ভুলতে পারি?
রথযাত্রা শেষে যাত্রীদের বাড়ি ফেরার পালা। সন্ধ্যার অন্ধকার এসেছে ঘন হয়ে। নৌকায় নৌকায় সবাই ফিরছে–আর চারিদিকে খোঁজাখুঁজি চলছে যারা এখনও ফেরেনিঃ মাঝি তাদের হাঁক দিচ্ছে সন্ধ্যার শান্ত আবহাওয়ায় কাঁপা কাঁপা ঢেউ তুলে সে-ডাক আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা কেউ সদ্য ক্রীত মেলার বাঁশিতে তুলেছে বিচিত্র বেসুরো আওয়াজ–কেউ ধরেছে গান।
এমনি কত কথা–কত ছবি আজ মনে পড়ে। কত কথা বলব আর কত ছবি আঁকব? বুকের পাঁজর খুলে দিতে কী ব্যথা তা কি কেউ কখনো বলে বোঝাতে পারে? হয়তো এমন দিন আসবে, যেদিন স্বরূপদাসের সেই গান–সেই গান গেয়ে কেউ আমাদের জন্যে এগিয়ে এসে বলবে,
এতদিন পরে ঘরে এলি রে রামধন,
মা বলে ডাকে না ভরত, মুখ দেখে না শত্রুঘন–
সেদিন কতদূরে?
.
চান্দিসকরা
বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে : আমাদের কপালে যা আছে তাই ঘটবে, কিন্তু তুমি এ অবস্থায় কিছুতেই গ্রামে এসো না।
চিঠি পড়ে মনটা কেঁদে উঠল। আমার বাড়ি, আমার গ্রাম, আজ তার দ্বার আমার কাছে রুদ্ধ। যে পথের ধূলি মিশে রয়েছে আমার অস্তিত্বের সঙ্গে, যে গ্রামের জল-কাদা, আলো বাতাস গায়ে মেখে জীবনের পথে এক এক পা করে এগিয়ে এসেছি–আজ সে-গ্রামে ফিরে যাওয়া আমার নিষেধ, সেখানে আমি নিরাপদ নই!
চিঠিখানা চোখের সামনে পড়ে রয়েছে। উর্দু আর ইংরেজিতে লেখা টিকিটের মাঝখানে পাকিস্তানি ‘ন্যায়পরায়ণতার’ তুলাদন্ড আঁকা–তার ওপরে জ্বলজ্বল করছে আমার গ্রামের ডাকঘরের ছাপ। এই ডাকঘরের ওপর কী বিরাট আকর্ষণ ছিল। ডাক আসবার একঘণ্টা আগে গিয়ে ডাকঘরে বসে থাকতাম-কলকাতা থেকে খবরের কাগজ আসবে, বিভিন্ন জায়গা থেকে বন্ধুদের চিঠি আসবে–সারাদিনের একঘেয়েমির ভেতর এটা ছিল মস্তবড়ো সান্ত্বনা। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে রোজ বেলা দশটা-এগারোটার সময় ঝুনঝুন করে ঘণ্টা বাজিয়ে চলে যেত ডাক-হরকরা। ছেলেবেলায় সেই ঘণ্টার প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। যেখানেই থাকতাম, হরকরার ঘণ্টা শুনলেই ছুটে এসে দাঁড়াতাম রাস্তার পাশে। দেখতাম হাঁটুর ওপরে লুঙ্গি পরে, একটা খাকি শার্ট গায়ে দিয়ে ধুলোমাখা খালি পায়ে, ডাকের ঝোলা কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেছে হরকরা। কোনো কোনোদিন আমাদেরই পুকুরের শান-বাঁধানো ঘাটের পাশে, বকুল গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ত। ঘাটের একটা সিঁড়িতে ঝোলা রেখে নেমে যেত জলের মধ্যে, মুখ-হাত ধুয়ে মাথায় জল দিয়ে আবার রওনা হত– কাঁধের ঝোলা থেকে শব্দ আসত, ঝুনঝুন, ঝুনঝুন। ভট্টাচার্য বাড়ির কাছ থেকেই ডাকঘরের রাস্তা গেছে বেঁকে–তারপর হরকরাকে আর দেখা যেত না। কিন্তু তার ঘণ্টার অনুরণন তখনও বাজত আমার কানে। আজও তেমনি করেই হয়তো হরকরা ছুটে চলেছে। তার ঘণ্টা বাজিয়ে–এ-চিঠিখানাও সে-ই বহন করে এনেছে। কিন্তু তার সেই ঘণ্টা শোনবার জন্যে আমি আর সেখানে নেই!
সপ্তাহে দু-বার করে আমাদের যে বিরাট হাট বসে তার মালিক আমরা। হাটের খাজনা আদায় করবার ভার পাঁচজন ইজারাদারের ওপর–তারা সকলেই মুসলমান। প্রতি হাটবারে কয়েক সহস্র লোক জড়ো হয় বেচা-কেনার জন্যে। ছেলেবেলায় আমাদের হাটে যাওয়া বারণ ছিল–পাছে হারিয়ে যাই এই ভয়ে। হাটে যাবার একটা বড়ড়া পথ ছিল আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। সে পথের ধারে আমাদের পুকুর আর তার বাঁধানো ঘাট, সেই ঘাটে গিয়ে বসে থাকতুম। কত লোক হাটে যেত সে-পথ দিয়ে কেউ তরকারি নিয়ে, কেউ মনোহারি জিনিস নিয়ে, কেউ হাঁস-মুরগি নিয়ে, কেউ কাঠ-বাঁশ নিয়ে–এমনি কত সব দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওরা যেত। কুমোরপাড়া, তাঁতিপাড়া, কামারপাড়া ইত্যাদি অঞ্চলের শ্রমজীবী লোকেরা যেত তাদের নিজ নিজ জিনিস নিয়ে। বসে বসে আমরা দেখতুম। শেষবেলার দিকে ছুটত জেলেরা। দূর গাঙে ওরা চলে যেত মাছ ধরতে, তাই হাটে যেতে তাদের দেরি হত। মাছের ভারে নুয়ে পড়ত তাদের ইস্পাতের মতো দেহ, ঘামে নেয়ে উঠত প্রতিটি লোমকূপ। দৌড়ে দৌড়ে যেত ওরা–জেলেদের আস্তে হাঁটতে কখনো আমি দেখিনি। হাটের পথে যেতে যেতে কত কথা ওরা কইত–তার ভেতর রাজনীতি ছিল না, অর্থনীতি ছিল না, ঘরের কথা, দৈনন্দিন জীবনের ছোটোখাটো সুখ-দুঃখের কথা, আশা নিরাশার কথা–এ নিয়েই মন তাদের ভরে থাকত।
আগেই বলেছি আমাদের পুকুরের বাঁধানো ঘাটের দু-ধারে মস্তবড়ো দুটো বকুলগাছ। বকুল ফুল পড়ে ঘাটের চাতাল সকাল-সন্ধ্যায় সাদা হয়ে থাকত। তার মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত বাড়ির অন্দরমহল পর্যন্ত। ঘাটের যে সিঁড়িগুলো জল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তাতে বসে গ্রামের ব্রাহ্মণরা আহ্নিক করত দু-বেলা। আর ওপরের বিস্তৃত চাতালে মুসলমানরা পড়ত নামাজ। হাটবারে ঘাটটাকে বিশেষ করে ঝাড় দিয়ে রাখা হত–কারণ সেদিন কয়েকশো লোক আমাদের ঘাটে আসত নামাজ পড়তে। এক সারিতে ৪০। ৫০ জন দাঁড়িয়ে যেত। সারিতে দাঁড়ানো এতগুলো লোকের একই সঙ্গে ওঠা-বসার ভেতর কেমন একটা ছন্দের দোলন ছিল, যা আমার খুব ভালো লাগত। প্রতিদিন এমনি দৃশ্য দেখতে দেখতে তার ছাপ চিরতরে পড়ে গেছে মনের পর্দায়, সারাজীবন গ্রামছাড়া থাকলেও আমি তা ভুলব না। আজও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই হয়নি, আজও তারা একইভাবে আল্লার উপাসনা করছে আমাদের ঘাটে কিন্তু পাশে বসে আহ্নিক করবার মতো কেউ হয়তো আর নেই!
হাটবারে যে দুটো লোককে সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ত তারা হচ্ছে আমিরউদ্দিন আর মাখখু মিয়া। ওরা ছিল আমাদের হাটের ইজারাদার। হাট ভেঙে যাবার পর আমাদের জন্যে চিনেবাদাম, ছোলাভাজা ইত্যাদি খাবার নিয়ে রাত্রিবেলায় ওরা আসত। শীতের সময় পেতাম বড়ো বড়ো কুল। বহু বছর আগে বড়দার সঙ্গে আমিরউদ্দিন এসেছিল কলকাতায়। কলকাতার মতো শহর যে পৃথিবীতে থাকতে পারে এ ছিল ওর কল্পনার বাইরে। শেয়ালদা থেকে পথে নেমে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইল, বুঝতে পারল না সত্যি মাটির পৃথিবী, না রূপকথার স্বপ্নপুরী! কিন্তু তার পরের রাত্রিতেই আমিরউদ্দিন যা কান্ড করলে, তা ভেবে কতদিন আমরা হেসেছি। তখন রাত বারোটা কি একটা হবে–হঠাৎ ঝুপঝুপ করে করে বৃষ্টি নামল। তার আগের কয়েক মাস ভয়ানক খরা যাচ্ছিল–এতে ফসলেরও ক্ষতি হয়েছিল প্রচুর। বৃষ্টির আওয়াজ কানে আসতেই আমিরউদ্দিন ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। দাদাকে ডেকে বললে, বাবু, কাইলই আঁই বাড়ি যামুগই। খোদার দোয়ায় বৃষ্টি অইল, খ্যাতে লাঙল ফেলাইতে না পাইল্লে, এ-খন্দে আর চাইল ঘরে তুইলতে পাইতাম না উবাস মরুম। আরে ইস্টিশনে নিয়া কাইল সকালেই গাড়িত তুলি দি আইয়েন, বাবু। অনেক বোঝানো সত্ত্বেও আর একদিনের জন্যেও কলকাতায় থাকতে রাজি হল না আমিরউদ্দিন। মাঠের ডাক এসেছিল তার জীবনে, লিকলিকে ধানের শিষের সোনালি স্বপ্নের কাছে কলকাতার ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে গেল।
সেদিন আমিরউদ্দিনের বোকামি দেখে হেসেছিলাম–আজ বুঝতে পারছি গ্রামের আকর্ষণ গ্রামের ছেলের কাছে প্রবল, কত গভীর। দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের স্বপ্ন কোনোদিন কি ভুলতে পারব? ধান কাটা সারা হবার পর শুরু হত আমাদের ঘুড়ি ওড়ানোর পালা। কত ধুলো গায়ে মেখেছি, দৌড়তে গিয়ে কতবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছি–কত রক্ত মাঠের ধূলির সঙ্গে মিশে রয়েছে। সেই মাঠ পেরিয়ে দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যেতাম মনুমিয়ার বাড়ি। মনুমিয়া আখের চাষ করত, তার ওপর ছিল আমাদের লোভ!
রেজ্জাক মিয়ার খেজুরের রসও কি আমাদের কম প্রিয় ছিল! রাত্রে রস পড়ে হাঁড়ি ভরতি হয়ে থাকত সকালে সে-রস বিক্রির জন্যে পাঠানো হত গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে। আমাদের বাড়িতেও খেজুরের রস কেনা হত পায়েস বানাবার জন্যে। আমাদের মন কিন্তু তাতে ভরত না। রেজ্জাক মিয়া ভোরবেলা যখন গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামাত, আমরা গিয়ে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের লোলুপ দৃষ্টি দেখে রেজ্জাক মিয়া কিছু রস আমাদের মধ্যেই বিলিয়ে দিত।
ঘটা করে দুর্গাপুজো হত আমাদের বাড়িতে। পুজোর কটা দিন লোকজনের ভিড়ে সারাবাড়ি গমগম করত। পুজো উপলক্ষ্যে একদিন স্থানীয় বিশিষ্ট মুসলমান ভদ্রলোকদের
নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হত। পুজোর প্রসাদ তাঁরা খেতেন না, তাই তাঁদের জন্যে বন্দোবস্ত করা হত আলাদা খাবারের। পুজোমন্ডপের পাশেই আমাদের বৈঠকখানা ঘর। বিরাট আলোর ঝাড়ের তলায় পরিষ্কার চাদর আর তাকিয়া দিয়ে ফরাস পাতা হত। সকলে বসতেন সেখানে। আমরা ভয়ে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকতাম না–আশপাশে ঘুরঘুর করে বেড়াতাম। আশরাফউদ্দিন, সোনা মিয়া, কালা মিয়া প্রভৃতি সকলেই হলেন গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি। বহুকাল থেকেই আমাদের বাড়ির সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা এঁদের। আমাদের পূর্বপুরুষের সম্পর্কে কত গল্প শুনেছি এঁদের মুখ থেকে। পুজোর সময় জিনিসপত্র জোগাড় করে দেবার ভার থাকত এঁদের ওপর–কোন জিনিস কত পরিমাণ প্রয়োজন এঁরা সব জানতেন। এঁরা সকলেই চাষি–কিন্তু গুরুজনদের মতোই এঁদের আমরা সমীহ করে চলতাম। ভালোবেসে এঁরা আমাদের কচি মন জয় করেছিলেন।
এমনি কত শত সাধারণ দৈনন্দিন স্মৃতি আজ ভিড় করে দাঁড়িয়েছে মনের দ্বারে। ছেড়ে আসা গ্রামের ফেলে-আসা দিনগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছে আমার অন্তরলোকে। এদের কোনোটিই বিশেষ ঘটনা নয়–অতিসহজ-সরল, সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি কান্নার কথা। একদিন এর তেমন কোনো মূল্যই হয়তো আমার কাছে ছিল না, কিন্তু আজ তাকে হারিয়েছি, তাই সে হয়ে উঠেছে অমূল্য। একই গ্রামবাসী হিসেবে যুগ যুগ ধরে আমরা হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে এসেছি–শুধু ধর্মবিশ্বাস ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারার ভেতর আর কোনো তফাতই ছিল না। দেশে যখন সমৃদ্ধি এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্যে সমানভাবেই এসেছে। যখন বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারীর তান্ডব শুরু হয়েছে, তখনও হিন্দু-মুসলমানের জীবনে সমানভাবেই পড়েছে তার অভিশাপ। কিন্তু কোন এক অশুভ মুহূর্তে ঘোষণা করা হল : হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের শত্রু, এদের ভেতর কখনোই মিল হওয়া সম্ভব নয়। মুসলমান প্রতিবেশী নতুন চোখে তাকাল হিন্দু-প্রতিবেশীর দিকে। বললে, তুমি আমার শত্রু–এতদিন যে আমরা পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করে এসেছি, তা মিথ্যে– এতদিন যে বন্ধুর মতো, ভাইয়ের মতো ব্যবহার করেছি, তাও মিথ্যে –শত শত বছর ধরে তোমাতে আমাতে যে আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা কখনো সত্যি নয়! যে শত্রুতা হিন্দু-মুসলমানের ভেতর কোনোদিন ছিল না, দিনের পর দিন ধরে বিষাক্ত প্রচারের ফলে সে-শত্রুতা সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র একটি দুষ্ট রাজনৈতিক চক্রান্ত সফল করবার জন্যে।
সফল হয়েছে সে-চক্রান্ত। মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, ছল চাতুরির দ্বারা দেশকে করা হয়েছে দ্বিখন্ডিত। হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক ঐক্য, রাজনৈতিক ঐক্য, ভাব-ভাষা, চিন্তা-কল্পনা-সুখ দুঃখ হাসি-কান্নার ঐক্য নির্মমভাবে হার মানল ধর্মবিশ্বাসের অনৈক্যের কাছে। একটা জাতির জীবনে এর চেয়ে বড়ো অভিশাপ আর বোধহয় হতে পারে না। লক্ষ লক্ষ মুসলমানের লক্ষ লক্ষ প্রতিবেশী আমরা আজ হলাম ঘরছাড়া, দেশছাড়া!
কিন্তু এই ভৌগোলিক অস্ত্রোপচার আমাদের মনের নিবিড় ঐক্যকেও কি স্পর্শ করতে পেরেছে? না–পারেনি। কলকাতার নিষ্ঠুর নির্মম পরিবেশের মধ্যে মনের শান্তি কোনোদিন আমাদের আসবে না, আসতে পারে না। কলকাতার আকাশ-বাতাস, আলো-আঁধার, জল মাটি, গাছপালার সঙ্গে আমার গ্রামের প্রকৃতির তফাত, বৈজ্ঞানিকের চোখে হয়তো নেই, কিন্তু যে আলোতে প্রথম আমি চোখ মেলেছি, যে মাটি আমাকে বক্ষে ধরেছে, যে বাতাস ঘোষণা করেছে আমার জন্মবার্তা–তাকে আমি কেমন করে ভুলব, তার স্পর্শ যে আমার অস্তিত্বের অণুতে-অণুতে মিশে রয়েছে। আমার গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি জলবিন্দু, প্রতিটি লতাগুল্মের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আমার অন্তরের বাঁধন-একটা কলমের আঁচড়ে সে সবই কি মিথ্যে হয়ে গেল!
আমরা বাস্তুহারা, শরণার্থী–ভারতের দুয়ারে ভিক্ষাপ্রার্থী : এই আমাদের একমাত্র পরিচয় আজ। এই পরিচয়ের রক্তাক্ত টিকা ললাটে এঁকে কলকাতার পাষাণ-দুর্গের নিষ্ঠুর বন্ধনের মাঝখানে বসে আমি আজ অশান্ত মনে চেয়ে রয়েছি আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের দিকে।
রঘুনন্দন পাহাড়ের গা ঘেঁষে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত যে বিরাট ট্রাংক রোড চলে গেছে, তারই একধারে ত্রিপুরা জেলার দক্ষিণ প্রান্তে, কুমিল্লা সদরের অন্তর্গত আমার গ্রাম। নাম তার চান্দিসকরা। শুনেছি এককালে আমাদের গ্রামের নাম ছিল ‘চন্দ্র-হাস্য-করা, চান্দিসকরা তার সংক্ষিপ্ত রূপ। চান্দিসকরার আকাশ জুড়ে আজও চাঁদ হাসছে, প্রকৃতির সাজ বদল ঋতুতে ঋতুতে যথানিয়মেই চলেছে,বকুল ফুল পড়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে আমাদের বাঁধানো ঘাট, চাঁপা-টগর-রজনীগন্ধা-হাসুহানা-ডুইচাঁপার গন্ধে ভোরের বাতাস আজও চঞ্চল হয়ে উঠছে, আম-কাঁঠাল-জাম-জামরুলের ভারে গাছগুলো নুয়ে পড়ছে,-মাছের তান্ডবে অশান্ত হয়ে উঠছে দিঘির কালো জল, কালবৈশাখীর প্রলয় নাচন শুরু হয়ে গেছে আকাশে-বাতাসে– মুসলমান চাষিরা দিন গুনছে মেঘের আশায়, কবে বৃষ্টি হবে, কবে খেতে লাঙল পড়বে : এসব আমি আজ দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাঁতি-পাড়ার তাঁত আজ আর চলছে না, কুমোরের চাকা ঘুরছে না, কামারের লোহা জ্বলছে না, ছুতোরের বাটালি আজ নিস্তব্ধ! পৈতৃক ভিটা, পৈতৃক পেশার মায়া ত্যাগ করে তারা আজ দলে দলে হারিয়ে যাচ্ছে পূর্ববঙ্গের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভিড়ের ভেতর। আমিও তাদেরই সগোত্র–চলতে চলতে ভাবছি : উলটো রথের পালা আসবে কবে?
.
বালিয়া
নিশুতি রাত…কৃষ্ণাচতুর্দশীর সূচীভেদ্য অন্ধকারের মধ্য দিয়ে অতিসন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে। আমাদের নৌকাখানি। নৌকার ছই-এর-দু-দিকই আবৃত… সম্মুখভাগে বসে আপন মনে গান গাইছে প্রতিবেশী কাসেম ভুইঞা..পেছন থেকে লগি দিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছে যামিনী টিপরা। ছই-এর ভেতরে আমরা চারটি প্রাণী। সারাদিনের দারুণ অশান্তি আর উত্তেজনায় অবসন্ন! সর্বোপরি বর্তমানে জীবন পর্যন্ত সংশয়। কোনোক্রমে শহরে গিয়ে পৌঁছোতে না পারলে রাত্রিশেষে নররূপী পশুদের হামলা অবশ্যম্ভাবী–দিনের বেলায় গ্রামের মেয়েদের, বুড়োদের এবং শিশুদের শহরের নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ অঞ্চলে আমরা শুধু ছিলাম রাত্রির অবস্থা দেখে তারপর একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব বলে। কিন্তু গোধূলির ধূলি উড়বার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ, লুণ্ঠন ও জখমের সংবাদ এল-প্রান্তীয় বড়ো সড়ক ধরে মশালের সাহায্যে হামলাকারীর দল হই-হল্লা করতে করতে এগিয়ে চলেছে,–কোথাও-বা সারি সারি নৌকার সাহায্যে ওরা অন্তর্বর্তী বিল জলা প্রভৃতি পার হয়ে একের পর এক বাড়িতে হানা দিচ্ছে। এসব দৃশ্য আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়েই দেখা গেল। অবশেষে ওপাড়ার রহমন খাঁ এসে যখন জানাল রাত্রিতে আমাদের বাড়ি আক্রমণের প্ল্যান হয়েছে এবং চারদিকের আবহাওয়া বাগে এনে সর্বশেষে গ্রাম-কেন্দ্রের এই শক্ত ঘাঁটিটিকে বিপর্যস্ত করাই তাদের অভিপ্রায়–তখন আমাদের সম্মুখে নিরস্ত্রভাবে নিশ্চিত মৃত্যুবরণ কিংবা আত্মরক্ষার জন্যে আত্মগোপন এ দুটির একটি পথ শুধু খোলা রইল। রহমান জানাল, আমাদের বাড়িতে সম্প্রতি যে কয়েকটি বড়ো বড়ো বাক্স-প্যাঁটরা আমদানি করা হয়েছে তাতে বহু অস্ত্রশস্ত্র ছিল বলে ওদের বিশ্বাস,–তাই শক্তি পুরোদস্তুর সংগ্রহ করে তবেই ওরা এখানটায় হানা দেবে এবং সেটা এ রাত্রেই! কিন্তু ওদের বিশ্বাস বা সাময়িক ভয়ের কারণ যাই হোক, শূন্য বাক্স-প্যাঁটরা এবং নিছক বাঁশের লাঠির ওপর ভরসা করে আমরা চারিটি প্রাণী সহস্রাধিক ক্ষিপ্ত পশুর সম্মুখীন হবার সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। রাত্রিও প্রায় শেষ–অগত্যা কৌশলে পথের সুরক্ষিত ঘাঁটি পার হয়ে শহরে গিয়ে প্রাণ বাঁচানার পন্থাই সাব্যস্ত হল। প্রতিবেশী কাসেম খাঁর মস্তিষ্কের সুস্থিরতার কোনো প্রমাণই কোনোদিন পাইনি। আজ হঠাৎ এরকম দুঃসময়ে সে-ই অগ্রণী হয়ে এসে আমাদের নিরাপদে ঘাঁটি পার করে দেবার দায়িত্ব নিয়ে সত্যি অবাক করে দিল।
নৌকাঘাট ছেড়ে মাইলটাক দূরে ওদের ঘাঁটি। খালের এপারে-ওপারে ছাউনি ফেলে শিবির তৈরি করা হয়েছে। যেন একটি কাফেরও বিনাক্লেশে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে। দুপুরের দিকটায় এদের হাতেই ঘোষেদের বাড়ির নৌকাবোঝাই যাবতীয় মালপত্র লুষ্ঠিত হয়েছে, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে নৌকার যাত্রীদের যৎপরোনাস্তি লাঞ্ছনা করা হয়েছে।
কে যায়?–মেজাজি স্বরে প্রশ্ন আসে একটা ছাউনির মুখ থেকে।
আমি কাসেম ভূঁইঞা।–কে রে? ইসমাইল নিহি?-কাসেম গান থামিয়ে ওদের প্রশ্নের জবাব দেয় এবং নিতান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে প্রতি-প্রশ্ন করে।
আরে এত রাত্রে যাচ কই?–কাসেমের উত্তর : কই আর যামু,–যাই–রাইত পোয়াইলেই ত প্যাটের চিন্তা,–তার ব্যবস্থার লাইগ্যা।
কাসেমের ব্যাবসা দুধ বিক্রি। গৃহস্থ বাড়ির দুধ দাদন দিয়ে দীর্ঘকালীন বন্দোবস্ত নেয়, প্রত্যহ ভোরে তাই বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে শহরের মিষ্টির দোকানগুলিতে সে চালান দেয়। কাসেমের জবাবে ওরা সন্তুষ্ট হল, তাই আমাদের নৌকাও অবাধে বেরিয়ে এল সামনের দিকে।
এমনি করে সর্বনাশা ছেচল্লিশের এক নিশীথ রাত্রে মহাঅপরাধীর মতো নিজের পরমপ্রিয় পুণ্যতীর্থ জন্মভূমি, জন্মগ্রাম থেকে নিঃশব্দে বিদায় নিয়ে এলাম।… তারপর বছরের পর বছর কেটে গেছে–কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও সে-মাটির কথা ভুলতে পারিনি। আজন্ম যার আলো হাওয়া আমার জীবনকে বর্ধিত করেছে, যার মাঠ-ঘাট-বাট-বন অনুক্ষণ প্রভাবিত করেছে আমার মন, জ্ঞানোন্মেষের পর থেকে যাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অসংখ্য ঘটনা স্মৃতির ভান্ডার করেছে সমৃদ্ধ, মুহূর্তের তরেও তাকে ভুলি কী করে? আজও প্রতিমুহূর্তেই তাই শুধু পিছু-ডাক।
পূর্ববঙ্গের ভয়ংকর নদী মেঘনা। তারই পূর্বপারে অবস্থিত সুবৃহৎ রেল ও স্টিমার জংশন, বাণিজ্যবহুল বন্দর চাঁদপুর। আসামের কুলিধর্মঘটকে কেন্দ্র করে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের নেতৃত্বে চাঁদপুরের ঐতিহাসিক আন্দোলন, জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও সংগঠনকর্মে উৎসর্গীকৃত প্রাণ ভারতের প্রবীণতম, সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতাদের অন্যতম হরদয়াল নাগের কর্মসাধনা চাঁদপুরের পরিচয়কে ভারতের দূরতম প্রান্ত অবধি প্রসারিত করেছে। নতুন বাজার, খেয়া পার হলেই কয়েকটি পাটের কল, তার গা ঘেঁষে এঁকে বেঁকে রাস্তা চলেছে দক্ষিণমুখী, খানিকটা নীচু জমির হাঁটাপথ ছাড়িয়েই জেলা বোর্ডের বড়ো সড়ক সোজা চলে গেছে পূর্বে ও দক্ষিণে…এমনি চলতে চলতে শহরের কোলাহল যখন নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায় যখন প্রায় দু-ক্রোশ পথ পড়ে গেছে পেছনে, সামনে তখন ছায়ায় ঢাকা, পূর্বে ও পশ্চিমে, উত্তরে ও দক্ষিণে বৃক্ষরাজির আবেষ্টনীর মধ্যে ছায়াছবির মতো চোখে পড়ে একটি গ্রাম–’বালিয়া’ : লৌকিক নাম ‘বাইলা। আধুনিক সভ্যতা নিয়ে গর্ব করবার মতো কিছুই তার নেই, কিন্তু প্রকৃতির অফুরন্ত, অজস্র আশীর্বাদ যে তাকে অনুক্ষণ ঘিরে রেখেছে, গ্রামের সীমানায় পা। দিতেই যেকোনো পথিকের তা চোখে পড়ে। গ্রামটির প্রবীণতার সাক্ষ্য আর প্রতিক্ষণের জাগ্রত প্রহরীরূপেই যেন দাঁড়িয়ে আছে একটি সুউচ্চ তালগাছ আর তার পাশে জোড়া আমগাছ-গ্রামের ঠিক হৃদপিন্ডের ওপর,-সেনদের বাড়ির একেবারে সামনেটায়। জমিদার হিসেবে নয়, শিক্ষায় ও সামাজিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠ হয়েই এই বাড়ি দূরাতীত থেকে সসম্মান দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে প্রতিবেশী গ্রামগুলোর।
আমাদের বাড়ি বরাবর গ্রামের সমুখে সুবিস্তীর্ণ প্রান্তর, কোথাও উঁচু গাছপালা সূর্যদেবের আত্মপ্রকাশের পথকে অবরুদ্ধ করে রাখেনি। তাই প্রভাতের স্নিগ্ধতা আর সূর্যালোক মিলিয়ে যে দুর্লভ মাধুর্য প্রকৃতিদেবী দু-হাতে বিলাতে শুরু করেন, তার সম্মোহনে দলে দলে ছেলে মেয়ে ভিড় জমায় সেই আমগাছের তলায়; গাছের নবোদগত আম্রমুকুলে ঢিল ছোড়ে কেউ, কেউ বা অদূরে খালের হাঁটুজলে নেমে হাতমুখ প্রক্ষালন করতে থাকে।
চাঁদপুর জংশনে মেঘনা থেকে যে শাখা-নদীটি শহরটিকে দু-ভাগে ভাগ করে দিয়ে এগিয়ে গেছে সম্মুখপানে,–প্রায় সহস্র গজ পরেই তার রূপান্তর ঘটেছে প্রকান্ড খালে, ক্রমে আরও সংকীর্ণ হয়ে এই খাল বাণিজ্যবাহী জলপথরূপে শহরের সঙ্গে সহস্রাধিক গ্রামকে সংযুক্ত করে নোয়াখালির প্রান্তসীমায় গিয়ে মিশেছে। বর্ষায় তাই বাড়ির সম্মুখ দিয়ে সারি সারি চলমান নৌকার মজা দেখতে সকাল সন্ধ্যায় ছোটোদের ভিড় জমে, বড়োদের মধ্যে যাঁরা বিদেশবাসী, গাঁয়ে এসেছেন ছুটি-ছাটা উপলক্ষ্যে, খালের পাড়ে এখানে সেখানে দু-জন চারজন করে দল বেঁধে পলিটিক্স চর্চা করছেন তাঁরা। জিন্না বড়ো পলিটিশিয়ান কি গান্ধি বড়ো, সূর্য সেন-অনন্ত সিং-এর আমলই ছিল ভালো কিংবা সত্যাগ্রহই এনে দেবে বাঞ্ছিত স্বাধীনতা, পড়য়া হাল পটিশিয়ানদের মধ্যে তাই নিয়ে চলে অফুরন্ত বাক-বিনিময়।
…এই মাঝি, নৌকা থামাও। হঠাৎ হরিমোহন পরামানিক খালের পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একরকম খালের জলে নেমেই একটা নৌকার ছই শক্ত হাতে টেনে ধরে।
কী অইল বাবু?–ছই-এর ওপর থেকে সশঙ্ক হয়ে প্রশ্ন করে মাল্লা আর পেছন থেকে মাঝি একই সঙ্গে।
কী অইল? মাঠের মধ্য দিয়া পাল তুইল্যা যাইতেছ, জানো না পাল তুইল্যা গেলে হেই জমিতে আর কোনোদিন ফসল অয়না?
ও হো,–এই নামা-নামা, পাল নামা।–মাঝির নিজেরও হয়তো চাষবাস আছে, তাই শস্যক্ষতির আশঙ্কাটা তার মনে সহজেই প্রবল নাড়া দেয়।
বর্ষার নতুন জলে খালে মাছ ধরার কী আনন্দ! পুঁটি, ট্যাংরা, বাতাসি আর কাজলী-বজরীর ঝাঁকিজালের ফাঁকিতে না পড়ে উপায় কী? জোছনা রাতে চাঁদা মাছগুলো চাঁদের আলোকে ঝিকমিক করে ওঠে জালের ফাঁকে ফাঁকে। অমাবস্যায় পাকা ধরুয়াদের হাত যেন অবলীলাক্রমেই অন্ধকারের মধ্যে জাল থেকে রকমারি মাছগুলোকে খুলে নেয়-কাঁটার ঘা লাগে না। প্রায় প্রত্যহ সন্ধ্যায় কালবৈশাখীর দৌরাত্ম্য। তারই মধ্যে বেপরোয়া হয়ে মাছ ধরা চলে,–মাঝে মাঝে কেবল কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে একজন অপরজনের অবস্থিতি জেনে নেয়।
সন্ধ্যা হতে-না-হতেই পাড়ায় পাড়ায় শিশুদের কাঁসর-ঘণ্টাধ্বনি আর অবিশ্রান্ত কলরব মুখরিত করে তোলে গ্রাম। মাঝে মাঝে খোল-করতাল নিয়ে দল বেঁধে এপাড়া থেকে ওপাড়া, এবাড়ি থেকে ওবাড়ি। আমাদের গ্রাম-পরিবেশের এ ছিল এক আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
মাঝে মাঝে পালা সংকীর্তনের আসর জমে উঠত আমাদের বাড়িতে কিংবা আমাদের জ্ঞাতিবাড়ি পশ্চিমের বাড়িতে। গাইয়ে–’বাইলার দল’! আমাদের গ্রাম ও প্রতিবেশী গ্রামের প্রায় দু-ডজন কীর্তনীয়া আর কীর্তন-রসিক নিয়ে গড়া এইদল। বছর পাঁচ পুরোদস্তুর ট্রেনিং দিয়ে এরা সত্যিকারের একটা ভালো দল খাড়া করেছে।–’রাধার বিচ্ছেদ’ ‘নিমাই-সন্ন্যাস, ‘মানভঞ্জন’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘নৌকাবিলাস’–প্রতিটি পালাগানের যেমন মর্মস্পর্শী রচনা, তেমনই তার সুর।
পুবের হিস্যার সোনাদার বার্ষিক শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সন্ধ্যায় পালাকীর্তনের ব্যবস্থা। ত্রিপল টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে বিরাট উঠোনের ওপর। বসবার ঠাঁই শতরঞ্চি আর মাদুর ইতিমধ্যেই শ্রোতৃসমাগমে ভরে গেছে। তা ছাড়া একপাশে গাছপিঁড়িতে অত্যন্ত আগ্রহভরে বসে আছেন আমাদের অশীতিপর বৃদ্ধ প্রতিবেশী ও প্রজা মেহেরুল্লা খাঁ এবং তাঁর আশপাশে ইসমাইল শেখ, হরমোহন খাঁ, হামির ভুইঞা, ইয়াসিন গাজি, কলন্তর খাঁ, রহমান এবং আরও বহু মুসলমান। ফরমায়েশ হল, ‘নিমাই সন্ন্যাস’ হোক!
দলপতি জগদীশ চন্দ আর রমেশ নাহা, মূল গায়েন হরিচরণ মহানন্দ, বায়েন (খোল বাজিয়ে) বিভূতিদা, ওরফে বিভূতি পাগলা, দোহারদের মধ্যে প্রধান অনন্ত আর শিশির কাকা–কালু, ব্রজেন্দ্ৰকাকা, ছোট্টকাকা এঁরা দ্বিতীয় পঙক্তির। আর একজন আছেন চিত্তদা। তিনি ক্ষীণদৃষ্টি, সত্যি কোনোদিন কোনো গান গেয়েছেন কি না সঠিক কেউ বলতে পারে না। তাহলেও কথা এবং সুরের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখভঙ্গি অব্যর্থরূপে প্রমাণ করে তাঁর কীর্তনপ্রিয়তার কথা। আসলে কীর্তনপ্রিয়তাও তত বড়ো কথা নয়, যত বড়ো কথা হচ্ছে দলের লিষ্টিতে নাম রাখা! তবে চিত্তদা কিন্তু গল্পরসিক। শুধু রসিক নন, গল্পস্রষ্টা! বারোহাত কাঁকুড়ের তেরোহাত বিচি আর তিলকে তাল করার অসংখ্য গল্প মুহূর্তে বানিয়ে গানের ফাঁকে ফাঁকে আসর জমাতে তাঁর জুড়ি নেই! হরিচরণ হাতের করতালসহ হাত দুটি তুলে সভ্যগণ’ সমীপে নমস্কার জানিয়ে শুরু করে,
বাছা নিমাইরে,–বাছা নিমাই,
কোথায় গেলি রে,
দুঃখিনী মায়েরে ফেলে!
কণ্ঠ যেমন তীক্ষ্ণ, তেমনি মধুর। প্রধান দোহার অনন্তও মোটেই ‘ফ্যালনা’ নয়। ওদিকে বায়েন বিভূতি পাগলা এ তল্লাটের ওস্তাদ খোল বাজিয়ে। তাঁর খোল সত্যিই কথা কয়–আর এই খোল সহরতে তার নৃত্যের অপূর্ব ভঙ্গিমা বাইলার দলের প্রধান আকর্ষণ। উপযুক্ত সঙ্গতের মধ্যে গান সহজেই জমে ওঠে। দ্রুততালে তখন গানের অপর একটি কলি গাওয়া হচ্ছে,
নিমাই তোরে কোলে লব,
সব দুঃখ পাশরিব,
বড়ো আশা করেছিলাম মনে–
নিমাই রে!
গান শুনতে শুনতে পুত্রশোকে শোকাতুরা দক্ষিণহিস্যার মণিদি সুরের মূর্ঘনায় মূৰ্ছিতা হয়ে পড়ে! তাঁকে নিয়ে উদব্যস্ত হয়ে ওঠেন মেয়েরা। গান চলতেই থাকে। গায়েন, বায়েন, দোহার, শ্রোতা কেউ যে তখন আর এ জগতে নেই! অদ্ভুত অপূর্ব রসানুভূতি– আজও যার রোমাঞ্চ জাগে দেহে ও মনে।
সেনদের বাড়ির দোলউৎসব সুবিখ্যাত। সর্বজনীনতার মাধুর্য দিয়ে মন্ডিত এ উৎসবের প্রতিটি অঙ্গ। গ্রামের সবাই, এমনকী আশপাশের গ্রামেরও বহু ছেলে-বুড়ো বর্ষঘুরে আসতেই এ উৎসবের প্রত্যাশায় দিন গুনে চলে। পুজোর আনন্দ, আবিরের ছড়াছড়ি তো আছেই–তা ছাড়াও অষ্টপ্রহর সংকীর্তনান্তে মহোৎসবের খিচুড়ি আর লাবড়া! সেদিন সারদা পিসি এসে ধরে পড়লেন উদ্যোক্তাদের–তাঁর গুরুঠাকুর এসেছেন, মহোৎসবের পর তাঁকে দিয়ে শ্রীশ্রীগীতা পাঠ করাতে হবে। অতিউত্তম প্রস্তাব, মুহূর্তে পশ্চিম হিস্যার বাঁধানো বারান্দায় একটা বেদির মতো তৈরি করে দেওয়া হল, তার ওপরে বসলেন পন্ডিত কমলাকান্ত কাব্যতীর্থ। সুপুষ্ট বলিষ্ঠ দেহ, গৌরকান্তি, মুখাবয়বে জ্ঞান-গভীরতার ছাপ সুস্পষ্ট। মেয়েদের মঙ্গলশঙ্খধ্বনির পর তাঁর গুরুগম্ভীর কণ্ঠ থেকে ধ্যানমন্ত্র উচ্চারিত হতে থাকে,
মূকং করোতি বাঁচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম
যকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ মাধবম।
তারপর বেছে বেছে কয়েকটি শ্লোক পাঠ আর বাংলায় তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন পন্ডিতমশায়। শ্রোতৃবৃন্দ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে অমৃতময়ী শ্রীভগবানবাণী-সারগর্ভ জীবনদর্শনের মধুর ব্যাখ্যান। হঠাৎ টিপরার ‘জুম’ সর্দার কৈলাস সভায় ছুটে এসে ডুকরে কেঁদে ওঠে –’আমার জোয়ান মর্দ ছেলেটি তিন দিনের জ্বরে মারা গেল!’ সভাস্থল থেকে একটা তীব্র বেদনার ধ্বনি উত্থিত হয়। বিভূতিদা, যামিনীকাকা ও আমরা জনকয়েক মিলে কৈলাসকে সান্ত্বনা দিতে দিতে নিয়ে যাই স্থানান্তরে, কেউ কেউ লেগে যায় শ্যামমোহনের সৎকারের ব্যবস্থায়।
এ অঞ্চলে অনেক টিপরার বাস। চেহারায় টিপরাদের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে, তাই ওরা ত্রিপুরার আদিম অধিবাসী বলে দাবি করে। ফরসা রং ছাড়া কালো রং একজনেরও নেই ওদের মধ্যে, অদ্ভুত শক্ত বাঁধন দেহের, যেন লোহা পিটিয়ে গড়া হয়েছে। যতদূর জানা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষগণ এদের প্রজাস্বত্ব দিয়ে এনেছিলেন গ্রামরক্ষী ও বিশ্বাসী অনুচররূপে। এদের সকলের পদবিই ‘সিং’-কৈলাস সিং, মিষ্ট সিং, যামিনী সিং, রমণী সিং, কামিনী সিং, এমনি সব নাম। মেয়েরাও পুরুষদের মতো সমান পরিশ্রমী ও বিনয়ী। সাধারণত ওরা কয়েকটি পরিবার দল বেঁধে একজায়গায় ছোটো ছোটো কুঁড়ের মধ্যে বাস করে। এই বাস-ব্যবস্থাকেই বলা হয় ‘জুম’। প্রায় প্রত্যহই বিকেলের দিকে আমরা বেড়াতে যেতাম কোনো-না কোনো জুমে। টিপরাদের সঙ্গে আলাপে অফুরন্ত আনন্দ পেতাম। ওদের সরলতা, সৎসাহস, আতিথেয়তার কথা আজ বড়ো বেশি করে মনে পড়ে।
এগ্রামে অধিকাংশই টিনের ঘর। পাকা ঘর শুধু একটি–আমার খুল্লতাত তার মালিক। দোতলা দালান, দক্ষিণ খোলা, অবিশ্রান্ত হাওয়ার আনাগোনা, তারই লোভে সন্ধ্যার দিকে ছেলে-বুড়ো জমায়েত হয় কাকার শান-বাঁধানো বারান্দায়। আজগুবি গল্পে জমে ওঠে ভরা বৈঠক। প্রধান গল্পকার এবাড়ির অর্ধশতাব্দীর পুরাতন ভৃত্য সুধন্য। এমনি সময় যথারীতি ডাক পড়ে কবিয়াল গৌরাঙ্গের–বৃদ্ধ দীনদয়ালের বড়ো ছেলের। গৌরাঙ্গ আমাদের দু-বাড়ির কোনো-না-কোনো হিস্যার কাজে আছেই, যদিও কেবল খোরাকি দিয়েও কোনো এক হিস্যা তাকে একনাগাড়ে দীর্ঘদিন রাখতে নারাজ। গৌরাঙ্গের পৈটিক দাবিটা বড়ো মাত্রাতিরিক্ত, ওদিকে কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। তবু তার সরল নির্বুদ্ধিতার জন্যেই সবাই তাকে ভালোবাসত। তাই বেকার হতে হয়নি তাকে কোনোদিন। গৌরাঙ্গ নিজেকে কবির দলে সরকার (কবিয়াল) বলতে গর্ববোধ করে। কোন কোন বিখ্যাত কবির দলে সে শাকরেদি করেছে তার ইতিহাসও সে নির্ভুল বলে দিতে পারে। আমরা অবশ্য জানতাম, কবি অক্ষয় সরকারের দলে থেকে ফুটফরমাশ খেটেছিল ও মাসখানেক, ব্যস, ওই পর্যন্তই তার শাকরেদি!
অমৃত হালে বিভূতি বায়েনের সাকরেদ হয়েছে। আমাদের পরামর্শমতো সে খোলে চাঁটি মারতেই গৌরাঙ্গ শুরু করে,
রামগুণাগুণ বাদ্য বাজে
গোবর্ধনের বাড়ি হে,
(আমরা দোহাররা : রামগুণাগুণ বাদ্য বাজে…)
গোবর্ধনে অম্বল খায়
হাপপুর হুপপুর হে।
মুহূর্তে দারুণ হাসির রোল পড়ে যায় ‘অম্বল’ খাওয়ার দাপটে!
আশ্বিন মাসের শেষ। দুপুরে বাড়ির বৈঠকখানার সামনে একটা বড়ো আমগাছতলায় মাদুর পেতে বসে একদিন গল্প করছিলাম আমরা জনকয়েক মিলে। এমনি সময় চন্ডীপুর (নোয়াখালি) থেকে হরেনকাকা এমন একটা সংবাদ এনে হাজির করলেন যা দুঃস্বপ্নেরও অতীত বলে বোধ হল। তিনি জানালেন, ওই অঞ্চলে দলে দলে ক্ষিপ্ত মুসলমান কয়েকটি বাড়িতে হানা দিয়ে সমস্ত ঘর অগ্নিদগ্ধ করেছে, লুণ্ঠন করেছে জিনিসপত্র, গোরুবাছুর পর্যন্ত। দুটি রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের সংবাদও দিলেন তিনি, আর বললেন সর্বত্র এই আগুন ছড়াবার জন্যে সভাসমিতিতে প্রচারও চলছে। চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে-না-হতেই খবর পেলাম পাশের গ্রামে অগ্নিকান্ড আর লুঠতরাজের। বেলাবেলি মেয়েদের, বুড়োদের আর শিশুদের সরিয়ে দেওয়া হল নিরাপদ স্থানে–শহরের আইন-শৃঙ্খলার মধ্যে। রাত্রিশেষে দশসহস্রাধিক মানুষের গ্রামকে শ্মশানপুরীর নিস্তব্ধতার মধ্যে নিঃশেষে শূন্য করে দিয়ে আমরা তরুণরাও জন্মভূমি, জন্মগ্রাম থেকে বিদায় নিলাম। শত শতাব্দীর ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল যে ইতিহাস, বর্বরতার হিংস্র অভিযান তাকে চুরমার করে দিল নিমেষে। ইতিহাসের এই ছিন্নসূত্র আবার কোনোদিন জোড়া লাগবে কি না কে জানে!
.
কালীকচ্ছ
গ্রাম-প্রাণ আমাদের বাংলাদেশ। অসংখ্য গ্রাম পূর্ব বাংলায়। আমরা ছেড়ে এসেছি সেসব গ্রাম। সেসব ছেড়ে-আসা গ্রামের মধ্যে কালীকচ্ছ একটি নাম–সে অন্যতমা, সে অনন্যা সে আমার গ্রাম-জননী। পূর্ববাংলার আর সব গ্রামের মতোই জল-বাতাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমার কালীকচ্ছ মহিমাময়ী। আর সবাইয়ের মতো আমারও দেহ-মনে শিহরন জাগে বহুস্মৃতি-বিজড়িত সেই জন্মগ্রামের কথা ভাবতে। মায়ের মতো করে সেই গ্রামই যে আমায় শিখিয়েছিল সংগ্রামময় এই পৃথিবীতে সংগ্রামী হয়ে বেঁচে থাকতে। আজ তাই তার অভাব মনকে পীড়িত করে, করে তোলে বিষাদ-ভারাক্রান্ত। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি বড়ো কর্মকেন্দ্র ছিল কালীকচ্ছ। মুক্তিযুদ্ধের সেই ইতিহাসে কালীকচ্ছের অবদান বড়ো কম নয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ ভারত ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় সংযোজনায় সাময়িকভাবে হলেও সে আজ বঞ্চিত।
আজ থেকে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার কথা। সেই ছোটোবেলার কত স্মৃতিই না আজ হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। আমাদের বাড়িকে বলা হত রামপ্রসাদের রামের পুরী। সাতমহল বাড়ি। তাতে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ একটা পুরোনো মন্দির। শেয়াল শিকার করতে গিয়ে একদিন একটা কুকুর নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম সেই মন্দিরে। কিন্তু শেয়াল ধরা পড়েনি সেখানে। তাহলেও সেই মন্দিরে পাওয়া গেল একটি সুরক্ষিত বাক্স। খুব খুশি মনেই সেই বাক্স নিয়ে আমি ফিরে এলাম। প্রাণের ভয়ে যে মন্দিরের ধারে কাছেও যায় না কেউ সেখানে যাওয়ার কথা বাড়িতে খুলে বলাও তো মুশকিল। ও মন্দির নাকি ছিন্নমস্তার। কোনো এক সন্ধ্যায় ওই মন্দির থেকে এক ছিন্নমস্তা মূর্তিকে বার হয়ে যেতে দেখে আমাদেরই এক প্রপিতামহী নাকি চিরতরে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। সেই থেকেই মানববর্জিত এই মন্দিরে অপদেবতার ভয়ে কেউ প্রবেশ করতে সাহস পায় না। সেই মন্দিরে বাক্সটি দেখে ভাবলাম হয়তো ওই দেবতারই ধনরত্ন রাখা আছে তাতে। সাগ্রহে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাক্সটি খুলেই বাবা কীরকম গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং এ নিয়ে বেশি হইচই করতে বারণ করে দিলেন।
বাক্সটিতে যা জিনিসপত্র ছিল তা নিয়ে দেখানো হল স্বগৃহে অন্তরিন প্রমথনাথ নন্দীকে। তিনি বললেন, ওগুলো তাজা কার্তুজ, গ্রামের বিপ্লবীদের সম্পত্তি। আমার বড়ো ভাই এনে ওইখানে রেখেছিলেন।
তখন প্রমথবাবু ও অন্যান্য কয়েকজন যুবকের গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখবার জন্যে গ্রামে গুপ্তচর ঘোরাফেরা করত। পুলিশ একবার খোঁজ পেলে হাজতে যেতে হবে সকলকেই। তাই বাক্সটি ফেলে দেওয়া হল পচা-ডোবার মধ্যে।
বিপ্লব আন্দোলনে আমাদের গ্রামের যুবকরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এসেছে প্রথম যুগ থেকেই। শ্রীঅরবিন্দ আমাদের গ্রামে পদার্পণ করেছিলেন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। পল্লি-মানুষের মনে বিপ্লব-বহ্নির ছোঁয়া লাগানো ছিল উদ্দেশ্য। বিপিনচন্দ্র পালও দু-বার আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন–কয়েকটি সভায় বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামেই জন্মেছিলেন মানিকতলা বোমা মামলার বিপ্লবী বীর উল্লাসকর দত্ত। ওই মামলা তখনও চলছে। ধরা পড়লেন আমাদের অশোক নন্দী। মামলায় জড়াবার আগেই মৃত্যু তাঁকে সরিয়ে নিলে। পরবর্তীকালে কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার ব্যাপারেও আমাদের গ্রামের বহু যুবক-যুবতি ধৃত ও অন্তরিন হয়েছিল। এক পুলিশের চরকে গুলি করা হয় আমাদের গ্রামে। সে ছিল মুসলমান। গুলি করেছিল আমাদের গ্রামেরই বিরাজ দেব। এ মামলায় ও আর একটি মামলায় তার জেল হয়েছিল মোট ৪৫ বৎসরের। মুসলমান গুপ্তচরকে মারার জন্যে সেদিন মুসলমান বন্ধুরাই সাহায্য করেছিল হিন্দুদের।
গ্রামের সভা-সমিতি ও আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল মহেন্দ্র নন্দীর বাড়ি। মহেন্দ্র নন্দী ছিলেন অশোক নন্দীর পিতা ও উল্লাসকর দত্তের মামা। মহেন্দ্রবাবুকে মহাপুরুষ বলেই জানতাম। তিনি হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। তাঁর ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়নি, এরকম বড়ড়া একটা শোনা যায়নি। তাঁর হাতের পরশ পেলেও নাকি রোগী সুস্থ হয়ে যেত। অনেক দূর দেশ থেকে দুরারোগ্য সব ব্যাধি নিয়ে বহু লোক আসত। কলকাতা থেকেও অনেকে ডেকে নিয়ে যেত তাঁকে। বিখ্যাত সেতারি আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর বড় ভাই আয়েতালি খাঁ ছিলেন মহেন্দ্রবাবুর শিষ্য।
মহেন্দ্রবাবু শুধু ডাক্তার ও স্বদেশি আন্দোলনের নেতাই ছিলেন না, স্বদেশি জিনিস প্রস্তুতের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রপথিক। এক ধরনের দেশলাইয়ের কল আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাঁর। ঝিনুক এবং নারকেলের মালার বোতাম তৈরির কলও আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। বাড়িতে তাঁর বিরাট কারখানায় দেশলাই, বোতাম ও তাঁতের কাপড় তৈরি হত। বহু বাঙালি তাঁর আবিষ্কৃত দেশলাইয়ের কল নিয়ে ব্যাবসা শুরু করেছিল।
মহেন্দ্রবাবু ছিলেন ব্রাহ্ম। মহেন্দ্রবাবুর বাবা আনন্দ নন্দী, কৈলাস নন্দী এবং আরও কয়েকজন একসঙ্গে ঢাকায় কেশবচন্দ্র সেনের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। দীক্ষাগ্রহণের পর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এসে বহুদিন আনন্দ নন্দীর বাড়িতে বাস করেছিলেন। আনন্দ নন্দী ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। তাঁর সম্বন্ধে অনেক কাহিনি এখনও কালীকচ্ছের ঘরে ঘরে প্রচলিত আছে।
এই সেদিন আমাদের মাস্টারমশাই বৃদ্ধ নিকুঞ্জবিহারী দত্ত বললেন যে, আনন্দ নন্দী সম্বন্ধে নানা কথা শুনে তাঁরা তিন বন্ধু মিলে একবার তাঁর কাছে গেলেন। উদ্দেশ্য, পরীক্ষায় পাশ করবেন কি না তাই জানা। তিনজনই তখন আই.এ. পরীক্ষা দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন। তাঁরা প্রশ্ন করবার আগেই আনন্দ নন্দী বললেন, ‘তোমরা যা জানতে এসেছ তা আমি একটু পরে বলব।’ বলে তিনি ধ্যানে বসলেন। ধ্যান শেষ হলে বললেন, তিনজনের মধ্যে নিকুঞ্জবাবু পাশ করবেন, একজন ফেল করবেন, তৃতীয় জন পরীক্ষাই দিতে পারবেন না। এই তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীই ফলে গিয়েছিল।
মৃত্যুশয্যায় আনন্দ নন্দীকে তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো চললে, আমার কী হবে? আনন্দ নন্দী জবাব দিলেন, তিন দিনের মধ্যে তুমিও আমার কাছে আসছ। মৃত্যুর পর আনন্দ নন্দীকে সমাধিস্থ করতে দিলেন না তাঁর স্ত্রী। বললেন, তিন দিন পর যেন তাঁদের উভয়কে একসঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়। নিজে বৈধব্যের বেশও পরলেন না। শান্ত মনে স্বামীর কাছে। যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলেন। তিন দিনের দিন তিনি হঠাৎ প্রাণত্যাগ করলেন। সাড়ম্বরে তাঁদের উভয়কে সমাধিস্থ করা হল। দয়াময়ের নাম প্রচারের জন্যে সেই সমাধির ওপর মহেন্দ্রবাবু একটি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সেই মন্দিরে নিয়মিত উপাসনা হত সকালে-সন্ধ্যায়। কাঙালিভোজন হত প্রত্যহ।
ওই মন্দিরটি ছাড়া কালীকচ্ছে আরও একটি ব্রাহ্ম মন্দির ছিল। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্যারীনাথ নন্দী। এত অধিক সংখ্যক ব্রাহ্ম হয়তো কাছাকাছি অন্য কোনো গ্রামে ছিল না। আনন্দ নন্দীর পিতা রামদুলাল নন্দী ছিলেন দেওয়ান। তাঁর রচিত অনেক গান একসময় মুখে মুখে ফিরত। রামদুলাল নন্দী নিজের জন্যে এক বিরাট পাকাবাড়ি তৈরি করলেন। তাতে কোঠাই ছিল কুড়িটি। দুই পাশে দুই পুকুর। তাতে বাঁধানো ঘাট আর সামনে বিরাট নাটমন্দির। বাড়ি তৈরি সম্পূর্ণ হবার পরে তাঁর গুরুদেব এলেন বাড়ি দেখতে। বাড়ি দেখেই তিনি মুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং তা শুনে রামদুলাল গুরুদেবকে বাড়িটি দান করে দিলেন।
ত্রিপুরা জেলার সবচেয়ে বড়ড়া, সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম কালীকচ্ছ। চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরি ডুবেছিল যে কালীদহে সেই কালীদহের পলিমাটিতে গড়া এই মনোরম গ্রাম। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির জন্মভূমি এই কালীকচ্ছ। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রমেশচন্দ্র দত্ত, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তারিণী নন্দী, সুরেশচন্দ্র সিংহ, প্রকাশচন্দ্র সিংহ, এস. ডি. ও. হেমেন্দ্রনাথ নন্দী, কৃষি কলেজের অধ্যক্ষ ও বহু গ্রন্থের রচয়িতা দ্বিজদাস দত্ত, মেজর জেনারেল সত্যব্রত সিংহরায়, ব্যাঙ্ক ব্যাবসায়ে লব্ধপ্রতিষ্ঠ নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত এই গ্রামের সন্তান। ত্রিপুরা জেলা থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম বি.এ. পাশ করেছিলেন মৃণালবালা নন্দী। তাঁরও জন্ম কালীকচ্ছে। কুমিল্লা লেবার হাউসের প্রতিষ্ঠাতা পি. চক্রবর্তীও ছিলেন এই গ্রামেরই অধিবাসী।
কালীকচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব ছিল না। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল রসিক নন্দীর পাঠশালা। এই পাঠশালায় যার হাতেখড়ি হয়েছে সে যে জীবনে কখনো অঙ্কে ফেল করবে না, এ ধারাণা ছিল প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। আরও একটি বিষয় ছিল একরূপ নিশ্চিত। অভিভাবকরা জানতেন যে, পড়ায় যে-ছাত্রের গাফিলতি হবে, রসিক নন্দীর বেতের দাগ কেটে বসে যাবে তার পিঠের চামড়ায়। সংস্কৃতে উচ্চ-উপাধিধারী ছিলেন সুরেন্দ্র তর্কতীর্থ, নৃপেন্দ্র তর্কতীর্থ প্রমুখ পন্ডিতরা। এঁদের বাড়িতে টোল ছিল। বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্ররা এসে টোলে পড়াশোনা করত। উদাত্ত কণ্ঠের সংস্কৃত পাঠের সুরে মুখরিত হয়ে থাকত কালীকচ্ছের প্রভাতী আর সান্ধ্য আকাশ। আজ সে গ্রামকে ছেড়ে দিয়ে আসতে হল পাকিস্তানের কবলে। সেই বৃহৎ গ্রামের মধ্যে একটি বাড়িও ছিল না মুসলমানের। আশপাশে অবশ্য অনেক গ্রামই ছিল মুসলমানপ্রধান, তবে ভয়-ভাবনা আমাদের কোনোদিনই ছিল না তার জন্যে।
তারপর আমোদ-আহ্লাদের কথা। সে-কথা ভাবলেও আজ মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে উপেন্দ্রবাবুর যাত্রার দলের ‘বিজয় বসন্ত’ পালার কথা। সরাইল হাইস্কুলের কেরানি ছিলেন উপেন্দ্রবাবু। অবসর সময়ে যাত্রার দলের মহড়া হত তাঁর বাড়িতে। তাঁরই প্রচেষ্টায় যাত্রার দলটি গড়ে উঠেছিল। দলটির খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। খালি মাঠে শামিয়ানা খাঁটিয়ে শীতের রাতে আটটা-ন-টার সময় যাত্রা আরম্ভ হত। এখনও চোখে ভাসে কয়েকটি দৃশ্য।…বসন্তকে মারবার হুকুম দিলেন রাজা। জহ্লাদ এসে উপস্থিত হল। সে যখন সাড়ে ছ-ফুট লম্বা দশাসই চেহারা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াত, ভয়ে আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যেত, লোমগুলো হয়ে উঠত খাড়া। আমাদের শিশুকালের সেই রোমাঞ্চকর স্মৃতি আজও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এই যাত্রার দলটিকে শ্রীহট্ট ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের লোকেরা টাকা দিয়ে নিয়ে যেত।
একবার দলটি মেঘনা নদীর বন্দর ভৈরব বাজারে গেল ‘বিজয় বসন্ত’ পালা অভিনয় কররার জন্যে। শীতের রাত। পালা এত জমে গেল যে, বিজয় ভুলে গেল সে অভিনয় করছে। বসন্তের বুকে সজোরে ছুরি বসিয়ে দিল। শেষপর্যন্ত ডাক্তারই ডাকতে হল রক্ত বন্ধ করার জন্যে। এই যাত্রা শোনার জন্যে আমরা সন্ধে না হতেই বাড়িতে কান্নাকাটি করে বাবা মার মত আদায় করে আসরে এসে বসতাম। একেবারে সামনের আসনে বসতে না পারলে কিছুতেই মন সন্তুষ্ট হত না। কিন্তু আমাদের চেয়েও সেয়ানা লোক ছিল। তারা এসে হঠাৎ ‘সাপ সাপ’ বলে চেঁচিয়ে উঠত। আমরা তখন সাপের ভয়ে পড়ি-কি-মরি করে দে-ছুট। তারা সেই সুযোগে এগিয়ে এসে সামনের আসনগুলি দখল করত। কখনো কখনো এ নিয়ে মারামারি পর্যন্ত লেগে যেত। সেদিন নিজের জায়গাটি পুনরুদ্ধার করতে পারলে স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধারের আনন্দ পাওয়া যেত।
এর ওপর ছিল পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা, গুটিদাঁড়া খেলার প্রতিযোগিতা। তেঁতুল কাঠের সার দিয়ে পিংপং-এর বলের মতো আকারের কালো কুচকুচে বল তৈরি হত। সেই বলটিকে মারবার জন্যে কাঁচা বাঁশ দিয়ে তৈরি হত দাঁড়া অর্থাৎ ব্যাট। ক্রিকেট খেলার সঙ্গে এর তুলনা চলে। রজনী ডাক্তার প্রচন্ড জোরে বল পিটাতেন, ক্রিকেটের ওভার বাউণ্ডারির চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হত তা।
গ্রামেই ছিল বাজার। গ্রামেই ছিল পোস্ট-অফিস। তা ছাড়া রক্ষাকালী, শ্মশানকালীর বাড়ি। রক্ষাকালীর বাড়ির পুজোয় মহিষ-বলির পর দড়ি কে নেবে তা নিয়ে লেগে যেত পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতা। যে পাড়া দড়ি পাবে সে-ই জয়ী সাব্যস্ত হবে। দত্তবংশের দাতা গোপীনাথ দত্তের নাম না করলে কালীকচ্ছের কথা বলা শেষ হয় না। অবশ্য শেষ কোনো দিনই হবে না। জন্মভূমির কাহিনি কবে আর শেষ হয়? সে যাক– গোপীনাথ দত্তের কথাই বলি। গোপীনাথ পুকুর থেকে স্নান করে ফিরছেন। হঠাৎ এক ভিখারি এসে সামনে দাঁড়াল। গোপীনাথের কাছ থেকে সে কিছু চায়। দেবার মতো কিছুই ছিল না গোপীনাথের। কিছুক্ষণ ভাবলেন গোপীনাথ। তারপর গামছাটি পরে কাপড়টি দিয়ে দিলেন ভিখারিকে।
দিনাজপুর – ফুলবাড়ি রাজারামপুর
বাংলাদেশের উত্তর ভূখন্ডের গ্রাম ফুলবাড়ি। রাঙামাটির পথ এখান থেকে শুরু হয়ে দিগন্তে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। পদ্মা-মেঘনার দোলন-লাগা ছায়া-সুনিবিড় পূর্ব-বাংলার গ্রামের তুলনায় দিনাজপুরের এই পল্লিশ্রী একটু বিশেষ বৈচিত্রময়। এখানে অরণ্যের অনাহত সারল্য উদ্দাম হয়ে উঠেছে গ্রামান্তের আদিবাসী নর-নারীর মাদল-দোলানো নৃত্যের তালে তালে। পান্ডববর্জিত পূর্ব-বাংলা থেকে এই বরেন্দ্রভূমি এদিক দিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। কলকাতার কর্মমুখর জনস্রোতে আজ নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। যে গ্রামের বুকে পিতৃ পিতামহের স্মৃতি প্রতিটি বৃক্ষ-লতায় পথের ধূলিকণায় মিশে আছে তার সঙ্গে আজ দুস্তর ব্যবধান। ফুলবাড়ি আর আমার নিজের বাড়ি নয়, সেখানে আমি অনাহূত। এ নির্মম সত্য বিশ্বাস করতে মন চায় না, অবিশ্বাস যে করব মনের সে জোরই বা কই?
৩সে. গ্রাম যে কী জিনিস, আজ তাকে হারিয়ে মর্মে মর্মে তা অনুভব করতে পারছি।
দুর্গোৎসবের সময় সাড়া পড়ে যেত পাড়ায় পাড়ায়। সোনার আঁচল বিছিয়ে শরতের রানি আসছেন। তাঁর আগমনি-সুরে সুরেলা হয়ে উঠেছে ফুলবাড়ির আকাশ, বাতাস, প্রকৃতি। এ তো শুধু পুজো নয়, এ যে আমাদের জাতীয় উৎসব! এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মিলিত হতাম সমস্ত গ্রামবাসী। শ্রেণি সম্প্রদায়ের প্রশ্ন সেখানে নেই, আর্থিক সংগতির প্রশ্ন সেখানে অবান্তর। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সে উৎসবে সকলে মিলিত হয়ে আনন্দ করেছি, সে মিলনের মধ্য দিয়ে গ্রামের সহজ সরল আত্মীয়তার মধুর স্পর্শ করে ধন্য হয়েছি।
সবচেয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে বিজয়াদশমীর দিনটি। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ বেদনায় মতোই সেদিনটি অশ্রু-টলমল। পুণ্যতোয়া করতোয়ার তীরে বিসর্জনের বাজনা বাজছে। সে উৎসব উপলক্ষ্যে সমবেত হয়েছে এসে সাঁওতাল-আদিবাসী ছেলে-মেয়ে স্ত্রী-পুরুষের সব দল। তাদের চিকন কালো যৌবনপুষ্ট দেহল-সৌষ্ঠব কেশপাশে কৃষ্ণচূড়ার অপূর্ব বিন্যাস সমারোহ। মাদলের তালে তালে শুরু হত তাদের লোকনৃত্য। কোথায় সেদিন, কোথায় সেই অরণ্যলালিত মানুষের নৃত্যছন্দের হিল্লোল! আজ সে সব স্বপ্ন বলেই মনে হয়।
উৎসবের দেশ বাংলার গ্রামে এসেছে দোলপূর্ণিমায় হোলিখেলার দিন। বসন্তে রং লেগেছে ফুলবাড়ির আকাশে। দিকে দিকে গান শুরু হয়েছে ‘দখিন দুয়ার খোলা। সেই ফাল্গুনের উজ্জ্বল রোদে আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তাম গ্রামের পথে। আমাদেরই কাউকে হোলির রাজা বানিয়ে দিতাম শিবের মতো সাজিয়ে। তার পেছন পেছন সকলে হোলির উৎসবের হই হল্লায় গ্রামের পথঘাট মাতিয়ে তুলতাম। ছড়িয়ে দেওয়ার, ভরিয়ে দেওয়ার সে আনন্দে হোলির দিনগুলো আজও মনকে দোলা দিয়ে যায়।
বারোয়ারিতলায় এক-একদিন বসত কীর্তনের আসর। মাথুর পালা শোনবার আকর্ষণে হাজার লোকের ভিড়। ভিনগাঁ থেকে এসেছে নামকরা কীর্তনীয়া। প্রতিবেশী মুসলমানরাও বাদ পড়েনি সে গানের আসরের আমন্ত্রণ থেকে। মাথুরের অশ্রুসজল কীর্তনের সুরে মুগ্ধ হয়ে কেউ-বা হয়তো মেডেল পুরস্কার দিতেন কীর্তনীয়াকে। মুসলমান শ্রোতারাও অনেক সময় দিয়েছেন উপহার। সেদিন তো ধর্মের কোনো বালাই ছিল না। স্কুলে মুসলমানদের পর্ব ‘মিলাদ শরিফ’ হয়েছে, হিন্দু ছাত্ররাও তাতে অংশ গ্রহণ করেছে বিনা দ্বিধায়। সেদিন তো কোনো জাতির প্রশ্ন, ধর্মের প্রশ্ন পরস্পরের এই প্রীতির সম্পর্ককে এমন বিষাক্ত করে তোলেনি। আজ কেন এই অন্ধ উন্মত্ততা?
আজও মনে পড়ে আমাদের গ্রামের সর্বজনপ্রিয় আবদুল রউফ সাহেবের মৃত্যুর দিনটি। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে সবার চোখে সেদিন জল এসেছিল। হিন্দু-মুসলমান সকলে সেদিন যোগ দিয়েছিল রউফ সাহেবের শবযাত্রায়। তাঁর সমাধি হিন্দু-মুসলমান অনুরাগীর শোকাশ্রুতে সেদিন স্নাত হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের স্মৃতি আজও তো মন থেকে মুছে যায়নি!
দরিদ্র পল্লি-বাংলা। ফুলবাড়িও তেমনই দরিদ্র পল্লি। গ্রামবাসী অনেকেরই আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। তবু তাদের মনে সুখ ছিল। আর ছিল প্রতিবেশীর প্রতি অসীম মমত্ববোধ। এই আত্মীয়তার স্পর্শেই গ্রামবাসী মানুষের জীবন সেদিন মধুময় হয়ে উঠেছিল।
গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে নগরে এসে আজ আস্তানা গড়েছি। এ মহানগরীর সঙ্গে শুধু দেনা-পাওনার সম্পর্ক, প্রাণের কোনো যোগ নেই এখানে। গ্রামের মাটিতে সবুজ তৃণলতা থেকে শুরু করে সব কিছুর সঙ্গেই যেন একটা মধুর প্রীতির সম্পর্ক পাতানো ছিল। দেশবিভাগের ফলে সেই মাটির মাকে হারিয়েছি। ছিন্নমূলের ভূমিকায় আজ আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলেছি অজানার ঘূর্ণাবর্তে। আমরা ফিরে পেতে চাই সেই মাটিকে। ফিরে যেতে চাই রাঙামাটির দেশে, সেই উত্তর বাংলার নিভৃত পল্লি-পরিবেশে।
ফুলবাড়ির রূপ আজ কেমন দাঁড়িয়েছে জানি না।
আধ-পাগলা সেই বিলাসী বৈরাগী আর হয়তো একতারা বাজিয়ে গান ধরে না–’চল সজনি যাই গো নদিয়ায়। বাউলের আখড়ায় সন্ধের দিকে আর আড্ডাও হয়তো বসে না। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির ডাক্তারবাবুর বাগানের গন্ধরাজ গাছটির ফুলের গন্ধ নিশ্চয়ই অকৃপণ দাক্ষিণ্যে পূর্ণ করে দেয় অঙ্গনতল। রজনিগন্ধার ঝাড় থেকে অফুরান মনমাতানো সৌরভ এখনও হয়তো ফুলবাড়ির পথঘাটে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আমাদের বাসুদেবের ভাঙা দেউলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাবার মতো কেউ আর বোধ হয় সেখানে নেই। ফুলবাড়ির নিষ্প্রদীপ দেউলে মানুষের ভগবান কী তপস্যায় মগ্ন কে জানে?
.
রাজারামপুর
কোথা থেকে যেন কী হয়ে গেল। যে ছিল একান্ত আপন সেই হয়ে গেল পর। স্বদেশকে স্বাধীন করবার মূল্য দিতে হল এইভাবে? মূল্য হিসেবে দিতে হল গ্রামজননীকে। আমাদের স্বাধীনতা তাই এল মহাবিচ্ছেদের কান্নায় ভিজে হয়ে!
আমার গ্রামের নাম রাজারামপুর। দিনাজপুরের অনেকগুলো গ্রামের একটি। রাজারামপুর ভাটপাড়ায় এসে পৌঁছোলে মনে হয় বাংলার সাধারণ গ্রাম থেকে এর চেহারা যেন একটু পৃথক। তবে রংপুর, রাজসাহী, নাটোর–এসব অঞ্চলের গ্রামের সঙ্গে মিল রয়েছে অনেকটাই। চারিদিকে শটীর জঙ্গল আর আটিশ্বরের ঝোঁপ। আম-জাম-কাঁঠালের বন মাঝে মাঝে এতই নিবিড় হয়ে উঠেছে যে হঠাৎ ঠাহর করাই শক্ত সেই বনের মধ্যে কোথায় কার খড়ের চালা মাথা উঁচু করে আছে।
দিনাজপুরের বালুবাড়ি শহরের অনেকটা কাছে, তাই তার গ্রাম্য চোহারা কিছুটা বদলেছে। কিন্তু তারই বুক চিরে মহারাজ হাই স্কুলের পাশ দিয়ে যে মেঠো পথ বনজঙ্গল ভেদ করে রাজারামপুর-ভাটপাড়ায় গিয়ে পৌঁছেছে, সে পথ দিয়ে দিনের বেলায় একা হাঁটতে কেমন যেন ভয় করে। কিছুদূর পথ চলার পরই ধুলো হাঁটু অবধি উঠে আসবে। গোরুর গাড়ির মন্থর গতি দেখে বেশ বোঝা যায় যে চাকা ধুলোর ভেতর দিয়ে কোনোরকমে এগিয়ে চলেছে। তবু ও-পথটার এমনই একটা আকর্ষণ আছে, সেপথে না গেলে তা বোঝা সহজ নয়। বালুবাড়ির সীমানা পার হওয়ার পরই দেখা যাবে বাঁ-দিকে কুমোরদের পল্লি। মাটির বাসন-কোসন ছাড়া এরা খাপড়াও তৈরি করে থাকে–শহরের লোকের খাপড়ার চাহিদা রোজই বাড়ছে।
তারপরই জলা-জঙ্গল পার হয়ে আম-কাঁঠাল গাছের সারি। পথের দু-ধার থেকে তারা যেন ইশারায় ডেকে নিয়ে যায়। তারপরেই রাজারামপুর ভাটপাড়া।
রাজারামপুর-ভাটপাড়া–এই দুই গ্রামের নাম পৃথক হলেও প্রকৃতপক্ষে ও-এলাকাটাকে একটা গ্রাম ছাড়া ভাবা যায় না। দুই গ্রামের মধ্যে শুধু ছেলেদের বল খেলার একটি বিস্তীর্ণ মাঠ। এই মাঠেরই একধারে রাজারামপুর আর একদিকে ভাটপাড়া।
পরাধীনতার যুগে এই অরণ্যঘেরা এলাকায় মাত্র কয়েক ঘর মানুষের বসতির মধ্যে থেকে ‘হিলি ডাকাতি’র প্রেরণা কীভাবে লোকে পেয়েছিল তার কাহিনি চিত্তাকর্ষক। এই সব এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি–কিন্তু হিলি ডাকাতির মামলার কথা সাধারণত কেউ বলতে চাইত না। শুনতাম, হৃষি এবার জেল থেকে বার হবে। কত অল্প বয়সে পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে গেছে। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। বালুবাড়ি, ক্ষেত্রিপাড়া, কালীতলা, বড়োবন্দর-এ সব জায়গার কে na জানে পরমধার্মিক রমেশ ভট্টাচার্যকে। তাঁরই ছেলে হৃষি। লেখাপড়ায় আর আদবকায়দায় তার মতো ছেলে মেলা ভার। রমেশবাবু বন্দরে নিজের বাড়ি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর শরিক দেবেশ ভট্টাচার্য ভাটপাড়াতেই থাকতেন। পৈতৃক সম্পত্তি অগাধ। দেবেশবাবু ছিলেন শৌখিন ও আমুদে প্রকৃতির লোক। হঠাৎ একদিন হৃষি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে কয়েকজন কিশোর এল বড়োবন্দর বালুবাড়ি থেকে ভাটপাড়ায়। এমন তারা প্রায়ই আসে। সকলের গায়েই আলোয়ান। দেবেশবাবু বাড়ি নেই।
তখন বাড়িতে নতুন নতুন কয়েকটা আগ্নেয়াস্ত্র এসেছে। হৃষির দলবলের আগ্রহে দেবেশবাবুর স্ত্রী একে একে ওদের সেগুলি সব দেখালেন। তারপর চামড়ার ‘কেসে’ বন্ধ করে তুলে রেখে দিলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে ছেলেরা হাসিমুখে প্রণম্যদের প্রণাম করে বেরিয়ে গেল।
তারপরই ওরা নিরুদ্দেশ। কিছুদিনের মধ্যে হিলি ডাকাতির মামলার বিশ্বরূপ প্রকাশ পেল। দেখা গেল হৃষিও অভিযুক্ত। একনম্বর আসামি ইংরেজের আদালতে। খবর শুনে ধর্মপ্রাণ রমেশবাবু মর্মাহত। কিন্তু হৃষির প্রাণভিক্ষার আপিলও তিনি নাকি করতে চাননি।
পরে দেখা গেল দেবেশ ভট্টাচার্যের বাড়িতে রিভলবারের চামড়ার কেসগুলো ঠিকই আছে, তবে তারমধ্যে থেকে আসল জিনিস উধাও হয়েছে।
আর ওই-উপজাতি পোলিয়ারা। ওদের প্রভাব বাসিন্দাদের ওপর প্রচুর। ওদের স্ত্রী-পুরুষ শটী জঙ্গলে কাজ করে। হলুদের মতো শেকড় তুলে চালনি-টিনে ঘষে ঘষে কাত বার করে। তারপর সে কাত ধুয়ে ধুয়ে, শুকিয়ে নিয়ে তৈরি করে শটী। ওদের সঙ্গে ওদের ভাষাতেই কথা কইতে হয়–’খাবা নাহে’, ‘এলাই বাহে’ ইত্যাদি। পিঠে নবজাত শিশুকে বেঁধে নিয়ে মাঠের কাজ করছে, মুড়ি বিক্রি করছে তাদের রমণীরা। এদের ভাষার প্রভাব অল্পবিস্তর পড়েছে সকলের ওপরই। অবশ্য মুখের ভাষাতেই এই প্রভাব সীমাবদ্ধ–লেখার ভাষায় নয়।
রাজারামপুর-ভাটপাড়া জঙ্গল আর পানাপুকুরে ভরা। তবু বন-জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে কত যে দেব-দেবীর মূর্তি আছে তার বোধ করি সীমা-সংখ্যা নেই। রাজারামপুরের ভদ্রকালী অতিজাগ্রত বলে খ্যাত। তেমনই আবার ভাটপাড়ার শ্মশানবাসিনীর মন্দির। শ্মশানবাসিনীর মন্দির দূর থেকে দেখলেই ভয় লাগে। বনজঙ্গল-ঘেরা এই জীর্ণ মন্দির। আরও কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে শিবলিঙ্গ আর কালীমূর্তি।
আষাঢ় থেকে শীতের আগে অবধি গ্রামে ম্যালেরিয়ার তান্ডব। তবু পুজোর সময় দেখা যায় একাধিক দুর্গাপ্রতিমা। ঢাকের আওয়াজে মুখরিত চারিদিক। যুবকরা মাঠে মাঠে বাঁধে থিয়েটারের স্টেজ। সারারাত ধরে কোথাও হয় আলমগির, কোথাও বঙ্গে বর্গি। দেশলাইয়ের বাক্সে কুইনাইনের পিল নিয়েও থিয়েটারে মাততে দেখেছি অনেককে।
আর আছে কান্তজিউয়ের মন্দির। সে মন্দিরের কারুকার্য দেখে মনে হয় কোথায় লাগে গয়ার মন্দির! দিনাজপুর রাজপ্রাসাদে যখন কান্তজিউকে মিছিল করে নিয়ে আসা হয়–সমগ্র শহর ও গ্রামগুলো যেন জেগে ওঠে উৎসবের আনন্দে। রাজবাড়িতে দেবতার অন্নভোগ হয় না–কিন্তু এই সময় অতিথির সেবা আর অন্নদান হয়। বছরের বাকি-কয়েক মাস কান্তজিউ থাকেন কান্তনগরে। বিখ্যাত গোষ্ঠমেলা আর রাসমেলার সময় কত দূর-দূরান্তর থেকে কত ব্যাপারী আসে। মেলা চলে একমাস। কান্তজিউয়ের ভোগের পর প্রধান সেবায়েত তাঁকে চাঁদির গড়গড়ায় তামাক সেজে দেন।
এ সম্বন্ধে একটি গল্প শোনা যায়। একবার এক অতিথি দর্শনলাভের আশায় কান্তজিউয়ের মন্দিরে আসে। রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় বাইরের বারান্দায় শুয়ে সে বিশ্রাম করতে থাকে। রাতে গড়গড়া টানার শব্দে সে তামাক খেতে ইচ্ছে করে এবং তাকে ‘একজন’ সেই চাঁদির কলকে এনে-দিয়ে যায়। পরের দিন কান্তজিউর কলকে বাইরে পড়ে থাকতে দেখে মন্দিরে গোলমাল বেধে যায়। সেই আগন্তুককে নিগ্রহ ভোগ করতে হয়। সেই থেকে নাকি কান্তজির তামাক খাওয়ার শব্দ আর শোনা যায় না।
পৌষ-সংক্রান্তি খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হত। আঙিনায় আলপনা দিয়ে ঘরের দরজার মাথায় পিঠেলুর চিত্র এঁকে শোলার ফুলগুচ্ছ ধান-দূর্বার সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। সব বাড়িতেই নানারকম পিঠে তৈরি হত এবং কারুর বাড়ির পিঠে ইচ্ছে হলে বিনা নিমন্ত্রণেই সে বাড়িতে গিয়ে খাওয়া যেত।
এ এলাকার লোকসংগীতের উল্লেখ না করলে বিবরণ অবশ্যই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। উত্তর-বাংলার ভাওয়াইয়া, ‘চটকা’ প্রভৃতি গান এই গ্রামেও শোনা যায়। একটি চটকা গানেরই দৃষ্টান্ত দিচ্ছি,
ডাল পাক কররে কাঁচা মরিচ দিয়া,
গুরুর কাছে নেওগা মন্তর নিরালে বসিয়া,–
ডাল পাক কর রো।
ছোটোবউ চড়ায় ডাল মাঝলা বউ ঝাড়ে,
(হারে) বড়োবউ আসিয়া কাঠি দিয়া নাড়ে।
ডাল পাক কর বরা।
(আমার) শ্বশুর করে ঘুসুর-ঘুসুর
ভাসুর করে গোসা,
(আজি) নিদয়া এল স্বামী এসে ধরল
চুলের ঘোসা,
ডাল পাক কর রো।
(আমার) শাশুড়ি আছে, ননদ আছে,
আছে ভাগনা-বউ,
এমন করে মার মারিল আইগ্যালো না কেউ,
ভাল পাক কর রো।
এমন কিছু নয়। সংসারের একটি ছোটো ছবি। রান্না, শ্বশুরের অভিযোগ, স্বামীর মারধোর, অসহায় স্ত্রীর আক্ষেপ এই তো ছবি। কিন্তু আন্তরিকতায় ভরা। গ্রামের বৈশিষ্ট্যই যে এই আন্তরিকতা। তার ছোঁয়া আমাদের বুকেও লেগেছিল। আজ সে গ্রাম স্বাধীন ভারতের দেশের বাইরে চলে গেছে। তবু তার সেই স্পর্শ আজও অম্লান।
নোয়াখালি – দরাপনগর সন্দীপ ত্রিপুরা বায়নগর চান্দিসকরা বালিয়া কালীকচ্ছ
পূর্ববঙ্গে প্রথম দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া নেমে আসে আমাদের নোয়াখালিতে। সাম্প্রদায়িক খঙ্গাঘাতে দ্বিখন্ডিত হয়েছি আমরা, কিন্তু তবু আমরাই একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। এই নোয়াখালির বুকের পাঁজরে পাঁজরে পড়েছিল মহাত্মার চরণচিহ্ন। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তাঁর ঐতিহাসিক পরিক্রমা সমস্ত পূর্ববাংলার বুকে একদিন এনেছিল চাঞ্চল্য। ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে এই গ্রাম সফরই যথেষ্ট। শ্রীচৈতন্যের পুণ্যস্পর্শে নবদ্বীপ যেমন ধন্য, তেমনি ধন্য হয়েছে নোয়াখালি মহাত্মাজির পুণ্য পাদস্পর্শে। বৈষ্ণবযুগের জগাই-মাধাইরা কি সব নতুন করে জন্ম নিয়েছে পূর্ববাংলার পল্লিতে পল্লিতে? ইতিহাসের পশ্চাদপসরণের অর্থই হল হানাহানি, বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তহত্যা, ভ্রাতৃবিরোধের কলঙ্কময় সমষ্টিফল। আমরা সে-কথা বুঝেছি অক্ষরে অক্ষরে, বুঝেছি আজ সর্বস্ব খুইয়ে। যাদের ভূমি যায় হারিয়ে তাদের ভূমিকা যে কী হতে পারে তাও ভাববার বিষয়!
এক দেশের অবাঞ্ছিত মানুষ অন্য দেশের ভারস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছি যেন আমরা, অমৃতবঞ্চিত পূর্ববাংলার অভিশপ্ত মানুষেরা আবার কবে এবং কী করে, স্বঐতিহ্যে, স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে তার শুভ ইঙ্গিত বা গোপনমন্ত্র কে বলে দেবে?
মনে পড়ছে ভোর পাঁচটায় হরিনারায়ণপুর থেকে যেদিন আমাদের স্টিমার ভোঁ বাজিয়ে অজানা রাজ্যের দিকে যাত্রা করল সেদিন পূর্বাকাশের উজ্জ্বল শুকতারাটি পর্যন্ত যেন লজ্জার, শঙ্কায়, অভিমানে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। হু-হুঁ শব্দে জল কেটে নিস্পৃহ যন্ত্রদানব চলছে এগিয়ে সাত-পাঁচ কোনো কথা না চিন্তা করেই–ব্যথাতুরা জননীর বুকের ভেতর গুমরে গুমরে উঠছে আর সেই হৃদয়-নিঙড়ানো ধড়ফড়ানির ঢেউ এসে লাগছে আমারও বুকে। স্নেহময়ী মাকে শেষবারের মতো দেখে নেবার জন্যে আমি দাঁড়িয়েছিলাম ডেকে–কিন্তু অশ্রুভারে সমস্ত কিছু তখন হয়ে উঠেছে অস্পষ্ট। মায়ের রূপ গেছে হারিয়ে। ইঞ্জিনের শব্দ শুনে আমার মনে হচ্ছিল দেশজননী যেন বলছেন, ফিরে আয়–ফিরে আয়–ফিরে আয় আপন ঘরে! লক্ষ করলাম চতুর্দিকে ফিরে আসার ইঙ্গিত, আমাদের না যেতে দেবার আহ্বান।
কিন্তু আমি দুর্বল মানুষ; আমার উপায় নেই থাকবার। দোটানায় পড়ে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে শুধু অক্ষমতার তপ্ত অশ্রু। সেদিন দেশজননীর কোল থেকে বিদায় নেবার পর থেকে যে অশ্রুবর্ষণ শুরু হয়েছে তার শেষ কোথায় জানি না। আজ এই বিশাল অনাত্মীয় পাষাণপুরীর এক কোনায় একখানি প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে ধুকছি, মাথা পড়েছে নুয়ে, দুর্ভাবনায় চোখের পাশে কালিমার ছাপ দেখা দিয়েছে। ছাত্রজীবনের রঙিন স্বপ্নরেশগুলি আজ কঠিন বাস্তবের আঘাতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে আসার সময় তার বুকে যে উত্তাল তরঙ্গরাশির নৃত্যরূপ দেখেছিলাম তারই মধ্যে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছি আমার সমস্ত আশা-ভরসা। উদবাস্তু স্টিমারের যাত্রী আমরা, আমাদের আশার স্বপ্ন দেখার সময় আছে? আমরা ওপারের অবাঞ্ছিত আর এপারের বোঝা হয়ে জীবন কাটাচ্ছি। সময় সময় দুঃখের আধিক্যে সজোরে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে মাটিতে, কিন্তু কোথায় আমার সেই মিষ্টি দেশের মাটি?
নোয়াখালি। বাংলামায়ের সর্বকনিষ্ঠা স্নেহ-দুলালি নোয়াখালি। মহাত্মার পাদস্পর্শে ধন্যা নোয়াখালি। সারাবাংলার অণু-পরমাণু দিয়ে গড়া সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আমার নোয়াখালি। তারই কোলে শিশু গ্রাম আমার প্রিয় দরাপনগর’। এ গ্রামের কোনো ঐতিহাসিক পটভূমিকা আছে কি না জানি না। শুধু জানি দরাপনগর নামটি মনে পড়লেই চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে আম-কাঁঠাল, সুপারি, নারকেলকুঞ্জ-ঘেরা একটি মনোরম দ্বীপপুঞ্জের প্রাণমাতানো ছবি। দু-পাশে ‘বারুই’-এর বরজ নিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে যাওয়া পল্লিপথ, আশপাশে সুসজ্জিত কুঞ্জের মতো প্রতিবেশীদের বাড়িঘর, স্নেহমমতায় ভরা মন। তারই মধ্যে দু-পাশে দুটি বিরাট পুকুর নিয়ে আমাদের বাড়ি। ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের প্রয়োজনাতিরিক্ত সাজসরঞ্জাম নিয়ে সাজানো ঘরগুলো। পুবদিকের খানিকটা বাদ দিয়ে চারপাশ ঘেরা ছিল সুপারিকুঞ্জে।
দু-বাড়ির মাঝখানে ছোট্ট একটি ‘জুরি’। জুরিটি দুই বাড়ির অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করলেও মানবিক গুণের সীমানা নির্ধারণ করেনি কখনো। তাদের প্রাণের মিল, মনের ছন্দ জুরির ওপর দেওয়া সুপারির পুলের অপেক্ষা করে না। পূর্বদিক রতনপুকুর। ওতে ডুব দিলে রতন পাওয়া যায় কি না জানি না, তবে তার কাকচক্ষু জল গ্রামের অধিকাংশ লোকই পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করত অন্য পুকুর ছেড়ে। এই রতনপুকুরের পাড় দিয়ে কচুবাড়ির দরজা দিয়ে চলে গেছে গেঁয়ো রাস্তা। কচুবাড়িতে কি শুধু কচুই হয়? শব্দ তাত্ত্বিকদের বিচার এখানে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, এরকম বহু অসামঞ্জস্যই আছে বাংলার পল্লিতে পল্লিতে। কচুবাড়ি আমাদের কাছে পরিচিত তার ফুল বাগিচার জন্যে–অতি প্রত্যূষে উঠে ফুল চুরি করতে যেতাম কচুবাড়ি! আজ বোঝাতে পারব না সেদিনকার দু-একটা ফুল চুরির মধ্যে আমাদের শিশুমনে কী উন্মাদনা জাগত।
কচুবাড়ি থেকে রাস্তা এঁকেবেঁকে ঘেরীর বিরাট দিঘির পাড় দিয়ে চলে গেছে কাবির হাটের দিকে। দিঘির পাড় এত উঁচু হয় জানতাম না, ওপর থেকে নীচে তাকালে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। তার উত্তর পাড়ের মাঝামাঝি অংশটা ভাঙা দেখে একবার কৌতূহলবশেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাবাকে তার কারণ। সেদিন বাবার কাছ থেকে যে উত্তর পেয়েছি তার বিস্ময় আজও কাটেনি, কিশোরমনে দাগ কেটে বসে গেছে। তিনি বলেছিলেন ওই ফাঁকটা দিয়েই নাকি একটি বিরাট সিন্দুক (যতখানি ভাঙা ততখানি মাপের) ক্রোশখানেক দূরে ‘কিল্লার দিঘিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাত দুপুরে। সেই বিরাট সিন্দুকে ছিল সাত রাজার সম্পদ। গ্রামবাসীরা বলে এই সিন্দুক চালাচালির ব্যাপারটি নাকি প্রায়ই নিশুতি রাত্রেই হয়ে থাকে বলে প্রবাদ আছে। বহুবার ভাঙা অংশটুকু মেরামতের চেষ্টাও হয়েছে, কিন্তু বাঁধা যায়নি কোনো-না-কোনো আশ্চর্য কারণে। শেষে ধৈর্য হারিয়ে লোকে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
মনে পড়ছে কতদিন রাত্রে রূপকথা শোনার বায়না নিয়ে মাকে বিরক্ত করেছি, ঘুমুতে দিইনি। আজও টুকরো টুকরো খেইহারা হয়ে স্মরণপথে বড়ো হয়ে দেখা দেয় সেই তেপান্তরে ছুটে-চলা দুঃসাহসিক রাজপুত্তুর, যার ঘোড়া এখনও জোর কদমে ছুটে চলেছে মনের রাজপথে ধুলো উড়িয়ে। সেই অনাদিকালের রাজপুত্তুরের পথের সাথি হলাম আজ আমরা! আমরাও ছুটে চলেছি তেপান্তরের রুক্ষ-শুষ্ক মাঠের ওপর দিয়ে সামান্য নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে। জানি না এই ছুটে চলার শেষ কোথায়? ছোটোবেলায় চাঁদের ছুটে-চলা দেখে আশ্চর্য হয়েছি। এত জোরে সাদা-কালো, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ অমন করে ছোটে কেন? আমি যেখানে যাই চাঁদও সেখানে যায় কেন ইত্যাদি প্রশ্নে মন হয়ে উঠত ভরপুর! কতদিন চাঁদকে পেছনে ফেলে যাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি ভেবে আজ হাসি পায়।
শিশুমনের বিস্ময় কাটিয়ে উঠে একদিন লক্ষ করলাম আমার জগৎটা হঠাৎ যেন বেড়ে গেছে অনেকখানি। আমি চষে বেড়াচ্ছি সারাগ্রামটা, গ্রামের প্রতি অণুপরমাণুর সঙ্গে আমার হয়ে গেছে একাত্মবোধ। আম, জাম, লিচু, জামরুল, কুল, বাতাবি গাছের ডালে ডালে ঘটেছে আমার অগ্রগতি। বর্ষার কাদাজলে চলেছে হরদম ফুটবল খেলার অনুশীলন–সেদিন সারাগাঁয়ে মায়ের যে পরশ পেয়েছি সেই পুরোনো কথা ভেবেই কাটাতে হবে বোধ হয় বাকি জীবন। সেদিনের ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ আজও লেগে রয়েছে আমার নাকে।
‘মতরী’ অর্থাৎ মিত্র বাড়ির দাওয়ায় যে দোকানঘরটি ছিল তাতেই সকাল সন্ধ্যায় বসত আচ্ছা। আশপাশের গ্রামের লোকও আসত সওদা করতে, গল্পগুজব করতে। আমাদের গ্রামটি হিন্দুপ্রধান হলেও দোকানঘরের মিলনতীর্থে দেখা মিলত সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরই চৌকিদার মুজহরলাল থেকে আরম্ভ করে চোর মরকালী, আর বুড়ো হাফেজ মিয়া থেকে আরম্ভ করে মিয়াদের বিকৃতমস্তিষ্ক বিলেত-ফেরত ছেলেটি পর্যন্ত সেখানে আসত দিনান্তে অন্তত একটিবার। পাগল ছেলেটি আপন মনে বিড়বিড় করে বকলেও ব্যবহারে কোনোরকম পাগলসুলভ হাঙ্গামা করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বেত ঘুরিয়ে গুরুমশায়ী চালে যখন সে চলে যেত আমার কিশোর মনে তখন জাগত প্রচন্ড বিস্ময়। সেদিন মানুষকে পাগল হতে দেখেছি, আজ দেখছি গোটা জাতি হয়ে উঠেছে পাগল! এমন পাগলামি করলে শান্তিতে মানুষ থাকবে কী করে সে-চিন্তা কারও মনে জাগেনি আজ পর্যন্ত? মানুষ বাঁচলে তবে তো জাতি,–তবে কেন জাতিবোধের আজ এমন প্রাধান্য মানুষের ওপর? মানুষ কী মরে গেছে? জাতের বজ্জাতি শেষ হোক এই প্রার্থনাই করছে সমস্ত সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষ!
মনে পড়ে বুড়ো তমিজুদ্দিনকে। বুড়ো ঘর ছাইত বছর বছর। সুপারির মরশুমে সুপারি দিত পেড়ে। প্রতি গাছ থেকে তার পাওনা ছিল এক গন্ডা সুপারি। সরু লম্বা একটা বাঁশের মাথায় কাস্তে বেঁধে সুপারি পাড়ত ছোকরাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। শুনেছি বয়সকালে তমিজুদ্দিন গাছে উঠত কাঠ-বেড়ালের মতো, বুড়ো বয়সে আর ভরসা করে না সরু গাছে উঠতে। মনে পড়ে বলীকেও। সে যখন জমিতে মই দিত তখন গিয়ে তার পেছনে কোমর জড়িয়ে মই-এর ওপর দাঁড়াতাম। বেঁটে বুড়ো বাধা তো দিতই না, বরং বাঁদিকের গোরুটার ল্যাজ মুচড়ে হেঁই-হেঁইও বলে আমাকে আনন্দে দেবার ব্যবস্থা করত। কিছুক্ষণ পরে নামিয়ে দেবার মতলবে প্রশ্ন করত, ‘অইল।’ ধুলোয় ধূসরিত শরীরের দিকে তাকিয়ে আমি শুধু জবাব দিতাম—’উঁহু!’
মনে পড়ছে মিত্রবাড়ির ঝুলন উৎসবের কথা। দামামার শব্দে কর্ণপটাহের অবস্থা হত সঙিন। আরতির ধূপের ধোঁয়ার আবছা পরিবেশের মধ্যে দেখতাম ঠাকুর দুলছেন, দোল খাচ্ছেন সহাস্য মুখে। পুজোর আরতিই ছিল সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। ছেলে বুড়োনির্বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে আরতি করত ভক্তিনম্র চিত্তে। বাজনার তালে তালে আরতি উঠত জমে, আগুনের ফুলকি পড়ত ছড়িয়ে এদিক-ওদিকে। ঢুলির বাজনার ছন্দ যখন চরমে, নাচতে নাচতে আরতিকরদের হাত থেকে তখন খসে পড়ত ধনুচি, আগুন ছিটকে পড়ে দু-একজনকে ঘায়েলও যে করত না তা নয়, কিন্তু সেদিকে নজর দেবার মনের অবস্থা তখন কোথায়? এইসব নিয়েই আমার গ্রাম, এইসব অনাসৃষ্টি নিয়েই পূর্ববাংলার সব গ্রাম পরিপূর্ণ। সামান্য ঝুলন উৎসবকে কেন্দ্র করেই যে বিরাট আনন্দোৎসবের ব্যবস্থা সেদিন যারা করত আজ তারা কে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে জানি না।
পুজোর সময় ধরদের বাড়িতে হত উৎসব। অভিজাত বাড়ির নোনা-ধরা দেয়ালের মতো তার সব কিছুতেই নোনা ধরলেও এই সেদিন পর্যন্তও পুজোর আনন্দটা ছিল অকৃত্রিম। ঢপ, রামায়ণ গান থেকে আরম্ভ করে যাত্রাগানের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠত সমস্ত গ্রামখানি। রামায়ণ গানের দু-চার লাইন আজও মনে আছে আমার। সেদিনকার আসর-ভরতি লোকের সামনে যখন গায়েন রামের রাজ্যাভিষেকের চিরঅভিপ্রেত সংবাদটি ঘোষণা করতেন তখন দর্শকদের মুখে ফুটে উঠত স্বস্তির হাসি। সে হাসির উৎস ছিল বিশেষ করে এই কথাটি,
ওগো কৌশল্যে, শুনে কী আনন্দ হল অযোধ্যার
রাজা হবে রঘুমণি লক্ষ্মণ হবে ছত্রধারী–
বামে সীতা সীমন্তিনী সদা নিরখি।।
এই যে সুখীসচ্ছল ভবিষ্যৎ অযোধ্যার ছবি, এ ছবি তো চিরন্তন। জীবনের ওপর সার্থকতার ছাপ পড়লে এমন নির্বিঘ্ন ছবি ফুটবে কী করে?
যাত্রার মধ্যে দীনবন্ধুর নাচই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। পুজোর সময় তাকে পাওয়া ছিল দুর্লভ সৌভাগ্যের কথা। বড়ো বড়ো যাত্রার দলে থাকত তার চাহিদা। তার ‘পূজারিনি’ নৃত্যই ছিল সবচেয়ে বিস্ময়কর। মাথায় ও দু-হাতে তিনটি ধূপদানি নিয়ে পূজারিনি তার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে দেবতাকে অর্ঘ্য নিবেদন করছে, অথচ প্রণাম করতে গিয়েও তার ধূপদানি স্থানচ্যুত হচ্ছে না। তার নৃত্যলালিত্য দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না যে শরীরে তার হাড় আছে একটাও! আমাদের গ্রামে দীনবন্ধুই ছিল প্রাচীনকালের সুরুচিসম্পন্ন নৃত্যের ধারক ও বাহক।
আজ ফেলে-আসা দিনগুলির ধূসর স্মৃতিরোমন্থনই ভালো লাগছে। আজ আমাদের অবস্থা মহাভারত বর্ণিত অভিমন্যুর মতো। তবে অভিমন্যু প্রবেশের মন্ত্র জানতেন, বের হয়ে আসার মন্ত্র সম্বন্ধে ছিলেন অজ্ঞ। আমরা বেরিয়ে আসার মন্ত্র জানি, জানি না ছেড়ে-আসা গ্রামে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভের মন্ত্র, এই তফাত! মৈত্রী-সাধনার মধ্য দিয়েই পাওয়া যাবে সে-পথের সন্ধান।
.
সন্দীপ
দক্ষিণে সুন্দরবন, উত্তরে তরাই। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা এই। তবু আরও এক মৃত্যুদীপ্ত ইতিহাস ছিল এই সীমানির্ধারিত ভূখন্ডের। সে-ইতিহাস একদিনে গড়ে ওঠেনি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বুকে পলিমাটির স্তরের মতো যুগে যুগে সাত কোটি মানুষের বুকের ভালোবাসায়, অশ্রুতে, প্রতিজ্ঞায় এ ইতিহাস লিখিত হয়েছিল। আজ নিজের হতে সে ইতিহাসকে দ্বিখন্ডিত করে দিলাম। এক সীমান্তের মানুষ আর এক সীমান্তে উপনীত হল শরণার্থীর বেশে, আশ্রয়ের প্রার্থনায়। হায় আমার দেশ! যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি, এ দেশের মাটিকে, এ দেশের আকাশকে তো ভুলতে পারি না। এ দেশে যে আমি জন্মেছি, এ দেশ যে আমার জননী।
দূর থেকে একটা কালো বিন্দুর মতো মনে হয় প্রথম। সমুদ্রের বুকে বুঝি বা কোনো ভাসমান কাষ্ঠখন্ড। ঢেউয়ের ভেতর ডুবে যাচ্ছে কখনো–আবার মাথা তুলছে হঠাৎ। কর্ণফুলি নদীকে অনেক পেছনে ফেলে সমুদ্রের মোহনায় এসে পড়েছে মোটরলঞ্চ। এবার সোজা কোনাকুনি পাড়ি জমাতে হবে। ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে চলেছে লঞ্চ। যান্ত্রিক আর্তনাদ তলিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক ঢেউয়ের উত্তাল বিক্ষোভে। নির্মেঘ আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্য। রোদের স্পর্শে সফেন ঢেউগুলি হিরন্ময় দীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইগলের মতো অনুসন্ধানী চোখে তাকালেও উপকূল চোখে পড়বে না আর। শুধু অন্তহীন জল চারদিকে–ঢেউয়ের অবিশ্রান্ত গর্জন। পালতোলা নৌকার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। দেখা যায় দু-একখানা যাত্রীবাহী নৌকা। সমুদ্রের উপযোগী বিশেষ ধরনের নৌকা এইসব। দিকচিহ্নহীন সমুদ্রে নৌকারোহীদের একমাত্র সহায় মাঝির অদ্ভুত দক্ষতা আর যাত্রীর দুর্নিবার সাহস। প্রায়ই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয় এদের। তবু পরাভূত হয় না এরা, অনেক প্রাণের বিনিময়ে কঠিন অভিজ্ঞতায় শক্তিমান সবাই। তাই রুদ্রের অভিসারে অভ্যস্ত এরা প্রত্যেকে।
দুপুরের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে এক সময়। সেই কালো বিন্দুটা চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে দেখা দেয় এইবার। সুপারি, নারকেল গাছে ঘেরা একটুকরো ভূখন্ড। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে ভূখন্ডের গায়ে। যে-কোনো মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে বলে কিনারে গিয়ে ভিড়ল লঞ্চ। ঢেউয়ের দোলায় লঞ্চ তখন কাঁপছে। কোনো অবলম্বন ছাড়া লঞ্চের ওপর দাঁড়ানো যায় না। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় খালাসিরা কিন্তু সিঁড়ি ফেলে দিলে। তাদের হাত ধরে ধরে সিঁড়ি পার হয়ে উঠে এল যাত্রীদল। এখান থেকে গন্তব্যস্থল মাইল দুয়েকের পথ। কিন্তু সেখানে যাওয়া যায় কী করে? মোটর, ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা কিছুই নেই। একটা কাঁচা রাস্তা এঁকেবেঁকে ভেতর দিয়ে চলে গেছে। ছোটো ছোটো মোট কাঁধে নিয়ে যাত্রীরা কেউ কেউ সেই পথে রওনা হয়। বাকি যারা রইল তারা আশ্রয় নিল গোরুর গাড়ির। যাতায়াতের একমাত্র উপায় এই দ্বিচক্রযান।
নতুন কোনো আগন্তুক তখন হয়তো সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন–সামনে অনন্ত সমুদ্র, দিগন্ত চোখে পড়ে না। একটা ঝলসানো তাম্র পাত্রের মতো পশ্চিমের সূর্য সমুদ্রের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। নিজের অস্তিত্ব লুপ্ত করে দেবার কামনায় উদবেল বিকেলের সূর্য। আশপাশের গাছগুলোতে পাখিদের ক্লান্ত কলরব। একটা স্তব্ধ বিষণ্ণ পরিবেশ। মুহূর্তের জন্যে অবাক হয়ে যান আগন্তুক। বাংলাদেশের অংশ নাকি এটা? কিন্তু বাংলার কোনো অঞ্চল এমন দুরধিগম্য, বহির্জগৎ-বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে ভাবতে পারেননি ভদ্রলোক। একটা বিস্মিত চেতনায় কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। পাশে দাঁড়িয়ে গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান যে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছে। সেদিকে খেয়ালই নেই তাঁর।
প্রায় দেড়শো বছর আগে একদল লোক যেদিন এখানে এসে নেমেছিল সেদিন তারাও বোধহয় বিস্মিত চোখে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল তাদের নির্ধারিত। কর্তব্য ছিল সুপরিকল্পিত। সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হওয়া রূপকথার রাজকুমারের মতো তাদের চমকপ্রদ অভিযাত্ৰা তাই থেমেছিল এখানে। জাতে ছিল তারা পোর্তুগিজ। পসরা খুলতে দেরি হয়নি তাদের। অপ্রতিহত আধিপত্যে বাঁধা পড়েনি কোথাও। দেড়-শো বছর আগে বাংলার প্রত্যন্তভাগের এই দ্বীপটিও ঔপনিবেশিক আলোর সংস্পর্শ থেকে অব্যাহতি পায়নি। ইতিহাসে তবু এই দ্বীপটির কথা হয়তো দেখতে পাবেন না, কারণ বিশেষজ্ঞের গবেষণার বাইরে যে এই দ্বীপ–আমার দেশ এই সন্দীপ।
শহরের অংশটিকে বলা হয় হরিশপুর, অবশ্য ঠিক শহর নয়। একটি থানা, মুনসেফ আদালত আর সাবট্রেজারি অফিস গোটা দ্বীপটার শাসনব্যবস্থার প্রতিভূ। মাইলখানেক পরিধি শহরের। দক্ষিণদিকে দিঘিরপাড় অঞ্চল জুড়ে অধিকাংশ শহরবাসীর বাস। একটা বিরাট দিঘির চারদিকে ছোটো ছোটো ঘর। কোনোটার চালা টিনের, কোনোটার বা খড়ের। কবি নবীন সেন যখন মুনসেফ ছিলেন এখানে তখন তাঁরই উদ্যমে কাটানো হয়েছিল এই দিঘি।
দিঘিরপাড়েরই বাসিন্দা ছিলাম আমি। দিঘির জলে সাঁতার কাটা একটা অপরিহার্য আনন্দের অঙ্গ ছিল আমাদের। তা ছাড়া আরও একটা কারণে দিঘিটি আকর্ষণীয় ছিল শৈশবে। ছোটো ছোটো রঙিন মাছ দিঘির কিনারে শ্যাওলা ঝোঁপের ভেতর ঘুরে বেড়াত। পাঠশালা পালিয়ে দল বেঁধে সেই মাছ ধরতে আসতাম আমরা। বড়োদের চোখ এড়িয়ে নিষিদ্ধ কাজটা সেরে নেবার সেই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু সময় সময় ধরা পড়ে যেতাম তবু।
‘ওখানে কী করছিস তোরা?’–-একদিন একটা গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে হকচকিয়ে চেয়ে দেখি সুধেন্দুদা দাঁড়িয়ে পেছনে। পড়ি কি মরি করে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল, ধরা পড়ে গেলাম আমি।
পাঠশালা পালিয়ে এই কাজ করে বেড়াচ্ছিস? সুধেন্দুদা তখনও আমার হাতটা ধরে রেখেছেন। আমার মুখে ‘টুঁ’ শব্দটি নেই।
‘দিঘির পাহারাওলা দেখতে পেলে হাড় ভেঙে দেবে সে খেয়াল আছে?’–সুধেন্দুদা হাত ছেড়ে দিয়ে কাছে টেনে নিলেন আমাকে। নিবিড় স্নেহে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলেন। একটা প্রীতির প্রবাহ যেন এই সুধেন্দুদা। বিদেশি যুগের জেলখাটা লোক। বাড়ি মাইটভাঙা গ্রামে। শহরে ছোটো একটা বইয়ের দোকান আছে তাঁর। স্কুল-পাঠশালার বই ছাড়াও উঁচুদরের সব বই রাখতেন তিনি। ওসব বই কাউকে কিনতে দেখিনি কখনো। সুধেন্দুদা আমাদের পড়তে দিতেন বইগুলো। রাজনীতি আর সাহিত্যের আস্বাদ নিতাম আমরা সেইসব বই থেকে। ঝড়ের রাতের বিজয়ী অশ্বারোহীর মতো আজও দেখতে পাই সুধেন্দুদাকে। মাইটভাঙায় চিরাচরিত দুর্গাপুজো নিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল একবার। হিন্দু-মুসলমানের উন্মত্ত বিরোধ, দু-পক্ষই কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছে। একটা রক্তের নদী হয়তো বয়ে যাবে কিছুক্ষণ পরেই। সহসা সুধেন্দুদা কোথা থেকে এসে মাঝখানে বাজের মতো পড়লেন। বিরোধের নিষ্পত্তি হল নিমেষেই। কিন্তু আঘাতে জর্জরিত হয়ে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে চলে গেলেন সুধেন্দুদা। সেই অনির্বাণ আদর্শের দীপশিখাকে ভুলব না কোনোদিন।
রবিবার আমাদের কাছে ছিল একটা দুর্লভ দিন। দুপুরের পরেই বেরিয়ে পড়তাম আমরা। আমাদের দলের সর্দার ছিলেন দ্বিজেনদা। শহরের বুকের ওপর দিয়ে সোজা উত্তর দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেই পথে হেঁটে চারআনির বাগে চলে যেতাম আমরা। দুর্গম জঙ্গলে আচ্ছন্ন চারআনির বাগ। সরু সরু পায়ে হাঁটা পথ আছে ভেতরে ঢুকবার। কয়েকটি পুরোনো দিঘি নানানরকম জলজ গুল্মে এমনভাবে ঠেসে আছে যে সেইসব আগাছার ওপর দিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে পার হওয়া যায়। জঙ্গলের এখানে সেখানে দালানের ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে।
একটা কাহিনি প্রচলিত আছে এই চারআনির বাগ সম্বন্ধে। পোর্তুগিজদের বিলীয়মান প্রভাবের মুখে মুসলমান কৃষাণের ছেলে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল সন্দীপের। প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে নাম নিয়েছিল সে দিলাল রাজা। বাগানের এই জায়গায় ছিল তার রাজপ্রাসাদ। তারপর একদিন দিলাল রাজার ক্ষমতাও অপহৃত হল আর কালক্রমে তার প্রাসাদ পরিণত হল এই জঙ্গলাকীর্ণ বাগানে। পায়ে হাঁটা পথ থাকলেও বাগানে বড় একটা ঢোকে না কেউ। কাঠুরেরা কাঠ কাটতে আসে মাঝে মাঝে। আর আসে গ্রামাঞ্চলের নামকরা সাপুড়ে ওঝারা। সাপ ধরবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তাদের। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিষধর সাপ ধরে ফেলে–বৃহৎ অজগরও অনায়াসে আয়ত্তে নিয়ে আসে। এইসব সাপ শহরে গ্রামে দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে তারা। বাগানের একটু দূরেই চারআনির কাছারিঘর। কাছারিঘরের সামনেই খোলা মাঠে হাট বসে শনি-মঙ্গলবার। হাটের এই দুইদিন নিস্তেজ নিষ্প্রাণ চারআনি হঠাৎ জেগে ওঠে যেন। সহস্র লোকের পদাঘাতে ও পদপাতে চারআনির বুকে প্রাণ সঞ্চার হয়। শুক্রবারে চাঁদবিবির মসজিদে নামাজের জমায়েত বসে। কাছারির ডান দিকে একটা বড়ো পুকুরের পাড়ে চাঁদবিবির মসজিদ। কারুকার্য খচিত, হলদে রঙের বিরাট মসজিদ। অনেক কালের পুরোনো। ইতিহাসের চাঁদ সুলতানা এর নির্মিতা বলে সন্দেহ করে অনেকে।
পড়ন্ত রোদে ধুলো মাখা-গায়ে অন্য কোনো পথে ফিরতাম আমরা। হাঁটতে হাঁটতে বসে জিরিয়ে নিতাম পুন্নাল গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায়। অশ্বথ বটের মতো বিশালকায় গাছ। শাখাপ্রশাখায় অজস্র গুটি ফল ধরে। গ্রামের লোকেরা এই ফল থেকে একপ্রকার তেল তৈরি করে বাতি জ্বালায়। পুন্নালের ছায়া ছাড়িয়ে এসে দাঁড়াতাম হাওতালের পুলের ওপর। পুলের নীচে একটা খরস্রোতা খাল। কৃষাণের ছেলেরা মহিষের পিঠে চড়ে ওপারে গিয়ে ওঠে।
মন আজ মুখর হয়ে উঠেছে স্মৃতিতে। কালবৈশাখীর আসন্ন ঝড়ের সংকেতে সন্দীপের সমুদ্র হয়তো এখন গম্ভীর হয়ে উঠেছে। অপর পারের যাত্রীদের পক্ষে এ সময়টা ভয়ংকর, তবু এই ভয়ংকরের রুদ্র লীলার চরণতলে দোদুল্যমান সন্দীপের চরকে ভুলতে পারিনি। যদি কোনোদিন সুযোগ আসে আবার ফিরে যাব। আবার মন খুলে বঙ্গোপসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে নীলাঞ্জন আকাশের দিকে মুখ তুলে গাইব–’সার্থক জনম মাগো, জন্মেছি এই দেশে।
পাবনা জেলা – গাড়াদহ পঞ্চকোশী ঘাটাবাড়ি সাহজাদপুর
কালের চাকা আবর্তিত হয়ে চলেছে অবিরাম। মানুষের জীবনের ওপর সে চাকার দাগ স্পষ্ট হয়ে থাকে। তাই একদিন যারা ছিল শ্যামল মায়ের আদুরে দুলাল, প্রকৃতি তার হৃদয়ের সমস্ত সৌন্দর্য নিঙড়ে যাদের অন্তর করেছিল কোমল, সজীব, তারা আজ রিক্ত, সর্বহারা। তারা কি কখনো ভেবেছিল, যে-দেশকে তারা ‘মা’ বলে জেনেছে–যে-দেশের মাটি তাদের কাছে স্বর্গের চেয়েও পবিত্র, সেই দেশ তাদের নয়? একটা কালির আঁচড়ের ফলে তাদের সব কিছু ছেড়ে আসতে হবে? ওপারের লক্ষপতি এপারে আসবেন শরণার্থী হয়ে, একটু মাথা গোঁজবার ঠাঁই আর দু-মুঠো ভাতের জন্যে হবেন অন্যের কৃপাপ্রার্থী। কচি শিশুর মুখে তুলে দেবেন দুধের গুঁড়ো? বাস্তবের কঠিন কশাঘাতে মন যখন নিস্তেজ হয়ে আসে তখন মনে পড়ে পল্লির সেই অনাবিল সৌন্দর্যের ছবি। মানসপটে ভেসে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত সেই শ্যামল বনানীর শোভা। কিন্তু সে রামধনুর মতোই ক্ষণস্থায়ী। তবুও তাকে তো ভোলা যায় না। ছন্নছাড়া জীবনের লক্ষ্যহীন যাত্রাপথে সেই ছবিই বার বার ভেসে ওঠে। আমার গ্রাম আমাকে ডাকে–নিভৃতে, অতিগোপনে। তার সেই ডাকে কি আর কোনোদিনই সাড়া দিতে পারব না? তার গোপন আহ্বান কি কোনো সাড়া না নিয়েই ফিরে যাবে?
পাবনা জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম, গাড়াদহ তার নাম। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন পটে আঁকা একখানা ছবি। শীর্ণকায়া করতোয়া কুলু কুলু রবে গাঁয়ের পূর্বসীমানা দিয়ে বয়ে চলেছে।
প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বাস আমাদের গাঁয়ে। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মুসলমান। অধিকাংশেরই জমিজমা বেশি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়েই এরা সংসার চালায় আর সকলের আহার জোগায়। সারাদিন এরা হাড় ভাঙা খাটুনি খাটে। শেষরাতে পাখির ডাকে এদের ঘুম ভাঙে। কাঁধে লাঙল নিয়ে তখন দলে দলে সবাই মাঠে যায়–সঙ্গে নিয়ে যায় এক বদনা জল আর তামাক–যা না হলে এদের একদন্ডও চলে না। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করে আবাদের খরচ জোগায়। সবসময় এক চিন্তা–কী করলে ফসল ভালো হবে। ভগবানের কাছে মানত করে ঠিক সময় বৃষ্টি দেওয়ার জন্যে। বর্ষায় গ্রামের অলিগলি পুকুর যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে, নৌকা ছাড়া যখন ঘর থেকে বের হওয়া যায় না তখনও দেখেছি ওরা দলবেঁধে ডুব দিয়ে দিয়ে পাট কাটছে। সমস্ত মাঠ ওদের কণ্ঠনিঃসৃত ভাটিয়ালি গানে মুখর হয়ে উঠেছে। ওদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে অনির্বচনীয় আনন্দোচ্ছাস। ওরা বলে, ওই গানের সুরের মধ্যেই সব কষ্ট ভুলে থাকার মন্ত্র রয়েছে। ওদের অনেকের বাড়িতেই তেমন ভালো ঘর নেই। কোনোরকমে বেঁচে থাকার জন্যে যা প্রয়োজন তার বেশি কিছুই নেই। অনেকে শুধু মজুর খেটেই সংসার চালায়। আবার কেউ কেউ ছোটোখাটো ব্যাবসাও করে। দল বেঁধে ওরা হাটে যায়। মাছ, লঙ্কা, পেঁয়াজ এগুলো না হলে একদিনও ওদের চলে না। সুখ-দুঃখের আলাপ করতে করতে বাড়ি ফেরে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে যখন ধানের খেতে সোনার রং দেখা দেয়, বাতাসে ধানের শিষগুলো নুয়ে পড়ে যখন পথচারীকে সাদর সম্ভাষণ জানায়, তখন চাষিদের মনে আর আনন্দ ধরে না। ধানখেতের দিকে চেয়ে তারা বৎসরের সমস্ত কষ্ট ভুলে যায়। কবে তারা এই ধান ঘরে তুলবে? এ থেকে দিতে হবে মহাজনের দেনা, ইউনিয়ন বোর্ডের ট্যাক্স, জমিদারের খাজনা, আরও কত কী!
উত্তর দিকে তাঁতিপাড়া। দিন-রাত খটখট শব্দে তাঁত চলছে। গামছা, লুঙ্গি, ছোটো কাপড় –এগুলোই সাধারণত বোনা হয় ওদের তাঁতে। সপ্তাহে একদিন করে তাঁতিরা হাটে তা নিয়ে যায়, মুনাফা যা থাকে তাতে ভালোরকমেই চলে। রাস্তা দিয়ে চলতে নতুন সুতোর কেমন যেন একটা গন্ধ নাকে আসে। কোনোসময়ই তাঁত বোনার বিরাম নেই। তাঁতিপাড়ার একটু দূরেই কুম্ভকারদের বাস। কত সময় গিয়ে বসেছি ওখানে। কী নিপুণ হাতের স্পর্শে কাঠের ঘূর্ণায়মান চাকার মাঝ থেকে হাঁড়ি তৈরি হয়ে আসত তা দেখে আশ্চর্য হতাম। এরপর সেইসব হাঁড়ির সঙ্গে বালি মিশিয়ে তারা পিটত অতিসন্তর্পণে। রাশি রাশি হাঁড়ি, কলসি, থালা, বাটি একসঙ্গে জড়ো করে মাটির নীচে গর্ত করে তার ওপর মাটি চাপা দিয়ে ভেতর থেকে আগুন ধরিয়ে দিত। বুড়িতলা’য় মানত করত যাতে এ সময় বৃষ্টি না হয়। পুজো-পার্বণ উপলক্ষে কুমোরপাড়ায় লোকের ভিড় জমত। সবাই দেখেশুনে বাছাই করা জিনিস নিয়ে আসত। পরিশ্রমের তুলনায় সে জিনিসের দাম নিতান্তই কম। বর্ষার সময় নৌকো বোঝাই করে কুমোররা এগ্রাম সেগ্রাম ঘুরে বেড়াত এবং হাঁড়ি-কলসির বিনিময়ে গৃহস্থের বাড়ি থেকে ধান নিত। এইটেই ছিল ওদের বড়ো আয়। এইভাবে তারা সারাবছরের ধান জোগাড় করে রাখত।
আর একটু দূরেই কর্মকারপাড়া। এখানেও সারাদিনরাত হাতুড়ির আওয়াজ কানে আসত। বিয়ে বা অন্য উৎসব উপলক্ষ্যে এদের কাজ বহুগুণ বেড়ে যেত। কোনো চাষিরই প্রায় সোনার গয়না তৈরি করার সামর্থ্য নেই। তাই পাটের টাকা পেলেই তারা বৎসরে অন্তত একটিবার রুপোর গয়না তৈরি করায়। সবচেয়ে ভিড় জমত সাধুর দোকানে। রাত্রিতে লাল টকটকে লোহার চিমটে দিয়ে ধরে সে যখন গয়না পিটত তখন চারদিকে আগুনের ফুলকি উড়ে পড়ত। আর সেই জ্বলন্ত লোহার আঁচে তার মুখের একাংশ লালচে মেরে যেত। এই। কর্মচঞ্চল জীবনের মাঝখানেও এরা আমোদ-প্রমোদ অত্যন্ত ভালোবাসত। মাঝে মাঝে খোল করতাল নিয়ে কীর্তন করত; আবার কবিগান, পাঁচালি, ঢপ কীর্তন, কৃষ্ণযাত্রা, বাউলগান শুনেও কোনো কোনোদিন রাত কাটিয়ে দিত। খাবারের চিন্তা তাদের ছিল না, তারা জানত যতদিন হাত ততদিন ভাত, তাই অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে তারা থাকত না।
কেউ অন্যায় করলে তার বিচার হত গ্রামেই। হিন্দুপ্রধান এবং মুসলমান প্রধানদের নিয়ে বসত পঞ্চায়েত। আসামি নত মস্তকে তাঁদের নির্দেশ মাথা পেতে নিত। সুখে দুঃখে সকল সময়ে এমনিভাবে গ্রামবাসীরা একসঙ্গে বসে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করেছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময়ও ঠিক এমনিভাবে তারা তাদের কর্মপন্থা ঠিক করেছিল। জমিদারবাড়িতে দরবার বসল। সামনেই একটা ছোটো চৌকির ওপর তাকিয়া হেলান দিয়ে তিনি বসে রয়েছেন। সামনে হুঁকোর নলটি পড়ে আছে। গ্রামের প্রধানগণ একে একে এসে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে যে যার আসনে বসে পড়ল। প্রজাদের সুখ-দুঃখের অভিভাবক তিনি।
গ্রামের ঠিক মধ্যস্থলে রায়েদের বাড়ি। পাশেই ব্রাহ্মণপাড়া, পুজোআর্চা নিয়েই এরা সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। সন্ধের সময় প্রতিবাড়িতে ঠাকুরের সন্ধ্যারতি আরম্ভ হত। মন্দিরপ্রাঙ্গণ লোকে ভরে উঠত। ছেলে-মেয়েরা পুজোর প্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফিরত। এ ছিল তাদের নিত্যকর্ম। রায়েদের বাড়ির সামনেই খেলার মাঠ। শত কাজের মধ্যেও দলে দলে লোক আসত খেলা দেখতে। অনেক দূর থেকেও খেলোয়াড়গণ আসত। গ্রামবাসীরা তাদের সেবার ভার সানন্দে নিজেদের মাথায় তুলে নিত।
মাঠের একপাশেই ‘বুড়িতলা’। কীভাবে যে এর এই নামকরণ হয়েছে তা আমরা জানি না। প্রতিশনিবার এর প্রাঙ্গণে লোক সমাগম হত। মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী নর-নারী হাতে পুজোর ডালা নিয়ে বসত এই বুড়িতলায়। আসলে গাছটা ‘সরা গাছ। গোড়া থেকে দু-তিন হাত পর্যন্ত সিঁদুর দিয়ে লেপা। লোকে বলে এ গাছ নাকি জ্যান্ত দেবতা। লোকমুখে আরও শোনা যায় যে, আশপাশের অন্ধকারে কারা নাকি ঘুরে বেড়ায়।
গাঁয়ের পূর্ব দিকে নদীর ধারে জেলেদের বাস। বর্ষার শীর্ণকায়া করতোয়া যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে, জেলেদের ডিঙি তখন সমস্ত নদী ছেয়ে ফেলে। নদীর এপার থেকে ওপার
পর্যন্ত মোটা মোটা বাঁশ পুতে দেওয়া হয় এবং মাঝে কিছুটা জায়গা ফাঁকা থাকে। তারপর সমস্ত জায়গাটা জেলেরা জাল দিয়ে ঘিরে দেয়। বর্ষার সময় এইরকম ভাবে জেলেদের জালে বড়ো বড়ো মাছ ধরা পড়ে। গ্রামের হাটে এদের ধরা মাছ বিক্রি হয়। লোকের ভিড় খুব বেশি হলে উৎসাহী হয়ে হয়তো অমুক সর্দার কি পরামানিক তাকে মাছ বিক্রি করে ঠিকমতো দাম নিতে সাহায্য করে। বেচা-কেনা শেষ হলে জেলেরা খুশি মনে এদের হয়তো একটা ভালো মাছ খেতে দেয়। এর মধ্যে কোনো কুটিলতা নেই। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে, সহজ অন্তরে এরা সাহায্যকারীকে তার পরিশ্রমের জন্যে সামান্য কিছু উপহার দেয়।
খেলার মাঠের একটু দূরেই স্কুল, ডাকঘর, ইউনিয়নবোর্ড অফিস। ডাকঘর থেকে যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ওই রাস্তার পাশে থাকত এক বাগদি নাম তার ঝন্টু। ডান হাতের কবজি পর্যন্ত কাটা। ওর নাকি আগে মাছ ধরার খুব ঝোঁক ছিল। গাঁয়ের পশ্চিম দিক দিয়ে যে বিলটা গেছে লোকে আজও ওটাকে ‘লক্ষমণির বিল’ বলে। ঝন্টু একদিন নাকি ওখানে মাছ ধরতে যায় গভীর রাত্রিতে। ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ দেখল সাতটা কলসি ভেসে আসছে–আর তার ভেতর থেকে ‘টুং টাং’ আওয়াজ হচ্ছে। প্রথম কলসিটি ধরতেই সে শুনতে পেল কে নাকি ভেতর থেকে বলছে-‘তোমার যা দরকার পরের কলসিটি থেকে নাও। এইভাবে পর পর ছয়টি চলে গেল। শেষের কলসির ঢাকনাটা আপনা থেকেই খুলে গেল। কে নাকি বলল–’একবারে যা পারো নাও। ঝন্টু দেখল ঘড়া ভরতি সোনার মোহর– একবার নিয়ে কোঁচড়ে রেখে আবার যেমনি হাত দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে হাতের কবজিটুকু কলসির ভেতরেই রয়ে গেল। সেই থেকে নাকি ও ‘হাতকাটা ঝন্টু’ বলেই সকলের কাছে পরিচিত।
এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছে ঝন্টু। তবু সে মাঝে মাঝে গ্রামের মধ্যে নানারকম খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। কোনোদিন বা গান গায় আবার কোনোদিন বা নিজের জিভটা কেটে থালার ওপর রেখে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। ছেলেবেলায় ওর কারসাজি না বুঝতে পেরে অবাক বিস্ময়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম।
পুজোর সময় আমাদের গ্রাম এক অপূর্ব শ্রী ধারণ করত। আনন্দময়ীর আগমনে চারিদিক আনন্দমুখর হয়ে উঠত। আমাদের পেয়ে গাঁয়ের চাষি সম্প্রদায় যেন হাতে স্বর্গ পেত। তাদের ধারণা–আমরা এলেই থিয়েটার হবে। সাড়া পড়ে যেত গ্রামে। এখানে হিন্দু-মুসলমানে কোনো ভেদ নেই। এ যে আমাদের জাতীয় উৎসব-এর সঙ্গে রয়েছে যে আমাদের অন্তরের যোগ। তাই একই সঙ্গে মন্দিরের সামনে ভিড় জমে উঠত হিন্দু-মুসলমানের। কোনো দ্বিধা নেই–কোনো সংকোচ নেই। সকলেই যেন ওই একই মায়ের সন্তান। বিজয়ার দিন করতোয়ার তীর আর একবার ভরে উঠত। উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন সব সেদিন এক হয়ে যেত।
গ্রামের দক্ষিণ দিকে বাজার। নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসই এখানে পাওয়া যায়। গরিব চাষিরা বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে আসে বিক্রি করতে। যা পায় তাই দিয়ে অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্যাদি কিনে নিয়ে যায়। দুধ খাবার মতো সামর্থ্য তাদের অনেকেরই নেই। বাজারের একধারে বিরাট গর্ত। ওখানে চড়কের গাছ পোঁতা হয়। চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে এখানে মেলা বসে। দেখেছি দু-জনের পিঠে বড়ো বড়ো বঁড়শি বিধিয়ে একটা বাঁশের দু-ধারে ঝুলিয়ে তাদের ঘোরানো হত। সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠত দেখে। আজ নানারূপেই মনে পড়ছে আমার গ্রামকে। জন্মভূমি থেকে বহুদূরে চলে এসেছি; তবু মনে পড়ছে পাবনা জেলার ছোটো সেই অখ্যাত পল্লি-জননীকে। এখন হয়তো শীর্ণকায়া করতোয়া। বর্ষার প্লাবনে যৌবন উছলা হয়ে উঠেছে। গ্রামের দিগন্তে জমেছে সন্ধ্যার ছায়া। আমার শত স্মৃতি জড়ানো সেই গাড়াদহ। দেশের সীমানায় সে আজ কতদূর, তবু মনের কত কাছে, কত নিভৃতে। এ তারই অশ্রুসজল ইতিহাস।
.
পঞ্চকোশী
পঞ্চকোশী। নদী নয়, গ্রামের নাম। আমার নিজের গ্রাম। নামের হয়তো ইতিহাস আছে। সবটা আজ মনেও নেই, থাকবার কথাও নয়। তবু পাবনা জেলার উপান্তে সিরাজগঞ্জ থেকে পাঁচক্রোশ দূরের এই গ্রামে আমার জন্ম। নামের ইতিহাস যাই হোক, গ্রামটি যে এককালে নেহাত ছোটো ছিল না তার প্রমাণের অভাব নেই। তার পুরোনো আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায় নানা কাহিনি বিজড়িত কতকগুলো পরিত্যক্ত ভিটে থেকে; আর পাওয়া যায় হৃতগৌরব জমিদারবাড়ির চুনকাম খসা, নোনাধরা ইটের তিনতলা দালানের চোরা কুঠরির গহ্বর থেকে সেখানে এখন চামচিকে আর লক্ষ্মীপেঁচার তত্ত্বাবধানে পড়ে রয়েছে। রৌপ্যনির্মিত আসা-সোঁটা, বল্লম আর বিরাট আকারের সব ছাতি আর বস্তাপচা অজস্র শামিয়ানা, তাঁবু আর শতরঞ্চি। জীবনের যে সময়টা রূপকথা শোনবার বয়েস সে সময়ে এমন কোনো সন্ধ্যা বাদ যায়নি যেদিন ঠাকুমার মুখ থেকে শুনতে পেতাম না আমাদের গ্রামের প্রাচীন নানা অপরূপ ঐতিহ্যের কাহিনি।
গ্রামের পুবদিকে মাঠের মধ্যে ওই যে একটা ভিটে আছে যেখানে এখন রয়েছে ঘনসন্নিবিষ্ট আমগাছ আর বাঁশের ঝাড়, ওইখানে ছিল মনমোহন দাশের বাড়ি। মনমোহন দাশের ঐশ্বর্যের খ্যাতি ছিল প্রচুর–বদান্যতার খ্যাতি ছিল প্রচুরতর। সেকালের রাজর্ষি জনক রাজা হয়েও নিজহাতে হলকর্ষণ করতেন, আর একালের মনমোহন দাশ সোনার খড়ম পায়ে দিয়ে নাকি নিজে গোরু দিয়ে ধান মাড়াতেন। হয়তো এ নিছক কাহিনি ছাড়া আর কিছুই নয় কিন্তু ঠাকুমার মুখে সেদিন এসব শুনে আমাদের মনে যে অভূতপূর্ব ভাবের সঞ্চার হত সে তো আজও ভুলবার নয়। এমন আরও কত টুকরো টুকরো কাহিনি–! তারপর জমিদারবাড়ির কথা যে বাড়ি একদিন ছিল আত্মীয়-অনাত্মীয়, চাকর-চাকরানির কলরবে মুখরিত, আজ সে বাড়ির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে দাঁড়কাকের কর্কশ কণ্ঠস্বর। এখনও কত নৈশ নিস্তব্ধতার অবকাশে ঠাকুমার মুখে শোনা জমিদারবাড়ির কাহিনি চলচ্চিত্রের মতো একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। জমিদার দীননাথ দাশগুপ্ত তাঁর দিনাজপুরের বাসা থেকে বৎসরান্তে একবার দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে পঞ্চকোশীর বাড়িতে ফিরে আসছেন। সাতদিন আগেই বাড়িতে খবর পৌঁছে গেছে। নায়েব গোমস্তা থেকে আরম্ভ করে পেয়াদা চাকর চাকরানিদের একমুহূর্ত বিশ্রাম নেই। ঘর-দোর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার জন্যে সকলেই অতিমাত্রায় ব্যতিব্যস্ততদারক রত নায়েব প্রসন্ন ভট্টাচার্যমশাই তাঁর সুপুষ্ট উদর নিয়ে দোতলা-একতলা ছুটোছুটি করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন, আর অযথা চেঁচিয়ে সারাবাড়িটা তোলপাড় করে তুলেছেন। বাইরের মন্ডপে চার-পাঁচজন কুমোর অক্লান্ত পরিশ্রমে সুবিশাল দেবীপ্রতিমা সমাপ্ত করবার জন্যে ব্যস্ত। সকলেই জানে তাদের সবার জন্যেই আসছে নানারকমের উপহার। এদিকে জমিদার দিনাজপুর থেকে জলপথে গ্রামের সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন, খবর আসতেই তাঁকে অভ্যর্থনা করে আনবার জন্যে দলে দলে ছুটে চলেছে হিন্দু-মুসলমান প্রজার দল। প্রত্যেকের কাঁধে একটা করে লাল ব্যাজ–আর হাতে লাল নিশান। পেয়াদা বরকন্দজরাও চলেছে। কাঁধে তাদের রুপোর আসা-সোঁটা, হাতে তাদের রুপোর বল্লম, আর অপরূপ সাজে সজ্জিত বেহারার দল নিয়ে চলেছে বহুবর্ণে খচিত মখমলের জাজিম বিছানো পালকি।…পুজোর কয়েকদিন কারও বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত না, হিন্দু মুসলমান সকলেরই সে ক-দিন জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ। কল্পনার চোখে দেখতে পাই বাইরের প্রাঙ্গণে সারি সারি পাশা-পাশি বসে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিমন্ত্রিত প্রজার দল গরদ বসন পরিহিত নগ্নপদ জমিদার দীননাথ নিজে উপস্থিত থেকে তদারক করছেন তাদের আহারের।…আজ ভাবি সেদিন কোথায় বা ছিল দুই জাতিতত্ত্ব, কোথায়ই বা ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ! পরিপূর্ণ প্রীতির সম্পর্ক ছিল হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে; চাচা, ভাই সম্বোধনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল একটা নিকট মধুর সম্পর্ক! ঝগড়া বিবাদ হত, মারামারি হত–দুই পক্ষই ছুটে আসত জমিদারের কাছারিতে, গ্রামের মোড়লদের নিয়ে বসত মিটিং, হত বিচার, কমিটি যে রায় দিত, দুই পক্ষই তা মাথা পেতে মেনে নিত। হিন্দু সেদিন মুসলমানের কাছে অপরাধ স্বীকার করতে সংকোচ বোধ করত না, মুসলমানও হিন্দুর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা ভিক্ষে করতে দ্বিধা করত না।
এই তো সেদিনের কথা! মধ্যাহ্নে জমিদারবাড়ির কুল-বিগ্রহের ভোগশেষে যখন কাঁসর বাজত, দেখতাম দলে দলে উল্লসিত কণ্ঠে চিৎকার করতে করতে থালা হাতে ছুটে আসছে হিন্দু-মুসলমান ছেলে-মেয়ে–সকলেই প্রসাদপ্রার্থী। আবার সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠতেই আসত বহু মুসলমান স্ত্রী-পুরুষ কারও-বা মাথাধরা, কারও-বা চোখ ওঠা, কারও-বা পেটকামড়ানি, কারও বা মেয়েকে ভূতে পেয়েছে–সকলেই আসত একটু ‘ঠাকুর’ ধোয়া পানির জন্যে, (চরণামৃতকে তারা বলত ঠাকুরধোয়া পানি)। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা মতির মা, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাদের হিন্দুর দেবতাকে বিশ্বাস করলে তোমাদের ইসলাম বিপন্ন হয় না?’ মতির মা উত্তর করেছিল, ‘অতশত বুঝি না বাপু, যাতে কইর্যা আমাগো উপগার হয় আমরা তাই করি। তা ছাড়া আপনাগ ঘরে দ্যাবতা, আর আমাগ ঘরে আল্লা আর পেরথক না, আপনারা কন ভগবান আর আমরা কই খোদা!’ সেদিন দেশের অধিকাংশ জনসাধারণই ছিল বোধ হয় আমাদের এই মতির মার মতো মানুষ! সরল অকপট বিশ্বাস নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে তাই তারা হয়ে উঠতে পেরেছিল একাত্ম!
আজ মনে পড়ে সেই নাজির ভাইয়ের কথা। শৈশব থেকে আরম্ভ করে কৈশোর পর্যন্ত প্রতিটি দিনের সে ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। সামাজিক মর্যাদা, বয়সের পার্থক্য, শিক্ষার স্তরভেদ কিছুই তার ও আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। খেলার মাঠ থেকে আরম্ভ করে পড়ার ঘর পর্যন্ত তার সঙ্গ ছিল আমাদের অপরিহার্য। মনে পড়ে আমির ভাই, ফজু ভাই, জোমসের আলি, আবদুল সরকারের কথা। সন্ধেবেলা মামার ডিসপেন্সারি’ ঘরে কড়া শাসনে তিন-চারজনে মিলে আমরা যখন সুর করে স্কুলের পড়া তৈরি করতাম সময় সময় মামাকে কেন্দ্র করেই আমাদের আড্ডাও জমে উঠত প্রবলভাবে! সন্ধে সাতটা থেকে রাত এগারোটা অবধি কোনো কোনোদিন একটানা আড্ডা চলত। খাবার তাগিদ দিতে দিতে বাড়ির সবাই বিরক্ত হয়ে উঠত, তবু আমাদের আসর চলত পুরো দমে।
মনে পড়ে সেইসব বাল্যবন্ধু রশি, সওকত, রউফদের কথা। নিজেদের গ্রামে হাই স্কুল ছিল না। পড়তে যেতাম দু-মাইল দূরে সলপ স্কুলে। স্কুলে যাওয়ার পথে আমাদের বাড়ি ছিল ‘সেন্টার। দক্ষিণপাড়া থেকে আসত রশিদের দল, আর পাশের গ্রাম রায়দৌলতপূর থেকে আসত সুনীলদা, কার্তিকদা, শান্তি। একসঙ্গে স্কুলে যেতাম আর একসঙ্গে ফিরতাম। গল্পগুজবে আর হাস্য পরিহাসে দু-মাইল রাস্তা কখন ফুরিয়ে যেত টেরও পেতাম না। বৈশাখের খররোদ আর আষাঢ়ের মুশলধারায় বৃষ্টি আমাদের কোনোদিন নিরানন্দ করতে পারেনি। চৈত্র মাসের বারুণি, স্নানের দিন থেকে আরম্ভ হত আমাদের মর্নিং স্কুল। সূর্য ওঠার অনেক আগেই রওনা দিতাম স্কুলে। শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে প্রাণ জুড়োনো ঝিরঝিরে শীতল হাওয়ায় খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে দল বেঁধে স্কুলে যাওয়ার সে কী আনন্দ ভাষার মাপকাঠি দিয়ে তার গভীরতা নির্ণয় করা চলে না। মাঠজুড়ে সবুজের মেলার মধ্যে দেখতাম প্রকৃতির অবর্ণনীয় দৃশ্যসম্ভারের আয়োজন। স্কুল থেকে ফেরার পথে পরের গাছ থেকে ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়ার প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের নিত্যকার কাজ।
বর্ষায় চারিদিক যখন জলে জলময় হয়ে যেত তখন স্কুলে যেতে হত নৌকোয় করে। আমাদের ঘাটে বাঁধা নৌকোয় যেয়ে সবাই উঠতাম–প্রত্যেকের এক হাতে বই-খাতা, আর এক হাতে নিজ নিজ বইঠা। স্কুলের গায়ে নৌকো ভিড়িয়ে একই সঙ্গে ঝুপ ঝুপ করে বইঠা ফেলে উঠে যাওয়া, ফেরার পথে অন্য গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে বাইচ প্রতিযোগিতা, এসব কি সহজে ভোলবার! আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে বলরামপুরের নদী। ধান-পাট কাটা শেষ হওয়ার আগেই যাতে জল এসে সমস্ত ডুবিয়ে না দেয় সে জন্যে প্রতিবছরই নদীর মুখে তৈরি করা হয় প্রকান্ড একটা বাঁধ। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই আমরা দিন গুনতাম কবে বাঁধ কেটে দেওয়া হবে আর কবে আমাদের পুকুরে জল পড়বে। পুকুরে বিপুল স্রোতে জল আসত। তা ছিল আমাদের একটা বড়ো আকর্ষণ। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই হয়তো শুনতে পেতাম জলস্রোতের একটানা কল্লোল, বুঝতাম পুকুরে জল পড়ছে। তখন কোথায় থাকত ভোরবেলার সুখনিদ্রা, কোথায় থাকত পড়াশোনা–ছুটতে ছুটতে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসতাম মাখন, রবি আর কেষ্টদের। মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যেত। জেলেরা স্রোতের মুখে বড়ো বড়ো জাল পেতে ‘খরা’ তৈরি করত মাছের জন্যে। মাছ ধরার সে কৌশলটি একমাত্র পূর্ববাংলায়ই দেখেছি।
আমার গ্রামের চাষিদের কী সুন্দর সরল জীবনযাত্রা! ভোরবেলা যখন দেখতাম কাঁধে হাল আর কোঁচড়ে মুড়ি নিয়ে চাষির দল এগিয়ে চলেছে, তখন কতদিন মনে ইচ্ছে জাগত অমনি করে ওদের সঙ্গে মাঠে যেতে। মাঠেও আল ধরে কোথাও যেতে যেতে যখন দেখতাম নিড়ানি হাতে গান করতে করতে খেতের মধ্যে ওরা কাজ করে চলেছে–মন যেত তখন উন্মনা হয়ে আর নিজের অজ্ঞাতেই যেন পা দুটো দাঁড়িয়ে যেত। যেকোনো ঘটনাকে উপলক্ষ করে নিজেরাই মুখে মুখে ওরা রচনা করত গান–আর সেই গান তারা উন্মুক্ত প্রান্তরে দল বেঁধে গলা ছেড়ে গাইত প্রচন্ড রোদে চাষের কাজ করতে করতে। গ্রামের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের কথা মনে পড়লে আজও কানে বাজে সেই সুর। মনে হয় এখনও যেন সেই সুরেই ওরা গেয়ে চলেছে,
শুনেন সবে ভক্তিভাবে কাহিনি আমার–
শিবনাথপুরের কুমুদবাবু ছিলেন জমিদার,
ছিল সে ডাঙাদার,
ছিল সে ডাঙাদার, নাম তার ছিল জগৎজুড়ে,
জ্যৈষ্ঠ মাসের ১২ তারিখ ঘটনা মঙ্গলবারে।
মলো সে অপঘাতে,
মলো সে অপঘাতে, গেল সাথে দুনিয়ার বাহার–
তারপরে শুনেন বাবুর বাড়ির সমাচার।
বাবু যখন যাত্রা করে,
বাবু যখন যাত্রা করে গাড়িতে চড়ে রওনা
হতে যায়,
টিকটিকির কত বাধা পড়ে ডাইনে আর বাঁয়।
তা শুনে ঠাইগরানি কয়,
তা শুনে ঠাইগরানি কয়, বলি তোমায়
গঞ্জে যেয়ো না,
ঘটতে পারে আপদ বিপদ পথে দুর্ঘটনা।
স্বপ্নের কথা বুড়ি করিল বর্ণনা।
সব কথা অবশ্য আজ আর মনে নেই। বিপর্যস্ত জীবনযাত্রায় স্মৃতিও হয়ে আসছে ধূসর। তবু জানি আজও গ্রামের সাধারণ মানুষের দল তেমনি আত্মীয়তায় আমার কথা মনে রেখেছে। মনে রেখেছে আমায় সেই রশিদ, সওকতের দল। মনে রেখেছে আজিজুল, জেলহেজভাই। তবু নাকি সে গ্রাম আর আমার নয়। আমি আজ শরণার্থী।
.
ঘাটাবাড়ি
পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ থেকে মাইল আঠারো দূরে একটি সাধারণ ছোটো গ্রাম। ইতিহাসে খ্যাতি নেই। তবু গ্রামখানি স্বয়ংসম্পূর্ণ। নাম ঘাটাবাড়ি। এর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ছোট্ট নদী আঠারদা। কয়েক মাইল দূরে কান্ত কবি রজনীকান্ত সেনের জন্মস্থান ভাঙাবাড়ি। গ্রামের ইতিহাসে যার নাম অবিস্মরণীয় তিনি হলেন রাজা বসন্ত রায়। এই বসন্ত রায় কে? তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া যায় না। তবে তাঁর সম্বন্ধে এ অঞ্চলে জনশ্রুতির অভাব নেই। পাশের গ্রামে বসন্ত রায়ের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ আজও পড়ে রয়েছে। তাঁর কালের বলে বর্ণিত বড়ো বড়ো দুটি জলাশয় ‘ধলপুকুর’ ও ‘আন্দ পুকুর’ (অন্দর পুকুর) স্বল্প জলের সম্বল নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে আজও।
বাংলার সত্যিকারের সৌন্দর্য তার প্রকৃতির লীলা বিকাশের পরিচয় পাওয়া যায় উত্তর ও পূর্ববাংলায়। পল্লবঘন বৃক্ষরাজির ছায়ায় শান্তির নীড় এক-একটি গ্রাম। সেই লক্ষ গ্রামেরই একটি গ্রাম এই ঘাটাবাড়ি। গ্রীষ্মের শীর্ণ নদী সংকুচিত তীরভূমিতে ক্ষীণধারায় দিয়ে যায় তার স্নিগ্ধ শীতল পরশ। বর্ষায় ফিরে পায় তার হারানো যৌবন। নদীটির সঙ্গেও অনেক লোকপ্রসিদ্ধি জড়িয়ে আছে। ঠাকুরমার মুখে শুনেছি, ওই নদীর মাঝখানে আঠেরোটি বড়ো বড়ো গর্ত আছে। অনেক কাল আগে নদীতে নাকি সিন্দুক ভেসে উঠত। কেউ বলত ওর মধ্যে মোহর আছে আবার কেউ বলত বাসনপত্র।
আমাদের অঞ্চলটা পাটের এলাকা। এককালে সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে নদীর ধারে ধারে সাহেবদের বড়ো বড়ো কুঠি ছিল। আজ সেইসবই যমুনার কুক্ষিগত। নদী কল্লোলে তার কোনো ইঙ্গিত আজ আর পাওয়া যায় না। আমাদের গ্রামাঞ্চলে নীলের চাষও হত। অনেক জায়গায় বিশেষ করে ওই কুঠিপাড়ায় নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায়।
ছুটিতে গ্রামে যেতাম বাইরে থেকে। পুরো একদিন হেঁটে পরের দিন প্রায় বারোটা একটার সময় গ্রামের স্টিমার ঘাট সোয়াকপুরে পৌঁছোতাম। ঘাটে আসবার আগেই স্টিমারের আর্তনাদ আমাদের সচকিত করে তুলত। পাড়ে ভেড়বার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের বেগে ছুটে আসত কুলিরা। কিনারায় দন্ডায়মান নর-নারীর উৎসুক মুখের মাঝখানে দেখতাম আমাদের চিরপুরাতন কর্মচারীর হাসিমুখ। শেষের পথটুকু যেতে হত গোরুর গাড়িতে। সারি সারি মাল, যাত্রী বোঝাই ছোটো ছোটো গোরুর গাড়ি। যেন মহাপ্রস্থানের যাত্রী সব। এমানী ভাইয়ের গাড়ি তৈরি থাকত আমাদের জন্যে। ছইয়ের ভেতর না বসে সব সময়েই আমি এমানী ভাইয়ের পেছনে বসতাম। জীর্ণ গাড়ির চাকার একটানা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ কেমন জানি মোহ সৃষ্টি করত মনে। রৌদ্ররুক্ষ ধূলিময় পথ। শীর্ণকায় গোরুগুলোর মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। চালকের উদ্যত লাঠি দেখে অনেক কষ্টে যেন এগগাবার চেষ্টা করছে। এমানী ভাই মাঝে মাঝে হাঁক দেয়- ‘ডানি-ই ক্যারে, গোরু নৌড় পারে না ক্যা?’ গ্রামের ভেতর আঁকা-বাঁকা যাত্রাপথ। এপাশে ওপাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে ঢেঁকির ঢপ ঢপ শব্দ। শোলার বেড়ার ওপর দিয়ে কিষাণ বউদের উৎসুক কৌতূহলী দৃষ্টি। খেতে কর্মরত চাষিদের প্রশ্ন–গাড়ি যাবে কোনে? হায়, এ সবই অতীতের রোমন্থন মাত্র। কাপড়ের আড্ডা ইনাদপুর এলেই আমাদের গ্রামের কাছে আসা হল। সোজা সড়ক দূর থেকে আমার গ্রামকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গোরুর গাড়ি থেকে নামবার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে আসতেন জসীম কাকা। আগেই বলেছি, গ্রামটি ছোটো হলেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাজার-হাট, ডাকঘর, স্কুল, খেলার মাঠ সব কিছুই সেখানে গ্রামের ধনী-দরিদ্রের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল ডাকঘর। দুপুরবেলায় দেখতাম গ্রামের পথ দিয়ে দেশ-বিদেশের সুখ-দুঃখের চিঠি ভরতি থলি ঝুলিয়ে এবং ঘণ্টাবাঁধা বল্লম কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেছে রানার। তার ঠুন ঠুন শব্দ শুনে ছুটে আসত গ্রামের ছেলে-মেয়েরা। গ্রামের হাটটাও ছিল বাড়ির খুব কাছেই। ডাকঘরের সামনের ছোটো রাস্তাটি ধরে এগোলেই হাট। তার কিছু দূরে এম. ই. স্কুল। আমার পিতামহের প্রতিষ্ঠিত। আমার কাকা ছিলেন এর প্রধানশিক্ষক, সামনেই খেলার মাঠ। গ্রীষ্মের অপরাহ্নে গাঁয়ের তরুণদল সেখানে ফুটবল খেলায় মেতে উঠত। পাশ দিয়ে চলে গেছে ইউনিয়ন বোর্ডের অপ্রশস্ত সড়ক। বর্ষায় মাঠ, সড়ক সব ডুবে যেত। বর্ষাকালে গ্রামের চেহারা হয় অপূর্ব। শুধু জল, থইথই করা জল। নৌকো ছাড়া কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।
ফুটবল খেলা নিয়ে গ্রামে খুব হইচই হত। নিজেদের শিল্ড খেলা ছাড়াও অন্যান্য গ্রামের প্রতিযোগিতার খেলায় খেলতে যাওয়া হত। বেশ মনে পড়ে মালিপাড়ার ফাইনাল খেলার কথা। আমাদের গ্রাম যখন তিন গোলে বেতিল গ্রামকে হারাল তখন হিন্দু-মুসলমান গ্রামবাসীর সে কী বিজয় উল্লাস!
বারোমাসে তেরো পার্বণের দেশ আমাদের। অন্যান্য পুজো-পার্বণ ছাড়াও চড়ক পুজো আমাদের গাঁয়ের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসে পাট-ঠাকুরের পুজো আরম্ভ হয়। পাট ঠাকুরের আসল ইতিহাস জানি না। তবে শুনেছি শিবপুজোরই এ এক ভিন্ন প্রথা। চৈত্র সন্ন্যাসীরা পাড়ায় পাড়ায় প্রত্যেক বাড়িতে পাট-ঠাকুর সামনে রেখে নাচ-গান করে। সংক্রান্তির দিন তাঁরা মিলিত হয়, খোলার কালীবাড়িতে। এখানে এ উপলক্ষ্যে বসে বড়ো মেলা। গ্রামের ছেলেবুড়োরা যোগ দেয় এই আনন্দ উৎসবে। সন্ধ্যায় দুজন হর-পার্বতী সেজে নাচে। তারপর আরম্ভ হয় চড়ক ঘোরানো। হিন্দুর অনুষ্ঠানে মুসলমানরা সানন্দে অংশগ্রহণ করত; আবার তাদের অনুষ্ঠানে হিন্দুরাও তেমনভাবেই যোগ দিত।
আমাদের বাড়ির পুবদিকে ঠাকুরবাড়ি। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষ্যে ওখানে হত কীর্তনগান। ঠাকুরমশাইরা একে একে সবাই গত হয়েছেন। তাঁদের ছেলে মেয়েরা অসহায় অবস্থায় পূর্ব বাংলার পরিস্থিতিতে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। আজকের সন্ধ্যায় ঠাকুরবাড়িতে হয়তো আর খঞ্জনির ঝনঝনি শব্দ শোনা যায় না। শোনা যায় না সুমধুর শঙ্খধ্বনি বা কাঁসর ঘণ্টার বাজনা। গৃহিণীরা আজ আর কেউ হয়তো সেখানে গলায় আঁচল দিয়ে তুলসীতলায় সন্ধ্যাদীপ জ্বালে না। আমার গাঁয়ের এক-একটি তল্লাট জুড়ে আজ হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে আমার মনের মতোই এক-একটি ফাঁকা মাঠ। কিন্তু হাসির ঝরনাধারায় আবার কি আমার গ্রাম সঞ্জীবিত হয়ে উঠবে না?
হায় রে পৃথিবীর গতির বুঝি পরিবর্তন হয়েছে। তা না হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মিলনের ধারা এমনভাবে সাম্প্রদায়িকতার মরুতে হারিয়ে যেতে পারে? দুঃখ-সুখের জোয়ার ভাটায় তারা যে একই সঙ্গে চলেছিল। আজ সেই শান্তির জীবনে অপ্রত্যাশিত ভাবে এসে পড়েছে একদলের মনে সংশয় মৃত্যুভয়। নিজের জন্মভূমিতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করবার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। আজকের এই লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ সবহারাদের দল কি পথে প্রান্তরেই প্রাণ দেবে? শত সহস্র বীরের রক্তস্রোত কি ব্যর্থ হবে?
.
সাহজাদপুর
ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ লাইনে ছোট্ট স্টেশন উল্লাপাড়া। স্টেশন ছোটো হলেও খুব কর্মব্যস্ত। মেল আর এক্সপ্রেস ট্রেনের স্টপেজ। চালানি মাল, মাছ, পান, পাট–ওঠে নামে। বড়ো বড়ো ব্যাপারীর আনাগোনায় রেল স্টেশন উল্লাপাড়া সর্বদাই সজাগ।
স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে বাইরে নেমে গেলেই শুনতে পাবেন : ‘আয়েন বাবু আয়েন বলদ দেহেন দেহি আমার, যেন হাতিশালের হাতিছোটো যহন দেহেন যেন পঙ্খিরাজ ঘোড়া। এমনি একের পর এক গোরুর গাড়ির চালক এসে প্রলুব্ধ করবে আপনাকে। কেউ এসে বলবে : ‘ছইখান দেহেন দেহি। অট্টেলিকা বাবু, বজ্জর পলেও খাড়া, একখানি কাবারি নাহি খসে।’
‘যাবেন কনে, সাজাদপুর? গেরাদহ? চক্ষের নিমেষে লইয়া যামু।’
গোরুর গাড়ি ছাড়া খরার দিনে গতি নেই। যে গ্রামেই যান, মাইলের পর মাইল আপনাকে যেতেই হবে গোরুর গাড়িতে উল্লাপাড়া স্টেশন থেকে।
পথ আর ফুরোয় না। চলেছে তো চলেইছে। বিরক্তি প্রকাশ করলে মাঝে মাঝে গাড়োয়ান তাড়া দেয় বলদ দুটোকে ল্যাজ মলে। অমনি কিছুদূর পর্যন্ত বেশ জোরে ছুটে চলে গাড়ি। দু হাত দিয়ে তখন ছইয়ের বাঁশ চেপে ধরতে হয়–ভয় হয়, গাড়ি উলটে নীচে পাশের ধানখেতে পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই। তবে ভাবতে ভাবতেই ভয় কেটে যায়। গাড়ির গতি আবার মন্থর হয়ে আসে। উচ্চৈ:স্বরে গাড়োয়ান গেয়ে ওঠে পুরোনো একটা গান : ‘দরদি রে, তোর ভাঙা নৌকায়…।’ নানা সুরের দোল খেতে খেতে গানের প্রথম কলিটিই মাঝপথে থেমে যায়–শেষ আর হয় না। বাঁয়ের বলদটার পেটে পা দিয়ে ঠেলা দিয়ে গাড়োয়ান বলে ওঠে–দ্যাখ দিনি, ডাঁয়ে ডাঁয়ে…।
ছোটো ছোটো গ্রাম পার হতে হয় একে একে। বেতবনের আর বাঁশবনের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে টিনের চাল আর খোড়ো ছাউনির আগল চোখে পড়ে এখানে-ওখানে। উৎসুক হয়ে গ্রামের মেয়ে-বউয়েরা মুখ বার করে দেখে আর একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করে–কোন গাঁয়ে যায় রে?
গাড়োয়ান সবারই পরিচিত। হেঁকে বলে– সাজাদপুর, সাজাদপুর। কোমরে কাপড় জড়ানো, ছোটো ঘোমটায় আঁটসাট মুখগুলো মনে হয় আপন, বড়ো নিজের–যেন স্নেহ মমতায় ভরা নিজের ঘরের মা আর বোন। ইচ্ছে করে নেমে গিয়ে শুধোই। কত সুখ, কত পরিতৃপ্তির পরিবেশে ঘর বেঁধে আছ তোমরা, শোনাবে তোমাদের গল্প, বলবে তোমাদের কথা?
ঢিবি পার হয়ে ঘচাং করে নীচে নেমে আসে ওই পঙ্খিরাজদের গাড়ি আর পেছনে ফেলে যাই এমনি করে গ্রামের পর গ্রাম। তারপরেই দু-দিকে ধু-ধু মাঠ। মাঝে মাঝে শুধু টেলিগ্রাফের পোস্ট, তারা যেন বলছে–এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও, আরও আছে পথ।
একবার গভীর রাতের গাড়ি থেকে নেমে চলেছিলাম এমনই এক গোরুর গাড়িতে। পথ অনেক, তাই গাড়োয়ান পোয়ালের ওপর বিছানা খুলে দিয়ে ছইয়ের খোলা মুখ দুটোয় কম্বলের পরদা টাঙিয়ে দিয়ে বলল–ঘুমায়ে পড়েন বাবু, শীতের রাত। যাবেন ধীরে ধীরে।
মাথায়-কানে গামছা জড়িয়ে ফয়েজ আলি গাড়ি চালায়। বেশ আরামে চলেছি–চোখ দুটোও বোধহয় ধরে এসেছে। চমক ভেঙে গেল ফয়েজের গানে,
আমায় শুধস নারে, কোন গাঁয়ে যাই–
ও সে, কালো চক্ষের জল দেখেছি
ফুলের নূপুর পায়।
তার দিঘল চোখের কাজল
আমার অঙ্গে লাগে নাই রে…
ও ভাই শুধস নারে…
কী দরদটালা গলায় ফয়েজ গেয়ে চলেছে! নিস্তব্ধ রাত–ফিকে জোছনা, ফাঁকা মাঠের হাওয়ায় বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে : আমায় শুধস নারে…। ওদের মেঠোসুরে গলার বাঁধুনি এত সুন্দর লাগে কেন? কে ওদের শেখায় এমন করে প্রাণঢালা গান গাইতে? আর একবার ফিরতি পথে গাড়োয়ান জমিরকে বলেছিলাম : জমির মিয়া, জানো ভাই ওই গানটা–সেই ‘তার দিঘল চোখের কাজল আমার অঙ্গে লাগে নাই রে? সে গাইল। একেবারে ভিন্ন সুর। কিন্তু তেমন করেই চঞ্চল করল আমার মন প্রাণ।
এই পথেই, ঠিক এই সব ঝোঁপঝাড় ধুলোবালির পথ পেরিয়েই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে, ঠাকুর কাছারিতে গেছেন কতবার? এই কথা মনে হত বার বার উল্লাপাড়া থেকে আমার জন্মগ্রাম সাহজাদপুরে যেতে যেতে। প্রতিটি বট আর কুলের গাছ, প্রতিটি টেলিগ্রাফের পোস্ট দেখে মনে হত কবি হয়তো কখনো এদের কানে-কানে কোনো বার্তা দিয়ে গেছেন অনাগত পথিকের জন্যে! কবি এখানে আসতেন কখনো পালকিতে, কখনো বা গয়নার নৌকোয়। এই কুঠিবাড়িতেই ওপরতলায় বসে তিনি লিখেছিলেন, ‘পোস্টমাস্টার।
এই ঠাকুর-কাছারিতে কোনো এক টিনের চালার পাটকাঠির বেড়া-ঘরে কয়েকবার আশ্রয় পেয়েছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখতাম সেই বাঁধানো বকুলতলা, কুঠিবাড়ির গা-ঘেঁসে বড়ো বড়ো গয়নার নৌকোয় আনাগোনাবাজার-হাট ঘাট-মাঠ-পথ, আর ওই বিখ্যাত কাঠের পুলটা, যার মুখ গিয়ে ঠেকেছে পাটগুদামের মস্ত টিনচালার ঘরটার গোড়ায়। কত রাত অবধি আমরা দল বেঁধে কাটিয়েছি ওই কাঠের সাঁকোটার ওপর দাঁড়িয়ে। ভারি আনন্দ হত যখন তার নীচ দিয়ে একের পর এক নৌকো চলে যেত। কোনোটায় বোঝাই থাকত বাঁশ, কোনোটায় তামাক, কোনোটায় দুধ। জোয়ান মাঝিদের শক্ত হাতের লগি ঠেলায় সাঁৎ সাঁৎ করে বড়ো বড়ো নৌকোগুলো জলের বুকে মুখ রেখে পিছলে পিছলে এগিয়ে যেত। এক একদিন কুঠিবাড়ির লাইব্রেরির বারান্দায় বসে বসেই রাত প্রায় কাবার করে দিতাম। মুরগি ডেকে উঠত ওপারে চাষিদের উঠোনে। তখন বাড়ি ফিরতাম।
হাটে-বাজারে সর্বত্রই প্রায় বেড়ার ঘর। পাটকাঠির বেড়া, হেঁচা বেড়া, অথবা খলপার বেড়াই বেশি। ওপরে টিনের চাল। কোথাও-বা বেড়ার গায়ে সুন্দর করে মাটি লেপা। পাকা দালানঘরও আছে অনেক।
ঠাকুর কাছারির সব কর্মচারীই একটি এলাকায় বাস করেন–ম্যানেজার সাহেব থেকে দপ্তরি পেয়াদা অবধি সকলেই। কাছারির তরফ থেকে বাসা দেওয়া হয় সবাইকে।
অপর্যাপ্ত দুধ আর মাছের বাজার সেখানে। ইলিশমাছ আর দুধ যে অত সস্তা হতে পারে তা ভাবাও যায় না। লোকে বাজারে দুধ আনতে গেলে বালতি নিয়ে যেত সঙ্গে করে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দেও এরকম সচ্ছল অবস্থা ছিল সেখানে।
বর্ষাকালে (দুর্গাপুজোর আগে অবধি) নৌকো ছাড়া যাতায়াতের উপায় থাকত না। চরিদিকে থইথই জল। গভীর রাতে বাঁশ আর বেতবনের ভেতর দিয়ে ছপ ছপ শব্দে বৈঠা ঠেলে ঠেলে ছোটো-বড়ো নৌকোগুলো যেত-আসত। হাটের দিনে সেই যাতায়াত প্রায় সারারাতই লেগে থাকত। নৌকোর ওপরই রান্না করছে মাঝিরা, সেইখান থেকেই হাঁড়ি-বাসন ধুয়ে নিচ্ছে, সেইখানেই আহার সারছে। জলেই যেন ওদের ঘরকন্না। একবার একটানা পাঁচ দিন রইলাম এই নৌকার ঘরে। পাবনা জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম। কত বিচিত্র পথে আনাগোনা–তার শেষ নেই। হ্যারিকেন লণ্ঠন নৌকোর মাথায় তুলে দিয়ে ছইয়ের ওপর উঠে বসে রাত্রের অন্ধকারে মাইলের পর মাইল যাও–চারিদিকে জলরাশি–কোথাও-বা উঁচু–কোথাও নীচু। যেসব হাঁটাপথে একবার হেঁটে গেছি তারই বুকের ওপর দিয়ে জলরাশি ভেদ করে নৌকোয় যেতে সে কী আনন্দ! নিশুতি রাত। তবু বহুদূরের নৌকোর ডাক স্পষ্ট শোনা যায়। আর বহুক্ষণ ধরে তার মাথায় টিমটিম আলো দেখা যায়। সহযাত্রী জোটে। দুই নৌকো পাশাপাশি চলে। তীরের ওপর দিয়ে দুজন হয়তো বা গুণ ধরে চলে। জলের ভেতর পা দুটো ডুবিয়ে বসে শুনি ওদের গলাছাড়া গান,
ও কালা শশী রে
আর বাজায়ো না বাঁশি–
বাঁশি শুনিতে আসি নাই আমি,
জল নিতে আসি…।
গলার অত জোর, অথচ মিষ্টত্ব নষ্ট হয় না–প্রাণঢালা দরদ মেশানো গান।
বড়ো বড়ো গয়নার নৌকো জোড়া জোড়া ঢাক পিটিয়ে চলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আট, দশ, পনেরো কুড়ি মাইল–একটানা পথ। ঢাকের গগনভেদী শব্দে জানা যায়-গয়নার নৌকো চলেছে। ভেতরে শুয়ে বসে বহুযাত্রী একসঙ্গে যেতে পারে। কী শক্ত গড়ন–যেন লোহার তৈরি এই নাও।
দুর্গাপুজোর মতোই সরস্বতীপুজো এইদিকে মহাসমারহে হত। সেই সময় বসত গানের আসর-দূর-দূরান্তর থেকে আসতেন নানা গুণীজন। সাহিত্যসভায় বাংলাদেশের স্বনামধন্য অনেকেই আসতেন। যেবার অনুরূপা দেবী সভানেত্রী সেবার আমি ছিলাম উপস্থিত। নাচ, গান, কবিতা প্রতিযোগিতা লেগে থাকত তখন প্রায় প্রত্যেকটি সন্ধ্যায়।
পাবনা জেলার সাহজাদপুর, জামিরতা, পরজনা, বাঘাবাড়ি–এদের আর-এক রূপ দেখেছি পঞ্চাশের মহামন্বন্তরে। কোথায় ছিল এত লোক? এই নরকঙ্কালের দল? একটু ফ্যানের জন্যে ঘুরে বেড়াত ওরা বেড়ার গায়ে গায়ে। যে বাড়িতে ছিলাম, সেই বাড়িতে রাত্রে রান্নাঘরে ধরা পড়ল একটি চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছেলে। অনেক লোকজন চোর মনে করে লাঠি-সোঁটা নিয়ে ছুটে এল–ভাতের হাঁড়ি থেকে দুই হাতে ভাত তুলে মুখে দিচ্ছে ছেলেটা–এতটুকু ভয় বা উদবেগ যেন তার নেই।
যেসব মাঠে সোনার ফসল ফলেছে একদিন সেই ধানখেতেই বহু নরকঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখেছি এখানে-ওখানে। চোখের সামনে খিদের জ্বালায় মানুষকে মরতে দেখেও মানুষ নিজের অন্নের ভাগটুকু সামলে রেখেছে। আগে যাকে দেখেছি ঘরের বউ, সন্তানের মা, পচা ময়লা ঘেঁটে খাদ্যের সন্ধানে তাদেরও ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। পরিচয় থাকা সত্ত্বেও কথা বলেনি তারা–শুধু জ্বলন্ত চোখ তুলে একদৃষ্টে চেয়ে থেকেছে। বেশিক্ষণ সে-দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে সাক্ষাৎ ভগবানও বুঝি ভয় পাবেন!
কাছারি বাড়ির ওপারেই কামারের ঘর। দিনভর ভারী হাতুড়ির ঠোকাঠুকি লেগেই আছে। কখনো গোরুর গাড়ির চাকায় লোহার বেড় লাগানো, কখনো কোদাল-কুড়ল-দা-খোন্তা তৈরি হচ্ছে। কামার বলে ঠাউর, আইচেন কন থিয়্যা?
শুনি ওদের কাজকর্মের কথা।
বিখ্যাত ছিল সূর্য রায়ের হোটেল। পাবনা জেলার গেজেট বলা হত ওকে। গ্রাম-গ্রামান্তরের খবর পাওয়া যেত সেখানে গেলে। কত জায়াগার লোক এসে জোটে। সন্ধের পর প্রত্যহ জমে মজলিশ–গল্পের, তাসের আর দাবার। হাটবাজার বন্ধ হয়ে গেলে সূর্য রায়ের হোটেল জমে ওঠে।…
আজও হয়তো সেই আড্ডা জমে, গয়না নৌকোর ভিড় জমে নদীতে, গাড়োয়ান সেইরকম উদাত্ত গলায় গান গেয়ে যায়, শুধু আমরা আর সে আড্ডায় যোগ দিতে পারি না, সেই গান শুনতে পাই না। র্যাডক্লিফের কুড়লের ঘায়ে সাহজাদপুর যে আজ আলাদা হয়ে গেছে! মায়ের সঙ্গে ছিঁড়ে গেছে আমার যোগ।
ফরিদপুর জেলা – কোটালিপাড়া রামভদ্রপুর কাইচাল খালিয়া চৌদ্দরশি খাসকান্দি কুলপদ্দি
বিশাল বনস্পতিও ধরাশায়ী হয় প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়ায়, বুনো হাতির পায়ের চাপে সাজানো ফুলের বাগান যায় বিপর্যস্ত হয়ে। ঠিক তেমনি তো হয়েছে আমার পুববাংলার হাজার হাজার সোনার পল্লি-প্রতিমার অবস্থা–জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম ভুল রাজনীতির আকস্মিক অশনিপাতে। বহুপুরুষের যত্নে গড়া কত বাড়িঘর আজ পড়ে আছে শ্রীহীন হয়ে, খাঁ খাঁ করছে কত বিদ্যায়তন, কত দেউল। শিবশূন্য শিবালয়গুলোতে হয়তো চলেছে অশিবের হানাহানি, হয়তো বা অনেক মঠ-মন্দির লুপ্তও হয়ে গেছে এত দিনে। আর ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ তো নতুন কিছু নয়–দেবালয় ধ্বংসের অভিযান অনেকবারই প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে ভারতবাসীকে।
একটা ক্রুদ্ধ রুদ্র নিশ্বাসে সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবহমান ধারা যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে পুববাংলায়। অতীত ইতিহাসের কত গৌরবময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে বাংলার এক-একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে; কিন্তু আজ যেন এক একটা ছেড়ে আসা গ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে সঙ্গে পল্লিমায়ের সেই সব স্মৃতির আভরণ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দিগবিদিকে। এমনি এক গ্রাম-মায়ের কোল থেকেই প্রথম সূর্য-প্রণাম করেছিলাম আমি প্রায় বছর চল্লিশ আগে। আজন্ম আত্মীয় সে মাটি আজ আমার পর–এ সত্য, না স্বপ্ন! সত্য হলেও গ্রামকে নিয়ে গর্বের যে অন্ত নেই।
আমার জন্মভূমি কোটালিপাড়া শুধু গ্রাম নয়, আবার পরগনাও। বাংলার এককালীন বিদ্যাপীঠ নবদ্বীপ সম্বন্ধে যেমন বলা হত-নবদ্বীপে নবদ্বীপ গ্রাম, পৃথক পৃথক কিন্তু হয় এক নাম’, এও অনেকটা তাই। পাশাপাশি কাজোলিয়া, মাজবাড়ি, পশ্চিমপাড়া, ডহরপাড়া, পিঞ্জুরি, ঊনশিয়া, মদনপাড়, দিঘির পাড়, রতাল এবং এমনি আরও বহু জনপদের সমষ্টিগত গ্রাম-নাম কোটালিপাড়া। এসব জনপদের লোকেরা বাইরে গিয়ে চিরকালই নিজেদের পরিচয় দিয়ে আসছে কোটালিপাড়ার অধিবাসী বলে। গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত এই পরগনা গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পুণ্যতোয়া ঘাগর নদ। ছোটোবেলা থেকেই দেখে এসেছি প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির দিনে লক্ষ লক্ষ লোককে এর শীতল জলে স্নান করে গঙ্গাস্নানের পুণ্যার্জন করতে। সে উপলক্ষ্যে এর তীর জুড়ে বসত বিরাট মেলা। আজও কি বসে সেই মেলা? মেলার উল্লাসে মেতে ওঠার মতো মানুষের মন কি আজও আছে কোটালিপাড়ায়? আমার মন যে তা বিশ্বাসই করতে চায় না। ঘাগরেরই কোলে গড়ে উঠেছিল ঘাগর বন্দর। সে বন্দরের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। দেশের মাটিকে বিদায় দিয়ে আসার আগেও দেখে এসেছি কত দূর-দূরান্তরের কত পণ্যবাহী নৌকার ছড়াছড়ি সে বন্দরে! সেদিন এক বন্ধু এসে জানাল, ঘাগর বন্দরের যৌবনোচ্ছাস আর নেই, বার্ধক্যের ঝিমুনি লক্ষ করে এসেছে সে তার চোখে।
মনে পড়ে ঝনঝনিয়া, দেওপুরা, বরুয়া এবং বাগিয়া বিলের কথা। বিশাল জলরাশি বুকে ধরে এসব বিল এ অঞ্চলের মাটিকেই শুধু রসসিক্ত করেনি, এ পরগনার মানুষের মনেও বইয়ে দিয়েছে রসের বন্যা। কত গায়ক, বাদক, কথক এবং আরও কত জ্ঞানী-গুণী জন্মগ্রহণ করেছেন এ মাটিকে ধন্য করে। এই কোটালিপাড়ায় ব্রাহ্মণ-প্রাধান্যের কথা প্রবাদ-বাক্যে পরিণত হয়েছিল। ‘বারোশো বামুনের তেরোশো আড়া, তার নাম কাশ্যপপাড়া’–-একটি অংশের পরিচয় থেকেই বাকি কোটালিপাড়া সম্বন্ধেও মোটামুটি একটা ধারণা মিলবে। কারণ প্রায় সব কোটালিপাড়া জুড়েই রয়েছে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের বাস। লক্ষাধিক লোকের বাসভূমি এ পরগনায় লক্ষ শিবের পুজো হত বলে কাশীতুল্য স্থান হিসেবে এর ছিল ব্যাপক প্রসিদ্ধি। নবদ্বীপ, বিক্রমপুর, ভাটপাড়া–বাংলার ব্রাহ্মণ্যবিদ্যার এই মুকুটমণিদলের মধ্যে কারও চেয়ে ন্যূন নয় আমাদের কোটালিপাড়ার স্থান।
এ অঞ্চলে এক-একটি দেবস্থান গড়ে উঠেছে এক-একটি গ্রামের কেন্দ্র-পীঠরূপে। সিদ্ধান্তের খোলার বহুবিশ্রুত চড়কপুজোর কাহিনি যে কত পুরোনো তা জানা নেই। অনেক অলৌকিক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই চড়কপুজোর সঙ্গে। ভয়ে ও শ্রদ্ধায় এ এলাকার মুসলমানেরাও চড়কঠাকুরকে প্রণামি দিয়ে আশীর্বাদ ভিক্ষা করে আসছে চিরকাল। হরিণাহাটি ও পশ্চিমপাড়ার কালীবাড়ির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে অনেক পুরোনো কথা। মদনপাড়ের গোবিন্দের, সিদ্ধান্তবাড়ির বুড়ো ঠাকুর, রতালের মনসাদেবী, সিদ্ধেশ্বরী মাতা ও লক্ষ্মী নারায়ণের বিগ্রহও সমধিক প্রসিদ্ধ।
একেবারে ছোটেবেলা থেকেই রতালের মনসাদেবী সম্বন্ধে কত গল্প শুনে আসছি। জনপ্রিয় দেব-দেবীর মধ্যে বাংলাদেশে মনসাদেবী নাকি একেবারে জাগ্রত। রঘু গাইনের নাম আজও কোটালিপাড়ার লোকের মুখে মুখে। এক সময় ফরিদপুরে সর্বত্র মনসার গান গেয়ে বেড়াতেন ইনি সদলবলে। সে প্রায় শ-দুই বছর আগেকার কথা। প্রত্যাদেশে মনসা পেয়ে যে দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রঘু গাইন তাই আজ রতালের মনসাদেবী নামে খ্যাত। আদিষ্ট গীতাবলি অবলম্বনেই মনসার গান গাইতেন রঘু গাইন। অনেক অভূতপূর্ব ঘটনার কথা প্রচলিত আছে এই দেবী ও তাঁর ভক্ত রঘু গাইন সম্বন্ধে। ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে আশ্বিনের ঝড়ে রতালের গাইন বাড়ির সব ঘর ধুলিসাৎ হলেও যে ঘরে মনসার চামর ছিল সে ঘরখানি ঠিক দাঁড়িয়েই ছিল। আশ্চর্য ঘটনা বই কী। কিন্তু আজ যে সেই মনসাদেবীর চামর নিয়েই রঘু গাইনের বংশধরগণকে গ্রাম ছেড়ে কলকাতা প্রবাসী হতে হল, অদৃষ্টের পরিহাস ছাড়া তাকে আর কী বলব? রঘু গাইনের প্রপৌত্র, রমাকান্ত গাইনের সময়ে এক রাত্রিতে নাকি ডাকাত পড়েছিল তাঁদের বাড়িতে। কিন্তু মনসাদেবী যে বাড়ীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী ডাকাতের ক্ষমতা কী যে সে বাড়ির কোনো ক্ষতি করবে? নাগকুল নাকি এমনি ভাবে ঘিরে রেখেছিল বাড়ির চারদিকের সীমানা যে, দস্যুদল সাপের ‘ফোঁস ফোঁস’ শব্দে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আর সাহস পায়নি। এ অনেককাল আগেকার কথা। রঘু গাইনের মনসাভক্তি সম্বন্ধে ছোটোবেলায় একটি অদ্ভুত কাহিনি শুনেছিলাম। সেই অলৌকিক ঘটনার কথা আজও মনে পড়ছে। ফরিদপুর জেলার বাইটামারি গ্রামে কোনো এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে এক নবজাতকের অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে হয়েছে মনসা পুজো। মনসা ভাসানের গান গাইবার জন্যে আমন্ত্রণ হয়েছে দুটি বিখ্যাত দলের। তার মধ্যে একটি হল রঘু গাইনের দল। গাইনের দল আসতে একটু দেরি করে ফেলায় ধনী গৃহস্থামী এতটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন যে, তাঁদের গানের আর প্রয়োজন নেই বলেই জানিয়ে দিলেন তিনি। আর কোনো উপায় না দেখে, ফিরে যাওয়ার আগে মনসাদেবীকে একবার প্রণাম জানিয়ে যেতে চাইলেন রঘু গাইন। প্রার্থনা মঞ্জুর হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ নির্দেশও দেওয়া হল যে, কৃত অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তাঁকে পশ্চার্দিক থেকে দেবীকে প্রণাম করতে হবে- আসরে ঢুকে সম্মুখ থেকে তাঁকে প্রণামের অধিকার দেওয়া হবে না। তাতেই রাজি হলেন রঘু। মন্ডপের পেছনে গিয়ে গানের সুরে প্রণাম জানালেন তিনি দেবীকে। অপূর্ব তন্ময়তা সে গানে। সমবেত জনতা যখন সে সুরের মূর্ঘনায় বিভোর সেই অবকাশে কখন যে দেবী প্রতিমা ঘুরে গেছে পেছন দিকে কেউ তা লক্ষই করেনি। যখন চোখে পড়ল, তখন সে কী শোরগোল! শেষপর্যন্ত উলটো দিকেই দেবীর সামনে নতুন করে আসর বসিয়ে রঘু গাইনের মনসা ভাসানের গান শুনতে হল সবাইকে! কঠোর বাস্তবের আঘাতে বিপর্যন্ত আজকের বাঙালি দেব-দেবীর এসব অলৌকিক কাহিনি কী করে বিশ্বাস করবে?
তালতলা ভজন কুটিরের হরিসভার কথা মনে পড়ে। প্রতি পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাশুভ্র সন্ধ্যায় বসত সেখানে ভাগবতপাঠের আসর। ভক্তিযুক্ত মন নিয়ে কত পল্লিবাসী নর-নারী আসত সেখানে কৃষ্ণ-কথা শুনতে, আমিও যেতাম। সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দিরেও দেখেছি অজস্র লোক সমাগম হত বার্ষিক উৎসবে, শিবচতুর্দশী ও কালীপুজো উপলক্ষ্যে। রতালের মহাশক্তি আশ্রমে লোকেদের ভিড় লেগেই থাকত। আমাধ্যক্ষ আচার্য বরদাকান্ত বাচস্পতি জ্যোতিষ ও তন্ত্রশাস্ত্রে সুপন্ডিত। এঁর জ্যোতির্বিদ্যায় মুগ্ধ হয়ে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে সবাই এসে আপদে বিপদে জড়ো হত সেখানে। বাস্তবিকপক্ষে মহাশক্তি আশ্রম কোটালিপাড়ায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলনক্ষেত্র। শুধু বাংলা দেশের নয়, ভারতের দূরান্তবর্তী অঞ্চল থেকেও অনেক লোককে আসতে দেখেছি এ আশ্রমে জ্যোতিষী মাহাত্মের ফলোভের জন্যে। বাচস্পতি মশায়ের গণনা সম্বন্ধে কত যে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প রয়েছে তারও শেষ নেই। শুধু গণনাকার্যের জন্যেই নয়, ভজনকীর্তনে, কাঙালি ভোজনে, অতিথিসেবায় সর্বদাই থাকত এ আশ্রম মুখরিত। রতালের মনসাবাড়ি নামেও খ্যাত ছিল এ বাড়ি। আশ্রমমাতা জ্ঞানদাদেবী প্রসাদবিতরণে, দরিদ্রনারায়ণসেবায় ছিলেন অন্নপূর্ণারূপিণী। পঞ্চাশের মন্বন্তরে কত হিন্দু মুসলমানের যে প্রাণরক্ষা হয়েছে এই আশ্রমমাতার কৃপায় গ্রামবাসীরা কি সে-কথা ভুলতে পারে! কিন্তু তবু এঁদের সবাইকে চলে আসতে হয়েছে প্রিয় গ্রাম ছেড়ে। শুনেছি সেই মহাশক্তি আশ্রম উঠে এসেছে কলকাতা পাইকপাড়ায়। সেখানে নাকি লোকের ভিড়ের অন্ত নেই, শ্রীশ্রীনারায়ণ ঠাকুরের দর্শনার্থী সেখানে আসে দলে দলে। কিন্তু কোটালিপাড়ার সেই পরিবেশ পাওয়া কি সম্ভব কলকাতায়? আমার গাঁয়ের হরিসভায় আর ভাগবতপাঠের আসর বসে না, সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে আর হয় না উৎসব আয়োজন!
কত মহাজ্ঞানী ও গুণীজনের আবির্ভাবে ধন্য আমার কোটালিপাড়া। আবার কি আমরা ফিরে যেতে পারব না সেখানে? পথহারা হয়েও পথ চলতে চলতে তার আকুল আহ্বান সব সময়ই তো শুনতে পাই, কিন্তু তার ডাক শুনেও পা এগোতে চায় না কেন সেদিকে? আজও কি পূর্ণ প্রায়শ্চিত্ত হয়নি আমাদের পাপের? আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই কোটালিপাড়ার অতীতকে স্মরণ করে। বেদান্ত শাস্ত্রে আচার্য শঙ্করতুল্য মহাপন্ডিত স্বর্গীয় মধুসূদন সরস্বতী জন্মপূত ঊনশিয়া কোটালিপাড়ারই অন্তর্গত। মধুসূদনের পান্ডিত্যের তুলনা বিরল। তাই তো কাশীর পন্ডিতসমাজে আজও প্রচলিত প্রশস্তিবচনে বলা হয়েছে তাঁর সম্বন্ধে,
মধুসূদন সরস্বত্যা পারং বেত্তি সরস্বতী।
পারং বেত্তি সরস্বত্যা মধুসূদন সরস্বতী।।
মধুসূদন সরস্বতীর বিদ্যার পরিমাণ স্থির করা একমাত্র দেবী সরস্বতীর পক্ষেই সম্ভব এবং একমাত্র মধুসূদন সরস্বতীই দেবী সরস্বতীর জ্ঞানপরিধির পারংগম। বিদ্যাদায়িনী সরস্বতীর সঙ্গে যার তুলনা করেছেন কাশীর পন্ডিতসমাজ তাঁর জন্মস্থানের লোক আমরা আজ গ্রাম মায়ের কোলছাড়া হয়ে অজ্ঞান অববাধের মতো ঘুরে বেড়াই চরম অসহায়তায়। মধুসূদন রচিত ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ অদ্বৈত বেদান্তের প্রামাণিক গ্রন্থরূপে ভারতের সর্বত্র প্রসিদ্ধিলাভ করেছে। এবং ভারতের বাইরেও রয়েছে মধুসূদনের গুণমুগ্ধ বহু দার্শনিক পন্ডিত। নবদ্বীপ পাকা টোলের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক ও পরে কাশীরাজের বৃত্তিভোগী কাশীবাসী প্রসিদ্ধ বৈদান্তিক ও নৈয়ায়িক স্বর্গীয় জয়নারায়ণ তর্করত্ন, জয়পুর রাজ কলেজের প্রাক্তন ন্যায়াধ্যাপক স্বর্গত কালীকুমার তর্কতীর্থ প্রমুখ পন্ডিতেরাও ছিলেন ঊনশিয়ারই অধিবাসী। বাস্তবিকপক্ষে কোটালিপাড়ার প্রধান গৌরব পন্ডিতস্থান হিসেবেই। এ অঞ্চলের পন্ডিতদের মধ্যে আজও যাঁরা জীবিত রয়েছেন তাঁদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে ব্যাসকল্প মহাপন্ডিত মহামহোপাধ্যায় ভারতাচার্য হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের কথা। ইনি আজ স্থানান্তরে একক সাধনায় মহাকায় মহাভারত রচনায় নিমগ্ন। পশ্চিমপাড়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কোটালিপাড়ার প্রথম মহামহোপাধ্যায় পরলোকগত রামনাথ সিদ্ধান্ত পঞ্চানন ও প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক স্বর্গীয় শশীকুমার শিরোরত্ন। প্রসিদ্ধ সংগীতজ্ঞ স্বৰ্গত রাধারমণ রায় এবং বর্তমান যুগের ভারতখ্যাত অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরশিল্পী তারাপদ চক্রবর্তীও (নাকুবাবু) এ গ্রামেরই ছেলে। আধুনিক শিক্ষায় সুপন্ডিত রাজনীতিবিদ ডা. ধীরেন্দ্রনাথ সেনের বাড়ি ছিল দিঘির পাড়ে এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক চপলাকান্ত ভট্টাচার্যের গ্রামও কোটালিপাড়ারই মদনপাড়। বাঙালি শিল্পপতিদের অন্যতম স্বৰ্গত কর্মবীর সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন হরিণহাটিতে। কোটালিপাড়াকে বড়ো করার, সমৃদ্ধ করার কত পরিকল্পনা ছিল তাঁর! রতালে জন্মেছিলেন সুপন্ডিত ও সুগায়ক-কথক রঘুমণি বিদ্যাভূষণ এবং জ্যোতির্বিদ গোপাল মিশ্র। তাঁরা উভয়েই দেহরক্ষা করেছেন দীর্ঘকাল আগেই কিন্তু তাঁদের দেহই শুধু নয়, তাঁদের কীর্তিধন্য নামও যে জড়িয়ে আছে আমার গাঁয়ের সোনার মাটির সঙ্গে!
সমগ্রভাবে ব্রাহ্মণপ্রধান হলেও কোটালিপাড়ার কাসাতলী, গোয়ালঙ্ক, পিঞ্জুরী প্রভৃতি কয়েকটি জনপদ বৈদ্যপ্রধান এবং আধুনিক শিক্ষায় ও প্রগতির ক্ষেত্রে এঁরা অগ্রণী।
সাত সাতটি হাট, দুটো দৈনিক বাজার, চারটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়, দুটো সংস্কৃত কলেজ, দশ-বারোটি টোল, এবং তার ওপর থানা, ডাকঘর, সাবরেজেস্টারি অফিসে সবসময় জমজমাট থাকত আমার সাধের কোটালিপাড়া। আর আজ? এখন নাকি সরকারি অফিস ছাড়া একটি বাজার, দুটি হাট ও একটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় কোনোরকমে অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করছে বিদির্ণ কঙ্কালের মতো। সংস্কৃত শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ছিল যার আসল পরিচয় সেখানে আজ একটিও টোল নেই, একজনও অধ্যাপক নেই–কোটালিপাড়ার মানুষ আমরা ভাবতেও যে পারি না সে-কথা!
আজ কত স্মৃতি জাগে মনে। বড়ো বড়ো পুজোপার্বণের কথা নাই বা বললাম! আমার গাঁয়ের মেয়েরা-মায়েরা মিলে বছরের পর বছর মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করেছে সারাবৈশাখ মাস ধরে –প্রতিমঙ্গলবারে। তাঁদের সমস্ত মঙ্গলকামনার প্রতিদানে ঘোর অমঙ্গলের অন্ধকারে কেন আমাদের ঠেলে দিলেন মা মঙ্গলচন্ডী? তবে এই চরম অঙ্গলকে অতিক্রম করেই পরমমঙ্গলের সন্ধান পাব আমরা? ছোটোবেলায় আমার দু-বোনকে দেখেছি তারাব্রত করতে। তাদের মতো তাদের সমবয়সি মেয়েরাও করত এ ব্রত পালন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে। কত আকাঙ্ক্ষা কত আকুতিই না প্রকাশ পেত ব্রতচারিণীদের উচ্চারিত ছড়া-মন্ত্রের কলিতে কলিতে। পৌষ সংক্রান্তি থেকে মাঘ মাসের সংক্রান্তির দিন পর্যন্তও চলত এই ব্রতচার। পরিষ্কার উঠোনে আঁকা হত কত সুন্দর আলপনা। সে অলপনার ঘরে দাঁড়িয়ে তারা-বন্দনার গান গাইত আমার দু-বোন ছড়া কেটে কেটে। কী মিষ্টিই না লাগত তা শুনতে আর কী অপূর্ব পরিবেশই না সৃষ্টি হত শীতের সন্ধ্যায়! আজও মনে পড়ে গভীর মনোযোগ দিয়েই আমি শুনতাম তারাব্রতের মাহাত্ম-কথা আমার বোনেদের মুখে। তারা সুর করে বলত,
তারা পূজলে কী বর পায়?
ভীম অর্জুন ভাই পায়,
শিবের মতো স্বামী পায়,
কার্তিক গণেশ পুত্র পায়,
লক্ষ্মী সরস্বতী কন্যা পায়,
নন্দী ভৃঙ্গী নফর পায়,
জয়া বিজয়া দাসী পায়।
তারা পূজি সাঁজ রাতে,
সোনার শাঁখা পরি হাতে।
হায়, এত বর লাভের প্রত্যাশা সত্ত্বেও আমার পুববাংলার মা বোনেদের আজ কী হাল? তাদের ব্রত, তাদের সমস্ত শুভকামনা কবে সার্থক হবে? কবে আমরা আবার সগৌরবে গিয়ে ঘর বাঁধব আমাদের পুববাংলায়?
.
রামভদ্রপুর
যে দেশের জন্যে আমি হা-হুঁতাশ করছি সে দেশ আজ আর আমার নয়! স্বভূমি, স্বদেশ আজ আমার পরভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে দেশে জন্মেছি, যে দেশের ধূলিকণা আমার শরীর গড়েছে, যে দেশের নদীর জল, গাছের ফল আমাকে এত বড়োটি করেছে সে দেশের ওপর আমার আজ কোনো দাবিই নেই ভেবে মনটা হু হু করে উঠছে। ফুল না ফুটতেই ফুল ঝরাবার খ্যাপামি এল কী করে বুঝতে পারি না হাজার চেষ্টা করেও। হয়তো এই অবস্থাটিকেই রূপ দেওয়ার জন্যেই কবিগুরু লিখেছেন,
‘কোন সে ঝড়ের ভুল,
ঝরিয়ে দিল ফুল
প্রথম যেদিন তরুণ মাধুরী মেলেছিল এ মুকুল।। হায় রে!
নবপ্রভাতের তারাসন্ধ্যাবেলা হয়েছে পথহারা।…
…হায় গো দরদি কেহ থাক যদি শিরে দাও পরশন।
এ কি স্রোতে যাবে ভেসে দূর দয়াহীন দেশে
কোনখানে পাবে কূল। হায় রে!’
সত্যি, প্রথম যেদিন এই মকুলমাধুরী মেলেছিল সেইদিনই উঠল জীবনসমুদ্রে ঝড়! সারাবেলা বীণার সুর বাঁধতে গিয়ে কঠিন টানে কেঁদে উঠে ছিন্ন তার যেন রাগিনী দিল থামিয়ে। জীবনের ছন্দে প্রস্তুত হতে গিয়ে ভাগ্যে ঘটল নির্বাসন। আজ মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের এই নির্বাসন দন্ড হল কোন দোষে? নবপ্রভাতের তারা সন্ধেবেলায় পথহারা হল কেন? বিধাতার নিষ্ঠুর বিদ্রুপে আজ আমরা সর্বহারা’ নামে পরিচতি। সর্বত্র নাসিকাকুঞ্চন ছাড়া অন্য পুরস্কার তো কপালে জুটল না! অবাঞ্ছিত হয়ে আর কতকাল আত্মার অবমাননা করব? স্রোতে কি বৃথাই যাব ভেসে, কূলে তরি কি কোনোদিনই লাগবে না? এই পথের ধার থেকে তুলে কোন দরদি মানুষ গৃহে দেবে স্থান তা জানি না!
নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার গ্রাম রামভদ্রপুরের কথা। মরুভূমির মাঝখানে নামটি যেন মরুদ্যানের শান্তির প্রলেপ এনে দেয় মনে। মাদারিপুর মহকুমার অধীনে, মেঘনার এক অখ্যাত শাখানদীর পশ্চিমে নতমুখে সহস্র লাঞ্ছনা মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে আমার জন্মভূমি রামভদ্রপুর। আজ মাঝে মাঝে স্বপ্নের মধ্যে আমার গ্রামের ডাক শুনি; আমাদের ফিরে যাওয়ার জন্যে যেন আকুল মিনতি করছে সে। শুনেছি ভোরের স্বপ্ন মিথ্যে হয় না, আমার দেশজননী আমাদের কোলে টেনে নেবেন ভেবে মন নেচে উঠছে পেখম তুলে। যাব, নিশ্চয়ই যাব আমরা ফিরে মায়ের কোলে। আমরাও তত দিন গুনছি আশাপথ চেয়ে। আবার আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে গলা জড়িয়ে সুখ-দুঃখের গল্প করব আগের দিনের মতো।
মনে পড়ছে আমাদের গ্রামের বাজারের কথা। নদীর ধারে বসত বাজার। এই বাজারে হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে কেনাকাটা করত জিনিসপত্র। দোকানপাটগুলো ছিল মানুষের যেন মিলনতীর্থ, সবাইকে বেঁধে রেখেছিল বন্ধুত্বের সুতোয় একত্রে। কেরামতের মশলার দোকানের খরিদ্দার ছিলাম আমরা, আবার বিখ্যাত হরলালবাবুর দোকানে রিয়াজদ্দি, দিনালি, মোবারক মুনশি আড্ডা দিত দিনরাত। সম্প্রদায় হিসেবে দোকান নির্বাচনের জঘন্য মনোভাব কোনোকালেই আমাদের ছিল না। মনে পড়ছে মাছ কেনার সময় ঠোঙার প্রয়োজন হলে অকুতোভয়ে চলে যেতাম কেরামতের দোকানে। একদিনের জন্যেও তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেখিনি। আবার অন্য দিকে, রিয়াজদ্দির কোনোদিন তরকারি বিক্রি না হলে সোজা সে নিতাই কুড়ির দোকানে বা হরলালবাবুর মুদিখানায় গিয়ে ডালাভরতি তরকারি রেখে দিত পরের দিন বিক্রি করার আশায়। বেতের ডালাখানি চৌকির নীচে রাখবার সময় সে হয়তো মুচকি হেসে কোনো কোনো দিন বলত—’কর্তা, থুয়ে গেলাম ডালাটা। আপনার তরকারির দরকার নাই? লাগে তো কন থুইয়ে আসি বাড়িতে। পয়সা হেইটা কাইল দিবেন কর্তা।’ গ্রামবাসীর ওপর গ্রামবাসীর এই যে সহজ বিশ্বাস, সে বিশ্বাসের গলা টিপল কে?
বর্ষাকালে বাজারে যাওয়ার পথে জল উঠত জমে। গ্রামের লোকজন তখন ভাসিয়ে দিত নৌকার শোভাযাত্রা। যারা কষ্ট করে হেঁটে যাওয়ার দুঃসাধ্য চেষ্টা করত তাদের ডেকে মুসলমান ভাইরাই আত্মীয়তার সুরে বলত,–‘কর্তা গো যাইতে কষ্ট হইব–নৌকা যোওন লাগে।’ মনে পড়ে ছোটোবেলায় দুষ্টুমি করে দলবেঁধে তাদের নৌকো চেপে পাড়ি দিতাম অন্য গ্রামের দিকে সকলের অজ্ঞাতে। কখনো বা নৌকো দিতাম ভাসিয়ে স্রোতের মুখে। নৌকার মালিক ঘাটে নৌকা না দেখে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেড়াত এদিক-ওদিকে। কিন্তু এজন্যে তাদের মুখ মলিন হতে কোনোদিন দেখিনি, নৌকো খোঁজার পরিশ্রম কোনোদিন তাদের অসহিষ্ণু করে তোলেনি।
পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পথে মুসলমানেরা যখন মাথায় তরকারির বোঝা আর হাতে দুধের হাঁড়ি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠত তখন আমি, কুমুদ, মাখন, সতীশ প্রভৃতি ছেলেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তাদের মোট নিজেদের মাথায় তুলে নিয়ে সাহায্য করেছি। বাবুদের সাহায্য করতে দেখে তারা সভয়ে কত সময় দ্বিধাজড়িত গলায় বলেছে—‘এটা করেন কী কর্তা, আমিই নিতে পারুম’ এইভাবেই চলে এসেছে আমার গ্রামের দৈনন্দিন জীবন। সেদিনের সরল সহজ জীবন কি আমরা চেষ্টা করলে আবার ফিরে পেতে পারি না?
বাজারের পাশেই ছিল মধ্য ইংরেজি স্কুল। সামনে ছোটো মাঠ, তার পরেই মেঘনা নদীর শাখার উত্তালতরঙ্গমালা যেন সমস্ত বাধাবিপত্তিকে চূর্ণ করে কূলে এসে আছড়ে পড়ার সাধনায় ব্যস্ত। লাল-নীল-বাদামি-হলুদ পাল তুলে চলে নৌকার ঝাঁক,–দূর থেকে ময়ূরপঙ্খি বলে ভুল হয়। হয়তো এপার দিয়ে পাট বোঝাই নৌকা তিন হাজার মন মাল নিয়ে চলেছে। গুণ টেনে। মাঝিদের পেশিবহুল কালো কালো শরীর বেয়ে ঝরছে স্বেদধারা। গুণ টানার পরিশ্রমে পিঠের শিরগুলো উঠছে ফুলে। পরিশ্রমও যে মানুষকে সময় সময় কত মনোরম করে তোলে তার পরিচয় আমরা সেদিন পেয়েছি। মাঝিদের লোভনীয় স্বাস্থ্যের সঙ্গে নিজেদের ক্ষীণ শরীর মিলিয়ে কত সময় লজ্জিত হয়েছি মনে মনে।
গ্রামের ধনী ঈশানচন্দ্র দে মশায়ের ছেলে ললিতমোহন দের অর্থে তৈরি হয়েছিল আমাদের গ্রামের মধ্য ইংরেজি স্কুলটি। টিনের ছাউনি দেওয়া লম্বা বাড়ি, সমস্ত গ্রামের বিদ্যাবিতরণ কেন্দ্র। নীচের ক্লাসে আমার সঙ্গে পড়ত আকুবালী আর ফজলুল বলে দুজন সহপাঠী। তিনজনের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা থাকার দরুনই হয়তো আমরা তিনজনের বন্ধুত্বের ত্রিভুজ গড়ে ছিলাম সেদিন। ওদের ফুলকাটা সাদা টুপি, আর রঙিন ভেলভেটের ফেজ দেখে কত সময় মন খারাপ করে ঘরের এককোনায় বসে থেকেছি–আমাকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে ওরা কত সাধ্যসাধনা করেছে কারণ নির্ণয়ের জন্যে। পরে কারণ জানতে পেরে হেসে নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের টুপি দিয়েছে আমার মাথায় চড়িয়ে। মুহূর্তে মনের মেঘ কেটে গিয়ে দেখা দিত হাসির সূর্ব। তাদের টুপি মাথায় দিয়ে তাদেরই সঙ্গে খেলা করেছি কতদিন। কিন্তু আজ? জাতিভেদের সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে আর পারবে কেউ এমনভাবে অন্যের মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্যে নিঃস্বার্থ ত্যাগ করতে?
মনে পড়ে আকুবালী আমাদের বাড়ি এলে মা ওকে আম, কলা, দুধ দিতেন বাটি ভরে। আকুবালী আকণ্ঠ ভোজন করে স্বহস্তে বাটিটি ধুয়ে রাখত বারান্দায়। বারণ করলেও শুনত না। জানি না কোথা থেকে আকুবালী শিখেছিল এ ধরনের সামাজিক শৃঙ্খলা! আমাদের খাওয়ার সময়েই হয়তো কোনো কোনোদিন এসে পড়েছে করিমচাচা কিংবা জয়নাল। থপ করে চাটাইয়ের ওপর বসে পড়ে আকুবালীর দিকে রাগত দৃষ্টি হেনে বলেছে—’তুই তো খাইয়া লইলি পেটটা ভইরা, আমরা পেটটা ভরুম না? দেননা মাঠাইন দুইটা আম খাইয়া লই। কর্তাগো সিন্দুইরা গাছের আমগুলা বড়ো মিষ্টি!’ কত আনন্দ করেই না মা খাওয়াতেন তাদের। আজও হাসি পায় তাদের ভোজনপর্বের দৃশ্যটা মনে পড়লে। আগ্রহ ভরে চেটে চেটে আম খাওয়ার ঢং দেখলে মনে হত যেন বহুদিন থেকে ওরা উপবাসী! খাওয়ার পরেই কলকেতে ভরে নিত তামাক।
এই যে সামাজিক হৃদ্যতা সেদিন দেখেছি তার মৃত্যু হল কোন চক্রান্তকারী ডাইনির মন্ত্রে? মানুষ মানুষকে কেন আজ এড়িয়ে চলছে পশুর মতো? আমরা কি স্বার্থপরতা, নীচতা, শঠতা ভুলে গিয়ে আবার আত্মীয় হয়ে উঠতে পারি না? সাধারণ মানুষ কেন হিংস্র হবে, কেন মানবীয় গুণগুলোকে বিসর্জন দিয়ে পরের ক্রীড়নক হয়ে উঠবে? কাকে ছেড়ে কার চলে সংসারে? আবার কি আমরা মানুষ হতে পারব না, একত্রে মিলেমিশে থাকতে পারব না?
প্রতিবৎসর বাসন্তি পুজো হত আমাদের বাড়িতে। এ পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের ধনী-মানী জ্ঞানী-গুণীর নিমন্ত্রণ তো হতই, সেই সঙ্গে নিমন্ত্রণ হত সমস্ত গ্রামবাসীর। এ উৎসবে দেখেছি আমাদের চেয়ে বেশি উৎসাহী ছিল মুসলমান ভাইরা। এই দিনটির জন্যে তারা উদগ্রভাবে প্রতীক্ষা করে থাকত বছরের প্রথম দিন থেকে। তাদের আগ্রহে পুজো যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। তারাই সংগ্রহ করে আনত বলির মোষ। নিয়ে আসত চাঁদপুর থেকে মালপত্র সুশৃঙ্খলভাবে। পুজোর ঢাকের আওয়াজে সমস্ত গ্রামখানি হয়ে উঠত জীবন্ত, বহুদূর থেকে ঢাকের শব্দ শুনে লোক আসত ছুটে। এ পুজোকে প্রত্যেকে নিজের বলে গ্রহণ করায় সেদিন কোনোরকম গোলযোগই দেখা দিত না গ্রামে। গ্রামবাসীদের মধ্যে আত্মীয়তাপূর্ণ ব্যবহারই সমস্ত জিনিসটিকে করে তুলত মধুময়।
আমাদের বাড়িতে থাকত জংগু ঢালি আর এলাহিবক্স। তারা বাগান তদারক করত, কাঠ চিরত, নৌকা বাইত-বলতে গেলে কঠোর পরিশ্রমের সব কাজগুলোই তারা সমাধা করত বিনা বাক্যব্যয়ে। সকালবেলা একগামলা পান্তাভাত খেয়ে লেগে যেত কাজে। ভাত খাওয়ার ব্যঞ্জনও ছিল তাদের কত অনাড়ম্বর–একটি পেঁয়াজ আর একগন্ডা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে এত নির্বিবাদে এত ভাত খাওয়া যেতে পারে তা এলাহিবক্সদের খাওয়া না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না! জীবনযাত্রা এত সরল ছিল বলেই তাদের পক্ষে সবই সেদিন ছিল সম্ভব, কিন্তু আজ আর সেদিন নেই। বিলাসের ফাঁসে পড়ে সকলেই হয়ে উঠেছে বিলাসী, এখন সারল্য তাই হয়েছে বিতাড়িত। আগে যারা কর্তাবাড়ির প্রসাদ পেয়েই নিজেদের মনে করেছে ধন্য, আজ তাদের মনোভাব অন্য ধরনের। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে আম কুড়োনোর ছবি। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে বাগানে আম কুড়োতে গেলে জংগু আর এলাহিবক্স কত সমাদর করে আমাদের হাতে আম দিত তুলে। বাগান জমা দেওয়া সত্ত্বেও তারা আপনা থেকে কোনোদিনও একটি আম নেয়নি, সমস্ত আম পৌঁছে দিয়েছে আমাদের বাড়িতে। কর্তামা বা বাড়ির অন্য কেউ ডালায় ভরে যে কটা আম তাদের দিতেন তাই বাড়ি নিয়ে যেত তারা হাসিমুখে পরমপরিতৃপ্তির সঙ্গে। ডালা কাঁধে তুলতে তুলতে বরঞ্চ কৃতার্থ হয়ে বলত, ‘পোলাপানেরে থুইয়া আমি একলা খামু কেমন কইরা, আপনাগো দয়াইত তবু পোলাপানরা আম জাম খাইতে পায়।’ একথা কি বঞ্চিতের কথা? আজ ভারাক্রান্ত মনে ভাবি সময় সময় মানুষের সৌহার্দ্যবোধ কেন নষ্ট হল? আমাদের আত্মীয়তাবোধ কি তাহলে চোরাবালির ওপর ছিল প্রতিষ্ঠিত, না হলে, তা এমন অতলতলে তলিয়ে গেল কী করে হঠাৎ?
মনে পড়ে আমাদের বাড়ির সর্বজনীন তামাক খাওয়ার দৃশ্যের কথা। ঘরের বারান্দায় থাকত তামাকের সাজসরঞ্জাম। বাজারের পথে বাড়ি হওয়ায় চব্বিশ ঘণ্টা ভিড় থাকত লেগে। যে কেউ তামাক খেত, তার শাকরেদ হত জংগু আর এলাহি। বিনামূল্যে এই সামান্য তামাকের আকর্ষণ ছিল অদ্ভুত, যতক্ষণ ধোঁয়া না পেটে পড়ত ততক্ষণ সবাই যেন স্থবির হয়ে বসে থাকত গোলাকার হয়ে! বিদেশি পথিকরাও শ্রমলাঘবের জন্যে এখানে ক্ষণিকের জন্যে না বসে যেতে পারত না। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি সেদিন নেশার কাছে সমস্ত জাতিভেদ হয়েছিল পরাজিত। সেটা ছিল মানুষের বিশ্রামাগার, ঘর্মক্লেদাক্ত দেহে রৌদ্রের খর তাপ থেকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যেই আত্মীয়তার সুর উঠত নিবিড় হয়ে বেজে। ধোঁয়ার অক্ষরে অক্ষরে সেদিন লেখা হত–’সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই!
শৈশবের কোমল মনে যে ছাপ একবার পড়ে তা হয়ে থাকে অক্ষয়। এখন হুবহু মনের মানচিত্রে সমগ্র গ্রামখানি জ্বলজ্বল করছে। মনে পড়ে বাজার থেকে পশ্চিম দিকে চলে গেছে প্রশস্ত রাস্তাটি–তার দু-পাশে কুমোর, নাপিত, কামার ইত্যাদি নানা শ্রেণির বাস। আধ মাইল যাওয়ার পর ডাইনে বাঁয়ে বেঁকে গিয়ে গাঁয়ের দু-পাড়া এসে মিশেছে চৌমাথায়। এই মোড়টিই গ্রামের কেন্দ্রস্থল। ডাইনের রাস্তাটি মুসলমান পাড়ার বুক চিরে চলে গেছে কার্তিকপুর পর্যন্ত, বাঁয়ের রাস্তা গেছে গ্রামের উচ্চশ্রেণির বাবুমশায়দের পাড়া ছুঁয়ে। এই রাস্তার ওপরেই পড়ে মুন্সেফ সাহেবের বাড়ি, নাম ‘বাবুবাড়ি’। ঝাউগাছ সমন্বিত প্রশস্ত খোয়া বাঁধানো চওড়া রাস্তাটি বাবুবাড়ির আভিজাত্যের পরিচায়ক। সেদিন ঝাউগাছের বুক থেকে সোঁ সোঁ শব্দ করে যে হাওয়া যেত ছুটে আজ সে শব্দ শুনলে মানুষের আর্তনাদ বলেই ভুল হবে! মনে হবে সহস্র দুঃখ-দুর্দশায় বুক ফাটানো আর্তনাদ ফেটে পড়ছে ঝাউগাছের ফাঁকে ফাঁকে। জানি না মুন্সেফ সাহেব সে দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেয়েছেন কি না! রাবণের চিতাগ্নির মতো এই যে মনের আগুনের আর্তস্বর অহর্নিশি শব্দায়িত হচ্ছে এর শেষ কোথায়?
এখানেই পুজোর সময় হত থিয়েটার। থিয়েটারের জন্যে সমস্ত গ্রামবাসীরাই উদগ্রীব হয়ে দিন গুনত, চাঁদা তুলত, হাতে লিখে প্রোগ্রাম তৈরি করত। পুজোর ছ-মাস আগে থেকেই সিনগুলো নতুন হয়ে ঝলমলিয়ে উঠত। গ্রামের চিত্রকর মল্লিকমশায় ছিলেন এই দৃশ্যপট সজ্জার পান্ডা। তিনি দৃশ্যপটে আঁকতেন। রামভদ্রপুরেরই গ্রাম্য ছবি। আমার গ্রামের ছবি ড্রপসিনের গায়ে কী চমৎকার লাগত তা আজ ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।
পুজোর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছে মহীসারের বৈশাখী মেলার কথা। বৈশাখের প্রথম দিন থেকে সাত দিন সে মেলা হত স্থায়ী। আমরা গুরুজনদের কাছ থেকে পৃথক পৃথক ভাবে পয়সা জমিয়ে মেলা দেখতে যেতাম হইহুল্লোড় করে। চৈত্র সংক্রান্তিতে সুদূর হাটখোলার একমাইল উত্তরে সারাদিন মেলায় কাটিয়ে বাড়ি ফিরতাম ক্লান্ত চরণে। হাতের পুঁটলিতে বাঁধা থাকত পুতুল, বাতাসা, কদমা, জিলিপি, বাদামভাজা ইত্যাদি লোভনীয় বস্তুসম্ভার। মহীসারের মেলাতে রবারের বল, মাটির গণেশ আনতেই হবে এই ছিল আমাদের নিয়ম। সেসব দিন কি আমাদের জীবনে আর ফিরে আসবে না? এই মেলা উপলক্ষ্যে আমাদের গ্রামে বাইচ খেলা ছিল প্রধান আকর্ষণ। শান্ত মেঘনার শাখানদীতে বাইচ খেলা সেদিন সমস্ত গ্রামবাসীকে উদ্দীপনা দিয়েছে তার তুলনা পাওয়া ভার। নদীর তীরে একটা দীর্ঘ বাঁশে পেতলের একটি কলসি থাকত ঝুলানো। বাইচ আরম্ভ হলে দ্রুত নৌকো চালিয়ে যে প্রতিযোগিতায় জিতে ওই কলসি নিতে পারবে তারই শ্রেষ্ঠত্ব সকলে নিত স্বীকার করে। চক্ষের পলকে তীব্র গতিতে নৌকোগুলো সব হয়ে যেত অদৃশ্য। নদীর বুকে কালো কালো বিন্দু যেন ছুটে চলেছে, সহস্র চোখে তারই দিকে তাকিয়ে থাকত অজস্র মানুষ। উৎসাহের বাষ্পে ফেটে পড়া সে মানুষের আজ এ কী অবস্থা! যারা একদিন আনন্দকেই জেনেছিল জীবন বলে, আজ তারা উলটো পথের পথিক হল কেন? উপনিষদ বলছে যে আনন্দ থেকেই মানুষের জন্ম, আনন্দের মধ্যেই তার লয়। কিন্তু আমরা তো তার প্রমাণ পেলাম না! আনন্দের মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেও আনন্দের মধ্যে তো বিদায় নিতে পারলাম না। তবে কি স্বর্গ থেকে এ বিদায় ক্ষণস্থায়ী? আবার আমরা আনন্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হব? মহাজন বাক্য তো নিষ্ফল হয় না, অবিশ্বাসী আমরা সব সময় স্থির মস্তিষ্কে চিন্তা করতে পারি না বলেই অযথা দুঃখ পাই। উপনিষদ সত্য, উপনিষদ অভ্রান্ত, উপনিষদের কথা নিষ্ফল হতে পারে না। আবার আমরা মানুষ হব, আবার আমরা সুখী-স্বচ্ছল হব। একাগ্রমনে কান পেতে শুনুন, আকাশে বাতাসে উঠছে আনন্দের সুর। আনন্দের মধ্য দিয়ে আনন্দকে চিনে নেওয়াই কর্তব্য আমাদের।
.
কাইচাল
পুজোর ছুটি। ‘ঢাকা মেল’ ধরবার জন্যে ছুটে চলেছি। স্টেশন একেবারে জনারণ্য। তবু এ ভিড় অগ্রাহ্য করেই প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে রওনা হয়েছি। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে শেয়ালদা থেকে ট্রেন বেরিয়ে গেল। কলকাতার আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে চলেছি। চেনা চেনা গ্রাম ও শহরের পাশ দিয়ে হু হু করে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়েছি। আমার গ্রাম আমাকে ডাকছে ফরিদপুর জেলায় কাইচাল আমার গ্রাম।
ট্রেন থেকে নেমে নৌকোঘাটায় গিয়েছি, অমনি শত কণ্ঠে চিৎকার হয়েছে—’কোহানে যাবেন কত্তা, এদিকে আসেন।’ যে নৌকোখানি দেখতে একটু ভালো, গেলাম তার নিকট। মাঝির নাম মৈনুদ্দিন, এই তার আসল পেশা আর এমন বিশ্বাসী সে যে, নৌকোয় কিছু ফেলে গেলেও ফিরিয়ে দিয়ে যায়, সুতরাং ভাড়ার প্রশ্নই উঠল না।
নৌকো চলেছে। নৌকোর বাইরে বসে আছি, সব দেখছি। মাঝি বললে,–‘কর্তা, ছইর মধ্যে যান রইদ লাগবে।’ অবসন্ন দেহ, তবু ঝিম ধরে বসে আছি, কী যে এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। ফরিদপুরে ‘মাইজা মিয়ার খাল’ বিখ্যাত, তার মধ্যে নৌকো পড়েছে। মৈনুদ্দিন মাথাল নামিয়ে রেখে মাজার গামছা কষে নিল। চইরটাকে একটানে বের করে নিয়ে এক চিৎকার দিয়ে বলল, ‘যার যার হাতের বায়ে।’ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলাম, দেখি কিছু সাহায্য করতে পারি কি না। মৈনুদ্দিন দিল না, বলল—’আপনার নাগবে না, আপনি বসেন।’
নৌকো ছেড়ে দিলে, জিজ্ঞাসা করি কখন পৌঁছোতে পারব। সে বললে, সন্ধ্যাসন্ধি। পাট ভরতি, মুসুর ভরতি, আরও কতরকম পসরা ভরতি কত নৌকো ঝুপঝাঁপ শব্দে চলেছে নিকটবর্তী কোনো এক বন্দরের হাটে।
ঢাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বুঝলাম এসে পড়েছি, তবে আশপাশে ছোটো ছোটো আরও গ্রাম রয়েছে, তাই আমার গ্রাম কতদূর তা বুঝতে পারছি না! মৈনুদ্দিন বলল,–‘এই তো কাইচালের বিল, এটা পার হলেই আপনাগো গ্রাম দেহা যাবেনে।’
কাইচাল গ্রামের বাবুদের বিল। এর অনেক ইতিহাস আছে। আশপাশে ভূত-পেতনি ঘোরে আর বিলের মধ্যে সিন্দুকের ঘড় ঘড় শব্দও নাকি অনেকে শুনেছে। ফইটকার খালের মুখে একটা ভ্যাসালের কাছে গেলাম। সনাতন মাঝির ভ্যাসাল, ওপরে সে আছে, একটা ছোটো হ্যারিকেন লণ্ঠন বাঁধা। মাছটাছ আছে নাকি সনাতন?’ বলতেই একখান চার-পাঁচ সের ওজনের নলা এবং সের আড়াই পরিমাণ টাটকানি দিল সে। বলল, ‘লইয়া যান, দাম এখন দেওয়া নাগবে না। খালের ভেতর দিয়ে একখানা মুসলমান গ্রাম পার হতেই কানে ভেসে এল দোতারার ক্ষীণ শব্দ, বুঝলাম আমাদের গ্রামের নাপিতপাড়ার প্রসন্ন শীল। এ তল্লাটে ও ছাড়া আর কেউ এ যন্ত্র বাজায় না। আর জানতাম কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রোজই ও দোতারা বাজায়। হঠাৎ ‘কাহার’ বাড়ির আলো দেখলাম, প্রশ্ন এল, ‘যায় কেডা?’ নৌকো গিয়ে ঘাটে লাগল।
গল্প শুনেছি যাতে বাইরের কোনো শত্রু কোনো হিন্দুর গ্রাম আক্রমণ করতে না পারে এইজন্যে এ তল্লাটের প্রায় প্রত্যেকখানি গ্রামই চতুর্দিকে মুসলমানদের দিয়ে ঘেরা। আমাদের গ্রামখানিও তেমনি। বহুপুরাতন গ্রাম, জমিদার প্রধান স্থান। কালীমন্দির শিবমন্দির, পুরোনো দিঘি, রামসাগর, শানবাঁধানো ঘাট ইত্যাদিতে তার সাক্ষ্য দেয়। বসু মজুমদারেরা পুরাতন বাসিন্দা। ছেলেগুলো উচ্চশিক্ষা পাওয়ায় সবাই প্রবাসী। তাই নাটমন্দিরের ওপরে উঠেছে বট পাকুড় গাছ, ভেতরে বাস করেছে কবুতর আর পেঁচা, তবু কিন্তু কোনো পুজো-অর্চনা বাদ যায় না।
প্রায় সমস্তরকমের জাতের বাস আছে এ গ্রামে। ভদ্র এবং শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশি থাকায় আশপাশের সমস্ত লোকের আচার-ব্যবহার ভদ্র। উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত গৃহস্থের প্রায় সকলেরই ধানের গোলা, গাইগোরু এবং পুকুর আছে। তারপর প্রত্যেকখানি বাড়িই আম, নারিকেল, কলা, কাঁঠাল ইত্যাদি গাছে ঘেরা; প্রত্যেকের সঙ্গেই যেন নিবিড় আত্মীয়তার বন্ধন। প্রত্যেকটি ঋতু উপভোগ করেছি পরিপূর্ণভাবে, কোকিলের কুহু কুহু রব, দোয়েলের শিস, পাপিয়ার তান। প্রকৃতিদেবী যেন আপন হাতেই সাজিয়েছেন গ্রামকে। উত্তর এবং দক্ষিণে প্রশস্ত মাঠ। শীতের দিনে দেখেছি পরিপূর্ণ যুবতীর ন্যায় মাঠখানি নানারকম রবিশস্যে ভরা–আবার বর্ষাকালে দ্বীপের ন্যায় মনে হয়েছে গ্রামটিকে। শীতের দিনে কাদের গাছি এসেছে খেজুর গাছে হাঁড়ি পাততে। ছেলেদের দল ছুটেছে তার পেছনে পেছনে,–‘ও গাছি একটা চুমড়ি দেবে?’ গাছি বলেছে, ‘পান নইয়া আইস।’ তার সাজ দেখলে মনে হত যেন সে কোনো যুদ্ধে যাচ্ছে।
নির্মল ঘোষ, বিমল ঘোষমহাশয়রা বাড়ি আসছেন শুনলে সারাতল্লাটে সাড়া পড়ে যেত। আশপাশের গ্রামের লোকজন উদগ্রীব হয়ে উঠত দেখা করবার জন্যে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা হয়ে উঠত চঞ্চল। খেলাধুলোর বন্দোবস্ত হত সকালে, দুপুরে, বিকালে–যাতে কেউ বাদ না যায়। সে কী আনন্দ! প্রত্যেকেই কিছু না কিছু পুরস্কার পেত। গ্রামের পূর্বদিকে সাত-আট মাইল দূর থেকে নির্মলবাবুর প্রতিষ্ঠিত স্কুল ঘর দেখে লোকে ‘ওই কাইচাল’ বলে এ গ্রাম ঠিক করে। কয়েক বৎসর হল একটি দাঁতব্য চিকিৎসালয়ও তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ ছাড়া দেশের ও দশের অনেক উপকার এবং কাজ এঁরা করেছেন। এঁদের কাজকর্ম দেখে সকলেই বলাবলি করত, লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্যে এঁরা দু-ভাই দৃঢ়সংকল্প।
এঁরা যখন চলে এসেছেন তখনও নির্জীব হয়নি গ্রাম। ছোটো হিস্যার খোকাদার কাছারিঘরের দোতলায় প্রায় সব সময় চলেছে নাচের মহড়া–এক, দুই, তিন। বড়ো হিস্যার কাছারিতে চলেছে নামকরা অভিনেতাদের পার্ট, কত অঙ্গভঙ্গি সহকারে মাস্টার তাদের শেখাচ্ছেন। তারপর মণীন্দ্রমোহন বসু মজুমদারের কাছারিতে চলেছে গান-বাজনার তোড়জোড়।
গ্রামে ছিল পোস্ট-অফিস। দূর গ্রাম থেকে কোনো লোক এসেছে দরকারে, যত শীঘ্র সম্ভব ফিরে যাবে; কিন্তু ভুলে গেছে সে তার জরুরি কাজ। একাছারি ওকাছারি ঘুরে দেখেশুনে ডাকঘরে যেতে যেতে ডাকঘর হয়ে গেছে বন্ধ!
গ্রামের মোহন শীল বিকট কালো পোশাক পরে কপালে বড়ো একটা সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে খাড়াহাতে জল্লাদের ভূমিকায় যখন থিয়েটারের আসরে অবতীর্ণ হয়েছে তখন অনেক ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। খোকাদার প্রকান্ড আটচালা ঘরে হচ্ছে যাত্রাগান–গ্রামের রাশভারী প্রকৃতির লোক সুরেশচন্দ্র ঘোষমহাশয় দলের সেক্রেটারি, দক্ষিণারঞ্জন বসুমহাশয় ম্যানেজার, শ্রোতার সংখ্যা অধিকাংশই মুসলমান, কিন্তু ‘টু’ শব্দটি নেই। কারণ জমিদার বাড়িতে গান, তারপর স্বয়ং জমিদাররা উপস্থিত। জায়গায় জায়গায় পেয়াদা এবং বরকন্দাজরা বাঁশের এবং বেতের লাঠি হাতে দন্ডায়মান হয়ে খবরদারি করছে।
যখন চড়ক পুজো এসেছে, তখন কী মাতামাতিই না শুরু হয়েছে। বালা সন্ন্যসীরা নানারূপ কৃচ্ছসাধন করে এই জাগ্রত এবং ক্রুদ্ধ দেবতার পুজোর জন্যে তৈরি হয়েছে। খোকাদার বেলতলা পুকুরের মধ্যে প্রকান্ড একটি আস্ত গাছ ডুবে আছে–যে সে গাছ নয়, ওর ভেতর রয়েছে দেবতা! প্রবাদ আছে চড়ক পুজোর ঢাকের বাজনা শুনলে ওই গাছ ভেসে ওঠে। এই পুজোর দিন যত সব ভূত, পেতনি, দানব, দত্যি নেমে আসে এবং অবাধে যাতায়াত করে; তাই ওইদিন আগে থেকেই সাবধান হয় ছেলে-মেয়েরা।
গাজন গান হবে। গ্রামের অক্ষয় পাল এবং নগরবাসী মন্ডল পুরাণ আলোচনার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছে, কতলোক জমেছে। জ্ঞানীজন সব বসেছে সম্মুখে, পাশে দুটো ঢাক তৈরি হয়ে রয়েছে। হচ্ছে গাজন গান, কী সে আনন্দ! একবার শ্যাওড়া গাছের ডাল কাটায় গ্রামের একটা ছেলে ভীষণ অসুখে আক্রান্ত হয়। বাঁচবার আশা তার মোটেই ছিল না। পরে প্রকৃত ঘটনা জেনে মানত করে পুজো দেওয়া হয় গাছের গোড়ায়। তারপর সে রোগমুক্ত হয়। আমি নিজে দেখেছি। কাজেই অবিশ্বাস করতে পারি না। তবে হতে পারে কাকতালীয়।
বীজ বপনের সময় বৃষ্টির পাত্তা নেই। সারামাঠ প্রখর রৌদ্রতাপে ফেটে খাঁ খাঁ করছে। কৃষককুল হায় হায় করছে। অহোরাত্র কীর্তন হচ্ছে। হঠাৎ কেউ বলল গ্রামের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত নিশাতলা–ওখানকার দেবতা স্বপ্নে বলেছে পুজো দিতে! অমনি সবাই মিলে সেখানে গিয়ে দেবতার পুজো দেয়, তিন-চার মন দুধ দিয়ে যে যে গাছে দেবতা আছে তাদের স্নান করায়। আমরা দেখেছি সেই দিনই কি পরের দিন ভীষণ বৃষ্টি হয়ে মাঠ ভাসিয়ে দিয়েছে! বুদ্ধিতে এসবের ব্যাখ্যা চলে না। কী হিন্দু কী মুসলমান সবাই ওই জায়গাটিকে ভয় করে এবং ভক্তিও করে। হায়, আর কি কোনোদিন ফিরে যাব না সে দেশে, আমার সোনার গাঁয়ে!
কালীবাড়িতে আছেন জাগ্রত কালী, পাশে সাতটি শিব। প্রত্যহই পুজো হয়। আমরা শুনেছি আমাদের কালীবাড়িতে নরবলি পর্যন্ত হয়েছে!
ফাগুন মাস। কলকাতা থেকে সুধাংশুবাবু এসেছেন। অনেক গুলি এনেছেন। বাড়িতে তাঁদের বন্দুক আছে। ছেলের দল সব তৈরি হয়েছে ঘোড়ামারার বিলে পাখি শিকারে যাবে। কত আনন্দ এতে পেয়েছে গ্রামের ছেলেরা। তিন-চারটে বাতাবি লেবুর গাছ ছিল, কেউ কোনোদিন পাকা লেবু দেখেনি–কারণ ওসব দিয়ে ফুটবলের কাজ চালাতে হয়েছে।
পশ্চিমপাড়ার ঠিক কোনায় ছিল নগেন-ক্ষিতীশদের বাড়ি। তাদের মার সঙ্গে আমার মায়ের ছিল খুব ভাব। দুজনেই বিধবা। নিজের তিনটি ছেলে থাকা সত্ত্বেও কী ভালোই না বাসতেন তিনি আমাকে। প্রত্যেকদিনই গিয়েছি তাঁদের বাড়িতে আর কিছু মুখে না দিয়ে কোনোদিনই ফিরতে পারিনি। অনেকে মনে করিয়ে দিত, আমি ব্রাহ্মণের ছেলে, কিন্তু মাসিমার অপত্য স্নেহের কাছে কোনো কথাই টিকত না। মনেপ্রাণে মাসির মুখে হাসি দেখতে চেয়েছি। নগেন ক্ষিতীশ থাকত বিদেশে। মাসির দুঃখ, তারা ঠিকমতো চিঠি দেয় না। নগেন বড়োভাই হয়েও ক্ষিতীশের বিয়ের জন্যে চেষ্টা করছে না, আরও কত কী মাসি নালিশ জানাত আমার কাছে। আজ নগেন, ক্ষিতীশ, মাখন তিনজনেই সংসারী হয়েছে, বেশ সুখে-শান্তিতেই আছে। কিন্তু মাসি তাঁর বউ আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে দেশে থাকতে পারলে তাঁর কত বেশি আনন্দ হত!
তারপর বিশ্বকর্মা পুজোয় ভাঙার গাঙে নৌকাবাইচ। রতন সর্দার সকালেই তার বাবরি চুলে সাবান দিয়ে ফুলিয়েছে, কপালে বড়ো সিঁদুরের ফোঁটা দিয়েছে, লাল গামছা একখানা পরেছে, আর একখানা মাজায় বেঁধে এক হাতে ঢাল এবং অপর হাতে লকলকে ধারালো খঙ্গ নিয়ে নৌকোর ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আশিহাত লম্বা নৌকো, দশ-বারো হাত হবে তার গলুই। দু-পাশে পেতলের চক্ষু, আরও কত কী দিয়ে সাজানো। গলুই-এর ওপরে পেতলের দুটি সাপ ফণা তুলে রয়েছে এবং নৌকোর দোলায় দোলায় উভয়ে উভয়কে আঘাত করছে। রতন সর্দার বোল বলছে,
আমার নায়ে হোলক গাবি কে, আরে হোলাবিলাই শাদি করবে কাহই আইনা দে।
গ্রামের প্রত্যেক বাড়ির প্রত্যেকটি আমগাছের কোনো-না-কোনো নাম রয়েছে। আমাদের পুকুরপাড়ে উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল একটা খুব উঁচু আম গাছ–নাম তার থোপঝুড়ি। ওই গাছের মাথায় ছিল বড়জিয়াল পাখির বাসা। তারা ওই স্বামী-স্ত্রীতে প্রহরে প্রহরে ডাকত। পুকুরপাড়ের গাছে ছিল মাছরাঙার গর্ত। মাছরাঙা পুকুর থেকে মাছ ধরে পেয়ারা গাছের ডালে বসে খেত। আমি বাঁশ-গুলি দিয়ে অন্য অনেক পাখি মেরেছি, কিন্তু এদের কোনোদিন মারিনিঃ |||||||||| পূর্বপাড়ায় ত্রিনাথের মেলা। কে যেন গান ধরেছে,-”আমার ঠাকুর তেন্নাথের যে করিবে হেলা…’, তারপর যেন কী ভুলে গেছি। গণশা গিয়েছে সেখানে, তাই কামিনীদি ডাকছে, ও গণশা, গরে সোমত্ত বউ, আর তুই গান শুনছিস?’ কামিনীদি শুতে যেতে পারছেন না। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাঁর সেসব বিলাপ শুনতাম।
এখানে আমার ঘুম ভাঙানোর কেউ নেই, কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আমার ঘরের কোণে বেতের ঝোপে ডাহুক ডাহুকি, আরও কতরকম পাখির ঐকতান ভোরে আমার ঘুম ভাঙাত। |||||||||| গ্রামের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বৃদ্ধ ঘোষালমশায়কে। তিনি যখন মাথায় কলসি নিয়ে অপরূপ ভঙ্গিতে নাচতেন, তখন গ্রামের কত লোক এসেছে তা দেখবার জন্যে। এখনও লোকমুখে সে নাচের খবর শুনতে পাওয়া যায়। |||||||||| অক্ষয় চক্রবর্তীমশাই চামর দুলিয়ে রামায়ণ গান করতেন। গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সব
তন্ময় হয়ে বসে শুনত। রামের বীরত্বে কে না পুলকিত হয়েছে, লক্ষ্মণের কথায় কার না শরীরে রোমাঞ্চ দিয়েছে, সীতার দুঃখে কে না অভিভূত হয়েছে? কিন্তু আজ সেসব স্মৃতি!
আজকাল পঞ্চায়েত প্রথার কথা খুবই শুনছি। অথচ আমার গ্রামে এ সব সময়েই ছিল। আশপাশের কোনো গ্রামে বা কোনো লোকের সঙ্গে কারো ঝগড়া-বিবাদ হলে জমিদার বাড়ির পেয়াদা গিয়ে নিয়ে আসত তাদের খবর দিয়ে। গ্রামের প্রবীণ লোকদের ডাকা হত, জমিদার উপস্থিত থাকতেন, সূক্ষ্ম বিচার হত, উভয়েই খুশি মনে গল্প করতে করতে চলে যেত। এইভাবে কত লোক অযথা অর্থব্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলত। |||||||||| গ্রামের চতুষ্পর্শ্বে দু-তিন মাইলের মধ্যে ভাঙার হাট, পোড়াদিয়ার হাট, নরকান্দার হাট, ফলিখালির হাট আর আউরাকান্দির হাট-বর্ষাকালে দেখেছি কত লোক কত রকমের নৌকোয় করে ছুটেছে হাটের দিকে। আবার শুকনোকালে দেখেছি মাঠের ভেতর দিয়ে নানা রাস্তায় লোক ছুটেছে কাতারে কাতারে হাটের দিকে। কারও মাথায় ধামার ভেতর কয়েকটি লাউ কিংবা কিছু বেগুন, না হয়তো অন্য কোনো তরিতরকারি, কারও হাতে দুধের ভাঁড়। এরা সবাই আপন আপন খেত কিংবা বাড়ির জিনিস নিয়ে চলেছে হাটে। তারা ধানের দর, পাটের দর, ভাঙার হাটে কয়খানা ধানের নৌকো এসেছে ইত্যাদি বলাবলি করতে করতে চলেছে।
জমিদার বাড়িতে পুণ্যা হবে। কাছারিঘর সাজানো হয়েছে। ভোর হতেই প্রজারা সব আসছে দুধ মিষ্টি আর টাকা নিয়ে। এদিকে আটটায় সর্দারি খেলা হবে, নামকরা সব সর্দাররা এসেছে। কে কত ভালো খেলা জানে আজ তার প্রমাণ হবে স্বয়ং জমিদারের সামনে। আফা সর্দার কলসির ওপর থালা উপুড় করে বাজাতে আরম্ভ করেছে, আর আর সর্দাররা পা তুলে নেচে নেচে কতরকমের কায়দা দেখাচ্ছে। এসব দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে।
.
খালিয়া
নদীর নাম কুমার, গাঁয়ের নাম খালিয়া। নামের মধ্যেই মূর্ত হয়ে রয়েছে নদীটির পরিচয়। কুমারের মতোই সংযত ও সাবলীল ছন্দে অবিরাম বয়ে চলেছে সে তার অনির্দেশ্য যাত্রায় মধুমতীর উদ্দেশে। তার যাত্রাপথে