পশুপতি কিছু বলার আগেই হাবুলের গাড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে মাঠে নেমে গেল।
আত্মাদর্শন
“এই দেখো হে কাকে এনেছি সঙ্গে করে,” বলে রমেশবাবু সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে পেছনের মানুষটিকে দেখালেন।
জগবন্ধু বেতের চেয়ারে বসে পা তুলে মোজা পরছিলেন। চেয়ারের পাশে কেডস জুতো। পায়ের আধখানায় মোজা উঠেছে। বললেন, “দেখছি তো, কাকে ধরে নিয়ে আসছ! উনি কে?”
জগবন্ধু চিনতে পারলেন না। বাগানের ফটক খুলে রমেশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যে ভদ্রলোক আসছিলেন তাঁর দিকে জগবন্ধুর চোখ আগেই পড়েছিল। বাবাজি-বাবাজি গোছের চেহারা। দাড়ি, গোঁফ, ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল। আনা আষ্টেক সাদা হয়ে এসেছে। ভদ্রলোকের শরীরের গড়ন-পেটন দোহারা, রঙ বোঝা যাচ্ছিল না, কালো অবশ্য নয়।
মাথা নাড়লেন জগবন্ধু। বাবাজিকে চিনতে পারছেন না।
রমেশ বললেন, “পারলে না? আমাদের বঙ্কু। নন্দবাবুর ছেলে গো। সেই ডাক্তার নন্দবাবু, বরফ কলের কাছে দোতালা বাড়ি।”
“বঙ্কু!” জগবন্ধু, একে একে বরফ কল, নন্দ ডাক্তার, এবং খাকি হাফ প্যান্ট পরা বঙ্কুকে ঠাওর করে নিতে পারলেন, কিন্তু এই দাড়ি গোঁফঅলা, বাবরি চুলের বঙ্কুকে তার সঙ্গে মেলাতে পারলেন না। ঢোক গিলে বললেন, “তা ওর এই দশা কেন?”
রমেশ বললেন, “বঙ্কু এখন স্পিরিচুয়ালিস্ট। আত্মা ভূত প্রেত, পরকাল-টরকাল নিয়ে পড়ে আছে।”
“কেন, ওর কি বউ মারা গেছে?” জগবন্ধু বললেন, বলে গোড়ালির কাছ থেকে মোজাটা পায়ের ওপর দিকে টেনে নিলেন।
বঙ্কু মোলায়েম করে হাসল। বলল, “ভাল আছেন, জগুদা?”
“যে বয়সে যেমন থাকে ভাই সেই রকম আছি। অল্পস্বল্প ডায়েবেটিস, প্রেশারের খানিকটা ট্রাবল, হাতের গাঁটে আরথারাইটিস—এই সব উপসর্গ নিয়ে আছি। তা তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো?”
“আজ আর বসব না। আপনারা তো এখন বেড়াতে বেরুবেন।”
“ওই একটা চক্কর। মোল্লার দৌড় মসজিদ। স্টেশনের দিকে যাব একবার। কলকাতার গাড়ি এলে খবরের কাগজটা নেব, একটা পাউরুটি, এক প্যাকেট সিগারেট, গিন্নির জন্য সেউভাজা। তারপর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরব।”
“কেমন লাগছে জায়গাটা?”
জগবন্ধু আঙুল দিয়ে রমেশকে দেখালেন। “ওকে জিজ্ঞেস করো। ও হল ইঞ্জিন, আমি মালগাড়ি। নিজের বউ, আমার বউ—দুটো বউকে মন্তর দিয়ে জপিয়ে হাওয়া বদলাতে নিয়ে এসেছে আমাকে। আমার তো দেখছি একদিন খিদে হলে দু দিন পেট একেবারে ফায়ার ব্রিকস হয়ে থাকে। কুয়োর জলে চান করে করে গায়ে রাশ বেরিয়ে গেল। এটা কি কোনো ভদ্রলোকের জায়গা।”
রমেশ বললেন, “বঙ্কু, তুমি একবার সকালের দিকে এসে জগোবাবুকে দেখো। চোখের তলা লাল হয়ে গিয়েছে, গাল টকটক করছে…। নবযৌবন সঞ্চার হচ্ছে সিক্সটি টুতে।”
“সে কি তোমার জলের গুণে? চার আউন্স করে ওষুধ খাই না সন্ধ্যেবেলায়? বিলিতি ওষুধ। কাস্টমস থেকে যোগাড় করে আনতে হয়েছে?”
বঙ্কু এবার জোরেই হাসল।
রমেশ বললেন, “চলো, তা হলে বেড়ানোটা সেরে আসি। বঙ্কু, তুমি একটু বসো, আমি একবার ভেতর থেকে ঘুরে আসি। গিন্নিদের ফরমাসটা শুনে নেওয়াই ভাল। ও, একটা কথা তোমায় বলতে ভুলে গিয়েছি। জগোবাবুর গিন্নি সম্পর্কে আমার বড় শালী, মাসতুতো শালী।” বলে অন্দরমহলে চলে গেলেন।
জগবন্ধু অন্য পায়ের মোজাটা পরতে পরতে বললেন, “কোন ছেলেবেলায় তোমায় দেখেছি, বঙ্কু ; তারপর এতকাল পরে ; আফটার ফরটি, ফটি ফাইভ ইয়ার্স কি বলো? চেনা মুশকিল। রমেশ তোমায় চিনল কেমন করে?”
“এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল, অন্য দু একজন ছিলেন। কথায় কথায় ধানবাদের কথা উঠল, তাতেই চিনলেন।”
“বাহাদুরি আছে রমেশের।” মোজাটা পরে ফেললেন জগবন্ধু। “তা তোমার বাবা মা?”
“নেই।”
“সেই যে দিদি ছিল, কি নাম যেন…বয়েসে সব ভুলে যাই হে।”
“দিদিও নেই।”
জগবন্ধু সহানুভূতির শব্দ করলেন। “সবই হারিয়েছে?’
“তা বলতে পারেন,” বঙ্কু নিস্পৃহ গলায় বলল।
কেডস পায়ে গলিয়ে নিলেন জগবন্ধু। “সংসার টংসার করোনি? বউ ছেলেমেয়ে?”
বঙ্কু দাড়িতে হাত রেখে বলল, “করার চেষ্টা করেছিলাম। ছেলেমেয়ে হয়নি। বউ খসে গেছে।”
এমন সময় জগবন্ধুর স্ত্রী যামিনীকুসুম এলেন। বিকেলের গা-ধোওয়া কাপড় বদলানো গিন্নি গিন্নি চেহারা। এসেই একবার বঙ্কুকে দেখে নিয়ে মুখভরা হাসি খেলিয়ে বললেন, “ঠাকুরপোর মুখে সব শুনলুম, ভাই। আপনিও সম্পর্কে আমাদের দেওর। এ বাড়িতে যখন পা দিয়েছেন একটু চা খেয়ে যান।”
বঙ্কু নমস্কার করে বলল, “আমরা একই জায়গার লোক, বউদি। ছেলেবেলাটা একসঙ্গে কেটেছে। অনেককাল পরে দেখা হল। বড় ভাল লাগল। চা আজ থাক না, পরে একদিন হবে। জগুদারা এখন বেড়াতে যাবেন, কার্তিক মাস, বিকেল তো ফুরিয়ে গেল।”
“তা যান না ; আপনি দু দণ্ড বসেই যাবেন। আশা চা নিয়ে আসছে।”
জগবন্ধু জুতোর ফিতে বেঁধে ফেললেন। “চা-টা খেয়েই নাও, তারপর এক সঙ্গে বেরিয়ে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।”
বঙ্কু মাথা হেলাল।
যামিনী বললেন, “শুনলুম আপনি এখানে আশ্রম করেছেন?”
“আশ্রম ঠিক নয়” বঙ্কু বলল, “বলতে পারেন আশ্রমের মতন। মন্দির ঠাকুর দেবতা নেই। পুজো পাঠও হয় না।”
জগবন্ধু গিন্নির দিকে তাকিয়ে বললেন, “বঙ্কু স্পিরিচুয়ালিস্ট। আত্মা নিয়ে কাজকর্ম করে। বড় কঠিন সাধনা। থিয়োসফি বোঝ?”