জলধর খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন, বললেন, “ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর আছে। গিন্নির পায়ে একবার কামড়ে দিয়েছিল। ইনজেকশান দিতে হয়েছিল, অভিলাষীজি।”
“কাউয়া নেই?”
“কাউয়া কি কেউ পোষে। কাক আর ইঁদুর সব বাড়িতেই আছে।”
অভিলাষী একটু যেন হাসলেন, “ঠিক বলেছেন। এবার একটা কথা বুঝে নিন। মানুষমে তিন ইন্দ্রিয় জাদা জাদা কাম করে। চুহা হল কাম, কাউয়া হল ক্রোধ, আর বিললি হল লালচ।”
পশুপতি মুগ্ধ হয়ে বলল, “ব্রিলিয়ান্ট। অভিলাষী দারুণ বলেছেন। জলধরের তিন ইন্দ্রিয়ই তেজি…।”
জলধর ধমকে উঠতে যাচ্ছিলেন তার আগেই অভিলাষী বললেন, “জোর হলে আরও তিন জনম।”
“তিন জন্ম?”।
“আগাড়ি জনম আর চুহাগিরি করবেন না!”
জলধর চট করে একবার পশুপতির দিকে তাকিয়ে নিলেন। “এ-জন্মেই করলাম তো আগাড়ি জনম!”
অভিলাষী বললেন, “ঝুট বলছেন।”
“ঝুট! কোন শালা আমার নামে বলে—!”
নিরীহ মুখ করে পশুপতি বললেন, “কোনো শালাই বলবে না। জলধরের ও-সব ফালতু দোষ নেই অভিলাষীজি। লোকে যে বলে, জলধর মধু কবিরাজের বিধবা শালীর সঙ্গে…”
“অ্যাই, হচ্ছে কি?”
“কথাটা শেষ করতে দাও না,” পশুপতি বললেন, তারপর অভিলাষীর দিকে তাকালেন। “শুনুন অভিলাষীজি! মধু কবিরাজের বিধবা শালী এখানে বেড়াতে এসে ছ’ আট মাস ছিল। গানের লাইনের লোক তো, গজল গাইত। বেনারসি না এলাহাবাদি বিবি। আমাদের জলধর কবিরাজের বাড়ি গিয়ে গানের সঙ্গে ঠেকা দিত তবলায়। জলধর ভাল তবলচি!…আমি মিথ্যে বলছি না অভিলাষীজি, মিত্তির সাহেব সাক্ষী।”
অভিলাষী মুচকি হেসে বললেন, “জলধরজি বড়া কলাচার।”
জলধর ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “তবলার কথা থাক। আপনি বলুন তো, কে থাকছে কে যাচ্ছে! আমি আগে, না গিন্নি আগে?”
“ভগবান জানেন।”
“ভগবান জানেন তো আপনি কী জানেন?”
“আমি আঁখ বন্ধ করে এক তামাশা দেখছি, জলধরজি! দূরমে রামলীলা হচ্ছে। সীতাজি কাঁদছেন, হনুমানজি হায় হায় করছেন।”
জলধরের বুক কেঁপে উঠল। বলে কি অভিলাষী! তবে কি তাঁর দশাও সাধনের মতন হবে?
জলধর বললেন, “শুনুন অভিলাষীজি! আমি সাফসুফ বলে দিচ্ছি—আই অ্যাম নট সাধন! চিরটাকাল আমি সামনে সামনে এসেছি—গিন্নি আমার পেছন পেছন। ফাইন্যাল রাউন্ডেও অমি আগে যাব। বুঝলেন।”
সাধন বললেন, “যাওয়া কি তোমার হাতে?”
জলধর বললেন, “দেখা যাবে। এখন পাঁচ সাত বছর যাচ্ছি না। পরের কথা পরে।…তা মিত্তিরমশাই আমাদের তো রাত হয়ে যাচ্ছে, এখন শুরু করলে—!” বলে ইশারায় পানভোজনের কথা বুঝিয়ে দিলেন।
খেয়াল হল কদম্বর। বললেন, “তাই তো সাতটা বেজে গেল। ফকিরকে ডাকি।’
হাবুল বললেন, “আমরা যে বাদ পড়ে গেলাম, কদম্বদা।”
“হবে হবে, অভিলাষী তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আবার একদিন হবে। ওর শরীর ভাল যাচ্ছে না। একদিনে বেশি স্ট্রেন উচিত নয়।”
হাবুল অভিলাষীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। “ঠিক আছে, তাই হবে। আমাদের একটু মনে রাখবেন অভিলাষী দিদি।”
অভিলাষী মাথা হেলিয়ে হাসলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাচ্ছিলেন অভিলাষী, সামান্য দুলছেন। পায়ে খড়ম-জুতো। ঠুক টুক আওয়াজ উঠছিল। পশুপতির পাশ দিয়ে যাবার সময় অভিলাষী আড়চোখে কেমন করে যেন ইশারা করলেন। অন্য কেউ নজর করল না। পশুপতি হাত জোড় করে বলল, “আপনি ভগবতী। কাল পরশুই আবার আসব।”
পাঁচ
ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা।
হাবুল আর সাধন সামনে। পেছনের সিটে পশুপতি আর জলধর। জলধর যেভাবে গাড়ির মধ্যে গড়িয়ে রয়েছেন তাতে বোঝা যায় তিনি বাস্তবিকই এখন জলে পূর্ণ হয়ে রয়েছেন। তাঁর চোখ বোজা। মাঝে মাঝে নাক ডাকছিল।
পশুপতি হুঁশে আছেন—তবে এলিয়ে আছেন।
সাধন সামান্য মুখে দিয়েছেন তাতেই নেশা ধরে গিয়েছে। মাঝে মাঝেই তাঁর শোক উথলে উঠছে।
হাবুল যতটুকু নেশা করেছিল তাতেই আনাড়ির মতন গাড়ি চালাচ্ছিল। ভাগ্যিস মেঠো জমি আশেপাশে, নয়ত গাড়ি ডোবায় গিয়ে পড়ত।
সবাই চুপচাপ। হাবুল নিজেকে সজাগ রাখার জন্যে জোরে জোরে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছিল।
হঠাৎ হাবুল বলল, “জলধরদা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
কোনো সাড়া নেই।
পশুপতি আড়ষ্ট জিবে বললেন, “একেবারে কাদা। কাছা খুলে খেয়েছে। ওকেই আগে নামিয়ে দিও হাবুল। চ্যাংদোলা করে নামাতে হবে।”
হঠাৎ জলধর বসা গলায় বললেন, “আমি ঘুমোইনি।”
“ঘুমোওনি! নাক ডাকছ যে!”
“জেগে জেগেও নাক ডাকা যায়। আমি ভাবছিলাম।” জলধরের কথাগুলো অস্পষ্ট, জড়ানো।
“কী ভাবছিলে?”
“অভিলাষীকে ভাবছিলাম। মুখটা আমার বড় চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি।”
পশুপতি বললেন, “দেখেছ?”
জলধর কোনো জবাব দিলেন না।
আরও খানিকটা এগিয়ে আসার পর সাধন আবার যখন ফুপিয়ে কেঁদে উঠছেন হঠাৎ যেন জলধর কিছু আবিষ্কার করলেন। বললেন, “পশুপতি, এই অভিলাষী আর মধু কবিরাজের সেই বিধবা শালীটা এক নয়? সে বেটি হাওয়া হয়ে গেল—হঠাৎ। কদম্ব তখন এখানে এসেছিল। কদম্ব যাবার হপ্তা খানেক পরে ও-বেটি পালাল। তাই না?”
পশুপতি বললেন, “তুমি কোন বিধবার কথা বলছ? যার গানের সঙ্গে তবলায় ঠেকা দিতে যেতে। বাঁজা বিধবা।”
সিটের গর্ত থেকে উঠতে উঠতে জলধর বললেন, “মেয়েছেলে কেমন ভোল পালটেছে দেখেছ! ছিল কলসী, হয়ে গেল অভিলাষী। চেনাই যায় না। তাই বলি অভিলাষী এত হাঁড়ির কথা বার করছে কেমন করে? কদম্ব মিত্তির এমন পাকা ধড়িবাজ তা জানতাম না। যাক ভালই করেছে। বুড়ো বয়েসে একটা অবলম্বন তো দরকার। কি বলো?”