জলধর বললেন, “কী সাইজের ইঁদুর? ধেড়ে না লেঙটি?”
“তা মনে নেই। বড় ছোট সব ছিল।”
“তুমি কি ধাতে ছিলে, হাবুল? ভাঙা, গাঁজা খাওনি তো?”
হাবুল প্রবলভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।
হাবুলের মাথা নাড়া দেখে পশুপতিরা হেসে উঠলেন।
এমন সময় বাইরে দমকা বাতাস উঠল। ঝড়ের মতন। কোনো ঘরের দরজা জানলা আছড়ে পড়ে বন্ধ হল, গাছপালায় শব্দ উঠল, একটা হুলো বেড়াল বাইরে কোথাও গজরাতে লাগল। সামান্য পরে সব শান্ত। দমকা বাতাস যেটুকু পড়ে থাকল তা কানে পড়ার মতন নয়।
সাধন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই অভিলাষী ইশারায় কদম্বকে কিছু বোঝাতে চাইলেন।
কদম্ব ঠিক বুঝতে পারলেন না। উঠে কাছে গেলেন অভিলাষীর। কিছু বললেন অভিলাষী, জড়ানো গলায়, ইঙ্গিতে। কদম্ব ফিরে এলেন নিজের জায়গায়।
“সাধনবাবু, আপনি একটু কাছে গিয়ে বসুন। কিছু বলার আছে ওর।”
সাধন বিগলিত বোধ করলেন। এত লোক থাকতে তাঁরই ডাক আগে পড়েছে। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে অভিলাষীর কাছাকাছি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
অভিলাষী চোখ বন্ধ করে মৃদু মৃদু দুলছিলেন। সামান্য পরে চোখ খুলে তাকিয়ে সাধনকে দেখলেন। বললেন, “দুনিয়া বড় ফাঁকা লাগে, দাদাজি?”
সাধন চমকে উঠলেন। অভিলাষীর গলার স্বর সামান্য ভাঙা ভাঙা, মোটা, জড়ানো। তা হলেও কী নরম ভঙ্গি। হাঁ করে অভিলাষীকে দেখতে লাগলেন। দু-গাল টকটক করছে। ফিকে গন্ধ চারপাশে।
সাধন বললেন, “তা লাগে! একা থাকি সংসারে। স্ত্রী আজ চার বছর নেই।”
“বিজলীবালা?”
সাধন চমকে উঠলেন। গা কেঁপে গেল। চক্ষু আর পড়ে না। হ্যাঁ। আপনি জানলেন কেমন করে?”
অভিলাষীর সেই আঙুরদানার মতন টসটসে হাসি ঠোঁটে। চোখের পাতা আরও একটু বড় করে বললেন, “রাখী পূর্ণিমায় ছেড়ে গিয়েছিলেন!”
সাধনের বুক গুমরে উঠল। অভিলাষী একেবারে ঠিক বলেছেন। রাখী পূর্ণিমাতেই বিজলী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। চার বছর হয়ে গেল। কিন্তু অভিলাষী এত কথা বলছেন কেমন করে! আশ্চর্য!
সাধনের বুক টনটন করে উঠছিল। বিজলী বেঁচে থাকতে দামি শালের মতন যত্ন করে রেখেছিল তাঁকে। দুবারের বেশি তিনবার হাঁচলে—নাকের ওষুধ, পায়ের মোজা বার করে দিত। এখন আর কে কার!
অভিলাষী বললেন, “দুঃখ করবেন না। উনি ভাল আছেন।”
সাধন বললেন, “দুঃখ করব না। আমার তিরিশ বত্তিরিশ বছরের বউ! আপনি বলছেন কেমন করে অভিলাষী! সুখদুঃখের জীবন ভেঙে দিয়ে চলে গেল। কোথায় রেখে গেল আমাকে!”
“কেউ যায় কেউ থাকে দাদাজি!…আপনি দুখ করবেন না। উধার তো ওঁর পুনরজনম হয়ে গেল!”
“পুনরজনম। ফির জনম নিয়েছেন। এখন তো ওঁর পুরা এগারা মাস বয়েস। পুরা এগারা। তিন বছর আত্মা হয়ে ঘুমেছেন ফিরেছেন। আবার জনম নিয়েছেন।
জলধর বললেন, “এগারো মাসের বাচ্চা! আরে রামো, সে তো তা হলে কাঁথায় শুয়ে আছে পেনি পরে। দুধ তুলছে। হাতে চুষিকাঠি। সাধন, ভাবতে পারছ ব্যাপারটা! ছ্যা-হ্যা!”
সাধন চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা অনুমান করার চেষ্টা করছিলেন। সেই বিজলী, যার তিন গজ কাপড় লাগত সেমিজ করতে সে এখন ইয়ে হয়ে পেনিফ্রক পরে কাঁথায় শুয়ে আছে!
সাধনের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। পুনর্জন্ম তো ডেনজারাস জিনিস। সাধন যদি সামনের দু-এক বছরের মধ্যে মারা যান—এবং চট করে জন্মান আবার, তবুও বিজলী বয়েসে বড় থেকে যাবে। তার মানে আর কোনোদিন বউ হবে না, হবে দিদি। যা কচু, এ-জন্মের বউ আসছে জন্মে…।
অভিলাষী বললেন, “আপনি কিছু ভাববেন না দাদাজি! বাচ্চি ভাল আছে, সুখে আছে।”
সাধন আর কী বলবেন? বুক ভেঙে মস্ত এক দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। এরকম তো কথা ছিল না। বিজলী বলত, কর্তা তোমার আমার বন্ধন জন্ম জন্মান্তরের, পালাবে কোথায়, যেখানেই যাও কাছা ধরে টেনে আনব।’ কই কথা তো খাটল না। এবার তুমি কী করবে বিজু! তুমি আর আমায় ধরতে পারবে না।
চোখ ছলছল করে উঠল সাধনের। একেই বলে কপাল! আমি থাকলাম এখানে পড়ে, তোমার ঘরবাড়ি আগলে, তোমার মেয়ে জামাই নাতিনাতনীর কেয়ার টেকারের মতন হয়ে, আর তুমি স্বার্থপরের মতন পালিয়ে গিয়ে আবার একদফা জন্ম নিয়ে কাঁথায় শুয়ে পা ছুঁড়ছ। নিকুচি করেছে জন্মান্তরের!
সাধন চোখের জল মুছতে রুমাল হাতড়াচ্ছিলেন।
এমন সময় অভিলাষীর গলা শোনা গেল। এবার একটু জোরালো হয়েছে।
“পায়ে ছ’টা আঙলি কার আছে?” অভিলাষী বললেন।
জলধর থ’ মেরে গেলেন। নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। ধুতিতে ঢাকা। বললেন, “আমার।”
“ডান পায়ে?”
“হ্যাঁ।”
“পিঠে ঘা আছে? কারুয়া ঘা।”
“কার্বাঙ্কোল হয়েছিল। গত বছর।”
“রাতমে ঘুম হয়?”
“তোফা। এক আধদিন পেটে গ্যাস হলে ঘুম গড়বড় করে।”
“চিন্তাউন্তা নেই?”
“কিসের চিন্তা! আমার হল আপনি আর কোপনি। তা অভিলাষীজি, সাধনের পরিবারের কথা হল—এবার আমার ইয়ের কোন দশা হবে বলুন তো?” জলধর যেন ঠাট্টার মতন করে বললেন, যদিও তাঁর কোথায় সামান্য খটকা লাগছিল। জলধরের ডান পায়ে কড়ে আঙুল দুটো, আর পিঠে এক কার্বাঙ্কল হয়ে গত বছর গরমের সময় বেজায় ভুগেছিল। অভিলাষী এসব কথা জানল কেমন করে?
অভিলাষী চোখ বুজে বসে থাকতে থাকতে একবার নাকের বাঁ দিক টিপলেন, তারপর ডান দিক। দেওয়ালের ছবির আড়াল থেকে টিকটিকি ডেকে উঠল।
অভিলাষী বললেন, “চুহা, কাউয়া, বিললি—তিন জানোয়ার তু পাললি। চুহা তো আপনি জানেন জলধরজি, ইঁদুর। কাউয়া—কাক। ইঁদুর কাক আর বিললি তিন জানোয়ার সব ঘরমে থাকে আগর না থাকে তো আগ লাগে। আপনার ঘরে চুহা নেই?”