নলিন বলল, “সরসীও যা শত্রু পরে পরের তালে ছিল—”
দুই বোন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কেমন সব মানুষ দেখছ? দুম্ করে সব বলে দিল। লজ্জায় মরে আর কি দু-বোনে!
ছি ছি। মাথা কাটা যাচ্ছে যেন। চটে গিয়ে মানসী বলল, “বা, এখন আমরা⋯। তুমি যে তখন বললে, ভয়ের ব্যাপার আছে…”
সরসীও নলিনকে আক্রমণ করল, “তুমি না বলেছিলে, এটা আছে ওটা আছে…দাঁত তুলতে গেলে অঘটন ঘটতে পারে…”
নলিন পুলিনের দিকে তাকাল, পুলিন চোখ টিপল। দুজনে চোরা হাসি হাসল। তারপর নলিন বলল, “ও আমরা বলেই থাকি। মানে, ইচ্ছে করেই বলেছি।”
“কেন, কেন?” দুই বোন দুই স্বামীর হাত ধরে টান মারল।
পুলিন নিশ্চিন্ত গলায় বলল, “না, মানে—এ রকম কিছু না বললে তোমার বাবা আর তোমাদের উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যেত না। বাব্বা, যা দৌরাত্ম্য!”
মানসী পুলিনের গায়ে জোর একটা ঠেলা মারল। “অসভ্য কোথাকার।”
নলিন বলল, “তোমাদের বাবা হতে পারে কিন্তু আমাদের কাছে যে ওই বাবাটিই বাঘ।”
সরসী নলিনের পিঠে এক কিল বসিয়ে দিল।
পুলিন ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠতে উঠতে শিস দিচ্ছিল, নলিন হাসছিল।
দুই বোনে পাশাপাশি ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠছিল। মানসী বলল, “দেখ, বাবা তো সব সময় চোখে গগলস দিয়ে থাকত, না হয় ডান চোখটা রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখত। আমার মনে হয়, অনেক আগেই চোখ সেরে গিয়েছিল, দেখতে তো দেয়নি আমাদের, নিজেও দেখত না ভয়ে।”
সরসী মাথা নাড়ল; হয়তো তাই। বলল, “দাঁতের ব্যথাও ছিল না বুঝলি। আতঙ্কে ওই রকম করত। গালে ব্যথা হলে অত চেঁচামেচি কি মানুষ করতে পারে। শক্ত টোস্টই বা খেত কি করে।”
মানসী মাথা নাড়ল। ঠিক। তারপর দুবোনেই সিঁড়ি উঠতে উঠতে খিলখিল করে হেসে উঠল।
চুম্বক চিকিৎসা
মুদির দোকানে যেভাবে ফর্দ মেলায় সুবোধ ডাক্তার সেইভাবে হাতের কাগজগুলো মিলিয়ে নিয়ে গুরুপদ সান্যালকে বললেন, “বাঁচতে চাও, না, মরতে চাও?”
গুরুপদ ভিতু মানুষ। ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “কেন? কী হয়েছে?”
সুবোধ ডাক্তার বললেন, “মানুষের পাঁচটা ইন্দ্রিয়। তোমার পাঁচটাই বরবাদ হতে চলেছে। হবে না? টাকা ছাড়া কিছু চিনলে না। হরিনামের মালার মতন শুধু টাকা টাকা জপ করে গেলে। এবার বোঝো!”
এমনিতেই গুরুপদর ঘাম-ধাত; গলগলিয়ে ঘামেন সারাক্ষণ, তারপর ফাল্গুন মাস পড়তে না পড়তেই গরম শুরু করেছে এবার। গুরুপদ ঘামতে লাগলেন। গলা শুকিয়ে গেল। বললেন, “কী হয়েছে সেটা বলবে তো?”
সুবোধ বললেন, “কী হয়নি। ব্লাড প্রেশার হাই, ব্লাড সুগার অ্যাবনরমালি বেশি, যে কোনোদিন মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে পারো। ব্লাড কোলেস্টরাল যাচ্ছেতাই, তার ওপর হার্ট, ওদিকে তোমার পুরনো পাইলস। কোনটা দেখব। যেদিকে দেখছি চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে। এত্ত সব বাধিয়ে বসেছ যে তোমার কোন চিকিৎসা আমি করব বুঝতে পারছি না।”
গুরুপদর মাথা ঘুরতে লাগল। চোখের সামনে মশার মতন পোকা উড়তে লাগল নেচে নেচে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনো রকমে বললেন, “আমি আর বাঁচব না?”
“বাঁচার পথ কি খোলা রেখেছ যে বাঁচবে!”
গুরুপদ শুকনো গলায় বললেন, “তুমি ভাই আমাকে আর ভয় দেখিয়ো না। এমনিতেই আমি মরছি। বন্ধু লোক তুমি, ডাক্তার মানুষ। তুমি কিছু করো।”
সুবোধ বললেন, “আমি যন্ত্র। যন্ত্রী তো তিনি—” বলে ডাক্তার ছাদের দিকে আঙুল দেখালেন। “ওপরঅলাই হিসেবের খাতা ঠিক করে রেখেছেন। তাঁর হিসেবে যা আছে তাই হবে।—যাক গে, কাগজগুলো রেখে যাও। কাল পরশু একটি বার এসো। দেখি কী করা যায়। একটু ভেবে নিই।”
গুরুপদর তর সইছিল না। বললেন, “দেরি করে কী লাভ?”
সুবোধ ধমক মেরে বললেন, “বাহান্নটা বছর দেরি করলে আর এখন দু রাত্তির তোমার কাছে বেশি হল। যাও, মিথ্যে বকিয়ো না। বাড়ি যাও। লেট মি থিংক। পরশু সন্ধেবেলায় চলে এসো।”
“তুমিও তো বাড়িতে আসতে পারো! গিন্নি বড় চিন্তায় থাকবে। তুমি গিয়ে বুঝিয়ে বললে ভাল হয়—!”
সুবোধ ডাক্তার রাজি হয়ে গেলেন। পরশু মানে রবিবার।
রবিবার সন্ধেবেলায় সুবোধ ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ থাকে।
গুরুপদ উঠতে যাচ্ছিলেন, সুবোধ হঠাৎ বললেন, “তোমার গিন্নির চেক আপটাও করিয়ে নিলে পারতে, গুরুপদ! এক যাত্রায় পৃথক ফল হয়ে লাভ কিসের?”
“কথাটা মন্দ বলোনি হে! গিন্নিরও শরীর ভাল যায় না। তা তুমি যখন বাড়িতে যাবে, বুঝিয়ে বোলো একবার। আজ আসি ভাই।”
“এসো।”
চেম্বারের বাইরে এসে গুরুপদ দেখলেন, তাঁর গাড়ি রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি একটা সিনেমা হাউস, পাড়াটাও বাজারপাড়া। ফলে রিকশা, অটো, মিনিবাস, বাসে রাস্তার যা অবস্থা তাতে এপার থেকে ওপারে যেতে হলে গাড়ি চাপা পড়ার ষোলো আনা আশঙ্কা।
এই ভরসন্ধেতে গাড়িচাপা পড়ে মরতে রাজি নন তিনি। হাত নেড়ে চেঁচিয়ে ড্রাইভারকে ডাকতে গিয়ে দেখলেন, ভিড়ভাড়াক্কা হইহল্লার মধ্যে তাঁর গলা দশ পনেরো হাত দূরেও পৌঁছচ্ছে না। গাড়িও বার বার আড়াল পড়ে যাচ্ছে।
গুরুপদ রাস্তার একটি ছেলেকে বললেন, “বাবা, ওই যে নীল গাড়িটা, ওর ড্রাইভারকে একটু বলবে, গাড়ি ঘুরিয়ে এদিকে আনতে।”
ছোকরা গুরুপদকে দেখল। তারপর বলল, “দাদু, এই রাস্তায় এখন গাড়ি ঘুরবে না। জাম্প লেগে যাবে। দশটা টাকা ছাড়ন—দুজনকে ডেকে আনি, আপনাকে ঠেলে দেব। ভিড়ে যাবেন।”