প্রভাময়ী ছেলেদের ওপর ভরসা রাখেননি। পাড়ার প্রবীণা যারা আসত তাদের কাছে বলতেন সব। তারা নানারকম টোটকার খবর দিত। অমুকের পাতার রস, তমুকের মাজন, অমুক ঠাকুরের পায়ে ছোঁয়ানো হলুদ ভেজানো কাপড়, তমুক ফল বেটে পুড়িয়ে গরম জলে মিশিয়ে কুলকুচো⋯ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রভাময়ী সেই টোটকা যা যা সংগ্রহ করতে পারছিলেন করুণাকেতনকে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করাচ্ছিলেন। করুণাকেতনও করছিলেন।
বিজুকে টেলিগ্রাম করা হল মুঙ্গেরে। করুণাকেতনের চোখে সর্বদা গগলস। সারাটা দিন ছটফট করতে করতে আর চেঁচামেচি করে করে শরীর কাহিল হয়েছে, গলা বসে গেছে। ঘরের দরজা জানলা বন্ধ থাকায় আলো বাতাস আসতে পায় না; বাতাসে বন্ধ গন্ধ ধরে গেছে।
ছয়
অবশেষে একদিন কেমন করে কী যেন হয়ে গেল। করুণাকেতন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চোখে গগলস এঁটে কলঘরে মুখ ধুতে গেলেন। মুখে জল দিতে গিয়ে দেখলেন মুখে স্বাদ লাগছে, কুলকুচো করতে কোনো কষ্ট হল না, মাড়ি বা দাঁতের গোড়ায় ব্যথাও নেই, গাল গলা টিপলেন নিজে নিজেই—ব্যথা লাগল না। এতদিন ভয়ে গগলস জোড়া খুলতেনই না, মুখে চোখে জল দিতে হলে ডান চোখটা বন্ধ করে রাখতেন। সাহস করে আজ গগলস খুলে ভয়ে ভয়ে ডান চোখের পাতা খুলে আয়নায় চোখ দেখলেন। বিশ্বাস হল না, আবার দেখলেন ভাল করে, সর্বাঙ্গে বুঝি আনন্দের তড়িৎ খেলে গেল।
ঘরে এসে মেয়েদের ডাকাডাকি শুরু হল। মানসী ছুটে এল, সরসী এল। প্রভাময়ীও এলেন সামান্য পরে। ঘরের দরজা জানলা করুণাকেতন নিজের হাতেই মহানন্দে খুলে দিচ্ছিলেন। বিকট শব্দ হচ্ছিল। এ ক’দিন ঘরে আলো বাতাস ঢোকেনি। সকালের আলো রোদ ও বাতাসে বাসি ঘর যেন ধোয়ামোছা হতে লাগল।
করুণাকেতন মানসীকে বললেন, “দেখ…চোখটা দেখ একবার…”
মানসী দেখল। চোখের কোথাও লালের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বলল, “লাল নেই কোথাও, পরিষ্কার একেবারে সাদা।”
সরসীকে দিয়েও চোখটা দেখালেন একবার। সরসী দেখল। বলল, “কিছু নেই কোথাও। সেরে গেছে।”
করুণাকেতন এবার দাঁত দেখলেন। না তাঁর সেই মাড়ির গোড়া আর ফুলে নেই, সাদাটে দাগ ধরে নেই ব্যথার জায়গাটাতে।
করুণাকেতন ঘরের মধ্যে নাচতে লাগলেন যেন। প্রভাময়ী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসলেন।
পুলিন নলিন এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে আসেনি, চেম্বারে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। তারাও এল।
করুণাকেতন পুলিনের দিকে তাকিয়ে অতিশয় গম্ভীর হয়ে গেলেন, এবং নলিনকে হাতের ইশারায় কাছে আসতে বারণ করলেন।
প্রভাময়ী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা দিয়ে করুণাকেতন কোনো রকম তোয়াক্কা না করে বললেন, “ছেলেদের বলুন, ডিসপেনসারি তুলে দিয়ে আপনার কাছে টোটকা শিখুক। ⋯ওয়ার্থলেস⋯ওই দুটোই সমান। কিচ্ছু জানে না⋯। হাতুড়ে⋯।”
পুলিন নলিন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। মানসী সরসীকে দেখল একবার আড়চোখে। বউরা কেউই লজ্জিত নয়, মুখে চোখে রাগের ভাবও দেখা যাচ্ছে না।
পুলিন কোনোরকমে বলল, “আপনি টোটকা করছিলেন?”
করুণাকেতন প্রায় ভেঙিয়ে উঠে জবাব দিলেন, “না করব না, তোমাদের জন্যে, বসে থাকব, কবে আমায় অন্ধ কর,—না?”
নলিন বলল, “আমাদের বলা উচিত ছিল…”
মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে করুণাকেতন জবাবে বললেন, “কেন? আপনারা কে? আপনাদের কেরামতি কত তা আমার জানা আছে…যত সব পেন্টুল ডাক্তার।”
পুলিন নলিন মুখ লাল করে বেরিয়ে গেল।
একটা দিন অপেক্ষা করে করুণাকেতন গয়ার গাড়িতে উঠলেন। যথারীতি সাজ-পোশাক ও মালপত্র সমেত। মেয়ে জামাইরা স্টেশনে তুলে দিতে এসেছিল।
গাড়ি ছাড়ার আগে করুণাকেতন জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জামাইদের বললেন, “কিছু মনে কোরো না; বুড়ো মানুষ, দু-চারটে কটু কথা বলেছি। —দেখো হে, আমি দেখলাম তোমাদের একটু টোটকাও শিখে রাখা দরকার। দেশি জিনিসটা ফেলনা নয়। বিলেতিটা বাইরে দেখাবে, দেশিটা আণ্ডারহ্যাণ্ড।”
দুই জামাই একই সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে—”
তারপর করুণাকেতন মানসীকে বললেন, “তোদের শাশুড়িকে বলবি নাতিকে যেন কানের ডাক্তার করে। ওটাই যা বাকি।”
মানসী ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে সরসীর দিকে তাকাল।
গাড়ি ছেড়ে দিল, এবং দেখতে দেখতে করুণাকেতনের মুখ অদৃশ্য হয়ে গেল।
পুলিন নলিন হাঁপ ছাড়ল। নলিন বলল, “বাপ্স⋯”, পুলিন বলল, “উন্মাদ একেবারে!”
মানসী হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তোমাদের ক্ষমতায় কুলোলো না, এখন তো আমাদের বাবাকে উন্মাদ বলবেই—”
সরসী বলল, “লজ্জা করা উচিত।”
পুলিন প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, “সারাবার কী ছিল, এ সিমপ্ল কেস অফ কন্জাংটিভাইটিস⋯। নিজের থেকেই সেরে যেত…। বরং দাঁতটা⋯”
নলিন বাধা দিল, বলল, “দাঁতে তেমন কিছু হয়নি, ইন ফ্যাক্ট গামবয়েল হয়ে কোথাও সেপটিক অ্যাবজরপ্শান হচ্ছিল। একটু চিরে দিলেই চলত—এমনিতেও কুলকুচো করলে পেন্ট লাগালেও অনেক সময় সেরে যায়।”
মানসী সরসী হাঁটতে লাগল। পুলিন নলিনও।
মানসী বলল, “এখন তো দুজনেই গলা বড় করে বলছ, কিছুই না, এটা সিমপ্ল সেটা সিমপ্ল, তখন এত বিদ্যে কোথায় ছিল?”
পুলিন নলিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসল। তারপর মানসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার দোষ কি, তুমিই তো বাগড়া দিচ্ছিলে। ভাবছিলে তোমার বুড়ো বাবাকে মেরে আমি কেন দোষের ভাগী হই। মরে মরুক নলিনের হাতে…”