সরসী আর কথা বলল না, ঘর ছেড়ে চলে গেল।
মানসীও চলে যেত, তবু গেল না, সে বড়। বলল, “বিজুকে তার করতে হবে না। মা কি ভাববেন! আমি দেখছি—”
“তুমি আমার কোনটা দেখবে! বিয়ে করে পর হয়ে গেছ। বাপ মরছে মরুক, তোমরা তোমাদের বরের আত্মসম্মান দেখছ।”
মানসীর গলা ক্ষোভে বন্ধ হয়ে গেল।
দুপুরে পুলিন নলিন বাড়ি ফিরতেই দুই বোন ঝাঁপিয়ে পড়ল। করছ কী তোমরা? কিছু না করে চারটে দিন বুড়ো মানুষটাকে অযথা যন্ত্রণা দিচ্ছ! মনে রেখো, আমাদের বাবা। তোমরা কেমন ওর জামাই? কী শিখে এসেছ বিলেতে? রোগ যদি সামান্যই হয়—তবে সারছে না কেন? ঘুম নেই, খাওয়া নেই, বুড়ো মানুষ চার দিনে কতটা কাহিল হয়েছে দেখতে পাচ্ছ না! ডাক্তার না হাতি!
পুলিন বলল, “ঠিক আছে, আজ বিকেলে আমাদের শঙ্করমামাকে ডাকি, একবার দেখে যান। ⋯ওঁর ওপিনিয়ান নেওয়া হোক।”
শঙ্করবাবু প্রবীণ লোক, এ শহরের সেরা ডাক্তার। এলেন, দেখলেন যত্ন করে। বললেন, তেমন কোনো গণ্ডগোল তো দেখতে পাচ্ছি না। প্রেশারটা বেশ হাই। ব্লাড টেস্ট করতে পারি, তবে দরকার কি! চোখ দাঁতের ব্যাপারে তোমরাই তো আছ, আমি আর কি করব। প্রেশারের জন্যে একটা ট্যাবলেট দাও।
রাত্রে পুলিন নলিনকে বলল “কমপ্লেনটা দাঁতের হতে পারে, চোখে সেপটিক ফোকাস পড়েছে। তুই দাঁতের ট্রিটমেন্ট কর।”
নলিন বলল, “দাঁতে যা করার আমি করছি, তুমি চোখ সামলাও, হেমারেজ চোখে হয়েছে, দাঁতে নয়।”
“আহা, কিন্তু সেটা তো দাঁতের জন্যে হতে পারে—”
“পারে তো অনেক কিছুই—”
“তুই একটা আস্ত ইডিয়েট। কিচ্ছু জানিস না, কোনো কিছু শিখিসনি, পড়িসনি।”
“তুমি আমার সাবজেক্টে কথা বলতে এসো না; আই নো বেটার দেন ইউ। তুমি চোখ সামলাও, আমি দাঁত সামলাব। দাঁতে মস্ত একটা কিচ্ছু হয়নি।”
“ননসেন্স—। রেসপনসিবিলিটি বলে কিছু নেই তোর।”
“বোগাস—। তোর এবিলিটি তো দেখতেই পাচ্ছি।”
শোবার ঘরে মানসী বলল, “করছ কি তোমরা⋯, বাবার স্বভাব তো জানো না। এখন ঘরে বসে গালাগাল দিচ্ছে, এরপর সকলের সামনে যাচ্ছেতাই করবে। মার কানে যদি যায়, কেলেংকারি।”
পুলিন চিন্তিত মুখ করে বলল, “ব্যাপার কি জানো। চোখের ব্যাপারে একটা মাইনর কিছু করতে পারি। কিন্তু ওই রকম হাই ব্লাডপ্রেশার, সাহস হয় না। বুড়ো মানুষ, তায় শ্বশুর, তার ওপর রিস্ক। যদি কিছু একটা হয়⋯আপদ বিপদ⋯।”
মানসী আঁতকে উঠল। সর্বনাশ! হিত করতে বিপরীত কিছু একটা হয়ে যাক, তারপর লোকে বলবে বড় জামাই শ্বশুরকে মারল। মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। ছিছি করবে সকলে। তা ছাড়া বরাবরের মতন একটা দাগ থেকে যাবে, বদনাম অপযশ, খুঁত। স্বামীর ডাক্তারিতেও নিন্দে রটবে। যে ডাক্তার নিজের শ্বশুর মারে তার কাছে কোন রোগী আসবে গো!”
মানসী পুলিনকে আঁকড়ে ধরল, বলল, “সর্বনাশ! না—না, ওসব তোমার করতে হবে না। খুনের দায়ে পড়বে নাকি!⋯দরকার নেই আগ বাড়িয়ে বিপদ ডেকে। ⋯যা করার অন্যে করুক।”
“নলিন দাঁতটা তুলে দিলেই আমার মনে হচ্ছে সব সেরে যাবে—”
“তবে কি! ঠাকুরপোই যা করার করুক, তোমার দালালি করতে হবে না। ওই নমো-নমো করে থাকো, লোশান-টোশান পর্যন্ত দাও তার বেশি নয়।”
সরসী নলিনের মধ্যেও কথাটা খোলাখুলি হয়ে গেল।
নলিন বলল, “একটা দাঁত তো ডেনজারাস হয়ে রয়েছে। তুলে দিতে পারি, তুলতে অসুবিধে নেই। কিন্তু যেরকম হাই ব্লাডপ্রেশার। তুলতে গিয়ে কোনো রকম বেকায়দা কিছু হয়ে যাক, ক্লট ফ্লট হয়ে যাক একটা, তারপর দম করে তোমার বাবা স্বর্গলাভ করুন। বাপস, ওই রকম রুগির চিকিৎসা!”
সরসী শিহরিত হল! বলে কি? এত কাণ্ড ভেতরে। না বাবা, দাঁত তুলে দরকার নেই। বলা কি যায় বিপদের কথা! এক করতে আরেক হবে। তখন লোকে বলবে, ছোট জামাই শ্বশুরকে মারল। বরাবরের বদনাম, মা ভাইয়ের কাছে মুখ দেখানো যাবে কোনোকালে। কেন বাবা, দরকার কিসের আমার পা বাড়িয়ে গর্তে পড়ে। এসব জিনিস থেকে সরে থাকা ভাল। সংসার বড় মুখ বাঁকা, একবার বেঁকলে সারাজীবন তার মুখ সোজা হয় না।
সরসী স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরল, বলল, “আমার মাথার দিব্যি, তুমি ওকাজ করতে যেও না। মানুষ মারার দায়ে পড়বে, তাও আবার শ্বশুর। বদনাম, নিন্দে। মাগো, ভাবতেও পারি না। রুগিও জুটবে না আর কপালে। কাজ কি তোমার ফাঁসির দড়িতে হাত দিয়ে। আপনারটা সামলে থাকো…”
নলিন বলল, “আমি কি অত বোকা! পুলিন যা করার করুক, চোখ নিয়েই তো গণ্ডগোল শুরু! দাঁতের কথা কার বা খেয়াল হবে।”
সরসী বলল, “সেই ভাল। দাদা যা পাপ করবে…। তুমি গা-আলগা দিয়ে থাকো।”
অতঃপর কয়েকটা দিন মানসী পুলিনকে ও সরসী নলিনকে আগলে আগলে রাখল। কারোরই ইচ্ছে নয়, তার স্বামী এমন একটা মারাত্মক কাজে হাত দেয়। ওদের ভয় ছিল বাবা যেরকম বেপরোয়া হয়ে হইচই, চেঁচামেচি, গালমন্দ শুরু করেছেন তাতে স্বামীরা না অসহ্য হয়ে সত্যি সত্যি একটা কিছু করতে বসে। মানসী পুলিনকে আড়ালে বার বার বলত, ‘খবরদার’; সরসী নলিনকে বলত; ‘মাথা গরম করে দাঁত তুলতে যেও না।’…
দুই বোন কেউ কাউকে বুঝতে দিত না, আড়ালে তারা স্বামীদের কেমন করে সামলাচ্ছে। বরং বিরক্তিই দেখাত সামনা-সামনি। কী যে সব ডাক্তার ছাই বুঝি না। হপ্তা কেটে গেল, কোনো কিছু করতে পারলেন না। ⋯এর চেয়ে বাবার মুঙ্গেরে ফিরে যাওয়াই ভাল ছিল। বিজুকে সত্যিই একটা টেলিগ্রাম করে দি, কি বলিস!