করুণাকেতন যে বস্তুত তাঁর হোন্ডঅলের মতন নির্জীব নিরীহ নির্বাক পদার্থ নন, অবিলম্বে তা প্রকাশ পেল। মেয়ে-জামাইরা প্রণাম সারতেই তিনি দণ্ডায়মান কুলিদের দিকে তাকিয়ে তাঁর ভাঙা খসখসে গলায় চিৎকার করে ধমকে উঠলেন, “খাড়া হো কর কিয়া করতা হ্যায়, পাঁটঠা কাঁহাকার…”
তাঁর হুঙ্কার এবং মুখভঙ্গি দেখে পাঁঠারা ঘাবড়ে গিয়ে হোন্ডঅলটা টানা-হেঁচড়া করতে লাগল।
মানসী শুধল, “মা কেমন আছে?”
“যেমন থাকে,⋯” করুণাকেতন কুলিদের দেখছিলেন, “বেতো ঘোড়া।” বেতো ঘোড়া কে? মা না কুলিরা।
সরসী বলল, “বিজুর কলেজ খুলেছে?”
“দরজা খুলেছে।” মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে কুলি তাড়ানোতেই তাঁর মনোযোগ।
পুলিন বলল, “আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসছি—আপনারা এখোন।”
“আরে না না, এ তোমার বিলেত নয়; এখানকার কুলিরা লেজি, ফাঁকিবাজ, ডাকাত…। তুমি এদের সঙ্গে পারবে না।”
করুণাকেতনের বিলেত-প্রীতি না থাক, জামাইরা বিলেত-ফেরত এই অহংকার আছে। মেয়েদের বিয়েতে পাত্র অপেক্ষা পাত্রদের বিলেত-ফেরতের কথাটাই তাঁর মন টেনেছিল। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
নলিন আড়চোখে শ্বশুরমশাইকে দেখে নিয়ে বলল, “বিলেতের কুলিরা সাহেব কুলি, এরা তো এদেশি, বেহারি-টেহারি…”
“ধড়িবাজ।” করুণাকেতন বললেন। কাকে বললেন, জামাইকে না কুলিদের বোঝা মুশকিল।
মেয়েরা তাদের বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে টেনে নিয়ে চলল, পুলিন-নলিন কুলিদের দিয়ে মালপত্র গোছাতে লাগল।
নলিন বলল, “তোকে আসবার সময় বললাম, চাকায় পাম্প দিয়ে নে; নিলি না এবার…?”
“ধরবে তো সব?”
“আমি গাড়িতে যাচ্ছি না। ⋯তোরা চলে যা, আমি হেঁটে চেম্বারে চলে যাব।”
“না না, সেটা বিশ্রী দেখাবে।”
“দেখাক গে, গাড়ির চাকা খুলে মাটিতে বসে রগড়ানোর চেয়ে সেটা ভাল।”
“চল চল—যাবার সময় চাকায় পাম্প দিয়ে নেব।”
“তোমরা যাও। আমি ওর মধ্যে থাকছি না।”
“শ্বশুর কি আমার একলার? তোমারও শ্বশুর। মাইণ্ড দ্যাট—”
নলিন যুক্তিটা অস্বীকার করতে পারল না, চুপ করে গেল। পরে প্লাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “বিয়েতে আমরা এ-রকম একটা ফাউ পাব জানলে বিয়েই করতাম না।”
করুণাকেতনের অভ্যর্থনায় কোনো ত্রুটি হল না। নীচের তলায় তাঁকে মস্ত ঘর দেওয়া হয়েছিল। খাট-বিছানার অভাব থাকার কথা নয়, ঘরের মধ্যেও সারাদিন রোদ, জানলার বাইরে বাগান, ঘরের সঙ্গে লাগানো কলঘর। করুণাকেতন প্রীত হলেন। প্রভাময়ী নিজেই বেয়াইয়ের সুখ-সুবিধা স্বাচ্ছন্দ্য দেখছিলেন, তাঁর কথা মতনই সব ব্যবস্থা হয়েছে। দোতলায় ওঠানামা করতে বুড়ো মানুষের কষ্ট হবে বিবেচনা করে নীচেই ব্যবস্থা করেছিলেন। মনে একটু শঙ্কা ও সঙ্কোচ ছিল, বেয়াইমশাই এই ব্যবস্থায় ক্ষুণ্ণ হন কি না। করুণাকেতন বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হলেন না, বললেন, তিনি একটু নিরিবিলি পছন্দ করেন।
করুণাকেতনের খাবার সময় মেয়েরা কাছে থাকলেও প্রভাময়ী নিজেই দেখাশোনা করলেন। কুটুম মানুষ, ব্যবস্থার কোনো রকম ত্রুটি, সুখ-সুবিধের স্বল্পতা প্রভাময়ী রাখেননি। দেখলেন, করুণাকেতন ভোজন বিষয়ে অসংযমী। খেতে ভালবাসেন। খাওয়ার গল্প করতে ভালবাসেন। এক সময় হাকিম ছিলেন, ঘুরেছেন নানা জায়গায়; কোথায় কোন খাদ্যটা পাওয়া যায়, তার স্বাদ কেমন, দাম কত এ-সবও নখদর্পণে।
“আমার হাই ব্লাডপ্রেশার⋯” করুণাকেতন নিজেই বললেন, “বেশ হাই। আমার ফ্রেণ্ড বলাই-ডাক্তার বলে খাওয়া কমাতে। আমি বলি ও-সব বুজরুকি, খাওয়া কমালে প্রেশার কমে না। তোমার তো বাপু এই দুটো আহার, তোমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে কেন? বলাই জবাব দিতে পারে না। বলে, বয়েস⋯। আরে, বয়েসে যা তা হবেই, মাথার চুল পাকবে, দাঁত পড়বে, ঘুম হবে না। বয়েসে যদি ব্লাডপ্রেশার বাড়ে, বাড়বে; তা বলে খাব না। ⋯মরব ভেবে খাওয়া বন্ধ রাখা আমার কুষ্ঠিতে লেখেনি।”
প্রভাময়ী প্রতিবাদ করলেন না, করা উচিত নয়, বললেন, “তা তো ঠিকই।”
দুপুরে করুণাকেতন বেশ একটা ঘুম দিলেন। ঘুম থেকে উঠেই বিপত্তিটা দেখলেন।
মুখ ধুয়ে অভ্যাস মতন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিরলকেশ মাথাটি আঁচড়াতে গিয়ে লক্ষ করলেন ডান চোখটা একটু লাল। চোখে জল দেবার সময় সামান্য জ্বালা জ্বালা করছিল, অতটা খেয়াল করেননি। ঘুমের জন্য চোখটা লাল হতে পারে। দু’চোখের জমি বিচার করে যদিও মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল, করুণাকেতন তখনকার মতন ডান চোখ লাল হওয়াটাকে ঘুমের দরুন হতে পারে ভেবে কাউকে কিছু বললেন না।
আধঘণ্টা খানেকের মধ্যে বার দশ-বারো চোখ দেখলেন। উহুঁ, লাল ভাবটা কাটছে না।
মানসী চা এনেছিল। চা খাবার সময় মেয়েকে বললেন, “আমার ডান চোখটা দেখ তো।”
মানসী চোখ দেখল, বলল, “একটু লাল হয়ে আছে।”
“কেন?”
কেনর জবাব কি দিতে পারে মানসী। বলল, “কি জানি! চোখে কিছু পড়েছিল হয়তো।”
কোথায় কি পড়েছে মানসীর জানার কথা নয়, তবু আমতা আমতা করে বলল, “ট্রেনে এসেছ, ধুলোবালি পড়েছে হয়তো। ⋯”
“জ্বালা করছে।” করুণাকেতন বললেন, এবং ডান চোখটা একটু ছোট করে তাকিয়ে থাকলেন।
সরসী এল। সরসী আসতেই করুণাকেতন ছোট মেয়েকে দিয়ে আর একবার চোখ দেখালেন। “লাল হয়েছে—” সরসী বলল।
“টকটকে লাল?”
“না—, অতটা টকটকে নয়, তবে লালই⋯”