পুলিন নলিন খেতে বসেছে, মা সামনে, মানসী এবং সরসী হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রভা শুধোলেন, “কই মাছটা কেমন খাচ্ছিস? নটু কোথথেকে যোগাড় করে এনেছে।”
পুলিন বলল, “কে রেঁধেছে?”
“ছোট বউমা।”
“মন্দ না⋯” পুলিন সামান্য মুখ তুলে একবার ভাই এবং পরে সরসীকে দেখে নিল। গম্ভীর হয়ে বলল, “শীতের কই এমনিতেই খেতে ভাল লাগে। ⋯তা কই মাছ রাঁধে দিদি⋯”
“কার দিদি?” নলিন সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলল।
পুলিন সামান্য অপ্রস্তুত। “কার দিদি মানে? আমাদের দিদি।”
“ও!” নলিন ঘাড় নাড়াল বার কয়েক, বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুই সরসীর দিদির কথা বলছিস।”
সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে সরসী ও মানসী চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। হাসি চাপল।
পুলিন অল্পের জন্যে দমে গেলেও ত্বরিতে সামলে নিল। বলল, “তোর ভাবাভাবি ওই রকমই। বুদ্ধি বলে জিনিসটা তো কোনো কালে হল না। নিরেট।”
“তোর ব্রেনের ওয়েট কত?”
“যতই হোক, তোর চেয়ে বেশি।”
“তা হলে ওটা ব্রেন নয়, ব্রেনগান।”
সরসী জোরেই হেসে ফেলল। মানসী ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।
পুলিন মার দিকে তাকাল। প্রভা বুঝুন না বুঝুন, হাসছিলেন। এটা নিত্য দিনের ঘটনা। এ যদি বলে ‘তুই গাধা’, ও বলবে ‘তুই এল্ডার গাধা’।
“মা, তোমার ডেন্টাল সার্জনকে বলো দাঁতের পাটি সব সময়ে চোখের তলায় থাকে।”
পুলিন বলল, “ভগবানই মেরে রেখেছেন, আমার হাত নেই।”
“ও তোর ছোটই—” প্রভা বললেন।
“ব্যবহার দেখে তো মনে হয় না। ⋯বড় ভাইয়ের বউকে নাম ধরে মানসী বলে। আস্ত একটা ছোটলোক।”
নলিন এক মনে খেয়ে যাচ্ছে, হাসিটা চোখে জড়ানো।
মানসী বলল, “হ্যাঁ মা, এটা আমিও বলব। বাইরের লোকের সামনেও ও এইভাবে ডাকে।” বোঝাই যায় মানসী ইচ্ছাকৃতভাবে নলিনকে খোঁচাবার চেষ্টা করছে।
প্রভা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নলিন বলল, “বাইরের লোকের সামনে তোমায় কি বলে ডাকব, যদি বলো ‘মা জননী’ বলতে পারি।”
সরসী খিল খিল করে হেসে উঠল। প্রভাও হাসলেন। পুলিনও হেসে ফেলল। মানসী অপ্রস্তুত।
নলিন পুলিনকে বলল, “খাবার সময় বেশি কথা বলিস না ধীরে সুস্থে কাঁটা বেছে খা। কই মাছ খাচ্ছিস তো, সামলে⋯”
মানসী তার অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠেছিল। নলিনকে চোখের ইশারায় কি যেন বুঝিয়ে শাসাল। নলিন সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম মুখ করে চোখে চোখে বলল, খবরদার।
প্রভা বললেন, “পরশু সকালে বেয়াই-মশাই আসছেন, শুনেছিস?”
পুলিন এবং নলিন দুইজনে মার মুখের দিকে তাকাল। তারা শোনেনি। শোনার অবসর হয়নি। চেম্বার থেকে ফিরে সোজা স্নান করতে গেছে, স্নান সেরে খেতে এসেছে। ইতিমধ্যে মানসী অথবা সরসীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে বুঝি একবার, কিন্তু খবরটা তখনও পাওয়া যায়নি।
“হঠাৎ ?” পুলিন শুধলো।
“যাবেন গয়া। যাবার পথে এখান থেকে ঘুরে যাবেন।”
“গয়া কেন? কার পিণ্ডি⋯না, মানে কে থাকে গয়ায়?”
“মেসোমশাই—” মানসী বলল, “মেসোমশাই অনেক দিন ভুগছেন অসুখে, দেখতে যাবে বাবা।”
পুলিন বলল, “রাত জেগে ঠাণ্ডা লাগিয়ে আসছেন কেন? মুঙ্গের থেকে দিনের বেলায় গাড়ি পাওয়া যায়।”
জবাব দিল সরসী। “বাবা রাত্তিরের গাড়িই পছন্দ করে।”
পুলিন জল খেল, ঢেঁকুর তুলল, বলল, “একলাই আসছেন নাকি?”
“একাই”, মানসী জবাব দিল।
“ন্যাচারেলি। ⋯তোপের মুখে বসে কেই বা আসতে চাইবে।” নলিন গম্ভীর মুখে বলল।
সরসী মানসী ভ্রূকুটি করে কিছু বলবার আগেই নলিন উঠে পড়ল। পুলিনও।
বিকেলে আবার চেম্বার। শীতের বেলা, পাঁচটাতেই অন্ধকার হয়ে যায় বলে পুলিন নলিন চারটে নাগাদই চলে আসে চেম্বারে। সকালের চেয়ে বিকালের দিকটাতেই লোকজন বেশি, মানে দশ বিশজন নয়, হরেদরে চার পাঁচটা রুগি। কোনো কোনোদিন ফাঁকাও যায়।
পৌষ মাস, শীতটাও বেশ পড়েছে। সাতটা নাগাদ নলিন তার কাজকর্ম শেষ করে পুলিনের চেম্বারে ঢুকল। পুলিন টেবিলে পা তুলে দিয়ে জার্নালের পাতা ওলটাচ্ছিল।
নলিন বলল, “তোর হল? আর আসবে কেউ?”
হাতের কাগজ রেখে পুলিন বলল, “না। সাতটা বাজল, চল উঠি।” বলে পুলিন তার হাতের কাছের জিনিসগুলো গুছোতে লাগল। গুছোতে গুছোতে বলল, “চন্দ্রবাবু তাঁর ভাগ্নিকে এনেছিল, বুঝলি, গ্লুকোমা বলে মনে হচ্ছে। সিরিয়াস কিছু নয়, তবু এ-বয়সে জেনারেলি গ্লুকোমা হওয়ার কথা নয়।”
“সারিয়ে ফেল।”
“সেরে যাবে। ওষুধ দিয়েছি।”
“আজ আমার একটা সাংঘাতিক এক্সপিরিয়ান্স হয়েছে।” নলিন তার সেই অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বিভীষিকা দর্শনের ভঙ্গি করল। “একটা কাবলিঅলা এসেছিল—।”
“কাবলি⋯!” পুলিন এমনভাবে বলল, যেন কাবলিঅলাদের দাঁতে রোগ হয় এ তার জানা ছিল না।
নলিন ভাইয়ের দিকে তাকাল। “বাঃ, কাবলিদের কি দাঁত থাকে না!”
“হয়েছিল কী ওর?”
“দাঁত তুলতে হল।”
“কটা?”
“একটাই তুললাম। একটা দাঁত তুলতে ঝাড়া এক ঘণ্টা। বেটা কিছুতেই পুরো মুখ খুলবে না প্রথমে। ভুলিয়ে ভালিয়ে হাঁ করালাম তো মুখের মধ্যে কিছু ঢোকাতে দেবে না। তাতেও বাগ মানালাম তো মাড়িতে ইঞ্জেকশান করার আগেই গলগল করে ঘামতে লাগল। ওই চেহারা ভয়ে কাঠ। তারপর বেটার কী কান্না।”
“দাঁত তুললি?”
“দিলাম তুলে। বললাম, এটা তুলে দিলেই আর একটা গজাবে।” নলিন হাসতে লাগল। “অদ্ভুত, বুঝলি। নতুন দাঁত গজাবে শুনে বেটা কাবলি কাবু হয়ে গেল। ⋯ভাবল আসলটা যাক সুদ আসবে। বাপস, যা ট্রাবল দিয়েছে।”