পুলিন সিগারেট খুঁজে ধরিয়ে নিয়েছিল। সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে কি ভেবে সে দাঁত-দেখানো চেয়ারে এসে বসে পড়ল। বসে বলল, “এই দেখ তো, দাঁতের ফাঁকে কোথায় একটা কাঁটা আটকে আছে, বের করে দে।”
নলিন বিন্দুমাত্র গরজ দেখাল না। জানলার কাচের পাল্লা বন্ধ করে পরদা টেনে আলো আড়াল করে দিল।
পুলিন বলল, ‘কি রে, কাঁটাটা বের করে দিলি না?’
নলিন তার টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট কুড়োতে কুড়োতে জবাব দিল, “ওবেলা দেব। এক সঙ্গে।”
“একসঙ্গে।”
“দুপুরে গিলতে গিয়ে আবার তো একটা কাঁটা ঢোকাবি।”
পুলিন ঘাড় ফিরিয়ে ভাইকে দেখছিল, এবার উঠল। পুলিন প্রায়ই খেতে গিয়ে দাঁতের ফাঁকে কাঁটা আটকে ফেলে, নাকি আটকে যায়। তার একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যেস, মাছের কাঁটা বাছাও তার সহ্য হয় না। নলিন তাকে খোঁচা দিল আর কি! দিক।
ক্লিনিকের বাইরে শীতের রোদে ওদের গাড়িটা দিব্যি রোদ পোয়াচ্ছে। ছোট্ট একটা হিলম্যান, টকটকে লাল রং। পুলিন নলিন এগিয়ে গেল, চাকর চেম্বারের দরজা জানলা বন্ধ করছে, শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
গাড়িতে উঠে পুলিন বলল, “শেতলদার মার ছানি কাটতে হবে, বুঝলি।”
নলিন অন্য পাশ দিয়ে উঠে পুলিনের পাশে বসল, “কেটে ফেল।”
নলিন এমন সাদামাটা নিরুত্তাপ গলায় বলল যে, পুলিনের মনে হল ব্যাপারটা নলিন অবহেলার চোখে দেখছে। গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে পুলিন বলল, “এ তোর দাঁত তোলা নয়, সাঁড়াশি ধরে মারলাম টান, বেরিয়ে গেল জান-প্রাণ…।”
গাড়ি চলতে শুরু করল। নলিন জবাব দিল, “হাতুড়ের মতন কথা বলিস না। দাঁতের তুই কী জানিস?”
“যা যা, দাঁতের আবার জানা⋯ ! তোরা যে কত ব্লাফ দিস লোকে তো আর জানে না। জানলে কাছে ঘেঁষত না।”
“তোরাও ঘর অন্ধকার করে যে ম্যাজিক দেখাস তাই বা ক’জন জানে বল? বুদ্ধু হয়ে টাকা গুনে দিয়ে চলে যায়।”
রাস্তায় কে একজন হাত তুলে কিছু বলল, পুলিন মাথা নাড়ল, নলিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি। জয়মলরামের দোকান পেরিয়ে গেল, বাজারের একটা রাস্তা এখানে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে, পুলিন বাঁদিকে পথ নিল, ম্যাকসাহেবের বেকারি, মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে হালদারদা কার সঙ্গে যেন গল্প করছে, পুলিন নলিনকে দেখে হাসল, ওরাও প্রত্যুত্তরে হাসিমুখ করল, তারপরই গণেশ হালুইকরের মিষ্টির দোকান পড়ল ডানপাশে।
পুলিন গাড়ি দাঁড় করাল। বলল, “দই নিয়ে আসবি?”
“শীতকালে দই খেতে নেই⋯”
“দইয়ের কথা বলেছিল; কি-যেন বলল আরও একটা মনে পড়ছে না।”
“আমায় কিছু বলেনি।”
“মানসী আমায় বলেছে।”
নলিন অগত্যা হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলল। “টাকা দে।”
“তুই নিয়ে আয়⋯”
“বেশ আছিস—”
পুলিন হাসল, বলল, “গাড়ির তেল কিনতে হবে, আমার কাছে তেলের টাকাটা আছে।”
“সকালে কিছু ইনকাম হয়নি তোর?”
“দূর⋯র। প্রথমে এল সেই ফেরিঅলা বুড়োটা তারপর এল শেতলদা। টাকা দিতে চেয়েছিল, ওকি আর নেওয়া যায়!”
নলিন দু-মুহূর্ত বড় ভাইকে দেখে গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে নেমে পড়ল। দু-পা এগুতেই শুনল পুলিন সিগারেট-সিগারেট করে চেঁচাচ্ছে। নলিনের হাসি পেল। তাদের দুই ভায়ের পক্ষে এখানে চেম্বার খুলে বসা বোকামি হয়েছে। অর্ধেক লোকের কাছে তারা টাকা নিতে পারে না। এত সব চেনাশোনা, কেউ দাদা, কেউ কাকা-মামা, কেউ আসে বাচ্চা ছেলেমেয়েকে দেখাতে, কেউ মা-পিসিকে নিয়ে। কেউ বা নিজের জন্যেই আসে। এদের বেশির ভাগই দু-পাঁচ টাকা দিতে চায়, স্বেচ্ছায়, পুলিন-নলিন নিতে পারে না। নিতে লজ্জা করে। এভাবে কতদিন প্র্যাকটিস চলবে? নিতান্ত বাপ-ঠাকুর্দার পয়সা ছিল তাই চলছে, নয়ত মুশকিলে পড়তে হত। অবশ্য নলিন ভাবল, তারা এখন একেবারে নতুন; পুরানো হলে ফ্রি-রুগি কমে যাবে, আশপাশ থেকে দেদার রুগি আসবে।
দই কিনে নলিন দেখল টাটকা বালুসাই তৈরি হয়েছে। ফুলটুসি বালুসাই খেতে খুব ভালবাসে। নলিন বালুসাই কিনল। হালুইকরের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গেল পানের দোকানে, সিগারেট কিনল। গাড়িতে ফিরে আসার সময় নলিন হিসেব করে দেখল, তার সকালের রোজগার শেষ হয়ে দু-টাকা গাঁট-গচ্চা গেছে। মন্দ নয়!
গাড়িতে এসে বসে দরজা বন্ধ করল নলিন।
পুলিন শুধোল, “ওটা কী আনলি?”
“বালুসাই।”
পুলিন হেসে বলল, “সরসী বলেছিল?” বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল আবার।
“না, তোর মতন আমার চেম্বারে বসে বসে বউয়ের অর্ডার নিতে হয় না।”
গাড়ি চলছে। পুলিন ভাইকে দেখল মুখ ফিরিয়ে। হাসছিল। শিস দিল একবার। তারপর মুখ গম্ভীর করে বেসুরোভাবে গাইতে লাগল, “যৌবন সরসী নীরে…।”
নলিন গম্ভীর হয়ে বলল, “বাড়িতে তোর শোবার ঘরে আরও একটা লাইন করিয়ে নে ফোনের। এ-রকম আর চলবে না। ফেড আপ হয়ে গিয়েছি।”
জবাবে পুলিন বলল, “তুই-ই বরং একটা করিয়ে নে, আমার তো লজ্জাই করে।”
নলিন পুলিনের মুখের দিকে তাকাল। “বাজে কথা বলিস না। আমি দেখেছি, যখনই ফোন করতে গেছি বাড়িতে তুই মানসীর সঙ্গে গল্প করছিস।”
“আমি তো দেখেছি, ঠিক উল্টো, তুই সরসীর সঙ্গে গল্প করছিস।”
“লায়ার।”
পুলিন হাসতে লাগল। সামান্য দূরে পেট্রল পাম্প। পেট্রল নিতে হবে গাড়িতে। পুলিন রাস্তার ধার ঘেঁষে পেট্রল পাম্পের দিকে এগুতে লাগল।
দুপুরের খাওয়াটা সাবেকি ধরনের। দুই ভাই খেতে বসে এক সঙ্গে, বউরা বসে না। কাছে থাকে। মা-ই সব দেখাশোনা করেন। বউরা ফরমাশ খাটে। রাত্রে অবশ্য মা থাকেন না, দুই ভাই এবং দুই বউ টেবিল ঘিরে বসে ঘণ্টাখানেক ধরে খায়। খাওয়ার চেয়ে গল্প-গুজবই বেশি করে, হাসিঠাট্টার পাট সহজে মিটতে চায় না।