শোকটা সকলেরই গায়ে লেগেছিল। পুলিন তখন সবে কলেজে ঢুকেছে, নলিন স্কুলে। অভিভাবক বলতে শুধু তাদের মা। দিদি জামাইবাবু তো দূরে থাকে। অবশ্য পাড়ার লোক সবসময়ই কাছে ছিল। শোকের পর্বটা আস্তে আস্তে কাটল। প্রভাময়ী নিজেকে সামলে নিলেন।
আই-এস-সি পাশ করে পুলিন চলে গেল পাটনা মেডিকেল কলেজে পড়তে। ক্ষিতীশবাবুর সেই রকম ইচ্ছে ছিল। তাঁর বাবা ছিলেন সিভিল সার্জন। ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তারি পড়ে। ক্ষিতীশের ডাক্তারিটা তেমন পছন্দ ছিল না, তবে বাবাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘তোমার নাতি পড়বে।’
পুলিন পাটনা থেকে পাশ করে গেল বিলেত, চোখের বিদ্যেতে একটা ডিপ্লোমা আনার জন্যে। সেখানে থাকতে থাকতে ছোট ভাইকে নিয়ে গেল। নলিন শিখল দন্ত চিকিৎসা। পুলিন ফিল আগে, নলিন ফিরল মাস দুই তিন পরে।
পুলিন নলিন অতঃপর এখানেই বসেছে। বাবা চাইতেন না—অর্থ এবং প্রতিষ্ঠার জন্যে ছেলেদের কেউ এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। ‘যা করার এখানে থেকেই করবে ; এদের জন্যে করবে।’ প্রভাময়ীরও সেই রকম ইচ্ছে ছিল। শ্বশুরমশাই অনেকটা জমিজায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন, বাগান করেছিলেন; স্বামীর হাতে সেই বাড়ি-বাগান জমি-জায়গা আরও তকতকে হয়েছিল, ছোটখাটো অদল-বদল হয়েছিল। দীর্ঘকাল থাকতে থাকতে এই বাড়ি আর এই জায়গার ওপর যে মায়া জন্মেছিল, সেটা পুরুষানুক্রমে মমতা এবং দুর্বলতা। শ্বশুর ও স্বামী যে ভিটেতে বসবাস করেছেন, শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তা ত্যাগ করে যাওয়ার চিন্তা প্রভাময়ী করতে পারতেন না। পুলিন-নলিনও তা চায়নি। তাদের সংসারে অস্বচ্ছলতা কোথাও ছিল না, বরং ঠাকুরদা এবং বাবা যা রেখে গেছেন তা যথেষ্ট, ভদ্রভাবে জীবন কাটাবার পক্ষে অপ্রতুল নয়। তা ছাড়া পুলিন এবং নলিন এই শহরেই বসবে এ তারা বরাবরই স্থির করে রেখেছিল। জন্মাল এখানে, মানুষ হল, লেখাপড়া শিখল, ঘরবাড়ি থাকল এখানে—আর তারা যাবে পাটনা কি ভাগলপুরে প্র্যাকটিস শুরু করতে! দূর…তা কি হয়। পুলিন ভাল করেই জানত সে একেবারে সাধারণ ছেলে, তার এমন কোনো মেধা নেই যে, বাইরে গিয়ে চেম্বার খুললেই রাতারাতি সে পশার জমিয়ে ফেলবে। বিলেত থেকে একটা ডিগ্রি ডিপ্লোমা আজকাল কে আর না আনছে! ওটা কিছুটা শখ, কিছুটা ফালতু। তার চেয়ে এই শহরে চোখের ডাক্তার নেই, চেম্বার খুললে এখানেই খুলবে। বাবা যা চাইতেন, মা যা চায়। নলিনেরও মনোভাব সেই রকম। দাঁতের ডাক্তারও তো নেই এখানে, অথচ দাঁতের গোড়া কার না ফুলছে—এইখানেই সে প্র্যাকটিস করবে, কম্পিটিটার নেই।
পুলিন বিলেত থেকে ফিরে এসে সদর বাজারের কাছাকাছি ওদেরই এক ভাড়া দেওয়া বাড়ি মেরামত করাল, বাহারি করল। ওপরতলায় খান চারেক ফালি-ফালি ঘর থাকল, সেটা হল ক্লিনিক। নীচের তলায় দুই ভাইয়ের চেম্বার, আলাদা আলাদা, একটা আই স্পেশ্যালিস্ট ডাক্তার পি সেন-এর, অন্যটা ডেন্টাল সার্জন ডাক্তার এন সেন-এর।
পুলিন আর নলিন একেবারে পিঠোপিঠি ভাই, বছর দেড়েকের ছোটবড়। মাথার ওপর ছিল দিদি, তার বিয়ে হয়েছে মুঙ্গেরে, ভগ্নিপতি কলেজে কেমিস্ট্রির প্রফেসার। আসা-যাওয়া আছে। অতি রসিক-পুরুষ। পুলিন নলিনের বিয়েতে ভদ্রলোকের কিছুটা কারসাজি ছিল।
ওদের বিয়ের গল্পটা প্রসঙ্গত কোনো সময়ে আসবে, আপাতত এইটুকু মাত্র জানা দরকার—পুলিনের স্ত্রী মানসী, এবং নলিনের স্ত্রী সরসী সহোদর বোন, পুলিন নলিনের মতনই পিঠোপিঠি। চারজনের সম্পর্কটা তাই আরও কৌতুকপ্রদ হয়ে উঠেছে। পুলিন অনেক সময় ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে শালী সম্পর্কে ঠাট্টা করে, এবং নলিনও প্রত্যুত্তরে পুলিনের বউকে বড়শালীর প্রাপ্য খোঁচাটুকু মারতে ছাড়ে না।
বিয়ে হয়েছে বছর পুরতে চলল, অথচ দুই ভাই এমন সব কীর্তি করে যাতে মনে হয় এরা সদ্য বিবাহিত। যেমন আজ সকালে ফোন নিয়ে করল। এ-রকম নিত্যই হয়। চেম্বারে এসে রুগি না থাকলেই যে যার বউকে ফোনে ডেকে গল্প করতে চাইবে। মুশকিল এই, চেম্বারে পুলিনের নিজের ফোন আছে, নলিনেরও আছে; অথচ বাড়িতে মাত্র একটা ফোন। পুলিন-মানসী বাক্যালাপ চলতে থাকলে নলিন লাইন পায় না, নলিন-সরসী বাক্যালাপ চলতে থাকলে পুলিন হাঁ করে বসে থাকে। এবং দুজনেই দুজনের আক্কেল দেখে বোধ হয় অবাক হয়ে যায়।
তিন
বারোটার পর পুলিন গায়ের কোটটা কাঁধে ঝুলিয়ে শিস দিতে দিতে নলিনের চেম্বারে এসে ঢুকল। ছিপছিপে-চেহারা পুলিনের, গায়ের রং ফরসা, মুখ লম্বা ধরনের, সোজা শক্ত নাক, চোখ দুটো চকচকে, মাথার চুল কোঁকড়ানো। বাবার মুখের আদল পেয়েছে বড় ছেলে। ঘরে ঢুকে পুলিন বলল, “কই রে, তাড়াতাড়ি নে। ⋯খিদে যা পেয়েছে!⋯তোর সিগারেটের প্যাকেটটা কই⋯?” পুলিন নলিনের টেবিল হাতড়ে সিগারেট খুঁজতে লাগল।
সামান্য আগে নলিনের এক রুগি বিদায় নিয়েছে, নলিন সাবানে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছছিল। হাত মোছা হয়ে গেলে—একপাশে রাখা স্টেরিলাইজার যন্ত্রপাতির বাক্সটা কাচের আলমারির মধ্যে সরিয়ে রাখল।
নলিন বেশ গোলগাল, গায়ের রং পুলিনের চেয়েও ফরসা। নলিনের মুখও গোল, ফোলা ফোলা গাল নাক একটু পুরু, চোখ দুটো স্বচ্ছ ও সুন্দর, মাথায় সাবেকি ধরনের টেরি, চোখে ক্যারেট গোল্ড ফ্রেমের চশমা; নলিন হাসলে তার দাঁত দু পলক তাকিয়ে দেখার মতন। দাঁতের ডাক্তার বলেই বোধ হয় নিজের দাঁত দেখিয়ে নলিন অনেক রুগিকে পরোক্ষে ঘায়েল করে। নলিনের মুখের আদলে মায়ের মুখের ছাপ আছে।