“কী বুঝব?”
“লীলা।”
গোরাচাঁদ সামান্য চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “বুঝেছি। তবে ওকে। একেবারে ইয়ে অবস্থা থেকে দেখছি।”
“ভালই তো! ইয়েরাই পরে টিয়ে হয়। আরে তুই নিজের বাগানের গাছের ফল খাবি—তার স্বাদই আলাদা। আমরা তো টুকরির মাল খেয়েছি। ” ও পাশে গুঞ্জন উঠল যেন।
গোরাচাঁদ এবার হেসে ফেলল জোরে। বলল, “তা না হয় খাব। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? ইউ নো মাই জেঠামশাই!”
“কি ভাবিস না তুই। ঘণ্টা আমরা বাঁধব। দিদি বাঁধবে। নিয়োগীকে দিদির কাছে দুর্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। এভরিথিং ও-কে।”
“ও! মানে তোরা সবাই তা হলে…”
“বিন্দুমাত্র সন্দেহ রাখিস না গোরা, সবাই মিলে মাথা খাটিয়েছি। তুই আমাদের বন্ধু, তোর ভাল-মন্দ আমরা না দেখলে কে দেখবে!” জলধর হাসছিল।
শালা! ভাল-মন্দ দেখনেওয়ালা।… তা ওর কী হবে? মশলাবাড়ির মেয়েটার? ভদ্রবাড়ির একটা মেয়েকে নিয়ে তোরা যা কেচ্ছা করলি… ছি ছি!”
জলধর বলল, “তুই ভাবিস না। চারুর এনট্রি পাকা হয়ে গেল।”
চারু! কেন রাজু?”
“ওই একই হল। যা চারু তাই রাজু। টাকার এপিঠ ওপিঠ।”
“কী বলছিস তুই?”
“ঠিকই বলছি। চারু আসলে ফুড ডিপার্টমেন্টে আছে, নলিনীর সঙ্গে। অফিসার। তোর গুঁড়ো মশলার যাওয়া-আসা আছে চারুর কাছে। ইয়ের ব্যাপার থাকে তো—! চারু মশলাবাড়ির সদর পেরিয়েছিল, এবার অন্দরে ঢুকে যাবে। ও নিয়ে তুই ভাবিস না। তোর টাকাও আমার কাছে।”
গোরাচাঁদ ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “এখানেও ধাপ্পা! তোরা আমায় বুদ্ধ বানিয়ে ছাড়লি।”
জলধর হো হো করে হাসছিল। বলল, “গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—!”
“থাম, গীতা আওড়াতে হবে না। …ফুটকি আছে? ওকে একবার দে।”
ফুটকি ফোন নিল। “কী বলছ?”
“বলছি, তোর কেরামতি দেখলাম। তা তুই গলাটা পালটাতিস কেমন করে?”
ফুটকি হাসছিল, বলল, “কায়দা আছে। ফোনের মুখে পাতলা রাংতা রাখতাম। একটু পেঁজা তুলো। তা ছাড়া তোমার তো বাঁ কানটা ভাল না।”
“বাঃ! চমৎকার! যেমন জামাইবাবু তেমনি তার শালী।… তা তুই এত কাণ্ড করতে গেলি কেন? ব্যাপারটা কান ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতন হয়ে গেল। সরাসরি দেখালেই পারতিস!”
“যাঃ! নিজে দেখতে জানে না, আবার আমায় বলে!” বলতে বলতে ফোন রেখে দিল ফুটকি।
গোরাচাঁদ ফোন নামিয়ে রাখল। দাঁড়িয়ে থাকল সামান্য। তখনও বৃষ্টি পড়ে চলেছে। গোরাচাঁদের মজা লাগছিল। ভালও লাগছিল। বেশ ঝরঝরে মনে হচ্ছিল নিজেকে। বুকের কাছে কী যেন একটা ঝুলত এতদিন। এখন একেবারে হালকা।
চার তাস
নলিন ফোনে কান রেখে সাড়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল; ওপারে গলার স্বর উঠতেই নলিন বলল, “কী ব্যাপার?”
“কিসের কী ব্যাপার!”
“ন’টা পাঁচ থেকে ন’টা তেরো⋯চারবার ফোন তুলেছি⋯এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল?”
“দিদি কথা বলছিল…”
“দাদার সঙ্গে নিশ্চয়।”
“হ্যাঁ।”
নলিন দু-মুহূর্ত চুপ; তারপর বলল, “তোমার দাদাটি ভেবেছেন কী? বাড়ির ফোন কী তাঁর আর তাঁর গিন্নির মৌরসিপাট্টা?⋯আলাদা ফোন নিতে বলো। বউয়ের ঘরে থাকবে।”
ওপারে চাপা হাসি।
নলিন বলল, “হাসছ যে?”
“দাদাকে বললে দাদা কী জবাব দেবে যদি জানতে…” ওপার থেমে গিয়ে হাসতে লাগল।
“যদি জানতে…” নলিন বলার ভঙ্গি অনুকরণ করে ভেঙাল। “লহর তুলে হাসছ যে! এ্যাঁ⋯! জানার কি আছে শুনতে পাই?”
ওপারের হাসি থামল না, স্টেশনের কাছে গাড়ি পৌঁছে গেলে গতি এবং শব্দটা যেমন মন্থর ও মৃদু হয়ে আসতে থাকে, সেই রকম হাসিটাও ঈষৎ কমে আসতে লাগল। তারই ফাঁকে ফাঁকে কথা। ওপার বলল, “দাদা বলবে, তুমিই আলাদা একটা ফোন তোমার বউয়ের ঘরে রাখো। বাড়ির ফোন তোমারও মৌরসিপাট্টা নয়।”
নলিন থমকে গেল যেন। তারপরই বলল, “মানে—?”
“খুবই সহজ।”
“এ রকম কথা বলার কোনো রাইট পুলিনের নেই। আমি দিনে ক’বার বাড়িতে আমার বউয়ের সঙ্গে ফোনে গল্প করছি। সে হরদম করছে। যখনই ফোন তুলি—দেখি লাইন নেই। তারই উচিত তার বউয়ের ঘরে একটা প্রাইভেট লাইন নেওয়া।”
“তা তুমিই বা হরদম ফোন তোলো কেন?”
“তুলি না।”
“না তুললে কেমন করে জানলে দাদা দিদিতে গল্প হচ্ছে⋯”
নলিন এবার একটু যেন থতমত খেয়ে গেল, সামলে নিল অবশ্য, বলল, “বোঝাই যায়। দেখতেই তো পাচ্ছি। বেলা আটটা সোয়া আটটায় চেম্বারে এসেছে, একটাও পেশেন্ট নেই, টেবিলে পা তুলে বউয়ের সঙ্গে গল্প করছে।”
“পেশেন্ট নেই কেন?”
“থাকলে কেউ সাত সকালে পেশেন্ট ফেলে বউয়ের সঙ্গে গল্প করে?”
“ও!⋯তোমারও বুঝি পেশেন্ট নেই?”
নলিন একেবারে বোবা। মাথা ফেরাতেই চোখে পড়ল তার ডেন্টিস্টস চেয়ারটা শূন্য। জানলা দিয়ে একমাত্র যা রোদই ঘরে এ-যাবৎ এসেছে, এসে দিব্যি সেই চেয়ারে বসে আছে। নলিন হেসে ফেলল। তারপর গলার সুর পাল্টে ডাকল, “ফুলটুসি!”
“শুনেছি, বলো—”
“আমার ঘরে একজন পেশেন্ট আছে।”
ওপারে বুঝি বিস্ময় এবং সামান্য বিব্রত হবার শব্দ এল।
নলিন বলল, “পেশেন্ট বেশ শান্তশিষ্ট, কিন্তু তার দাঁত নেই।”
ওপার অস্পষ্ট করে বলল, “বুড়ো?”
“এখনও হয়নি, হতে হতে দুপুর ফুরোবে।”
“ইয়ার্কি মারা হচ্ছে, না?⋯তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারার সময় আমার এখন নেই। অনেক কাজ। কী জন্যে ডাকছিলে বলো?”
“কী করছ?”
“স্নান করতে যাব, স্নান করে মার সঙ্গে…”
“সর্বনাশ, এই শীতে এখন স্নান! তোমার না চোখ ফুলে ব্যথা হয়েছে। পুলিন সকালে কী বলল?”