“প্রমাণ?” সলিল বলল, “প্রমাণ পেলেই তুই এগিয়ে যাবি! এই তো?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে। প্রমাণ চারুবাবুর কাছে আছে।”
চারু বলল, “আমি আপনাকে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছি। শুধু চিঠি নয়, একটা ফটোও। যাতে ফটোর পেছনে কমলিকা লিখেছে, রাজুকে আমার ভালবাসার সঙ্গে।”
“টু রাজু, উইথ মাই লাভ!” মানিক রগড় করে বলল।
“রাজু কে?”
“ওর লাভার।”
“কই চিঠি? ফোটো কোথায়?”
চারু বলল, “দিচ্ছি। তার আগে আর-একটা কথা বলে নিই গোরাবাবু! মেয়েটি হয়তো আপনাকে আবার একদিন ফোন করবে। দু’ চারদিনের মধ্যেই। সারেন্ডার করতে পারে, কিংবা দু’ দশটা রাফ কথা বলতেও পারে। আপনি তখন সমানে সমানে লড়ে যেতে পারেন। ওকে নক আউট করতে পারেন। তাই না?”
জলধর এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, “গোরা, হাতে ব্রহ্মাস্ত্র পেয়েও যদি তুই বেটা বখরি হয়ে থাকিস—ধিক তোকে। ধিক আমাদের।”
গোরাচাঁদ উত্তেজিত হয়ে বলল, “করুক ফোন, আমি ওকে দেখে নেব।”
পাঁচ
যে ফোনের নামে এতদিন গোরাচাঁদের হৃৎকম্প হত, গলা শুকিয়ে যেত ভয়ে—সেই ফোনের প্রত্যাশায় এখন সে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। অধৈর্য হয়ে ওঠে। দিন চারেক কেটে গেল। কোনো ফোন নেই। ছ’ দিনের মাথায় ফোন এল। রাত প্রায় ন’টা নাগাদ। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। বারান্দায় গিয়ে গোরাচাঁদ ফোন ধরল। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে। ও দিকে প্রবল বৃষ্টি, মেঘগর্জন, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর এই সময় সব অন্ধকার হয়ে গেল হঠাৎ। লোডশেডিং।
ফোন তুলতেই সেই গলা, তবে আজ একটু চাপা, ধীর, সামান্য জড়ানো। “কে, সোনার চাঁদ নাকি?”
গোরাচাঁদ কোনো জবাব দিল না।
“কী গো, গোরাচাঁদ শুনতে পাচ্ছ না। কালা হয়ে গেলে?”
“শুনছি।”
“বাঃ, এই তো! কথা ফুটেছে। ” বলেই হাসি।
গোরাচাঁদ নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। কড়া গলায় বলল, “শুনুন, আপনি হাসি থামান। এতদিন তো একতরফা খুব হেসেছেন। রসিকতা করেছেন। অপমান করেছেন আমাকে। এবার যে আপনাকে কাঁদতে হবে।”
“কাঁদতে হবে! কেন মশাই! কী দুঃখে!… খুব বৃষ্টি হচ্ছে। একটু গলা তুলে কথা বলো গোরাচাঁদ। তোমার গলা ভাল শুনতে পাচ্ছি না! বাব্বা, কী জোর বাজ পড়ল।”
গোরাচাঁদ বাঁকা গলায় বলল, “আসল বাজটা তো পড়েনি। পড়বে।”
“তাই নাকি? কোথথেকে?”
“আমার কাছ থেকেই।… শুনুন—শুনতে পাচ্ছেন—রাজুকে চেনেন। রাজু! মনে পড়ছে!”
“রাজু। মনে পড়বে না কেন! রাজু আমার বন্ধু।”
“শুধু বন্ধু? না, আরও বেশি। লাভার।”
“লাভারই তো! অনেক দিনের।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বড় বড় চিঠি লেখা হত। আমার আদরের, রাজু। তাই না। একটা চিঠি এনে পড়ব?”
“পড়তে পারো। আমার কাঁচকলা হবে। প্রেম করি, চিঠি লিখি। বেশ করি। তাতে তোমার কী গো নদের চাঁদ!”
গোরাচাঁদ ঘাবড়ে গেল। কী মেয়ে রে বাবা! একটুও দমল না, ভয় পেল না। কী বলবে বুঝতে না পেরে সে বলল, “ওদিকে প্রেম হচ্ছে, আর এদিকে—”
“মশাই, প্রেম নয় শুধু চুটিয়ে প্রেম। রাজু কি স্মার্ট, কী রকম ম্যানলি দেখতে, হ্যান্ডসাম! তোমার মতন গোবরগণেশ, হাঁদা, রসগোল্লা নাকি সে?”
গোরাচাঁদ চটে গেল। পড়ক বৃষ্টি। চেঁচিয়ে বলল, “শাট আপ। কথা বলতে শেখেননি? অসভ্য, অভদ্র, থার্ড ক্লাস! ন্যাস্টি! লজ্জা করে না, একটা ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেন বলছেন—আর এদিকে বিয়ের—”
“কে তোমাকে বিয়ে করতে কেঁদে মরছে নদের চাঁদ! আমি তো গোড়া থেকেই বলছি—লেজ গুটিয়ে পালাও। নয়ত বিপদে পড়বে।”
“চুপ করুন। আমি বিয়ে করছি না। আপনার মতন অসভ্য ন্যাস্টি মেয়েকে কোনো ভদ্রলোক বিয়ে করে না। এ বিয়ে হবে না। আমি ব্যবস্থা করছি।”
“আঃ! বাঁচা গেল!”
“হ্যাঁ, বাঁচা গেল। আমি বাঁচলাম।”
হঠাৎ কী যে হল, ফোনের ওপারে হাসির লহরা ছুটল। কী জোর হাসি। হাসতে হাসতে যেন মরে যাবে মেয়েটা। হাসছে তো হাসছেই। জোরে, ধীরে, লহর তুলে, ছররার মতন হাসির ধ্বনি ছিটিয়ে হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে ক্রমশ যেন কী একটা হচ্ছিল। স্বর পালটে যাচ্ছিল। গলা অন্যরকম হয়ে আসছিল।
গোরাচাঁদের কানের দোষ। বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় হাসির দাপট কমল। ভোল্টেজ কমে গেলে আলো যেমন নিভু-নিভু হয়ে আসে, সেইভাবে হাসির দমকা কমে এল। তারপর ওপার থেকে কে যেন বলল, “কী গো?”
গোরাচাঁদ চমকে উঠল। যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ধরতে পারল গলার স্বর।
“কী গো?”
“ফুটকি!”
“আমি।”
“তুই ওখানে কী করছিস?”
“আমি ওখানে কেন! আমি তো এখানে জামাইবাবুর বাড়িতে।”
“জামাইবাবু! জলধরের বাড়িতে?”
“হ্যাঁ, জলধরদার বাড়িতে আজ আমার নেমন্তন্ন ছিল। যা বৃষ্টি! আর বাড়ি ফেরা হবে না। এখানেই থেকে যাব।”
গোরাচাঁদ বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই-তুই এতক্ষণ আমার সঙ্গে রগড় করছিলি। আশ্চর্য!”
“এতক্ষণ কেন করব, বরাবর করছি, এতদিন।”
গোরাচাঁদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। ফুটকি, ফুটকি এতদিন তার সঙ্গে মজা করছিল। তাকে বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। “ফুটকি তুই—তুই…।”
“তুই তুই কী করছিস?” এবার জলধরের গলা, মানে ফুটকির হাত থেকে ফোনটা সে নিয়ে নিয়েছে। “কুঁতিয়ে কথা বলছিস কেন! স্ট্রেট বল.।”
“জলধর।”
“জলধর মিত্তির। লীলার জামাইবাবু। প্রাণের আরাম। তোরও বন্ধু। …তা কেমন খেলালাম তোকে।”
“শালা!”
“বল, বল। যা খুশি বল।… তা তুই কিছু বুঝলি? তোর যা মাথা, ইট মারলে ইষ্টক হয়ে যায়। তুই মাইরি সত্যি স্টকে এক পিস মালই। বুঝলি কিছু?”