জলধর বলল, “না, এখন আর—কই—খেলাটেলা…। তা তোমার হাতে ওটা কী?”
“চা। গোরাদার জন্যে!”
“আমাদের জন্যেও একটু হয়ে যাক ভাই। গোরাকে চা না খাইয়ে অন্য কিছু খাওয়ালে পারতে। এনার্জি পেত। চায়ে মুখ আরও বিস্বাদ হয়ে যাবে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় বেশি চা খেতে ভাল লাগে না।”
মানিক বলল, “দাদার চেহারা দু দিনেই যা হয়েছে। মনে হচ্ছে সলিড টায়ার পাঞ্চার হয়ে গিয়েছে।”
ফুটকি বলল, “আকুপাঞ্চার।”
হেসে উঠল সকলেই একসঙ্গে। অট্টহাসি।
গোরাচাঁদ অপ্রতিভ। সে হাসতে পারল না। ফুটকির ওপর চটে গেল। বন্ধুদের সামনে এই রসিকতার কী মানে হয়! ঠিক আছে, এক মাঘে শীত পালায় না। গোরাচাঁদও পরে দেখে নেবে ফুটকিকে।
চা দিয়ে ফুটকি চলে যাচ্ছি।
জলধর বলল, “চায়ের সঙ্গে ঝালটাল কিছু হবে? বড়া ক্লাসের। বর্ষার দিন।”
“জেঠাইমাকে বলছি।”
“থ্যাংক ইউ! তা শ্যালিকা, খবরটবর বললে না?”
“ভালই। ”
জলধর আর ফুটকির মধ্যে খুব সাবধানে, আড়ালে চোখাচুখি হল। ফুটকি চলে গেল। জলধর চারুর দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন চোখ টিপল। ছোট করে। বলল, “নিজের শালী বলে বলছি না, চারু। লীলা ভালই খেলত। আমি দেখেছি ওর খেলা। বুদ্ধি করে খেলতে পারত। বেশ মেয়ে।”
গোরাচাঁদ অন্যমনস্কভাবে চায়ে চুমুক দিল। দিয়েই ‘উঃ’ করে উঠল। চা যে এত আগুন গরম বুঝতে পারেনি। জিভ পুড়ে গেল।
সলিল বলল, “কী হল রে? জিভ বার করে বসে থাকলি?”
গোরাচাঁদ জিভ সামলাতে সামলাতে বলল, “ভীষণ গরম। জিভ ঠোঁট পুড়ে গেল।
মানিক মজা করে বলল, “একটু দেখেশুনে খাও, দাদা! চোখ চেয়ে দেখো।”
সলিল ততক্ষণে আরাম করে বসে পড়েছে। সিগারেট ধরাচ্ছিল। বলল, “তোর কিছু ভাল খবর আছে, গোরা। গুড নিউজ। চারুবাবু অনেকটা সাকসেসফুল। ”
গোরাচাঁদ প্রত্যাশাই করেনি চারুর কাছ থেকে কোনো ভাল খবর শুনতে পাবে। কথাটা কানে যাওয়া মাত্র সে চারুর দিকে তাকাল। চোখে কৌতুহল।
চারু বলল, “কাজ অনেকটাই এগিয়েছে গোরাবাবু। আমি মাঝে আর কোনো খবর .দিতে পারিনি আপনাদের। তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। কাজটাই তো আসল। ইন ফ্যাক্ট আমি আপনার ব্যাপার নিয়ে ভীষণ বিজি ছিলাম। কম কাঠখড় পোড়াতে, ঘোরাঘুরি করতে হয়নি।”
জলধর চারুকে বলল, “কতটা এগিয়েছ, তাই বলো গোরাকে।”
গোরাচাঁদ মাথা হেলাল। অর্থাৎ সে জানতে চায় কাজের কাজ কী হয়েছে?
চারু বলল, “প্রথমত আমি আপনাকে মেয়েটির বাড়ির ব্যাপারে অনেক কথাই বলতে পারি। ফ্যামিলি ইনফরমেশান। তারপর ওদের বিজনেস সম্পর্কেও খোঁজ-খবর করেছি। ভালই চালাচ্ছে। মাসে হাজার পঞ্চাশ টাকার বিজনেস করত। এখন ঢিলে যাচ্ছে কিছুদিন। প্রোডাক্ট খারাপ হয়ে গিয়েছে হালে। দেদার ভেজাল দিচ্ছিল। ওদিকে…”
বাধা দিল গোরাচাঁদ। মেয়ের বাপের ব্যবসা সম্পর্কে জানার কোনো আগ্রহ তার নেই। বলল, “বাপ বাদ দিন, মেয়ের কথা বলুন।”
চারু বলল, “মেয়ে, কী বলব, এমনিতে খারাপ নয়। দেখতে-শুনতে ভাল। লেখাপড়াও করেছে খানিকটা। তবে মেয়েটি একটু রোগা আর লম্বা। একটা চোখ সামান্য টেরা। তা এসব ঠিক আছে। স্বভাবটাই ঠিক নেই। রুক্ষ টাইপের, বদমেজাজি, ঝগড়ুটে। তা ছাড়া ওর একটা মেন্টাল—মানে সাইকোলজিক্যাল সিকনেস—গোলমাল আছে। ইনসমনিয়ায় ভোগে, রাত্তিরে যেখানে সেখানে ফোন করে, চেনা অচেনা মানে না, যা মুখে আসে বলে…!”
“পাগল?” গোরাচাঁদ বলল, প্রায় আঁতকে উঠে।
“না, পাগল ঠিক নয়, ওই ছিট টাইপের। তা তার চেয়েও বড় কথা ওর একজন—আই মিন—ওই কমলিকা মেয়েটির একজন ফ্রেন্ড আছে। লাভার। তা চার পাঁচ বছর ধরে দু’জনের লাভ চলছে। লুকিয়ে ঘোরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া। চিঠিচাপাটিও চলে। এরকম একটা চিঠি আমি হাতাতে পেরেছি। মেয়েটির লেখা।”
গোরাচাঁদ বলল, “লাভার! প্রেম! ও তা হলে এই বিয়েতে…”
“একেবারেই রাজি নয়, একদম নয়। ওর বাড়ি থেকে জোর করে এই বিয়েটা চাপাচ্ছিল। মেয়ে বলেছে, এই বিয়ে ঠিক হলে ও হয় বাড়ি থেকে পালাবে, না হয় গলায় দড়ি দেবে। বাড়ির লোক এখন খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। তবে পিছিয়ে যায়নি।”
গোরাচাঁদ বলল, “ভীষণ অন্যায় কথা। বাড়ির লোক এভাবে জোর করতে পারে না।”
মানিক বলল, “দাদা, ওর বাড়ির লোক নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। মেয়েকে নিয়ে মাথা ঘামাও। প্রেম করা খেপি মেয়েকে তুমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারো না!”
“আমি কি করব বলেছি! আশ্চর্য!”
“তা হলে তুমি এবার বেঁকে দাঁড়াও। তোমার রিজেকশান স্লিপ পাঠিয়ে দাও।”
“কাকে?”
সলিল কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই নিয়োগী বলল, “গোরা, দিস ইজ দি মোমেন্ট। গোল্ডেন অপারচুনিটি। কথাটা তুই জেঠাইমাকে বলে দে।”
গোরাচাঁদ ভেতরে ভেতরে খুশি হচ্ছিল। প্রেম-করা খেপি মেয়েকে তো তার গলায় ঝোলানো যাবে না। জেঠামশাই জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে খারিজ। ক্যানসেল। বলল, “জেঠাইমাকে বলা কি ঠিক হবে! ওদের ভেতরের কথাবার্তা। তার চেয়ে দিদিকে বলাই ভাল। দিদিকে বলতে পারি।”
“তাই বল।”
“কিন্তু প্রমাণ। দিদি যখন বলবে, কিসের উড়ো খবর শুনে এইসব বাজে কথা বলছিস? ভদ্দরলোকের বাড়ির মেয়ের নামে মিথ্যে গুজব রটানো ভাল নয়। নোংরামির কাজ। বাবা যখন জানতে চাইবে, প্রমাণ কী? তখন? কী বলব বাবাকে?… দিদি তো ভাই ছেলেমানুষ নয়, জামাইবাবুও পাকা লোক।”