নাকমুখ কুঁচকে বমির ভাব করে গোরাচাঁদ বলল, “কে দিল? পুরনো ঘিয়ে আদার রস! তোর কবরেজি?”
ফুটকি বলল, “আমার নয়, জেঠাইমার। জেঠাইমাকে কে বলেছে!”
“ফেলে দে। ভদ্রলোকে ওসব অখাদ্য খায় না। একে পুরনো ঘি তায় আদার রস, তার সঙ্গে মধু। ওদিকে আবার রসুন। কী কম্বিনেশন! ফেলে দে।”
ফুটকি বলল, “ফেলে দিতে হয় তুমি দাও। আমি রেখে যাচ্ছি।”
ফুটকির ভাল নাম লীলা। কাছাকাছি পাড়ার মেয়ে। জেঠাইমার সঙ্গে লীলার মায়ের খুবই বন্ধুত্ব। লীলার বাবা কচিকাচাদের ডাক্তার। একটু খেপাটে। নাম আছে ডাক্তার হিসেবে, পয়সা তেমন নেই।
গোল মতন ছোট বাটিটা রেখে ফুটকি চলে যাচ্ছিল, গোরাচাঁদ বলল, “তুই কি বাড়ি চললি?”
“হ্যাঁ। সাতটা বাজল। বৃষ্টি আসতে পারে।”
“তা যাবার আগে আমাকে কড়া করে এক কাপ চা খাইয়ে যা। আগুনের মতন গরম। গলাটা জ্বলে যাচ্ছে। কেমন বসে আছে দেখছিস না। শব্দ বেরুচ্ছে না। কী রকম শোনাচ্ছে রে আওয়াজটা?”
ফুটকি দু’ পলক দেখল গোরাচাঁদকে। তারপর অক্লেশে বলল, “গাধার মতন। ” বলে চলে গেল।
গোরাচাঁদ থ’ মেরে গেল। ফুটকির কথাবার্তা বরাবরই বেমক্কা। যা মুখে আসে বলে দেয়। কোনও বাদ-বিচার নেই। গোরাচাঁদকে তোয়াক্কা করে না। মান্য তো নয়ই। আসলে মেয়েটা এ-বাড়িতে ছেলেবেলা থেকে আসছে যাচ্ছে বলে ওর কোনো সঙ্কোচ আড়ষ্টতা নেই। কিছুই গ্রাহ্য করে না। আগে তো গোরাচাঁদকে ‘তুই’ বলত। বয়েসে বছর পাঁচেকের ছোট। আজকাল অবশ্য ‘তুমি’ বলে তাও যেন বাধ্য হয়ে। বেশি আস্কারা মেয়ে ও মাথায় উঠেছে। জেঠাইমাই ওকে মাথায় তুলেছে। তবে মেয়েটা ন্যাকা নয়। সাফ-সুফ কথা বলে। এক সময় মেয়েদের ফুটবল খেলত। আঁটসাঁট চেহারা। মাথায় একটু বেঁটে। মেয়েদের স্কুলে ভূগোল পড়ায়। ও আবার জলধরের শালী হয় সম্পর্কে। জলধরের বউয়ের মাসতুতো বোন।
গোরাচাঁদ অবশ্য ‘গাধা’ শব্দটায় খুশি হল না। কিন্তু এখন তার দিন ভাল যাচ্ছে না। যার যা খুশি বলে গেলেও তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। সেই মশলা-বাড়ির মেয়েটা, মানে গুঁড়ো মশলার কারবারি ফটিক দত্তের মেয়েটা, আজ ক’দিন চুপ মেরে আছে। মাঝে একদিন ছাড়া আর ফোন করেনি। ফোন করে অবশ্য সেদিন বলেছে, সোনার চাঁদ গোরাচাঁদকে সে হাতিবাগানের বাজারের কাছে বাগে পেয়েছিল। ইচ্ছে করলেই গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চাঁদের মাথায় চাঁটি মারতে পারত। দয়া করে মারেনি।
তারপর আর ফোন আসেনি। গোরাচাঁদ আজকাল ফোনের ডাক পেলেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়, গলা দিয়ে শব্দ বেরুতে চায় না! দরদর করে ঘামতে থাকে।
বন্ধুদের ওপরেও গোরাচাঁদ বেশ ক্ষুন্ন হয়ে উঠছিল। ওরা কোনও কর্মের নয়। কিছুই করল না। এতদিনের বন্ধু, এত মাখামাখি, ভাব-ভালবাসা, দায়ে অদায়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, সেই বন্ধুরাই তাকে একা হাড়িকাঠের সামনে রেখে সরে থাকল। লাভের মধ্যে গোরাচাঁদের হাজার দেড়েক টাকা গচ্চা গেল। ওই চারু বাঁড়ুজ্যেকে দিতে হয়েছে।
কী করেছে চারু? কিস্যু নয়। মেয়ের নাম ধাম ছবি, মেয়ের বাপের খোঁজ-খবর সব নিয়ে দিব্যি বসে আছে। জলধর কোত্থেকে একটা ফালতু, বাজে লোক ধরে আনল। কে জানে লোকটা চিট ক্লাসের কী না?
বড় দুঃখেই গোরাচাঁদ বড় করে নিশ্বাস ফেলতে গেল, নাক বন্ধ থাকার জন্যে পুরোপুরি ফেলতে পারল না, বাতাস আটকে গেল।
এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। কারা যেন আসছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সলিলরা ঘরে ঢুকল। চার বন্ধু, আর সেই দাড়িঅলা চারু।
“কি রে? তোর নাকি চার পাঁচ জ্বর! হেপাটাইটিস? না, ম্যালেরিয়া?” সলিল বলল।
গোরাচাঁদ বন্ধুদের দেখছিল। বলল, “কে বলল?”
“বাজারে খবর! তা কী হয়েছে তোর? হেভি টাইপের ম্যালেরিয়া?”
“না। কে বলেছে তোদের আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে?”
“হলেই হয়। কলকাতা শহরে আকচার ম্যালেরিয়া হচ্ছে।”
“আমার সর্দিজ্বর হয়েছে। কমন কোল্ড। ইনফ্লুয়েঞ্জা!”
“তাই নাকি! তা ভাল। বাঁচালি।
“ নিয়োগী বলল, “তুই বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিস না?”
“দু’ দিন বেরোইনি। কারখানা অফিস দু’ দিক দেখতে হচ্ছিল। তার ওপর বৃষ্টি বাদলা। ”।
“কেমন আছিস এখন?”
“জ্বর। গলা বুজে আছে। মাথায় যন্ত্রণা। গা-হাত ভেঙে যাচ্ছে।”
মানিক বলল, “সেরে যাবে দাদা। মেরে কেটে সাত দিন। তবে ক্যালকাটা ফিভার হলে দশ পনেরো দিনের ধাক্কা। শরীরটা বেশ উইক করে দিয়ে যাবে। তা তাতে একদিক থেকে ভাল। আষাঢ় মাসটাও তুমি কাটিয়ে দিতে পারবে। শরীর দুর্বল হলে বিয়ে করা যায় না। এখন আমাদের টাইম দরকার। তুমি যদি আরও একটু বেয়াড়া অসুখ বাধাতে পারতে, শ্রাবণ মাসটাও গড়িয়ে দেওয়া যেত।”
ঠিক এই সময় ফুটকি ঘরে এল। গোরাচাঁদের জন্যে গরম কড়া চা এনেছে।
ফুটকিকে দেখেই জলধর বলল, “কী গো? তুমি! যাক, দেখা হয়ে গেল! কোনো খবরই পাই না। কেমন আছ? খবরটবর ভাল?”
ফুটকি হাসল। “আপনারা ভাল?” বলে সলিলদের দিকেও তাকাল। হাসি হাসি মুখ। সলিলরা সকলেই ফুটকিকে চেনে। এবাড়িতেই দেখছে বরাবর।
একমাত্র চারুই ফুটকিকে চেনে না।
জলধর চারুকে বলল, “চারু, আমার শালী লীলা। অনেক ভাগ্যে এমন শালী পেয়েছি। লীলা খেলোয়াড়। লেডিজ ফুটবলে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলত।”
চারু চকচকে চোখ করে হাসল। বলল, “বাঃ। আমি এই প্রথম মেয়ে ফুটবলার দেখলাম। এখনও খেলেন?”