গোরাচাঁদ তখনও ভাল করে কিছু বুঝছিল না। বন্ধুদের দেখছিল।
সলিল বলল, “জলধর একটা কাজের কাজ করেছে। সিবি-ই তোকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে গোরা।”
চারু পাইপের ছাই খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, “উদ্ধার করতে পারব কিনা জানি না। চেষ্টা করব। তার আগে কয়েকটা কথা বলে নিই সলিলবাবু। কলকাতায় আজকাল বেশ কয়েকটা প্রাইভেট ইনটেলিজেন্স এজেন্সি হয়েছে। তারা নানা রকম কাজ করে। এমন কি সিকিউরিটি সার্ভিসও। আমরা সবরকম কাজ করি না। আমাদের ফার্ম ছোট। আমরা স্পেশ্যালাইজড কাজ নিই। তবে খুবই যত্ন করে করি।”
“আপনারা কী কী কাজ করেন?” সলিল বলল।
“প্রথমে মেটরিমোনিয়াল কাজকর্ম। ধরুন, পাত্র বা পাত্রী পক্ষ—সিক্রেটলি কিছু ইনফরমেশান চাইল, ফ্যামিলি সম্পর্কে, ছেলেমেয়ে সম্পর্কে। আমরা সেটা যোগাড় করে দি। তারপর হল ডিভোর্সের ব্যাপারে পার্টিকে তাদের দরকার মতন ইনফরমেশান সাপ্লাই করা। “
মানিক বলল, “বাঃ! বিয়ে আবার বিবাহ-বিচ্ছেদ! আপনারা তো মশাই গাছেরও খান, তলারও কুড়োন!”
চারু বলল, “সরি, গাছ দু জাতের। একই গাছের নয়।”
নিয়োগী বলল, “আর কী করেন স্যার?”
“ব্ল্যাকমেলিং কেস। আপনাকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে—আপনি আমাদের কাছে এসে ক্লায়েন্ট হলেন। তারপর দেখুন সেই ব্ল্যাকমেইলারকে কী করি!”
সলিল বলল, “গোরার কেসটা ব্ল্যাকমেইল বলে চালানো যাবে?”।
“এখনই বলতে পারছি না। সব শুনতে হবে ভাল করে— তারপর ভেবে দেখব।”
জলধর গোরাচাঁদকে বলল, “গোরা, আমি সবই বলেছি যতটা পারি। এবার তুই বল। নিজের কেস নিজে বলাই ভাল। ”
গোরাচাঁদ বলব-কি বলব না করে তার বিপদের কথা বলতে লাগল।।
গোরাচাঁদের বৃত্তান্ত শেষ হল যখন তখন ঘড়িতে সাড়ে ন’টা। গরমের দিন। সাড়ে নটা এমন কিছু রাত নয়। আচ্ছা ভাঙতে প্রায়ই দশ সোয়া দশ বেজে যায়। কাজেই জলধররা কেউ চঞ্চল হল না।
সিগারেট খুঁজতে খুঁজতে সলিল চারুর দিকে তাকাল। অর্থাৎ বলতে চাইল, শুনলেন তো সব—এবার বলুন কী করা যায়?
চারু কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। ভাবছিল। চোখ বন্ধ করে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চোখ খুলল। তারপর গোরাচাঁদকে বলল, “আপনি কী করতে চান?”
“আমি! আমি কী চাইব?”
“মানে মেয়েটিকে বিয়ে করতে চান? না, তাকে হটাতে চান?”
ওই মেয়েকে বিয়ে! অসম্ভব! মশাই, ওই মেয়েকে কেউ বিয়ে করে? কালীর খাঁড়া। ডেনজারাস মেয়ে। অসভ্য, ভালগার, পাজি…। না, ওকে আমি বিয়ে করব না। নেভার।”
“বাড়িতে একবার বলে দেখুন না?”
“আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে বাড়িতে বলব! আমার জেঠামশাইকে আপনি চেনেন না।জেঠার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাধ্য আমার নেই। এমনিতেই বাড়িতে বিয়ের বাজার বসে গেছে। আজ বেনারসি, কাল বালুচরি, পরশু স্যাকরা, তরশু ফার্নিচার…। না মশাই ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। তবে হ্যাঁ, দিদি এলে বলতে পারি। দিদি দুর্গাপুর থেকে কবে আসবে তাও জানি না। এদিকে দেখতে দেখতে দিন চলে যাচ্ছে…।”
জলধর বলল, “চারু, বিয়েটা ভেঙে যাওয়াই দরকার। মেয়েটাকে তুই প্যাঁচে ফেলে দে। এমন কিছু একটা কর, যাতে মেয়ে পক্ষের আর মুখ না থাকে কিছু বলার। দু একটা ব্ল্যাক স্পট লাগিয়ে দে। এমনিতেই বিয়ে ভেঙে যাবে।”
গোরাচাঁদ তাড়াতাড়ি বলল, “না না, নোংরা কিছু করবেন না। হাজার হোক ভদ্রবাড়ির মেয়ে। ব্ল্যাক স্পট লাগালে কেচ্ছা হয়ে যাবে। সেটা উচিত নয়।”
মানিক রগড় করে বলল, “উঃ, দাদার যে বড় দরদ। তোমার ক্যারেকটারে যখন স্পট লাগাল। ”
“সবাই সব পারে না। আমি ভদ্রলোক। ইতরামি করতে পারব না।”
চারু বলল, “আসলে আপনি চাইছেন, সাপও মরে, লাঠি না ভাঙে। তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“বেশ দেখি কী করতে পারি! তা এ সব করতে হলে কিছু টাকা পয়সা লাগবে। কত তা বলতে পারছি না। হাজার দুই চার হতে পারে।”
গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে জানাল, তার আপত্তি নেই।
চার
জ্যৈষ্ঠ মাসের ফাঁড়াটা কাটল। জেঠাইমার দয়ায়। এখন আষাঢ় চলছে। পাঁজিতে আষাঢ় মাসের মাঝামাঝির আগে বিয়ের দিন নেই। প্রথমটা দিনটা পড়েছে বৃহস্পতিবার, দ্বিতীয়টা শনিবারে। বৃহস্পতিবারে জেঠাইমা বিয়ে দেবে না। শনিবারে মেয়ের তরফে আপত্তি। কাজেই সেই একেবারে আষাঢ়ের শেষে সোমবার দিনটাই মোটামুটি ঠিক। আর তা না হলে শ্রাবণের গোড়ায়।
আষাঢ় মাসের দু’ একটি দিন, গোড়ায় গোড়ায়, আকাশ ঘোলাটে, মেঘ হল, বৃষ্টি হল না। তারপর বৃষ্টি নামল। দিন দুই ভাল বৃষ্টি হল। আবার রোদ। রোদ-বৃষ্টির মাঝখানে পড়ে গোরাচাঁদের সর্দি লেগে গেল। বর্ষার সদি। জেঠামশাই অন্য কাজে ব্যস্ত বলে গোরাচাঁদকেই সোদপুরের কারখানা আর শোভাবাজারের অফিস সামলাতে হচ্ছিল। এমন সময় সর্দিজ্বর।
গোরাচাঁদ জ্বর গায়ে সেদিনও বেরুতে পারেনি। জ্বর ততটা নয়, একশো এক ছুঁয়েছে, কিন্তু নাক, গলা, মাথার অবস্থা খারাপ। নাক বুজে আছে, গলায় অসম্ভব ব্যথা। টনসিল ফুলেছে, গলার স্বর ভাঙা। মাথার কথা আর কী বলবে গোরাচাঁদ—ছিঁড়ে যাচ্ছিল যেন। ভীষণ যন্ত্রণা।
সন্ধেবেলায় গোরাচাঁদ খানিকটা গরম নুনজলে গার্গল করে ঘরে আসতেই দেখল, ফুটকি কী একটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভাঙা গলায় গোরাচাঁদ বলল, “ওটা কী রে?”
ফুটকি বলল, “পুরনো ঘিয়ে আদার রস, রসুন, মধু দিয়ে মেড়ে কফের ওষুধ। বুকের সর্দি তুলে দেবে। গলা পরিষ্কার হবে।”