সলিল বলল, “বোস আগে। মাথা ঠাণ্ডা কর। জল খা।” বলে পাশ থেকে জলের বোতল বাড়িয়ে দিল।
গোরাচাঁদ জলের বোতল নিল না। বলল, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাড়ি ছাড়া করাবে ওই মেয়েটা। আমার সুখস্বস্তির বারোটা বাজিয়ে দিল।”
সলিল বলল, “আবার কী হল? এখনও ফোন করছে?”
“কাল করেনি। আজ করেছিল। আমাদের অফিসে। ভাগ্যিস জেঠামশাই তখন ছিল না?”
“কখন করেছিল।”
“এই তো বিকেলের পর, ছ’টা সোয়া ছটা।”
“তুই তা হলে তোদের অফিস থেকেই আসছিস?”
মাথা হেলিয়ে গোরাচাঁদ বলল, “না এসে পারলাম না। তোরা আমার অবস্থাটা যদি বুঝতিস!”
নিয়োগী বলল, “কী বলল মেয়েটা?”
“যা মুখে আসে বলে গেল। আমাকে নিয়ে রগড় করল, টিজ করল। …আমায় কী বলে জানিস? কত বড় আস্পর্ধা! বলল, তোমার যা বুদ্ধি গোরাচাঁদ—ছাগলের মাথাও তার চেয়ে সাফ। টুকেমুকে বি কম পাস করেছিলে, পেছনে তোমার জেঠা এক জোড়া ঠেলা লাগিয়েছিল পয়সা খরচ করে। ওই বুদ্ধি নিয়ে তুমি গেঞ্জির ব্যবসা করবে! যতদিন জেঠামশাই আছে, তারপর তো তোমায় সকলে লুটেপুটে খাবে। তুমিও দু হাতে পয়সা উড়িয়ে রাস্তায় দাঁড়াবে। তোমার যে কত মুরোদ আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। না আছে বিদ্যে না বুদ্ধি! তোমার মতন অপদার্থকে বিয়ে করে আমি কি শেষে হাঁড়ি মেজে মরব। ওটি হচ্ছে না। “
জলধর বিস্ফারিত বদনে বলল, “বলিস কী! এসব কথা বলল তোকে। ছাগল বলল।”
“ছাগলের চেয়েও খারাপ বলল। …ছুঁচোটুচোও বলল।”
“আর কী বলল?”
“বলল, আমার স্বভাব-চরিত্র খারাপ।”
“স্বভাব-চরিত্র খারাপ?” মানিক হাতের তাস ফেলে দিয়ে থ’মেরে বসে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর দু হাতে মুখ ঢেকে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। “ওঃ, ভাবা যায় না। দাদার স্বভাব হল ঝরনার জল। স্ফটিক স্বচ্ছ! বিশুদ্ধ, জার্ম ফ্রি, ব্যাকটেরিয়া মাইনাস। এমন স্বভাব লাখে একটাও পাওয়া যায় না। সেই দাদাকে কিনা স্বভাব নিয়ে কথা বলা! ছি ছি! এ তো মানহানির মামলা আনা যায়!”
মানিককে থামিয়ে দিয়ে নিয়োগী বলল, “গোরা, স্বভাবের সঙ্গে চরিত্রও বলল? তোর চরিত্র? মানে ক্যারেকটার?”
গোরাচাঁদ এবার গলা চড়িয়ে বলল, “বলল মানে? এমন একটা খারাপ কথা বলল শুনলে তোরা কানে আঙুল দিবি।”
জলধর গলা বালিয়ে বলল, “কী খারাপ কথা বলল? ইয়ের কথাটথা—?”
“বলল, আমি একটা মেয়ের সব লুটেপুটে নিয়েছি। মেয়েটাকে চিট করেছি। তাকে পথে বসিয়ে এখন দিব্যি সাধুপুরুষ সেজে বিয়ে করতে যাচ্ছি অন্য মেয়েকে। আমি বজ্জাত, বেহায়া, ক্রিমিন্যাল। আমাকে জেলে দেওয়া উচিত।”
সলিল আর নিয়োগী মাথা নাড়তে নাড়তে একসঙ্গে বলল, “দিস ইজ টু মাচ। আর টলারেট করা যায় না।”
মানিক বলল, “দাদা, লুটেপুটে খাওয়া মেয়েটার নাম বলল?” বলে আড়চোখে তাকিয়ে থাকল।
“না।” গোরাচাঁদ প্রায় ধমকে উঠল। “নাম বলবে! কিসের নাম? কার নাম? আমি কি তোমার মতন মেয়ে-হ্যাংলা!…” বলে সলিলদের দিকে তাকাল গোরাচাঁদ। বলল, “আমার ভীষণ লেগেছে, ভাই। জীবনেও এত খারাপ, বাজে, মিথ্যে কথা শুনিনি। ভদ্রলোকের ছেলে একেবারে ইতর হয়ে গেলুম। তোমরা হয় কিছু করো, না হয় বন্ধুত্ব শেষ করে দাও।”
বন্ধুরা চুপচাপ। মুখ নিচু করে বসে থাকল যেন।
শেষে জলধর বলল, “ভাবিস না গোরা, আমি আছি। তোর হয়ে লড়ে যাব। দেখছি মেয়েটাকে। “
তিন
দিন কয়েক পরে গোরাচাঁদ বন্ধুদের আড্ডায় এসে দেখল, নতুন একজনের আবির্ভাব ঘটেছে সেখানে। এ মুখ তার দেখা নয়, চেনাও নয়। তাদের এই আড্ডায় তারা চার পাঁচ জন নিয়মিত আড্ডাধারী ছাড়াও মাঝেমাঝে অনিয়মিত দু একজন গল্পগুজব করতে চলে আসে। তারাও বন্ধুস্থানীয়। কিন্তু এই নতুন মানুষটিকে গোরাচাঁদ কখনও দেখেনি।
গোরাচাঁদকে দেখেই জলধর হাত বাড়িয়ে ডেকে নিতে নিতে বলল, “আয় গোরা, তোর জন্যে হাঁ করে বসে আছি। একটু দেরি করে ফেললি।”
দেরি সামান্য হয়েছিল গোরাচাঁদের। নিয়োগী খবর দিয়েছিল, সাতটা নাগাদ চলে আসবি। জরুরি ব্যাপার আছে।
এখন প্রায় পৌনে আট।
মানিক বলল, “দাদা, তুমি কি রাত আটটার প্রোগ্রাম শেষ করে আসছ?”
গোরাচাঁদ কোনো জবাব দিল না কথার। মানিকটা দিন দিন বড় বেশি চ্যাংড়া হয়ে উঠছে।
জলধর বলল, “গোরা, আলাপ করিয়ে দিই। এ হল আমার পুরনো বন্ধু। চারু ব্যানার্জি। আমরা সিবি বলে ডাকতাম। স্কটিশে আমার ক্লাসমেট ছিল। সিবি এখন ঈগল এজেন্সির পার্টনার।” বলে সিবির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “চারু, এই আমাদের গোরা। এর কথাই তোমাকে বলেছিলাম। বেচারির একেবারে যায়-যায়, অবস্থা। তোমায় কিছু একটা করতেই হবে।”
ঠিক নমস্কার নয়, চোখে চোখে এক রকম আলাপের সৌজন্য বিনিময় হল। চারুর চোখে ঈষৎ হাসি, গোরাচাঁদের চোখে খানিকটা কৌতূহল।
গোরাচাঁদ দেখছিল চারুকে। বেশ টগবগে চেহারা, ধারালো নাকমুখ, গায়ের রং কালচে। চারু গোরাচাঁদেরই সমবয়েসি হবে। গালে পাতলা দাড়ির জন্যে খানিকটা যেন ব্যক্তিত্বময় বলে মনে হয়। হাতে পাইপ।
সলিল বলল, “বোস গোরা, এখানে আয়। তোর কথা জলধর সবই বলেছে সিবিকে। …ফারদার তোর যদি কিছু বলার থাকে বলতে পারিস।”
গোরাচাঁদ বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না… উনি…!”
জলধর বলল, “উনি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। ঈগল পাখি মানে লোকের হাঁড়ির খবর টেনে বার করা ওঁর পেশা। অবশ্য টাকা দিয়ে চারুকে ভাড়া করতে হয়। …তোর কপাল ভাল গোরা, চারুকে আমি পেয়ে গেলাম। একেবারেই হঠাৎ দেখা আমাদের অফিসের সামনে। অনেক কাল পরে। চারু বলল, ও এখন ঈগল এজেন্সিতে কাজ করছে। পার্টনার। ওকে পেয়ে আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলুম। মনে হল, চারু আমাদের কাজে আসতে পারে। দারুণ হেলপ হবে। তোর কথা বললুম। আজ ওকে আসতে বলেছিলুম এখানে—তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমরাও সবাই থাকব। ভাল করে সব কথা বলা যাবে।”