“চেহারা, স্বভাব। হোয়াট নট! যা প্রাণে চাইছিল বলে গেল। তারপর শেষে বলল, পয়সা ছড়ালে কাকের অভাব হয় না বুঝলে নাড়গোপাল। তোমার মতন পাত্তর আমার পাশে দাঁড়াবার যুগ্যি নয়। আমার বাপ অনেক ভাল ভাল পাত্তর আনতে পারে—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিএ, সরকারি অফিসার। তুমি তাদের কাছে গোল্লা। হনুমান!”
“হনুমান?” মানিক আঁতকে উঠল। “দাদা, তোমায় হনুমান বলল! কী মেয়েরে বাবা! এ তো অত্যন্ত অসভ্য, বেয়াদপ!”
এমন সময় চা এল গোরাচাঁদের।
চা দিয়ে বাচ্চা মেয়েটা চলে যেতেই গোরাচাঁদ কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “কী বলব ভাই! রোজ রাত আটটার পর মেয়েটা ফোন করে আর একতরফা যা মুখে আসে বলে যায়। শেষে কাল বলল, শোনো নদের চাঁদ তোমায় ওয়ার্নিং দিয়ে দিচ্ছি, তুমি যদি গাড়ি সাজিয়ে টোপর হাতে সত্যিই বিয়ে করতে আস, বিপদ হবে। পাড়ার ছেলেদের বলে রাখব, বোমা মেরে তোমার বিয়ের সাধ ঘুচিয়ে দেবে।”
নিয়োগী সভয়ে বলল, “সে কিরে? পাড়ার ছেলেদের লেলিয়ে দেবে বোমা মারতে। এ তো মাইরি পলিটিক্যাল নেতাদের মতন কথা হল! মেয়েটা তো ডেনজারাস।”
গোরাচাঁদ বলল, “আমিও কাল মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। স্ট্রেট বলে দিয়েছি—গুঁড়ো মশলার মেয়ে বিয়ে করতে আমার বয়ে গেছে। যত্ত ভেজাল!”
সলিলের যেন রোমহর্ষ অনুভূতি হল। বলল, “তুই বললি?”
“বললাম। কালোকে কালো বলব—তাতে ভয় কিসের! ওরা তো গুঁড়ো মশলার বাড়ির লোক। মেয়ের বাপের গুঁড়ো মশলার বিজনেস। অন্নপূর্ণা গুঁড়ো মশলা! আমাকে যদি ও গেঞ্জি জাঙ্গিয়ার ব্যবসাদারের ছেলে বলতে পারে—আমি ওকে গুঁড়ো মশলা বলতে পারব না? আমাদের সাতাশ বছরের হোসিয়ারি কারখানা। হোসিয়ারি বিজনেসে সুতো ভালমন্দ হতে পারে— কিন্তু ভেজাল চলে না। ওরা ভেজাল। আমরা নির্ভেজাল।
বন্ধুরা প্রথমটায় কথা বলতে পারল না। গোরাচাঁদকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
নিয়োগী শেষমেশ কথা বলল। “গোরা, তুই ঠিক করেছিস। রাইটলি সার্ভড। তোর কারেজ দেখে জয় হিন্দ বলতে ইচ্ছে করছে।”
জলধররা হেসে ফেলল। অবশ্য অট্টহাস্য নয়। মুচকি হাসল।
সলিলদের অ্যাটর্নি অফিস। বাপকাকার আমলের। আইনটা তার মাথায় আসে চট করে। ঠিক আইন নয়, তবে আসল কথাটা সে না বলে পারল না। বলল,”গোরা, কেস তুই কাঁচাতে চাইলেও কি পারবি? তোর জেঠামশাই! বলেছিস তাঁকে?”
গোরাচাঁদ বলল, ভয়ভয় গলায়, “না ভাই, বলিনি। জেঠামশাইকে কি এসব কথা বলা যায়! বিশ্বাসই করবে না। বড় এক বগ্গা মানুষ। তার ওপর ওই গুঁড়ো মশলার সঙ্গে জেঠামশাইয়ের খাতির জমে গেছে। আমি যদি বলি, মেয়েদের বাড়ি থেকে মেয়েটা রোজ রাত্তিরে আমায় ফোন করছে, জেঠামশাই ভাববে, আমি তলায় তলায় ইয়ে করছি। বলবে, রাস্কেল—তুই বললেই আমি মেনে নেব—ও-বাড়ির থেকে মেয়েটি তোকে ফোন করে। বিয়ের আগেই। তুই আমায় সহবত শেখাবি! আসলে তোর কোনো বদ মতলব আছে।”
জলধর মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক। জেঠামশাইকে একথা বলা যায় না। বলা উচিত নয়।”
নিগোগী বলল, “তা হলে জেঠাইমাকে বল।”
“জেঠাইমা মানেই জেঠামশাই। বলার সঙ্গে সঙ্গে জেঠার কানে চলে যাবে।”
“তা হলে?”
মনমরা মুখ করে গোরাচাঁদ বলল, “বড়দের কানে উঠলেই—এবাড়ি ওবাড়ি ঝগড়া লেগে যাবে। তারপর ধর হাজার হোক, ওরা মেয়ে পক্ষ! মেয়ের বাপ-মা যখন মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে—সে বড় কেলেঙ্কারি হবে। একটা মেয়ের পক্ষে নিজের প্রেস্টিজ বাঁচানো বড় কথা। …না, আমি অতটা অসভ্যতা করতে পারব না। এক আমি দিদিকে বলতে পারি! কিন্তু কোথায় দিদি? সে না আসা পর্যন্ত কিছুই করতে পারছি না।…সত্যি বলতে কি, আমি চাইছি, অন্য রকম কিছু করতে, যাতে এই নেগোসিয়েশানটা নিজের থেকেই ভেঙে যায়। …তোরা আমায় বাঁচা।”
মানিক বলল, “কেমন করে?”
গোরাচাঁদ বলল, “কেমন করে—সেটা তোরা ঠিক কর। তোরা আমার বন্ধু। বন্ধু হয়ে যদি এসময়ে আমায় না দেখিস, কবে দেখবি! আমি তোদের কাছে এসেছি বিপদে পড়ে। যা হয় তোরা কর।”
বন্ধুরা চুপ। কী বলবে! হঠাৎ জলধর বলল, “দাঁড়া, দেখছি। ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।”
দুই
মাঝে একটা দিন বাদ গেল। তার পরের দিন গোরাচাঁদ ট্যাক্সি করে এসে হাজির। বাড়ির সামনে ডিজেল ট্যাক্সির বিকট আওয়াজ মিলোতে না মিলোতেই গোরাচাঁদ যেন টলতে টলতে ঘরে ঢুকল। চোখ লালচে, মুখ টকটক করছে, ঘামছিল দরদর করে। জামার বোতাম খোলা। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঘটেছে। গোরাচাঁদের এমন চেহারা বড় একটা দেখা যায় না।
ঘরে এসে গোরাচাঁদ বন্ধুদের তাস খেলা দেখতে দেখতে ক্ষোভের গলায় বলল, “তাস খেলছিস! খেল! সারা জীবন তাসই খেলে যা?”
সলিল বন্ধুকে দেখতে দেখতে বলল, “কেন, কী হয়েছে?”
“না, হবে আবার কী! কিছুই হয়নি। আমি শুধু তোদের দেখছি। তোরা আমার বন্ধু! ভাবতেও কষ্ট হয়। হাউ সেলফিশ!”
নিয়োগী বলল, “কী হয়েছে বলবি তো! ঘরে ঢুকেই হেঁয়ালি শুরু করলি!”।
মানিক হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। বলল, “দাদা, তুমি বোসো। আগে বোসো।”
“বসব! আমার বসার দরকার নেই! আমি তাস খেলতে আসিনি।”
জলধর বলল, “নতুন কিছু হয়েছে বুঝি? বেজায় খেপে গিয়েছিস?”
গোরাচাঁদ বলল, “খেপে গিয়েছি। খেপে যাওয়া তো সামান্য ব্যাপার ; আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সারা গা জ্বলে যাচ্ছে! মাথা কেমন করছে!”