বন্ধুরা যেন বুঝতে পারছিল না, শিষ্ট মার্জিত নম্র গোরাচাঁদ হঠাৎ এভাবে বিগড়ে গেল কেন? ও কি সত্যিই বিগড়েছে? না, তামাশা করছে? চেহারা দেখে তো মনে হয় না তামাশা করছে!
জলধর যেন তখনও বিশ্বাস করেনি। বলল, “তুই বেটা সত্যি বলছিস? না, নাটক করছিস?” বলে বন্ধুদের সঙ্গে একবার চোখাচুখি করে নিল।
“সত্যি বলছি।”
“হয়েছেটা কী?”
“বললাম তো, মেয়েটা আমাকে ইনসাল্ট করেছে। একবার নয় অনেকবার। কালও আমাকে যা-তা বলেছে।”
“কেন?”
“আমি কেমন করে জানব?”
“তুই কিছু করেছিলি?”
গোরাচাঁদ আরও বিরক্ত হল। বলল, “আমি কিছু করব? মানে? আমি তাকে চোখেই দেখিনি। সে তুই দেখেছিস।”
কথাটা মিথ্যে নয়। সম্বন্ধ-করা বিয়ে। জেঠামশাইয়ের এক বন্ধু সম্বন্ধটা দিয়েছিল। জেঠামশাই জেঠাইমা দিদি মেয়ে দেখেছে। আর গোরাচাঁদ ও তার বন্ধুদের তরফে দেখেছে জলধর।
মানিক রঙ্গ করে বলল, “চোখে দেখনি বোলো না দাদা, বলো ফটো দেখেছ—ফেস টু ফেস হওনি।”
সলিল বলল, “এই মানিক, চুপ কর। ব্যাপারটা শুনতে দে।” বলে গোরাচাঁদের কাছাকাছি গিয়ে বসল। “ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বল। হয়েছেটা কী?”
গোরাচাঁদ সামান্য সময় চুপ করে থাকল। বলল, “কী বলব! গত হপ্তায় যখন এখানে এলাম—তোদের বললাম, জেঠামশাই এই জষ্টি মাসেই বিয়ের তারিখ ঠিক করবে বলেছে। মেয়েদের তরফও তাই চায়। জেঠাইমা বলছে, আষাঢ়। জ্যৈষ্ঠমাসে নাকি বড় ছেলের বিয়ে দিতে নেই।”
নিয়োগী বলল, “তোর আর বড় ছোট কী! তুই তো একটাই।”
সলিল বলল, “ছেড়ে দে, যাহা বাহান্ন তাহা তিপান্ন, জষ্টিমাস আর আষাঢ় মাসে তফাতটা কী!… তারপর কী হল বল?”
গোরাচাঁদ বলল, “মাস নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বিশ্বাস কর। তা গত হপ্তায় এখান থেকে ফিরে গেলাম—সেটা তোর শনিবার। রবিবার সন্ধেবেলায় এক ফোন।”
“ফোন?”
“বাড়িতে। ফোন তুলতেই একটা মেয়ের গলা। কী বলল জানিস?”
“কী?” বন্ধুরা এসঙ্গে বলল।
“বলল, কী গো নদের চাঁদ কেমন আছ?”
“নদের চাঁদ?”
“বিশ্বাস কর, প্রথম কথাই বলল, কী গো নদের চাঁদ, কেমন আছ? আমি ভাই একেবারে হকচকিয়ে গেলাম। বুঝতেই পারলাম না কী ব্যাপার। আজকাল ফোনে যা সব কাণ্ড হয় তোরা জানিস। কিছু চ্যাংড়া আজেবাজে কথা বলে, অসভ্যতা করে। চেংড়িরাও করে ভাই। থার্ড ক্লাস কথাবার্তা বলে। তা আমি বললাম, কাকে চাই? কে নদের চাঁদ?.. তখন মেয়েটা বলল, আহা, ঢং কোরো না। তোমাকেই চাই! গোরাচাঁদ না কালাচাঁদ! কী নাম রে? ভদ্রলোকের ওই সব নাম হয় নাকি? শোনো নদের চাঁদ, বিয়ে করতে সাধ হয়েছে—নামটা পালটাতে পারোনি। যাও কোর্টে গিয়ে এফিডেভিট করে নামটা আগে পালটে নাও। টেলিফোনের পাঁজিতে ভাল ভাল নাম পাবে। বুঝলে? নামের কী বাহার? গোরাচাঁদ! অখাদ্য। আবার করেন কী, না—গেঞ্জি জাঙ্গিয়ার ব্যবসা! ছিছি! ওই ছেলের আবার বিয়ে করতে সাধ! নোলা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে! লজ্জাও করে না?”
বন্ধুরা অবাক। বিশ্বাস করতে পারছিল না। জলধর বলল, “যাঃ, কী বলছিস! তোকে এসব কথা বলল? একটা মেয়ে? তাও আবার যে-মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা ফাইন্যাল হয়ে গিয়েছে।”
গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে সদুঃখে বলল, “শুধু ওইটুকু বলল নাকি! আরও কত কী বলল। অসভ্যের মতন। তারপর আরও বলল, কাল আবার ফোন করব। রাত আটটা নাগাদ। ফোন ধরবে। না ধরলে তোমার বারোটা বাজিয়ে দেব। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব—বুঝলে কালাচাঁদ। আমায় তুমি চেনো না।”
সলিল বন্ধুদের মুখের দিকে তাকাল। শেষে গোরাচাঁদের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলল, “গোরা, দিস ইজ নট পসিবল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। বিয়ে আমরাও করেছি। আমাদের বউরাও কম তেঁয়েটে নয়। তা বলে তারা বিয়ের আগে এভাবে কথা বলেনি। সে সাহস ছিল না।”
মানিক বলল, “দাদা, তুমি কি ফোন ধরার সময় হুঁশে ছিলে?”
“মানে?”
“মানে নরম্যাল ছিলে তো? কান ঠিক ছিল! তোমার আবার কানের দোষ আছে একটু।”
“বাজে কথা বোলা না।”
নিয়োগী বলল, “গোরা, মেয়েটার গলা শুনে তুই চিনতে পারলি?”
গোরাচাঁদ রেগে গিয়ে বলল, “আমি কি মেয়ের গলা শুনেছি? না, তাকে চোখে দেখেছি।”
“তবে কেমন করে বুঝলি ওই মেয়েটাই ফোন করছে?”
“বাঃ, অদ্ভুত কথা। কেমন করে বুঝলি! মেয়েটা অত কথা বলে যাচ্ছে, হাসছে হি হি করে, টন্ট করছে—আর আমি বুঝব না! আমি কি গাধা! তা ছাড়া ও তো বুঝিয়েই দিল—এই হল সেই মেয়ে যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
সলিল বলল, “তুই নাম জানতে চাইলি না?”
“চেয়েছি। বলেছে, ন্যাকামি কোরো না! নাম না বললে চিনতে পারছ না, না?”
জলধর বলল, “সেই মেয়েই। কমলিকা। আমি তো ওকে দেখেছি। কথাও শুনেছি। মেয়েটাকে দেখতে ভাল। তবে ভেতরে বিচ্ছু বলে মনে হল। যে-ভাবে টেরচা চোখে আমাকে দেখছিল। গলার স্বরটা একটু ভাঙা ভাঙা, না কিরে গোরা?”
গোরাচাঁদ বলল, “ভাই, ফোনে গলা শুনে বোঝা যায় না। অচেনা গলা। তবে জোর আছে গলার। ধমক মেরে কথা বলে। “
মানিক বলল, “পরের দিন তোমাকে ফোন করেছিল আবার?”
“করেছিল। আটটার পর পরই।”
কী বলল?”
“ন্যাস্টি কথাবার্তা।”
“অশ্লীল কিছু?”
“নানা, ভালগার টাইপের কথাবার্তা! আমায় কেমন নাড়ু-নাড়ু দেখতে ! চোখ লিচুর মতন, নাক ভুটানিদের টাইপ। আমার নাকি গলগণ্ড রোগ আছে।”
“গলগণ্ড! তোমার? কই আমরা তো দেখছি না। বরং তোমার গল বেশ গোলগাল। তা শুধু চেহারার কথা বলল?”