“ইয়ার্কি! তোমার মতন অসভ্য নাকি সবাই, যে নিজেদের কীর্তি ছাপাবে।!”
“আরে না, কীর্তি ছাপাবে কেন। বাংলা গল্প উপন্যাস থেকে বাছাই করে নেওয়া চিঠি। প্রেমপত্র।”
“বইটা আছে তোমার?”
“এখন আর পাচ্ছি না। কে যে পড়তে নিয়ে চুরি করে নিল! সকলেরই দরকার পড়ে তো!” বলে হেসে ফুলরেণুর হাত ধরে বুকের ওপর টেনে নিয়ে বলল, “তুমিই চুরি করেছিলে নাকি? তুমি যা চোর। ইউ আর এ টুকলি।”
স্বর্ণকমলের বুকে লজ্জায় মুখ রেখে কিছুক্ষণ পড়ে থাকল ফুলরেণু। তারপর মুখ ঘুরিয়ে স্বর্ণকমলের কানের দিকে ঠোঁট নিয়ে বলল, “আর তুমি যে আমার প্রশস্তি গাইতে, মন ভোলাতে সেও তো তোমার কালিদাসের টুকলি। তুমি চোরের বেশি বাটপাড়।”
স্বর্ণকমল হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, “এ সব চুরিতে দোষ নেই।…কি বল।”
ফুলরেণু পিঁপড়ের মতন নিশব্দে স্বর্ণকমলের কানের লতি কামড়ে দিল।
গোরাচাঁদ
গোরাচাঁদ ঘরে আসতেই বন্ধুরা তাকে সহর্ষে অভ্যর্থনা জানাল। আয় গোরা, আয়; একটু আগেই তোর কথা হচ্ছিল। হপ্তাখানেক দেখা নেই—ভাবছিলাম হল কী! জলধর কালই তোর বাড়ি যেত। তা তোর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল?
বন্ধু বলতে ঘরে তখন তারা চারজন। সলিল, জলধর, নিয়োগী আর মানিক। ওরা তাস খেলছিল। বেশির ভাগ দিন সন্ধেটা ওদের তাস খেলেই কেটে যায়। সলিলদের বাড়ির বৈঠকখানার নামই হয়ে গিয়েছে ‘তাসের ঘর’।
গোরাচাঁদ খুবই বিমর্ষচিত্তে ঘরে ঢুকেছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, জবরদস্ত ডেঙ্গুজ্বর কিংবা ম্যালেরিয়ায় ভুগে সবে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। চোখমুখ শুকনো, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, দাড়ি কামানো হয়নি ভাল করে, চোখের চশমা ঢিলে হয়ে নাকের ডগা পর্যন্ত গড়িয়ে এসেছে। এরকম হবার কথা নয়, অন্তত এখন।
হাতের তাস হাতে রেখেই জলধর বন্ধুকে দেখছিল। বলল, “কিরে গোরা, তোর এ হাল কেন? অসুখ-বিসুখ করেছিল নাকি? আমার বাড়ির ফোনটা ডেড, নয়ত তোকে—।”
গোরাচাঁদ কোনও কথা বলল না। একেবারে কোণের দিকে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল।
নিয়োগী বলল, “বিয়ে পেছিয়ে গেল নাকি রে? মন খারাপ? আরে মন খারাপ হবার কী আছে! গরমে বিয়েটা ঠিক জমে না। গরম বর্ষা পার করে দে—মাত্তর তো আর চার পাঁচটা মাস, তারপর লাগা। অর্লি অঘ্রানে। নরম শীতে নতুন বউ…ফাইন!”
গোরাচাঁদ বেশ বিরক্ত হয়ে নিয়োগীকে দেখল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “জলের বোতলটা দে।”
বন্ধুরা তাস খেলতে বসলে চায়ের কাপ খাবারের প্লেটের সঙ্গে কয়েকটা জলের বোতলও জমে যায়।
মানিক জলের বোতল এগিয়ে দিল। বলল, “খালি পেটে জল খাবে দাদা? একটু তলানি আছে। দেব?” বলে হাসল। বন্ধুদের মধ্যে মানিক হল জুনিয়র।
গোরাচাঁদ ও-সব নেশার জিনিস খায় না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একবার দশ বিশ ফোঁটা খেয়েছিল। মিলিটারি মাল। তাতেই তার জিব জড়িয়ে গিয়ে সে কী অবস্থা! পান সিগারেট ছাড়া গোরাচাঁদের আর কোনও নেশা নেই। তার বন্ধুরাও ঠিক নেশুড়ে নয়, তবে মাঝেমাঝে দু-এক পাত্তর চড়িয়ে নেয়।
জল বেশি ছিল না। যেটুকু ছিল খেয়ে নিল গোরাচাঁদ। তারপর বলল, “একটু চা হলে হত।”
সলিল বলল, “চা হবে। আগে বল, তোর হয়েছে কী?”
“সে অনেক কথা। বলছি। আগে একটু চা…।”
সলিল উঠে গেল চায়ের কথা বলতে।
জলধর বলল, “আমরা তো তোর বিয়ে নিয়েই কথা বলছিলাম। ভাবছিলাম তোকে বলব, তোর জেঠামশাই ওল্ডম্যান, তাঁকে আর কষ্ট দেওয়া কেন! তোর বিয়ের ব্যাপারটা আমরাই ম্যানেজ করে দেব। এই ধর বিয়ের চিঠি, প্যান্ডেল, খাওয়া-দাওয়া, লোকজনকে আপ্যায়ন…।”
জলধরের কথা শেষ হল না, গোরাচাঁদ বলল, “বিয়ে হচ্ছে না। আমি করছি না। ”
বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠল, “সে কি রে? কেন? সব ঠিক হয়ে গেল—এখন— ?”
সলিল ফিরে এল।
সলিল ফিরে আসতেই মানিক বলল, “সলিলদা, শোনো গোরাদা কী বলছে! বিয়ে করছে না গোরাদা।”
সলিল দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল গোরাকে। অবাক হয়ে বলল, “বলিস কিরে! সত্যি নাকি?”
গোরাচাঁদ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। এই বিয়ে করছি না।”
“কেন?”
“আমাকে বিচ্ছিরিভাবে ইনসাল্ট করেছে। যা-তা বলেছে মেয়েটা।”
“মেয়েটা! কোন মেয়েটা?”
“ওই মেয়েটা, কমলিকা না মালবিকা— কী যেন নাম ওটার।” গোরাঁচাদ রীতিমতন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের গলায় বলল। নামটাও যেভাবে বলল—মনে হল,ওই মেয়ের নাম মনে রাখারও যেন তার প্রয়োজন নেই।
তাস খেলার পাট চুকে গেল। হাতের তাস ফেলে বন্ধুরা পরম কৌতুহলে গোরাচাঁদকে দেখতে লাগল। ব্যাপারটা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। গোরাচাঁদ কোনও কালেই বদমেজাজি নয়, হঠকারিও নয়। রুক্ষ রূঢ় সে হতে পারে না কোনও অবস্থাতেই। ওর স্বভাব নরম। নিরীহ ভিতু ধরনের মানুষ। সাদামাটা সরল। তার জেঠামশাইয়ের একান্ত বাধ্য ও অনুগত। অবশ্য তার কারণ আছে। গোরাচাঁদের বাবা যখন মারা যান গোরার বয়েস তখন তিন। জেঠামশাই জেঠাইমাই তাকে মানুষ করেছেন।
মা অবশ্য ছিলেন। কিন্তু ওর তেরো চোদ্দো বছর বয়েসে মা-ও চলে যান। জেঠামশাই জেঠাইমাই তার সব। জেঠামশাইদের কোনো ছেলে নেই, একটি মেয়ে আছে—গোরাচাঁদের দিদি। দিদিও অনেক দিন ধরে অন্য সংসারের লোক হয়ে গিয়েছে—থাকেও কলকাতার বাইরে। দুর্গাপুরে। মাঝেমধ্যে আসে অবশ্য। দিদিও গোরাচাঁদকে ভালবাসে খুব। …তা ছেলে হিসেবে গোরাচাঁদ চমৎকার। সরল, ভদ্র , সভ্য, নম্র। দেখতেও ভাল। গায়ের রং ফরসা ; চেহারা গোলগাল। চোখ দুটি বড় বড় মুখে সব সময় একটু হাসি লেগে থাকে।