ফুলরেণু বলল, “এখানে আবার ফুল কোথায় ?”
স্বর্ণকমল মনে মনে বলল : আমার সামনে : মুখে বলল, “বসন্তকাল—, পবনঃ সুগন্ধি।”
ফুলরেণু আড়চোখে তাকিয়ে স্বর্ণকমলকে দেখল একবার। তারপর মুখ নিচু করে হাঁটতে লাগল। মাঠের কোথাও কোথাও রং শুকিয়ে আছে, কোথাও বা আবির পড়ে আছে ধুলোয় ; মেয়েরা সকালে দৌড়োদৗড়ি করে রং খেলেছে মাঠে। ফুলরেণু মুখ উঠিয়ে সামনে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে চোখ তুলল : টলটল করছে পুর্ণিমার চাঁদ।
স্বর্ণকমল বলল, “বেশ লাগছে না ?”
ফুলরেণু কোনও জবাব দিল না।
স্বর্ণকমল আবার বলল, “আহা সেই বসন্তবর্ণনাটি মনে পড়ছে : দুমাঃ সপুষ্পা সলিলং, সপদ্মং, স্ত্রিয়ং সাকামাঃ পবনঃ সুগন্ধ…”
শ্লোকটা শেষ করতে দিল না ফুলরেণু। প্রায় ধমকে উঠে বলল, “আমার সামনে সংস্কৃত বলবেন না।”
“কেন, কেন ?” স্বর্ণকমল যেন খুব অবাক।
“আমি পছন্দ করি না।”
“ও !…কিন্তু এটা কালিদাসের বসন্ত বর্ণনা…”
“কালিদাস…।” ফুলরেণু যেন আঁতকে উঠল। মুহূর্ত কয়েক আর কথা বলতে পারল না, তারপর বলল, “অত্যন্ত অসভ্য, ভালগার।”
স্বর্ণকমল দাঁড়িয়ে পড়ে আবার হাঁটতে লাগল। “আজ্ঞে এর মধ্যে কোনও ভালগারিটি নেই। শুনুন না—‘রম্য-প্রদোষ সময়ঃ স্ফুটচন্দ্রহাসঃ পুংস্কোকিলস্য বিকৃতঃ পবনঃ সুগন্ধি’,…মানে হল—রমণীয় সন্ধ্যাকাল, বিমল চন্দ্রকিরণ, পুংস্কোকিলের কুজন, সুগন্ধি বায়ু…”
“আপনি থামুন, মানে বলতে হবে না”, ফুলরেণু আদেশের মতন করে বলল।
স্বর্ণকমল থামল।
ফুলরেণু বলল, “কলেজে ছেলেমেয়েদের সংস্কৃত পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমি হলে করতাম। …যত সব কুশিক্ষা হচ্ছে।”
“আজ্ঞে—কুশিক্ষা !”
“আপনার কি ধারণা সুশিক্ষা হয় ?”
“না, মানে—, এটা তো রস অনুভবের ব্যাপার।”
“বেশি রসে স্বাদ তেতো হয়।” ফুলরেণু ঠোক্কর দিয়ে বলল। “এখানকার ছেলেমেয়েদের তো দেখছি—কী রকম সব তেতো হয়ে গেছে। যত অসভ্যপনা, বেয়াড়াপনা, বাঁদরামি শিখেছে।”
স্বর্ণকমল নিরীহ ভালমানুষ মতন মুখ করে বলল, “আপনি কি বলতে চাইছেন এদের চিত্ত-প্রকৃতি তরল ও চঞ্চল হয়ে উঠছে।”
“আপনার ওসব ছলছল ভাষা আমি বুঝি না। আমি বলছি এরা বাঁদর হয়ে উঠছে, অভব্য অশালীন হয়ে উঠছে।”
“সংস্কৃত পড়ে ?”
“আপনাদের কাছে ওইসব ছাইভস্ম পড়ে।”
“আপনি যে কোথায় ভস্ম পাচ্ছেন আমি বুঝছি না।…তবে হ্যাঁ, বলতে পারেন ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নি ! দু একটা যদি পড়ে দেখতেন ?”
“পড়েছি—পড়েছি।” ফুলরেণু অধৈর্য হয়ে বলল।
“পড়েছেন ! বাঃ !” স্বর্ণকমল পুলকিত বোধ করল। “আরও পড়ুন—খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুন কুমারসম্ভবম্ রঘুবংশম্ অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ মেঘদূতম্…আহা এ-সবের কি তুলনা আছে। অতুলনীয়। যদি বলেন বাংলা মানে দেওয়া বই আমি দিতে পারি।”
“থাক আমার দরকার নেই।” গম্ভীর হয়ে ফুলরেণু বলল। “সে কষ্ট আপনাকে করতে হবে না।”
“কষ্টের কিছু না। এখানেই আছে। মমতার কাছে। আমি চেয়ে নিয়ে দেব। আপনিও চেয়ে নিতে পারেন।”
“আমার চেয়ে দরকার নেই।… আমি জানি কী আছে।” ফুলরেণু গলা চড়িয়ে চোখের দৃষ্টি আগুন করে বলল। “যত ট্রাশ অসভ্যতা ! আপনাদের মতন লোকের এই সবেই মজা।”
‘আজ্ঞে…’ স্বর্ণকমল করজোড়ে বলল, “অপরাধ নেবেন না, একটা কথা বলি : উদেতি পূর্বং কুসুমং ততঃ ফলং ঘনোদয়ঃ—আগে পুষ্পেদগম পরে ফল, আগে জলোদয় পরে বর্ষণ—এই তো নিয়ম। আপনি পড়ে যান পুষ্পেদগম হচ্ছে ধীরে ধীরে পরে ফল হবে ; মেঘের উদয় আমি দেখছি বর্ষণ পরে হবে…”
ফুলরেণুর আর সহ্য হল না। লোকটা তার সঙ্গে রসিকতা করছে ! তামাশা ! কী সাহস দেখেছ ? ফুলরেণু সোজা গেট দেখিয়ে দিল, “আগে আপনি যান পরে অন্য কথা।”
স্বর্ণকমল হেসে ফেলল। ফুলরেণুকে চোখ ভরে দেখতে দেখতে বলল, “যাচ্ছি। আজ দোল পূর্ণিমা, আপনাকে তো হাতে করে আবির-কুঙ্কুম দিতে পারলাম না, প্রশস্তি লেপন করে যাই। সত্যি আপনাকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে আজ।…কালিদাস যে এই বসন্ত ঋতুতে অনঙ্গদেবকে বহুরূপে রমণীদেহে অবস্থান করতে দেখেছেন, তা যথার্থ। আমিও, দেখছি—নেত্রেষু লোলো মদিরালসেষু গণ্ডেষু পাণ্ডুং কঠিনঃ স্তনেষু…আপনার মদিরালস চক্ষুতে চঞ্চলভাবে, গণ্ডদেশে পাণ্ডুরূপে সেই দেবতা বিরাজ করছেন…” বলতে বলতে স্বর্ণকমল গলার স্বর অতি নিচু করল, এবং শেষ শব্দের ব্যাখ্যাটা অশ্রুতভাবে নিজের কাছেই করল ! আর দাঁড়াল না, পালাল।
রাগে ফুলরেণুর সর্বাঙ্গ কাঁপার কথা, মাথায় আগুন জ্বলে ওঠার কথা, কিন্তু বেচারি হঠাৎ কেমন লজ্জায় অস্বস্তিতে আরক্তিম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এবং তার বুক কি কারণে যেন কাঁপল।
পাঁচ
দেখতে দেখতে দেড় দু মাস কাটাল। গরমের ছুটিতে ফুলরেণু কাশীতে নিজের বাড়িতে এল। মা বললেন, “আমি কত ভাবনায় ভাবনায় মরতুম, কি জানি কেমন থাকিস। তা বলতে নেই রেণু, তোর শরীর বেশ সেরেছে। মুঙ্গেরের দিকে জলহাওয়া খুব ভাল, না রে ?…” ফুলরেণু শুধু হাসল, কিছু বলল না।
রাত্তিরে টোকন এসে হাতে একটা মস্ত খাম দিল। বলল, “নে ফুলদি, তোর ফাইল। পাঁচজন ক্যান্ডিডেট আছে। তাদের ফটো, নাম ধাম বয়েস প্রফেশন—সমস্ত পার্টিকুলার নোট করে দিয়েছি। এখন তুই বাবা তোর পছন্দমত বেছে নে। …ব্যাপারটা কিন্তু বর্ষায় সারতে হবে, আষাঢ় মাসে।’’