সাধনবাবুর বাড়িতে মানুষ বলতে তিনি এবং তাঁর জগন্নাথ। ভদ্রলোক বিপত্নীক। জগন্নাথের হাতেই খাওয়া-পরা, ঘরদোর সংসার। সন্তান বলতে একটি মেয়ে। মেয়ে-জামাই নিজেদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার ফেঁদে আছে ডালমিয়ানগরে। সাধন হলেন শিষ্টগোছের মানুষ। কথা খানিকটা সমঝে বলেন; ধর্মে টান এবং মাঝারি অর্শ-ব্যামো দুই-ই দেখা দিয়েছে স্ত্রীর অবর্তমানে। চোখ দুটি আজকাল অন্যমনস্ক ও উদাস হয়ে উঠছে দিন দিন। বয়স বাষট্টি। স্বাস্থ্য মাঝারি।
সাধনের খুব ঘনিষ্ঠ হলেন জলধর। দুজনে কেমন একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও আছে। সম্পর্কে সাধন জলধরের শালা। জলধর তড়বড়ে মানুষ। চৌষট্টি বছর বয়েসেও বাইক চাপতে পারেন, লাল আটার রুটি আর ছোলা সেদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারেন, তিন পোয়া দুধ এখনও রাত্রে তাঁর বরাদ্দ, গলার স্বর গমগম করে। স্বাস্থ্যটি দেখলে মনে হয় না, বয়েস তাঁকে তেমন কাবু করতে পেরেছে। গায়ের রং কালো। মাথায় বারো আনা টাক, চার আনা চুল—সবই সাদা। জলধরের সামান্য সন্ধ্যাপূজার ব্যবস্থা আছে। নিত্যই তিনি যে পেটমোটা ফ্লাস্কটি বয়ে আনেন—তার মধ্যে হরি শাহ-এর দোকানের দিশি মদ্য থাকে। একেবারে আনুপাতিক হারে জল মেশানো। এই বস্তুটি তিনি সাধনের বাড়িতে বসে খান। গল্প করেন। পান চিবোন। সিগারেট টানেন। এবং বলা বাহুল্য বৃদ্ধদের এই সান্ধ্য মজলিস সজীব করে রাখেন।
পশুপতি জলধরেরই সমবয়সী। মাস কয়েকের ছোট হতে পারেন। জলধর যখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন পশুপতি তখন জিয়োলজিস্ট হিসেবে কাছাকাছি ঘোরাফেরা করেছেন। সেই সূত্রে প্রথম পরিচয়। সেই পরিচয় পরে বন্ধুত্বের পর্যায়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের সাংসারিক কুশল বিনিময় এবং সুখ-দুঃখের পত্রালাপ চলত দূর থেকেও। অনেক পরে পশুপতি এসে বাসা বাঁধলেন এই ছোট শহরে, জলধরেরই কথায়। মানুষ হিসেবে শৌখিন, সদাশয় এবং সদাতৃপ্ত। চেহারাটি চমৎকার। বোঝা যায়—একসময়ে রূপবান পুরুষ ছিলেন। এখন আধিব্যাধি ভর করেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেয়াড়া হল, হাঁপানি। বর্ষা আর প্রথম শীতটায় পশুপতি কাবু হয়ে পড়েন। হাঁপানি ছাড়া অন্য ব্যাধিটা হল ডায়েবেটিস। তবে এটা মারাত্মক নয়। পশুপতির এক ছেলে কানপুরে, অন্য ছেলে পাটনায়। বাড়িতে পশুপতি আর তাঁর স্ত্রী। জলধরের ছেলেও পাটনায়। সেদিন থেকে পশুপতি অনেকটা নিশ্চিন্ত।
হাবুল সেন—সবার চেয়ে বয়েসে ছোট। ষাটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা, মাথার চুলগুলো সব সাদা। খানিকটা যেন চুল পাকিয়ে বুড়োর দলে ঢুকেছেন বলে মনে হয়। ব্যবসাদার মানুষ। শেড কনস্ট্রাকশান-এর কাজে নাম আছে। ছোট ভাই ব্যবসা দেখে, আর হাবুল সেন জোগাড়যন্তর করেন। হাবুলের স্ত্রী কলকাতার কাগজে কবিতা লেখেন। হাবুল বলেন, “হিস্টিরিয়া সেরে যাবার পর থেকে ওটা হয়েছে।”সন্তানাদি নেই।
চারজনের পরিচয়টুকু মোটামুটি দিয়ে রাখা গেল। এর পর যিনি—তিনি হলেন কদম্ব মিত্তির। তাঁকে নিয়েই জলধরের সন্ধেবেলার আড্ডাখানা আজ জমে উঠল।
জলধর হাঁক ছেড়ে জগন্নাথকে গ্লাস আনতে বললেন। তারপর পশুপতিকে জিজ্ঞেস করলেন, “অভিলাষী জিনিসটা কী—তুমি জান?”
পশুপতি মাথা নাড়লেন, জানেন না।
জলধর বললেন, “সংসারে কিছুই জানলে না। তোমাদের দিয়ে কোনো উপকারটিই হল না জগতের।” বলে জলধর অবজ্ঞার মুখভঙ্গি করলেন।
পশুপতি বললেন, “তুমিই বলো। জগৎ উদ্ধার করতে তুমিই অবতার রূপে এসেছ জলধরবাবু, তুমিই বলো।”
জলধর কোনো কথা বললেন না। স্কুলে মাস্টারমশাইয়রা যেমন ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রশ্ন শুধিয়ে সেইভাবে অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
সাধন বললেন, “আমি কখনো কথাটা শুনিনি। স্ত্রীলোক যখন স্পিরিচুয়াল তখন উঁচু দরের কিছু হবে।”
হাবুল বললেন, “কদম্বদা এর আগে একবার এক ফিরিঙ্গি বুড়ি এনেছিলেন মনে আছে? সে নাকি কদম্বদাকে রান্না শেখাত।”
এমন সময় জগন্নাথ কাচে গ্লাস দিতে এল।
পশুপতিরা এ-সময় চা-টা খান। জগন্নাথ ইশারায় কে কে চা খাবেন জেনে নিয়ে চলে গেল।
জলধর ফ্লাস্কের ঢাকনা খুলতে খুলতে বললেন, “কদম্ব এটিকে কি-শেখাতে এনেছে কে জানে!”
পশুপতি বললেন, “শেখার কি শেষ আছে জীবনে! তা যাক, তুমি বাপু মানেটা বলো তো?”
জলধর ফ্লাস্ক থেকে হরি শা ঢেলে নিলেন। গন্ধ ছুটল। আঙুল আলতো করে গ্লাসে ডুবিয়ে আঙুল তুলে নিলেন। বার তিনেক জল ছিটিয়ে দিলেন বাতাসে। উৎসর্গ করলেন। তারপর বললেন “মানে আর কী! কদম্ব মিত্তিরের ইয়ে, মানে ওই পোষা স্ত্রীলোক গোছের কিছু। ঠিক মানেটা হাবুলের বউ জানতে পারে, পদ্য লেখে বউমা।”
পশুপতি খোঁচা মেরে বললেন, “তোমার বিদ্যেতেও কুলল না। যাক বাঁচা গেল।”
দুই
পরের দিন সন্ধের আগে আগেই চারজন কদম্ব মিত্তিরের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। হাবুল সেন তাঁর গাড়িটা নিয়েছিলেন। চারজনের পক্ষে যথেষ্ট। এখনও টানতে পারে বিলিতি গাড়িটা।
কদম্ব বাইরেই পায়চারি করছিলেন। মালিকে বোঝাচ্ছিলেন—বর্ষার গোড়ায় বাগানে কোন কোন গাছ লাগাতে হবে। বন্ধুদের দেখে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন, “আসুন আসুন।”
জলধর বললেন, “কালকে আর হয়ে উঠল না। আজ সব জুটিয়ে আনলাম। কেমন আছেন?”