মেয়েরা চুপ। গীতাদি হঠাৎ হেসে বললেন, “আপনি ভাই বড় বেরসিক। স্বর্ণকমলবাবু আলাদা কী আর পড়াতে পারেন। বোধহয় কাদম্বরী পড়াচ্ছিলেন। ওদের খানিকটা ‘কুমার সম্ভব’—আর বোধহয় ‘শকুন্তলা’র দু-একটা অংশ আছে।” গীতাদি নিজে বাংলা পড়ান।
ফুলরেণু বলল, “কাদম্বরী-টরী জানি না, আপনারা জানবেন। ওসব নোংরা জিনিস পড়ে কি হয় ?”
“বলছেন কি ভাই আপনি ! ‘কাদম্বরী’, ‘রঘুবংশ’, ‘মেঘদূত’, ‘শকুন্তলা’—এ সব হল আমাদের প্রাচীন কাব্য, কত নামকরা বই, সংস্কৃত সাহিত্যের মণিমাণিক্য, এসব না পড়লে সংস্কৃত পড়া হবে কেন !”
“পড়তে হবে না।”
“হবে না ?”
“আমি হলে সংস্কৃত পড়া বন্ধ করে দিতাম। কথায় কথায় শুধু নলিনী আর মালিনী…।”
“পীনপয়োধরও আছে—” গীতাদি উলটো ঠাট্টা করলেন, “আলপিন নয় কিন্তু…।”
উমাদি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা থামিয়ে দিয়ে বললেন, “যাকগে—যাকগে, যেতে দাও। সব পড়াই পড়া। পড়ার মধ্যে দোষ কিছু নেই।…আমি বলি কি ফুলরেণু, তুমি মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখো। কলেজের ছেলেমেয়েরা তো শিশু নয়, তারা নিশ্চয় খানিকটা বোঝে। যা বোঝে না, তা না বুঝুক। বয়েস হয়েছে—জগতের কিছুটা বুঝবে বই কি ! তোমার যদি কোনও আপত্তি থাকে, কারও সম্পর্কে কোনও কমপ্লেন থাকে, তুমি প্রিন্সিপ্যালকে বলতে পারো, আমাদেরও পারো।”
ফুলরেণুর মাথার ঠিক ছিল না, রাগে অপমানে জ্বলছিল। বলল, “আপনারা যা করেছেন তাতে ছেলেমেয়েদের মাথা খাওয়া হচ্ছে। নয়তো ওইটুকু মেয়ে ভালবাসাবাসির চিঠি লেখে ?”
উমাদি, সুমিত্রা, মনোরমা, গীতা, বিজয়া—সবাই ফুলরেণুর দিকে তাকিয়ে থাকল। নয়ন বুঝি অপলক হল একটুক্ষণ।
মনোরমা বললেন, “ওমা, তাই নাকি ! কোন মেয়ে ?”
ফুলরেণু নাম বলল না। “নাম জেনে কি হবে ! এই কলেজেরই ছাত্রী, আপনাদেরই স্টুডেন্ট…”
বিজয়া পরম কৌতুকে জিজ্ঞাসা করল, “কোন ইয়ার ? আর্টস না সাইন্স ?”
বিজয়ার কথায় ফুলরেণুর ঘেন্না হচ্ছিল ! এটা কি তামাশার কথা ? কিছুই বল না ফুলরেণু।
উমাদি সিঁথির কাছে কাঁচাপাকা চুলের কাছটা একটু চুলকোলেন। সুমিত্রার মুখের দিকে তাকালেন সামান্য, তারপর বললেন, “আমি আর কী বলব ! যে বয়েসের যা⋯! এরা তবু উনিশ-কুড়িতে লিখছে, আমি ষোলো সতেরোয় লিখেছি…।”
উমাদির কথায়, সকলে কলরোল তুলে হেসে উঠল। ফুলরেণুর মনে হল সবাই মিলে তাকে নিয়ে তামাশা করল, উপহাস করল, একশেষ করল অপমানের। তার একমাত্র ভরসা ছিলেন উমাদি, সেই উমাদিই তাকে সকলের সামনে এমন ভাবে অপ্রস্তুত করলেন যে লজ্জায় অপমানে তার মাথা কাটা গেল।
আর কিছু বলল না ফুলরেণু ; কলেজ ছুটি হয়েছে, ঘর ছেড়ে চলে গেল।
ফুলরেণু বুঝতে পেরেছিল উমাদিদের দিয়ে কিছু হবে না। এরা এই কলেজের ধাত পেয়েছে, সব ব্যাপারেই হেলাখেলা, তামাশা ; দায়দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা এরা ভাবে না। সভ্যতা শালীনতার জন্য মাথাব্যথা এদের হবার কথা নয়, যদি সে জ্ঞান থাকত তবে পুরুষ প্রফেসারদের ঘরে বসে অত গল্প গুজব, হাসি, পান-জরদার আসর জমাত না। নিতান্ত এদের বয়েস হয়েছে, ছেলেপুলে আছে—ঘরসংসার করে নয়ত বয়েস কমিয়ে এই গোয়ালে ঢুকিয়ে দিলে ওই ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে এরাও সমান মিশে যেত !
যাক, এরা চুলোয় যাক। ফুলরেণু ওদের মতন হতে পারে না, পারবে না। যা করার সে একলাই করবে। সহকর্মীদেরই যখন পাওয়া গেল না, তখন পুরুষদেরও সাহায্য পাওয়া যাবে না। পুরুষদের সাহায্য নেওয়ার কথা অবশ্য ফুলরেণু আগে ভাবেনি। তবে এটা পাওয়া গেলে, ওটা পাওয়া যেতে পারত হয়ত। না পেয়েছে না পাক, কথাটা সে সরাসরি প্রিন্সিপ্যালের কাছে ওঠাবে। তার আগে তাকে একটু খোঁজ খবর নিতে হবে। মামলা সাজিয়ে না নিয়ে মোকদ্দমা লড়তে যাওয়ার মতন বোকামি সে কবে না।
তিন
সেদিন হোস্টেলে মমতাদের ঘরে এসে ফুলরেণু বলল, “মমতা, তোমার সংস্কৃত বইখানা দেখি।”
মমতা কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল, কিছুই বুঝতে পারছিল না। বলল, “কোন বই, দিদি ?”
“ক্লাসে যা পড়ানো হয়…”
“আমাদের চারটে বই। একটা বই সিলেকসানের মতন, অন্য তিনটে…”
“একটাই আগে দাও।”
মমতা একটা বই এনে হাতে দিল।
ফুলরেণু বইটা হাতে নিয়ে পাতা খুলল। “এ আমি কি বুঝব ! সংস্কৃত টংস্কৃত আমি জানি না। মানের বই নেই ?”
মমতা এবার যেন বুঝল একটু। বলল, “বাংলা আছে, দিচ্ছি।”
বইয়ের ডাঁই থেকে মোটা মতন একটা বই এনে ফুলরেণুর হাতে দিল মমতা। বলল, “এটায় দিদি, বাংলা হরফে সংস্কৃত লেখা আছে, মানে দেওয়া আছে বাংলায়। খুব সুন্দর…”।
ফুলরেণু পাতা উলটে এক লহমা দেখে নিল। কালিদাস গ্রন্থাবলি…। বলল, “তোমাদের এ বই সবটা পড়ানো হয় ?”
মমতা মাথা নাড়ল। “না, ওটা পড়ানো হয় না ; ওর থেকে দুটো কাব্যের চারটে সর্গ পড়ানো হয় !”
“কোনটা কোনটা ?”
“রঘুবংশম্ আর অভিজ্ঞান শকুন্তলম্…” মমতা বলল, কোন কোন সর্গ তাও বলল।
ফুলরেণু বই নিয়ে ফিরে আসতে আসতে বলল, “তোমাদের উনি পড়াতে এলে বলবে যাবার সময় যেন আমার সঙ্গে কথা বলে যান।” স্বর্ণকমলের নামটা ইচ্ছে করেই ফুলরেণু বলল না।
মমতা মাথা হেলিয়ে বলল, “আজ তো উনি আসবেন না, কাল আসবেন। এলে বলব।”
ফুলরেণু চলে গেল।
এতক্ষণ রেবা ঘরের একপাশে বসে কত যেন মন দিয়ে সেলাই করছিল। ফুলরেণু চলে যেতেই মাথা উঠিয়ে চোখ ভরা হাসি নিয়ে বলল, “কী ব্যাপার রে ?”