“বললেন বই কি। সাফসুফ বললেন—” বটকৃষ্ণ মাথা নাড়লেন! “আমিও ভেবেছিলুম—চলেই যাব। জেলখানায় বসে কিছু তো করার উপায় নেই। সেদিন সন্ধেবেলায় তোমার দিদি যখন কাঠকয়লা জ্বালিয়ে ধুনো দিতে এল, বললাম—তোমার বাবা আমায় পরশুদিন চলে যেতে বলেছেন। আমি চলে যাচ্ছি। তোমাদের ঘরদোর কম ; মধুপুর থেকে তোমার বাবার কোন বন্ধু আসবেন। তোমার দিদি ধুনোয় ঘর অন্ধকার করে দিয়ে চলে গেল। আমি বসে নাকের জলে চোখের জলে হলাম। রাত্রের দিকে তোমার দিদি এক চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। চিরকুট পড়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। মধুপুরের সেই ভদ্রলোক—রায়সাহেবের বন্ধু—তাঁর ভাইপোর জন্যে নলিনীকে দেখতে আসছেন। তোমার দিদি লিখেছিল : তুমি আমায় বাঁচাও। না বাঁচালে বিষ খাব। তুমি ছাড়া আমার কে আছে লক্ষ্মীটি?”
সত্যপ্রসন্ন নলিনীর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনি কি তাই লিখেছিলেন, দিদি?”
নলিনী বললেন, “বয়ে গেছে।”
বটকৃষ্ণ বললন, “বয়েই তো যাচ্ছিল। অন্য হাতে পড়লে বুঝতে। সোনার অঙ্গ কালি করে দিত।…যা বলছিলাম সত্য, তোমার দিদির চিঠি পড়ে আমার মনে হল—বিষটা আমিই আগে খেয়েনি। কিন্তু কোথায় পাব বিষ? কারমাটারে একটা সিদ্ধির দোকান পর্যন্ত নেই। ভাবলাম গলায় দড়ি দি; ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখি—একটা হুক পর্যন্ত নেই, দড়ি বাঁধব কোথায়! যেদিকে তাকাই ফাঁকা। মরার মতন কিছু হাতের কাছে পেলাম না। ভাবি আর ভাবি, কোনো উপায়ই পাই না। হঠাৎ একটা জেদ চাপল। ভাবলাম, জীবনটা তো নষ্ট হয়েই গেল, প্রেমের পূজায় এই তো লভিনু ফল। তা নষ্টই যখন হল—বেচারি নলিনীর জন্যে কিছু না করেই কি মরব? ও আমার কাছে বাঁচতে চেয়েছে। কেমন করে বাঁচাই? কেমন করে? সারা রাত ঘুম হল না। ছটফট ছটফট করে কাটল। হাজার ভেবেও কোনো বুদ্ধি এল না। পরের দিন সকাল থেকে মৌনী হয়ে থাকলাম। রায়সাহেবকেও পাত্তা দিলাম না। দুপুরবেলায় খেলাম না। বিকেলবেলায় কেমন ঘোরের মতন বাইরে পায়চারি করতে করতে খেয়ালই করিনি রায়সাহেব আমায় ডাকছেন। যখন খেয়াল হল—রায়সায়েব তখন আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। উনি বললেন, কি হে, তুমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁট নাকি? বলতে যাচ্ছিলাম—আজ্ঞে না। কিন্তু হঠাৎ আমার এক মামার কথা মনে পড়ল। মামা সোমনামবুলিজমে ভোগে, মানে স্লিপ ওয়াকার, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটে, তবলা বাজায়, ক্যালকুলাসের অঙ্ক করে। বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার ওই রোগটা আছে। বংশানুক্রমিক। রায়সাহেব আঁতকে উঠে বললেন, সেকি, আগে তো বলোনি। ও যে সর্বনেশে রোগ। আমার এক বন্ধু এই রোগে সেলুন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেল। এ তো ভাল কথা নয়। তুমি রাত্রে বাথরুম-টাথরুমে বেরিও না। কাইজার ছাড়া থাকে। তোমার গলার টুঁটি কামড়ে ধরবে। না না, খুব খারাপ, ভেরি ডেনজারাস, তোমার আগেই বাপু বলা উচিত ছিল। স্লিপ ওয়াকার্সদের আমি বড় ভয় পাই। রায়সাহেব কি যেন ভাবতে ভাবতে চলে গেলেন। আমিও হঠাৎ ব্রেন ওয়েভ পেয়ে ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে গেলাম।”
মমতা শুধোলেন, “মাথায় বুঝি কোনো বুদ্ধি এল?”
বটকৃষ্ণ চুরুটটা ধরিয়ে নিলেন আবার। বললেন, “হ্যাঁ, মাথায় বুদ্ধি এল। ওই একটি মাত্র পথ ছাড়া আর কোনো পথও ছিল না। রাত্রে এক ফাঁকে তোমার দিদিকে অনেক কষ্টে ধরলাম। বললাম, সোনা আমার—তোমার শোবার ঘরের দরজাটা আজ একটু খুলে রেখো। শুনে তোমার দিদি আমায় মারতে ওঠে আর কি! অনেক করে বোঝালাম। বললাম—তোমার বাবা কত বড় বাঘা ওল আমি দেখব, আমিও সেই রকম তেঁতুল।”
অধৈর্য হয়ে মমতা বললেন, “তারপর কি করলেন বলুন।”
বটকৃষ্ণ বললেন, “সেদিন রাত্রে রায়সাহেব কাইজারকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখলেন। তোমার দিদি শুতে নীচে, তার ঘরে থাকত নিত্য ঝি। নিত্য বড় ঘুম কাতুরে। ভূতটুতের বড় ভয়। সেদিন নিত্য ঘুমিয়ে পড়ার পর নলিনী ঘরের ভেতর থেকে ছিটকিনিটা খুলে রাখল। ভোর রাতের দিকে আমি স্লিপ ওয়াকিং করতে করতে তোমার দিদির ঘরে গিয়ে হাজির। নিত্যঝি ভোরবেলায় উঠত। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখল আমি সটান বিছানায় শুয়ে আছি, নলিনী জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। নিত্য হাঁউমাউ করে চেঁচাতে লাগল। তার চেঁচানির চোটে কাইজার চেন ছিঁড়ে বাঘের মতন নীচে নেমে এল। পাজামার দড়ি আঁটতে আঁটতে রায়সাহেব নীচে নেমে এলেন, আমার হবু শাশুড়ি ঠাকরুণও। পঙিক্ষ চাকরও হাজির। আমি সমস্তই বুঝতে পারছি—কিন্তু নড়ছি না—মড়ার মতন শুয়ে আছি। কানে এল, রায়সাহেব ঘরের মধ্যে বোমা ফাটানোর গলায় বললেন, ঘরের দরজা কে খুলেছিল? কে? নলিনী কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতে কাঁদতে বলল, নিত্যদি। কলঘরে গিয়ে ফিরে এসে নিশ্চয় দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। নিত্য বলল, না বাবাঠাকুর আমি নই। শাশুড়ি ধমক দিয়ে বললেন, চুপ কর তুই, তোর ঘুম আমি জানি না। সব ক’টাকে বাড়ি থেকে তাড়াব। রায়সাহেব বললেন, ওই রাস্কেল, ইতর, ছুঁচোটাকে তুলে দাও, দিয়ে আমার ঘরে নিয়ে এসো। হারামজাদাকে হান্টার পেটা করব।”
সত্যপ্রসন্ন প্যাকেট খুলে দেখলেন আর সিগারেট নেই। মমতা হাসির দমক তুলে দিদির হাত টিপে ধরলেন।
বটকৃষ্ণ বললেন, “খানিকটা পরে আমি রায়সাহেবের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালুম। ঘরে আমার হবু শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ ছিল না। রায়সাহেব সার্কাসের রিং মাস্টারের মতন বসে ছিলেন হান্টার হাতে, একপাশে গিন্নি, অন্য দিকে তাঁর কাইজার। রায়সাহেব আমায় দেখেই তোপ দাগলেন : বদমাশ, স্কাউড্রেল, পাজি, ইতর, কোথাকার।…তুমি কোন মতলবে বাড়ির মেয়েদের ঘরে ঢুকেছিলে? সত্যি কথা বলো? নয়ত চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব!…ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল, কিন্তু এই শেষ সময়ে ভয় করলে তো চলবে না। মা কালীকে মনে মনে ডেকে ন্যাকার মতন বললুম, আপনি কি বলছেন—আমি বুঝতে পারছি না। আমি সাত্ত্বিক সন্ন্যাসী মানুষ। আমি কেন বাড়ির মেয়েদের ঘরে ঢুকতে যাব, ছি ছি। বলে কানে আঙুল দিলাম।