মমতা হেসে গড়িয়ে পড়ে বললেন, “আপনার তো পোয়া বারো হল।”
বটকৃষ্ণ বললেন, “তা আর বলতে। রায়সাহেব তো জানেন না কোন রন্ধ্রপথে আমি ঢুকতে চাইছি। একেই বলে ভাগ্য। ভাগ্য যদি দেয় তুমি রাজা, না দিলে ফকির। অমন জাঁদরেল রায়সাহেব আমায় বাড়ির মধ্যে নিয়ে গিয়ে বসালেন। চা এল। চা খেতে খেতে বললেন : তোমার বয়েস কত হে? বললাম, ছাব্বিশ শেষ হয়েছে। উনি বললেন, তা এই বয়সে সন্ন্যাস নিয়েছ কেন?
“বললাম, বয়েস কি বৈরাগ্যকে আটকায়! গৌতম বুদ্ধ কোন বয়সে গৃহত্যাগ করেছিলেন? তীর্থংকর কখন করেছিলেন? মহাপ্রভু কোন বয়সে সংসার ত্যাগ করেছিলেন তা তো আপনি জানেন। রায়সাহেব আমার মুখের দিকে দু দণ্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, বুঝেছি। তা এখন কদিন এখানেই থাকো। পরে আমি দেখছি।”
সত্যপ্রসন্ন বললেন, “বলেন কি দাদা, সোজাসুজি আপনাকে থাকতে বললেন।”
“বললেন”, মাথা নেড়ে নেড়ে বললেন বটকৃষ্ণ। “বলেছি না—গেরুয়াতে রায়সাহেব হৃদয় গলত। তা ছাড়া উনি সন্দেহ করেছিলেন—আমি কোনো কারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে সাধু-সন্ন্যাসী সেজেছি।”
নলিনী বোনকে বললেন, “জানিস মনো, আমাদের কারমাটারে বাড়ির দশ আনা হয়েছে মাত্র—ছ’ আনা তখনও বাকি। দোতলায় মাত্র দুটো ঘর হয়েছে, একটায় থাকত বাবা ; আর অন্যটায় মা, যামিনী, কালু। নীচের তলায় একটা মাঝারি ঘরে থাকতুম আমি। নীচেই ছিল রান্না, ভাঁড়ার, বসার ঘর।—তবু কোথাও কোথাও কাজ বাকি থেকে গেছে। বাবা ওকে নীচের তলার বসার ঘরটায় থাকতে দিল।”
বটকৃষ্ণ বললেন, “তোমার বাবার মতন সদাশয় মানুষ আর হয় না। থাকতে দিলেন বটে কিন্তু চারদিক থেকে গার্ড করে দিলেন। সকালে রায়সাহেব নিজে এসে আমার ধর্মে কতটা মতি তা বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন। ভীষণ ভীষণ প্রশ্ন করতেন : রামায়ণ মহাভারত থেকে গীতা পর্যন্ত। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানার চেষ্টা করতেন আমি কে—কোথা থেকে এসেছি—কেন সংসার ত্যাগ করেছি? সকালে আমাকে ধরাশায়ী করে তিনি বেরিয়ে যেতেন। তিনি বেরিয়ে গেলে আসত ভবিষ্যৎ শ্যালিকা যামিনী আর শ্যালক কালু। ওরা এসে বলত, লুডো খেলো ; কিংবা বলত-মাথা নিচু পা উঁচু করে তপস্যা করে দেখাও, না হয় দুটো বেয়াড়া অঙ্ক এনে বলত, করে দাও। দুপুরবেলা আমার শাশুড়ি পেঁপে সেদ্ধ কাঁচকলা সেদ্ধ ডাল সেদ্ধ দিয়ে ভাত খাওয়াতেন। রায়সাহেব কারমাটারের সস্তা মুরগির ঝোল টানতেন। পঙিক্ষ চাকর, নিত্য ঝি এরাও আমাকে চোখে চোখে রাখত। সন্ধেবেলায় রায়সাহেব আবার একদফা গোয়েন্দাগিরি করতে বসতেন। রাত্রে কাইজারকে ছেড়ে রাখা হত নীচের তলায়। ভেবে দেখো, অবস্থাটা কী দাঁড়াল। একেবারে প্রিজনার হয়ে গেলাম। ভাবতাম হায়—একি হল, আমি তো নজরবন্দি হয়ে গেলাম। এরপর রায়সাহেব আমার মতলবটা জানতে পারলেই তো সোজা পুলিশের হাতে তুলে দেবেন।”
মমতা রঙ্গ করে বললেন, “দিদির সঙ্গে দেখা হত না?”
“দিদির এদিকে ঘেঁষার হুকুম ছিল না। দৈবাৎ দেখা হয়ে যেত।”
নলিনী এবার গালে হাত বললেন, “কত মিথ্যেই যে বলবে! আমি তোমায় দুবেলা চা জলখাবার দিতে আসতুম, ঘর পরিষ্কার করতে যেতাম।”
“ও তো নিমেষের ব্যাপার। আসতে আর যেতে। বড় জোর একটা চিরকুটে দু লাইন লিখে ফেলে দিয়ে যেতে। তোমার ন্যাকামি দেখলে তখন রাগে গা জ্বলে যেত। নিজেরা চারবেলা চর্বচোষ্য খাচ্ছ, ডিম উড়ছে, মুরগি উড়ছে, মাছ চলছে—রাত্রে নাক ডাকিয়ে নিদ্রা হচ্ছে—আর আমি বেটা বটকৃষ্ণ—ভেজানো ছোলা, আদার কুচি, কাঁচকলা সেদ্ধ, কপি সেদ্ধ খেয়ে বেঁচে আছি। রাত্রে মশার ঝাঁক গায়ের চামড়া ফুলিয়ে দিচ্ছে, তার ওপর ওই নেড়ি কুকুরটার সারা রাত দাপাদাপি।”
নলিনী বললেন, “দেখো দত্তবাবু, এত পাপ ভগবানে সইবেন না। তোমার জন্যে আমি লুকিয়ে ডিমের ওমলেট, মাছ ভাজা, এমন কি কাচের বাটি করে জানলা গলিয়ে মাংস পর্যন্ত রেখে গিয়েছি। মশার জন্যে রোজ ধুনো দিয়ে যেতাম তোমার ঘরে।”
বটকৃষ্ণ বললেন, “ধুনো যে কোথায় দিতে লক্ষ্মী তা তো জানি না। তবে হ্যাঁ, তোমার বাবা কাইজারকে রোজ হাড় মাংস খাইয়ে খাইয়ে একটা বাঘ করে ফেলেছিলেন। আফিং খাইয়ে খাইয়ে আমি নেড়িটার শরীর চিমসে করে দিয়েছিলাম। তোমার বাবা তাকে আবার তাজা করে ফেলেছিলেন। রাত্রে একটু বেরুব, রোমিও-জুলিয়েট করব—তার কি উপায় রেখেছিলেন রায়সাহেব! চার পাঁচ দিনেই বুঝলুম, আমার আশা নেই। বৃথাই মাথা নেড়া করে গেরুয়া পরে ছুটতে ছুটতে এসেছি। নলিনী-মিলন হবে না। মানে মানে ফিরে যেতে পারলেই বাঁচি। তবে হ্যাঁ—সংসারে আর ফিরব না। গেরুয়াই যখন ধরেছি—তখন সোজা হরিদ্বার কিংবা কনখলে চলে যাব। এটা স্থির করে নিয়ে রায়সাহেবকে বললাম, এবার আমায় যেতে দিন। উনি বললেন, সেকি আরও কটা দিন থাকো না। অসুবিধে হচ্ছে! বললাম, আজ্ঞে না, এত সুখ-আরাম আমাদের জন্যে নয়। আমরা গৃহত্যাগী। দুঃখকষ্ট সহ্য করাই আমাদের ধর্ম। রায়সাহেব ধূর্ত চোখ করে বললেন, ছেলেমানুষ তো, ফাজলামি বেশ শিখেছ। শোন হে, এই রবিবার মধুপুর থেকে আমার এক বন্ধু আসবে। রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার! আমারও ঘরদোর কম। তা তুমি কালকের দিনটা থেকে পরশু—শনিবার চলে যেও।
মমতা বললেন, “ওমা! সেকি! আপনাকে চলে যেতে বললেন?”