নলিনী আর মমতা দু’জনেই প্রবল আপত্তি তুললেন “সব দোষ মেয়েদের! তোমরা আর ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানো না?”
বটকৃষ্ণ হেসে বললেন, “মাছ ভাজা হলে আমরা খেতে জানি। কিন্তু মাছটা ভাজে কে? মেয়েরা। ও কথা থাক, তবে এটা তো সত্যি কথা—নলিনী যদি বুদ্ধিটা না দিত—আমার চোদ্দো পুরুষের সাধ্য ছিল না—অমন একটা মতলব মাথায় আসে।”
মমতা বললেন, “বুদ্ধিটা কী?”
“বলছি। রায়সাহেব করুণাময়ের হৃদয়ে অন্য কোনো করুণা না থাকলেও মানুষটির কয়েকটি বিগ বিগ গুণ ছিল। ভেরি অনেস্ট, কথার নড়চড় করতেন না—হ্যাঁ তো হ্যাঁ—না তো না। তোষামোদ খোসামোদ বরদাস্ত করতেন না একেবারে। আর ভদ্রলোকের সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা ছিল সাধু-সন্ন্যাসীর ওপর। গেরুয়া দেখলেই কাত, হাত তুলে দু বার হরিনাম করলেই করুণাময়ের হৃদয়ে করুণার নির্ঝর নেমে আসত। নলিনী আমার হাত ধরে বলল একদিন, সোনা—তুমি সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যাও।”
মমতা হেসে বললেন, “ও, মা সেকি কথা, দিদি আপনাকে সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যেতে বলল?”
নলিনী বললেন, “তুই ওসব বানানো কথা শুনিস কেন? সবই দিদি বলছে, আর উনি গোবর গণেশ হয়ে বসে আছেন, ঘটে বুদ্ধি খেলছে না!”
বটকৃষ্ণ বনেদি ঘড়ির আওয়াজের মতন বার দুই কাশলেন, তারপর বললেন, “আমার ঘটে বুদ্ধি খেলেনি—তা তো আমি বলিনি। তুমি আমায় সোনা লক্ষ্মী দুষ্ট—এইসব করে গলিয়ে শেষে বেকায়দা বুঝে গেরুয়ার লাইনে ঠেলে দিয়ে পালাতে চেয়েছিলে। তা আর আমি বুঝিনি—”
নলিনী বোনকে বললেন, “কথার ছিরি দেখছিস?
“তোমার দিদি আমায় পথে ভাসাচ্ছে দেখে—বুঝলে ভাই মমতা, আমার বুদ্ধির ঘট নড়ে উঠল। লোকে দত্তদের কি যেন একটা গালাগাল দেয়—আমি হলাম সেই দত্ত। ভেবে দেখলাম—রায়সাহেব করুণাময়কে বাগাতে হলে গেরুয়ার লাইন ছাড়া লাইন নেই। ওই রন্ধ্রপথেই ঢুকতে হবে। নলিনীকে বললাম—ঠিক আছে, তোমরা কারমাটারে যাও—আমি আসছি। নলিনী আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি এসো লক্ষ্মীটি, আমি তোমার জন্যে হাঁ করে চেয়ে থাকব।”
সত্যপ্রসন্ন এবার বেশ জোরে হেসে উঠলেন। “দাদা কি সত্যি সত্যিই সাধু-সন্ন্যাসী হলেন?”
বটকৃষ্ণ চুরুটের ছাই ঝেড়ে আবার সেটা ধরিয়ে নিলেন। বললেন, “নাটকের সেটাই তো ভাই থার্ড অ্যাক্ট। তোমার দিদিরা কারমাটারের নতুন বাড়িতে চলে গেল। রায়সাহেবের সেই নেড়ি কুকুরটা পর্যন্ত। আমার চোখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু পুরুষমানুষ আমি—যোগী হয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন, শাস্ত্রে বলেছে—কর্ম আর উদ্যোগের দ্বারাই পৌরুষের বিচার। আমিও হাত পা ঝেড়ে উঠে বসলাম।”
মমতা বললেন, “কী করলেন?”
বটকৃষ্ণ বললেন, “লোকে মা বাপ মরলে মাথা নেড়া করে। আমি তোমার দিদিকে পাবার আশায়, আর করুণাময়ের করুণা উদ্রেকের জন্যে মাথা নেড়া করলাম, টকটকে গেরুয়া বসন পরলাম—আর একটা পকেট সংস্করণ গীতা আলখাল্লার পকেটে ঢুকিয়ে একদিন পৌষ মাসের সকালে কারমাটার স্টেশনে নামলুম। চোখে একটা চশমাও দিয়েছি, গোল গোল কাচ, চশমার ফ্রেমটা নিকেলের। চেহারাটা আমার ভগবানের কৃপায় মন্দ ছিল না, তা ছাড়া তখন কচি বয়েস, ড্রেসটা আমায় যা মানিয়েছিল—না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না। …তা কারমাটার স্টেশনে নেমে একটু খোঁজখবর করে খানিকটা এগুতেই দেখি—আমার নলিনী মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে। দেখে চক্ষু সার্থক হল। কে বলবে—এই নলিনী সেই নলিনী। পনেরো বিশ দিনেই দেখি ওঁর মুখ চোখের রং ফিরে গিয়েছে। সেকালে মেয়েরা আজকালকার মতন করে শাড়ি জামা জুতো পরত না। এই ফ্যাশনটাও ছিল না। নলিনী পার্শি ঢঙে শাড়ি পরেছে, গায়ে গরম লং কোট, মাথায় স্কার্ফ, পায়ে মোজা আর নাগরা জুতো। নলিনীর সঙ্গে বাড়ির ঝি নিত্যবালা। কাছাকাছি আসতেই নলিনী দাঁড়িয়ে পড়ল। একেবারে থ। তার চোখের পলক আর পড়তে চায় না। এদিকে পৌষ মাসের ওই ভোরবেলায় শীতে আমার অবস্থা কাহিল। একটা করকরে র্যাপার ছাড়া আর কোনো শীতবস্ত্র নেই। গায়ে অবশ্য তুলে ধরানো গেঞ্জি রয়েছে। কিন্তু তাতে শীত বাগ মানানো যাচ্ছে না। দিদিমণিকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে নিত্যবালা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। নলিনী কথা বলতে পারছে না। আমিও চুপচাপ একটা কথা বলি—নলিনীদের বাড়ির কেউ আমাকে চিনত না। চোখে দেখে থাকবে—কিন্তু তেমন করে নজর করেনি। তার ওপর আমার নেড়া মাথা সন্ন্যাসীর বেশে চেনা মুশকিল। নলিনী চোখের ইশারায় আমায় মাঠ ভেঙে সোজা চলে যেতে বলল। বলে সে নিত্যকে নিয়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল।”
মমতা ঠাট্টা করে বললেন, “দিদি আপনাকে দেখে কেঁদে ফেলেনি তো?”
“কাঁদো কাঁদো হয়ে গিয়েছিল,” বটকৃষ্ণ বললেন, “তোমার দিদি হয়তো ভাবেইনি—সেই উৎপাত আবার এসে জুটবে।”
নলিনী বললেন, “উৎপাত ছাড়া আর কি! যে জ্বালান জ্বালিয়েছে।”
সত্যপ্রসন্ন আবার সিগারেট ধরালেন, “তারপর কী হল?”
বটকৃষ্ণ বললেন, “তারপর আমি সোজা করুণাময়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির। নতুন বাড়ি করেছেন রায়সাহেব, শৌখিন ছোট্ট বাড়ি, তখনও সব কাজ শেষ হয়নি, জানলা দরজায় সদ্য রং হয়েছে, বাড়ির বাইরে রং পড়ছে। চুনের গন্ধ, রঙের গন্ধ। তবে সত্য, জায়গাটি সত্যিই চমৎকার। রায়সাহেব বাড়ির মধ্যে কাইজারকে নিয়ে পদচারণা করছিলেন। কাঠের নতুন ফটকের সামনে আসতেই কাইজার বেটা হাউমাউ করে তেড়ে এল। কিন্তু আমার পকেটে তো তখন ডগ বিস্কুট নেই, আফিং দেওয়া বান রুটিও নেই। কাইজারের তাড়ায় গেটের সামনে থেকে পিছিয়ে এলুম। রায়সাহেবের চোখ পড়ল। তিনি একটা ঢোললা পাজামা, গায়ে জব্বর ওভারকোট পরে, গলায় মাফলার জড়িয়ে পায়চারি করছিলেন, আমায় দেখে এগিয়ে এলেন। কাইজারকে ধমক দিয়ে বললেন ; ডোন্ট শাউট। তাঁর এক ধমকেই কাইজার লেজ নাড়তে লাগল। রায়সাহেব আমায় কয়েক মুহূর্ত দেখলেন, মানে নিরীক্ষণ করলেন। আপাদমস্তক, সেই সার্চ লাইটের মতন চোখের দৃষ্টিতে আমি ভিতরে ভিতরে কাঁপতে লাগলাম। অবশ্য শীতটাও ছিল প্রচণ্ড। শেষে রায়সাহেব বললেন, কি চাই?…আমি বললুম, কিছু না। এখান দিয়ে যাচ্ছিলুম, নতুন বাড়িটা দেখে চোখ জুড়ল, তাই দেখতে এসেছিলাম। বাড়িটি বড় চমৎকার। রায়সাহেব তোষামোদে খুশি হবার লোক নন, কিন্তু বউ, বাড়ি আর গাড়ির গুণগান গাইলে পুরুষমানুষে খুশি হয়। রায়সাহেব বললেন, আচ্ছা ভেতরে আসুন। আমি হাত জোড় করে বললাম, আমায় আপনি বলবেন না, বয়স্ক প্রবীণ লোক আপনি—আমি লজ্জা পাব। ভেতরে যাবার প্রয়োজন কী! বাইরে থেকেই দেখে বড় ভাল লাগছে। রায়সাহেব আরও খুশি হলেন। বললেন, এসো, এসো ; ভেতরে এসো। তোমার তো শীত ধরে গেছে—এসো এক কাপ গরম চা খেয়ে যাও। রায়সাহেব কাঠের ফটক খুলে ধরলেন।”