নলিনী এবার ঝাপটা মেরে বললেন, “আমার বাবার নিন্দে কোরো না বলছি। যে মানুষ স্বর্গে গিয়েছেন তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা!”
হাত মাথা নেড়ে বটকৃষ্ণ বললেন, “নিন্দে কোথায় করছি, গুণগান গাইছি। আচ্ছা ভাই মমতা, তুমি ছেলেবেলায় এক-আধবার তোমার মেসোমশাইকে দেখেছ তো? আমি যা বলছি তা কি মিথ্যে! রায়সাহেব করুণাময়কে দেখলে কি মনে হত না গাদা বন্দুক তোমার দিকে তাক করে আছে। বাবারে বাবা, সে কি কড়া লোক, সাহেবি ডিসিপ্লিনে মানুষ—ফাজলামি করবে তাঁর সঙ্গে! চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরও বড় বড় রেলের অফিসাররা খানাপিনায় তাঁকে ডাকত। আমি যখনকার কথা বলছি—তখন তিনি রিটায়ার করে গিয়েছেন, করে একটা ভাড়া করা বাড়ি নিয়ে থাকেন। প্রচণ্ড খাতির, লোকে ভয় পায় বাঘের মতন ; বলত কেঁদো বাঘ। সেই বাঘের বাড়িতে কোন সাহসে আমি ঢুকব বলো! এদিকে আমার যে হৃদয় যায় যায় করছে, রোজ অম্বল, চোঁয়া ঢেকুর ; ঘুম হয় না, খাওয়ায় রুচি নেই, দুঃস্বপ্ন দেখছি রোজ। শেষে তোমাদের ওই দিদি নলিনী একদিন ইশারা করে আমায় বাড়ির পেছন দিকে যেতে বলল।”
বাধা দিয়ে নলিনী বললেন, “মিথ্যে কথা বোলো না। আমি তোমায় কিছু বলিনি ; তুমিই একদিন একটুকরো কাগজে কী লিখে ছুড়ে দিয়ে পালিয়েছিলে!”
বটকৃষ্ণ বাধ্য ছেলের মতন অভিযোটা মেনে নিয়ে বললেন, “তা হতে পারে। একে বলে স্মৃতিভ্রংশ। বুড়ো হয়ে গিয়েছি তো?”
“সুবিধে বুঝে একবার বুড়ো হচ্ছ, আবার জোয়ান হচ্ছ।” নলিনী বললেন।
মমতা বললেন, “তারপর কী হল বলুন? বাড়ির পেছনে কী ছিল?”
বটকৃষ্ণ বললেন, “রায়সাহেবের বাড়ির পিছন দিকে ছিল ভাঙা পাঁচিল, কিছু গাছপালা—বাতাবিলেবু, কুল, কলকে ফুল এই সবের। খানিকটা ঝোপঝাড় ছিল। আর বাড়িঅলা সত্য সাঁইয়ের সে আমলের একটা ভাঙা লরি। লরির চাকা-টাকা ছিল না, পাথর আর ইটের ওপর ভাঙা লরিটা বসানো ছিল। আমরা সেই ভাঙা লরির ড্রাইভারের সিটে আমাদের কুঞ্জবন বানিয়ে ফেললাম। তোমায় কি বলব মমতা, যত রাজ্যের টিকটিকি গিরগিটি পোকা-মাকড় জায়গাটায় রাজত্ব বানিয়ে ফেলেছিল। দু-চারটে সাপখোপও যে আশেপাশে ঘোরাঘুরি না করত তা নয়। কিন্তু প্রেম যখন গনগন করছে তখন কে ও সবের তোয়াক্কা রাখে। ভয় তো সব দিকেই ছিল—রায়সাহেব করুণাময় একবার যদি ধরতে পারেন হান্টার চালিয়ে পিঠের চামড়া তুলে দেবেন, বিন্দুমাত্র করুণা করবেন না। তা ছাড়া রয়েছেন নলিনীর বোন যামিনী। আর এক যন্ত্রণা। ওদিকে ছিল কালু—বাচ্চা হলে হবে কি রাম বিচ্ছু। তার ওপর সেই নেড়ি কাইজার। রোজ চার ছ’আনার ডগ বিস্কুট নিয়ে যেতাম পকেটে করে। তাতেও ভয় যেত না। বিস্কুট খেলেই কুকুর মানুষ হয় না। বিপদে পড়তে পারি ভেবে বান রুটির মধ্যে আফিঙের ডেলা মিশিয়ে পকেটে রাখতাম।”
সত্যপ্রসন্ন আবার একটা সিগারেট ধরালেন। বললেন, “কুকুরকে আফিঙের নেশা করালেন? এরকম আগে কই শুনিনি।”
“শুনবে কোথা থেকে হে” বটকৃষ্ণ বললেন, “আমার মতন গাদা বন্দুকের নলের মুখে বসে কোন বেটা প্রেম করেছে? আমি করেছি। লরির মধ্যে বসে, কাইজারকে ডগ বিস্কুট আর আফিং খাইয়ে—রাজ্যের পোকামাকড়ের কামড় খেতে খেতে পাক্কা এক বছর। গরম গেল, বর্ষা গেল, বসন্ত গেল—প্রেমের রেলগাড়ি চলতেই লাগল, যখন তখন উল্টে যাবার ভয়। তোমার নলিনীদিদির আজ এ-রকম দেখছ ; কিন্তু তখন যদি দেখতে—কী সাহস, কত বুদ্ধি। কত রকম ফন্দিফিকির করে—ছোট বোনকে হরদম কৃমি-বিনাশক জোলাপ খাইয়ে, ছোট ভাইকে দু-এক আনা পয়সা ঘুষ দিয়ে অভিসার করতে আসত। মেয়েছেলে হয়ে টিকটিকিকে ভয় পায় না এমন দেখেছ কখনো? তোমার দিদি সে-ভয়ও পেত না। আমরা দু’জনে লরির মধ্যে বসে ফিসফাস করে কথা বলতাম, হাতে হাত ধরে বসে থাকতাম, মান করতাম, মান ভাঙাতাম। বার কয়েক ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছি। একবার তো রায়সাহেব হাতে-নাতে ধরে ফেলতেন—শুধু তাঁর চশমাটা চোখে ছিল না বলে বেঁচে গিয়েছিলাম।”
নলিনী মাথার কাপড়টা ঠিক করে নিলেন আবার, টিপ্পনী কেটে বললেন, “যা সিঁধেল চোর, সারা গায়ে তেল মেখে আসতে। তোমায় কে ধরবে।”
মমতা একটু গুছিয়ে বসলেন। তাঁর শরীর বেদম ভারী নয়। তবু বেতের চেয়ারটা শব্দ করে উঠল।
বটকৃষ্ণ চুরুটটা আবার জ্বালিয়ে নিলেন। পাশের বাংলোয় আইভিরা গ্রামোফোন বাজাতে শুরু করেছে।
বটকৃষ্ণ বললেন, “নাটকের সেকেন্ড অ্যাক্ট এইভাবে শেষ হয়ে গেল ; ভাঙা লরিতে বসে—কাইজারকে ডগ বিস্কুট আর মাঝে মাঝে আফিং-রুটি খাইয়ে। এমন সময় মাথার ওপর বজ্রাঘাত হল। নলিনী বলল, রায়সাহেব কারমাটারে যে বাড়ি তৈরি করেছেন নতুন—সেখানে হাওয়া বদলাতে যাবেন। পুরো শীতটা থাকবেন। আর সেখানেই নাকি কে আসবে নলিনীকে দেখতে। ভেবে দেখো ব্যাপারটা, একে নলিনী থাকবে না, তায় আবার কে আসবে মেয়ে দেখতে। নলিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, আমি বুক চাপড়াই। আজকালকার দিন হলে অন্য কথা ছিল—ইলোপ করে নিয়ে যেতাম নলিনীকে। সেটা তো সম্ভব নয়। আর রায়সাহেব করুণাময় গুহর বাড়ি থেকে মেয়ে বার করে নিয়ে যাবার হিম্মত কার আছে। …আমরা দুটি যুবক-যুবতী তখন অকূল পাথারে ভাসছি। এক একবার মনে হত—অ্যারারুটের সঙ্গে ধুতরো ফুলের বিচি মিশিয়ে খেয়ে ফেলি। তাতে কী হত সেটা অবশ্য জানতাম না। নলিনী কেঁদে কেঁদে শুকিয়ে গেল, নলিনী মুদিল আঁখি। আর আমার তো সবদিকেই শ্মশান—খাঁ খাঁ করছে! …এমন অবস্থায় নলিনী হঠাৎ একদিন এক বুদ্ধি দিল। মেয়েরা ছাড়া কোনো বুদ্ধি কেউ দিতে পারে না। পুরাণে আছে—লক্ষ্মী বুদ্ধি দিয়েছিল বলে দৈত্যরা স্বর্গ জয় করতে পারেনি। যতরকম কুট, ফিচেল, ভীষণ ভীষণ বুদ্ধি জগৎ সংসারে মেয়েরাই দেয়।”