মমতা হেলেদুলে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। বয়েসে গলা মোটা হয়ে গিয়েছে—খিলখিল হাসিটা মোটা মোটা শোনাল। “দিদি, তুমি চড় দেখিয়েছিলে?”
নলিনী বললেন, “দেখাব না! লোকের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করা। আবার দাঁত বের করে হাসা হচ্ছিল!”
“তা কি করব—” বটকৃষ্ণ চায়ের পেয়ালায় বড় করে চুমুক দিলেন। “তুমিই বলো মমতা, দাঁতটা যত সহজে বার করা যায়, হৃদয়টা তো তত সহজে বার করে দেখানো যায় না। যদি দেখানো যেত, আমি একেবারে সেই মুহূর্তে দেখিয়ে দিতাম—তোমার দিদি আমার হৃদয় ফাটিয়ে দিয়েছে।”
সত্যপ্রসন্নর মতন গম্ভীর মেজাজের লোকও এবারে হেসে ফেললেন। হয়ত মুখে চা থাকলে বিষম লেগে যেত। মমতাও হাসছিলেন।
বটকৃষ্ণ ধীরেসুস্থে তাঁর নিবন্ত চুরুট আবার ধরিয়ে নিলেন। বললেন, “প্রথম দর্শনে প্রেম—লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে—আমার তাই হল। পা আর নড়তে চায় না। চক্ষু আর পলক ফেলে না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। এমন সময় রায়সাহেব করুণাময় গুহর বাড়ির এক নেড়ি কুত্তা ফটকের কাকলিনী যদি বুদ্ধিটা না দিতছে এসে চেল্লাতে লাগল। তার চেল্লানির চোটে বাড়ির লোক জমে যাবার অবস্থা। আমি আর দাঁড়ালাম না ভয়ে।”
নলিনী বললেন, “আমার বাবা নেড়ি কুকুর পোষার লোক নয়। ওটা খাস অ্যালসেশিয়ান। নাম ছিল কাইজার।”
বটকৃষ্ণ মিটমিটে চোখ করে বললেন, “খাস নেড়িও নয়, তাদের তেজও কম নয়। সে যাক গে, তখনকার মতন তো পালালাম। কিন্তু চোখের সামনে সেই কচি শসা দুলতে লাগল। কুকুরের মুখের ডগায় মাংস ঝুলিয়ে তাকে দৌড় কালে যেমন হয়—আমাকেও সেই রকম আড়াই মাইল দৌড় করিয়ে শসাটা বিছানায় ধপাস করে ফেলে দিল।”
সত্যপ্রসন্ন বললেন, “আড়াই মাইল কেন?”
বটকৃষ্ণ বললেন, “আড়াই মাইল দূরে একটা মেসে আমি থাকতাম। মেসে গিয়ে সেই যে শুলাম—আর উঠলাম না। বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেল, সত্য। তোমার বড় শালী চোখের সামনে সাইকেল চড়তে লাগল। আর বার বার দেখতে লাগলাম সেই জিব ভেংচানো, চড় মারার ভঙ্গি। কালিদাস খুব বড় কবি, কিন্তু একবারও খেয়াল করলেন না, শকুন্তলা যদি খেলাচ্ছলে একবারও রাজা দুষ্মন্তকে চড় দেখাত কিংবা জিব ভেঙাত, কাব্যটা তবে আরও জমত।…আমার হল ভীষণ অবস্থা, সারাক্ষণ ওই একই ছবিটা দেখি। ঘুম গেল, খাওয়া গেল, অফিসের কাজকর্মও গেল। পাঁচের ঘরের নামটা ভুলে গিয়ে পাঁচ পাঁচচে পঁয়ত্রিশ লিখে ফেললুম হিসেবে। মুখুজ্যেবাবু বললেন, তোমাকে দিয়ে হবে না! …তা অত কথার দরকার কি ভাই, রোজনামচা লিখতে বসিনি। সোজা কথা, প্রেমে পড়ে গেলুম তোমার বড় শালীর। কিন্তু থাকি আড়াই মাইল দূরে, সাইকেল ঠেঙিয়ে প্রেমিকাকে দেখতে আসা বড় কথা নয়, বড় কথা হল—এলেই তো আর দেখতে পাব না। রায়সাহেব সশরীরে রয়েছেন, রয়েছে কাইজার, লোহার ফটক, বাড়ির লোকজন। তবু রোজ একটা করে গুড়ের বাতাসা মা কালীকে মানত করে রায়সাহেবের বাড়ির দিকে ছুটে আসতুম। এক আধ দিন দেখা হয়ে যেত, মানে দেখতুম—বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রেমিকা আমার ধোপার সঙ্গে কথা বলছে, কিংবা বাগানে ঘুরে ঘুরে পাড়ার কোনো মেয়ের সঙ্গে হি-হি করছে। আমায় ও নজরই করত না।…আমার নাম বটকৃষ্ণ দত্ত। বটবৃক্ষের মতন আমার ধৈর্য, আর কৃষ্ণের মতন আমি প্রেমিক। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন করে লেগে থাকলুম আমি। শেষে একদিন, ‘কণ্ঠহার’ বলে একটা বায়োস্কোপ দেখতে গিয়ে চারি চক্ষুর মিলন এবং দুপক্ষেরই হাসি-হাসি মুখ হল। হাফ টাইমে বেরিয়ে স্যাট করে দু’ ঠোঙা চিনেবাদাম কিনে ফেললুম। অন্ধকারে ফিরে আসার সময় একটা ঠোঙা কোলে ফেলে দিয়ে এলুম শ্রীমতীর। লাভের ফার্স্ট চ্যাপ্টার শুরু হল।
মমতা পায়ের তলায় চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন। হেসে হেসে মরে যাচ্ছেন বটকৃষ্ণর কথা শুনতে শুনতে। নলিনী আর কি বলবেন, ডিবের পান জরদা মুখে পুরে বসে আছেন।
বটকৃষ্ণ কয়েক মুহূর্ত সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বোধ হয় ফটকের সামনে দেবদারু গাছের মাথা ডিঙিয়ে তারা লক্ষ করলেন, তারপর গলা পরিষ্কার করে স্ত্রী এবং শালীর দিকে তাকিয়ে রঙ্গের স্বরে বললেন, “থিয়েটারে দেখেছ তো ফার্স্ট অ্যাক্টের পর সেকেন্ড অ্যাক্ট তাড়াতাড়ি জমে যায়। আমাদেরও হল তাই। নলিনী বিকেল পাঁচটায় চুল বাঁধতে বাঁধতে বারান্দায় এসে দাঁড়াত, কোনোদিন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকত, ফটকের সামনে এসে কুলপি মালাই ডাকত। আমি দুদ্দাড় দৌড়ে সময়মতন হাজির থাকতাম রাস্তার উল্টো দিকে। চোখে চোখে কথা হত, হাসি ছোড়াছুড়ি করে হৃদয় বিনিময়। রায়সাহেবের বাড়ির কম্পাউন্ডে ঢোকার সাহস আমার ছিল না। নলিনীরও সাধ্য ছিল না আমায় ভেতরে ডাকে। আজকাল ছেলেমেয়েরা কত সহজ—ফ্রি, লাভারের হাত ধরে বাপের কাছে নিয়ে যায়—বলে, আমার বন্ধু। বাবারাও আর রায়সাহেবের মতন হয় না। রায়সাহেব—মানে আমার ভূতপূর্ব শ্বশুরমশাই—ভূতপূর্ব বলছি এই জন্যে যে তিনি এখন বর্তমান নেই—যে কী জাঁদরেল মানুষ ছিলেন তোমরা জানো না। সেকেলে রেলের অফিসার। ফার্স্ট ওয়ারে নাকি লড়াইয়ে গিয়েছিলেন, বেঁটে চেহারা, রদ্দামারা ঘাড়, মাথার চুল কদম ছাঁট করা, তামাটে গায়ের রং, চোখ দুটো বাঘের মতন জ্বলত। গলার স্বর ছিল যেন বজ্রনিনাদ।”