মহেশ বড় অস্বস্তিতে পড়লেন। কী যে বলেন। শেষে বললেন, “পাঁজি তো তুমি দেখবে!”
“না !”
“না কেন?”
“পছন্দ তোমাদের, ভালবাসা তোমাদের, আহ্লাদ তোমাদের—তোমরাই যা করার করবে। এই বিয়েতে আমি নেই। বিয়ের সময় আমি থাকবও না এখানে। বেনারসে দিদির কাছে চলে যাব।”
মহেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “তুমি বড় জেদ করছ! তুমি বুঝতে পারছ না, আজকালকার ছেলেমেয়েদের ধাত আলাদা। তারা তাদের মতন পছন্দ করে, ভাবে, নিজেদের ভালমন্দ নিজেরাই ঠিক করে নেয়। বিনু ওই বাচ্চু ছেলেটাকে সত্যিই ভালবাসে। আমি তোমার ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, বাবা, গো অ্যাহেড! আমরা সব জানি। দারুণ হবে।”
“হোক দারুণ। আমায় বাদ দিয়ে দারুণ হোক।”
মহেশ বললেন, “তোমাকে বাদ দিয়ে আমরা! বলছ কী?”
“ঠিক বলছি। মেয়ের ভালবাসা দেখে তোমার প্রাণ হু হু করে উঠল—তার হয়ে নাচতে নামলে, আর আমি যে চল্লিশটি বছর তোমার সব কিছু আগলে রাখলুম—আমার মান-মর্যাদাটুকু রাখলে না। এই রকমই হয়! আমাকে তোমরা তুচ্ছ করলে। ঠিক আছে। তোমাদের পাঁঠা তোমরা যেখানে খুশি কাটো।”
মহেশ হঠাৎ স্ত্রীর কোলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়লেন। পড়েই বললেন, “আমি তো তোমারই পাঁঠা। তুমি রাখলে আছি, নয়ত’ নেই। ঠিক আছে, মেয়েকে বলে দেব, বাচ্ছু হবে না।”
নবতারা স্বামীর মাথা কোল থেকে সরিয়ে দিলেন। বললেন, “আমি বলে দিয়েছি আজই।”
“সর্বনাশ! কী বলেছ?”
“বলেছি, যা তুই ওই ছোঁড়াটাকে বিয়ে করগে যা! তোর বাপ যখন বলছে, ছেলে ভাল তখন ভাল। আমি আর কিছু জানি না।”
মহেশ মহানন্দে স্ত্রীর গালে গাল ঘষে বললেন, “এই না হলে তুমি আমার তারাসুন্দরী। আহা, এমন মা ক’টা ছেলেমেয়েই বা পায়।”
নবতারা বললেন, “আদিখ্যেতা কোরো না। রসাতল কাকে বলে এবার তুমি দেখবে।”
হৃদয় বিনিময়
আজ পাঁচ সাত বছর হয়ে গেল বটকৃষ্ণ পুজোর মুখে দেওঘরে চলে আসছেন। জায়গাটা তাঁর খুবই পছন্দ হয়ে গিয়েছে, স্ত্রী নলিনীরও। এখানকার জল-বাতাসে নলিনীর শ্বাসের কষ্ট কম হয়, বাতের ব্যথাটাও সহ্যের মধ্যে থাকে। বটকৃষ্ণর নিজেরও খুচরো আধিব্যাধি বেশ ঢাপা পড়ে এখানে। দেওঘরে পাকাপাকিভাবে থাকার একটা ইচ্ছে বটকৃষ্ণের মনে মনে রয়েছে। ছেলেমেয়েদের জন্যে হয়ে উঠছে না, তারা দেওঘরের নাম শুনলেই নাক মুখ কোঁচকায়। প্রথম প্রথম এক-আধবার ছেলেমেয়েরা বটকৃষ্ণর সঙ্গে এসেছিল, এখন আর আসতে চায় না, বড় ছেলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে নৈনিতাল মুশৌরি রানীক্ষেত করতে যায়, ছোট পালায় পাহাড়ে-চড়া শিখতে, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে চিঠি লেখে ; ‘মা, তোমার জামাই একেবারেই ছুটি পাচ্ছে না, পুজোয় আমরা কোথাও যাচ্ছি না।’
বটকৃষ্ণ অবশ্য কারও তোয়াক্কা তেমন করেন না। বাষট্টি পেরিয়ে গিয়েছেন, তবু নুয়ে পড়েননি; শরীর স্বাস্থ্য এ-বয়সে যতটা মজবুত থাকা দরকার তার চেয়ে এক চুল কম নেই। খান-দান, বেড়ান, নলিনীর সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা করেন, শীতের মুখে ফিরে যান।
এবারে বটকৃষ্ণ ভায়রা সত্যপ্রসন্নকে আসতে লিখেছিলেন। একটা উদ্দেশ্য অবশ্য বটকৃষ্ণর ছিল। ইদানীং দু তিন বছর তিনি যে-বাড়িটায় উঠছেন—সেটা বিক্রি হয়ে যাবার কথা। বটকৃষ্ণর মনে মনে ইচ্ছে বাড়িটা কিনে ফেলেন। বাংলো ধরনের ছোট বাড়ি, কিছু গাছপালা রয়েছে ; পাশের দু চারখানা বাড়িও ভদ্রগোছের, পরিবেশটা ভাল।
সত্যপ্রসন্ন বটকৃষ্ণর নিজের ভায়রা নন, নলিনীর মাসতুতো বোন মমতার স্বামী। বয়েসে বছর ছয়েকের ছোট। পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বটকৃষ্ণর ইচ্ছে সত্যপ্রসন্নকে দিয়ে বাড়িটা দেখিয়ে তার মতামত নেন, ভবিষ্যতে সামান্য কিছু অদল-বদল করতে হবে—তারই বা কি করা যায়—সে-পরামর্শও সেরে রাখেন। সত্যপ্রসন্ন মত দিলে—বটকৃষ্ণ বায়নটাও করে রাখবেন। সত্যপ্রসন্ন স্ত্রী মমতাকে নিয়ে দেওঘর এসেছেন গতকাল। তারপর পাক্কা ছত্রিশ ঘণ্টা কেটে গেছে।
সন্ধেবেলায় বাইরের দিকের ঢাকা বারান্দায় চারজনে বসেছিলেন ; বটকৃষ্ণ, নলিনী, সত্যপ্রসন্ন আর মমতা।
ভায়রার হাতে চুরুট গুঁজে দিয়ে বটকৃষ্ণ বললেন, “সত্য, তোমার ওপিনিয়ানটা কী?”
সত্যপ্রসন্ন চুরুট জিনিসটা পছন্দ করেন না। তবু ধীরে-সুস্থে চুরুট ধরিয়ে নিয়ে বললেন, “বাড়ি খারাপ নয়, একটা একস্ট্রা বাথরুম তৈরি করা, কিচেনটাকে বাড়ানো—এসব কোনো সমস্যাই নয়। কুয়োয় পাম্প বসিয়ে ছাদের ওপর ট্যাংকে জল তোলাও যাবে—কলটল, কমোড—কোনোটাতেই আটকাবে না। কিন্তু এত পয়সা খরচ করে এ-বাড়ি নিয়ে আপনি করবেন কী?”
বটকৃষ্ণ চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “বাড়ি নিয়ে লোকে কী করে হে! আমরা থাকব।”
“পারবেন থাকতে বুড়োবুড়িতে?”
“না পারার কোনো কারণ দেখছ? ছেলেমেয়েরা এখন সাবালক; বেকার নয়, খোঁড়া অন্ধ মাথামোটা নয়, তাদের সংসার তারা করুক, আমরা বুড়োবুড়িতে এখানে থাকব।”
মমতা বললেন, “এখন মুখে বলছেন জামাইবাবু, সত্যি কি আর তাই পারবেন? নন্তুর বিয়ে দেননি এখনও। বাড়িতে বউ এলে দিদিই কি এখানে থাকতে পারবে?”
বটকৃষ্ণ বললেন, “ছেলের বউ বড়, না আমি বড়—সেটা তোমার দিদিকেই জিগ্যেস করো।”
সাদা মাথা, সাদা খোলের লাল চওড়া পেড়ে শাড়ি, গোলগাল—ফরসা, বেঁটেখাটো মানুষটি একপাশে বসেছিলেন। মাথার কাপড় ঠিক করে নলিনী বললেন, “ছেলের সঙ্গে রেষারেষি করছ নাকি?”