নবতারা বললেন, “এতকাল তবে সুখশান্তি পেয়েছি।”
“আমার হিসেব বলছে।”
“বললেই আমায় মানতে হবে। সুখ যে কত পেয়েছি আর শান্তিতে কেমন আছি—আমিই জানি। তা যাক গে সেকথা। আমার ভাগ্যেও তা হলে ওঁর কোনও আপদ কাটল না।”
“না, তেমন কিছু দেখছি না।”
এমন সময় বিনু এল। বিনুর সঙ্গে এ-বাড়ির কাজের মেয়েটা, ফুলু। ট্রে সাজিয়ে চা খাবারটাবার এনেছে। বিনু সামান্য খোঁড়াচ্ছিল। একটা পায়ের গোড়ালিতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়াননা। মচকানো পা।
বিনু মেয়েটি দেখতে বেশ। ছিপছিপে গড়ন, মিষ্টি মুখশ্রী, চোখ দুটি হাসভিরা, থুতনির মাঝখানে ছোট্ট মতন গর্ত। চমৎকার ঝরঝরে মেয়ে।
বিনু নিচু হয়ে চা খাবার এগিয়ে দিচ্ছিল নন্দদের।
নন্দ চুনিকে বললেন, “চুনি, এ আমাদের বিনুমা।” বলে হাসিমুখেই বিনুকে বললেন, “কিগো সেই পায়ের চোট। এখনও খোঁড়াচ্ছ।”
“মচকে গিয়েছে। যা ব্যথা!”
“ভাঙেনি তো?”
“ভাঙলে দাঁড়াতে পারতাম নাকি?”
মাথা নাড়লেন নন্দ। “তা ঠিক।” বলতে বলতে চুনির দিকে তাকালেন আবার, “চুনি—একবার না হয় তোমার নিয়মটা ভাঙলে। বিনুমায়ের এটা যদি একবার দেখতে।”
চুনি কিছুই বলল না। বিনুকে দেখতে লাগল।
নবতারা বললেন, “না, না, জোরাজুরি করে লাভ নেই। ওঁর যখন নিয়ম নেই তখন আর কেন…”
নবতারার কথা শেষ হল না, চুনি বলল, “ওকে বসতে হবে না। আমার দেখা হয়ে গেছে। তুমি যেতে পারো। তোমার পুরো নামটা কী?”
“বিনতা।”
“বি-ন-তা! ঠিক আছে তুমি যাও।”
বিনু চলে গেল।
চা খাবার খেতে খেতে নন্দ বললেন, “মেয়েটাকে একটু ভাল করে দেখলে না চুনি।’’
“দেখেছি।”
“দেখেছ। ওই দেখাতেই হবে! তা একবার…”
“কোনও দরকার নেই নন্দদা। মেয়েটির অনেক সুলক্ষণ আছে। বয়েস কত। “কুড়ি পেরিয়েছে?”
“বাইশ,” মহেশ বললেন।
“তা হলে তো বেশ ভাল! কুড়ির পর থেকেই শঙ্খ।”
‘‘শঙ্খ।’’
“দরং টংলা। কুমুদহি গজাধী শঃ। ওসব আপনাদের বোঝার কথা নয়। এ মেয়ে পরম ভাগ্যবতী। বাপমায়ের সংসারের অনেক ভাল করেছে।”
মহেশ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তা ঠিক। বিনুর জন্মের পর থেকেই আমার উন্নতি।” বলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। “আমাদের অনেক ঝঞ্জাট কেটে গিয়েছে—তাই না।”
নবতারা কিছুই বললেন না।
চুনি বলল, “ও হল চার পাঁচ ছয়ের কাউন্ট। বিষ্ণু শঙ্খ। স্বর্ণ শ্বেতাভ। সুখ। আনন্দ সম্পদ বৃদ্ধি করে। ভাগ্যবতী।”
নন্দ বললেন, “বিয়ের কোনও যোগটোগ নেই?”
“যোগ হয়ে গেছে নন্দদা! বিয়ে সামনেই।”
“যোগ হয়ে গেছে! পাত্র! পাত্রের কথা কিছু বলতে পার?”
চুনি মাছের চপ খেতে খেতে বলল, “সাউথ ইস্ট!”।
“সাউথ ইস্ট মানে? সে তো রেলওয়ে—সাউথ ইস্টার্ন!”
“রেল নয়। সাউথ ইস্ট ডিরেকশন থেকে পাত্র আসবে।”
“সাউথ ইস্ট! সে তো গোটা…”
“না না, খুব দূর হবার কথা নয়। কাছাকাছি থেকেই।”
“ছেলে কেমন হবে? কী করবে টরবে?”
“ছেলে ভালই হবে। হেলদি, লেখাপড়া জানা। চোখ হয়তো একটু কটা হবে। দেখবেন—মিশুকে হবে খুব!”
“কাজকর্ম?” মহেশ বললেন।
“ভাবতে হবে না। কালে নাকালে লক্ষ…”
“লক্ষপতি?”
“না না কালে কালে অনেক করবে।”
নবতারা এবার কথা বললেন। “মেয়ের ভাগ্যে তার বাবার ওই মন্দটা কেটে যেতে পরে না?”
চুনি কী ভাবল। চোখ বন্ধ করে হয়তো হিসেব করল কিছু। তারপর বলল, “ঠিক। কাটতে পারে। আপনি ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন বউদি। মেয়ে আপনার পারে। তবে ওর ভাগ্যটা আরও একটু পোক্ত করিয়ে দেবেন।”
“কেমন করে?”
“বিয়েটা দিয়ে দেবেন আগে। বিয়ে হলে যুগ্ম হয়।”
“ইচ্ছে তো খুবই—”
“ইচ্ছে বলবতী হলে সবই হয়। আপনারা অনর্থক সময় নষ্ট করবেন না। শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সেরে ফেলা ভাল। তা ছাড়া মহেশদার সময়টা মনে রাখবেন।”
নবতারা মাথা হেলিয়ে জানালেন, তাঁর মনে থাকবে।
চার
মহেশের ঘুম এসে গিয়েছিল, গা-নাড়া খেয়ে ঘুম কাটল। চোখ খুলে তাকালেন। দেখলেন নবতার পাশে বসে আছেন। আতঙ্কিত হলেন।
“কী হল?” মহেশ বললেন।
“ওঠো। উঠে বসো।”
“কেন! উঠে বসার কী হল?”
“দরকার আছে!”
মহেশ বললেন, “শুয়ে শুয়ে হয় না?”
“ওঠো।”
মহেশ উঠে বসলেন।
নবতারা বললেন, “তুমি এত বড় জোচ্চোর, আমি জানতাম না।”
“ঠগ! জোচ্চোর! কী বলছ?”
“ন্যাকামি কোরো না। আমি কচি খুকি নয়, হাঁদাবোকা মুখও নয়। তুমি আমার সঙ্গে চিটিংবাজি করলে?”
মহেশ রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। বললেন, “আমি আবার কী করলুম।”
“যা করেছ তুমি জান! ন্যাকা সাজতে এসো না।.. তুমি মেয়ের হয়ে গল্প ফেঁদে আমায় বোকা বানাবার চেষ্টা করলে!… ওই চুনিটা কে? মিথ্যে বলবে না। আমি সব জানি। ছেলেকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছি।”
মহেশ বুঝতে পারলেন, জলের কুমির তাঁকে ধরেছে। পালাবার পথ নেই। নন্দ তাঁকে কুমিরের মুখেই ঠেলে দিল।
মহেশ বললেন—“চুনি—মানে চুনি হল নন্দর মামাতো ভাই।”
“আর ওই নাচিয়ে ছেলেটা?”
“চুনির মাসতুতো দাদা।”
“বাঃ! মামাতো মাসতুতো! দড়ি বাঁধাবাঁধি।
“এসব বুদ্ধি কে দিয়েছিল?”
“নন্দ আর চুনি। নন্দই আসল।”
“ওরা পরামর্শ দিল, আর তুমি নিলে?”
মহেশ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “কী করব! মেয়েটা যে ওই বাচ্চু ছেলেটাকেই পছন্দ করে। লাভ করে। প্রেম।”।
“তোমায় বলেছে।”
“বাঃ, বলবে না!”
“তোমারই তো মেয়ে! আর ওই নাচিয়েটা?”
“আরে বাবা, সে তো আমাদের মাথা খেয়ে ফেলল।”
নবতারা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তা হলে আর কী! এবার মেয়েকে বলো একটা পাঁজি আনতে। বাপেতে-মেয়েতে মিলে দিন ঠিক করে নাও।”