নবতারা আর কথা বললেন না।
তিন
দিন চারেক পর নন্দলাল এলেন। ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল বিকেলে, সন্ধের গোড়ায় থামল।
সন্ধেবেলায় গায়ে বর্ষাতি, মাথায় ছাতা নন্দলাল এলেন তাঁর ভাই চুনিকে নিয়ে। কথা ছিল আসার।
বসার ঘরে ঢোকার আগেই নন্দলাল উচু গলায় হাঁক মেরে বললেন, “বউদি, আজই আসতে হল বৃষ্টি বাদলার মধ্যে। চুনি কাল সকালেই দিল্লি মেলে চলে যাচ্ছে। আবার কবে আসবে ঠিক নেই। নিয়ে এলাম আজই।”
মহেশ কেমন চোরের মতন বললেন, “এসো। এসো।” বলেই নন্দকে চোখ টিপলেন। নিচু গলায় বললেন, “দিল্লি মেল রাত্রে পাস করে। মুখ্যু।”
নন্দ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “ডাউন ট্রেন ভীষণ লেট যাচ্ছে ক’দিন।”
“এসো।”
বসার ঘরে বসলেন নন্দরা।
নন্দর ভাই চুনি—মানে তিব্বতি বাবার পোশাক খানিকটা পাল্টেছে যেন। একরঙা আলখাল্লা। টকটকে লাল। মাথায় কানঢাকা টুপি। ঘাড়ের পাশে চুল ঝুলছে। দাড়ি গোঁফ যথারীতি। চোখে রঙিন কাচের চশমা। পাতলা কাচ, রংটাও ফিকে। হাতে একটা ঝোলা।
মহেশ বার কয়েক নন্দকে কী বলব কী বলব করে শেষে বললেন, “ডাকি তা হলে!”
“হ্যাঁ, ডাকুন।…বিনুকেও তো আসতে হবে একবার। তা ও খানিকটা পরে এলেও হবে। বউদিকেই ডাকুন আগে।”
“বিনুটার ভীষণ সর্দি জ্বর। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে। পায়েও ব্যথা। তবে আসবে। আজ জ্বর কমেছে।”
নন্দ বললেন, “চুনিরও গলা ভেঙে গেছে। কাল যে-গাড়িটা করে ফিরছিল সেটা রাস্তা থেকে হড়কে গিয়ে ডোবায় পড়ে গিয়েছিল। জলে কিছুক্ষণ হাবুডুবু খেয়েছে বেচারি।”
মহেশ বললেন, “জোর বেঁচে গেছে বলো। জলে হাবুডুবু বড় খারাপ। বসো, গিন্নিকে ডেকে আনি।”
খানিকটা পরে নবতারা এলেন।
মহেশ আগেই ফিরে এসেছিলেন, কথা বলছিলেন নন্দদের সঙ্গে।
নবতারা ঘরে আসতেই নন্দ পরিচয় করিয়ে দিলেন, “বউদি আজই আসতে হল। বৃষ্টি বাদলা মাথায় নিয়ে। চুনি কাল সকালেই চলে যাচ্ছে। মহেশদাকে আমি গতকালই বলে রেখেছিলাম—আজ আসার চেষ্টা করব।”
নবতারা চুনিকে দেখছিলেন।
চোখ বুজে, সামান্য জিব বার করে মাথাটা নুইয়ে ছিল চুনি। দু কানে হাত রাখল কয়েক পলক। অভিবাদন জানাল বোধ হয়।
নবতারা নন্দকে বললেন, “এসে ভাল করেছেন। না এলে আর ওঁকে দেখতে পেতুন না। তা কাল উনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“কলকাতা হয়ে শিলিগুড়ি দার্জিলিং।”
“এখানেই থাকেন।”
“এখন বছর খানেক।”
“ঘরবাড়ি কি এদিকেই কোথাও?”
“হ্যাঁ ; এই তো বীরভূমে। চুনি বরাবরই বাড়ি-ছাড়া। ঘুরে বেড়াত এদিক ওদিক। কাজকর্ম করত। ভাল লাগত না। ছেড়ে দিয়ে পালাত অন্য কোথাও। ওই করতে করতে তিব্বত চলে গেল। ওর বরাবরই খানিকটা সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে মেলামেশা ছিল। ওই থেকে যা হয়—মন চলে গেল সাধনা টাধনার দিকে।”
নবতারা শুনলেন। তারপর বললেন, “তা উনি আপনার দাদার ব্যাপারে যা বলেছেন, তা কি ঠিক?”
এবার চুনি বলল, ভাঙা গলায়, “যা দেখেছি তাই বলেছি।’’
“কী দেখেছেন? কুষ্টি তো দেখেন নি।”
“আপনাদের এই হরস্কোপ আমি দেখি না। আমরা মুখ দেখি। মুখ দেখে বলি। মুখের হিসেব আছে। তারপর অঙ্ক। অঙ্কের গোলমাল হতে পারে।”
“এক থেকে দশের পর আরও আছে?”
“আঠারো পর্যন্ত আছে।”
“ওনার হিসেব..”
“বিলকুল ঠিক। হিসেব ভুল হবে না। তবে ওপরঅলা যা করবেন।”
নবতারা নিজের মুখটা দেখালেন। “আমার মুখ দেখে কিছু বলুন।’’
চুনি একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমি একটা মুখই দেখব। আপনার মুখ দেখলে আপনারই দেখব। মেয়ের মুখ দেখব না।’’।
নন্দ তাড়াতাড়ি বললেন, “বউদি আমি চুনিকে বলেছি, বিনুর মুখ দেখে দু চারটে কথা বলতে হবে।”
নবতারা বললেন, “দুটো মুখ দেখা যায় না।”
চুনি বলল, “আমি দেখি না। কাগজ পেনসিল দিন আপনারটাই হিসেব করি।”
মহেশ তাড়াতাড়ি বললেন, “তুমি কেন। বিনুকেই দেখুক না।”
নবতারা যেন কানই করলেন না, বললেন, “আমারটাই হোক। তোমার তো মন্দ শুনলাম। কতটা মন্দ আমাকে দিয়েই বোঝা যাবে। আমার ভাগ্যেও যদি খারাপ থাকে—!”
সাদামাটা যুক্তি। স্বামীর ভাগ্যের অন্তত খানিকটা স্ত্রীর ভাগ্যেও বর্তাবে।
মহেশকে বাধ্য হয়ে কাগজ কলম জুগিয়ে দিতে হল।
চুনি তার হালকা রঙিন কাচের চশমার আড়াল থেকে নবতারাকে দেখল বার বার, তারপর কাগজ কলম নিয়ে হিসেবে বসল। লাইন টানল নানা রকম, ছোট বড়, কাটাকুটি করল, চৌকো গোল নানান ছাঁদের চেহারা এল এখানে সেখানে। শেষে অঙ্ক। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ—হয়ত জ্যামিতির অঙ্কও হল।
অতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে থাকা মুশকিল। মহেশ একবার বাইরে গেলেন, ফিরে এলেন খানিকটা পরে। নন্দ হাই তুলতে লাগলেন। দু চারটে কথাও হল মহেশের সঙ্গে নিচু গলায়। বাইরে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি আবার আসতেও পারে।
নবতারা কিন্তু একই ভাবে বসে বসে চুনিকে দেখছিলেন। দু চার বার চোখ সরে যাচ্ছিল স্বামীর দিকে।
শেষ পর্যন্ত নন্দ বললেন ভাইকে, “কিরে? হল?”
চুনি মাথা হেলাল। বড়সড় নিশ্বাস ফেলে বলল, “হয়েছে।” “কী হল?”
“অবিন্ধন দশা।”
“মানে?”
‘তেরো চোদ্দ পনেরোর কাউন্ট। অহি হল সাপ। স্নেক। সাপের বন্ধন। মানে সংসারের দড়াদড়ি দুশ্চিন্তা ভাবনায় একেবারে জড়িয়ে পড়বেন। না, ওদিকে কোনও ভয় নেই, দেহহানি ঘটবে না। তবে মন আর এখনকার মতন থাকবে না। সুখশাস্তি যা পাবার, পাওয়া হয়ে গিয়েছে। আবার খানিকটা পাবেন পনেরোর ঘরে। তা, সে পেতে পেতে বছর দশ। ওটাই শেষ।”