“ও কিন্তু দিনের বেলা বেরুতে চায় না। সন্ধে করেই আনব।”
“তাই আনুন।”
নবতারা আর বসলেন না, উঠে পড়লেন।
মহেশ আর নন্দ সিগারেট শেষ করলেন, আর-একটা করে। বৃষ্টি থেমে আসার মতন হচ্ছিল।
ছাতা ছিল নন্দর কাছে। বললেন, “ওঠা যাক মহেশদা!”
“হ্যাঁ, চলো।”
নন্দকে নিয়ে মহেশ সদর পর্যন্ত আসতেই দরজার কাছে বিনুর সঙ্গে দেখা।
“নন্দকাকা! তুমি কখন এসেছ!”
“অনেকক্ষণ। কোথায় ছিলি তুই?”
“বাড়ি ছিলাম না। এই মাত্র ফিরলাম। … দেখো না, রিকশা থেকে নামতে গিয়ে শাড়ি ফাঁসল, বাঁ পাটাও গোড়ালির কাছে মচকে গেল। আমাদের গলির এখানটায় যা পেছল হয়।”
নন্দ হেসে বললেন, “তাই দেখছি।…আজ তা হলে বউদির কাছে—।।” “মা! ওরে বাব্বা। জানতে পারলে রক্ষে রাখবে না।”
“পালা তা হলে।”
বাইরে এসে মহেশ বললেন, “নন্দ, যে নদীতে কুমির থাকে—সেই জলে ঝাঁপ দিচ্ছি আমরা। এরপর—’’
নন্দ বলল, “ভেবে লাভ নেই দাদা। হয় মক্কা, না হয় ফক্কা।”
রাত্রে শুতে এসে নবতারা বললেন, “শুনছ তো!”
মহেশ জেগে ছিলেন। খোলা জানলা দিয়ে বর্ষার জলো বাতাস আসছিল। গুমোট গরম নেই। পাখাও চলছে। তবু ঘুমিয়ে পড়তে পারেননি। না পারার কারণ নবতারা। স্ত্রী বলে রেখেছিলেন, বিছানায় পড়লাম আর ঘুমোলাম না হয়, কথা আছে। তা ছাড়া মহেশ নিজেই খানিকটা চিন্তায় ছিলেন।
মহেশ সামান্য দেরি করে সাড়া দিলেন। “বলো।”
নবতারা তখনও বিছানায় শোননি, শাড়ি জামা আলগা করে মাথার খোঁপা সরিয়ে নিচ্ছিলেন ঘাড়ের কাছ থেকে। বললেন, “মেয়ের বিয়ে নিয়ে তোমার বড় চিন্তা।”
মহেশ ব্যাপারটা ধরতে পারলেন। সন্ধেবেলার কথার জের। বললেন, “কার না হয়। সব মা বাপেরই হয়ে থাকে।’’
“তা হলে ব্যবস্থা দেখো।”
“কী ব্যবস্থা দেখব।”
“ছেলে খোঁজো।”
“তুমিই খোঁজো না।”
“কেন! তুমি বাপ না! বাড়ির কর্তা, পুরুষ মানুষ। চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কত চেনা শোনা।”
“আমায় আর খুঁজতে বোলো না। যে ক’টা খুঁজে বার করেছি—সব কটাকে তোমরা অপছন্দ করেছ।”
নবতারা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন স্বামীকে। বললেন, “ওকে খোঁজা বলে না। ছেলে কি মাঠে-চরা গোরু ছাগল যে গলায় দড়ি বেঁধে একটা ধরে আনলে আর হয়ে গেল। আমার বাবাকে দেখেছি..”
“তোমার বাবা কী জিনিস ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন তা তুমিই জান। তবে আমি যাদের খোঁজ দিয়েছিলাম—’’
“অখাদ্য। ওরা আবার ছেলে! আমার পছন্দ হয়নি, তোমারও বা হয়েছিল কোথায়! মেয়েরও নয়।”
“মেয়ের কথা তুমি জানলে কেমন করে?”
“আমি মা হয়ে জানব না, তুমি বাবা হয়ে জানবে! তোমার মতন বাপের কোনও মান-মর্যাদা আছে। ছেলেমেয়ের সঙ্গে হাসি ফক্কুড়ি করছ। বাপ না ইয়ার বোঝা যায় না। মেয়ে তো সবসময় বাপের সঙ্গে হ্যা হ্যা হিহি করছে। আমরা বাপু বাপকে যত ভালবাসতাম, তত ভয় পেতাম। তোমায় তো ওরা গ্রাহই করে না, ভাবে প্রাণের ইয়ার। দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।”
মহেশ বললেন, “তোমার বাবার সঙ্গে আমাকে মেলাতে যেও না। তিনি তিনি, আমি আমি। …তুমি বলছ, আগে যাদের খোঁজ এনেছি মেয়েরও তাদের পছন্দ হয়নি।”
“হ্যাঁ।”
“আমি যদি বলি, একটা ছেলেকে পছন্দ ছিল।”
সঙ্গে সঙ্গে নবতারা একেবারে ঘুরে বসলেন? “কে? কাকে পছন্দ ওই নাচিয়ে ছেলেটাকে?”
“নাচিয়ে মানে! ও…”
“ও-টো রাখো। ওকে আমি দেখিনি নাকি! ভটভটি করে ঘুরে বেড়ায় এপাড়া ওপাড়া, মেয়েদের মতন লম্বা চুল মাথায়, চোখে ঠুলি, পোশাক আশাকের কী বাহার, যেন সং; সারা জামা প্যান্টে তাপ্পাতুল্পি, রং। ওটাকে আমি নাচতে দেখেছি। গত বচ্ছর এখানে যে ফাংশান হল তাতে পিঠ কোমর ভেঙে মাটিতে শুয়ে বসে কী নাচ। সেই সঙ্গে ঝমঝমা বাজনা। নাচ আর থামে না। হিন্দি সিনেমা। অখাদ্য। ছিছি, দামড়া একটা ছেলের ওই ঢং দেখে পিত্তি জ্বলে গেল! ওই হারামজাদা আবার ছেলে হল নাকি? ওকে তুমি নিজের মেয়ের পাত্র হিসেবে ভাবতে পারলে। রাম রাম।”
মহেশ সবই জানেন। বললেন, “তুমি শুধু নাচ দেখছ।”
“আবার কী দেখব! আমি ওকে নাচতে দেখেছি।”
“ইয়ে, মানে ওকে বলে ব্রেক ড্যান্স। আমি তো তাই শুনেছি। ব্রেক ড্যান্সের এখন খুব কদর। মডার্ন ক্রেজ। ওই নাচ ওই রকমই। শরীর ভেঙে ভেঙে নাচতে হয়। তা নাচটা ও জানে, শিখেছে। নাচে বলেই ছেলে খারাপ হবে। ও কম্পুটার এনজিনিয়ার, ভাল কাজকর্ম করে, বাপের ঘরবাড়ি আছে, বাবা রেলের বড় অফিসার ছিলেন। ভাল ফ্যামিলি।… আমাদের নন্দর সঙ্গে একটা রিলেশান আছে।’’
নবতারা ধমকে উঠে বললেন, “চুলোয় যাক তোমার ভাল ফ্যামিলি। বোম্বাইঅলাদের মতন দেখতে, —সাজ পোশাক, কুচ্ছিত নাচ, ভটভটি চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাদিন, গুণ্ডা বদমাশের মতন—, ওর সঙ্গে ভদ্রলোক মেয়ের বিয়ে দেয়। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের, আমি দেখেশুনে একটা বাঁদরকে জামাই করব! ছি, তোমার লজ্জা করল না বলতে।”
মহেশ চুপ। মাস কয়েক আগেও এক দফা তাঁকে এসব শুনতে হয়েছে।
হঠাৎ নবতারা বললেন, “কী বলছিলে তুমি? ওই বাঁদরকে বিনুর পছন্দ?”
মহেশ বিপদে পড়ে গেলেন। ঢোঁক গিলে কোনও রকমে বললেন “না—মানে, মনে হল অপছন্দ নয়।”
‘মনে হওয়াচ্ছি। দেখি তার কেমন পছন্দ।”
মহেশ তাড়াতাড়ি বললেন, “একটা কথা বললুম আর তোমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। দাঁড়াও না। মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাও দু-দিন পরেই বলবে।”