রত্নদিদি চুপ করে গেলেন। আমরাও চুপচাপ। ততক্ষণে দিদির মাথার ধ্বধবে সাদা চুলের ওপাশে জানলা ঘেঁষে এক ঝলক জ্যোৎস্না এসেছে। মনে হচ্ছিল, আলোটা যেন রত্নদিদির মাথায় মাখানো। সামান্য পরে মুখেও নেমে আসবে।
হঠাৎ দেখি রত্নদিদি একটু হাসলেন। বললেন, “আবার কী মনে হয় জানিস এক একবার। নাতি হয়ত কিছু একটা আন্দাজ করেছিল। করেও আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করল। ওটা কী কম পাজি, না, ধুরন্ধর। কেমন ঠাকুরদার নাতি দেখতে হবে তো!”
রসাতল
মহেশ ঘোষ খানিকটা আগে আগেই বাড়ি ফিরলেন। মন ভার, মুখ ভার। নিজের ঘরে এসে দেখলেন, স্ত্রী নবতারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুঠো মুঠো পাউডার ছড়াচ্ছেন গায়ে। মাথার চুল ঝুঁটি করে বাঁধা, চুড়োর মতন। ঘাড়ে গলায় চাপ চাপ পাউডার ; সারা মুখ সাদা। হাতে বুকেও অজস্র পাউডার ; পায়ের তলায় মেঝেতেও পাউডারের গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে।
মহেশ কয়েক পলক আলমারির আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আলমারিটা তাঁর বাবার আমলের। পয়লা নম্বর বর্মি টিক দিয়ে তৈরি, ইংলিশ ডিজাইন। আলমারির একটা পাল্লায় আসল বেলজিয়াম গ্লাস। পুরোটাই। আয়নায় স্ত্রীকে আপাদমস্তক দেখা যাচ্ছিল, শাড়ির আঁচল ভূলুণ্ঠিত, গায়ের জামাটা ঢোল্লা নিমা ধরনের।
আলমারির মতন তাঁর এই স্ত্রীটিও বাবার আমলের। বাবাই এনে ঘরে ঢুকিয়েছিলেন। উনিও বর্মি। তবে আসল নয়। রেঙ্গুনে জন্ম, দিল্লিতে বালিকা জীবন, কলকাতায় যৌবন-সমাগম, তার পর দুর্গাপুরে এসে বিবাহযোগ্যা কন্যা। বাবার কৃপায় তখন থেকেই উনি মহেশের সহধর্মিণী। নবতারা নামটি থেকে ‘নব’-টি কবে খসে গেছে। এখন উনি ‘তারা’। অবশ্য মাঝে মাঝে মহেশ সোহাগ করে স্ত্রীকে তারাসুন্দরী বলে ডাকেন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, গায়ের আঁচল মাটিতে লুটিয়ে মহেশের তারাসুন্দরী পাউডার মাখছেন, ঘরের দু’কোণের দুটো পাখাই ঝড়ের বেগে ঘুরছে, পাউডার উড়ছে বাতাসে, লেবু-লেবু গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে, বাতি অবশ্য একটাই জ্বলছিল। এমন একটি দৃশ্য অন্য দিন দেখলে মহেশ হয়ত গান গেয়ে উঠতেন, আহা কী শোভা দেখ রে, মাচা তলে রাধা সাজে বাহা রে। আজ আর গান এল না গলায়, অন্য কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন—তার আগেই নবতারা কথা বললেন। “আজ এত তাড়াতাড়ি?”
গায়ের জামা আলগা করতে করতে মহেশ বললেন, “চলে এলাম।”
“চলে এলে! তাসপাশা জমল না?” বলতে বলতে নবতারা মুখের ওপর জমা পুরু-পাউডার আলতো করে মুছে নিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন দেওয়াল-ঘড়িটা। হিসেব তাঁর ভুল হয়নি। এখন মাত্র সোয়া আট। ঘোষবাবু রাত সাড়ে নয় কি দশের আগে বড় একটা বাড়ি ফেরেন না। আজ আগে আগেই ফিরেছেন।
মহেশ গায়ের জামা খুলে জায়গা মতন রাখতে রাখতে বললেন, “এ-মাসে ক’কৌটো হল? ছয় না সাত?”
কথাটা শুনেছিলেন নবতারা। জামার তলায় আরও খানিকটা পাউডার ছড়িয়ে বললেন, “কেন? হিসেব চাইছ?”
‘না। হিসেব চাইছি না। হিসেবের দিন ফুরিয়ে গেছে। এবার নিকেশ।.. আহা, কী চেহারাই হয়েছে এ-সংসারের। বাড়িতে ঢুকলাম, নীচে তোমার ছোট ছেলে আর মেয়ে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা জমিয়েছে। গান শুনছে—ইংরিজি গান। আই লাভ ইউ বেবি। স্টিরিও ফেটে যাবার জোগাড়। ও তো গান নয়, কামান। …আর ওপরে এসে দেখি—তুমি বন বন করে দুটো পাখা চালিয়ে বাঘের মতন থাবা করে পাউডার মাখছ। বাঃ, বেশ!”
লুটোনো শাড়ির আঁচল তুলে নিতে নিতে নবতারা বললেন, “তাতে হয়েছে কী? দুটো পাখা চললে আর দু’কৌটো পাউডার খরচ হলে তুমি কি ফতুর হয়ে যাচ্ছ! নিজে যখন দু’বোতল গিলে আস—তখন হিসেবটা মনে থাকে না।”
“বাজে কথা বোলো না। বোতল আমি গিলি না।” “না, তুমি গেলো না বোতল তোমায় গেলায়। ’’
“আবার বাজে কথা। মাসকাবারি বাজারে দু’চারটে বাড়তি জিনিস তোমার সংসারে আসে না? আমাদেরও ওই রকম মাসকাবারি হিসেব। তুলসীরই যা রোজকার বাজার।”
“আমারই বা নিত্যি দিনের নাকি! গরমে মরছি, বুকপিঠ ঘাড়গলা জ্বলে যাচ্ছে ঘামাচিতে, দু’কৌটো পাউডার যদি মেখেই থাকি—তোমার এত খোঁটা দেবার কী আছে! না হয় তোমার পয়সায় মাখব না আর, ছেলের পয়সায় মাখব।”
“থাক, তোমার ছেলেদের বহর বোঝা গেছে। বড়টি তো টু-ইন-ওয়ান হয়ে আছেন। তাঁরা দুটো মানুষ থাকেন—তাতেই বাবু-বিবির চলে না, যখন-তখন ভরতুকি পাঠাতে হয়।”
“আমার ছেলে…”
“তিন হাজারি। তিনে এখন কিছু হয় না। বাইরে থাকেন তো! ছেলে, ছেলের বউয়েরও কুলোয় না ওতে। বাপের ভরতুকিটা হল ওদের ঠেকো। যাক গে, তুমি মাখো। গরমে ঘামাচি, শীতে পা-ফাটার ক্রিম…”
“তার মানে! ঘামাচিতে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে না বলছ?”
“তা বলিনি। বলছি ঘামাচি আর বেঙাচি একই ক্লাসের। ও যায় না।”
“কিসে যায়?”
“নিজেই যাবে। এই তো বর্ষা পড়ে গেল। এবার যাবে।”
“ও! খুব টেরা টেরা কথা বলছ যে আজ—!” নবতারা আলমারির কাছ থেকে সরে এলেন। স্বামীকে দেখতে লাগলেন খুঁটিয়ে। নেশার কোনও চিহ্ন নেই। বরং অন্য অন্য দিন মুখের যেমন স্বাভাবিক ভাব থাকে, আজ তা নেই। খানিকটা গম্ভীর মুখ। কপালটাও কোঁচকানো সামান্য। আড্ডা-ফেরত স্বামীকে বেশিরভাগ সময়েই হাসিখুশি মজাদার লাগে, যেন আড্ডার রেশ নিয়েই বাড়ি ফেরেন। আজ ঘোষবাবুর মুখের এ-চেহারা কেন! নবতারা বললেন, “কী হয়েছে? ঝগড়াঝাটি?”