‘ক’ মাস লাগল মেওয়া ফলতে?” আমি বললাম হাসতে হাসতে।
“তা লাগল ক’মাস। তার আগে এক কাণ্ড হল। লালুবাবু যে সেবার একটা বাক্স ক্যামেরা নিয়ে এসেছে ফটো তুলবে বলে, আমায় বলেছিল। ফটোও তুলত, আমি নজর করিনি। একদিন বলল, আমার একটা ছবি তুলবে। আমি না না করলাম। কিন্তু সে একেবারে নাছোড়বান্দা। শেষে একদিন শীতের দুপুরে, কেউ যখন কোথাও নেই, হাসপাতালের পেছনের সেই করবী ঝোপের পাশে একটা পাথরের ওপর বসাল আমায় লালু। বলল, সে সব ব্যবস্থা করে ক্যামেরাটা মানির হাতে দেবে। নিজে থাকবে আমার পাশে, ফটো তুলবে মানি। আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না। লালুবাবুও শুনবে না। শেষে আমার পা ধরতে আসে। কী করা করব, রাজি হয়ে গেলাম।”
“ফটোও তোলা হল যুগলের?”
“হল। কিন্তু শয়তানিটা কী করল জানিস লালমোহন।” রত্নদিদি বললেন, “মানিকে ঠিকঠাক দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজে একবার সব দেখে নিয়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। আমার ভাই লজ্জাই করছিল। মুখ তুলে তাকাতে পারি না। ওদিকে মানিকে রেডি হতে বলে লালুচাঁদ পেছন থেকে ঝপ করে আমার চোখ টিপে ধরল। আর ওদিকে ছবি তোলাও হয়ে গেল মানির। ফটো তুলে নিয়ে মানি দে ছুট। আমি হতভম্ব। বুঝলাম, মানিকে সবটাই শেখানো পড়ানো ছিল। রাগের মাথায় লালুর হাত খামচে, মাথার চুল টেনে ছিড়ে যা মুখে এল বলতে বলতে বাড়ি ফিরে এলাম। রাগে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল।”
রত্নদিদি একটু চুপ করলেন। কিছু যেন ভাবছিলেন।
বললাম হেসে, “ফটোটা উঠেছিল?”
“উঠেছিল মানে, কপালে থাকলে কী না ওঠে রে? লটারির টাকাও উঠে যায় চাপরাশির কপালে। মানির হাতে তোলা সেই ফটোও লালমোহনের কপালে উঠে গেল। ..তা ভাই বলতে পারিস, ফটোটা উঠল বলে বিয়ের ফাঁসটাও লেগে যেতে পারল।”
“কী রকম?”
“রকম আর কী! লালুবাবু চৌখস ছেলে। বাঁকড়াতে থাকতে থাকতেই বি.এন রেলের হাসপাতালে চাকরি জোগাড় করে ফেলল ছোট ডাক্তারের। তারপর একদিন বাবার নামে এক রেজিস্ট্রি এল। নতুন ছক কোষ্ঠী আর পাঠাবার দরকার হয়নি ওর। শুধু ওই ছবির একটা কপি পাঠিয়ে দিল বাবাকে, আর লিখল— ‘আপনাদের বিবেচনায় যা হয় করিবেন। আমি দূরে চলিয়া যাইতেছি, নতুন চাকরি, বিলম্বে আমার অসুবিধা হইবে।”
“বলো কি, সেই ফটো তোমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল?”
“দেবার জন্যই তো তুলেছিল। কম সেয়ানা নাকি ও। মাথায় যত ফন্দিফিকির তত বুদ্ধি। আইবুড়ো এক মেয়ের অমন ছবি, পেছন থেকে চোখ চেপে ধরে আছে এক ছোঁড়া— ওই ছবি দেখার পর কোন বাপ-মা আর বসে থাকতে পারে? অন্য সম্বন্ধ-ই বা করবে কেমন করে! কোন সাহসে! কাজেই বিয়েটা হয়ে গেল।” রত্নদিদি হাসলেন, “লালুবাবুর রত্নলাভ হল।”
“বিয়েতে খুব ধুম হয়েছিল তাই না!” কে যেন বলল মেয়েদের তরফ থেকে।
“তা হয়েছিল। তবে তাদের আজকাল যেমন দেখলাম তেমন নয়। সে অন্য রকম, নিজেদের লোকজন, পাড়াপড়শি নিয়ে ধুম। বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলা সেরে বরের সঙ্গে চলে গেলাম দূরে। সেখান থেকে চাকরির বদলি ঘটতে ঘটতে আটশো হাজার মাইল দূরে গিয়েই পড়লাম একদিন। আমাদের আর এদিকে ফেরা হল না। তারপর একদিন তোদের জামাইবাবু তো চলে গেলেন। আমিই পড়ে থাকলাম ছেলে বউ নাতি আগলে। কী করব বল? কপালে আমার যেমনটি লেখা ছিল সেই ভাবেই আছি। দুঃখ করে কী লাভ!”
সবাই চুপ। একটু যেন গম্ভীর হয়ে এল আবহাওয়া। অবস্থাটা হালকা করার জন্য আমি বললাম, “তা সেই ফটোটা তুমি রেখেছ না হারিয়ে ফেলেছ?
মাথা নেড়ে রত্নদিদি বললেন, “হারিয়ে ফেলব কেন, রেখে দিয়েছি। তা বলে সেটা কি আর, দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা যায়! লোকে দেখলে বলবে কী। ছেলেরাও তো বড় হয়ে উঠছিল। আমার বাক্সর তলায় লুকিয়ে রেখে দিতাম।”
“আহা, রত্নদিদি— সে ফটো যদি একবার দেখতে পেতাম…।”
“পাগল, তোদের দেখাতাম আর কী!…এবারই কি হল জানিস! শীতের আগে একদিন আমার তোরঙ্গ খুলে চাদরটা জামাটা বার করছি রোদে দেব বলে। আমাদের ওখানে শীত একেবারে কসাই, মায়াদয়া নেই, পড়ল তো গা-হাত-পা কেটে কেটে রক্ত বার করে দেয়।…তা আমি তোরঙ্গ খুলে আমার শালটা চাদরটা ফ্ল্যানেলের জামাটা বার করছি, করতে করতে তোরঙ্গর তলায় রাখা ফটোটা হাতে এল। তুলে নিয়ে দেখছিলাম। কত পুরনো ছবি, মামুলি একটা ক্যামেরায়, ছবিটা হলুদ হয়ে গিয়েছে। বেসম-বেসম রং, এখানে ওখানে দাগ ধরেছে। উঠে গিয়েছে খানিক— তবু ঘটিহাতা জামা পরা বিনুনি ঝোলানো রোগা পাতলা একটা মেয়েকে চোখে পড়ে, আর পড়ে খোঁচা খোঁচা মাথার চুলের একটা ছেলেকে, মালকোঁচা মারা ধুতি, গায়ে শার্ট আর হাতকাটা সোয়েটার। ছেলেটা মেয়েটার পেছনে দাঁড়িয়ে। চোখ টিপে ধরে আছে মেয়েটার। ও ছবি দেখলে কেউ তোদের রত্নদিদির ছবি বলবে না। তোদের জামাইবাবুরও নয়।…নিজের মনে ছবিটা দেখে নিজেই বুঝি হাসছিলাম, এমন সময় হুড়মুড় করে নাতি এসে পড়ল। ফটোটা লুকোতে গিয়েও পারলাম না। নাতি কেড়ে নিল। দেখল খানিক। তারপর কী বলল জানিস?”
“কী” ?
“বলল, এ বুড়িয়া কার পিকচার এটা?..কী বলি বল নাতিকে? বললাম, ও এমনি। হবে কারও। বাক্সর মধ্যে পড়েছিল।..তা ফটোটা ফেরত দিতে দিতে নাতি বলল, বুঢড্ডি টিভিতে ওল্ড হিন্দি ফিল্ম দেখায় দেখেছ? অছ্যুত কন্যা, ঝুলন– দ্যাট টাইপ…বেচারি হিরো হিরোইন…ফালতু, আদ্মি! একদম ফালতু! বলে সে চলে গেল। …আমি আর কী করব বল! দেখলাম একটু, তারপর কাগজে মুড়ে— যেমনটি ছিল তোরঙ্গর তলায় রেখে দিলুম।…ভাবিস না আমার রাগ দুঃখ হল! কেনই বা হবে ভাই! পঞ্চান্ন ষাট বছর কী কম! অত পুরনো ছবির দাম কী! কদরই বা হবে কেন? নাতিই বা কেমন করে চিনে নেবে তার ঠাকুমা ঠাকুরদাকে ওই ফটো থেকে! চেনা যে যায় না। ”