আমি বললাম, “আবার কোষ্ঠী কেন?”
“বাবার যে বিশ্বাস কোষ্ঠীতে। তখন এগুলো হত।”
“এখন আরও বেশি হয়।”
“লালুদের বাড়ি থেকে তার ছক কোষ্ঠী এল। বাবা নিজে পাঁজিপুথি নিয়ে বসল। আমার ছক গেল লালুদের বাড়িতে। …দশ বিশ দিন সময় গেল বাবার কোষ্ঠী বিচার করতে ভাল করে। তারপর বাবা বলল, এই বিয়ে হবে না। জাতকের পতন-যোগ আছে। মানে ছেলের অনিবার্য পতনযোগ। সেটাই ভীষণ খারাপ যোগ। মারকতুল্য। মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপতে পারে— তবে…”
আমি হেসে বললাম, “পতন-যোগ তো কেটেই গিয়েছিল, দিদি। গাছ থেকে পড়ার পর আর কিসের ভয়! অন্য পতন তো তোমার সঙ্গে, প্রেমে পতন।”
রত্নদিদি বললেন, “কে কাকে এ সব বোঝায়! বাবা ছেলের খুঁত ধরে বলল, পতন-যোগ আছে পাত্রর, তো ও-বাড়ি থেকে ছেলের বাবা বলল, মেয়ের ছক থেকে তাদের পণ্ডিত দেখেছে যে, মেয়ের বন্য জন্তু দ্বারা দংশনের যোগ আছে। অগত্যা এ-বিয়ে হবে না।”
“কিন্তু হল তো বিয়ে!”
“হল বইকি! কেমন করে হল সেটা এবার শোন।”
তিন
বিশুর মা আমাদের জন্যে চা এনেছিল। বিয়েবাড়ির কাঠের ট্রে ; ছোট ছোট কাপে কয়েক জনের মতন চা। কেউ নিলাম, কেউ নিলাম না। রত্নদিদি দু বেলা দু বারের বেশি চা খান না। তিনি চা নিলেন না। বরং আরও একবার জল খেয়ে মশলা মুখে দিলেন।
বাইরে বুঝি বসন্তের দমকা হাওয়ার ঝাপটা থেমে গিয়েছে। শীতের সিরসিরে ভাবটাই গায়ে লাগছিল। জ্যোৎস্না আরও পরিষ্কার। উজ্জ্বল।
“তারপর কী ঘটল, বলো?” আমি হেসে বললাম।
রত্নদিদি বললেন, “বলি।….তিন-চার মাস আমাদের আর দেখাদেখি নেই। চিঠিপত্তর লেখার দিনকাল তখন নয়, সে সাহসও নেই। সেই একবার যা চিঠি লিখেছিল লালুবাবু। এদিকে বিয়ের কথাও ভাঙতে চলেছে। মনটন ভাল থাকবে কেন, বল! রাগ হত খুব। ভদ্রলোকের ছেলে তুমি, একটা ভাল ছক কোষ্ঠীও করাতে পার না! বাবার মুখে কতবার শুনেছি, যদু মধু বেলা অনিলার ছক কোষ্ঠী বিচার করে বাবা মাকে বলছে, ‘বেশ ছক গো, দেরে বড় আনন্দ হল, বিয়ে হলে মিলমিশ হবে খুব, রাজযোটক।’..পরের কোষ্ঠীতে যা হবার হোক আমাদের তাতে কী! আমরা তো আর যোটক হতে পারছি না। বলবি, আমারও তো ছকটক ভাল ছিল না। আমি বলছি, মোটেই তা নয়। বাবা হল মেয়ের বাপ— সে যদি ছেলের বাড়ির লোকদের আগ বাড়িয়ে বলে, ছেলের ছকে দোষ আছে— তারাই বা মেয়ের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ছাড়বে কেন!
“বিয়ের কথা ভেঙেই যাচ্ছিল। এমন সময় একদিন আবার লালুবাবু এসে হাজির। তার ভাবসাব দেখে মনে হল, বাড়ির গুরুজনদের কথাবার্তা নিয়ে সে একটুও মাথা ঘামায় না। বরং নতুন ডাক্তার হয়ে তার যেন চেহারা খুলেছে, আরও বড় বড় ভাব হয়েছে, আমতলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, যখন তখন, দিব্যি আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলছে— মামিমা একটু চা খাওয়ান, দুধ কম, আমি আবার কড়া চা ছাড়া খেতে পারি না। কী আর বলব মাসিমা, হাসপাতালে এত খাটায় যে দিনে দশ বারো বার চা না খেলে জোর পাই না। খাটতে আমার ভালই লাগে। এই বয়েসে খাটব না তো কখন খাটব বলুন। কুঁড়েমি দেখলেই আমার মাথা বিগড়ে যায়। ওই যারা খায়দায় আর ঘুমোয়— তাদের কি হয় না।…এই ভাবে নিজের বাহাদুরি ফলায় মায়ের কাছে। আর আমায় খোঁচা মারে।”
কৃষ্ণাবউদি বলল, “বিয়ের কথা তো ভেঙেই গিয়েছে তবু উনি এভাবে আসতেন আপনাদের বাড়িতে?”
“আসবে না কেন, দু কান কাটা যে—” রত্নদিদি হেসে বললেন, “তা ছাড়া ডাক্তার কাকার ভাগ্নে, আমাদের প্রতিবেশী। দু বাড়িতে অত ভাবসাব, ডাক্তার কাকিমা মায়ের বন্ধুর মতন, লালুও আমাদের কত চেনাজানা হয়ে গিয়েছে। বিয়ের কথাবার্তা ভেঙে গেলেও একেবারে সব কিছু উপড়ে মাটিতে নুয়ে পড়েনি। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।… তা লালমোহন এবার এসে মাকে যত তোয়াজ করতে শুরু করল, তার বেশি করতে লাগল আমায়। তখন শীত পড়েছে। ওদিকে জব্বর শীত পড়ত, ভাই ; পৌষ মানে একটা লেপে কুলোত না রাত্তিরে! ভোরে তোলা জলে হাত ছোঁয়ানো যায় না, ইঁদারার টাটকা জলে ধোঁয়া ওঠে, কিন্তু যেই না—বালতির জলে বাতাস এসে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে কনকনে। সকালে সামনের মাঠটা হিনে শিশিরে ভিজে যেন অসাড় হয়ে থাকত।… রোজ সকালে দেখতাম, লালমোহন আমার ঘরের বন্ধ জানলার কাছে এসে ঠকঠক করে টোকা মারত। ধড়মড় করে উঠে বসলাম, জানলা খুললাম কী দেখি মাথার হনুমান টুপি, গায়ে ভট কম্বলের অলেস্টার, গলায় মাফলার, লালুর মুখ। তখন সবে রোদ উঠছে, সুয্যির মুখ দেখিনি, তার আগেই লালুর মুখ। তখনই ঠিক হয়ে যেত, বেলায় কোথায় কখন দু জনে দেখা হবে। আবার বেলায় যখন দেখা হত, বলে দিত বিকেলে কেমন করে দেখা হবে। এই ভাবে সারা দিনে তিন-চার বার দেখা হত দু জনে আড়ালে। কখনো কাঁঠালতলার পেছনে একটা অকেজো রোড রোলারের আড়ালে। কখনো বন্ধ হাসপাতালের পেছনে করবী ঝোপের কাছে। লালু আমায় বলত, একেবারেই ঘাবড়াবে না, বিয়ে আমাদের হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না ; আমি আর এক সেট কুষ্ঠীগুষ্টি করিয়ে দিচ্ছি বাঁকড়োর ফেমাস পণ্ডিতকে দিয়ে, হরিসাধন জ্যোতিষার্ণব। দেখবে সেই কুষ্ঠীতে আমি রাজা, তুমি রানি। …আর তখনও যদি তোমার বাবা বাগড়া মারেন, তোমায় নিয়ে আমি পালাব রতনমণি। সেরেফ ক’টা মাস। আমি চাকরির চেষ্টায় আছি। তুমি লক্ষ্মী, একটু সবুর করো, সবুরে মেওয়া ফলে।”