“তবে আমাদের সময়ে দিনকাল তো অন্যরকম ছিল। আজকালকার মতন চোখের সামনে নাচানাচি করার জো ছিল না। লুকিয়ে চুরিয়ে, এপাশ সেপাশ নজর রেখে কথাবার্তা, মেলামেশা।
“ওর তখন পরীক্ষা। শেষ পরীক্ষা। লালমোহন বইপত্তর গুছিয়ে মামার বাড়িতে পরীক্ষার পড়া করতে এল। তাই তো বলত মুখে। স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে ভিড়লে পড়া হয় না। বাড়ি সেই কোন পাড়াগাঁয়ে, বাপ জমিজায়গা, ধানচাল, পুকুর বাগান নিয়ে থাকেন।
“মামার বাড়িতে এসে লালমোহন যখন বইপত্তর খুলে বসেছে, তখন এক বিকেলে বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেল একটা। আমার বেশ মনে আছে দিনটা। বর্ষাকাল নয়, তবু থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। দিন দুপুর মেঘলা। রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিপঝিপে বৃষ্টি।
“তা সেদিন— এই মাঝ দুপুরে লালমোহন বাঁশি বাজিয়ে ডাকল আমায়। এ তোর আড়বাঁশি নয়, সিটি বাঁশি। ফুরর-ফুর—ফুরর-ফুর। চেনা বাঁশি আমার। মেঘলা দিন, দু পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে খানিকটা আগে, আমি নিজের ঘরে খাটে শুয়ে শুয়ে ‘ইন্দিরা’ পড়ছিলাম। বাবার আমার পড়ার নেশা ছিল। এক আলমারি বই, নাটক নবেল, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, দু-একটা পুরনো ইংরিজি বই—এই রকম সব। ..কাজকর্ম না থাকলে আমি চুপ করে শুয়ে থাকতাম খানিক, না হয় পুরনো পড়া বই আবার পড়তাম। সেদিন শুয়ে শুয়ে ‘ইন্দিরা’ পড়ছি। ওই যে একটা জায়গা আছে বইয়ে— ‘ধানের ক্ষেতে,/ ঢেউ উঠেছে,/ বাঁশতলাতে জল।/ আয় আয় সই, জল আনি গে/ জল আনি গে চল—’, পড়তে পড়তে হেসে মরছি নিজের মনে— এমন সময় শুনি ফুরর-ফুর, ফুরর ফুর।…বুঝলাম লালুবাবু ডাকছেন। বই রেখে উঠে পড়ে বাইরে এলাম। এদিক তাকাই ওদিক তাকাই বাঁশিওয়ালাকে দেখতে পাই না। ভর দুপুর, ঘন মেঘলা, বৃষ্টির দরুন মাঠঘাস ভিজে, চারপাশ ফাঁকা, হাসপাতালের দিকেও কেউ কোথাও নেই, দুপুরে কেউ থাকে না, বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতাল, দুটো গোরু আর ছাগল চরছে কাঁঠালতলার দিকে। আমতলাও ফাঁকা। খুঁজতে খুঁজতে আমতলার কাছে এসে দেখি, লালুবাবু একটা আমড়ালের ওপর পাতার আড়ালে কায়দা করে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বসে বসে ভিজে আমপাতার পাতলা ডাল নাড়িয়ে জলের ফোঁটা ফেলছে নীচে। আমায় ভিজিয়ে দেবার আগেই সরে দাঁড়ালাম। চারপাশ দেখছি আর কথা বলছি দু জনে ; কেউ যদি আচমকা বাইরে এসে দাঁড়ায় আমাদের বাড়ির, কিংবা ডাক্তার কাকার বাড়ি থেকে— আমায় দেখতে পাবে, লালুবাবুকে পাবে না। আমায় দেখলে হয়ত ভাববে, গাছতলার নীচে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার ওই একটা দোষ ছিল, এটা সেটা, কানের ফুল, হারের লকেট, পয়সা কড়ি বড় হারাতাম। আমার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘হারানি’।.. তা দু জনে গল্প করছি, কথার তো কোনো মাথামুণ্ডু থাকে না আমাদের, হঠাৎ দেখি লালুবাবু গাছের ডাল থেকে একেবারে ধপাস করে মাটিতে। শব্দ হল। পড়েই চিত। আর নড়ে না চড়ে না। চোখের পাতা বন্ধ। আমার ভাই, বুক ধড়াস করে উঠল। চারপাশ তাকিয়ে নিয়ে ওকে একবার ডাকি, একবার নাড়া দি, তবু সেই কাঠের মতন পড়ে আছে। যাঃ অজ্ঞান হয়ে গেছে বোধহয়। কী করি, আমাদের বাড়ির গায়ে ইদারার পাড়ে দড়ি বালতি পড়ে থাকে। ছুটে গিয়ে বালতির জল এনে চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলাম। মৃগি রোগীর মতন মুখ করল একবার। তবু সাড়াশব্দ নেই। ভীষণ ভয় ধরে গেল। কী যে করি? বেঁচে আছে তো? ধারেকাছে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, সেই গোরু দুটো আর ছাগল ছাড়া। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, লালুবাবুর চটি জোড়া গাছতলায় পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এল, জুতোর গন্ধ শোঁকালে বেহুঁশ লোকের হুঁশ ফিরে আসে শুনেছি। দৌড়ে গিয়ে একপাটি চটি কুড়িয়ে এনে লালুবাবুর নাকে চেপে ধরলাম। হাতে হাতে ফল রে ভাই। মরা মানুষ যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল। লাফ মেরে উঠে বসল লালুবাবু। বলল, তুমি আমার মুখে জুতো ছোঁয়ালে, গোবর লাগিয়ে দিলে নাকে! কী বিচ্ছিরি গন্ধ! চললাম, আর নয়। যে মেয়ে লাভারের নাকে গোবর লাগানো জুতো ঘষে দেয়, সে মেয়ে নয়, মোষ। বলে লালুবাবু ঘেন্নায় নাকমুখ মুছতে মুছতে দে দৌড়।”
রত্নদিদি নিজেই হেসে উঠলেন। আমরাও অট্টহাসি হেসে বললাম, “জুতোটা না ঘষলেই পারতে! ইচ্ছে করে ঘষে দিয়েছিলে নাকি?”
রত্নদিদি মাথা নেড়ে বললেন, “না ভাই, বিশ্বাস কর, ইচ্ছে করে দিইনি। তাই কি কেউ দেয়! তখন কেমন মাথার গোলমাল হয়ে গিয়েছিল ভয়ে। থতমত খেয়ে গিয়েছিলুম।”
“তারপর কী হল?”
“কী হল! সে আর এক কাণ্ড। বাবুর মুখে জুতো ছোঁয়ানোর প্রায়শ্চিত্ত করতে একদিন সন্ধের মুখে আমাদের বাড়ির সদরে কাঠচাঁপা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে— এই তোর দু-চার পলকের জন্যে নিজের নরম গালটা এগিয়ে দিতে হল। আমি কি যেচে দিয়েছিলুম নাকি।…ও হঠাৎ বলল, তোমার গালে শুয়োপোকা পড়েছে। শিগগির দাও—ফেলে দি। ওই একটু ভুল হয়ে গেল, প্রথম, আর সেই মুহূর্তে মা এসে দাঁড়িয়েছিল বাইরে। দেখে ফেলল। লালুকে আমি ধাক্কা মেরে সরাবার আগেই সে নিজেই সরে পড়ল।”
আমাদের হাসির রোল উঠে বাইরে ছড়িয়ে পড়ল বোধ হয়।
“এ তো দেখছি—”
“দেখছি আবার কী! ওই টুকতেই সর্বনাশ হয়ে গেল।” রত্নদিদি বললেন, “লালুর পরীক্ষার পড়া হচ্ছে না ঠিকমতন বলে সে ফিরে গেল বাঁকুড়ায়। আমি থাকলাম মায়ের নজরে নজরে। ..দেখতে দেখতে মাস ফুরোল। পরীক্ষা হয়ে গেল লালুর। পাস করে হাসপাতালেই হাত পাকাতে লাগল। দেখাসাক্ষাৎ আর হয় না। শেষে লালুর মামাই বিয়ের কথাটা পাড়ল বাবার কাছে। বাবা বলল, ছেলে তো চেনাজানা, ডাক্তারও হয়েছে— ভাল কথা। তবে ওই ছেলের স্বভাবচরিত্র বুঝতে হবে। আর দেখতে হবে— ভবিষ্যৎটা কেমন? কোষ্ঠী দেখাতে হবে। বাবা নিজে দেখবে। তারপর কথা—!”