“লালমোহন থতমত খেয়ে গেল। বলল, তুমি আমায় ছাগল বললে? জানো আমি এল এম এফ পরীক্ষা দিচ্ছি। আজ বাদে কাল ডাক্তার হব।
“ঠোঁট উল্টে আমি বললাম, অমন লম্ফ আর হেরিক্যান ডাক্তার গণ্ডায় গণ্ডায় হয়। … আমার পেটে কী আছে তুমি জানলে কেমন করে? তোমার নিজের পেটের খবরটা নাও আগে গিয়ে। খবরদার, আমার সঙ্গে ফক্কুরি করতে এসো না, তোমার ডাক্তারি ঘুচিয়ে দেব, আমায় তুমি চেনো না।
“বললাম বটে, কিন্তু কাকে! কী কানকাটা নাককাটা ছেলে রে ভাই। মান অপমান জ্ঞান নেই। ধমক খেয়ে তার মজা যেন বেড়ে গেল। সাইকেলের চক্কর শুরু হল একেবারে আমাদের বাড়ির গায়ে। ঘন ঘন দেখতে আসতে লাগল আমার ভাইকে। একটু আড়াল পেলেই আমায় দেখে পিটপিট করে হাসত, আর বলত, শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায়, চোখ পাকালে পেটের কৃমি মরে না।
“ভাই সেরে উঠতে না-উঠতে আমি পড়লাম। বড় বয়েসের হাম। সে কী কষ্ট। ডাক্তার লালমোহন আমায় হামে পড়তে দেখল। ততদিনে তার স্কুল খুলে গিয়েছে। চলে গেল।
“ভাবলাম, বাঁচা গেল। আর তো পেছনে লাগতে আসবে না সে!…ওমা, তোরা শুনলে অবাক হয়ে যাবি, লালমোহনের কত বড় দুঃসাহস আর শয়তানি বিদ্যে! আমি সেরে উঠেছি, হঠাৎ একদিন এক চিঠি। একেবারে খামে। ভেবে দেখ কাণ্ডখানা! তখনকার দিনে কোনো গেরস্থবাড়ির আইবুড়ো মেয়ের নামে কি কেউ চিঠি লিখত? আবার খামের ওপরে আমার নাম, নীচে কেয়ার অফ বাবার নাম। ধর, বাবার নাম যদি নাও থাকত— তবু তো পোস্ট মাস্টার। তার মেয়েকে তুমি চিঠি লিখলে সে চিঠি কার নজরে পড়বে গো! বাবার হাতেই পড়ল চিঠি। মায়ের হাত ঘুরে সে চিঠি এল আবার আমার হাতে। ভয়ে লজ্জায় মরি। রাগে মাথায় আগুন জ্বলে যায়। এমন বেহায়া, অসভ্য, হদ্দ বোকা কেউ হয় নাকি? চিঠির খাম আগেই খোলা ছিল। ভেতরে কী দেখলাম জানিস? শুনলে তোদের বিশ্বাস হবে না। চার-ছ লাইনের এক চিঠি লিখেছে লালমোহন। চিঠির ঠিক ঠিক ভাষা আমার মনে নেই, তবে লেখার ঢংটা ওই রকম : ভাই রতনমণি, আসিবার সময় তোমার হামজ্বর দেখিয়া আসিয়াছি। এতদিনে নিশ্চয় তোমার জ্বরজ্বালা সারিয়াছে। বড় বয়সে হামজ্বর অতি মন্দ। পরে বড় ভোগায়। সাবধানে থাকিবে। তোমার কথা মতন আমাদের এখানকার এক নার্শারির কাগজ পাঠাইলাম। ফলফুলের নাম ও দাম পাইবে। সবই লেখা আছে। পয়লা নম্বরের গাছগুলিতে টিক মারা আছে। লক্ষ করিয়া দেখিও। মামাবাবু মামিমাকে আমার প্রণাম জানাইলাম। তোমরা স্নেহ জানিবে। ইতি তোমার লালুদা।
“চিঠি পড়ে আমি আকাশ থেকে পড়ি রে? এক ফালি চিঠি তো চারপাতা ছাপানো নার্শারির কাগজ। ফলফুলের নাম। দাম। আমি একবারের জন্যেও লালমোহনকে ফলফুল নার্শারির কথা বলিনি। আমাদের বাড়ির সামনে তিন হাতের বাগানে একটা কলাগাছ, লাউমাচা একটা। দুটো লঙ্কাগাছ আর ফুলের মধ্যে জবা, চাঁপা আর শীতের সময় দু-চারটে গাঁদা। বাগানে আমার জল দেওয়াও হয় না, ভরতদা দেয়।…আমার মাথায় কিছু ঢুকল না। নার্শারির ছাপা কাগজ কেন পাঠাল লালমোহন? তার মতলবটা কী? ছাপা কাগজগুলো বারবার দেখেও আমার বাপু বিদ্যে হল না বুঝি ওর মধ্যে কী হেঁয়ালি আছে।
রত্নদিদি একটু থামতেই, আমি হেসে বললাম, “হেঁয়ালি ছিল নাকি?”
কৃষ্ণাবউদিও হেসে বলল, “পায়ে ধরে পিসি সাড়া দেয় না মাসি— সেই রকম হেঁয়ালি নাকি?”
রত্নদিদি কাপড়ের আঁচল মুঠো করে মুখের সামনে তুলে জোরে জোরে হাঁচলেন বার দুই। খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। কাল ছিল ত্রয়োদশী, আজ চতুর্দশী। শুক্লপক্ষ। জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে যেন বাইরে, বাতাস বইছে।
“ছিল। কিন্তু তখন বুঝিনি”, রত্নদিদি বললেন, “পরে বুঝলাম। নার্শারির ছাপা কাগজ পাঠিয়ে ও বাবা-মায়ের চোখে ধুলো দিয়েছে— সেটা ধরতে পারলেও বুঝতে পারিনি ফলফুলের ছাপা নামগুলোর তলায় যেখানে যেখানে পেনসিলের টিক আছে— সেই অক্ষরগুলো বেছে বেছে সাজিয়ে নিলে বোঝা যায় লালু আমার ‘লাবে’ পড়েছে।”
কৃষ্ণাবউদি জোরে হেসে ফেলে বলল, “আপনি তো বললেন, হেঁয়ালি ধরতে পারেননি।”
“পারিনি তো! কেমন করে পারব।… তারপর লালমোহন আবার যখন এল, আমায় বলল, তোমার মাথায় ঘিলু আছে না গোবর! কিস্যু বুঝতে পারো না। নিয়ে এসো নার্শারির কাগজ বুঝিয়ে দিচ্ছি। গোলাপের ‘লা’ আর বেলের ‘বে নিলে কী হয়— বুঝতে পারো না? ঘেন্টু কোথাকার! …বললাম, সে-কাগজ ফেলে দিয়েছি।…হাঁ হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ফেলে দিয়েছ। তুমি মেয়ে, না হান্টারওয়ালি! এই ভাবে কেউ চাবুক মারে বুকে!”
আমরা হেসে ফেললাম। হো হো করে।
সত্যদা বলল, “লালমোহন কি প্রায়ই আসত তোমাদের ওখানে?”
রত্নদিদি বললেন, “আসত মানে! এই তোমার গরমে আসছে, পুজোয় আসছে, শীতে আসছে, দোলের ছুটিতে আসছে— দু-এক মাস অন্তর অন্তর হাজির। বাঁকড়ো তো কাছেই আসতে চাইলেই আসা যায়।”
“তারপর—?” আমি বললাম।
রত্নদিদি হাসতে হাসতে বললেন, “দেখ আমি বাহাত্তুরে বুড়ি। আমার আর লজ্জাশরম কী! যা বলব, খোলাখুলি বলব। লালমোহনের সঙ্গে আমার ভাবসাব হয়ে গেল বেশ। ও এলেই আমার ভাই মন ফুরফুর করত। চলে গেলে বুক হু হু করত। তা যাই বলিস, লালুর মামা-মামিও ভাগ্নে বলতে ছিল অজ্ঞান। ভালবাসত খুব। এই যে তাদের ভাগ্নে হরদম ফাঁক পেলেই মামার বাড়িতে ছুটে আসে— তাতে ওদের সায় ছিল, খুশি হত। কিন্তু ভাগ্নে যে কার টানে ছুটে আসে তা কি অত বুঝত! একটু-আধটু বুঝত নিশ্চয়। তারা তো কানা নয়। আমার বাপ-মাও নয়। বুঝত ঠিকই, মুখে কিছু বলত না। বলবেই বা কেন! ছেলে হবু ডাক্তার, মেয়ের বয়েস আঠারো হল। ঘরে মর্যাদায় সমান সমান। ভেতরে ভেতরে একটা সায় ছিল দু তরফের।