“তোমার হাতে পড়লে পাকা হব না। কাঁচা আতা চালের তলায় গুঁজে রেখে মা মাসিরা আতা পাকাত দেখেছি। আর দেখলাম তোমাকে—। আমার কাঁচা বয়েসটাকে কেমন করে পাকিয়ে দিলে।”
রমেশ এই সময় গুন গুন করে টপ্পা গেয়ে উঠল, “আমার কাঁচা পিরীত পাড়ার ছোঁড়া পাকিয়ে দিল গো।”
জগবন্ধু ধমক মেরে বললেন, “ভালগার। বেহায়াপনা। আত্মা এমন বেহায়া হয় জানতাম না। ছ্যা ছ্যা—।”
তিরি হি হি করে হেসে বেঁকা গলায় বলল, “কেন গো জগুদা, ছ্যা—ছ্যা কেন? আমার সেই কচি বয়েসে যখন বাতাবিতলায় দাঁড় করিয়ে বিল্বমঙ্গল প্লে করতে তখন তোমার বেহায়াপনা কোথায় যেত!”
“বিল্বমঙ্গল ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার! তুমি তখনও মুখ্যু ছিলে এখনও মুখ্যু।”
তিরি ইস ইস শব্দ করল জিবে। বলল, “মুখ্যু তো বটেই নয়ত আমাকে পড়া দেখিয়ে দেবে বলে কেনই বা তেতলার ছাদে নিয়ে যাবে বলো। আহা দুজনে কত পড়াই পড়তাম—পড়তে পড়তে মুচ্ছো যেতাম। আমি রোগা পাতলা—তাই না তিরতিরে তিরি। আর তুমি গোবা গবলা। তোমার মুচ্ছো হলে সে ভার কি সইতে পারি, হেলে যেতাম।”
জগবন্ধু টেবিল চাপড়ে বললেন, “এ-সব হচ্ছে কি? আমার কাছা ধরে টান মারা হচ্ছে?”
যামিনী তিরির উদ্দেশে বললেন, “দাও ভাই দাও বুড়োর কাঁচাকাছা খুলে ন্যাংটো করে দাও।”
তিরি উৎসাহ পেয়ে বলল, “ও-হাঁড়ি কি ভাঙা যায়, বউদি। ও হল জ্বালা। বলতে গেলে সাত কাহন। আমার অত সময় নেই। অনেকক্ষণ এসেছি। যাবার সময় হয়ে গেল।”
জগবন্ধু গজরাতে লাগলেন, “মানুষ মরে গিয়েও এত মিথ্যে কথা বলতে পারে।”
তিরি ফোঁস করে উঠল। “কোপচো না। জ্যান্ত থাকতে তুমি আমায় দিয়ে মিথ্যে কথা বলিয়েছ? না নিজে বলছ? লজ্জা করে না। ঠাকুমার সত্যনারায়ণের মানত করা টাকা চুরি করে এনে দিয়েছি, কিনা জগুদা আমার ঝরিয়াতে সার্কাস দেখতে যাবে। দিইনি? নেমকহারাম একেই বলে! আমার কোলে লম্বা হয়ে শুয়ে উনি বললেন, তিরি আমি তোমার লখিন্দর—তুমি আমার বেহুলা, আমি তোমার প্রেমে মরেছি। তুমি আমায় যমের হাত থেকে উদ্ধার করো। আর তুমি যদি উদ্ধার না করো আমি সংসার ত্যাগ করে ভোলানাথ হয়ে ঘুরে বেড়াব হরিদ্বার লছমনঝোলা। ঠিক এই সময় জ্যাঠামশাই—জগুদার বাবা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। আর লখিন্দর আমার গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে সাক্ষাৎ যমের পাশ দিয়ে ছুটে পালাল।”
জগবন্ধু চিৎকার করে বললেন, “তোমার সেই ধেষ্টামির জন্যে বাবা আমায় সটান হেতমপুর কলেজে পড়তে পাঠিয়ে দিল তা জান?”
“তা জানব না। আমি তো তখন কুচি খুকি নই। সতেরো বছর বয়েস হয়ে গেছে।—ওই কীর্তির পরও বাড়ি এলে তোমার কত আদিখ্যেতা। আমার এ-গালে চুমু ও-গালে চুমু। এক একদিন গাল আমার নীল হয়ে যেত।”
জগবন্ধু আর্তনাদ করে উঠলেন। “প্রিভিলেজ অফ কিসিং আমার ছিল যে তোমার গালে চুমু খাব?”
“খেয়েছ!”
রমেশ বলল, “তিরি মিথ্যে বলছে না। আমি একদিন জগোবাবুকে কিস করতে দেখেছি। গোয়াল ঘরের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে করছিল।”
জগবন্ধু খেপে গিয়ে বললেন, “ও শালা, আমি হলাম চোর, আর তুমি সাধু!”।
তিরি বলল, “সাধু আবার কোথায়! সেদিন জগুদা একটা গালে চুমু খেয়ে চলে যাবার পর রমাদা এসে বলল, আমি তোদের চুমোচুমি দেখেছি। দে, আমায় দুটো দে, নয়ত বলে দেব বাড়িতে।”
রমেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বার কয়েক ঢোঁক গিলল। আমতা আমতা করে বলল, “আমার মনে নেই।”
আশালতা নিচু গলায় বলল, “কী ঘেন্না, কী ঘেন্না! এঁটো মুখে মুখ ঠেকাতে ঘেন্নাও করল না।”
বঙ্কু এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার বলল, “দিদি, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি আর কথা বোলো না, হাঁপাচ্ছ।”
তিরি একটু চুপ করে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, “সত্যি অনেক দেরি করে ফেললাম। অনেক দূর যেতে হবে। আমি এবার যাই। আমার কর্তা তো হাঁ করে চেয়ে আছেন। তা একটা কথা বলি জগুদা, বিয়ের পর আমার বর কিন্তু একদিনের জন্যেও কাছ ছাড়া করেনি। বড্ড ভালবাসত। কিন্তু কপাল যার মন্দ তাকে কে বাঁচাবে। শখ করে দু ঘটি বুনো সিদ্ধির সরবত খেয়েছিল, তার সঙ্গে চার ছটা কুলপি। ওতেই কাল হল। রাত আর কাটল না। তিরি জপতে জপতে চলে গেল মানুষটা। আর আমিই বা বেজোড়ে থাকি কেমন করে বলো। চার মাসের মাথায় আফিং খেলাম। এখন দুজনে দিব্যি জোড়ে আছি।”
যামিনী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। “আহারে সতী লক্ষ্মী!”
তিরি বলল, “এবার আসি। কথায় কথায় কত রাত হয়ে গেল। চলি গো জগুদা রমাদা। আসি ভাই বউদিরা। তোমরা ভাই সুখে শান্তিতে থাকো। বঙ্কু, আসি ভাই।”
সামান্য চুপচাপ। তারপর বঙ্কু বলল, “দিদি চলে গেছে। লাল বাতিটা আবার জ্বলে উঠেছে। এবার আমাদের উঠতে হবে।”
জগবন্ধুরা চলে যাচ্ছেন, বঙ্কু ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল।
ফটকের বাইরে এসে জগবন্ধু রাগে গর-গর করতে করতে বঙ্কুকে বললেন, “তুমি একটা হাড় হারামজাদা। শালা চিট!”
যামিনী কয়েদি ধরে নিয়ে যাবার মতন করে জগবন্ধুর ডান হাতটা খপ করে ধরে নিয়ে টান মারলেন। তাঁর বাঁ হাতে ছ শেলের ভারী টর্চ। বললেন, “কে কী সেটা পরে দেখব। আগে বাড়ি চলো।”
দু পা পেছনে রমেশ। আশালতা স্বামীকে হাতখানেক তফাত রেখে হাঁটছেন। আর বার বার স্বামীর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। মানুষটার ঘেন্নাপিত্তি এত কম! নাক সিঁটকে উঠল আশালতার।