যামিনী বললেন, “লেখালেখির চেয়ে গলা শোনা ভাল, নয়রে, আশা?”
আশালতার গা ছমছম করছিল। বলল, “কেন, লেখাটা খারাপ?”
রমেশ বললেন, “আমার হাতের লেখা ন্যাস্টি। তোমার তো কাগের বগের ঠ্যাং। যামিনী দিদির আঙুলে বাত। কে লিখবে! জগোবাবু পিঁপড়ে বানান লিখতে তিনটে চন্দরবিন্দু বসায়—ওর কথা বাদ দাও।”
বঙ্কু বলল, “সবই আত্মার ইচ্ছে। তিনি যদি কথা বলতে চান শুনতে পাবেন, যদি লেখাতে চান যার ওপর ভর করবেন তাঁকে লিখতে হবে। আমি নাচার। নিন তৈরি হন। আর কথাবার্তা নয়, ঠিক ঠাক হয়ে বসুন।”
বঙ্কু চারপাশ ঘুরে ফিরে সব একবার দেখে নিল। কোথা থেকে কাগজ বার করে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর ঘরে হালকা বাতিটা নিবিয়ে বলল, “রেডি”। বলে পেটা ঘণ্টায় ঢং করে ঘন্টা বাজাল।
অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বঙ্কু দূরে এক কোণে গিয়ে বসল। কুলুঙ্গির টিমটিমে লাল বাতিটাই শুধু জ্বলতে লাগল।
যামিনী নিজে চোখ বন্ধ করার আগে একবার আড়চোখে দেখে নিলেন জগবন্ধু চোখ বন্ধ করেছেন কি না।
আশালতা ঢোক গিলে চোখ বুজে ফেললেন।
রমেশ মাথা নিচু করল।
বঙ্কু খানিকটা তফাত থেকে এমন একটা উদ্ভট শ্লোক পড়তে লাগল মনে হল যেন লামাদের দেশ থেকে আমদানি করেছে মন্ত্রটা।
বঙ্কুও চুপ করে গেল।
ঘর একেবারে নিস্তব্ধ। কোনো রকম শব্দ নেই। নিশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যাচ্ছে না। ধুনোর ধোঁয়ায় ঘর ভরে গিয়েছে, ধূপের ঘন গন্ধ।
বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে জগবন্ধু কিছু বলে ফেলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় টেবিলের ওপর রাখা তেকাঠ নড়ে উঠল। যামিনী ফিসফিস করে বললেন, “এসেছেন।”
যিনি এসেছিলেন তাঁর বোধ হয় তেমন পছন্দ হল না জায়গাটা, তেকাঠ নাড়িয়েই চলে গেলেন।
খানিকটা পরে আবার একজন এলেন, তেকাঠ নাচালেন, রমেশের দিকে গড়িয়েও দিলেন তেকাঠ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিষ্ঠান করলেন না। পালালেন।
বার তিনেক এই রকম হল। এক একটি আত্মা আসেন, দু চার মুহূর্ত থাকেন, তারপর চলে যান। আত্মদর্শীরা তাঁদের নাগাল পান না।
শেষে আচমকা বঙ্কু বলল, “বাতি কাঁপছে, কেউ আসছেন। কাছকাছি এসে গেছেন।”
চারজনই কুলুঙ্গির বাতির দিকে তাকালেন। খুব কাঁপছে। মানে আত্মা একেবারে ঘরের দোরে।
যামিনী আঁচলটা গলায় জড়িয়ে দিলেন, আশালতা দু’হাত জোর করে কপালে ঠেকালেন।
লাল বাতি দপ দপ করতে করতে নিবে গেল।
সামান্য চুপচাপ থাকার পর বঙ্কু বলল, “উনি এসেছেন, বউদি! এবার কথাবার্তা বলা যেতে পারে। আপনারা কি কিছু বলবেন?”
বাতি নিবে যাবার পর ঘরে এক ফোঁটাও আলো নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। যামিনী স্বামীকেও ঠাওর করতে পারছিলেন না, বললেন, “তুমিই কথা বলো, বঙ্কু ঠাকুরপো।”
বঙ্কু বলল, “জগুদা, আপনারা বলবেন কিছু?”
রমেশ বললেন, “না না, তুমিই যা বলার বলো, আমরা শুনতেই চাই।”
বঙ্কু বলল, “বেশ।…কথার মধ্যে আপনারা কিন্তু বাধা দেবেন না।”
দু মুহূর্ত পরে বঙ্কু আগত আত্মার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করল।
বঙ্কু বলল, “আপনি এসেছেন, আমরা বড় খুশি হয়েছি। কোথা থেকে এসেছেন?”
আত্মা জবাব দিলেন, শোনা গেল না।
বঙ্কু বলল, “আপনার কথা কিছু শুনতে পাচ্ছি না। একটু জোরে জোরে বলুন।” চোঙা দিয়ে এবার আওয়াজ বেরুল। মেয়েলি গলা।
“আমাদের সৌভাগ্য আপনি এসেছেন। নমস্কার নিন। কোন স্তর থেকে আসছেন?” বঙ্কু বলল।
“সূক্ষ্ম তিন থেকে।”
“অনেক দূর থেকে আসছেন। বড় কষ্ট হয়েছে আসতে। আপনার পরিচয়?”
“বাড়িতে সবাই তিরি বলে ডাকত, ভাল নাম ছিল রাণী।”
বঙ্কু যেন চমকে উঠল। বলল, “সেকি। দিদি তুমি? তুমি এসেছ? এতদিন কত জনকেই তো ডেকেছি, তুমি তো কোনোদিন আসনি?”
“না। তুই ডাকতিস জানি। ইচ্ছে হত আসতে। তবু আসিনি, আজ এলাম চাঁদের হাট দেখতে।”
“চাঁদের হাট? বুঝেছি, তুমি জগুদা রমাদার কথা বলছ! সঙ্গে বউদিরা রয়েছেন—যামিনী বউদি, আশা বউদি।”
“জানি সব জানি। দিব্যি সব সুখে রয়েছে। তাইতো দেখতে এলাম। একেই বলে কপাল। ওদের সুখের কপাল।”
“সংসারে সুখের কপাল নিয়ে কজন আর আসে, দিদি। তোমার আমার মতন দুঃখের কপালই বেশি।” বঙ্কু ভারী গলায় বলল।
“আমাদেরও সুখ হত রে, বঙ্কু। কতকগুলো পাজি নচ্ছার হতচ্ছাড়ার জন্যে হয়নি। ওই তো জগুদা, ও আমায় বিয়ে করতে পারল না?”
জগবন্ধু খস খসে গলায় একটা আওয়াজ করলেন। যার অর্থ হল, এ-সব কী হচ্ছে?
বঙ্কু বলল, “বিয়ে তো বাপ-মায়ে দেয়, দিদি! জগুদা কি করবে?”
“বিয়ের বেলায় বাপ-মা। আর আমার সঙ্গে যে ছেলেবেলা থেকে প্রণয় ছিল।”
জগবন্ধু আর সামলাতে পারলেন না। বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “এটা হচ্ছে কী? তামাশা?”
তিরির আত্মা বলল, “তামাশা কে করেছে, তুমি না আমি?”
“বাজে বোকো না, আমি তোমার সঙ্গে প্র—প্রণয় করিনি।”
‘আহা রে! করিনি—মাইরি আর কি! ছেলেবেলায় কে আমায় পুকুরে নামিয়ে সাঁতার শেখাত, বাগানে নিয়ে গিয়ে অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়াত! বলুক না ওই রমাদা। সে তো দেখেছে নিজের চোখে।”
জগবন্ধু গলা চড়িয়ে বললেন, “ছেলেবেলার কথা বাদ দাও। তখন সবাই নাবালক। একসঙ্গে মিলেমিশে খেলাধুলো করে, গাছের আম পাড়ে, কোষ্ট কুল খায়, কানামাছি খেলে। ওকে কেউ প্রণয় বলে না।”
তিরি বলল, “তাই নাকি! তা পনেরো বছর পেরিয়ে গেলে তখনও কি ছেলেবেলা থাকে?”
“পনেরো পেরিয়ে তুমি বড় পাকা হয়ে গিয়েছিলে।”