বঙ্কু বলল, “একটু বসুন। জিরিয়ে নিন। চা খান।”
“ওই করতেই তো সন্ধে হয়ে যাবে। অন্ধকার হয়ে আসছে—দেখছ না!”
রমেশ বললেন, “না না, তাড়ার কিছু নেই বঙ্কু! রাত হয় হবে। যা দেখতে এসেছি সেটা বাপু না দেখে যাব না। কি বলো দিদি?”
যামিনী সায় দিয়ে বললেন, “ঠিকই তো!” বলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, “সবাই তোমার হুকুমের চাকর। এই আয় বলে তুড়ি মারলেই আকাশ থেকে নেমে আসবে।” স্বামীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বঙ্কুর দিকে তাকালেন এবার। “না ভাই বঙ্কু ঠাকুরপো, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তুমি রয়ে সয়ে যা করার করো। ওই নাস্তিকের কথা শুনো না।”
বঙ্কু হাসিমুখে বলল, “আমি সবই ব্যবস্থা করে রেখেছি। আপনারা চা খেয়ে নিন ; তারপরই শুরু করা যাবে।”
আশালতা বললেন, “আমরা কিন্তু আজ খাওয়া দাওয়ার বাদ বিচার করিনি।”
“কোনো বিচারের দরকার নেই। আমি শুধু বলেছিলাম, আসবার সময় পরিষ্কার জামা কাপড় পরে আসবেন। আর পারলে তিনটে করে তুলসীপাতা চিবিয়ে আসবেন।”
“তা এসেছি।”
“তবে আর কি! যখন বসব তখন জুতোটুতো খুলে হাত পা মুখ ধুয়ে নেবেন। তাতেই হবে। বসুন, চায়ের কতটা হল দেখি।”
বঙ্কু চলে গেল। চার জনে বসে বসে বঙ্কুর বাড়ির বাইরের দিকটা দেখতে লাগলেন। বাড়ি ছোট নয় বলেই মনে হচ্ছে। ভেতরের দিকে ঘরটর বেশি থাকতে পারে, কে জানে। বাগানটা ভালই সাজিয়েছে বঙ্কু, দেদার গাছপালা। বাড়ির চারদিকে এত নিম কাঁঠালের গাছ রেখেছে কেন?
কুয়ো থেকে জল তোলার শব্দ হচ্ছিল। অন্ধকার হয়ে গেল।
জগবন্ধু সিগারেট খেতে খেতে রমেশকে বললেন, “ভূতো বঙ্কু এত সব করল কি করে হে রমেশ? দৌলত ভূতে জুগিয়েছে?”
রমেশ বললেন, “ওর তো এখানে কিছু জমি-জায়গা আছে। লোক রেখে চাষবাস করায়। তা ছাড়া কাঠের কারবারও করে সামান্য।”
“এ বাড়িতে থাকে কে কে?”
“বাড়ির কাজকর্ম যারা করে তারাই থাকে—আর কে থাকবে?”
জগবন্ধু ঠাট্টা করে বললেন, “ওর বউ কি প্রেতের ঠেলাতেই চম্পট দিয়েছে হে?”
যামিনী হঠাৎ বললেন, “কিসের যেন গন্ধ আসছে?”
আশালতা চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাক টানলেন, তারপর বললেন, “ঘন দুখ উথলে ওঠার মতন, তাই না? পায়েস পায়েস।”
“কেউ কি এলেন নাকি আশেপাশে।”
যামিনী চার দিকে তাকালেন।
আশালতার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি যামিনীর হাত চেপে ধরলেন।
এমন সময় চা এল। বেতের ট্রেতে সাজানো। বাড়ির কাজের লোক বয়ে এনেছে। পেছনে বঙ্কু।
“কিসের একটা গন্ধ পাচ্ছি, ঠাকুরপো?” যামিনী বললেন।
“গন্ধ!…ও বুঝেছি, আসলি চন্দনের গন্ধ। যে-ঘরে আমরা বসব, সেই ঘরে ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছে,” বঙ্কু বলল।
বঙ্কুর আত্মা-সাধনার ঘরখানি দেখার মতন। মাঝারি ঘর, নানা ধরনের আসবাব। গোল টেবিল, হাতলহীন চেয়ার, হ্যাট স্টান্ডের মতন কি একটা একপাশে রাখা, চার কোণে চারটে লোহার খাঁচা। খাঁচার মধ্যে মাটির মালসায় ধুনো দেওয়া হয়েছে। একদিকে একটা চোঙা ঝুলছে—একসময় রেডিওতে যেমন হালকা গোছের চোঙা লাগানো থাকত অনেকটা সেই রকম। কোণের দিকে একটা কুলুঙ্গি কাচ দিয়ে ঢাকা। কাচের আড়ালে টিমটিমে একটা লাল বাতি জ্বলছে। সারা ঘর জোড়া মোটা শতরঞ্জি। পায়ের শব্দ হয় না। হালকা নীল লাইম ওয়াশ করা দেওয়াল, চার দেওয়ালে চারটি কাঠের গুঁড়োভরা মরা বেড়াল আর কাকের দেহ ঝুলছে। কুচকুচে কালো রং বেড়াল দুটোর। জানলা ঘেঁষে একটা সরু টেবিলের ওপর একটা পেটা ঘণ্টা, গোটা দুয়েক শাঁখ, ধূপদানি। জানলাগুলো কালো পরদা দিয়ে ঢাকা।
জুতো খুলে হাত পা ধুয়ে জগবন্ধুরা ঘরে ঢুকেছিলেন। ঘরের মধ্যিখানে গোল টেবিলের চারপাশে চেয়ার সাজানো। বঙ্কু সকলকে বসতে বলল।
টেবিলের ওপর একটা চাকা-লাগানো ছোট তেকোঠ পড়ে ছিল।
জগবন্ধু চোখ সইয়ে নিয়ে বললেন, “এটা কী?”
বঙ্কু বলল, “ওটা লেখার জিনিস। ওর মধ্যে একটা সরু-গর্ত আছে পেনসিল ফিট করার জন্যে। আত্মারা বেশির ভাগ সময় কথা বলতে চান না। তখন মিডিয়াম ওই জিনিসটার ওপর হাত রেখে আত্মার কথাবার্তা লিখতে পারেন।”
“লিখবে কিসে? চাকা লাগানো কেন?”
“কাগজে লিখবে? কাগজ দিয়ে দেব। চাকা লাগানো রয়েছে হাত ভাল সরবে বলে। তাড়াতাড়ি লেখা যাবে।”
জগবন্ধু বললেন, “কলটি তো বেড়ে বানিয়েছ!”
আশালতা বার কয়েক খুক খুক করে কাশলেন। ঘরের চারদিকই বন্ধ। ধূপধুনোর ধোঁয়ায় ঘরের সবই অস্পষ্ট।
রমেশ বললেন, “তা আর দেরি কেন?”
“না, এবার শুরু করব। তার আগে একটা কথা বলে নিই। টর্চ, দেশলাই, লাইটার—কোনো রকম আলো জ্বালবেন না। আমায় দিয়ে দিন।”
জগবন্ধু টর্চ বাইরে রেখে এসেছেন। দেশলাই দিয়ে দিলেন।
বঙ্কু বলল, “ওই লাল বাতিটা দেখছেন? যদি দেখেন বাতিটা খুব দপদপ করছে বুঝবেন আত্মা কাছাকাছি এসে গেছে। এই ঘরে তাঁর আবির্ভাব হলে আলো নিবে যাবে।”
জগবন্ধু বললেন, “আমরা কি লাল আলোর দিকে চেয়ে থাকব?”
“না। আপনারা মুখ নিচু করে চোখ বুজে যাঁকে দেখতে চান, অবশ্য তাঁর মৃত্যু হওয়ার দরকার, তাঁর কথা এক মনে ভাববার চেষ্টা করবেন। সবাই যদি একই লোকের কথা ভাবেন তাতে তাড়াতাড়ি কাজ হতে পারে। কিন্তু তা তো সম্ভব হয় না। চারজনে চাররকম ভাবলে ক্রস লাইন হয়ে যায়।”
“কলকাতার টেলিফোনের মতন?” জগবন্ধু বললেন।
বঙ্কু বলল, “এবার শুরু করা যাক। আপনারা এখন কেউ আলোর দিকে তাকাবেন না। যদি আলো কাঁপে আমি বলে দেব তখন তাকাবেন। আর একটা কথা, আপনাদের ভাগ্য যদি ভাল হয়—আত্মার কথাও শুনতে পাবেন। সূক্ষ্ম আত্মা, গলার স্বর আরও সূক্ষ্ম। কানে শোনা মুশকিল। ওই যে চোঙাটা দেখছেন, ওই চোঙা দিয়ে স্বর শোনবার ব্যবস্থা আমি করেছি। টোনটাকে হাই ভলুম করার ব্যাপার আর কি!”