বড়ো রাস্তার ঠিক মধ্যিখানেই কালীমন্দির। হাতে মাংসের ঠোঙা। চোখ বন্ধ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দূর থেকেই প্রণাম জানিয়ে প্রমথ রাস্তা পার হল। পর্দা-ফেলা রিকশা থেকে গলা বার করে দুটি বউ প্রমথর পাশ দিয়ে চলে গেল।
সিনেমা হলগুলো আজকাল এয়ারকণ্ডিশন করা হয়েছে। প্রমথ ভাবতে শুরু করল, তা না হলে এই অসহ্য দুপুরে পারে কেউ বন্ধ ঘরে বসে থাকতে। তবু শখ যাদের আছে তারা ঠিক যাবেই, অমিয়ার কোনো কিছুতেই যেন শখ নেই আজকাল। অথচ মেজোবউদি-তার আপন মেজদা, যিনি ডাক্তার হয়েই আলাদা হয়ে গেছেন, তাঁর বউ এখনও না কি এমন সাজে যে ছেলের জন্যে পাত্রী দেখতে গেলে মেয়ে-বাড়ির সকলে গা টেপাটেপি শুরু করেছিল। মেয়েকে ফিরে সাজতে হয়েছিল ওর পাশে মানাবার জন্যে। এ খবর অমিয়াই তাকে দিয়েছিল। ওর শখ এখন এইসব খবর জোগাড় করাতে এসে ঠেকেছে। অথচ সাজলে এখনও হয়তো পুতুলকে হার মানাতে পারে।
গলিটা এবার দেখা যাচ্ছে, ওখানে ছায়া আছে। এইটুকু পথ জোরে পা চালাল প্রমথ। ভাবনারও একটা মাথামুন্ডু আছে। অমিয়া যতই সাজগোজ করুক, পুতুলের বয়সটা তো আর পাবে না। সতেরো বছরের একটা আলাদা জেল্লা আছে, দেখতে ভালো লাগে। অমিয়ার বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছরে, সেও পুতুলের মতো লাজুক আর ছটফটে ছিল।
হাড়গোড়সার ছেলের হাত-পায়ের মতোই ন্যাতানো গলিটা। হলকা বাতাস পর্যন্ত স্যাঁতসেঁতিয়ে যায়। এ গলিতে ঢুকলে গায়ে চিটচিটে ঘাম হয়। কোঁচাটা পকেটে থাকছে না। আলু আর পেঁয়াজের জন্যে। পেটের কাপড়ে গুঁজে দিতে একটুক্ষণ দাঁড়াল প্রমথ। ওপর থেকে উকিলবাবুর বিধবা বোন দেখছে। প্রমথ ঠোঙার দিকে তাকাল। হ্যাঁ, ওপর থেকেও বোঝা যায় এর মধ্যে মাংস আছে। নন্দী বাড়ির সঙ্গে ওর খুব ভাব। ছোটোমেয়ের শ্বশুর বুঝি কোন এক উপমন্ত্রীর বন্ধু। তাই নন্দীগিন্নি ধরাকে সরা দেখে, অমিয়া দুচক্ষে দেখতে পারে না এই মানুষগুলোকে। উকিলবাবুর বোনের দেখা মানেই পাড়ার সব বাড়ির দেখা। খবরটা শুনলে অমিয়া নিশ্চয় খুশি হবে।
বাড়ি ঢোকার মুখে দোতলার মিহিরবাবুর সঙ্গে দেখা হল প্রমথর। এবাড়িতে অল্পদিন এসেছে। মুখচোরা, বউয়ের মতোই মেশে না কারুর সঙ্গে, শুধু কবিতা আর রাজনীতির কথায় মুখে খই ফোটে।
দেখেছেন তো আবার স্ট্রাইক কল করেছে বেস্পতিবার?
শুনেছি বটে, আপিসে বলছিল সবাই, যা মাগগিগন্ডার বাজার, আগের বার এগারো সিকে ছিল, এখন তিন টাকা।
ঠোঙাধরা হাতটা দোলাল প্রমথ। কিন্তু মিহিরবাবুর নজর তাতে আটকাল না।
এখন তবু তিন টাকা। এক-একটা ফাইভ ইয়ার যাবে আর দেখবেন দামও পাঁচগুণ চড়বে।
অন্য সময় হলে মিহিরবাবুর সঙ্গে একমত হত প্রমথ। কিন্তু সে যা চাইছিল তার ধার দিয়েও গেল না কথাগুলো। রোববার মিহিরবাবুদের মাংস রান্না হয়েছিল। গরমমশলাগুঁড়োবার জন্যে হামানদিস্তেটা নিয়েছিল। এখনও ফেরত দেয়নি। বোধ হয় ভেবেছে ওদের আর কীসে দরকার লাগবে, যখন তোক ফিরিয়ে দিলেই হবে। মিহিরবাবু তোক ভালো। তবু প্রমথর মেজাজ তেতে উঠল ক্রমশ।
আরে মশাই স্ট্রাইকফ্রাইক করে হবেটা কী, তাতে পাঁচ টাকার জিনিস এক টাকায় বিকুবে?
কিছুটা তো কমবে।
আপনাদের ওই এক কথা।
প্রমথ উঠোনের কোণে রান্নাঘরের সামনে রকে ঠোঙাটা নামিয়ে রাখল। গলার আওয়াজে অমিয়া বেরিয়ে এল। তার পিছনে পুতুল আর চাঁদু। মিহিরবাবু ওপরে উঠে গেলেন। তারপর ওরা কথা বলল। ওদের চোখগুলো বরফকুচির মতো ঝিকিয়ে জুড়িয়ে দিল প্রমথকে।
এইটুকুই সে চেয়েছিল। খুশি হোক অন্তত আজকের দিনটায়। জিনিসের দাম বাড়ছে, স্ট্রাইক হবে, মিছিল বেরোবে, ঘেরাও হবে, পুলিশ আসবে, রক্তগঙ্গা বইবে, এ তো হামেশাই হচ্ছে। মানুষকে যেন একটা কামার তাতিয়ে তাতিয়ে ক্রমাগত পিটিয়ে চলেছে বিরাট একটা ভারী হাতুড়ি দিয়ে। সুখ নেই, স্বস্তি নেই, হাসি নেই, খুশি নেই।
ওসব ভাবনা আজ থাক। খোকনকে কোলে নিয়ে হাসতে শুরু করল প্রমথ ওদের দিকে তাকিয়ে।
রোদের কটকটে জ্বলুনি এখন আর নেই। বেলা গড়িয়ে এল। অমিয়া তাড়া দিচ্ছে দোকানে যাওয়ার জন্যে। ঘরে আদা নেই। বঁটি সরিয়ে উঠল প্রমথ। এতক্ষণ তার মাংস কোটা দেখছিল খোকন। চাঁদু বিকেলের শুরুতেই বেরিয়েছে। কোথায় ওর ফুটবল ম্যাচ আছে। বাটনা বাটতে বাটতে পুতুল খোঁজ নিচ্ছে চৌবাচ্চার। দেরি হলে বালতিতে শ্যাওলাসুদ্ধ উঠে আসে।
পাড়ার মুদির দোকানে আদা পাওয়া গেল না। তাই দূরে যেতে হল প্রমথকে। ফেরার সময় খোকনকে দেখল রাস্তায় খেলছে। ওর সঙ্গীদের মধ্যে ভুবন গয়লার নাতিকে দেখে ডেকে নেওয়ার ইচ্ছে হল। তারপরেই ভাবল, থাক, এখন বাড়ি গিয়েই-বা করবে কী। তা ছাড়া-ঘুপচি ঘরের মধ্যে আটকা থাকতেই-বা চাইবে কেন। খোকনকে ভালো জামা-প্যান্ট কিনে দিতে হবে, উকিলবাবুর ছেলেদের কাছাকাছি যাতে আসতে পারে। উকিলবাবুর ছেলেরা বাসে স্কুল যায়…বেশ ইংরেজিও বলতে পারে এই বাচ্চা বয়সে।
মাংসে বাটামশলা মাখাচ্ছিল অমিয়া। প্রমথকে দেখামাত্রই ঝেঁঝে উঠল।
এত দেরি করে ফিরলে, এখন বাটবে কে।
কেন, পুতুল কোথায়?
বিকেল হয়েছে, তার কি আর টিকি দেখার জো আছে। সেজেগুজে বিবিটি হয়ে আড্ডা দিতে গেছে।
আচ্ছা, আমিই নয় বাটছি।
বঁটি পাতল প্রমথ আদার খোসা ছাড়াবার জন্যে। অনেকখানি শাঁস উঠে এল খোসার সঙ্গে। সাবধানে বঁটির ধার পরীক্ষা করল, ভোঁতা। তাহলে অত পাতলা করে খোসা ছাড়ায় কী করে অমিয়া, অভ্যাসে! অভ্যাস থাকা ভালো, তাহলে সময় কেমন করে যেন কেটে যায়। অবশ্য আলু বা আদার খোসা ছাড়িয়ে কতক্ষণ সময়ই-বা কাটে। তবু ঘরসংসার, রান্নাবান্না, ছেলেপুলে মানুষ করা, এটাও তো এক রকমের অভ্যাসেই করে যায় মেয়েরা, না কি স্বভাবে করে। অমন স্বভাব যদি তার থাকত—প্রমথ ভাবল, তাহলে বাঁচা যায়। জীবনটা যেন ডালভাত হয়ে গেছে। ওঠা-নামা নেই, স্বাদ-গন্ধ নেই, কিছু নেই, কিছু নেই, তবু কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। আশ্চর্য, এই ভোঁতার মতো বেঁচে থাকাটাও একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বদ অভ্যাস।