ওরা দাঁড়িয়ে দেখল। দু-তিন বার মাথা নাড়াল।
যদি মান্তু না হয় তো ওরা বেঁচে যাবে।
ভূপতি যেন নিজেকেই প্রবোধ দিয়ে শোনাল।
অন্য কোনো বাপ-মায়ের ছেলে তো! তাদের কী অবস্থা হবে?
দুজনে ধীরে ধীরে সতর্ক পায়ে হাঁটতে শুরু করল। যত এগোচ্ছে জল ক্রমশ বাড়ছে। কাঁচা পথটুকুই শুধু যা ভয়ের।
হাঁপির টান কি বোধ করছ? ফিরে গিয়ে মালিশ করে দেব। আজ কিছু খেয়ো না, উপোস দাও। একটু গরম দুধ যদি…।
ওরা কাঁচা রাস্তা পার হয়ে একসময় বড়ো রাস্তায় পৌঁছোল। ধু-ধু নদীর মতো রাস্তাটাকে আবার ওরা অবাক হয়ে দেখল।
না বললেই হত। ফুটপাথ থেকে পা টিপে টিপে রাস্তায় নেমে বলাইয়ের মা-র দিকে হাত বাড়িয়ে ভূপতি বলল। কথাটার উত্তর সে পেল না।
আমার মুখ দিয়ে কেন যে বেরিয়ে এল!
বিস্ময় নিয়ে ভূপতি স্ত্রীর হাত চেপে ধরে জল ঠেলতে ঠেলতে বাড়ি ফিরে এল। গেটের থেকেই তারা দেখল বারান্দায় নন্দা দাঁড়িয়ে। তাদের দেখতে পেয়ে সে অস্বাভাবিক উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, বলাইয়ের মা, ভূপতি..মাস্তু নয়, বডিটা মান্তুর নয়। ওরা হাসপাতাল থেকে একটু আগে ফিরে এসেছে। ভেতরে এসো বলেছি।
ওরা এক-তলার দরজা দিয়ে ঢোকার আগেই নন্দা নেমে এসেছে।
উঃ, কী ভয় যে পাইয়ে দিয়েছিল! ওটা অন্য ছেলে। এই মান্তুর দিদি আবার ফোন করেছিল, পাঁচ মিনিটও হয়নি। মিছিমিছি চিঠি দিয়ে তোমাদের পাঠালাম। পড়ে কী হল ওদের?
দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। হঠাৎ দপ করে বলাইয়ের মা-র চোখ জ্বলে উঠল, হাত মুঠো হল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। তারপর ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল চোখের চাহনি।
চিঠিটা জলে পড়ে ভিজে গেছে। পড়া গেল না।
বাঁচা গেছে, বাব্বা! পড়লে কী যে ওদের অবস্থা হত!
ফোন করেননি? ভূপতি জিজ্ঞাসা করল।
না তো? বোধ হয় ওদের লাইন খারাপ। তোমরা আর ভিজে কাপড়ে থেকো না। চা করো…না না আমিই করে দিচ্ছি।
মাঝরাতে ভূপতির ঘুম ভেঙে গেল, টানা বৃষ্টির মতো কান্নার শব্দে। সে শুধু একটা হাত বলাইয়ের মা-র পিঠে রাখল।
বেহুলার ভেলা
অমিয়া বলল, পয়সা কি কামড়াচ্ছিল। কয়লাওয়ালার কাছে এখন দু-মনের দাম বাকি। তা ছাড়া ওই ক-টা আলুতে কী হবে, ঘরে যা আছে তাও দিতে হবে দেখছি। এরপর সে বললে, টাটকা খুব, চর্বিও কম দিয়েছে।
পুতুল বলল, রোববার কোর্মা বেঁধেছিল তৃপ্তির নতুন বউদি। খুব বেশি ঘি দিয়েছিল, তাই ক্যাটক্যাটানি শুরু করেছিল শাশুড়ি। এই নিয়ে সে কী ঝগড়া মায়েতে-ছেলেতে। তারপর সে বলল, আমি কিন্তু রাঁধব বলে দিলুম। বাবুদা বলছিল পাঞ্জাবির হোটেলে নাকি দারুণ রাঁধে, আজ আসুক-না একবার দেখিয়ে দোব ক্ষণ।
চাঁদু বলল, আগে জানলে জোলাপ নিয়ে পেটটাকে রবারের করে রাখতুম। খানিকটা কাল সকালের জন্যে তুলে রেখো, চায়ে বাসি রুটি ভিজিয়ে খেতে খেতে তো জিভে চড়া পড়ে গেল। শেষকালে সে বলল, যেই রাঁধো বাবা, জবাফুলের রসের মতো রং হওয়া চাই কিন্তু।
রাধু এখন বাড়ি নেই। পাঁচ বছরের খোকন শুনে শুনে কথা শেখে, সেও প্রমথর হাঁটু জড়িয়ে বলল, বাবা আমি খাব মাংস।
ওরা যা-ই বলুক প্রমথ লক্ষ করছিল চোখগুলো। ঝিকোচ্ছে বরফকুচির মতো। ওরা খুশি হয়েছে। ব্যাস, এইটুকুই তো সে চেয়েছিল, তা-না-হলে মাসের শেষ শনিবারে একদম পকেট খালি করে ফেলার মতো বোকামি সে করতে যাবে কেন।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথটা আরও ছোটো হয়ে যায় শোভাবাজারের মধ্যে দিয়ে গেলে। বিয়ের পর কয়েকটা বছর বাজারের মধ্যে দিয়েই অফিস থেকে ফিরত, সেও প্রায় বাইশ বছর আগের কথা। তারপর বাবা মারা গেলেন, দাদারা আলাদা হলেন, প্রমথও এখনকার বাড়িটায় উঠে এল। উঠে আসার তারিখটা পাওয়া যাবে ভব শ্রীমানির খাতায়। সেই মাস থেকেই অমিয়া মাসকাবারি সওদা বন্ধ করল, ওতে বেশি বেশি খরচ হয়। তারপর কালেভদ্রে দরকার পড়েছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার। আজ গরমটা যেন অন্য দিনের থেকে বেশি চড়ে উঠেছে, জুতোর তলায় পিচ আটকে যাচ্ছে, কোনোরকমে বাড়ি ফিরলে বাঁচা যায়।
ডাববোঝাই একটা ঠেলাগাড়ি পথজুড়ে মাল খালাস করছে, চারধারে যেন কাটামুণ্ডুর ছড়াছড়ি। তার ওপর বাজারের আঁস্তাকুড়টাও জিনিসপত্রের দামের মতো বেড়ে এসেছে গেট পর্যন্ত। পুব দিকের গেট দিয়েই বেরোনো ঠিক করল প্রমথ। দুটো রকের মাঝখানের পথটায় থইথই করছে জল। চাপা কল থেকে জল এনে ধোয়াধুয়ি শুরু করেছে দুটো লোক। ঝাঁটার জল যেন কাপড়ে না লাগে সেই দিকে নজর ছিল।
আর দু-পা গেলেই বাজারটা শেষ হয়, তখুনি আচমকা জল ছুড়ল লোকটা। কাপড়ে লাগেনি, কিন্তু লাগতে তো পারত। বিরক্ত হয়েই সে পিছন ফিরেছিল আর অবাক হল পিছন ফিরে।
বাজারের শেষ মাথায় দাঁড়িয়েছিল প্রমথ, যতদূর দেখা যায় প্রায় শেষ পর্যন্ত এখন চোখ চলে। ফাঁকা, খাঁ-খাঁ করছে; অদ্ভুত লাগল তার কাছে।
সকালে মাছির মতো বিজবিজ করে, তখন বাজারটা হয়ে যায় কাঁঠালের ভুতি। ঘিনঘিন করে চলতে ফিরতে। আর এখন, চোখটা শুধু যা টক্কর খেল কচ্ছপের মতো চটমোড়া আনাজের ঢিপিতে। নয়তো সিধে মাছের বাজার থেকে ফলের দোকানগুলো, দোকানে ঝোলানো আপেল–গুলো পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আপেল না-হয়ে নাশপাতিও হতে পারে কিন্তু লক্ষ্মী পুজোর দিনটায় একবার ওদিক মাড়াতে হয়। ফুল, পাতা ওই দিকটাতেই পাওয়া যায়, আর তখনই চোখে পড়ে ঝোলানো আপেল, সবরি কলার ছড়া, আনারস আর শীতের সময় চুড়করা কমলা লেবু। শীতের কথা মনে পড়লেই কপির কথা মনে আসে, আগেকার দিনে সের দরে কপি বিক্রি হত না। নাকের সামনে বাঁধাকপি লোফালুফি করতে করতে সগ্নেসিচরণ হাঁক ছাড়ত, খোকাবাবু এই চলল পাঁচ নম্বরি ফুটবল, ছোকা বেঁধে খাও গোস্ট পালের মতো শট হবে। সন্যেসিটা যেন কী করে জেনে ফেলেছিল স্কুল টিমে প্রমথ ব্যাকে খেলে, আর গোষ্ঠ পালকে তো সে পুজো করত মনে মনে। আজকাল অনেকেই নাম করেছে, চাঁদুর মুখে কত নতুন নতুন নাম শোনা যায়। ওই শোনা পর্যন্ত। মাঠে যেতে আর ইচ্ছে করে না। সন্নেসি একদিন ফুটপাথে মরে পড়ে রইল। আজেবাজে জায়গা থেকে রোগ বাধিয়ে শেষকালে বাজারের গেটে বসে ভিক্ষে করত। সন্ন্যেসির সঙ্গে সঙ্গে কুলদাকে মনে পড়ল প্রমথর, চেহারা কী! যাত্রাদলে বদমাইশের পার্ট করত। বাজারে শিবরাত্তিরে যাত্রা শুনতে আসার আগে হিসেব করে আসতে হত বাবার কাছ থেকে কতগুলো চড় পাওনা হবে। কুলদার হাতে আড়াইসেরি রুইগুলোকে পুঁটি বলে মনে হত। ওর মতো ছড়া কাটতে এখন আর কেউ পারে না। আজকাল যেন কী হয়েছে, সেদিন আর নেই। গুইরাম মরে গেছে, ওর ছেলে বসে এখন। ছেলেটা বখা। অথচ গুইরামের পানে পোকা হাজা কিংবা গোছের মধ্যে ছোটো পান ঢোকানো থাকত, কেউ বলতে পারত না সেকথাগুইরামের দোকানের পাশে এখন একটা খোটানি বসে পাতিলেবু নিয়ে। অমিয়ার জন্য রোজ লেবুর দরকার, একদিন ওর কাছ থেকে লেবু কিনেছিল প্রমথ। মাস ছয়েকের একটা বাচ্চা, বয়স দেখে মনে হয় ওইটেই প্রথম, কোলের ওপর হামলাহামলি করছিল, বুকের কাপড়ের দিকে নজর নেই। ওর কাছ থেকে আর কোনোদিন লেবু কেনেনি সে। দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের যেন হজমের গোলমাল শুরু হয়েছে আর লেবুও যেন এত বড়ো বাজারটায় ওই একজায়গাতেই পাওয়া যায়। দিন দিন যেন কী হয়ে উঠেছে। বুড়োধাড়িদের কথা নয় বাদ দেওয়া গেল, কিন্তু কচিকাঁচারাও তো বাজারে আসে, বাজার পাঁচটা লোকের জায়গা।