ওরা দুজনে মুখ ফেরাল পরস্পরের দিকে। চিঠিতে যা বলা হয়েছে সেটা তারা জানে। কিন্তু সেটা কি তারা মুখে বলবে? দুজনে দুজনের কাছে প্রশ্নটা রাখল।
তোমরা কি বলতে পারবে নন্দা কী লিখেছে?
ভূপতির দিকে তাকিয়ে বলাইয়ের মা-র চোখে অনুনয় ফুটে উঠল। ভূপতি ধীরে ধীরে মুখটা ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল।
আপনার ছেলে জেঠির বাড়িতে গেছে।
হ্যাঁ, বেলগাছিয়ায়।
বলাইয়ের মা আবার ভূপতির মুখের দিকে তাকাল। আবার সে মুখ ফিরিয়ে নিল। আঙুল দিয়ে সে জাল আঁকড়ে ধরেছে, চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল।
আজ সকালে সে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে এখনও ফেরেনি।
অ্যাঁ! সেকী কথা? গেল কোথায় তাহলে? সকাল থেকে বাড়ি নেই? নন্দাকে খবরটা দিল কে?
ফোন করে জানিয়েছেন বউদির দিদি।
ঠিক কী বলেছে? আঃ চিঠিটাও এমন ভিজিয়েছ যে কিছু পড়া যায় না। এমন সাংঘাতিক একটা ব্যাপার, সাবধানে চিঠিটা রাখবে তো।
এই সময় ভিতর থেকে খালিগায়ে পাজামাপরা একটা লোক বেরিয়ে এল। মান্তুর বাবা, মহিলার স্বামী সতু। তাকে দেখেই মহিলা ব্যাকুল হয়ে বললেন, এরা কী বলছে শোনো। নন্দা পাঠিয়েছে এই চিঠি দিয়ে। কিছু পড়া যাচ্ছে না এমনই ভিজিয়েছে। বলছে মান্তু সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখনও ফেরেনি। দিদি ফোন করে নন্দাকে বলেছেন, তাই সে খবরটা চিঠি লিখে এদের হাত দিয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু এরা এমনই গাধা যে… এখন কী হবে?
তোমরা ঠিক জান? ঠিক বলছ? সতু উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল।
বউদি তো এই কথাই বললেন।
আর কী বললেন?
বলাইয়ের মা পাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে ভূপতির চোখ দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পেল না। সে ইতস্তত করল। সতু তখন অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আর কী বললেন সেটা বলো।
হ্যাঁ, বলেছেন…
ওরা তিন জনই ভূপতির দিকে তাকাল।
একটা ছেলে জ্বলে ডুবেছে। তার লাশ পাওয়া গেছে।
কযেক সেকেণ্ডের জন্য প্রাণঘাতী নীরবতা বিরাজ করল। তারপরই মান্তু রে বলে মহিলা চিৎকার করে উঠলেন।
বলাইয়ের মা বিষণ্ণ চোখে ভূপতির দিকে তাকাল, তার চাহনিতে ভৎসনা, কেন কথাটা বলতে গেলে?
ছেলেটা কে? মান্তুই কি? সতু স্তম্ভিত অবস্থা থেকে শান্ত গলায় বলল।
আর কিছু বলেননি।
হ্যাঁ, বলেছেন বাড়ির সবাই হাসপাতালে গেছেন। বলাইয়ের মা কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা তুলে দিল।
সেটা এতক্ষণ বলনি কেন? কোন হাসপাতালে? নাম কী হাসপাতালের?
সতুর ব্যগ্র অ্যাকুল স্বরে কুঁকড়ে গেল দুজনেই। পরস্পরের মুখের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে আবার তারা সতুর দিকে তাকিয়ে একইসঙ্গে মাথা নাড়ল। মহিলাটি চিৎকার করে যাচ্ছেন উবু হয়ে বসে। চিঠিটা চোখের সামনে ধরে উন্মাদের মতো চোখে সতু পড়ার চেষ্টা করে হতাশায় ছুড়ে ফেলে দিল।
কথা বলছ না কেন, তোমরা কি বোবা? সতু ফেটে পড়ল, এমন একটা ভয়ংকর খবর, অথচ বলতে পারছ না কোন হাসপাতালে গেছে। ইডিয়ট, উল্লুক কোথাকার! ইচ্ছে করছে জুতোপেটা করি। এখন নন্দার বাড়ি গিয়ে জানতে হবে. ওহহ, মানসবাবুর বাড়ি থেকে তো ফোনই করা যায়। আমি ফোন করতে যাচ্ছি, বুঝলে?
সতু দ্রুত বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে, তোমরা এবার এসো। আর কখনো তোমাদের যেন… বলতে বলতে ছুটে বেরিয়ে গেল।
দুজনে ব্যথিত চোখে মেঝেয় গড়াগড়ি দেওয়া মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। বলাইয়ের মা এগিয়ে এসে ঝুঁকে মহিলার বাহুতে হাত রেখে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগল।
আয়, চলে আয়। ভূপতি একটু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাটা বলেই দরজার দিকে এগোল। সামনের বাড়ির দুজন মহিলা ছুটে আসার সময় তাকে ধাক্কা দিয়েই ভিতরে ঢুকল।
বলাইয়ের মা ধীর পায়ে বেরিয়ে এল। দুজনে আবার জল ঠেলে ঠেলে ফিরছে। বৃষ্টি এখন বন্ধ। মেঘের জন্য চারিদিক স্যাঁতসেঁতে আলোয় নির্জীব, বিষগ্ন। তাদের জলভাঙার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মুখ নামিয়ে তিন-চার হাত ব্যবধান রেখে ওরা এগোচ্ছে।
হঠাৎ ভূপতি দেখল বলাইয়ের মা হেলে পড়ছে। দু-হাত তুলে বাতাস আঁকড়ে ধরার জন্য তালু আর আঙুলগুলো মুঠো হল, তারপর জলের নীচে চলে গেল, আবার একটুর জন্য ভেসে উঠল মুখ আর দুটো হাত।
ডুবে যাচ্ছে। ভূপতি ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ধর, ধর।
তৃতীয় বার ভেসে উঠে ডুবে যাবার সময় বলাইয়ের মা ছাতার প্রান্তটা মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেল। ভূপতি ওকে টেনে আনল ছাতার সঙ্গে। বলাইয়ের মা-র চোখে ভয়। মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হওয়ার বিস্ময় ছড়িয়ে রয়েছে মণিতে। ঠোঁট দুটো থরথর করছে। ভয়টা এবার কুয়াশা সরে যাবার মতো আবছা হতে হতে একেবারেই সরে গেল। একটা রাগ এবার সেই জায়গায় উঠছে।
তুমি বলাইকে তাহলে কেন ধরনি?
নৌকোটা উলটোতেই বাঁশের খোঁচাটা চোখে তখন যদি…বলেছি তো তোকে কত বার। দু-হাত ঝাঁকিয়ে ভূপতি চেঁচিয়ে উঠল। আমি তো নাম ধরে তারপর চেঁচিয়েছি, চোখে দেখতে পাচ্ছিলুম না অন্ধ হয়ে গেছলুম, সাঁতার দিতে দিতে কত বার চেঁচিয়েছি, ডুবে ডুবে নদীর তল পর্যন্তও গেছি।
সে হাঁফাতে লাগল। বলাইয়ের মা কাছে এসে ওর বুকে কপালে হাত রাখল। সেই সময় উদভ্রান্ত সতু তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল সামনে ঝুঁকে, দৌড়োবার চেষ্টায় শরীরটা পড়ো পড়ো, দু-হাত ভারসাম্য রাখার জন্য পাখির ডানার মতো ঝাপটাচ্ছে। সতু ওদের দেখেও দেখল না। কিছুটা পিছনে সেই মহিলা, মান্তুর মা। লেপটানো শাড়িতে জড়িয়ে-যাওয়া পা ফেলতে গিয়ে বার বার জলে আছাড় খাচ্ছে। কয়েক হাত হামা দিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে চলতে গিয়ে আবার পড়ছে। মুখ থেকে একটা উ উঁ শব্দ একটানা বেরিয়ে আসছে। মান্তুর মাও ওদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল।