নামার সঙ্গে সঙ্গে জল তার কোমর ছাড়িয়ে গেল, ভূপতির কাছে এসে সে হাত বাড়াল। ভূপতি হাতটা ধরল। তারপর পায়ে পায়ে দুজনে এগোতে লাগল জলের টান ঠেলে।
পা ঘষে ঘষে হেঁটো না তাহলে ঊরুতে ব্যথা করবে। তুলে তুলে হাঁটো। বলাইয়ের মা বলল। ওরা মোড় ঘুরে না যাওয়া পর্যন্ত না তাকিয়ে রইল। বড়ো রাস্তার মুখে এসে চলা থামিয়ে দুজনে রাস্তা বরাবর তাকাল। চওড়া একটা নদীর মতো দেখাচ্ছে। দু-ধারে ফুটপাথে বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি জলের নীচে। তাদের ডালপালাগুলো বড়ো ছাতার মতো লাগছে। কয়েক জন লোক জল ঠেলে চলেছে। পার্কের রেলিঙের সঙ্গে শেকলবাঁধা একটা ঠেলাগাড়ি জলে ওঠা-নামা করছে নৌকোর মততা, রোল বিক্রির একটা কাঠের গাড়ি হেলে রয়েছে বাড়ির গায়ে। ভাঙা পাইপ দিয়ে ছড়ছড়িয়ে জল ছাদ থেকে পড়ছে। নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার বাঁশের ভারা থেকে একটা বাঁশ ঝুলছে। যেকোনো সময় নীচে পড়বে। ফুটপাথে রাখা দুটো মোটর গাড়ি, জলে তার অর্ধেক ডোবা। জলে ভেসে যাচ্ছে কাঠের টুকরো, গাছের ডাল, পাতা, ন্যাকড়া, রবারের চটি, কৌটো, মরা পায়রা।
আঃ!
ভূপতি হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। বউয়ের হাত ধরে সামলে নিতে গিয়ে বলাইয়ের মাকে নিয়ে জলে পড়ে গেল। মাথা ভিজিয়ে দুজনে উঠে দাঁড়াল। ছাতাটা হাত থেকে পড়ে জলে ভাসছে বলাইয়ের মা খপ করে ধরে নিল।
গর্ত রয়েছে। ভূপতি সাবধান করে দিল।
চিঠিটা ভিজেছে কি না দ্যাখো! ব্যস্ত স্বরে বলল বলাইয়ের মা।
ভূপতি পকেট থেকে চিঠির খামটা বার করল। খামের কাগজ চুপসে গেছে। ঠিকানা লেখা অক্ষরগুলো ধ্যাবড়ানো। ভীত চোখে বউয়ের দিকে সে তাকাল।
আমায় দাও।
বলাইয়ের মা ভিজে খাম ধরা হাতটা উঁচু করে তুলে আবার এগোতে শুরু করল।
প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর ভূপতি দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁফাচ্ছে। ব্যথায় ঊরু দুটো তুলতে পারছে না। কোমরে ব্যথা করছে। চোখে শ্রান্তি। বলাইয়ের মা ওর বাহু ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এক বার স্বামীর কপালে হাত দিয়ে তাপ বুঝে নিল। মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে ভূপতি আবার চলতে শুরু করতেই বলাইয়ের মা হাত টেনে ধরল।
আর একটু জিরোও।
কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে দুজনে চলতে শুরু করল। কিছু লোক রাস্তায় নেমেছে। একজন ওদের জিজ্ঞাসা করল, সিগারেটের দোকান খোলা দেখেছে কি না। ওরা মাথা নাড়ল। দুটো বড়ো মোড় পেরিয়ে গিয়ে আর একটা মোড় যার মাঝখানে পাঁচিলঘেরা জমি। সেই জমিতে একটা টুপিপরা লোকের দাঁড়ানো মূর্তি। এই পর্যন্ত তারা এসেছে। এবার আরও সোজা এগিয়ে ডান দিকে প্রথম রাস্তাটায়।
ওরা ডান দিকের প্রথম রাস্তা ধরে চলল। জল এখানে হাঁটুর কাছাকাছি। অল্পবয়সি কয়েকটা ছেলে গামছা দিয়ে রাস্তায় মাছ ধরছে। সামনে আলোর থামের পাশে লাল অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড দেখে ওরা দাঁড়াল। এবার এই বাড়ির গা দিয়ে যে কাঁচা রাস্তাটা গেছে তাই ধরে যেতে হবে। কিন্তু জলডোবা রাস্তাটা কাঁচা না পাকা বোঝা যাচ্ছে না।
দুজনে সেই রাস্তাটাই ধরল। বাড়িগুলো সবই ডান দিকে। বাঁ-দিকে থইথই জল। ডান দিকেও বাড়ির কিনার পর্যন্ত সাত-আট হাত জল। বোঝা যাচ্ছে না রাস্তাটা কতটা চওড়া। বোঝা যাচ্ছে না জলের নীচে ডাঙা না পুকুর না রাস্তার নালা কী রয়েছে!
ওরা থমকে দাঁড়াল, ঝিরঝির বৃষ্টি নেমেছে। দমকা হাওয়াও চলছে। ভূপতি ছাতা খুলতেই হাওয়ার ঝাপটায় হাত থেকে উড়ে যাবার উপক্রম হল। সে ছাতাটা বন্ধ করার চেষ্টা করেও পারছে না। বলাইয়ের মা হাত বাড়িয়ে দু-হাতে ছাতার বাঁট চেপে ধরল আর তখন খামটা হাত থেকে জলে পড়ল। তাড়াতাড়ি জল থেকে তুলে নিয়ে সেটা শেমিজের মধ্যে রেখে সে ছাতাটাকে আঁকড়ে ধরে বন্ধ করল। ভূপতির লাজুক চাহনিটা দেখেও দেখল না!
আবার ওরা এগোচ্ছে। পা টিপে, পা ঘষড়ে হুশিয়ার হয়ে। বাঁ-দিকে বাজার বসে কিন্তু এখন জায়গাটা দিঘির মতো। সেটার পর তিন-তলা বাড়ি। তারপর টালির চালের ঘর। কয়লার দোকান, কেরোসিনের উনুন সারাইয়ের দোকান, মুড়ির দোকান। সব বন্ধ। তারপর মুদির দোকান। একটা পাল্লা খুলে মুখ বার করে আছে একটা লোক, তারপরই এক-তলা বাড়িটা। বাইরের দালান লোহার সাদা জাল দিয়ে ঘেরা।
দালানে একজন মহিলা দড়িতে কাপড় মেলছে। ওরা দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বাড়িটাই? ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বৃষ্টি এখন টিপ টিপ পড়ছে। বলাইয়ের মা এগিয়ে গেল জালের দিকে। মহিলাটি এইসময় মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। যেন চেনা চেনা লাগছে তাঁর। জালের কাছে এগিয়ে এলেন।
তুমি কি নন্দার বাড়িতে কাজ কর?
বলাইয়ের মা-র মুখে স্বস্তির ছাপ পড়ল।
হ্যাঁ। এই চিঠিটা।
কে পাঠিয়েছে, না?
বলাইয়ের মা মাথা কাত করল।
শেমিজের মধ্য থেকে ভেজা খামটা বার করে ভাঁজ করে জালের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল। মুখ ফিরিয়ে ভূপতির দিকে তাকিয়ে মাথাটা হেলাল।
এ তো একেবারে ভিজে কালি লেপটে একশা হয়ে গেছে, একটা লাইনও তো পড়া যাচ্ছে না। তুমি জলে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো।
মহিলা দরজা খুলে দিলেন। বলাইয়ের মা ইতস্তত করে এক বার মুখ ফিরিয়ে ভূপতির দিকে তাকাল। ভূপতি ইশারা করল তাকে ভিতরে যাবার জন্য।
তোমার সঙ্গে এসেছে? ওকেও আসতে বলো, জলের মধ্যে কি দাঁড়িয়ে থাকা যায়?
জ্বর হয়েছে। বলাইয়ের মা কৃতজ্ঞ চাহনি দিয়ে দোষ স্বীকার করার মতো গলায় বলল। তারপর হাতছানি দিয়ে ভূপতিকে ডাকল।
চিঠিটা ভিজিয়ে ফেলেছ। কী লেখা আছে তা তো বুঝতে পারছি না। এই দুর্যোগে এতটা পথ ভেঙে পাঠিয়েছে যখন নিশ্চয় খুব দরকারিই কোনো ব্যাপার হবে!